এমন একটা মুসাবিদা করা এমন দিনে খুবই মুশকিল যেখানে মুক্তি অর্জনের উদযাপন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলির দিকে মুখ ফেরায়। পঞ্চাশ বছরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-স্মারক গৌরবের সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই গৌরবের অর্জনকে বহন করার সক্ষমতা কি আমাদের আছে? সেই উত্তরাধিকারে কি আমাদের অংশ আছে? এর উত্তর খুঁজে পাই প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি, প্রতি ৭ মার্চ, প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর। পড়শীর উদযাপনের কাছে যাই নিজেকে প্রত্যয়ী করার জন্য, আমারই মধ্যে এক অন্য ‘আমি’কে খুঁজে পাই—জাগিয়ে রাখে মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির ফেলে আসা এক শতাব্দীর সর্বাত্মক সংগ্রামের স্মারক।
১৯৪৭ এর পার্টিশন উপমহাদেশের মানচিত্রে যে অস্বাভাবিক ‘কীটদষ্ট’ পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল তার অস্তিত্ব আজ আর নেই। একাত্তরের জীবনযুদ্ধ দুহাজার মাইল দূরের শাসকের ছল-কৌশলী আগ্রাসনকে পরাস্ত করে জিতে নিয়েছিল নতুন এক আত্মপরিচয়। ১৯০৫ এর বিভাজনের পর থেকে উপর্যুপরি আরও দু-বার বিভাজনের যে খরসান পথ ধরে বাঙালি এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আজ—তার নির্ণায়ক মীমাংসা ছিল মুক্তিযুদ্ধ। বিশের দশকে এমন স্বপ্ন অনেকেই দেখেছিলেন, স্বাভাবিক কারণেই তার স্বপক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন, কিন্তু একাত্তরের মীমাংসা আমাদের সেই দাবীর এক করুণ পরিণতির সামনে এনে দাঁড় করায় আমাদের। ১৯৪৭ এর ভাঙন থেকে ১৯৫২তে পৌঁছানো, ১৯৫৪ এর নির্বাচনে জয়লাভ করার পরেও সামরিক শাসনে মুখে পড়ে যাওয়া ১৯৫৮তে, ১৯৬৬ এর ছয় দফার দাবী থেকে ১৯৬৯ এর গণ-আন্দোলনের পথে এগিয়েছে পূর্ব-বাংলার মুক্তিকামী মানুষ; শুরু করেছিল তার ন’মাসের সর্বাত্মক অন্তিম মরণপণ সংগ্রাম ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, প্রায় ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন ষোলই ডিসেম্বর, ১৯৭১। রমনা রেসকোর্স ময়দানে পাক সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের মধ্যে দিয়ে আপাতত শান্তিকল্যাণ এসেছিল নতুন বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বরের এই মহাযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত ও ‘হয়ে ওঠা’র বিশ্লেষণ আজও হয়ে চলেছে নিরন্তর। ১৯৭১ এর ১ মার্চ গভীর রাতে ইয়াইয়া খানের রেডিও-বার্তায় জানা গেল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত। এর প্রতিক্রিয়ায় পরের দিন থেকে অসহযোগ আন্দোলন—সর্বাত্মক ঘোষণা এল শেখ মুজিবুর রহমানের রমনা মাঠে ৭ মার্চের ভাষণে। বেগতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করলেন। পূর্ব-পাকিস্তানের নির্বাচিত জননেতাকে বাইরে রেখে আলোচনার কথা একজন স্বৈরাচারী শাসকের মতই ঘোষণা করে চলেছিলেন তিনি। ৬ মার্চ পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্ণরের পদ থেকে ভাইস এডমিরাল আহসানকে সরিয়ে লেফটেন্যন্ট জেনারেল টিক্কা খানকে নিয়োগ দেওয়া হল; ২৫ মার্চ থেকে শুরু হয়ে গেল গণহত্যার পর্ব—এক অদ্ভুত অন্ধকারের সময়কাল। আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ অথবা জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ যে আখ্যান ধরে আছে। সে ইতিহাসের বিস্তারে যাওয়ার অভিপ্রায় এখানে নেই। পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে আল বদর, আল শামস বাহিনী যুক্ত হয়ে ভয়াবহ আগ্রাসনের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল মুক্তি বাহিনীকে। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের সেই অবিস্মরণীয় যুদ্ধের বিভিন্ন প্রায়োগিক ও কৌশলগত দিক রয়েছে, ভারতের সাহায্যের প্রসঙ্গ রয়েছে—সবকিছু নিয়েই প্রচুর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু হিংসা-আক্রমণ-হুমকির মুখে পড়ে যেসব মানুষেরা দেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিল তাদের প্রসঙ্গ সূত্রেই প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল পার্টিশনের বিভাজিত বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম আমাদের সেই মানুষগুলির কাছে ফিরিয়ে আনে—চিনতে শেখায় আত্ম-অপর। উত্তর প্রজন্মের দায় সেই চেনা-জানার সঙ্গে সংলগ্নতার—সেইসব ইতিহাস অস্বীকৃতির প্রয়াসের বাইরে এসে দাঁড়ানোর।
দূরের মুক্তিযুদ্ধঃ এপার থেকে দেখি
আজ পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য কি সত্যিই এমন আপন কোনো স্মৃতি? এমন কোনো চোয়াল শক্ত করা জীবনযুদ্ধ যা প্রতি পলে শ্রদ্ধা অর্জন করে নেয়? আমাদের সমাজ-পরিবারের পরিসরে কি সেই স্মৃতির সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে বাড়িয়ে দেওয়া যায় সহমর্মিতার হাতখানি—উত্তর প্রজন্মের কি সেই দায় আছে? এমন কোনো বিভাজনরেখা কি ফল্গুধারায় আজও বয়ে চলে সমাজ পরিসরে—যেখান থেকে পরিত্রাণ নেই! এসব কথাই মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পর ভাবতে বসায়। এই কলকাতা শহরে, এই ২০৯৪ মাইল সীমান্তের এপার-বাংলার এক জটিল পার্টিশনোত্তর উদ্বাস্তু-সংমিশ্রিত জনগোষ্ঠীর অধিমানসের কিনার ধরে হাঁটতে শুরু করে উত্তর প্রজন্মের বিবেক। এই প্রজন্ম সেই হন্তারক সময় দেখে নি, সেই সময়ের দাগ আঁচড় কাটে নি তার চেতনায়—সামাজিক নৈতিকতার প্রত্যয়ী চেহারা ভেঙেচুরে একাকার হয়ে আছে তার চারপাশে। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য কীভাবে বয়ে বেড়াবে সে? এই পশ্চিমবঙ্গে! এই ভারতবর্ষে? স্মৃতি-কন্ডুয়নের নৈমিত্তিক প্রবাহ থেকে যেমন বাঙালির পরিত্রাণ নেই তেমনই যুদ্ধ জয়ের শিহরণ গায়ে মেখে সে রোমাঞ্চ অনুভব করে, টুকরো-টাকরা জুড়ে নেয় দূরের সম্পর্ক, একরকম মহান ঐতিহ্য পরম্পরায় নিবদ্ধ হবার হাতছানি উপেক্ষা করার সাহস তার হয়ে ওঠে না। পশ্চিমবঙ্গের ভারতবাসী, ভারতবর্ষ তার দেশ—তার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের যুগপৎ দায় নিয়ে আশ্চর্য দাঁড়িয়ে থাকে আসমুদ্র হিমাচল। এক সংমিশ্রিত সংস্কৃতির বহুধা বিভক্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেই তার বিস্তার; তার জন্য পড়ে থাকে একরকম প্রান্তিকতা—দেশ ও রাষ্ট্রের এক নিরুচ্চার বিবিক্তি। যে ঐক্য ভারতবর্ষের শতধারার সাংস্কৃতিক বিস্তারকে টেনে রাখে সেখানে যে অনেক ভাষাভাষী মানুষের মতই একা—আবার যে ভাষা একটা গোটা দেশ জিতে নিল একাত্তরে সেখানেও সে হারানোর ব্যথায় মুহ্যমান। পঞ্চাশ বছর পর তার জন্য যে নৈতিকতাটুকু অবশিষ্ট থাকে তার থেকে রসদ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, বহুভাষিক যে রাষ্ট্রিক পরিসরে তার দিনযাপন সেই পরিসর থেকে অনেক দূরে মুক্তিযুদ্ধ—অনেক দূরে সেই গর্বোজ্জ্বল লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে জিতে নেওয়া মুক্তির আস্বাদ!
এই পর্যন্ত বলে কি ইতিহাসের দায় থেকে বেরিয়ে আসতে চায় আজকের প্রজন্ম। একাত্তরের পরে কেটে গেছে যে কাল, পেরিয়ে গেছে একটা শতাব্দী, আশ্চর্য ছোট হয়ে যাওয়া এক পৃথিবীতে প্রযুক্তির অত্যাশ্চর্য পরিণতি সাজিয়ে দিয়েছে তরুণ-তরুণীর সামুহিক স্বপ্নগুলি, সেই কালের ঘেরাটোপ থেকে তাহলে কি অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধ? বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা এক প্রজন্মের শৌর্য-স্মারক? ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে একটু উল্টে-পালটে দেখলেও এমন একটা ভাবনার ঘের হয়ত উঠে আসবে। ১৯৪৭ এর কয়েক বছর আগেও মুসলমানের জন্য একটা আস্ত দেশ কেড়ে নিতে হবে এই অখণ্ড ভারতবর্ষের মানচিত্র ছিঁড়ে কেটে—এমনটা ভাবেননি স্বয়ং জিন্নাহ। গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেল অথবা মৌলানা আজাদ ইংরেজদের ধর্মীয় বিভাজনের কারসাজি রুখতে কোনো প্রয়াসই নেন নি এমনটাও ইতিহাস বলে না। হিন্দু-মুসলমান একত্রে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যের জীবন কাটিয়েছে একথা যেমন সত্য, তেমনই নির্মম সত্য হল সংখ্যাগুরু উচ্চবর্গীয় হিন্দুর জীবনচর্যার অন্তরমহলে পড়শী মুসলমানের স্থান সঙ্কুলান। ভেতরের এই ভেদরেখা নিয়ে ঐক্যের চর্চা যে আন্তরিক হতে পারে না এমন সতর্কবাণী রবীন্দ্রনাথ বিশের দশক থেকেই শুনিয়েছেন; চিত্তরঞ্জন দাশ থেকে শুরু করে সুভাষচন্দ্র বসু সকলেই পারস্পরিক সৌহার্দ্যের প্রতি নিষ্ঠাবান হয়ে ভিন্নতর রাজনৈতিক বয়ান উপস্থাপন করেছিলেন। এ.কে.ফজলুল হকের উত্থান, মৌলানা ভাসানীর সমন্বয়ী চিন্তাসম্ভূত রাজনৈতিক চিন্তা-পরিসর, আবুল হাশিমের বঙ্গ-কংগ্রেসের রাজনীতির কেন্দ্রীয় পরিসরে উঠে আসাকে এই প্রচেষ্টার প্রলম্বিত পরিণতি দেখা যায়, কিন্তু তবু তো কার্যত দাগ কাটে নি অখণ্ড বাংলার দাবী—সোহরাবর্দীর মত রাজনীতিজ্ঞের সমর্থনেও জমি পায় নি একটা অখণ্ড আস্ত বাংলার বাস্তব চাহিদা। হারিয়ে যাওয়া সাতচল্লিশের পর যখন একাত্তরের বাংলাদেশ জেগে উঠল তখন এক আশ্চর্য ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হলাম আমরা। দেশ জিতে নেওয়া গেল, বাংলা ভাষাভাষীরাই সেই দেশের কর্তাব্যক্তি—কিন্তু সেও এক কাটাছাঁটা দেশ। সাতচল্লিশের স্বাধীনতার মত কাটাছাঁটা মানচিত্র—যা ক্রমশ বাঙালি মুসলমানের দেশের দিকে এগোতে থাকল। তাহলে কি বাঙালি মুসলমান একটা ‘দেশ’ চেয়েছিল? না কি স্বাধীন শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার মত একটা ব্যবস্থা না পেয়ে একটা আস্ত দেশই জিতে নিতে হল তাদের? মুক্তির জন্য তাদের প্রাণপণ চোয়াল শক্ত করা যুদ্ধ, ভেঙে যাওয়া দেশের একপ্রান্তে থাকা বাঙালির কাছে সত্যিই এক মানসিক বিজয়ের স্বাদ নিয়ে এল। যেন যে ভবিতব্য আটকানো যায় নি সুযোগ পেয়ে তাকেই পরাভূত করার নিঃস্বার্থ এক সহমর্মিতার নিরীক্ষা হয়ে গেল একাত্তরে। যে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যের বেঁচে থাকা নির্মমভাবে আক্রান্ত হয়েছিল সাতচল্লিশে, প্রজন্ম হন্তারক পার্টিশনের এক প্রত্যুত্তরের সুযোগ এসেছিল একাত্তরে। নীরব মমতাময় সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাত রাষ্ট্রের সম্মতিতে শক্তিশালী হয়েছিল একথা ঠিক—কিন্তু তাতে গুরুত্বহীন হয়ে যায় না সাধারণ মানুষের সেই প্রতিস্পর্ধার শক্তি। যে দেশে সে আর ফিরবে না সেই ‘দেশ’ হয়ে ওঠার জন্য তার স্বপ্ন। একে হিন্দু অথবা মুসলমানের স্বপ্ন বলে চিহ্নিত করা যায় কি? বাঙালির একটা নিজস্ব দেশের স্বপ্ন—অখণ্ড দেশ হতে পারল না বটে খণ্ডিত বাঙালির দেশ তো হল! দূরে রয়ে গেল তাই মুক্তিযুদ্ধ—যে যুদ্ধে এপারের অগণিত বাঙালি নিরন্তর জীবনের হিসাব মিলিয়ে যেতে থাকল।
একথা অন্যত্র অনেকবার বলেছি যে, পার্টিশন ও মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য দৈশিক স্থান-কাল পরিপ্রেক্ষিতের ওপর নির্ভরশীল। ঢাকায় পার্টিশনের চর্চার পরিসর ও কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য আলোচনার পরিসর ভিন্ন মাত্রার হতে বাধ্য। বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্র উদ্ভবের পর ঢাকার জনপরিসরে ক্রমশই প্রান্তিক হয়েছে পার্টিশন থেকে দেশভাগ চর্চার প্রেক্ষিত; বিদ্যায়তনিক স্তরেও সেই রেওয়াজ ক্রমশ জোরদার হয়েছে। নতুন জাতিরাষ্টের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত এই চর্চার অভিমুখ বদলে দিয়েছে। তেমনই এপার বাংলায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পৌনঃপুনিকভাবে ফিরে গেছে সাতচল্লিশের দেশভাগে—সব হারানোর কথালাপের মধ্যে। আজ ষোলই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু-শরণার্থী মানুষদের মনে ভিন্নতর তাৎপর্যে ভাস্বর হয়ে ওঠে; আর উত্তরপ্রজন্মের কাছে এই মুক্তিযুদ্ধ পড়শী দেশের ‘সেলিব্রেশনের’ সান্নিপাতিক জ্বরে আক্রান্ত হবার থেকেও বেশি তার নিজস্ব আত্মখননের এক সুযোগ এনে দেয়। ভারতবর্ষের ভাষিক মানচিত্রে বাঙালির যে প্রান্তিকতা, মুক্তিযুদ্ধ সেই প্রান্তিকতাকে কেন্দ্রাভিমুখী করতে চায়—যা বাস্তবিক পরাভূত। বহুভাষিক রাষ্ট্রকাঠামোয়, জাতীয়তাবাদী প্রগলভতায় এই ভাষিক পরিচিতি সত্তা এক দুর্মর প্রতিস্পর্ধাকে সামনে আনে—সে আশ্রয় নেয় সেই প্রতিস্পর্ধার বর্মে। দূরের মুক্তিযুদ্ধই ভিন্ন তাৎপর্যে তার সামনে এনে দেয় এই সুযোগ।
মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিকতায় বাঙালি উদ্বাস্তু মনের আশ্রয় নেই বলেই আমার বিশ্বাস। এই ঐতিহাসিকতা আমাদের বাঙালি সত্তার শৌর্যগাথা হিসেবে তুলে ধরে এবং নিজস্ব জাতীয়তাবাদী পরিসরে আমাদের পরাভবের স্মারক হিসেবে প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য আলোচনা রাষ্ট্র পোষিত সংস্কার—বাধ্যতই তার অভিমুখ রাজনৈতিক। পশ্চিমবঙ্গের আপামর উদ্বাস্তু ও শরণার্থীর মনে তার একটা সামাজিক প্রচ্ছায়া আছে—যা সর্বদা রাজনৈতিক পরিসরে দৃশ্যমান নয়। নিশ্চয়ই একথার অর্থ এই নয় যে, রাজনৈতিক পরিসরে এই মানুষগুলির ব্যবহার নথিভুক্ত হয় নি কখনও—নিশ্চয়ই হয়েছে; বিশেষত দীর্ঘ তিন দশকের বামপন্থী আন্দোলন ও তার পূর্বে শ্রেণি-রাজনীতির অক্ষে এই মানুষগুলির হাত-পা-মাথা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। তবুও মোটের ওপর বলা যায় মুক্তিযুদ্ধের মাইক্রো-ইতিহাসের বিন্যাস পশ্চিমবঙ্গে সেভাবে লেখা বা বলা হয়ে ওঠে নি। ধর্মীয় পরিচিতির ঊর্দ্ধে সৌহার্দ্যের সামাজিকতা স্পষ্ট হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ আরেকটা দেশ ছাড়ার গল্প হয়ে উঠেছে, আরেকবার আশ্রয় খোঁজার আখ্যান বুনে গিয়েছে। আজ যখন উদ্বাস্তু-শরণার্থীর নাগরিকত্বের দাবী রাজনৈতিক পরিসর ছাপিয়ে সামাজিক পরিচিতির ভিতে আঘাত করছে তখন এই যুদ্ধের দিনগুলিই হয়ে উঠেছে জীবনের জলবিভাজিকা। কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র বাদ দিলে বাংলাদেশে মুসলমান উদ্বাস্তুদের মোটের ওপর এই দায় এখনও আসে নি। ভবিষ্যতের উত্তর আমাদের অজানা। মুক্তিযুদ্ধের মাইক্রো-ইতিহাস অনুসন্ধান বাংলাদেশে এক রাষ্ট্রিক উদ্যোগ—এর ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। একজন বাংলাদেশীর কাছে মুক্তিযুদ্ধ এমন এক আত্মখনন যা তাকে রাষ্ট্রিক শাসনব্যবস্থার সংলগ্ন বা অন্তর্ভুক্ত করে তোলে। ভারতবর্ষের দাঁড়িয়ে এই বাংলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-খনন তাঁর কেন্দ্রচ্যুতি ঘটার সম্ভাবনাকে উসকে দেয়। তাই দূরের মুক্তিযুদ্ধ—দর্শকের মত পরিগ্রহণের আর্তি নিয়ে আমাদের সেই চর্চা করে যেতে হয়।
কাছের মানুষঃ আজও প্রত্যয়ী করে
সাতচল্লিশের মতই উদ্বাস্তু মানুষের ঢল নেমেছিল একাত্তরে। উদ্বাসনের চাপে ভেঙে পড়েছিল ব্যবস্থা—জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠেছিল সমাজ-অর্থনীতির চালচিত্র। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কি শুধুমাত্র তাদের ছিল? বিগত পঁচিশ বছর ধরে এসে পড়া সব হারানো মানুষগুলির ঠিকানা যখন হয়ে উঠল এপারের ভাগীরথীর দু-পার, তাদের জীবনসংগ্রাম কি সর্বাত্মক মানসিক সংলগ্নতায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠেনি এই মুক্তিযুদ্ধে? এই বয়ানে আজ চোখ পড়ে আমাদের। পরমাশ্চর্যে তাকিয়ে দেখি ধর্মের জিগিরে উঠে আসা উন্মূলিত পরিবারের মানুষও বুকে আগলে রাখল তার ভিনদেশি ভাই-বোন-পড়শীকে। কি বৈপরীত্যময় সেই সহমর্মিতা কি ভালোবাসায় মমতায় উষ্ণ সেই যুদ্ধের দিনগুলি। বাংলার পার্টিশন বিষয়ে এক জন-গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করতে গিয়ে দেখেছি এঁদের, আত্মমগ্ন সংলাপে শুনেছি আশ্চর্য সব জীবনভাষ্য; শুধু ভেবেছি সব হারিয়ে ছেড়ে আসা দেশের মানুষ কেন মুক্তিযুদ্ধের কালে তারই পড়শীকে এভাবে আগলে রেখেছিল! আমরা জানি পার্টিশনের কালে উপরের রাজনৈতিক ভাষ্য অনেকাংশেই নীচের জীবনভাষ্যর সঙ্গে মেলে নি। একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু-শরণার্থীদের মনেও যে একটা দেশে জেগে ওঠার আর্তি ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যে একজন অতি পরিচিত চেনা মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তা কি গভীরভাবে আমাদের ভাবায় না? মানসিক সংলগ্নতার এই স্মৃতি এক পরাভবের বিরুদ্ধে যেন এক প্রতিস্পর্ধী চেতনার প্রকাশ। একটা যুদ্ধ যেন হচ্ছে অবদমিত রাগ-অভিমানের সঙ্গে একনায়কতন্ত্রের, স্বৈরাচারের, আগ্রাসনের। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে আজও নিজেদের জীবনে শোনা শ্রেষ্ঠ উত্তেজক ভাষণের অন্যতম হিসেবে বর্ণনা করেছেন এমন মানুষ হামেশাই দেখেছি। ধর্মীয় পরিচিতির বাইরে গিয়ে সংকীর্ণমনা মানুষও বলে উঠেছেন ‘বাঘের বাচ্চা, আমাগো মুজিব’। মৌখিক বয়ানের এই নিশ্চিত অতিরঞ্জন নিয়ে যখন ভাবতে বসেছি তখন মনে হয়েছে—এই মানুষটাই ধর্মের উৎকট অশিষ্ট আগ্রাসনে দেশছাড়ার গল্প শুনিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে—আশ্চর্য তো লাগেই।
এক ধরনের মানুষ দেখা যাবে যাঁরা ওই উত্তাল দিনগুলিতে কোনো কিছুতেই অংশগ্রহণ করেন নি, বরং দেশ ছেড়ে এপারের কোনো জেলায় আশ্রয় নেবার পরে আস্তে আস্তে মিশতে শুরু করেছেন নতুন সমাজে। কিন্তু স্মৃতি রোমন্থনের সময় তিনিও মুক্তিযুদ্ধের কালকে জীবনের বাঁক বদলের কাল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। একাত্তরের পরে সীমান্তের লাগোয়া অঞ্চলগুলিতে নানাভাবে আয়-রোজকারের পথ খুলেছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের চরিত্র বদলেছে, ভিন্ন ভিন্ন তরিকায় অভিযোজনের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে তাদের জীবনে। দরিদ্র মানুষের বয়ানে এক আশ্চর্য নিরাসক্তি থাকে—এক্ষেত্রেও তাদের বয়ানে দেখেছি দূর থেকে দেখার নিরাসক্ত ভাষ্য; যেন এত বড় যুদ্ধের সঙ্গে কোনো সংযোগই হয়নি তার, অথচ গোটা জীবনটা বদলে গেছে এই যুদ্ধের ফলেই। মনে হয়েছে কষ্ট, দুঃখ, বঞ্চনার লিপিমালা তো শ্রেণি-নিরপেক্ষ ভাবনা নয়, হয়ত তাই দেশভাগের শরণার্থী আখ্যানের মূল গতিপথ যেন একটু উচ্চবর্গীয় মানুষের দিকে ঝুঁকে আছে। সমাজতত্ত্বের বিশ্লেষণে অবশ্য সেসবের উদাহরণ ঠাহর করতে বিশেষ কসরৎ করতে হয় না; সেসব লেখার অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে।
আজ কালের নিয়মেই সাতচল্লিশের উদ্বাস্তু মানুষজন কমে এসেছেন, জেগে আছেন ষাট-সত্তরের শরণার্থীরা। দীর্ঘ পঁচিশ-ত্রিশ বছর ধরে যে উদ্বাস্তু ও শরণার্থী স্রোত বাংলার সীমান্ত ধরে পারাপার করেছেন তার শেষ পর্যায়টি ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে। ভয়াবহ সেই অত্যাচার-ভীতি-গুজবের কালে আশ্রয় নেওয়া মানুষজনের স্মৃতি আমাদের পরিপার্শ্বে ছড়িয়ে আছে। ষাটের দশক জুড়ে বিপুল সংখ্যক নিম্নবর্গীয় নমঃশূদ্র শরণার্থী আগমন ঘটেছে এই বাংলায়। কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর, নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। আশ্রয় ও জীবনের জন্য সংগ্রামের এ এক অন্য আখ্যান—যা সচরাচর দেশভাগের স্মৃতিকথার সঙ্গে মিলবে না। ফেলে আসা দেশের জন্য সুখবিলাসী স্মৃতি-আখ্যান এখানে প্রায়শই পাওয়া যায় না—বরং এঁদের কথালাপ জুড়ে নিজেদের বর্তমান আস্তিত্বিক সংগ্রামে সুবিধা-অসুবিধার অত্যাশ্চর্য বিবরণ আমাদের হতবাক করে তোলে। সংগঠিত উদ্বাস্তু আন্দোলনের জমি ও অভিমুখ ততদিনে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়ে গেছে—এঁরা সেই আন্দোলনের সঙ্গে একপ্রকার সংলাপে নিয়োজিত হয়েছে, নিজের সামুহিক ও কৌমচেতনার নিরিখে ভিন্ন ভিন্ন পরিচিতি সত্তার স্বরূপ তুলে ধরে এগোতে চেয়েছে অথবা পিছিয়ে গেছে। মতুয়া-নমঃশূদ্র পরিচিতির মধ্যে একরকম যৌথতার শক্তি তাঁরা অর্জন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ-রাজনীতির পরিসরে তাঁরা উঠে এসেছেন ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে সংলাপ চালানোর সক্ষমতা নিয়ে। এঁদের জীবন-সংগ্রাম ও প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত সমাজ-গবেষাণার বিষয়, এক্ষেত্রে সেসব প্রসঙ্গে যাবার সুযোগ নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কালে এঁদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের কলোনি তৈরির এই চেহারার সঙ্গে চল্লিশ-পঞ্চাশের কলোনি গড়ে তোলার উদ্যোগের কিছু তফাৎ আছে। পশ্চিমবঙ্গের কিছু জেলায়, যেমন কুচবিহার, দিনাজপুর, নদিয়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কিছু অঞ্চলে নমঃশূদ্র শরণার্থীদের আগমন জেলার জনবিন্যাসে বড়সড় পরিবর্তন এনেছে। একাত্তরের আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। অনেক ফিরে গেছেন, পরবর্তীতে পুনরায় ফিরে এসেছেন এপারে।
দেশভাগ বাঙালি নারীকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের প্রশ্নে অনেক এগিয়ে দিয়েছিল একথা অনেকেই বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের ভূমিকা বাঙালি নারীমানসে এক প্রত্যয়ের জন্ম দিয়েছিল। জীবনসংগ্রাম ও আত্মপ্রতিষ্ঠার এক নতুন ইতিবৃত্ত তাঁরা রচনা করেছেন, আজও কিছু পরিবারের মধ্যে সেই প্রবহমানতা বজায় রয়েছে। স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক শেষ সংগ্রামে নিয়োজিত নারীদের ভূমিকা বাংলাদেশে আজ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে গেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সেইসব নারীর বিপর্যয়ের মর্মন্তুদ আখ্যানকে নিয়ে আমরা সেভাবে আলোচনা করিনি। তাঁদের পারিবারিক বৃত্তের বাইরে কোনো বৃহত্তর পরিসরে আমরা জায়গা করে দিতে পারি নি।
বাঙালি মুসলমানের নিজস্ব দেশের প্রসঙ্গকথা তার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভেতর নিষিক্ত আছে। ‘পাক বাংলার কালচার’ যখন লেখা হয়েছে তখন মুসলিম সমাজ পরিসরের সেসব বিতর্ক একটা অভিমুখ পেয়েছে। মুসলিম ‘তমদ্দুনের’ স্বপ্ন তেইশ বছরের উর্দু আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে ভিন্ন অভিমুখ পেয়েছিল। সাংস্কৃতিক সংগ্রামের জন্ম হয়েছিল ভাষিক পরিচিতির বিরোধাভাসের মধ্যে থেকে—পরবর্তীতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ‘এক্সক্লুশন’ সেই সংগ্রামকে বৈধতা দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীতে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যে সর্পিল বাঁকা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে বা চলেছে তার অভিমুখের দুটি প্রধান দিক। প্রথমত, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন ও ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে আন্তর্জাতিক শক্তিবিন্যাসের সঙ্গে সেদেশের সংলাপ। দ্বিতীয়ত, ভাষিক পরিচিতি সত্তার সঙ্গে ধর্মীয় পরিচিতির নিরন্তর সংলাপ। দুটি অভিমুখেরই ভাঙা-গড়া চলে অবিরাম। মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্যের মধ্যে দু-পাশে বাঙালি সত্তার এক সাধারণীকৃত রূপ ফুটে ওঠে—সাধারণ মানুষই সেই প্রস্ফুটনের অংশীদার। আজও দুপারের রাজনৈতিক পরিসর সেই পঞ্চাশ বছর পেছনের হারানো ও অর্জনের অতীত থেকে সংলাপ শুরু করতে বাধ্য হয়। তাই জায়মান থাকে মুক্তিযুদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ভোট অথবা বাংলাদেশের নির্বাচন শরণার্থী-উদ্বাস্তু-নাগরিকত্ব ছেড়ে বেরোতে পারে নি; পারার কথাও নয়। একরকমভাবে একাত্তরের মীমাংসা যেন সাতচল্লিশের সমাধানকে অমীমাংসিত ঘোষণা করতে থাকে। তখনই কাছে এসে দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতগুলি—মুখগুলি চেনা চেনা মনে হয়।
এই যুদ্ধ যে আপামর বাঙালির অস্তিত্বের যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল সেকথা আজও মানেন সেইসব মানুষেরা। বেড়াহীন সীমান্তে তখন পারাপারের সমস্যা ছিল অপেক্ষাকৃত কম। জীবনের সংকটময় পরিস্থিতিতেও ওপারের পড়শীকে এপারে আশ্রয় দিয়েছেন তাঁরা। পড়শী ফিরে গেছে নতুন জেগে ওঠা দেশে কিন্তু তাদের অনেকেরই আর ফিরে যাওয়া হয় নি; এমন মানুষদের মনে মুক্তিযুদ্ধের ছবিটা কেমন ছিল তা নিয়ে তৈরি হতে পারে নতুন ডিসকোর্স। আমরা কি সেদিকে তাকাতে পারব? রাষ্ট্র পোষিত প্রকল্পের বাইরে কি মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য খোঁজার সময় এসেছে? এপারের কাছের মানুষের মনের কথা দিয়ে কি সেই পথে এগোনো যায়?