বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ – ড. সাজিদ হোসেন

সূচী
ভূমিকা

           ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতিসত্তা ধ্বংস করে ‘অনুগত পাকি-বাঙালী’ সংকর জাতিধারা প্রবর্তনের লক্ষ্যে তত্কালীন পাকিস্তানের জেনারেল আগা মহম্মদ ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে পরিচালিত হয়েছিল এক পরিকল্পিত গণধর্ষণ। সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এথনিক ক্লিন্সিং এর লক্ষ্যে  যুদ্ধকালীন জেনোসাইডের পাশাপাশি সংঘটিত হয়েছে ‘পরিকল্পিত গণধর্ষণ’। ধর্ষণও হয়ে উঠেছে যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে নারীর শরীর পর্যন্ত। তার ফলস্বরূপ জন্ম নিয়েছে যুদ্ধশিশু। সারাবিশ্বে বেঁচে থাকা যুদ্ধশিশুর সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ! বর্তমানে এই বিষয়টি নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেকেই গবেষণারত।

       মুক্তিযুদ্ধকালের সাড়ে নয় মাসে আড়াই থেকে চার লক্ষ, আবালবৃদ্ধবনিতা ধর্ষিত হয়েছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দালাল জামাত-রাজাকার গোষ্ঠির হাতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেসব নারীকে যুদ্ধশেষে ‘বীরাঙ্গনা’ বলে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। ধানমন্ডির নিজ বাড়ির ‘ঠিকানা’ দিয়েছিলেন সবাইকে। তখন সদ্যসমাপ্ত যুদ্ধের ধকল কাটিয়ে ওঠায় ব্যস্ত নতুন দেশের নতুন সরকার ও সাধারণ জনগণ। দেশ পুনর্গঠনে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবকিছু আপাতদৃষ্টিতে ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠতে থাকলেও, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এক কালো অধ্যায়ের ফসল হিসেবে বীরাঙ্গনাদের গর্ভে আবির্ভূত হতে শুরু করে তথাকথিত ‘অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু’ – (তথ্যমতে) প্রায় ২৫ হাজার যুদ্ধশিশু।

       কিন্তু, কি হয়েছে তাদের? কোথায় তারা? এদেশে জন্ম হলেও ওইসব অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষীদেরকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। কারণ, ওইসব ‘দূষিত রক্তবাহী’ শিশুদেরকে বরণ করে নেওয়ার মতো মানসিক উদারতা, প্রসারিত হৃদয় বা সাহস কোনোটাই ছিলনা বাংলাদেশের। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও ডেনমার্কে দত্তকায়ন করা হয় সেসব যুদ্ধশিশুদের। তারা বাংলাদেশের জাতীয়গাথায় বিস্মৃত!

জাতিসত্তা প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা

                   মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন ছিলেন ইয়াহিয়া খান। তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত পরিকল্পনা ছিল ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট। এর ফলে এক কোটি সাধারণ মানুষকে ভারতে পালিয়ে  যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাদের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু। মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে আরো এক কোটি বাঙালীকে বিতাড়ন করা এবং ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করতে পারার সামর্থ্যে ওই সংখ্যাকে এক কোটিতে বৃদ্ধি করাটাও সম্ভব ছিল। এই হিসেবে একাত্তর সালের সাত কোটি বাঙালীর মধ্যে বাকি থাকতো আর চার কোটি। ত্রিশ লক্ষ শহীদের অধিকাংশ পুরুষ হওয়ার কারণে তখনো বেঁচে থাকা চার কোটির মধ্যে তিন কোটি নারী বলে ধারণা করা যুক্তিযুক্ত। এই তিন কোটি নারীকে ক্রমাগত ধর্ষণ করে গর্ভবতী করার ফলে জন্ম নিত বাঙালী শিশুর পরিবর্তে ‘পাকি-বাঙালী’ সংকর শিশু। সূচিত হতো নতুন জাতিসত্তা, ক্রমশ বিলীন হয়ে যেত বাঙালী জাতিসত্তা! এই ছিল মহা-পরিকল্পনা। তবে এই ভয়াবহ পরিকল্পনার সম্পূর্ণ রূপায়নের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের অকুতোভয় মুক্তিবাহিনী।

যুদ্ধশিশু কারা ?

        যুদ্ধশিশু বলতে সাধারণত বিদেশী আগ্রাসী বা হানাদার সামরিক সদস্যের ঔরসে এবং স্থানীয় মায়ের গর্ভজাত শিশুকে বোঝানো হয়ে থাকে। দখলদার সৈন্যদের সহযোগীদের (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জামাত-রাজাকার বা দালাল চক্র) মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুদেরকেও নির্দেশিত করে এই শব্দ। দেশে দেশে আগ্রাসী আক্রমণের সময়ে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত পরিকল্পিত যৌন-সন্ত্রাসে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য যুদ্ধশিশু। পারস্পরিক সম্পর্কহীন এবং পারিবারিক বন্ধনহীন পরিবেশে ইচ্ছার বিরুদ্ধে (‘স্লিপিং উইথ দ্য এনিমি’) জন্ম হয় এই নতুন এক সংকর প্রজাতির শিশুর – যার নামকরণ হয় যুদ্ধশিশু।

আলাপচারিতাঃ দেলোয়ারা বেগম

         মুক্তিযুদ্ধের পরপরই সারাদেশে গঠিত হয় নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র। পাবনা শহরের উত্তর উপকণ্ঠে নূরপুরের ডাকবাংলা ভবনে স্থাপিত হয়েছিল পাবনা নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং কেন্দ্রের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বীরাঙ্গনাদের জন্য সেবাসদন এবং যুদ্ধশিশুদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র। লোকমুখে সেই সেবাসদনই পরিচিত হয়ে ওঠে ‘বীরাঙ্গনা হাসপাতাল’ নামে। ওই বীরাঙ্গনা হাসপাতালের নার্স হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন দেলোয়ারা বেগম। বর্তমানে, এক মেয়ে আর এক পঙ্গু ছেলেকে নিয়ে, অবসর জীবন যাপন করছেন বিধবা দেলোয়ারা (স্বামী: মরহুম আমজাদ হোসেন)।

আমার মা (বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপিকা জান্নাতুল ফেরদৌস, সাবেক এমপি এবং পাবনার নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের একজন প্রতিষ্ঠাতা-উদ্যোগী) এবং ওই কেন্দ্রের কর্মকর্তা কানিজ রসুল প্যান্সি আপার কাছ থেকে জানতে পারি সেই দেলোয়ারা বেগমের কথা। ২০০৮ সালের ১৩ই এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে নিজ জেলা শহর পাবনায় গেলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। আমাদের বাড়ি নির্ঝরে পৌঁছে দেখি যে প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই আমার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি! সঙ্গে পুনর্বাসন কেন্দ্রের সহকর্মী নির্মল বসাক (পিতা মৃত নন্দগোপাল বসাক)। ড্রইং রুমে বসেই কথা হল তাঁর সঙ্গে। সেই সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আমার মা। সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত চলল সেই আলাপচারিতা। 

দেলোয়ারা বেগম

পাবনার বীরাঙ্গনা হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭২ সালের জানুয়ারী থেকে। পাবনার পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের একজন চিকিৎসক (নাম মনে করতে পারেননি দেলোয়ারা) এবং দেলোয়ারার ওপরে দায়িত্ব বর্তায় হাসপাতালের সেবা সম্পর্কিত তথ্য বীরাঙ্গনাদের পরিবারের কাছে পৌঁছনোর। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার অবর্তমানে, কাজটি ছিল অত্যন্ত দুরূহ। দুজনে মিলে শহর, শহরের উপকণ্ঠ এবং শহর থেকে দূর-দূরান্তে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সম্ভাব্য বীরাঙ্গনাদের কাছে সেবা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানানোর কাজ শুরু করেন। তাদের ওই আহ্বান এবং লোকমুখে সংবাদ পেয়ে ৭২ সালের জানুয়ারী থেকেই প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণের জন্য বীরাঙ্গনা হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকে ধর্ষিতা ও অন্তঃসত্ত্বা বীরাঙ্গনা নারীরা।   

এসময়ে ওই বীরাঙ্গনা হাসপাতালে আসেন একজন বিদেশী চিকিৎসক। ড. জিওফ্রে ডেভিস। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি নিবাসী একজন মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট ড. জিওফ্রে ডেভিস ১৯৭২ সালে বীরাঙ্গনাদের সেবা প্রদানের জন্য বাংলাদেশে এসে ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশন (IPFF), ইউনাইটেড নেশনস ফান্ড ফর পপুলেশন অ্যাকটিভিটিজ (ইউএনএফপিএ – বর্তমানে ইউএনপিএফ বা ইউনাইটেড ন্যাশনস পপুলেশন ফান্ড) এবং ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের অধীনে প্রায় ছয় মাস কাজ করেছিলেন। ওই চিকিৎসকই সন্তান-জন্ম এবং গর্ভপাত সম্পর্কিত কলাকৌশল প্রশিক্ষণ দেন দেলোয়ারাকে। সযত্নে নিপুণ হাতে দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন দেলোয়ারা। ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাস থেকেই দেলোয়ারার হাতে নিরাপদে যুদ্ধশিশুদের জন্ম হতে শুরু করে। বীরাঙ্গনারা হয়ে ওঠে মা-বীরাঙ্গনা।

জিওফ্রে ডেভিস, বাংলাদেশ ১৯৭২

নূরপুরের ডাকবাংলোটির একটি অংশে স্থাপিত হয়েছিল বীরাঙ্গনা হাসপাতাল। তার একটি কক্ষে থাকতো বীরাঙ্গনারা। পাশের কক্ষে স্থাপন করা হয়েছিল যুদ্ধশিশুদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র। জন্মের পরে প্রাথমিকভাবে আশ্রয়কেন্দ্রের দোলনায় রাখা হতো যুদ্ধশিশুদেরকে। এই আশ্রয়কেন্দ্রে ৪-৫ জন মা-বীরাঙ্গনা থাকতো পরিচয় গোপন করে; সম্ভবত বাচ্চাদের কাছাকাছি থাকার আগ্রহে!

নূরপুরের জেলা পরিষদ ডাকবাংলো – পূর্বে এটিই ছিল পাবনার বীরঙ্গনা হাসপাতাল

কতজন বীরাঙ্গনা ভর্তি হয়েছিল ওই হাসপাতালে? তাদের বয়স কত ছিল? কতজন শিশুর জন্ম হয়েছিল? কেউ গর্ভপাত করেছিলেন কি? আমার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে দেলোয়ারার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে থাকলাম গভীর আগ্রহে। 

জন্মের পরে শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রের দোলনায় কয়েকদিন রাখার পরে নির্দেশমতো ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সে দায়িত্বও সঠিকভাবে পালন করেন দেলোয়ারা বেগম। শুরু হয় পাবনা থেকে ঢাকা হয়ে বিদেশে যুদ্ধশিশুদেরকে প্রেরণের কার্যক্রম। প্রথম দলে ছিল ৭টি বাচ্চা। জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থায় হেলিকপ্টারে করে ওই যুদ্ধশিশুদের নিয়ে ঢাকায় যান দেলোয়ারা। সব বাচ্চাকেই হস্তান্তর করেন পুরনো ঢাকার ইসলামপুর মিশন হাসপাতালে (মাদার টেরেসা কর্তৃক ১৯৭১ সালের ২১শে জানুয়ারীতে স্থাপিত দি মিশনারিজ অব চ্যারিটির একটা শাখা)। সেখানে বাচ্চাদের রাখার ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নতমানের। এরপরে সড়কপথে ফিরে আসেন দেলোয়ারা। প্রায় তিন মাস পরে আবার ৫০টি যুদ্ধশিশুকে নিয়ে ঢাকায় যান দেলোয়ারা বেগম। এবারে হেলিকপ্টার না হলেও একটি বাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সেসময়ের জেলা প্রশাসক জনাব সাইদুর রহমান। আরো কয়েক মাস পরে পাবনা থেকে প্রেরণ করা যুদ্ধশিশুদের শেষ দলটিকে নিয়ে একইভাবে ঢাকায় যান দেলোয়ারা। কিন্তু বিদেশে বা কোন্ দেশে বাচ্চাদেরকে পাঠানো হয়েছে সেসম্পর্কে কিছুই জানেননা দেলোয়ারা। 

প্রশ্ন করলাম, বীরাঙ্গনা মায়েরা তাদের বাচ্চাদেরকে দিয়ে দেওয়া অর্থাৎ ঢাকায় বা বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার সময়ে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি? উত্তর দিল, না, সেরকম কেউই করেনি। এমনকি পাশের ঘরে থেকেও দোলনায় থাকা নিজ নিজ বাচ্চাকে দেখতেও আসত না। কারণ তাদের কাছে বাচ্চারা ছিল দুর্ঘটনার ফসল এবং বিশেষত পাকিস্তানী ঔরসজাত। দেলোয়ারা বলেন যে মূলত এজন্যই বাচ্চাদের জন্য তাদের কোনো মায়া জন্মায়নি।

আলাপের মাঝে কিছু ব্যতিক্রমী তথ্যও জানালেন তিনি। কোনো কোনো মা-বীরাঙ্গনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অগোচরে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, অতিরিক্ত ওষুধ খাইয়ে মেরে ফেলেছিল নিজ নিজ বাচ্চাকে। আবার অন্যদিকে কয়েকজন মা-বীরাঙ্গনা নিজ নিজ বাচ্চা নিয়ে পালিয়েও গেছে।

শুধু জন্মদানের ব্যবস্থাই নয়, সেইসঙ্গে সমাজে বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনেও এগিয়ে আসে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র। তবে প্রথমেই তাদের বিয়ের ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয় তারা। বীরাঙ্গনা নারীদেরকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে নিলে, সম্ভাব্য স্বামীদের অর্থ-সাহায্যের মাধ্যমে উৎসাহ দিতে শুরু করে পুনর্বাসন কেন্দ্র। যুদ্ধবিদ্ধস্ত পরিবেশে ওই অর্থ সাহায্যের বিষয়টি ছিল খুবই উপযোগী এবং প্রয়োজনীয়। বীরাঙ্গনাদের বিয়ে করার জন্য অনেক পুরুষই আবেদনপত্র জমা দিয়েছিল। দেলোয়ারা বেগম যতটুকু মনে করতে পারেন – ওই বীরাঙ্গনা হাসপাতালেই কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ৫০/৬০ জন বীরাঙ্গনা নারীর বিবাহপ্রদান সম্ভব হয়েছিল।

এ পর্যায়ে প্রশ্ন করলাম, কেউ কি কোনো বাচ্চাকে দত্তক হিসেবে নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিল? দেলোয়ারা জানালেন, মীরা রানি নামের পাবনা মানসিক হাসপাতালের একজন সিস্টার একটি মেয়ে যুদ্ধশিশুকে দত্তক নিয়েছিল।

যে সমস্ত বীরাঙ্গনার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কোনোকিছু জানেন কি? দেলোয়ারা উত্তর দিলেন, ১৯৭৩ সালে এতিমখানার তত্ত্বাবধায়ক জনাব আবদুস সাত্তার জেবুন্নেসা নামের এক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে করেছিলেন। পরে ওই সুপার সাহেব পদোন্নতি পেয়ে সমাজকল্যাণ কর্মকর্তাও হয়েছিলেন। তবে বর্তমান অবস্থানটি অজ্ঞাত।

কতদিন ধরে চলেছিল ওই বীরাঙ্গনা হাসপাতাল? উত্তরে বলেন, ১৯৭২ সালের শেষের দিকেই বীরাঙ্গনা হাসপাতালের কাজকর্ম শেষ হয়ে যায়। তবে সেখানে সেবা সদনে পাবনা নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের উদ্যোগে সেখানে আশ্রয় নেওয়া বীরাঙ্গনা নারীদেরকে বিভিন্ন ধরনের কুটিরশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর কিছু বছর পরে তাদের স্বোপার্জনের পরামর্শ দিয়ে সেইস্থান থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

পঁচাত্তর বছরের বয়োবৃদ্ধা দেলোয়ারার মুখে সবসময় লেগে আছে এক তৃপ্তিময় হাসি। কেন এত সুখী সে? প্রশ্ন করতেই আরো হাসিতে মুখ ভরিয়ে সপ্রতিভ উত্তর, ‘আমি তো বীরাঙ্গনা সেবিকা! আমার আবার দুঃখ কি! এই নামে কেউ ডাকলে খুব ভাল লাগে।’ প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত দেলোয়ারার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশভঙ্গি একেবারেই সহজ-সরল। মুক্তিযুদ্ধের একজন নারী মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে কম নয় দেলোয়ারা বেগমের অবদান।

মাদার টেরেসার অবদান

  যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের সাহায্যপ্রদানে ছুটে এসেছিলেন বিশ্বনন্দিত মাদার টেরেসা (২৭শে আগস্ট ১৯১০-৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৭)। আলবেনীয় বংশোদ্ভূত এই মহীয়সী নারী ছিলেন একজন ক্যাথলিক নান। সারাটা জীবন কাটিয়েছেন ভারতের কলকাতায়। নিজেকে উৎসর্গ করেছেন মানবসেবায়। নিজের প্রতিষ্ঠিত আশ্রমের মাধ্যমে আশ্রয় প্রদান করেছেন অসহায় মানুষকে। মুক্তিযুদ্ধের অনতিকাল পরেই (সম্ভবত ১৯৭২ সালের মে-জুন মাসে) ঢাকায় এসে পাঁচটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে চালু করেন বীরাঙ্গনাদের আশ্রয়কেন্দ্র। সারাজীবন গর্ভপাতের বিরুদ্ধে দৃঢ় ও সোচ্চার কণ্ঠ হিসেবে বাংলাদেশের গর্ভবতী হয়ে পড়া বীরাঙ্গনাদেরকে নিজ নিজ সন্তান (যুদ্ধশিশু) জন্ম দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন মাদার টেরেসা। সকল যুদ্ধশিশুদের আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। অসম প্রয়াসে রক্ষাও করেছিলেন সে প্রতিশ্রুতি। ১৯৭৯ সালে বিশ্ব দিয়েছে নোবেল পুরষ্কার এবং ১৯৮০ সালে ভারত তাঁকে দিয়েছে দেশের শীর্ষ-উপাধি ‘ভারতরত্ন’। ১৯৯৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  প্রদান করেছে সম্মানীয় নাগরিকের মর্যাদা। 

অন্যান্য দেশের যুদ্ধশিশু

                            যেসব শিশুদের পিতা মাতার ন্যূনতম একজন দখলদার সেনাবাহিনীর সদস্য বা যাদের পিতা মাতারা শত্রু সৈন্যের সহযোগী, তারা তাদের সংশ্লিষ্ট পিতা মাতাদের যে কোনো রকমের যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে মুক্ত। তবুও এসব শিশুদেরকে পরবর্তীকালে প্রকাশিত হওয়া তাদের পিতা মাতাদের অপরাধের কারণে নিজেদেরও অপরাধী মনে করতে হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জন্ম নেওয়া শিশুরা এরকম এক উদাহরণ। এসব শিশুরা দাবী করেছে যে, যখন তারা তাদের পরিচয় সরকারিভাবে প্রকাশ করেছে, তখন তাদের একপ্রকার আন্তঃনির্বাসিত (নিজ দেশে পরবাসী) হয়ে বসবাস করতে হয়েছে। ১৯৮৮ সালে ‘বর্ন গিল্টি’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়। সেখানে উল্লেখিত আছে ১২ জন যুদ্ধশিশুর সাক্ষাৎকার যাদের পিতা বা মাতা নরওয়েতে জার্মান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। তবে ওই ১২ জনের মধ্যের ১টি মেয়ে বেন্তে অস্বীকার করে বইয়ে উল্লেখিত তার ‘পরিচয়হীনতা’। এরপরে প্রথম কোনো নাৎসি শিশুর (নাৎসি সৈন্যের ঔরসে) আত্মজীবনী প্রকাশিত হয় নরওয়েতে। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ও আইসটাইন ইজেন রচিত বইটির নাম ‘দি বয় ফ্রম গিমলে’।

আমেরাশিয়ান: এশীয় এবং এশিয়ায় হানাদার মার্কিন সেনাদের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে প্রায় ১ লক্ষ যুদ্ধশিশু। এসব শিশুর বেশিরভাগই জন্ম নিয়েছে প্রধানত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরীয় যুদ্ধ এবং ভিয়েতনামের যুদ্ধে। আবার এসব ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মার্কিন ঘাঁটিতে, যুদ্ধকালে নয় বরং, ‘শান্ত-স্বাভাবিক সময়ে’। এসব শিশুকেই কথাশিল্পী পার্ল এস বাক অভিহিত করেছেন আমেরাশিয়ান হিসেবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধশিশু: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধশিশুরা সংখ্যায় ছিল প্রায় কয়েক লক্ষের কোঠায়। জন্ম হয়েছিল জার্মান এবং মিত্র বাহিনীর সেনাদের মাধ্যমে। সবচেয়ে পরিচিত দলটি হল নরওয়েজীয় যুদ্ধশিশু; কারণ এদের বেশিরভাগই জার্মান কর্তৃক লেবেন্সবর্ন প্রোগ্রামের আওতায় নিবন্ধিত হয়েছিল। এসব তথ্যও মোটামুটিভাবে অক্ষত রয়েছে। জার্মান লেবেন্সবর্ন শব্দের অর্থ ‘জীবনের ঝরণা’। এটা ছিল একটা নাৎসি সংস্থা। অ্যাডলফ হিটলার এবং নাৎসি বাহিনীর অধীনে একটা বড় আকারের নাৎসি সামরিক সংস্থা ‘এসএস বা শুজস্ট্যাফেল অর্থাৎ প্রোটেকটিভ স্কোয়াড্রনের নেতা হাইনরিখ হিমলারের উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় । এসএস সদস্যদের স্ত্রী এবং অবিবাহিত মায়েদের মাতৃকালীন আশ্রয় এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করে লেবেন্সবর্ন। শিশুদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করে এরা। ১৯৩৫ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এর কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিম এবং উত্তর ইউরোপে।

নরওয়েতে জার্মান সেনাদের সন্তান: ১৯৪০ সালে জার্মান সৈন্যরা আক্রমণ করে নরওয়ে। দেশটি দখল করে রাখে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে সেখানে জার্মান সৈন্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭২ হাজারে। নিরূপিত হয়েছে যে অধিকৃত সময়ে জার্মান পিতা এবং নরওয়েজীয় মায়ের মাধ্যমে ১০ থেকে ১২ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছে। এছাড়াও, কয়েক হাজার নরওয়েজীয় জার্মান সেনাদের সাহায্য বা দালালি করেছে। নাৎসি মতবাদ অনুসারে নরওয়েজীয়দেরকে বিবেচনা করা হতো খাঁটি আর্য হিসেবে। জার্মান কর্তৃপক্ষ তাদের সেনাদের জন্য নরওয়েজীয় মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। পূর্ব ইউরোপের মতো অন্যান্য দখলকৃত এলাকায় এ ধরনের সম্পর্ক নিষিদ্ধ ছিল কারণ নাৎসি দৃষ্টিভঙ্গিতে স্লাভরা নীচু জাতের!

ডেনমার্কে জার্মান সেনাদের যুদ্ধশিশু: ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ডেনমার্ক দখল করে রেখেছিল জার্মানি। জার্মান সেনাদের জন্য ড্যানিশ মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করার অনুমতি ছিল। নিরূপিত হয়েছে যে, দখলকালে বা তার পরপরই, জার্মান পিতা এবং ড্যানিশ মায়েদের মাধ্যমে ৬ থেকে ৮ হাজার যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়েছে। ড্যানিশ সরকারের নথিপত্রে ৫,৫৭৯টি যুদ্ধশিশুর তথ্য রয়েছে। ১৯৯৯ সালে, ড্যানিশ সরকার এদেরকে নিজ নিজ পিতার সংশ্লিষ্ট তথ্যের আর্কাইভে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়। সংশ্লিষ্ট তথ্যাদির জন্য দেশের স্বাভাবিক ৮০ বছর মেয়াদী গোপনীয়তার বাধ্যবাধ্যকতা থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জার্মান সেনাদের স্থানের পরে, সোভিয়েত, মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনাদের মাধ্যমেও ডেনমার্কে জন্ম হয়েছে যুদ্ধশিশুর। তবে সেই সংখ্যা অজ্ঞাত।

ফ্রান্সে জার্মান সেনাদের যুদ্ধশিশু: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সঠিকভাবে কতজন যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়েছিল ফ্রান্সে, তা অজ্ঞাত। তবে নিরূপিত হয়েছে যে এই সংখ্যা ৮০ হাজার থেকে ২ লাখের মাঝে। তবে নিশ্চিতভাবে তথ্যভুক্ত আছে যে, যুদ্ধোত্তর সময়ে ২৬ হাজার মেয়েকে, জার্মান সেনাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার কারণে ফরাসি সরকার তাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করে। দখল করার শুরুতে নাৎসি রাজত্বে জার্মান সেনাদের জন্য ফ্রেঞ্চ মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ায় নিষেধাজ্ঞা ছিল তবে, এই বিধিনিষেধ আরোপ করাটা কঠিন হয়ে ওঠায় সম্পর্ক গড়ার বিষয়ে নমনীয় নীতি গৃহীত হয়। ডেনমার্ক এবং নরওয়েতে এ বিষয়ে মধ্যপন্থা অনুসরণ করা হয়, কিন্তু পূর্ব ইউরোপে এ বিষয়ে কঠিন নীতি গৃহীত হয়। নীতির এই পার্থক্যের কারণ ছিল বর্ণগত বিভেদতত্ত্ব।

গুটিকয়েক যেসব দেশে জার্মান সেনাদের জন্য স্থানীয় মেয়েদের সংস্পর্শে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল, তার মধ্যে নেদারল্যান্ড অন্যতম। ডাচ ইন্সটিটিউট অব ওয়ার ডকুমেন্টেশন প্রাথমিকভাবে নিরূপন করেছিল যে, দখল বা আগ্রাসনকালে জার্মান সেনাদের ঔরসে প্রায় ১০ হাজার যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিককালে জার্মান ওয়েহরম্যাখেটর (১৯৩৫-১৯৪৫ সময়ের জার্মান সশস্ত্র সেনাদের নাম) ধারণকৃত তথ্য-আর্কাইভের ভিত্তিতে জানা যায় যে, ওই সংখ্যা হবে ৫০ হাজারেরও বেশি!

জার্মানীতে মিত্রবাহিনীর যুদ্ধশিশু: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বেশ কয়েক বছর ধরে জার্মানিতে অবস্থান করেছিল মিত্রবাহিনী। মারিয়া হোন রচিত গ্রন্থ ‘জিআইস্ অ্যান্ড ফ্রাঁইলেইন্স’-এর সূত্রে জানা যায় যে ১৯৪৫-৫৫ সাল সময়ে মিত্রবাহিনীর ঔরসে জন্ম নিয়েছিল ৬৬ হাজার যুদ্ধশিশু।

মিত্রবাহিনী

যুদ্ধশিশুর সংখ্যা

মার্কিন

৩৬৩৩৪

ফ্রেঞ্চ

১০১৮৮

ব্রিটিশ

৮৩৯৭

বেলজিয়ান

১৭৬৭

অন্যান্য/অজ্ঞাত

৬৮২৯

ইউরোপে কানাডীয় যুদ্ধশিশু: ১৯৩৯ সালে ব্রিটেন কর্তৃক জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার এক সপ্তাহ পরে, কানাডাও যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধকালে কানাডীয় বাহিনী ইটালী এবং নরম্যান্ডি দুই স্থানেই মিত্রবাহিনীর সঙ্গে মিলে যুদ্ধে অংশ নেয়। ইউরোপ মহাদেশে আগ্রাসনের আগে উল্লেখজনক সংখ্যায় কানাডীয় সেনা অবস্থান করছিল ব্রিটেনে। সর্বমোট এগারো মিলিয়ন (এক কোটি দশ লক্ষ) কানাডীয় সেনা, ইউরোপ এবং প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।

ব্রিটেনে অবস্থানকারি কানাডীয় সেনাদের ঔরসে এবং ব্রিটিশ মায়েদের গর্ভে জন্ম হয় প্রায় ২২ হাজার যুদ্ধশিশুর। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেখানে যেখানে কানাডীয় সেনারা অবস্থান করেছে, সেখানে জন্ম নিয়েছে যুদ্ধশিশু; বেলজিয়াম এবং অন্যান্য স্থানে স্বল্পসংখ্যক-সহ নেদারল্যান্ডে যুদ্ধশিশুর সংখ্যা ছিল ৬ হাজার।

যুদ্ধশিশুর সংখ্যা কত? আমরা কখনোই জানতে পারবনা যে মোট কতজন শিশু যুদ্ধে আলাদা হওয়া বাবা-মাকে দেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উত্তর ইউরোপে হানাদার জার্মান সেনা কর্তৃক জন্ম দেয়া শিশুদের সংখ্যা হাজার হাজার। কোনো কোনো পরিসংখ্যানে ভিয়েতনামে আমেরিকান/এশিয়ান [আমেরাশিয়ান] শিশুদের সংখ্যা ১ লাখেরও বেশি।

সময় দেশ যুদ্ধশিশুর সংখ্যা
১৯৭৫-১৯৯৯ পূর্ব তিমুর কয়েকশ
১৯৯০-১৯৯৮ লাইবেরিয়া ২৫০০০
১৯৯২ কম্বোডিয়া কয়েকশ(জাতিসংঘের সেনা/প্রশাসনিক                       কর্মকর্তাদের মাধ্যমে)
১৯৯৩ রুয়ান্ডা ২০০০-৫০০০
১৯৯২ বসনিয়া গর্ভধারণ ৮০০০,

জন্মগ্রহণ ৪০০০

১৯৮০-২০০১ তুরষ্ক/কুর্দিস্তান কয়েকশ
১৯৪৮-২০০১ মায়ানমার কয়েকশ
১৯৮০ ইরান/ইরাক কয়েক হাজার
১৯৬৫-১৯৭৫ ভিয়েতনাম ৪০০০০
১৯৬৫-১৯৮২ ফিলিপাইন ৫২০০০
১৯৬৫ কোরিয়া কয়েকহাজার
১৯৪০-১৯৬৫ কোরিয়া কয়েকহাজার(কমফোর্ট

উইমেনদের গর্ভে)

১৯৭২ বাংলাদেশ ২৫০০০

*উল্লেখ করা সংখ্যাগুলো ন্যূনতম হিসেবে পরিসংখ্যায়িত।

এই তথ্য অনুযায়ী মানবসভ্যতায় এ পর্যন্ত জন্ম নিয়েছে ৩ লাখেরও বেশি যুদ্ধশিশু; প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের কয়েক বছরে বিশ্ব দেখেছে অসংখ্য সশস্ত্র যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং শান্তিরক্ষা কার্যক্রম। ফলে, ৫ লক্ষ বা সম্ভবত ১০ লক্ষাধিক যুদ্ধশিশু জন্ম নিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এ মুহূর্তে সারাবিশ্বে বেঁচে থাকা যুদ্ধশিশুর সংখ্যা পাঁচ লক্ষ।

তিনজন যুদ্ধশিশু

বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু অস্ট্রেলীয় গীতা

(অস্ট্রেলিয়ায় প্রেরিত বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু গীতাকে নিয়ে এই প্রতিবেদনটি সংগ্রহ করেছি ডেবরা ইয়পসন রচিত এবং ফেডারেশন প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘দি কালার অব ডিফারেন্স – জার্নিজ ইন ট্রান্সরেসিয়াল অ্যাডপশন’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে)

আন্তর্জাতিক দত্তকায়নের প্রথম প্রবাহে ১৯৭০-এর দশকে বেশ কিছু শিশুকে নিয়ে আসা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। তারা আজ বড় হয়েছে। একটা ‘হঠাৎ অনাহুত দেশে’ আগন্তুক হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হয়েছে তাদের ভরাট কণ্ঠ। আয়না বলে, গীতা বাওয়ার্স দেখতে ভারতীয়দের মতো। কিন্তু যখন সে স্বপ্ন দেখে তখন সে ‘একেবারে শ্বেতাঙ্গ’; সামনে ফুটে ওঠা হাত থেকে পা পর্যন্ত সবটাই। ‘এটা আমাকে দেখায় যে আমি কতটা পশ্চিমী হয়ে উঠেছি। কিভাবে কতটা সাদা সংস্কৃতির মাঝে মিশে গেছি।’ এমনটাই অনুভূতি, বাংলাদেশ থেকে ১৯৭৬ সালে অস্ট্রেলিয়াতে দত্তক শিশু হিসেবে নিয়ে আসা গীতার।

ক্ষুধার্ত, শারীরিক প্রহারে জর্জরিত এবং মৃত্যুমুখে পতিত গীতাকে ঢাকার রাস্তা থেকে মাদার টেরেসার হোমে নিয়ে আসা হয়েছিল। বড় হয়ে এখনো সে তার শরীরে রহস্যময় ক্ষতচিহ্ন দেখে শিউরে ওঠে। সে জানেনা যে কে তার জন্মদাতা বাবা-মা। তার জন্মদিন ২৮শে মার্চ। না, দিনটি সঠিকভাবে তার জন্মের দিন নয়। সেটা ছিল তাকে এক পুষ্টি কেন্দ্রে নেওয়ার দিন; যেখানে তার স্বাস্থ্য ফিরে আসে। যদিও প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তার বয়স ২৭ (২০০১ সালে), অস্ট্রেলিয়াতে নিয়ে আসার পরে তার ওজনের ওপরে ভিত্তি করে বয়স নিরূপণ করা হয়। গীতা মনে করে যে সে আরো একটু বড়। স্কুলে সে সহপাঠীদের চেয়ে শারীরিকভাবেও বড়। সম্ভবত তার বয়স ২৯। 

১৯৭৬ সালে ৪ বছর বয়সে (উপরে) ২০০১ সালে ২৯ বছর বয়সে (নীচে)

পূর্ব তিমুরের যুদ্ধশিশু রাই

(২০০১ সালের ১০ই মার্চ শনিবারে ‘দি উইকএন্ড অস্ট্রেলিয়ান’ পত্রিকার  প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয় সিয়ান পাওয়েল রচিত এই প্রতিবেদনটি। এখানে বিশ্ব প্রেক্ষিতে উঠে এসেছে রাই নামে পূর্ব তিমুরের এক যুদ্ধশিশু এবং তার মায়ের কথা)

পাঁচ মাস বয়সের রাই। পূর্ব তিমুরের নতুন জাতির একটি শিশু। মুক্তভাবে জন্ম নেওয়া প্রথম প্রজন্মের একজন সে। বর্তমানে তার মা লরেনকা মার্টিন্সের বয়স ৪৩ বছর। শিশুটির পিতা ম্যাক্সিমু একজন সামরিক ব্যক্তি এবং ধর্ষক। পশ্চিম তিমুরের সীমান্ত এলাকায় ছয় মাসের জন্য নির্বাসনে গিয়েছিল মার্টিন্স। আশ্রয় পেয়েছিল আটাম্বুয়ার কাছে এক শরণার্থী শিবিরে। কুখ্যাত বেসি মিরাহ পুটিহ (রেড অ্যান্ড হোয়াইট আয়রন) দলের সদস্য ম্যাক্সিমু ১৯৯৯ সালের ৮ই ডিসেম্বরে প্রথম মার্টিন্সকে দিনের আলোয় জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। “(ক্যাম্পের) অনেক মেয়েকেই এমনটা করা হয়েছে,” মার্টিন্স বলে, “সুন্দর চেহারার কাউকে চোখে পড়লেই তারা তাকে উঠিয়ে নিয়ে যেত।” ঘাড় ঝাঁকিয়ে অস্থিরভাবে ব্যাখ্যা করে সে বলে পরে দিলির দক্ষিণাঞ্চলের এক পাহাড়ি শহর এরমেরার শহরতলীতে সে বসবাস করেছে তার এক আত্মীয়-ভাই তার পরিবারের সঙ্গে।

শেষের কথা

          ক্রম-উন্নয়নশীল মানবসভ্যতার বিপরীতে ইতিহাসের এই দৃশ্যপটের প্রচ্ছায়া বড় বেশি কলঙ্কিত। এখানে শুধুমাত্র নারীরা ধর্ষিত হয়নি, বরং সমগ্র মানবজাতি এক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। হোঁচট খেয়েছে মানুষের নিজের হাতে গড়া সভ্যতা। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখা পর্বটিকে আলোয় নিয়ে আসা সামর্থ্য আমার ছোট্ট কলমের নেই। আপাত শান্ত পুকুরে শুধু একটা ঢিল মেরে ঢেউ তোলার প্রয়াসেই আমার এ সামান্য প্রচেষ্টা। যুদ্ধশিশুদের অবহেলাভর জন্মের পাশে নিজের জন্মকে মনে হয় যেন রাজকীয় আবির্ভাব! একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের শরীর দখলের ফসল রূপে যুদ্ধশিশুদের আবির্ভাব। তারা মুক্তিযুদ্ধের আরেক উত্তরাধিকার। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের ‘প্রথম নাগরিক’।

তথ্যসূত্র

১.https://en.wikipedia.org/wiki/Rape_during_the_Bangladesh_Liberation_War

২. রবার্ট পেন রচিত ‘ম্যাসাকার’ বইয়ের ৫০ পৃষ্ঠায়

৩. https://en.wikipedia.org/wiki/War_children

৪. কাই গ্রেগের ‘দি ওয়ার চিলড্রেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদন; ওয়ার অ্যান্ড চিলড্রেন আইডেন্টিটি প্রজেক্ট; বার্জেন, নরওয়ে, ২০০১

কৃতজ্ঞতা

ব্যক্তিবর্গ: বীণা ডি’কস্টা (অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি), কেভিন জেরার্ড নীল, নয়নিকা মুখ্যোপাধ্যায়, নিলীমা ইব্রাহিম, সুরাইয়া খান (দেশী জার্নাল), মুস্তাফা চৌধুরি এবং ফতে মোল্লা।   

ওয়েবসাইট: জাতিসংঘ, ইউএনডিপি, দৃষ্টিপাত, ফিল্মঅপশন, ম্যাকুমবাইন্টারন্যাশনাল, ওয়ারঅ্যান্ডচিলড্রেন, উইকিপেডিয়া ও মুক্তমনা।

প্রচ্ছদঃ https://stories.savethechildren.org.uk/i-am-alive/

*****

(পড়ুন যুদ্ধশিশুর দ্বিতীয় প্রজন্মের কথা)