মুক্তিযুদ্ধ শুধু স্থবির ইতিহাস নয়,তার অভিঘাত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বহমান। ওই সময়ের ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন, এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। তেমনই দুজনের কথা ধরা রইল এখানে –
১। বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুর দ্বিতীয় প্রজন্ম ক্যাটরিনা ক্যাপুসিনোর স্মৃতিচারণ- অনুলিখনে সাজিদ হোসেন
২। চুকনগর গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী এরশাদ আলীর অভিজ্ঞতার বিবরণ- অনুলিখনে গৌরাঙ্গ নন্দী
১। যুদ্ধশিশুর দ্বিতীয় প্রজন্ম ~ ক্যাটরিনা ক্যাপুসিনো
দ্বিতীয় প্রজন্ম ~ ক্যাটরিনা ক্যাপুসিনো
১৯শে জুলাই ১৯৭২। বুধবার বিকেল।
যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। অল্পদিন আগে চালু হয়েছে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। এখান থেকে আজ কানাডায় নতুন আশ্রয়ের পথে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে চেপে বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছে ১৫ জন যুদ্ধশিশু। বিশেষত মাদার তেরেসা হোম এবং সহযোগী অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার উদ্যোগে বিদেশে দত্তকায়িত যুদ্ধশিশুদের মধ্যে এরাই প্রথম দল। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে জন্ম নিয়েছে এসব যুদ্ধশিশু। যুদ্ধশিশুদের এই প্রথম দলটি কানাডীয় মানব-হিতৈষী প্রতিষ্ঠান ‘ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেনের’ সৌজন্যে, টরন্টো ও মন্ট্রিয়লের উদ্দেশ্যে নিউইয়র্কে যাত্রা করছে। সেখানে এই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ইতোমধ্যেই নির্বাচিত ১৪টি পরিবারে দত্তক হিসেবে আশ্রয় হবে এসব শিশুর। এদের মাঝে একটি পরিবার, মি. ও মিসেস বনি ক্যাপুসিনোর।
এই ১৫ জন শিশুর মধ্যে একজন ছিল মাত্র চার মাস বয়সের ছোট্ট শিশু ‘শিখা’। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের অযাচিত অপবিত্রতাকে ধুয়েমুছে নিয়ে চলে গেছে আরেক নির্বাসনে। কানাডার কিউবেক নিবাসী মি. ও মিসেস ক্যাপুসিনোর কোলে। কানাডার মাটিতে বেড়ে ওঠা, প্রায় পঞ্চাশে পা দেয়া শিখার হৃদয়ে-মননে বাংলাদেশের অস্তিত্ব এক বহ্নিশিখা – যদিও হারিয়ে যাওয়া ঠিকানা। তবুও সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, ওই সুদূরে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন ভূখণ্ডটাই তার শিকড় – তার স্বপ্ন।
এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের কিছুই থেমে থাকেনা। থেমে থাকেনা পৃথিবীর আবর্তন। দীর্ঘজীবনের শেষপ্রান্তে এসেও বয়সের ভারে একটুও ক্লান্ত হননি সেই বনি ক্যাপুসিনো। দুঃস্থ শিশুদের পুনর্বাসনে কাজ করে চলেছেন নিরলসভাবে। চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন অনাথ আশ্রম ‘শিশুস্বর্গ’; নেপাল ও ভারতেও তাঁর অনুরূপ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এবারের দ্বিতীয় দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছে ক্যাটরিনা ক্যাপুসিনো – বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুর দ্বিতীয় প্রজন্ম। ১৯৭২-এ জন্ম নেওয়া সেই যুদ্ধশিশু শিখার কন্যা – ক্যাটরিনা। ১৯৭২ সালের দীর্ঘ ৪৩ বছর পরের এই দৃশ্যপটে, ২০১৫ সালে মায়ের সেই প্রিয় দেশের মাটিতে এসেছে ‘যুদ্ধশিশুর কন্যা’! বনি ক্যাপুসিনোর সঙ্গে এসেছে মায়ের দেশ মাতৃভূমি বাংলাদেশ দেখতে! নিজের মা শিখা সম্পর্কে ক্যাটরিনা বলে, “আমার মা এ দেশটাকে তাঁর স্বপ্নে এবং আত্মায় লালন করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি এখানে থাকতে পারেননি। কিন্তু তিনি আমায় বলেছেন, তাঁর শিকড় এখানেই।” বলতে বলতে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে তার চোখ, “চমৎকার এই দেশটাতে আমি আবার আসতে চাই। আমার মা, বোনসহ।”
২০১৫ সালের ২রা নভেম্বর। চট্টগ্রামের ‘শিশুস্বর্গে’ এসেছে যুদ্ধশিশু শিখার কন্যা ২১ বছর বয়সী ক্যাটরিনা। ২০০৯ সালে প্রকাশিত আমার ‘একাত্তরের যুদ্ধশিশু – কতটা অবহেলায়, কতটা ভালবাসায়’ বইটার মাধ্যমে আমার বাচ্চারা যুদ্ধশিশুদের সম্পর্কে বেশ আগ্রহী। ওদের নিয়ে গেলাম ক্যাটরিনার সঙ্গে দেখা করতে। চমৎকার এক মানুষ ক্যাটরিনা। মুহূর্তেই নিবিড় হয়ে আলাপে মেতে ওঠে আমার দুই কন্যা নিসর্গ নিগার দ্যুতি আর বহ্নিশিখা নিগার দিয়ার সঙ্গে। পুত্র সিয়াম সাজিদ দীপ্র ঢাকায় থাকায় অনুপস্থিত। শিশুস্বর্গের বাচ্চারা বনি ক্যাপুসিনোকে ডাকে ‘বনি-মা’ বলে। চমৎকার এক পরিবেশ। আমার ‘একাত্তরের যুদ্ধশিশু’ বইটা উপহার দিলাম ক্যাটরিনাকে। বইয়ের ভেতরে তাঁর মায়ের নামটা দেখে উচ্ছসিত সে। বাংলা পড়তে না পারলেও, মায়ের নামটা বুঝতে পারে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই! একসঙ্গে বসলাম। গল্প করলাম। বাংলাদেশ এবং এদেশের মানুষের প্রতি ক্যাটরিনার আগ্রহ সীমাহীন। সকলের জন্য তার হৃদয়ভরা ভালবাসা আর শ্রদ্ধা।


Previous
Next
অনুলিখন~ সাজিদ হোসেন
চুকনগর গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী এরশাদ আলী
২। চুকনগর গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী এরশাদ আলী
একাত্তরের ২০ মে চুকনগরের গণহত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী এরশাদ আলী। তিনি তখন ত্রিশোর্ধ্ব যুবক। পিতার সাথে পাতাখোলা বিলের কোণায় ধানক্ষেতে ছিলেন। পিতা চিকন আলী। পাকিস্তানী সেনারা এলে পিতা ধান ক্ষেতে থেকে যান, সন্তানদের দূরে নিরাপদে চলে যেতে বলেন। পিতার কথামতো এরশাদ আলীরা দূরে চলে যান, তবে অদূরে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানী সেনাদের তৎপরতা দেখতে থাকেন। সেনারা ধান ক্ষেতে গিয়ে চিকন আলীর সাথে কথা বলেন। কোন একটি কথায় চিকন আলী রেগে যান, কাঁচি উঁচিয়ে সেনাদের প্রতি তিনি তেড়ে ওঠেন। আর তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানী সেনারা তাঁকে গুলি করে। লুটিয়ে পড়েন চিকন আলী। চুকনগর গণহত্যার প্রথম শহীদ।
‘জীবনডা তার সুখির হলো না’
অশীতিপর বৃদ্ধ, অসুস্থ এরশাদ আলী আজও সেই যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন। স্বাভাবিকভাবে কথাও বলতে পারেন না, কষ্ট হয়। কিন্তু চুকনগরের নরমেধযজ্ঞের কথা উঠলেই তাঁর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। ঘৃণায় বুক বেঁকে ওঠে। পাক হানাদার বাহিনীদের গালি দেন। শহীদের ছেলে এরশাদ আলী মোড়ল বলেন, ‘ওরা (পাকিস্তানী সেনারা) মানুষ না, মানুষ কোনদিন মানুষরি এইভাবে মারতি পারে! জানের মায়ায় যারা পালায় যাচ্ছিল, সেই সব মানুষরি ওরা পাখির মত গুলি কইরে মারলো। গাছে চইড়ে, পানিতি নাইমে মানুষ বাঁচতি পারিনি।’
এরশাদ মোড়ল বলেন, ঘটনার দিন তারা তিন ভাই তাঁদের বাবার সাথে ক্ষেতে লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করছিলেন। তাদের চাষের জমির অদূরে মাঠের মধ্যে, নদীতে-নদী তীরে, মন্দির, পাশের নদী তীরে, বাজার প্রভৃতি জায়গায় বিপুল সংখ্যক নর-নারী-শিশু এসে জড়ো হয়েছিল। তাঁদের অনেকেই বিশ্রাম নিচ্ছিল, অনেকেই রান্না করছিল, কেউ কেউ খাচ্ছিল। সকাল ন’-দশটার দিকে মিলিটারির তিনটে গাড়ি আসে। দুটো গাড়ি বাজারের দিকে যায়, একটি গাড়ি তাদের দিকে আসে। তাই দেখে তাদের বাবা বলে, ‘এরশাদ, মিলিটারির গাড়ি আইছে, তোরা পালা।’ একথা শুনে এরশাদেরা তিন ভাই বাড়ির মধ্যে চলে যায়। মাঠে রয়ে যান চিকন মোড়ল। সেনারা এসে তাঁর সাথে কি যেন কথা বলে। চিকন মোড়ল হাতের কাঁচি নিয়ে সেনাদের ওপর তেড়ে যায়। তাঁকে হত্যা করা হয়।
এরশাদ মোড়ল ওই দিনের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বলেন, বিকেল চার-পাঁচটার দিকে তারা গুলি করা থামায়। পরে তারা চলে যায়। তখন তিনি পাতাখোলা বিল, বাজার, মন্দির, বটতলা, নদীর ঘাট প্রভৃতি এলাকা ঘুরে দেখেন। সব জায়গায় শুধু লাশ আর লাশ। মাটি রক্তে ভিজে গিয়েছে। তার মধ্যে লাশের স্তুপ। একটি লাশের পর আর একটি লাশ, তারপর আরও একটি। বোঝাই যায়, একজন আর একজনকে রক্ষা করতে গিয়ে মারা পড়েছেন। শিশুদের পা দিয়ে পিষে মারা হয়েছে। যারা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল, তাদের গুলি করা হয়েছে। নদীর পানি লাল হয়ে গেছে, আর লাশের পর লাশ জোড়া লেগে ভেলার মত তৈরি হয়।
পাতাখোলা বিলে তিনি তাঁর পিতার লাশের খোঁজ করছিলেন। তাঁরা যে জায়গায় কাজ করছিলেন, সেই জায়গায় একাধিকবার গিয়েও তিনি দেহটি দেখতে পাননি। জল-কাদায় লাশটি মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল। মানুষের ছোটাছুটিতে লাশটি হয়তো সরেও গিয়েছিল। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে। অবসন্ন দেহ। বিষণ্ণ মনে ঘুরছেন। কতো সময় কেটেছে, তা তিনি বুঝতে পারেননি। এমন সময়ে তাঁর কানে শিশুর কান্নার আওয়াজ আসে। কে কাঁদে, বিস্মিত হন এরশাদ আলী। কান্নার আওয়াজ অনুসরণ করে গিয়ে দেখেন, একটি মাস ছয়েক বয়সের ফুটফুটে মেয়ে-শিশু মায়ের বুক থেকে দুধ পান করার চেষ্টা করে চলেছে। মা-যে আর নেই, সেই শিশুই বা বুঝবে কি করে! হাতে থাকা টর্চের আলো ফেলে তিনি আরও ভালো করে পরখ করার চেষ্টা করেন। হঠাৎ আলোতে শিশুটি বিস্মিত হয়। আশেপাশে শত শত লাশের মাঝে মৃত মায়ের বুকে পড়ে থাকা শিশুটিকে তিনি কোলে তুলে নেন। নিয়ে যান বাড়িতে। খাবার দেন। নাম রাখেন সুন্দরী। তার এক বন্ধু নি:সন্তান মান্দার দাসের বাড়িতে রেখে বড় করে তোলেন। সেই শিশুটি এখন পঞ্চাশ বছর বয়সী সুন্দরীবালা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দৌলতে শিল্পকলা একাডেমী ডুমুরিয়া শাখায় অফিস সহায়ক হিসেবে তিনি কাজ করেন। এরশাদ আলী বলেন, ‘দুর্ভাগা সুন্দরী! মা-বাবারে চিনতি পারলো না। পাকিস্তানী সেনাদের গুলি থেকে মাইয়েডা রক্ষে পাইছিলো, তবে জীবনডা তার সুখির হলো না।’

অনুলিখন~ গৌরাঙ্গ নন্দী