পাকিস্তান আমল, মুক্তিযুদ্ধ ও বামপন্থী রাজনীতি – সহুল আহমদ

সূচী

পুরো প্রবন্ধে বামপন্থা বা বামধারা বা বামপন্থী রাজনীতি একটু শিথিল অর্থে ব্যবহার করা হবে। অর্থাৎ কেবল কমিউনিস্ট নামধারী দলগুলোকেই বোঝানো হবে না, বরঞ্চ একটা সামগ্রিক ভাবধারার দিকে ইশারা দেয়া হবে। মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের অবদান বা কর্মকাণ্ডকে আলাপ করতে হলে পাকিস্তান আমলের বামপন্থার রাজনীতি নিয়েও আলোচনার জরুরত রয়েছে। তখন কেবল পার্টি বা দলের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখলে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সামগ্রিক রূপ ঠাহর করা সম্ভব হবে না। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সারা দুনিয়াতেই আন্দোলন সংগ্রামের জোয়ার চলছিল। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা তখন আর কেবল বামপন্থী পার্টি বা দলের মধ্যে আটকে নেই, প্রায় সকল শিবিরেই কমবেশি এমন শ্লোগান দেয়া হতো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে বামধারার মনোভাব এতোই প্রভাবশালী ছিল যে, জনপ্রিয় দলগুলো, যারা কিনা নিজেদেরকে কমিউনিস্ট বলে দাবি করতেন না, তারাও বামপন্থী রেটরিক অহরহ ব্যবহার করতেন। এটা পাকিস্তান আমলের যে কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক সংগঠন বা সামাজিক সংগঠন বা এমনকি রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে পরিলক্ষিত। মওলানা ভাসানী বা শেখ মুজিব যখন চীন সফর করেন, তাদের দুজনের অভিজ্ঞতাতে বামধারার প্রতি স্পষ্ট ঝোঁক দেখা যায়, যদিও দুজনেই দাবি করেছেন তারা কমিউনিস্ট নন, বা চীনের মতবাদের অনুসারী নন।[1] শেখ মুজিব আত্মজীবনীতে লিখেন, ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।’[2]

সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস স্থাপন, পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে মন্দ ও শোষণের যন্ত্র বলে সাব্যস্ত করা- এসবই ছিল সেই যুগের প্রচণ্ড প্রভাবশালী ভাবনা। মোটাদাগে এই ভাবনাগুলোকে বামপন্থী ভাবনা বলে চিহ্নিত করা যায়, এবং দক্ষিণপন্থী দল ব্যতীত প্রায় অধিকাংশের মধ্যে এমন ভাবনা প্রভাবশালী ছিল। ষাটের দশকে সমগ্র পৃথিবী উত্তাল ছিল। আমরা দেখি তারিক আলী যখন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে লিখেন, তখন তিনি এই ঘটনাকে তৎকালীন দুনিয়াতে ঘটে যাওয়া অন্যান্য ঘটনার সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। ১৯৬৮ সালের মে মাসের বিদ্রোহ, মেক্সিকোর ছাত্র ও শ্রমিকদের আন্দোলন, ইতালি ও জার্মানিতে বিক্ষোভ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহের সমান্তরালে রেখে তিনি বলেন, অক্টোবরের শেষ দিকে যখন বিশ্বব্যাপী তরুণদের বিদ্রোহে ভাটা পড়েছে, আন্দোলনের গতি স্থিমিত হয়েছে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয়।[3] অর্থাৎ, সে সময়ে বামধারার যে প্রভাব সেটাকে একটা বৈশ্বিক প্রপঞ্চ হিসাবেও দেখা যেতে পারে। উল্লেখ্য, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের একটা বড় জায়গা জুড়ে ছিল শ্রমিকশ্রেণির উত্থান ও গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের বিদ্রোহ। এ দুই জায়গাতেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন কমিউনিস্টরা। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত টঙ্গীর শিল্প এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকায় গণ আন্দোলনের মুখে পশ্চিমা শিল্পপতিরা বেশ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। সে সময় স্মরণ করে হায়দার আকবর খান রনো বলেছিলেন, “সেদিন শিল্প এলাকায় যেন শ্রমিক শ্রেণির রাজত্ব কায়েম হয়েছিল।”[4]

আহমদ ছফা বামপন্থী রাজনীতি বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “বাংলাদেশি রাজনীতি সংস্কৃতির যা কিছু উজ্জ্বল অংশ তাঁর সিংহভাগই বামপন্থী রাজনীতির অবদান। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বামপন্থী রাজনীতির উত্তাপ থেকেই বাঙালি সংস্কৃতির নবজন্ম ঘটেছে। সামন্ত সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত একটি নতুনতর সংস্কৃতির উন্মেষ বিকাশ লালনে বামপন্থী সংস্কৃতিসেবীদের যে বিরাট সাফল্য এবং ত্যাগ; তিলতিল করে সংস্কৃতির আসল চেহারাটি ফুটিয়ে তোলার কাজে বামপন্থী সংস্কৃতিকর্মীরা যে শ্রম, মেধা এবং যত্ন ব্যয় করেছেন যে কাহিনী এখন প্রায় বিস্মৃতিতে বিলীন হতে চলেছে। …বাঙালি জাতীয়তার প্রাথমিক সোপানগুলো বামপন্থী রাজনীতির নেতাকর্মীরাই নির্মাণ করেছিলেন। সেজন্য তাঁদের জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন কম সহ্য করতে হয়নি।”[5] বামপন্থী রাজনীতির এই অবদানকে কেবল পার্টির কর্মকাণ্ড দিয়ে ঠাহর করা যাবে না।

দেশভাগের ফলে ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু পাকিস্তান ত্যাগ করলে পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির আকার ও প্রকার দ্রুত কমে আসে। দেশভাগের পূর্বে পূর্ব বাংলার প্রায় ১০,০০০ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন, অথচ পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্টদের সংখ্যা কমে কয়েকশোতে নেমে আসে। পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা আরও করুণ ছিল। তার উপর শুরু থেকে কমিউনিস্টদের ওপর ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় দমন পীড়ন, জুলুম, নির্যাতন শুরু হলে, কমিউনিস্টরা তাদের কৌশল বদলাতে বাধ্য হন। বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে, এমনকি তৎকালের জনপ্রিয় আওয়ামীলীগে যোগ দিয়ে কাজ করার কৌশল গ্রহণ করা হয়। ১৯৫১ সালে গঠিত কমিউনিস্টদের অঙ্গসংগঠন যুবলীগের লক্ষ্য ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, সামন্তবাদ বিরোধী, বিশ্বশান্তি, অবাধ গণতন্ত্র, ও দেশের মধ্যে সকল মানুষের কর্মসংসস্থানের সুযোগ ইত্যাদির ভিত্তিতে সর্বাধিক মানুষকে অনুপ্রাণিত করা। তারা বিভিন্ন দিবসের উছিলায় সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন; যেমন, সুকান্তের মৃত্যুবার্ষিকী, রবিঠাকুরের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী ইত্যাদি। অন্যদিকে যারা আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন (যদিও কমিউনিস্টদের মধ্যে এ নিয়ে বিস্তর তর্ক ছিল) তারা আওয়ামীলীগের কর্মসূচিতে আরো বেশি বামপন্থী আদর্শ ঢুকাতে এবং ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের জন্য চাপ দিয়েছিল। তালুকদার মনিরুদ্দজামান তাই বলেন, পূর্ব বাংলায় বামপন্থীদের নেতৃত্বে আদর্শিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। তার মতে, “বামপন্থীরা প্রথম ভাষা, স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক দুর্দশার মতো আবেগজড়িত ও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করার সময় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী আবেদনের পরিবেশ সৃষ্টি করে। কৌশলগুলো হলো- মূল দলগুলোর সাহায্যে সাংস্কৃতিক নাশকতা, জনপ্রিয় দলগুলোতে অনুপ্রবেশ এবং তাদের কর্মসূচিতে ধর্মনিরপেক্ষ, সামজ্রাব্যবাদ বিরোধী এবং সমাজতান্ত্রিক নীতিসমূহ অন্তর্ভূক্ত করা। পূর্ববাংলার বামপন্থীরাই একমাত্র রাজনীতিক যারা ১৯৭১ – এর প্রথম দিকে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর পূর্বে গেরিলা যুদ্ধের সম্ভাব্যতা এবং অন্যান্য বিপ্লবী কৌশল সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রাগ্রসর ধারণা (এবং পাবলিক ডিসকাশন প্রস্তাব উত্থাপন করেন) দিয়েছিলেন”।[6] অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানে বামপন্থী দল বা নেতৃত্ব ব্যর্থ হলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির গড়নে বামধারার রাজনীতি ছিল সফল।   

পাকিস্তান রাষ্ট্রের “অনমনীয় শত্রু”   

            পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, যখনই কেউ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে, তাকে ‘কমিউনিস্ট’ বলে গালি দেওয়া হয়েছে। এমনকি দক্ষিণপন্থী নেতাদেরকেও, যদি তারা কোনোভাবে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন, ‘কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন’ কিংবা ‘কমিউনিস্ট দ্বারা প্রভাবিত’ বলে চিহ্নিত করা হত। ফলে বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি যেমন নিষিদ্ধ হয়েছে, তেমনি কমিউনিস্ট নেতৃত্ব পাকিস্তান আমলে ভয়াবহ জেল জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড জেল জুলুমের একটা ভয়াবহ নজির। রাজবন্দীর মর্যাদা, পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি, ভালো খাবার না দেয়া ইত্যাদির প্রতিবাদে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশনা অনুসারে ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ থেকে পূর্ববঙ্গের সবগুলো কারাগারের কমিউনিস্ট রাজবন্দিরা আমরণ অনশন শুরু করেন। নির্যাতন ও প্রতারণার মুখে তারা কয়েক দফা অনশন করেন। নির্যাতনের ফলে কয়েকজনের রাজবন্দীদের মৃত্যু হওয়ার ফলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের বিভিন্ন কারাগারে। রাজশাহী কারাগারের রাজবন্দীরা নির্যাতন বন্ধের দাবি ও সাম্প্রদায়িক উসকানির প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে স্মারকলিপি দেন। জবাব না পেয়ে বন্দীরা ১৯৫০ সালের ৫ এপ্রিল অনশন শুরু করেন। অনশনকারীদের সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আইজি প্রিজন রাজশাহী কারাগারের খেলার মাঠে কয়েদীদের একত্র করে বললেন, কমিউনিস্টরা বাইরে কিছুই করতে পারছে না। আর এখন জেলে এসে আপনাদের উসকে দিচ্ছে। সুবিধা লোটার চেষ্টা করছে আপনাদের উসকে দিয়ে। আপনারা কমিউনিস্টদের ফাঁদে পা দিয়ে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনবেন না। অন্যদিকে রাজবন্দীদের কক্ষে গিয়ে বললেন, ‘জেলের ভিতরে আপনারা বিপ্লবের নামে যে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি করছেন তার পরিণাম শিগগির দেখতে পাবেন।’ ২৪ এপ্রিল খাপড়া ওয়ার্ড থেকে কয়েকজন বন্দীকে কনডেম সেলে (১৪ নম্বর সেল) স্থানান্তরিত করতে চাইলে বন্দীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। বেপরোয়া পুলিশ গুলি চালায় তখন। গুলিবর্ষণের পাশাপাশি পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে আহত বন্দীদের উপর। এক বন্দী তখন তীব্র তৃষ্ণায় পানি পান করতে চাইলে জেলার মান্নান সিপাহীকে নির্দেশ দেন বন্দীর মুখে প্রস্রাব করতে। সেদিন পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সাত জন কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী। আহত হয়েছিলেন প্রায় ৩২জন বন্দি।[7] এই ঘটনা পাকিস্তান আমলের শুরুতেই কমিউনিস্টদের নানামুখী লড়াই ও তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নজির হিসাবে পেশ করা হলো। উল্লেখ্য, কমিউনিস্টদের কর্মকাণ্ডের ওপর সরকারের সর্বদা তীক্ষ্ণ নজরদারির প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন গোপন দলিলে।[8]

পূর্ব বাংলায় কমিউনিজমের বিস্তার পাকিস্তান সরকার এবং এমনকি আমেরিকার জন্য একটা মাথা ব্যাথা ছিল। ভয় ছিল। যেমন পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব বাংলায় বাম রাজনীতির তৎপরতা ছিল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার জন্যে খুব বড় মাথা ব্যথার কারণ। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ‘পেটে খাবার ও ইসলাম – এই দুই জিনিস তাদের কমিউনিজম থেকে দূরে রাখবে।’ কমিউনিস্টদের তৎপরতা ঠেকাতে ১৯৫০ সালে আমেরিকা ‘পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্ট রুখতে একটি সমন্বিত কর্মসূচি’ নামে এক গোপন কর্মপন্থা হাতে নেয় যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল ‘কমিউনিস্ট – প্রভাব দূরীভূত করা এবং পাকিস্তানের নতুন ভাবাদর্শের প্রতি সমর্থনসূচক একটি কর্মসূচি তৈরি করা’। গোপন সেই দলিলে বিভিন্ন রকমের টার্গেট গ্রুপ নির্ধারণ এবং তাদের কাজের ধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা আছে। সে টার্গেট-গ্রুপ থেকে শিক্ষাক্ষেত্র, শ্রমিক শ্রেণী, সেনাবাহিনী কিছুই বাদ ছিল না। নথিতে ‘বিশেষ প্রকল্প’ এর মধ্যে ছিল রেডিও, সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র এবং ধর্মীয় নেতা ও গ্রুপগুলো। ‘ধর্মীয় নেতা ও গ্রুপগুলো’ প্রকল্পে বলা আছে, ধর্মীয় মঞ্চ থেকে যাতে কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণা চালানো যায় সে উদ্দেশ্যে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌছাতে হবে। এ ক্যাম্পেইনের লক্ষ্য হবে এই কথা বোঝান, যেহেতু কমিউনিজম ধর্মবিরোধী, ফলে সে ইসলামবিরোধী। উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলনকেও আমেরিকা কমিউনিস্ট প্রভাবিত আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে।[9]

এটাও উল্লেখ্য, গ্রেফতার-জেল-জুলুম পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বামপন্থী বা কমিউনিস্টদের প্রতি চলেছিল। আইয়ূব খানের আমলে এইদিকে যেমন ভাসানী গ্রেফতার হচ্ছেন, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে করাচীর সংগ্রামী কমিউনিস্ট হাসান নাসির গ্রেফতার হোন। নির্মম নির্যাতনের ফলে জেলেই তিনি মারা যান। বলা হয় যে, তার মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। প্রতিবাদের মুখে কর্তৃপক্ষ বলে যে, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।[10] বামপন্থী মনোভাবাপন্ন পত্রিকা দখল করা হয়। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিষেদগারের একটা নমুনা ১৯৬২ সালের পাকিস্তান টাইমসের একটা সম্পাদকীয় থেকে তুলে ধরা যেতে পারে। লেখা হয়,

“একটি মানুষের কাছে বাতাস যা, দেশের কাছে দেশপ্রেমও তাই। এ ছাড়া একজন বাচতে পারে না। গণতন্ত্রের মতো দেশপ্রেমও আধুনিক মতবাদ… কিন্তু কমিউনিস্টরা এই দেশের সবচে অনমনীয় শত্রু। বিশ্বাসের দিক থেকে তারা পাকিস্তানের জন্ম বিরোধী। এদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য আমরা কী করছি? অবশ্যই তাদের দল নিষিদ্ধ এবং তারা সংখ্যায় অল্প। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা তাদের উদ্বিগ্ন করে না… যখন প্রেসিডেন্ড দেশ সেবায় এগিয়ে আসবার জন্য দেশপ্রেমিকদের প্রতি আহ্বান জানান তখন তিনি দেশের শত্রুদের নির্মূল করার দায়িত্বও গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে সবচে ঘৃণ্য হচ্ছে কমিউনিস্টরা”।[11]

দল-উপদল-কোন্দল

               রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বামপন্থার প্রভাব ও কৌশল এবং বামপন্থী রাজনীতি ও কমিউনিস্টদের প্রতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের মনোভাব কিছুটা আলোচনার পর এবার আমরা কমিউনিস্ট দল ও বামপন্থীদের দল নিয়ে কিছুটা আলোচনা করবো। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে মওলানা ভাসানী নির্বাহী কমিটির ৯জন সদস্যকে নিয়ে আওয়ামীলীগ থেকে পদত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন একটি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ফ্রন্ট গড়ে তুলেন। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদের বিরোধিতা, এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভিত্তিক জাতিগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠাকে লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করা হয়। পার্লামেন্টারি কার্যক্রমের বাইরে কৃষকদের মধ্যে কাজ করছিলেন ন্যাপের এমন কমিউনিস্ট সদস্যরা মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি গঠন করেন। একইভাবে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের সাথে যুক্ত বামপন্থী নেতারা মিলে ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মজদুর ফেডারেশন গঠন করেন।[12]

অন্যদিকে দেশভাগের পর পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হলেও দুই অংশের ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে এবং কাজের সুবিধার্থে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক কমিটি তৈরি করা হয়। ১৯৫৬ সালে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, পূর্ব পাকিস্তান কমিটি পাকিস্তানের শাখা হিসাবে হিসেবে না, বরঞ্চ আলাদাভাবে পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক কাজ করবে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সোভিয়েত ও চীনের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব শুরু হলে এর প্রভাব ভয়াবহ আকারে পড়ে এখানেও। কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ কেউ চীনকে সমর্থন করেন [পিকিংপন্থী বলে পরিচিত হন], কেউ কেউ সোভিয়েতকে সমর্থন করেন [মস্কোপন্থী বলে পরিচিত হন]। প্রথমে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নে ভাঙ্গন ধরে। ১৯৬৬ সালের দিকে ভাঙ্গন ধরে মূল পার্টিতে। চীনপন্থীরা গড়ে তুলেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ) [সংক্ষেপে ইপিসিপিএমএল]। চীনপন্থীদের মধ্যে আরো বিভিন্ন উপদল দেখা দিতে থাকে। যেমন, পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন।

সোভিয়েতপন্থী ও চীনপন্থীদের মধ্যকার মোটাদাগে পার্থক্যটা এভাবে বলা যায়: “যখন মস্কোপন্থী দল সংসদীয় পথে সমাজতন্ত্র শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের তত্ত্বকে তুলে ধরছে, সকল পিকিংপন্থী দল ‘সার্বভৌম ও স্বাধীন পূর্ব বাংলার জনগণের গণতন্ত্র’ অর্জনের জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের পক্ষে কথা বলে”।[13] চীনপন্থীদের মধ্যে মৌলিক জায়গাগুলোকে মিল থাকলেও সাম্রাজ্যবাদকে প্রধান করে দেখা না দেখা, অর্থনীতি এখনো আধা-সামন্তবাদী নাকি পুঁজিবাদি হয়ে গিয়েছে, বিপ্লবের এজেন্ট কারা হবে ইত্যাদি প্রশ্নে নানা তর্ক বিতর্ক দেখা দেয়। তাদের প্রচারপত্র মূলত এই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাগুলোই বারেবারে ফিরে এসেছে: কেনো অন্যান্য চীনাপন্থীদের চেয়ে নিজের তত্ত্ব জোরালো। প্রতিটি দলই বিশ্বাস করতো, ‘সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব’ ছাড়া বিপ্লব সম্ভব নয়, ফলে সকল বিচার বিশ্লেষণে ‘সঠিক’ খোঁজার বাসনা পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে। যেমন, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ) মনে করতো পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আধা-সামন্তবাদী ও আধা-ঔপনিবেশিক। এটা উচ্ছেদের উপায় হচ্ছে ভুমিহীন কৃষক ও ক্ষুদ্র কৃষকের ঐক্যে পরিচালিত ‘জনগণের গণতান্ত্রিক বিপ্লব’। যেহেতু পাকিস্তানের দুই অংশে তাদের দ্বারা এই বিপ্লব সম্ভব হবে না, ফলে শুরু হবে পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে, পরে এটা আছড়ে পড়বে পশ্চিমে। অন্যদিকে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি মনে করতো, পাকিস্তানি অর্থনীতি আসলে বুর্জোয়া, সামন্তবাদকে আসলে বৃটিশরা ধ্বংস করে দিয়েছে। এখানে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির পথ হচ্ছে, কৃষকদের সহযোগিতায় শ্রমিকদের নেতৃত্বে ‘জনগণের গণতান্ত্রিক বিপ্লবে’র মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এই বিশ্লেষণের সাথে আবার পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ) দ্বিমত পোষণ করে। তারা পাল্টা যুক্তি দেখান যে, এই বিশ্লেষণ পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের বুর্জোয়া দ্বন্দ্বকে বড়ো করে দেখাচ্ছে, ফলে মনোযোগ শ্রেণি-শত্রু খতম থেকে সরে যাচ্ছে। এবং এটা পূর্ব পাকিস্তানের বুর্জোয়াদের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে সাহায্য করবে।[14] 

‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ যুক্তি দেখান যে, পাকিস্তান আদতে একটি আধা-পুঁজিবাদী, আধা-সামন্ত ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশ। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিরোধ হচ্ছে একদিকে ভূমিহীন ও নিম্নশ্রেণির কৃষক এবং অন্যদিকে সামন্তশক্তি। ফলে এখানে মুক্তির উপায় হচ্ছে কৃষক বিপ্লব। এবং পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক করার কর্মসূচি এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ‘পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন’ বাকি সবগুলো দলকে সংশোধনবাদী (বা নয়া সংশোধনবাদী) বলে খারিজ করে দেয়। তারা যতগুলো দ্বন্দ্ব দেখান সেখানে পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। তারাই জোরেশোরে [রাজনৈতিক মাঠে বোধহয় প্রথমবারের মতো] বলা শুরু করেন, পূর্ব পাকিস্তান আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ এবং উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। তিনি বাকি চীনপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, তারা পূর্ব পাকিস্তানকে আধা-সামন্তবাদী, আধা-ঔপনিবেশিক, আধা-পুঁজিবাদী ইত্যাদি বলে আসলে পাকিস্তানের মূল দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করেছে, এবং ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় পশ্চিম পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। ফলে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার নেতৃত্ব চলে যাচ্ছে বাঙালি বুর্জোয়াদের হাতে।[15]

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, দলগুলোর মধ্যে যেমন সূক্ষ্ম পার্থক্য ছিল, তেমনি মিলও ছিল। সকলেই সশস্ত্র বিপ্লবের পক্ষে কথা বলেছেন। বিপ্লবের ধরন হবে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক’ বা ‘জনগণের গণতান্ত্রিক’ বিপ্লব। ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ‘পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন’ এর থিসিসে: ‘সামন্তবাদের অবসান হবে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে এবং ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান সম্ভব জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে। কাজেই পূর্ব বাংলার বিপ্লব হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব।’[16] তালুকদার মনিরুজ্জামান আরেকটি বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করেন, তারা “ফ্রন্ট সংগঠনগুলোর ভূমিকাকে তুচ্ছ ভেবে …শক্ত ডেমোক্রেটিক সেন্ট্রালিজম এর মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী নীতির ওপর দলকে গড়ে তুলতে” চেষ্টা করেছিলেন।[17]

উল্লেখ্য, আইয়ুবের আমলে, বিশেষ করে আইয়ুবের পররাষ্ট্রনীতি চীনের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করলে চীনপন্থীরা কৌশলগত জায়গা বেশ বিপাকে পড়ে যান। এখানে মূল প্রশ্ন দাঁড়ায় সাম্রাজ্যবাদ। যতক্ষণ আইয়ুব সরকার সাম্রাজ্যবাদ [বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ] বিরোধী অবস্থান বজায় রাখছে ততক্ষণ তাকে রক্ষা করা কৌশলগত কারণে তারা প্রয়োজনীয় মনে করলেন। অন্যদিকে, সোভিয়েতপন্থীদের একমত ছিলেন যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ জনগণের প্রধান শত্রু, কিন্তু আইয়ূবের পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা নেই। বরঞ্চ আইয়ুব খান মার্কিন সিয়াটো ও সেন্টো চুক্তি ত্যাগ করে নি।

মুক্তিযুদ্ধ 

       একটা কথা বলা প্রয়োজন। কমিউনিস্ট পার্টিগুলো একেবারে শুরু থেকেই পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতির পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে। যেমন, পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির ১৯৫৩ সালের কর্মসূচিতে যেমন দেখা যায়, ‘পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতির পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকৃতি…’ তেমনি ১৯৬৮ সালের কর্মসূচিতে এই স্বীকৃতিকে আরো প্রসারিত অবস্থায় পাওয়া যায়, ‘পাকিস্তানের জাতিসমূহের বিচ্ছিন্ন হইবার অধিকার সহ আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করা’।[18] [ইটালিক লেখকের করা] চীনপন্থী দলগুলো কমবেশি প্রথম থেকেই বিভিন্ন নামে বা সম্বোধনে স্বাধীন পূর্ব বাংলার কথা বলে আসছে। উপরন্তু ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’ এর থিসিসে যে কেবল পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কথাই বলা হয়েছে তা নয়, এটাও বলা হয়েছে, ‘বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিকে স্বায়ত্ত্বশাসন ও বিভিন্ন উপজাতিকে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বাশাসন দেয়া হবে’।[19] অর্থাৎ, কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর থিসিস/কর্মসূচি থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, বিভিন্ন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রশ্নে কমিউনিস্টদের মধ্যে ঐক্যমত্য রয়েছে। 

উপরে উল্লিখিত দলগুলোর মধ্যেকার পার্থক্যের প্রভাব মুক্তিযুদ্ধেও এসে পড়েছিল। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জয়, ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টানাপোড়েন, মার্চের অসহযোগ আন্দোলন এইসব পেরিয়ে ২৫শে মার্চে শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম জেনোসাইড। জেনোসাইডের মুখোমুখি হয়ে একদিকে আওয়ামীলীগসহ বহু দলের নেতাকর্মীরা ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন, এবং সেখানে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা প্রবাসী সরকার গঠন করেন। অন্যদিকে যারা দেশে ছিলেন তারা দেশে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। ভারতের মাটিতে ভারতের সহযোগিতায় গড়ে তোলা হয় মুক্তিবাহিনী, সেখানেই ট্রেনিং দিয়ে পাঠানো হয় দেশের ভেতর যুদ্ধ করতে। আবার বহু স্বতন্ত্র বাহিনী গড়ে উঠে দেশের ভেতর, নিজেরা রুখে দাঁড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বিভিন্নভাবে এই পরিস্থিতিতে সাড়া দিয়েছিল। আওয়ামীলীগের সাথে সম্পর্ক কেমন হবে এটাও তখন একটা বড়ো প্রশ্ন হিসাবে হাজির হয়েছিল। কোনো কোনো দল আওয়ামীলীগের সাথে মিলেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। যেমন মণি সিংহ তাঁর একটা লেখাতে আওয়ামীলীগ ও শেখ মুজিবের সাথে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কথা পরিষ্কারভাবেই তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি বলেন, ষাটের দশক থেকেই আওয়ামীলীগের সাথে তাঁদের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাঁদের পার্টি আত্মগোপনে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে শেখ মুজিবের সাথে তাঁদের মতবিনিময় ও পরামর্শের আদান-প্রদান হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে আওয়ামীলীগ সহ একটি জাতীয় ঐক্য গঠনের নীতি তাঁরা গ্রহণ করেন।[20] কোনো কোনো দল নিজেরাই দেশের ভেতর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলে। যেমন, ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’ সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে বরিশালের পেয়ারাবাগানে গড়ে তুলে ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’।[21] সেখানে তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ১৯৭১ সালে দেশের অভ্যন্তর থেকে স্ব-উদ্যোগে যুদ্ধ গড়ে তোলার একটি অন্যতম প্রচেষ্টা দেখা যায় নরসিংদী জেলার শিবপুরে। আবদুল মান্নান ভুঁইয়া, হায়দার আনোয়ার খান জুনো প্রমুখের নেতৃত্বে সেখানে একটি বিরাট মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছিল।[22] যশোরে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) এর লড়াইয়ের কথাও জানা যায়।[23] আবার কোনো কোনো স্থানে মূল পার্টির থিসিসকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের এলাকায় ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যেমন আত্রাই এর ওহিদুর বাহিনী। পার্টির দুই কুকুরের লড়াই তত্ত্ব বা পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে একত্রে লড়াই করার পরিকল্পনাকে তারা ‘অবাস্তব ও উদ্ভট’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন, এবং ‘আওয়ামীলীগের সাথে ফ্রন্ট স্থাপন করে একসঙ্গে যুদ্ধ’ করেন পাকিস্তানিবাহিনীর বিরুদ্ধে। সরদার আমজাদ হোসেন ওহিদুর রহমানের বাহিনীকেও ‘দুই কুকুরের লড়াই’ মূল্যায়নকারীদের দলে ফেলে দিয়েছিলেন। দাবি করা হয়েছে তারাও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী ছিলেন না। ওহিদুর রহমান এর বিপরীতে জানান, “আমরা বৃহত্তর রাজশাহী জেলার কমরেডরা দুই কুকুরের লড়াই তত্ত্বটি প্রত্যাখ্যান করে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি থেকে পদত্যাগ করে রাজশাহী আঞ্চলিক কমিউনিস্ট পার্টি ধারণ করে স্থানীয়ভাবে মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলি।”[24]

মুক্তিযুদ্ধের চীনের পাকিস্তানী সরকারের পক্ষাবলম্বন চীনপন্থীদের আরো বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। তারা তত্ত্বীয়ভাবে আরো বেশি দিশেহারা হয়ে পড়েন। কেউ কেউ সরাসরি অস্বীকার করেন চীনের অবস্থানকে, কেউ কেউ অস্বীকার করলেও পাশাপাশি আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মুক্তিসংগ্রামকে মানতে নাকচ করেন। আবার কেউ তখনো সম্ভাব্য ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ দিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির থিসিসে বলা হয় আওয়ামীলীগ, সোভিয়েতপন্থী ন্যাপ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা হবে। মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার বাংলাদেশ-ভারতের পক্ষাবলম্বন তাদের এই ফ্রন্ট গঠন আরো সহজ করে দিয়েছিল। প্রবাসী সরকার যে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছিল তাতে সোভিয়েতপন্থীদের অংশগ্রহণ ছিল। 

মুক্তিবাহিনীতে বামপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আওয়ামীলীগের মধ্যে নানাবিধ অস্বস্তি ও অসন্তোষ দেখা যায়। আওয়ামীলীগের মধ্যে অনেকেই বামপন্থীদের প্রশিক্ষণ ও ফ্রন্টে যেতে দেয়ার বিষয়ে আপত্তি করেছিলেন। তদপুরি পরবর্তীতে বামপন্থীদের রিক্রুট করা হয়। এই সংক্রান্ত বিভিন্ন হিসাব পাওয়া যায়। যেমন, একটা হিসেবে দেখা যায় মুক্তিবাহিনীতে সোভিয়েতপন্থী দলের প্রায় ৬০০০ কর্মী যোগ দিয়েছিলেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তায় সোভিয়েত পন্থী কমিউনিস্ট পার্টি পৃথক যুব অভ্যর্থনা শিবির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রায় ২০,০০০ গেরিলা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে।[25] আরেকটি হিসাব থেকে দেখা যায়, নভেম্বরে ট্রেনিং সমাপ্ত হওয়ার পর ট্রেনিংপ্রাপ্তদের সংখ্যা: ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন ১৫ হাজার, মুজিব বাহিনী ১০ হাজার, ছাত্রলীগ ১০ হাজার, এবং পিকিংপন্থী ২/৩ হাজার।[26] 

পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার ব্যাপারে পুরোপুরি একমত থাকা সত্ত্বেও নেতৃত্বসহ নানাবিধ প্রশ্নে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে বিচিত্র ধরনের মনোভাব ও অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। দুটো নজির দেয়া যায়। যেমন, বহুল সমালোচিত ‘দুই কুকুরের লড়াই’ প্রচারিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) এর মুখপাত্র ‘মুক্তি যুদ্ধ’ পত্রিকায়।[27] প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ। তখন পূর্ব পাকিস্তানে চলছে অসহযোগ আন্দোলন, এমনকি ৭ই মার্চের ভাষণ দেয়া হয়ে গিয়েছে। এমন না যে পার্টি স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল, বরঞ্চ পূর্বের মতই সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ‘শোষণমুক্ত জনগণের গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা, এক স্বাধীন ও সার্বভৌম পূর্ব বাংলা’ এর পক্ষেই বারেবারে বলা হয়েছে। শেষে এও বলা হয়েছে যে, “দেশী ও বিদেশী শোষক দস্যুদের হাত হইতে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন না করা পর্যন্ত আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম চলিবেই চলিবে”। যখন পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছে তখন যে বাংলায় এক বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেটাও তারা উল্লেখ করেছেন। তৎকালীন স্লোগান, জনগণের অংশগ্রহণ ইত্যাদি প্রমাণ করে “জনগণ চান বিপ্লব, জনগণ চান বর্তমান শাসন-শোষণ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ, চান এক শোষণমুক্ত পূর্ব বাংলা, চান স্বাধীনতা ও মুক্তি”। ফলে স্বাধীনতা ও বিপ্লবী পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মধ্যে ন্যূনতম কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের যুক্তি মূলত দুটো। প্রধান যুক্তি হলো, ‘বাঙ্গালি জাতির মুক্তির আন্দোলন’ নামে শেখ মুজিব যে ‘অহিংস অসহযোগ আন্দোলন’ শুরু করেছেন সেটা কোনোভাবেই মুক্তির আন্দোলন নয়। ‘ইহা হইল এক বিরাট ধাপ্পা’। তিনি কেবল পশ্চিম পাকিস্তানি ধনিকদের স্থলে বাঙালি ধনিকদের প্রতিস্থাপন করিতে চান। ফলে তাদের কাছে মনে হয়েছে, “ইয়াহিয়া ভুট্টো প্রভৃতির সহিত মুজিবের লড়াই হইলো: পূর্ব বাংলার বাজারকে লুটপাট ও ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা লইয়া মার্কিনের পা-চাটা দুই কুকুরের মধ্যে লড়াই”। এই হচ্ছে বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) ‘দুই কুকুরের লড়াই’ তত্ত্ব। এর পরেই আসে তাদের দ্বিতীয় যুক্তি, প্রথমটার সম্পূরক হিসেবে। শেখ মুজিব যে শর্ত দিয়েছেন (তার ভাষণে) সেগুলো পূরণ করলে কী পূর্ব বাংলার মুক্তি অর্জিত হবে? তাদের উত্তর হচ্ছে নেতিবাচক। কারণ শর্তানুযায়ী “সেনাবাহিনী ব্যারাকে চলিয়া গেলেও ক্ষমতাসীন শাসন শোষকদের হাতেই সেনাবাহিনী থাকিতেছে”। এবং “আওয়ামীলীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হইলেও এবং ইয়াহিয়ার তৈরি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসিলেও জনগণের হাতে ক্ষমতা আসিবে না; জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জিত হইবে না; পূর্ববাংলা স্বাধীন ও সার্বভৌম হইবে না।” এই দুই যুক্তি দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি অনুমানের ওপর, “বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া পার্টির নেতৃত্বে মুক্তি সম্ভব নয়”। অর্থাৎ, ‘দুই কুকুরের লড়াই’ তত্ত্ব আসলে মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতাকে খারিজ করে দেয়নি, বরঞ্চ আওয়ামীলীগ ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বকে খারিজ করতে চেয়েছে। 

দ্বিতীয় নজির হচ্ছে সিরাজ শিকদারের পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ৮ জানুয়ারি একটি দলিল প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর সাথে পূর্ববাংলার জনগণের দ্বন্দ্ব প্রতিদিন তীব্র হচ্ছে। “আওয়ামীলীগ জনতাকে এর বিরুদ্ধে পরিচালিত না করে এ ষড়যন্ত্রে হাত মিলিয়েছে এবং পূর্ব বাংলার উপরন্তু শোষণ নিপীড়ন সমাধানের জন্য শান্তিপূর্ণ ও সংস্কারবাদী পথ ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কথা বলেছে”। তাঁরা আরো বলেন যে, যেহেতু সামরিক বাহিনী হলো পাকিস্তানি শাসকদের ক্ষমতার প্রধান উপাদান, সেহেতু ‘গণবিরোধী এই সশস্ত্র বাহিনী”কে পরাজিত ও ধ্বংস করা ব্যতীত জনগণের কোনো উপকারই করা সম্ভব হবে না। ফলে আওয়ামীলীগের সামনে দুটো রাস্তা খোলা রয়েছে: সশস্ত্র সংগ্রাম ও আপোষ। “আওয়ামীলীগের শ্রেণিভিত্তি প্রমাণ করে ইহা শেষোক্ত পথ অনুসরণ করেছে যার পরিণতি হলো জনগণের স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।” সেখানে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রীয়করণের আওয়ামী নীতিকে ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’ আখ্যায়িত করা হয়। “ইহা জনগণের পরিবর্তে দুর্নীতিপরায়ণ আমলা-ম্যানেজার প্রভৃতিদের স্বার্থ রক্ষা করে।”[28] মার্চের ২ তারিখ আওয়ামীলীগের উদ্দেশ্যে সিরাজ শিকদারের একটি খোলা চিঠি প্রকাশিত হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেখানে আওয়ামীলীগের জনপ্রিয়তা ও জনভিত্তিকে মেনে নেয়ার ইশারা পাওয়া যায়। শুরুতেই বলা হয়, “আপনার ও আপনার পার্টির ছয় দফা সংগ্রামের রক্তাক্ত ইতিহাস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবীসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাধীন করে।” অর্থাৎ এখানে ছয় দফার সমালোচনা না করে বলা হচ্ছে, এটাকে বাস্তবায়ন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিদ্যমান কাঠামো না ভাঙলে হবে না। এতে ‘পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা’, ‘অস্থায়ী সরকার কায়েম’, ‘জাতীয় মুক্তি পরিষদ বা ‘জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট’ গঠনের আহ্বান জানানো হয়। শেষে বলা হয়: পূর্ব বাংলার জনগণ রক্তের বিনময়ে প্রমাণ করেছে স্বাধীনতার চাইতে প্রিয় তাদের নিকট আর কিছুই নেই।”[29] ২০ এপ্রিল প্রকাশিত আরেকটি রচনায় উপরোক্ত পরামর্শ না মানার কারণে আওয়ামী নেতৃত্বের সমালোচনা করা হয়। বলা হয়, “শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের প্রস্তাব আগ্রাজ্য করে, অহিংস অসহযোগের ভুল পথে লেগে থাকে, স্বাধীনতা ঘোষণা, সরকার গঠন ও মুক্তিফ্রন্ট গঠনে বিরত থাকে। এভাবে জনসাধারণকে তারা ফ্যাসিবাদী হামলার মুখে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও নেতৃত্বহীন করে রাখে।”[30] শেষ বাক্যে উচ্চারিত সমালোচনা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে আরো বহুজনের কাছ থেকেও শোনা গিয়েছে। সংক্ষেপে, মুক্তিযুদ্ধ ও পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) ও পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন একমত থাকলেও আওয়ামীলীগ ও নেতৃত্ব নিয়ে বিচিত্র মত দেখা যাচ্ছে। আবার সময়ের সাথে আওয়ামীলীগের প্রতি মনোভাবেও পরিবর্তন দেখা যায়। স্বাধীনতা ও মুক্তিকে সংজ্ঞায়িত করা, এবং তা আদায়ে কৌশলের ভিন্নতা সিদ্ধান্তের ভিন্নতা তৈরি করেছিল।   

যুদ্ধ: ভেতর-বাহির

          মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের কেবল পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধেই যে লড়তে হয়েছে তা নয়, অন্যান্য প্রতিকূলতারও সম্মুখীন হতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় মুজিব বাহিনী। যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রতি তারা ছিল বৈরীমনোভাবাপন্ন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের আসনে তাজউদ্দীনকে তারা মানতে চায়নি। মইদুল হাসান ‘মুজিব বাহিনী’র বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ করেছেন, কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। ওনার বরাত দিয়ে অভিযোগের একটা তালিকা আলতাফ পারভেজ তাঁর গ্রন্থে তুলে ধরেছেন: “স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিভক্ত করা; বামপন্থীদের বিরুদ্ধাচরণ করা; সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া; মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে স্বংঘর্ষে অবতীর্ণ হওয়া; মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করা; এবং তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ ও তার প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র।”[31]

বিভিন্ন সূত্র ধরে বলা যায় যে, মুজিববাহিনী গঠনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, যদি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব কোনোক্রমে বামপন্থীদের হাতে চলে যায় তাহলে সেটা দমন করা। মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার বলেন,

“এই মুজিব বাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে সে সময় সেক্টর অধিনায়কদের কাছে থেকে শুনে, জেনে এবং অন্যান্য উৎসে প্রাপ্ত তথ্য থেকে মনে হয়েছিল যে তারা বর্তমান চলমান যুদ্ধের বিষয়ে যতটা না আগ্রহী, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী বা তৎপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের করণীয় বা ভূমিকা নিয়ে। … সেই সময় ভারতে যে নকশাল আন্দোলন চলছিল এবং সে আন্দোলন ক্রমশ বেশ জোরদার হয়ে উঠছিল, তৎপর ছিল। এর ফলে গেরিলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ যদি বামপন্থী হয়ে যায়, নকশাল আন্দোলনের প্রতি যদি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে, তাহলে ভারত সরকার মুজিব বাহিনীকে নকশালিদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করবে। তা ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও যদি বামপন্থীদের হাতে চলে যাওয়ার পর্যায়ে পৌছায়, তাহলে এই বাহিনীকে ব্যবহার করা হবে। …এ প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলা দরকার। তখন যে অভিযোগগুলো আসত, তার সবই যে লিখিত আকারে আসত তা নয়, মৌখিকভাবেও জানানো হতো। …মুজিব বাহিনী সম্পর্কে অভিযোগ আসত সেক্টর অধিনায়ক, সাব-সেক্টর অধিনায়ক, এমনকি সাধারণ গেরিলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকেও।”[32]

প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গঠিত যুব শিবিরের মহাপরিচালক এস আর মীর্জা। তিনি বলেন,

“মুজিব বাহিনীতে একটি বিষয় লক্ষ করেছি, এই বাহিনীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবার ছাড়া কোনো গরিব কিংবা চাষি পরিবারের ছেলেদের নেওয়া হয়নি। কোনো শ্রমজীবী মানুষকেও এই বাহিনীতে নেওয়া হয়নি। তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল এই আন্দোলন বা যুদ্ধ যাতে বামপন্থীদের হাতে চলে না যায়। সে জন্যই কোনো গরিব মজদুর, চাষি বা সাধারণ ঘরের মানুষকে নেওয়া হয়নি। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের যে গেরিলা বা গণবাহিনী সার্বিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের ৭০ ভাগই ছিল বিভিন্ন শ্রেণীর বিশেষত কৃষক পরিবারের। আমি মুজিব বাহিনীর বেশ কিছু সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা সবাই বেশ ভালো, শিক্ষিত, স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মুজিব বাহিনীতে যেসব ছেলে নেওয়া হয়, সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানতে পারিনি বা জানতে দেওয়া হয়নি। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গেই এ কাজটি করা হয়।”[33]

বামপন্থীরা বিভিন্ন স্থানে মুজিব বাহিনী, এমনকি মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। সিরাজ শিকদার মুক্তিযুদ্ধকালে বিভিন্ন দলিলে তার কিছু নজির তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামীলীগের লোকেরা তাদের অনেক সদস্যকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছিল। যেমন একাত্তরের আগস্ট মাসে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়। ঢাকার সাভার এলাকায় সিরাজ শিকদারের পার্টির সদস্যরা সক্রিয় ছিলেন। আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতা আলোচনার আহ্বান জানালে পার্টির কয়েকজন গেরিলা সদস্য যান। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন সামিউল্লাহ আজমী। চেয়ারম্যানের কাছে গেলে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে তাদেরকে হত্যা করা হয়। তাদের সন্ধানে পার্টি থকে পরপর দুজন কুরিয়ার পাঠান হলে তাদেরকেও হত্যা হয়।[34] নরসিংদীর শিবপুরকে মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলা ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ এর স্থানীয় প্রধান সংগঠক আবদুল মান্নান ভুঁইয়াকে হত্যার জন্য যুদ্ধকালেই মুজিব বাহিনীর একটি ছোট দল এসে হাজির হয়েছিল বলে জানা যায়।[35] যশোরের পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) এর নূর মোহাম্মদ লিখেন, “…রাজাকার ও পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধরত এলাকায় মুক্তিবাহিনী-মুজিববাহিনীর পক্ষে সশস্ত্র শক্তির কিছুটা ভারসাম্যগত পরিবর্তন হতেই মুক্তিবাহিনী-মুজিববাহিনী ন্যূনতম কোনো অজুহাত ছাড়াই আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, চালাল নির্মম হত্যাকাণ্ড। মনে হলো রাজাকার বা পাকবাহিনী নয়, আমরাই তাদের পয়লা নাম্বারের শত্রু।” নূর মোহাম্মদ বিভিন্ন জনের বরাত দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষ ও মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পিত আক্রমণের কিছু ঘটনা উল্লেখ করেন তার বইতে।[36]

বাম রাজনীতি: সফলতা-ব্যর্থতা

        প্রবন্ধের শুরুতে বামধারার রাজনীতিকে সফল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে; পাকিস্তান আমল জুড়ে পূর্ব বাংলায় যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছিল সেটাকে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখার জন্য। গবেষকরা এটাকে আদর্শিক বিপ্লবও বলেও সাব্যস্ত করেছেন। সফলতা বা ব্যর্থতাকে কেবল রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল দিয়ে বিবেচনা করার ফলে এই দিকটা অনেকসময় আড়ালে পড়ে যায়। তদুপরি কৃষক-শ্রমিকের পাশে থাকলেও নেতৃত্ব প্রদানে বামপন্থী রাজনীতির ব্যর্থতাকে অনেকেই অনেকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ কেউ অনেকগুলো দল-উপদল তৈরি এবং নিজেদের মধ্যকার রেষারেষিকে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, কেউ কেউ ‘সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব’ বা লাইন নির্ধারণ না করতে পারাকে চিহ্নিত করেছেন, কেউ কেউ বলেছেন, সঠিক তত্ত্ব হওয়া সত্ত্বেও কৌশলে ভুল ছিল। কেউ কেউ বামপন্থীদের মধ্যে মধ্যবিত্তসুলভ ‘দোষ’ এর উপস্থিতিকেও দায়ী করেছেন। আহমেদ কামাল বরঞ্চ একটু অনালোচিত একটি দিকে আলোকপাত করেছেন।[37] তিনি একটি গভীর সঙ্কটের দিকে ইশারা দিয়েছেন। সংক্ষেপে এটা বলেই আলাপের ইতি টানবো।                                    

আহমেদ কামাল সাপ্তাহিক গণশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত ১৯৭০-৭১ এর কৃষক আন্দোলনের সংবাদকে বিশ্লেষণ করে সেই আন্দোলনের প্রতি তাদের মনোভাবকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। গণশক্তি পত্রিকা মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ ও মাওবাদের চিন্তাধারা তুলে ধরে পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে শ্রেণি সংগ্রামকে তীব্রতর করতে চেয়েছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের যে ছোট ছোট এলাকাভিত্তিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল এবং স্বতঃস্ফূর্ত যে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল সেটাকে গণশক্তি অবজ্ঞা করে বিবেচনা করে। বলা হয় যে “এ সংগঠনগুলির কোনো রাজনৈতিক চরিত্র নেই।” কৃষকেরা নিজেরাই যেখানে আন্দোলন সৃষ্টি করছিলেন সেখানে পার্টি ‘হতবাক দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এ আন্দোলনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল।” আন্দোলনকে নেতিবাচকভাবে আখ্যা দিয়েছে “স্বতঃস্ফূর্ত” বলে। এটাও উল্লেখ্য, মোহাম্মদ ফরহাদ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে গিয়ে প্রধান ও প্রথম দুর্বলতা হিসাবে উল্লেখ করেন, “এটা ছিল মূলত স্বতঃস্ফূর্ত গণ-বিক্ষোভ”।[38] আহমেদ কামাল এই অবজ্ঞার সুলুক সন্ধান করেছেন খোদ লেনিনের তত্ত্বের মধ্যেই: “আমাদের কাজ হচ্ছে, সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কাজ হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততার বিরুদ্ধে লড়াই করা”। [ভি.আই.লেনিন, কী করিতে হইবে] কৃষক আন্দোলনকে ‘স্বতঃস্ফূর্ত ও অরাজনৈতিক’ ইত্যাদি না বলে বা এভাবে অবজ্ঞা না করে উচিৎ ছিল “ঐ সকল অশুদ্ধ কর্মকাণ্ডের জটিলতা উন্মোচন করা, ঐতিহাসিক জীবন প্রক্রিয়াকে তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা, নিম্নবর্গের উদ্যোগকে খুঁজে বের করা এবং সর্বোপরি লুকিয়ে থাকা শ্রেণি চেহারাটা খোঁজা যাকে বিকশিত করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করা যাবে।” গণশক্তি তা না করে অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদে আচ্ছন্ন ছিল। যেখানে জাতিগত বৈষম্য বিদ্যমান সেখানে নিছক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বলে কিছু থাকে না, অর্থনীতির অন্তর্গত সকল সম্পর্কই ক্ষমতার সম্পর্ক, রাজনীতির সম্পর্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। “গণশক্তির দৃষ্টি এই রাজনীতি বাদ দিয়ে অর্থনীতির মধ্যে আটকে ছিল।” আহমেদ কামাল সাবল্টার্ন স্টাডিজের তত্ত্বীয় কাঠামোকে ব্যবহার করে বলেন, গণশক্তির উদ্দেশ্য ছিল মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ ও মাওবাদের ভিত্তিতে জনগণকে সংগঠিত করা, ফলে পূর্ব বাংলার কৃষক তার মনোযোগের মুখ্য বিষয় আর থাকে নি, “সে নিজেই হয়ে উঠেছে সাবজেক্ট।” ফলে তারা নিপীড়িত জনগণের প্রতিনিধি হতে পারেনি, অবস্থান নিয়েছিল কৃষকের বিচিত্র জীবনের বাইরে। ফলে “পূর্ব বাংলার সমাজে সর্বেশ্বরতার প্রতিযোগিতায় গণশক্তির রাজনীতি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে, আর অন্যদিকে আওয়ামীলীগ প্রতিনিধিত্ব করে বিকাশমান বাঙালি জাতির। কৃষকের মধ্যে জাতির অবয়ব দেখতে ব্যর্থ হয় গণশক্তি।…হেরে যায় গণশক্তি।

আহমেদ কামাল এখানে গণশক্তির পরাজয়ের ভেতর দিয়ে যে গভীর দার্শনিক ও রাজনৈতিক সংকটের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, এখানকার সামগ্রিক বামপন্থী রাজনীতির ব্যর্থতার মধ্যেও সেটা পাওয়া যাবে।     

দোহাই

[1] মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মাও সেতুং এর দেশে, সংহতি, ২০২০; শেখ মুজিবুর রহমান, আমার দেখা নয়া চীন, বাংলা একাডেমি, ২০২০

[2] শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, ২০১২

[3] তারিক আলী, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ: জান্তা না জনতা, (অনুবাদ মাহফুজ উল্লাহ), বাংলা একাডেমি, ১৯৯৭, মূল গ্রন্থ: ১৯৭০

[4] হায়দার আকবর খান রনো, “উত্থাল ষাটের দশক”, নতুন দিগন্ত, এপ্রিল-জুন, ২০১৬

[5] আহমদ ছফা, সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০১৭ (দ্বিতীয় সংস্করণ)

[6] তালুকদার মনিরুজ্জামান, বামপন্থী রাজনীতি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলা একাডেমি ২০০৭; এই প্রবন্ধে বিভিন্ন কমিউনিস্ট দল সম্পর্কিত তথ্যের ক্ষেত্রে এই গ্রন্থের ব্যাপক সাহায্য নেয়া হয়েছে।  

[7] আহমাদ ইশতিয়াক, খাপড়া ওয়ার্ড: দেশের ইতিহাসে প্রথম জেল হত্যা, ডেইলি স্টার, এপ্রিল ২৪, ২০২১

[8] শেখ আকরাম আলী, গোপন দলিল ৭০-৭১, বাংলাদেশ বুক ক্লাব, ২০১৪

[9] হাসান ফেরদৌস, ১৯৭১ বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া, প্রথমা

[10] তারিক আলী, প্রাগুক্ত

[11] উদ্ধৃতি: তারিক আলী, প্রাগুক্ত

[12] তালুকদার মনিরুজ্জামান, প্রাগুক্ত

[13] প্রাগুক্ত

[14] প্রাগুক্ত

[15] প্রাগুক্ত

[16] পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস, ৮ জানুয়ারি ১৯৬৮

[17] তালুকদার মনিরুজ্জামান, প্রাগুক্ত

[18] মুর্শিদা বিনতে রহমান, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের দলিলপত্র: মস্কোপন্থি, প্রথম খণ্ড, সময়, ২০২০

[19] পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস, ৮ জানুয়ারি ১৯৬৮

[20] শাহীন রহমান (সম্পা.), আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী,  ২০১১

[21] মহিউদ্দিন আহমদ, লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি, বাতিঘর, ২০২১

[22] হায়দার আনোয়ার খান জুনো, একাত্তরের রণাঙ্গন: শিবপুর, সংহতি, ২০১১

[23] নূর মোহাম্মদ, একাত্তরের যুদ্ধ: যশোরে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) এর বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও জীবনদান, সংহতি,  ২০১৬

[24] ওহিদুর রহমান, মুক্তিসংগ্রামে আত্রাই, সংহতি, ২০১২

[25] তালুকদার মনিরুজ্জামান, প্রাগুক্ত

[26] মইদূল হাসান, মূলধারা ৭১, ইউপিএল, ২০১৩

[27] নেসার আহমেদ (সম্পা.), মুক্তি যুদ্ধ, ঐতিহ্য, ২০১০

[28] পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের দলিল: স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েম করুন, ৮ জানুয়ারি ১৯৭১

[29] পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের দলিল: শেখ মুজিব ও আওয়ামীলীগের উদ্দেশ্যে পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের খোলা চিঠি, ২ মার্চ ১৯৭১

[30] পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের দলিল: শেখ মুজিব ও তাজুদ্দিনের নেতৃত্বে ভারতে গঠিত পূর্ব বাংলার ‘জনগণের প্রজাতান্ত্রিক সরকার’ প্রসঙ্গে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন, ২০ এপ্রিল ১৯৭১

[31] মইদুল হাসান, প্রাগুক্ত; আলতাফ পারভেজ, মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনর্পাঠ, ঐতিহ্য, ২০১৫। মুজিব বাহিনী নিয়ে মাঠ পর্যায়ের গবেষণা ও দীর্ঘ পর্যালোচনার জন্য আলতাফ পারভেজের বইটি দেখা যেতে পারে।   

[32] এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কথোপকথন, প্রথমা, ২০১৬  

[33] প্রাগুক্ত

[34] মহিউদ্দিন আহমদ, প্রাগুক্ত

[35] হায়দার আনোয়ার খান জুনো, প্রাগুক্ত

[36] নূর মোহাম্মদ, প্রাগুক্ত

[37] আহমেদ কামাল, কালের কল্লোল: ইতিহাস, উন্নয়ন ও রাজনীতি, সংহতি, ২০১৮

[38] মোহাম্মদ ফরহাদ, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, দ্যু প্রকাশন, ২০১৯

প্রচ্ছদঃ মিতা মেহেদী

*****