৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমার বাবা এম আর আখতার মুকুলের অবদান ও আমাদের কলকাতার স্মৃতি – কবিতা আখতার

প্রাককথনঃ এম আর আখতার মুকুল ও চরমপত্র……

বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ্য, দুঃসাহসী অথচ সংযত ও সহিষ্ণু ‘চিরযুবা’ এম আর আখতার মুকুল। জন্ম ১৯২৯ সালের ৯ই আগস্ট। জীবিকার তাগিদে কখনও তাকে এজি অফিসে, সিভিল সাপ্লাই একান্টস, দুর্নীতি দমন বিভাগ, বীমা কোম্পানীতে চাকুরী করতে হয়েছে। এছাড়াও অভিনয়, শিক্ষকতা, ব্যবসা – যা কিছুই করেছেন তাকেই স্বকীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল করে তুলেছেন। ১৯৫২ -এর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে জেল খেটেছেন। সাংবাদিকতা পেশায় ছিলেন দীর্ঘ দুই বছর। দুর্ধর্ষ রিপোর্টার হিসেবে সফরসঙ্গী হয়েছেন শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, ইস্কান্দার মীর্জা, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, ভুট্টোর মত বড় বড় নেতাদের। জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্থাপনা করা এবং নিয়মিত রণাঙ্গন পরিদর্শন শেষে একই সঙ্গে লেখক, কথক ও ভাষ্যকার হিসেবে বেতারে সাড়া জাগানো ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করা। সাধারণ মানুষের মনের কথাকে, সুপ্ত আশা ও স্বপ্নকে তিনি জীবন্ত ও মূর্ত করে তুলে ধরেছিলেন সেদিনের সেই বিপন্ন অসহায় কিন্তু বীরত্ব ব্যঞ্জক মুহূর্তে। চোখা হাস্য পরিহাসে, রঙ্গ রসিকতায় আদি ও অকৃত্রিম ঢাকাইয়া বুলিতে দিশাহারা ছিল হানাদার বাহিনীর শিবির।

অতিরিক্ত সিগারেট ফোঁকার ফলে ঈষৎ … গলায় যেমন আছে জলদ গম্ভীর ডাক, তেমন আছে বুক কাঁপানো বাঘের হাঁক। ফুরফুরে মজলিশি মেজাজ, যার সঙ্গে বৈদগ্ধ ও অসামান্য স্মৃতিশক্তির বিরল সমন্বয় তার আলাপচারিতাকে করে তোলে খাপখোলা তরবারির মতো শাণিত ও ঝকঝকে।

দুই কন্যা কবিতা ও সঙ্গীতা, দুই পুত্র কবি ও সাগর। সুদীর্ঘ ৩৮ বছর একনিষ্ঠভাবে সংসারধর্ম পালনের পর তাঁর বিদূষী গৃহিনী ডক্টর মাহমুদা খানম জান্নাতবাসী হয়েছেন। ২০০৪ এর ২৬শে জুন এম আর আখতার মুকুল পরলোকগমন করেন। (মূল কথন বেলাল চৌধুরী)

এম আর আখতার মুকুল

এই লেখাটি ওনার বড় মেয়ে শ্রদ্ধেয় কবিতা আখতারের ১৯৭১ সালের স্মৃতিবিজড়িত ঘটনাবলীর কিছু অংশ।

        ১৯৬৩ থেকে ৭০-এর শেষ পর্যন্ত আমরা ৪ নম্বর অরফানেজ রোড, বকশিবাজারের এক বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। তখন আমার বাবা ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় জেনারেল ম্যানেজারের পদে চাকরি করতেন। ১৯৬৪-র সেপ্টেম্বরে আমার ছোটবোন সঙ্গীতার জন্ম ওই বাড়িতে। ওই বাড়িতে থাকাকালীন আমার মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছিলেন। আমার বাবা একইসময় আমেরিকান সংবাদ সংস্থা ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল’-এর পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদদাতা হিসেবেও চাকরি করছিলেন। ভাইয়া তখন শাহীন স্কুলে আর আমি আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তাম। ১৯৭০-এর মাঝামাঝি সময় থেকে বাবা আর সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ দু’জনে মিলে একটি নতুন পত্রিকা প্রকাশ করলেন। নাম ‘দৈনিক স্বরাজ’। এই পত্রিকার ভিতরের চার পাতা জুড়ে ছবি-সহ কেমন করে গেরিলা ট্রেনিং করতে হয় তা ছাপা হত। যা পরবর্তী সময়ে আমার বাবা আর ফয়েজ চাচার জন্য বিপদ ডেকে এনেছিল। ‘পাকিস্তানি ইনটেলিজেন্স’ থেকে পুরো নয়মাস ওরা আব্বা আর চাচাকে খুঁজছিল মেরে ফেলার জন্য।

আমাদের বকশিবাজারের সেই স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি বদলিয়ে পুরনো পল্টনে চলে এলাম। স্কুল বদলে সেগুন বাগিচা বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আমাদের নতুন বাসা ছিল সেগুন বাগিচার তৎকালীন ‘পিনম্যান ডি প্যারিস’ লন্ড্রির গলি দিয়ে ঢুকে একটু ভিতরে। স্কুলে ঠিকঠাক পড়াশোনা শুরু হওয়ার আগেই ইয়াহিয়া খান ঠিক করলেন, ভোটে জিতলেও, বাঙালি ও বঙ্গবন্ধুকে কিছুতেই ক্ষমতা দেবেন না।

এর মধ্যেই চলে এল সেই উত্তাল মার্চ। বাবা মা আমাদের বললেন, কেউ বাড়ির বাইরে যাবে না। বিশেষ করে ভাইয়া যেন না যায়। কখন কী হয় বলা যাচ্ছে না! এ দিকে প্রায়ই হরতাল থাকত তাই বাজারে জিনিসপত্র পাওয়া যেত না। আর সব কিছুর দামও বাড়তে লাগল।

বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে বাঙালিদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বললেন। কিন্তু আমাদের কাছে দেশকে মুক্ত করার জন্য ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি আর্মি ওদের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সাড়ে সাত কোটি অসহায় বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আর সেই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পুরনো ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে নিরীহ মানুষ মারার হত্যাযজ্ঞে নেমে পড়ল। কারণ, পাক আর্মিদের বলা হয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে কিছু হিন্দু গন্ডগোল করছে। ওদের শায়েস্তা করতে হবে। তাই ওরা প্রথমেই হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলোকে টার্গেট করল। পুলিশ লাইনে অস্ত্র ছিল। তাই পুলিশরা বিদ্রোহ করলে ওরা যদি সমস্যায় পড়ে? তাই ঘুমন্ত নিরীহ পুলিশদের মেরে ফেলল এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল। ২৫শে মার্চ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত আমরা ঢাকাতেই সেই সেগুন বাগিচার বাড়িতেই ছিলাম। তেমন কোনও খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই বাবা আমাদের সেই দুই ব্যান্ডের ‘সনি’ ট্রানজিস্টরটা ঘুরাতে ঘুরাতে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র’ পেয়ে গেলেন। সেই কেন্দ্র থেকে ঘনঘন বঙ্গবন্ধুর লিখে দেওয়া ঘোষণাপাঠ শুনতে পেলাম।

একদিন খাটের নীচে বিছানা করে আমরা সবাই ঘুমাচ্ছিলাম। কারণ, যেকোনও সময়েই পাকবাহিনী যাওয়া আসার পথে এলোপাথাড়ি গুলি করতে পারে। এরমধ্যে দেখি বাবা আর মায়ের মধ্যে একটু কথা কাটাকাটি হচ্ছে। কারণ, বাবা মুক্তিযুদ্ধে যেতে চান। আর মা বলছেন, ‘১৯৪৭-এ দেশভাগ আর ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন করেছ, আমি সবই সমর্থন করি। কিন্তু সেইসব আন্দোলনগুলোতে তুমি যোগ দিতে পেরেছিলে, কারণ তুমি তখন অবিবাহিত ছিলে। আর এখন তোমার আরও চারজন মানুষের কথাও ভাবতে হবে। তাই তোমাকে এখন অনেক চিন্তা করতে হবে, তুমি কী করতে চাও।’

এর মধ্যে ২৬/২৭ তারিখে ফয়েজচাচা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমার মায়ের নার্সিং ট্রেনিং নেওয়া ছিল তাই চাচাকে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলেন। আর এসেছিলেন আমাদের খুব নিকট আত্মীয় বিখ্যাত ব্যাংকার লুতফর রহমান সরকার। উনি এসে বললেন, ব্যাংকের কাজে ঢাকায় এসে আটকে পড়েছেন। আপাতত হোটেল পূর্বানীতে আছেন। এর মধ্যে কয়েকজন পাকিস্তানি বড় অফিসারের সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে, ওরা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মেরে ফেলার জন্য একটা তালিকা বানাচ্ছে। এবং সেই তালিকায় সাংবাদিকদের মধ্যে প্রথম নাম ফয়েজচাচা আর দ্বিতীয় নামটি আমার বাবার! এই খবর শুনে মা বললেন, কিছুতেই আর ঢাকায় থাকা যাবে না। আগে বগুড়ায় যাই,তারপর ঠিক করা যাবে কী করব। সেই ব্যাংকার দুলাভাই ৩১ তারিখ বিকালে গাড়ি পাঠালেন, গাড়ি আমাদেরকে নয়ারহাটে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। যে বগুড়া যেতে আমাদের নিজের গাড়িতে ১০/১২ ঘন্টা লাগত, সেই রাস্তায় লেগে গেল চারদিন। আরিচা, বাঘাবাড়ি, গাোয়ালন্দ ঘাট, আর শাহজাতপুর হয়ে চার তারিখ বিকেলে বগুড়ায় এসে পৌঁছলাম। নানার বাড়িতে দেখি, নানি আর ছোটো খালাকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন বড়মামা। বড়মামি আর ছোট্ট মেয়েকে মামির বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে মামা একাই বাড়ি পাহারা দিচ্ছেন। আমরা ওখানে দিন পনেরো থাকবার মধ্যেই খবর এল পাকিস্তানি সৈন্যরা রংপুর শহরেও চলে এসেছে। তাই এবার বাবা আমাদেরকে বগুড়ায় রেখে কলকাতায় যেতে চান। মা বললেন, যেখানেই থাকি একসঙ্গেই থাকব, দেশের এই অবস্থায় কেউ কারও খবর পাব না। হাতে মাত্র ১০০০ বাংলাদেশি টাকা আর মায়ের গহনা। এই দুটোর ভরসায় পাঁচটি মুখের আহার জোটাতে হবে! যদিও বাবা আর মায়ের দেশ ছাড়বার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু কী আর করা! এই সময় আমাদের সাহায্য করেছিলেন ভাষা-সৈনিক গাজিউল হক। উনি গাড়ি এবং পেট্রল তো জোগাড় করে দিলেনই, আবার পরে জয়পুরহাট অবধি এসে আমাদের হিলি বর্ডার পার করে দিলেন। আমাদের সঙ্গে আরও একটি পরিবারও গিয়েছিলেন। খন্দকার আসাদুজ্জানসাহেব এবং ওঁর স্ত্রী-সহ চারটি ছেলেমেয়েও ছিল। রাত ১২ টার সময় যখন বর্ডার পার হচ্ছিলাম, তখন আমরা তিন ভাইবোন মনে মনে খুব খুশি যে, আমরা বিদেশে যাচ্ছি। আর অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, আমার বাবা আর মা বেশ কান্নাকাটি করছেন। একে তো কোন অজানার উদ্দেশে রওনা হলাম, কী আছে ভাগ্যে কে জানে! আর এই যুদ্ধ কতদিন চলবে কে জানে, কবে আবার দেশে ফিরতে পারব! সেই রাতে হিলি বর্ডারে যখন আমাদের নাম-ঠিকানা লেখা হচ্ছিল তখন ওখানে অন্য এক ভদ্রলোক আমাদের সবার রাতে থাকবার জন্য হিলি গেস্ট হাউজে জায়গা করে দিলেন। কিন্তু অসম্ভব মশার জন্য আমরা কেউ ঘুমাতে পারলাম না। আবার পরেরদিন সকালের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে মালদহ পর্যন্ত দুটো ট্যাক্সি জোগাড় হল। মালদহ থেকে ট্রেনে আমরা মনে হয় পরের দিন ১৮/১৯ এপ্রিল শিয়ালদহ এসে নামলাম। ইতিমধ্যে বাবার হাতের ১০০০ টাকা ভাঙিয়ে ভারতীয় ৮০০ টাকা হয়ে গেল। হোটেল ইন্ডিয়া নামে এক হোটেলে উঠলাম আমরা দুই পরিবার, একেকটা রুমের অনেক ভাড়া। বাবার টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাবা অনেক চিন্তা করে সেই আমেরিকান সংবাদ সংস্থা ইউপিআই-এর অফিস খুঁজে বের করলেন। সেই অফিসের ব্যুরো চিফ ছিলেন অজিত দাস। বাবা ওঁকে বললেন, ‘আমাদের এই অবস্থা, যদি থাকার ব্যবস্থা হয়। আমি সবার খাবারের ব্যবস্থা করতে পারব।’ বাবার এই বিপদের কথা শুনে অজিত দাস টেলিপ্রিন্টারে ইউপিআই-কে জানালেন, ঢাকার সংবাদদাতা এখন থেকে কলকাতার অফিস থেকে রিপোর্ট করবে। বাবা তখনই বাংলাদেশের মধ্যে পাকিস্তান আর্মি কী অত্যাচার চালাচ্ছে, ছবি-সহ রিপোর্ট পাঠালেন। ইউপিআই বাবাকে বলল, “ওকে”।

অজিত চাচার নিজের বাড়ি ছাড়াও একটা ফ্ল্যাট ছিল ‘ট্রিভোলি কোর্ট’-এর ১৩ তলায়। সেটা খালি ছিল। বললেন, ‘কোনও ফার্নিচার নেই। আর রান্না বান্না করা যাবে না।’ বাবা তো খুবই খুশি। এ যেন ‘মেঘ না চাইতেই জল’। আমরা পরের দিনই উঠে গেলাম সেই ফ্ল্যাটে। আসাদুজ্জামানচাচার পরিবারও এল আমাদের সঙ্গে। আমরা প্রায় মাস দুয়েক ছিলাম। কিন্তু প্রত্যেকদিন তিন বেলা খাবার কেনার টাকা ছিল না। তাই বাবা প্রথমে পার্ক সার্কাসে একটি বাসা ভাড়া নিলেন। কিন্তু সেখানকার লোকজন আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে লাগল। তাই পাম এভিনিউ বালিগঞ্জে চলে গেলাম। এখানে এসে বাবার সুবিধা হল। প্রত্যেকদিন ভোর চারটায় উঠে ‘চরমপত্র’ লিখতেন, সেটা সকালে হেঁটে গিয়ে বালিগঞ্জে প্লেসে রেকর্ডিং করতেন। পরে বাবা ট্রাম ধরে চৌরঙ্গিতে সেই প্রেসে গিয়ে বাকি কাজ সারতেন। কলকাতায় ‘অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’-এর তখন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন সাহেবের সঙ্গেও বাবা দেখা করলেন। ওঁর সঙ্গে বাবার ছাত্রজীবন থেকেই পরিচয় ছিল। তিনি বাবাকে অস্থায়ী সরকারের ডিজি ইনফরমেশন হিসেবে দায়িত্ব নিতে বললেন। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাবাকে অনেক ধরনের পোস্টার, লিফলেট ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হত। সেই সুবাদে ‘রেডিয়েন্ট প্রসেস’ প্রিন্টিং প্রেসের দুই মালিক নীরদবরণ মুখার্জি আর সুধীর চন্দ্র মুখার্জির মতো দুই মহামানবের সঙ্গে বাবার আলাপ হয়েছিল। বাংলাদেশের জন্য যে কোনও প্রিন্টিং-এর কাজে বেশির ভাগ দিনই কোনও টাকাপয়সা নিতেন না। উল্টে আমাদের পুরো পরিবারের জন্য প্রায়ই দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করতেন। কারণ, আমরা সবাই বাবার সঙ্গে যেতাম।

  ৫৫নং বালিগঞ্জ প্লেসে ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অফিস। ২৫ মে কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনেই ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র’ থেকে প্রথম অনুষ্ঠান শুরু হল। বাবাকে একটা ভাল অনুষ্ঠান করতে দায়িত্ব দেওয়া হল, নাম ‘চরমপত্র’। ঠিক করেছিলেন আশরাফুজ্জামানচাচা। এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা বেতার থেকে ইঞ্জিনিয়াররা এবং কলাকুশলীরাও এসে হাজির হচ্ছিলেন। তাতে অনুষ্ঠানের মানও বাড়তে লাগল। আমার মা মাহমুদা খানম রেবা ‘মুক্তিযোদ্ধার মায়ের চিঠি’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান করতেন। আমি নিজেও আমার মা-এর লেখা ছড়া ‘স্বাধীন বাংলা’ থেকে পড়েছি। অনেক সুন্দর সুন্দর গান সেই সময় তৈরি করেছিলেন সমরচাচা।

এত কিছুর ঊর্ধ্বে ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটা। সেটি ‘বজ্রকণ্ঠ’ নামে সম্প্রচার হত। আর একটা নাটক হত ‘জল্লাদের দরবার’। খুব জনপ্রিয় ছিল। তবে আমার বাবার ‘চরমপত্র’-এর জনপ্রিয়তা এমনই ছিল যে, বাবাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক আসত। এমনকী কলকাতার বাইরে থেকেও আমন্ত্রণ আসত। একবার আমরা মহিষাদল নামে এক জায়গায় গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে বুঝলাম, আমার বাবার চরমপত্র’র জনপ্রিয়তা কোথায় পৌঁছেছিল। সেই গ্রামের মানুষ বাবাকে দেখবার জন্য কী অস্থির! ঠিক এইরকম সময় একদিন ড. দিলীপ মালাকার নামে এক সাংবাদিক বাবাকে একটি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন। এপার বাংলা ওপার বাংলার গুণীদের সংবর্ধনা। স্থান শ্যামবাজার পাঁচ রাস্তার মোড়ে একটি নাট্যশালায়। গুণীরা হলেন সাহিত্যিক গজেন মিত্র ও জরাসন্ধ, বেতার কথক বীরেন ভদ্র, ফুটবল খেলোয়াড় শৈলেন মান্না, চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ছায়া দেবী আর ‘চরমপত্র’ পাঠক এম আর আখতার মুকুল। অনুষ্ঠানের দিন আমরা সবাই গিয়েছিলাম। রাস্তায় যানজট লেগে গিয়েছিল এই অনুষ্ঠান দেখার জন্য। কোনওমতে ড. মালাকারকে খুঁজে পেলাম। উনি আমাদের বসিয়ে ছায়া দেবীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। কিন্তু হলের মধ্যে গন্ডগোল ক্রমশ বাড়তে লাগল। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কী হয়েছে। তারপর অনুষ্ঠান শুরু হল। একে একে সবাইকে স্টেজে বসানো হল। সবাইকে চন্দন কাঠের মালা পরিয়ে সুন্দর একটি করে শালও উপহার দেওয়া হল। কিন্তু হলের গণ্ডগোল বেড়েই যেতে লাগল। একজন ষণ্ডামার্কা ছেলে উঠে বলল, কারও কথা শুনতে চাই না, শুধু ‘চরমপত্র’ শুনতে চাই! বাবা লজ্জায় পড়ে গেলেন। বাবা উঠে সেই চরমপত্র’র গলা ব্যবহার করে বললেন, ‘এইদিককার কারবার হুনছেননি। শ্যামবাজারের মোড়ে অক্করে গ্যাঞ্জাম লাইগ্না গেছে।’ এইটুকু বলার সঙ্গে সঙ্গে হলে পিনপতন নীরবতা নেমে এল। বাবা বললেন, আমি আপনাদের সব কথা মেনে নেব, আপনাদের সামনে আমি দু’বার আসব। এখন একটু বলে নিই, এই যে এত গুণীজন এসেছেন, তাঁদের তো আমি খুবই সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি, ওঁদেরকে রেখে কী করে আমি একা অনুষ্ঠান করি? তাই কথা দিলাম, একদম শেষে এসে আপনাদের কয়েকটি ‘চরমপত্র’ শোনাব।’

      ১৯৭১-এর জুলাই/আগস্ট মাস নাগাদ বাবার ‘ইউপিআই’-এর চাকরিটা চলে যায়। কারণ, আমেরিকা পাকিস্তানকে সাপোর্ট করেছিল। তাই বাবাকে ওরা বলে পাঠাল, ‘চরমপত্র’ পাঠ বন্ধ করলে চাকরিটা থাকবে। বাবা বললেন, ‘আমি তা করতে পারব না। তাই এই চিঠিটাই আমার রেজিগনেশন লেটার হিসেবে বিবেচনা করো।’  বাবা বাড়িতে এসে মাকে তখনই কিছু বলেননি। কারণ, টাকাপয়সার অভাব যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মা প্রত্যেকদিন বলতেন, ‘তোমার যত কষ্টই হোক, ‘চরমপত্র’ বন্ধ করা যাবে না। কারণ, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা এবং মুক্তিযোদ্ধারা বসে থাকে, তোমার ‘চরমপত্র’ শুনে উৎসাহ পায় যুদ্ধ করার। এদিকে বাবার ভোরবেলা লেখালেখি করা অভ্যাস ছিল। একটা লেখা লিখলেন, ‘মিছিলের নাম শপথ’। লেখাটা পড়ে সেই অজিতচাচা বাবাকে বললেন, সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকা’র অফিসে একটা লেখা ড্রপ করবার বক্স আছে। সেখানে দিয়ে এস। বাবা গিয়ে ড্রপ করেছিলেন। সম্পাদক সাগরময় ঘোষের লেখাটা ভাল লাগাতে ছাপা হয়ে গেল। বাবা দুরুদুরু বক্ষে দেশ পত্রিকা অফিসে গেলেন। বাবাকে দেখেই সম্পাদক বললেন, ‘রেগুলার লিখবেন?’ বাবা বললেন, ‘লিখতে পারি যদি আমার লেখা কাটাছেঁড়া না করেন।’ ‘লিখুন। আপনার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকল’ জানিয়ে দিলেন সম্পাদক। একেকটা লেখার জন্য ১০০ ভারতীয় টাকা। বাবা লিখতে থাকলেন ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’। সেই দুঃসময়ে এইভাবেই অনেক কষ্টের মধ্যে আমাদের দিন কেটেছে। তখন আমার বাবার সেই বিখ্যাত চরমপত্র’র জন্য বাবাকে বাংলাদেশ সরকার প্রত্যেকদিন মাত্র সাড়ে সাত টাকা দিত। তাতে কী? সাধারণ মানুষের ভালবাসা আর যে জনপ্রিয়তা বাবা পেয়েছিলেন, সেটা এই মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরেও হারিয়ে যায়নি আশা করি। যাক, সেই কষ্টের দিন কাটিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পরই বাবা ১৮ই ডিসেম্বর ঢাকায় চলে যান। আর আমরা ১৯৭২-এর জানুয়ারির মাঝামাঝি দেশে ফিরে যাই।

১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারী ধানমন্ডিতে বাবা, বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমেদ
১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারী ধানমন্ডিতে বাবা, বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমেদ
১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবসে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাবা নিজে তাঁর বিখ্যাত 'চরমপত্র' পাঠ করছেন।
১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবসে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাবা নিজে তাঁর বিখ্যাত ‘চরমপত্র’ পাঠ করছেন।
ইন্দিরা গান্ধীর সফরের সময় ওনার বাম পাশে আমার বাবা
ইন্দিরা গান্ধীর সফরের সময় ওনার বাম পাশে আমার বাবা
বাবা আর মা
বাবা আর মা
সিডনিতে ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার সঙ্গে আমি
সিডনিতে ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার সঙ্গে আমি

Previous
Next

*লেখাটি পূর্বপ্রকাশিত।

*****