নব্বই নট আউট – ঈশান মজুমদার

নব্বইয়ের দশক! নামটার মধ্যে কী এমন লুকিয়ে রয়েছে বলুন তো? মাদকতা? উন্মাদনা? একটা গোটা প্রজন্মের বেড়ে ওঠা? নাকি ‘পুরাতনের হৃদয় টুটে আপনি নূতন উঠবে ফুটে’র কাব্যময়তা? এই গোটা সময়টা জুড়ে বহু উত্থান পতন রোমাঞ্চের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে থেকে গেছে আমাদের দেশ। তবে মানুষের জীবনের অন্যতম রোম্যান্টিসিজমের অবস্থান কেমন ছিল এই সময়টায়? ওহ, বুঝতে পারলেন না? আমি বলছি খেলাধুলার জগৎটার কথা। আসলে নব্বইয়ের এই সময়টাকে ধরতে গেলে একটা আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি এবং তার সঙ্গে তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থার কথাও বুঝতে হবে। ঠিক কেমন ছিল সময়টা?

কাট –

১৯৮৯ সাল বার্লিনের প্রাচীর ভেঙে পড়ল। দুই জার্মানির সেই মিলনক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে সুনীল গাঙ্গুলী লিখেছিলেন ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ। ১৯৯১ সালে একদিকে সোভিয়েতের পতন ঘটলো। নাকি কমিউনিজমের পতন বলবো? বাঙালি তখন যেন সামান্য ঝিমিয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে নন্দনে ছবি অথবা আকাদেমিতে নাটক দেখতে ভিড় জমায়। কখনও কখনও মুখর হয়ে ওঠে খেলা নিয়ে। ঠিক এমন সময়ে বাংলার মাটিতে নতুন স্বর উঠে এল। চাঁদ ফুল জোছনার কথা ভুলে আধমাথা টাকা নিয়ে ভুঁড়িওয়ালা একটা লোক মঞ্চে উঠছেন। তারপর কোনো ভণিতা না করে গেয়ে উঠলেন – “মান্না পিকে চুনীর ছবি বিরাট সম্বল!” সুমনের আবির্ভাব বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাংলার গানের জগতে যখন নতুনের জোয়ার আসছে, তখন বাংলার খেলাধুলার অবস্থানটা ঠিক কোথায় ছিল? মান্না-পিকে-চুনীর ছবিই কি তাদের একমাত্র সম্বল হয়ে ভাগশেষের মতো পড়ে ছিল? আরও বড়ো করে যদি দেখতে চাই, তবে প্রশ্নটা হওয়া উচিত : ‘নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রের হালহকিকত’ কেমন ছিল? এমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা সেখানে ঘটেছিল যার কারণে আজ আড়াই দশক শেষে বিচারসভা বসিয়েছি?

মনে রাখতে হবে, বাংলার ফুটবলের শেষ আইকনিক শিল্পী কৃশানু দে তখন প্রায় অস্তাচলের পথে। ফিরে এসে একটা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আশির জাদু হারিয়ে গিয়েছিল চোটের পরে। তাহলে? এই তাহলের উত্তর দিতে আমরা আশ্রয় নেব একটা আট অক্ষরের মারাঠির ছায়ায় – শচীন তেন্ডুলকর।

শচীনের উত্থান ভারতীয় ক্রিকেটের রূপটাকেই বদলে দিয়েছিল। তার কারণ, ক্রিকেট যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে খুব লাভজনক মুক্তাঞ্চল তখনও ছিল না। শচীন এসে ভারতীয় ক্রিকেটকে বিপণনযোগ্য করে তুললেন। সেই সময়ের বহু সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, শচীন তেন্ডুলকর এমনই একটা নাম যা কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলতে পারে। বাবরি মসজিদ যে দশকে ধ্বংস হয়েছে; নরপিশাচদের উল্লাস শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে; এমন একটা সময় সারি সারি মানুষ উপচে পড়ছে একটি টিভির সামনে – শচীন তেন্ডুলকর ব্যাট করছেন! কোথায় হিন্দু, কোথায় মুসলমান, শচীন তেন্ডুলকর এক অখন্ড ভারতবর্ষ। এখন তাঁর টুইট নিয়ে যতই হইচই হোক না কেন, তাঁর গুরুত্ব সেই জানে যে বেঁচে নিয়ে তাঁর সময়ে।

ক্রিকেট নিয়ে কথার মাঝখানেই রাজনীতি এসে পড়লো। ঠিক যেমন রাজনীতির মাঝে এসে পড়েছিল ক্রিকেট। শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতার কথা মনে পড়ে গেলো –

“এ এমন সময় বাঁচার

যখন নেতারা চলে প্রকাশ্যেই হামা দিয়ে লুম্পেনের তর্জনীসংকেতে

এ এমন সময়, যখন

শুধুই চিৎকারশব্দে যে-কোনও আকাট মিথ্যে সুঘোষিত সত্য হয়ে ওঠে

এ এমন সময়, যখন

আইনের শাসনহীন গোটা দেশে একনায়কের ইচ্ছা একমাত্র আইন

এ এমন সময়, যখন

এ-পাড়ায় ও-পাড়ায় নিরপরাধের মাংসে ঘাতকেরা নিত্য করে হোম—

সেসব দেখেননি আপনি কবি

আপনি শুধু দেখেছেন উৎসবের সমারোহে উন্মুখর প্রসাধিত রোম!”

প্রসাধিত রোম দেখার কথা যখন উঠলোই তখন বলি, ক্রিকেটের উত্থান ভারতের বহু খেলার কবরে শেষ পেরেকটুকু পুঁতে দিয়েছিল। বিষয়টিকে অন্যভাবেও দেখা যায়। অন্যান্য খেলা যেন সামাল দিয়ে উঠতে পারলো না ক্রিকেটের সঙ্গে। কিন্তু কেন পারলো না? এর একটা প্রধান কারণ বাণিজ্যিকরণ। হকি, ফুটবল অথবা কুস্তির মতো খেলার যে আঙ্গিক, তাঁর সঙ্গে বিজ্ঞাপন খাপ খায় না। আমি জানি আপনারা প্রশ্ন করবেন, তাহলে বিশ্বমঞ্চে এই খেলাগুলি এত টাকার বন্যা বইয়ে দিচ্ছে কিভাবে? উত্তর হল, খেলার নিয়ামকদের দেখুন। ইটালিতে ফুটবলকে গিলে ফেলেছিল মাফিয়ারা। বিশ্বখ্যাত মারাদোনার সঙ্গেও মাফিয়াদের যোগ উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটেনে ধনকুবেররা আসতে শুরু করেন। যদিও নব্বই দশকে রোমান আব্রাহামোভিচ অথবা মধ্যপ্রাচ্যের শেখদের হাতে খেলাটা চলে যায়নি। কিন্তু সাইডলাইনের ধারের বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপনের ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল। বার্কলেসের মতো সংস্থা ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগকে স্পনসর করতে শুরু করলো। শুধু তাই নয়, অভিজাত কোম্পানিরা টেনিসের মঞ্চে চলে এলেন। একেকজন খেলোয়াড়কে একেকটি সংস্থা প্রায় কিনে নিল। যার ফলস্বরূপ একবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে রজার ফেডেরারের সঙ্গে রোলেক্সের মতো কোম্পানির অন্তরঙ্গতা তৈরি হল। অন্যদিকে, অ্যান্ডি রডিককে স্পনসর করতে শুরু করলো লাকোস্টে। অর্থাৎ ক্রীড়াকে পণ্য রূপে ব্যবহার করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল নব্বই দশক।

ভারতীয় ক্রিকেটে এই কাজটিই করে দেখিয়েছিলেন শচীন তেন্ডুলকর। একইসঙ্গে জগমোহন ডালমিয়ার কথাও অগ্রাহ্য করা যায় না। তবে নব্বইয়ের শুরুরদিকে তার প্রভাব আন্তর্জাতিক আঙিনায় সেভাবে ছিল না। ধনকুবের মার্ক মাসকারেনহাসের ওয়ার্ল্ড টেল যখন শচীনের সঙ্গে বিশাল অঙ্কের চুক্তি করে ফেললো, সম্পূর্ণ সমীকরণটাই বদলে গেল। জেন্টলম্যান’স গেম রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল ছিয়ান্নবইয়ের বিশ্বকাপের মধ্যে দিয়ে। ভারতীয় ক্রিকেটে ত্রিদেশীয় সিরিজ শুরু হল – ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা-কেনিয়া। সকলেই জানতো কেনিয়া কোনোদিনই কোনোদিনই বাকি দুই দেশের সঙ্গে পারবেনা। কিন্তু এই সিরিজগুলোর মধ্যে দিয়ে খেলাটার প্রসার ঘটতে লাগলো। সৌরভ গাঙ্গুলী উঠে এলেন বাঙালির নতুন আইকন হিসেবে।  একটা কথা এই ফাঁকে বলে নেওয়া দরকার, অনিল কুম্বলে কম বড়ো খেলোয়াড় ছিলেন না সেই সময়ে। কিন্তু ওয়ার্ল্ড টেল খুব স্পষ্টভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিল খেলোয়াড়ি মাপকাঠি নয়, জন এবং গণের মাঝখানে গ্রহণ্যযোগ্যতাই আসল কথা।

সাদা পোশাক ছেড়ে রঙিন পোশাক, আর রাতের আলোয় ক্রিকেট এসে গিয়েছিল বহুদিন আগেই। এবার বিজ্ঞাপন আসতে শুরু করলো একের পর এক। বিজ্ঞাপনদাতারা দেখলেন, ওভারের মাঝের বিরতিটুকু তাদের কথা বলার জন্য উপযুক্ত। ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে এল পণ্য, ক্রিকেটাররা লাখপতি থেকে কোটিপতি হতে শুরু করলেন। আপনাদের হয়তো মনে থাকবে, এমন বহু পণ্য প্রকাশ্যে আনা হত বিশ্বকাপের সময়ে। অর্থাৎ, ক্রিকেটের প্রতিযোগিতাগুলি বাজারের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। তবে আলো যখন থাকবে, অন্ধকারও তখন ছায়া ঘনাবে সেটাই স্বাভাবিক। মশালা ম্যাচ শুরু হল, মাফিয়ারা এসে পড়লেন ভদ্দরলোকের খেলায়! দাউদের আস্তানা থেকে কয়েকটা ফোন বদলে দিতে লাগলো ম্যাচের রেজাল্ট। মধ্যপ্রাচ্যে মূলত শারজায় শুধু হল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। একই সঙ্গে শুরু হল গড়াপেটা – মুকেশের নামটা মনে পড়ছে? আমাদের অবশ্য ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি; ভুলে গেলাম অতি সহজেই। আবারও একটা ছয়, আবারও হই হই করে উঠলো দর্শক! তবে সে এমন সময় ছিল, যখন পথ চলতি লোকে চেঁচিয়ে উঠতো,

– দাদা কত স্কোর?

– ভারত তিরিশে দুই, আড়াইশো করতে হবে।

– শচীন আছে?

এই ‘শচীন আছে’র উত্তর অনেক মানুষকে পরের বাক্য বলার সুযোগ করে দিত। শচীন আউট হলেই টিভি বন্ধ! আবার শচীন আউট হলেই বেটিং শুরু!

এবার একটু অন্যদিকে তাকানো যাক – বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়ামঞ্চ – অলিম্পিক। ১৯৫২ সালে কেডি যাদবের কুস্তিতে পদক পাওয়ার পরে, ব্যক্তিগত পদক আমাদের কপালে আর জোটেনি। তবে চুয়াল্লিশ বছর বাদে ১৯৯৬ সালে আটলান্টা অলিম্পিকে টেনিসে ব্রোঞ্জ পেলেন লিয়েন্ডার পেজ। লিয়েন্ডার মহেশ জুটি বাঁধলেন তার কিছু বছরের মধ্যেই এবং গ্র্যান্ডস্ল্যামও জিতে ফিরলেন। ব্যাডমিন্টনের জগতে উঠে আসছিলেন পুলেল্লা গোপীচাঁদ। ১৯৯৮ সালের কমনওয়েলথে দলগত বিভাগে রূপো এবং ব্যক্তিগত বিভাগে ব্রোঞ্জ জিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি থাকতে এসেছেন। ফুটবলে শুরু হয়েছিল জাতীয় লীগ। প্রথমবারেই জেসিটি চ্যাম্পিয়ন হয়ে তাক লাগিয়ে দিল সকলকে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানও অবশ্য পালটা জবাব দিল পরের কয়েকবছরের মধ্যেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে। বাঙালি খেলোয়াড়দের মধ্যে উঠে আসছিলেন দীপেন্দু বিশ্বাস, অসীম বিশ্বাস, দেবজিত ঘোষরা। ভারতীয় ফুটবলের রঙিন ফানুসটা তখন বিশ্বকাপের মঞ্চে উত্তরণের স্বপ্ন দেখছে। সে স্বপ্ন অবশ্য পরের সাতাশ বছরেও সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু নব্বই দশকেই উঠে এসেছিলেন ভারতীয় ফুটবলের আইকন বাইচুং ভুটিয়া। সিকিমের এক ছোট্ট গ্রাম তিংকিতাম থেকে তাঁর স্বপ্নের দৌড়টা অনেক নাম না জানা প্রান্তের প্রতিভাবানদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল। নব্বইয়ের শেষদিকেই বিদেশে খেলার জন্য পাড়ি দেন বাইচুং। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব বারি এফসি তখন এতই মত্ত ছিল তাঁকে নিয়ে যে, তাঁর ও ক্লাবের নামানুসারে বারিয়ানি রেঁধে নামকরণ করেছিল – ‘বাইচুং বিরিয়ানি’!

আমরা যারা সেই সময় বড়ো হয়েছি, তারা সকলেই বাইচুং হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম মনে মনে। শুধু কি বাইচুং, ডগলাস গ্রাউন্ডে দৌড়লে সৌরভ হওয়া যায় অথবা শিবাজি পার্কে আরেকজনের শচীনের খোঁজে কে না মাতেনি সেই সময়? কিন্তু এই সবকিছুর মাঝে ক্রিকেট যেন গিলে ফেলছিল বাকি খেলাগুলোকে। ফুটবল খেলে যে টাকা পাওয়া যেত তার কয়েকগুণ টাকা ক্রিকেট থেকে আয় করতে শুরু করেন খেলোয়াড়রা। হাওয়া ফুরিয়ে যাওয়া ফুটবলে শেষ লাথিটা হয়তো মেরেই দিয়েছিল বাঙালি যুবসমাজ। শচীনের ব্যাটে এম আর এফ-এর লোগো আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাজারে নকল এম আর এফ ব্যাট চলে এলো। দোকানে দোকানে ভরে উঠলো ক্রিকেট প্যাক। বিস্কুটের স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষে ক্রিকেটারের সান্নিধ্য পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেল দেশের কোটি কোটি মানুষ। তারই মাঝে, বাংলার ফুটবল ১৯৯৭ সালের ফেড কাপ সেমিফাইনালে একটা বিস্ফোরণ দেখছিল! এক লাখ একত্রিশ হাজার দর্শকের সামনে বাইচুং ভুটিয়ার হ্যাটট্রিকের দৌলতে মোহনবাগানকে ৪-১ গোলে হারিয়ে দিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল। পিকে বনাম অমল দত্তের শেষ মনে রাখার মতো স্মৃতি। নব্বই দশকের শুরুর দিনগুলি যদি মারাদোনার প্রত্যাবর্তন নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে থাকে, তবে শেষের দিনগুলি ছিল রোনাল্ডো-জিদানের মৌতাতে ভরপুর। একশো চৌত্রিশ নম্বরে থাকা দেশে পাড়ায় পাড়ায় বিভাজন হয়ে যেত অন্য দেশের খেলা নিয়ে। কিন্তু বন্ধের দিনেও বল ভেবে বোমায় হাত দিল ছোটো ছেলেরা ক্রিকেট খেলার মাঝে। ছিন্নভিন্ন লাশের মাঝে বেঁচে থাকলো শুধুমাত্র ক্রিকেট।

জাতীয় টেবিল টেনিসের যুব পর্যায়ে জিতে টেবিল টেনিসে উঠে আসছিলেন মৌমা দাস এবং পৌলমী ঘটক। ভারতীয় হকির ডুবন্ত তরীকে একা ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন ধনরাজ পিল্লাই। স্প্রিটিংয়ে ১৯৯৮ সালের এশিয়ান গেমসে তাক লাগিয়ে দিলেন জ্যোতির্ময়ী শিকদার, ৮০০ এবং ১৫০০ মিটারে সোনা জিতে। নব্বইয়ের শেষভাগে ব্যাঙ্গালোর ফেডারেশন কাপে অঞ্জু ববি জর্জ জাতীয় রেকর্ড গড়লেন লং জাম্পে। যুব পর্যায়ে দুর্দান্ত প্রদর্শনীর দাপটে অ্যাথলেটিক্সে উঠে আসছিলেন সোমা বিশ্বাস। কিন্তু আজ যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি সোমা বিশ্বাসের সেরা পারফরম্যান্স কোথায় বলতে পারেন? আপনি মাথাও চুলকোবেন না, ঔৎসুক্যও দেখাবেন না। শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলবেন, “পরে গুগল করে নেবো।”

এখন সবকিছুর পরে একটা প্রশ্নই পরে থাকে – ক্রিকেট পেরেছে, বাকিরা পারেনি কেনো? তার একটা উত্তর হয়তো মিডিয়ার উত্থানের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। যেকোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা মিডিয়ার মাধ্যমে জনমানসে আঘাত করে। খেলার জন্য সেই সময়ে বরাদ্দ থাকতো পাঁচ মিনিট। তার মধ্যে তিন মিনিট ক্রিকেট নিয়ে কথা বলা হত। বহু মিডিয়ার স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বরা ক্রমাগত ক্রিকেট নিয়ে লিখে লিখে খেলাটাকে ভাসিয়ে রাখছিলেন মানুষের মনে। মাঝে মাঝে চিৎকার উঠতো, দশটা দেশের খেলা আবার খেলা নাকি? কিন্তু ভেবে দেখুন, বাকি দেশে খেলাটির প্রসারে আন্তর্জাতিক নিয়ামক সংস্থাগুলি সেভাবে গুরুত্বই দেয়নি। কেন? মালেশিয়া, চীন, রাশিয়া অথবা আমেরিকার মতো দেশে ক্রিকেটের প্রসার ঘটেনি কেন? ফুটবল বিশ্বকাপ তো আয়োজিত হয়েছিল আমেরিকাতে যখন তাদের ফুটবল নিয়ে প্রায় ধারণাই ছিল না (রেফারেন্স – ১৯৯৪ বিশ্বকাপের তথ্যচিত্র)। একই বিষয় ক্রিকেট নিয়ে হল না কেন? আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থার নীতিগুলি স্টাডি করলে একটা বিষয় মনে হয় বারবার, ক্রিকেটকে একটা ব্যবসায়িক পণ্যরূপে গড়ে তুলতে চেয়েছিল সংস্থাগুলি। টেস্ট ক্রিকেটের সংখ্যা কমিয়ে ক্রমাগত ওয়ান ডে সিরিজের দশক হল নব্বই দশক। খেলাটি বিস্তৃত হয়ে হাতের বাইরে চলে এটি তারা চাননি। দুহাজার সালে বাংলাদেশ টেস্ট খেলার ন্যুনতম যোগ্য না থাকা সত্ত্বেও স্টেটাস পেয়ে যায়। কেন? ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ার কারণে তো বটেই, খেলার প্রসারের ক্ষেত্রেও একটা বিরাট বড়ো পদক্ষেপ ছিল। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যুগের হাওয়া বইয়ে দেওয়ার সবচেয়ে বড়ো আক্ষেপের জায়গা এটাই হয়ে রইলো যে গত কুড়ি বছরে বাংলাদেশ টেস্ট খেলায় আদৌ তেমন দাগ কাটতে পারলো না এবং একই সঙ্গে ফুটবল ও অন্যান্য খেলার প্রায় অপমৃত্যু ঘটলো দেশটিতে।

তাই এতকিছু সত্ত্বেও নব্বইয়ের দশকের সবচেয়ে বড়ো আক্ষেপের জায়গা ছোটো খেলাগুলির হারিয়ে যাওয়া। ইডেনের মতো মাঠ বাংলায় ফুটবল নব্বই দশকে পেলোই না সেভাবে। যুবভারতীর রক্ষণাবেক্ষণের হাড়ির হাল, বহু খেলোয়াড়ের জীবন শেষ করে দিয়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক টানাপোড়েনে খেলোয়াড়দের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে বহুক্ষেত্রে। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বহু আকাদেমি। কিছুক্ষেত্রে শুধুমাত্র শিলান্যাসই হয়েছিল, বল আর গড়ায়নি। কাবাডি, খো খো ভুলে ক্রিকেট ব্যাট হাতে তুলে নেওয়ার দশক ছিল নব্বই। লিবারেলাইজেশন গ্লোবালাইজেশন প্রাইভেটিজেশনের যুগে খেলার জগতেও কর্পোরেটদের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাহলে কেন মনে রাখবো এমন সময়কে? শুধুমাত্র এই কারণেই যে অনেকগুলো ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল নব্বইয়ের দশক। কার্গিল যুদ্ধের দামামার আশেপাশেই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ; অথবা, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দ্বৈরথ; এই একটা দশক মানুষকে অনেককিছু দিয়েছিল। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল। ভারতে ১৯৯৬ বিশ্বকাপের উদ্বোধন ঘটে লেজার শো দিয়ে। ‘টেলিভিশনের ছাতা’ আর ‘সান্ধ্য সিরিয়ালের মোহ’ পিষে ফেলতে শুরু করেছিল কলকাতাসহ গোটা ভারতকে। অলিম্পিককে গুরুত্ব না দেওয়ারই দশকও নব্বই। অলিম্পিকে কোনওরকম পরিকল্পনা ছাড়া বিপুল অংশগ্রহণকারীর দল নিয়ে গিয়ে জঘন্যভাবে পরাজিত হওয়া এবং ক্রমাগত অজুহাত দেওয়ার দশকও ছিল নব্বই।

সত্যিই হয়তো অনেককিছু ছিল না, হয়তো অনেককিছু পাওয়া হয়নি। তবে এই না পাওয়ার মাঝে সবকিছু ছাপিয়ে একটা কথাই মনে হয় এখন দাঁড়িয়ে। হয়তো অনেক বছর পরে আমাদের চুলেও পাক ধরবে। ঝুঁকতে অসুবিধা হবে অথবা ঝুঁকে যাবো চিরতরে। তখন যদি কফি নিয়ে বসে দূর দিগন্তে অস্তমিত সূর্যের দিকে চেয়ে থাকি, মনের মধ্যে যেন ওয়েডনেসডে ছবির শেষ দৃশ্যের কথাগুলোই মূর্ত হয়ে ওঠে প্রতি মুহূর্তে –

পর জো ভি থা, আচ্ছা থা………

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী 

*****