জন্ডিস – বিমল লামা

জগতে কমবেশি সকলেই রংকানা। কারণ সব রং সবাই দেখতে পায় না। এমনই ধারণা জুবিনের। সে নিজেকেও রংকানা-ই ভাবে। কিন্তু কতটা? সেটাই সে জানতে চায়। কিন্তু জানবে কি করে! তারই উপায় সে খুঁজে বার করেছে নিজের মতো করে।

তার একটা রং এর খাতা আছে। সেই খাতায় সে হিসাব রাখে রং এর। চারপাশে যেসব রং সে দেখতে পায় তাদের অনুপুঙ্খ হিসাব। ভালো হতো সবাই যদি একটা করে নিজস্ব রং এর খাতা রাখত। তখন খাতাগুলো পাশাপাশি রেখে একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা যেত। কিন্তু তা তো লোকে করে না। তাই তার মতও ব্যক্তিগত রংয়ের হিসাব আর কারোরই নেই। তারা তো প্রয়োজন বোধ‌ও‌‌ করে না। তাই অনেক বলেও সে কাউকে রঙের খাতা রাখতে রাজি করাতে পারেনি। তাই বলে সে হাল ছেড়ে বসে থাকার পাত্র নয়।

তার আশপাশের সকলের রঙের হিসাব সে নিজেই রাখবে ঠিক করেছে। শুরু করেছে বাড়ি থেকেই। মা বাবা দিদি ঠাকুমা কাজের মাসি আর তার প্রিয় পোষ্য ব্লুটো। জুবিন কিন্তু কলেজে পড়ে। যদিও সহপাঠিনীদের প্রতি কোনও আগ্রহ তার নেই। আগ্রহ কখনো বা জাগে যদি কেউ রং নিয়ে আগ্রহ দেখায়। তখন সে তাদেরও রং এর হিসাব নেওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে পড়ে। আর তাদের জন্যও একটা রং এর খাতা বানিয়ে ফেলে। সেই খাতায় সে হিসাব রাখে রংয়ের।

এই করে তার এক ডজন খাতা জমেছে। সাতটা বাড়িতেই, পাঁচটা বাইরের। দুটো ক্লাসের মেয়ে, একটা ছেলে, একজন শিক্ষক আর এক ছাত্রনেতা।

তবে জুবিন খুব সতর্ক থাকে যাতে তার রঙের হিসাবে কোনও রাজনীতির রং না ধরে। সে চায় লোকে রং বলতে বুঝবে শুধুই রং। রংধনুর সাত রঙ আর সেই সাতের মিশেলে তৈরি অন্য সব রং।

আর সে জানে রংয়ের আধার আলো, আলোর আঁতুড় সূর্য। তাই সূর্যেরও হিসাব তাকে রাখতে হয়। উদয়াস্ত হিসাব। ভোরবেলা মাঠের ওপারে সূর্যকে তো উজ্জ্বল রঙের একটা গোলাই মনে হয়। তারপর সে তার সব রং পৃথিবীর গায়ে ঢেলে দেয়। নিজে মুক্ত হয়ে পাড়ি দেয় পশ্চিমে। সারারাতের কালিমালিপ্ত পৃথিবী তখন ধীরে ধীরে রঙিন হয়ে ওঠে আর জুবিন সেই রং আকণ্ঠ পান করার লালসায় গিয়ে হাজির হয় বড় ঝিলের ধারে। ঝিলের পাড় বরাবর অসংখ্য বড় বড় গাছের সারি। অনেক কুসুম গাছ আর কুসুম সারির ফাঁকে ফাঁকে পলাশ শিমুল জারুল সোঁদল কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া আর কাঞ্চন ফুলের গাছ। সারাবছর তারা ফুল দেয় কেউ না কেউ। পালা করে করে একেক জন একেক রংয়ের ফুল। কুসুম কোন‌ও ফুল দেয় না, কিন্তু তার ঝাঁকড়া পাতায় রং ধরে একে একে লাল হলুদ সবুজ কমলা বাদামি আর তাদের মিশেলে তৈরি আর সব রং। তখন জুবিনের ইচ্ছে করে কুসুম গাছের নতুন করে নাম দেয় কোন‌ও রংয়ের নামে। যেমন রংগবতী! কি রংদারু। অথবা বর্ণালী কিংবা শতরংগী।

ঝিলের জলে তখন ভোরের বাতাস শিহরণ তুলেছে। ছোট ছোট সহস্র ঢেউয়েরা রুপোলি মাছের ঝাঁকের মত কুচকাওয়াজে বেরিয়েছে। প্রথম আলোর সাত রঙা রশ্মিরা এসে পড়ছে তাদের ওপর। আর সুবিশাল এই বড় ঝিলের অনন্ত জলরাশির ওপর ঝিকিমিকি রঙের উৎসব শুরু হয়েছে, যেন শুধু জুবিনের‌ই জন্য। কারণ যতদূর চোখ যায় আর কেউ কোত্থাও নেই।

জল ঘেঁষা একটা কুসুম গাছের নিচে বসে জুবিন চেয়ে থাকে অপলক। সে স্থির হয়ে বসে থাকলেও তার ভেতরে তখন আলো আর রঙের নৈরাজ্য।  তার প্রকাশ তার চোখে-মুখে।

 সূর্যের সব রং জলের ভেতর ঢেলে দেওয়া পর্যন্ত সে সেখানেই বসে থাকে। একসময় রং মুক্ত হয় সূর্য। ঝিলের জলে ডুবে মিলিয়ে যায় তার সব রং। শুধু সবুজাভ জলরাশি নড়েচড়ে মৃদু বাতাসে। জুবিন তখন ঘরে ফিরে রং এর খাতা খুলে বসে। পাতার ওপর তারিখ আর সময় লিখে রং এর বিবরণ লেখে নিচে।

লাল নীল হলুদ এর বাইরে আর কি কি রং সে দেখল তারই দীর্ঘ তালিকা সে বানাতে বসে, পাতার পর পাতা। বাঁদিকে ক্রমিক সংখ্যা ফেলে একের পর এক রং এর নাম।

তার ইচ্ছাটা হল প্রত্যেককেই সে এই দৃশ্য দেখাবে যাদের খাতা সে করেছে, আর কি কি রং তারা দেখতে পেল তার তালিকা বানাবে। বাকিরা তেমন আগ্রহ না দেখালেও তার দিদি ছিল সমান উৎসাহী। দুজনের মধ্যে বলা যায় রং খেলা চলত খাতায় খাতায়। যদিও এই প্রকল্প তাকে অচিরেই ত্যাগ করতে হয়। কারণ ঘাঁটাঘাটিতে অন্তহীন রংয়ের নাম উঠে আসে। লাল নীল হলুদ সবুজ প্রত্যেকটা রংয়ের নাকি শতাধিক রকমফের। হওয়ারই কথা। সে তো নিজের চোখেই দেখেছে গাছেদের রং বদল, সবুজের রকমফের। কুসুম গাছের রংবাহার তো অবিশ্বাস্য। পান্নাসবুজ থেকে রক্ত লাল, সব রং দেখা যায় কুসুম গাছের পাতায়।

তবু এইসব রংবাজি তাকে ছাড়াতে হয়। এক তো সে তাল রাখতে পারে না। তার ওপর একটা চাকরিও নিতে হয় তাকে, সংসারের প্রয়োজনে। দিদির বিয়ে বাবার অবসর ইত্যাদি। বিস্তর ঘুরাঘুরির এক চাকরি। কলেজের মাঝপথেই। তখন জুবিন একদিন আনুষ্ঠানিকভাবেই অন্ত্যেষ্টি করে তার রঙ প্রকল্পের। ভোরবেলা বড় ঝিলের ধারে নিয়ে আসে ব্যাগভর্তি রংয়ের খাতাগুলো। বারোটা খাতা। তারপর উদীয়মান সূর্যকে সাক্ষী রেখে স্তূপাকারে সাজায় খাতাগুলো, যেন রংয়ের চিতা। তারপর ধরিয়ে দেয় আগুন। ভোরের আলোয় অবাক হয়ে জুবিন দেখে কত শত সহস্র রংয়ের উজ্জ্বল শিখায় জ্বলছে তার রঙের খাতা। কিন্তু অচিরেই তার সব রং গিয়ে মিশে যায় সূর্যের সাথে। তারপর ডুবে যায় ঝিলের জলে। পড়ে থাকে শুধু পোড়া ঘাসের ওপর কালো একটা গন্ডি। তার মাঝখানে গর্ত করে জুবিন পুঁতে দেয় একটা পাকা কুসুমের ফল। ভাবে একদিন তার সব রঙ গাছ হয়ে ধরে থাকবে পাতায় ডগায় মুকুলে বকুলে। গাছটা কুসুম হলেও নতুন করে তখন সে নাম দেবে তার। রঙদারু কি বর্ণালী। অথবা রঙ্গবতী কিংবা শতরংগী।

তারপর কর্মসূত্রে জুবিন ঘুরতে শুরু করে গোটা দেশজুড়ে। নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে পড়ে আর ভাবে কত রকম ভাষা! কত রকম খাদ্য খাবার রীতি বিধি। ধরনধারণ। অথচ একই দেশ একই মানুষজন। একই তাদের ভূত-ভবিষ্যৎ ঐতিহ্য ইতিহাস। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের এত বড় নিদর্শন আর কোথাও বোধহয় রেখে যায়নি মানব সভ্যতা।

তারপর একদিন হঠাৎ সে খুব মুষড়ে পড়লো। হতবাক হয়ে নিজেই নিজের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে উঠলো, আমি কি সত্যিই রং কানা হলাম!

হয়েছে কি, দেশেরই মধ্যে কোনও শহরে গেছে অফিসের কাজে। সেই শহরে তখন কোনও উৎসব চলছিল। হোটেলে ফেরার পথে সে পড়ে যায় কার্নিভালের ভেতর। জনতা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উদযাপন করছে কোনও উপলক্ষ। হয়তো কোনও বিজয় মিছিল। তারই মাঝে পড়ে সেও খেয়ে ফেলে বেশকিছু লাড্ডু মিঠাই মন্ডা। সব খেতে না পেরে মুঠোয় ধরে থাকে কিছু। ভিড়ের মাঝে কেউ তার গলায় মালাও দিয়েছে খান দুয়েক। সঙ্গে উত্তরীয় বুকে ব্যাজ আর আবিরে আবিরে রাঙিয়ে দিয়েছে তার মাথা মুন্ডু মন-মগজ। অনেক দিন পরে এমন করে রংয়ের প্রকোপে পড়ে ভালই লাগে জুবিনের।

কিন্তু ঝটকা লাগে হোটেলে ফিরে। রং লাগা জামা কাপড় ছেড়ে চান করবে বলে বাথরুমে ঢুকেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে অবাক নিজেকে দেখে। এত রং মেখেও রঙিন মানুষ মনে হচ্ছে না তার নিজেকে। উল্টে মনে হচ্ছে এক রঙা কোনও দৈত্য! কি ভিনগ্রহ থেকে এসে পড়া কোন বিটকেল জীব! কারণ তার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে একটাই রঙের প্রলেপ। গলার মালা, উত্তরীয় বুকের ব্যাজ। মুখে মাথায় পোশাকে লেগে থাকা আবির, সব একটাই রঙের। এমনকি হাতের মুঠোর ভেতর মিষ্টি গুলো, তাদেরও রং একই। যেন রং নয় কোনও অসুখ। বা অসুখের লক্ষণ। সেই অসুখে আক্রান্ত হয়ে তারই লক্ষণ ফুটেছে তারও সর্বাঙ্গ জুড়ে।

এখন ফিরে ভাবতে গিয়ে দেখল সত্যিই তাই। ওই গোটা মিছিলটাই ছিল একই রঙের। যেন মিছিলের প্রত্যেকেই আক্রান্ত সেই আজব রোগে যে রোগে আর সব রং বিনষ্ট হয়ে যায়। থাকে শুধু একটাই রং। শুধু পোশাকে আসাকেই নয়, হাতে মুখে, চোখে ভাবে।  সেই রোগ সর্বাঙ্গে নিয়ে সেও ফিরে এসেছে হোটেলে একান্তে নিজেই নিজের মুখোমুখি হতে। কার্নিভালের ভালোলাগা আর অবশিষ্ট নেই। মুখের মিষ্টতাও রূপান্তরিত হয়েছে তিক্ততায়। ঝিমঝিম করছে মাথা। কড়কর করছে চোখ। এক  রঙা বিকট গন্ধে বন্ধ হয়ে আসছে দম। সবচেয়ে বড়কথা, ভয় করছে নিজেরই নিজেকে দেখে।

তবু চান করার আগে নিজের কিছু ছবি তুলে রাখলো জুবিন।  হয়তো কোথাও কিছু প্রমাণ করবার দরকার পড়বে আসন্ন কোনও দিনে। দরকার পড়বে সামাজিক মাধ্যমে কোনো বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনে। যাতে লোকে বোঝে যেটা বোঝা দরকার।

যদিও পরদিন সকালে উঠেই জুবিন চলে গেল সেই শহর ছেড়ে। দ্রুতগামী ট্রেনে চড়ে বহু ঘন্টা ধরে গিয়ে নামল অন্য এক শহরে। সেখানে তখন রাত নেমেছে শহরজুড়ে। গভীর নীল রাত। স্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে যাওয়ার পথে ভীষণ ভালো লাগে তার এই নীল রাত। খোলা জানলা দিয়ে হু হু করে ঢুকে আসে নীল আলো আর স্নিগ্ধ হাওয়া। আলোর মিশেলে হাওয়াটাকেও মনে হচ্ছে নীলচে। গভীর অনুরাগের নীলাভ বায়ুমন্ডলে নিমজ্জিত এক অপরূপ স্বপ্নের শহর।

ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে কি হোটেলে পানীয় দেবে নীল রংয়ের! নীল রংয়ের খাবার প্লেট খাট-বিছানা পর্দার কাপড় পাপোশ আজব ব্যাপার!

ভাবতে-ভাবতে নীল চাদর চাপা দিয়ে ঘুমোতে যায় জুবিন। রাতের স্নিগ্ধ নীলিমায় ধীরে ধীরে সে মগ্ন হয়ে পড়ে সুগভীর নীল নিদ্রায় মনে মনে সবকিছু মেনে নিয়ে।

তখন কি আর সে জানতো এই শহরের প্রথম সকাল কি নিয়ে অপেক্ষা করছে তার জন্য! চোখ মেলে জানালায় নীল আকাশ দেখে প্রথমটা তো ভালই লেগেছিল কিন্তু জানলায় গিয়ে দাঁড়াতেই সে আবার ঝটকা খেলো। নীল আকাশের নিচে সাজানো আছে আপাদমস্তক এক নীল শহর।

নীল নীল ঘর বাড়ি ঘর অট্টালিকা ভবন। নীল নীল  বেড়া পাঁচিল খাম রেলিং সেতু। নীল দোকান নীল নীল রাস্তাঘাট। এমনকি নীল রঙে রাঙানো হয়েছে গাছপালা ফুল পাতা। অন্তত চেষ্টা গাছের গুঁড়ি নীল, ডালপালা নীল। নীল ফুলের অতিরেক চারিদিকে। তার ভেতর পাতারাও যেন সত্যি সত্যি হয়ে উঠেছে নীলাভ।

ভাবতেও তার সারা গা শিউরে ওঠে আজ তাকে সারাদিন এই নীলের ভেতর কাজ করতে হবে। তিল তিল করে নিজের ভেতরে টেনে নিতে হবে এ নীল রোগের জীবাণু। তারপর দিনের শেষে এই নীল অসুখ নিয়ে ফিরে আসতে হবে এই নীল হোটেলে। নীল পানীয়, নীল খাদ্য…!

ইচ্ছে করছে ট্রেন ধরে বহুদূর পালিয়ে যায় এই অসুস্থ শহর ছেড়ে। কিন্তু জীবিকার পিছুটান সে অগ্রাহ্য করতে পারেনা। এসব না মানলে কাজ থাকবে না। কাজ না থাকলে ভাত জুটবে না। ভাত ছাড়া বাঁচবে কি করে, বাঁচাবে কি করে পরিবারকে। তাই সব জেনে সব বুঝেও তাকে নেমে যেতে হয় এই নীল নগরের ভেতর আর দিনের শেষে ধুঁকতে ধুঁকতে ফিরে আসতে হয় বিপন্ন নীল শিয়ালের মত।

যদিও সে রাতটা কাটায় না সেই শহরে। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে ট্রেন ধরে দূরপাল্লার। ভাবে পালিয়ে বাঁচবে এই নীল রোগের সংক্রমণ থেকে।

দূরপাল্লার ট্রেন কোনও একটা শহরের সম্পত্তি নয়। গোটা দেশের। অর্থাৎ জাতীয় সম্পদ। হয়তো সেই জন্যই অনেকটা স্বাভাবিক লাগে সবকিছু। যদিও জুবিনের চোখ এড়ায় না। প্রচ্ছন্ন প্রবণতা বুঝতে অসুবিধা হয়না কোন রঙ ধরতে চলেছে ট্রেন। বলা ভালো রেল।

আর ঠিক তাই সকাল সকাল ট্রেন পৌঁছে যায় তার গন্তব্যে অন্য এক নতুন শহরে। চোখ মেলে চেয়ে দেখতেও হয়না তার রঙ। বার্থ-এ শুয়ে শুয়েই মাইকের ঘোষনা আসে কানে, কমলা! কমলা! কমলা!

সামনে ভোট আছে বোধহয় কোনও। স্টেশন ঘেঁষা ময়দানে জনসভা হবে। মাঠ সাজানো হয়েছে মঞ্চ বেঁধে। ফেস্টুন ব্যানার পতাকা টাঙিয়ে। আর জুবিনের আশঙ্কা মত সবকিছুর  একটাই রং, কমলা!

তারপর গোটা দিন তার কাটে এই একরঙা শহরের ভেতর। এই শহরের মানুষজন পোশাকও পরেছে কমলা রঙের। আর কিছু না হোক অন্তত একটা কমলা উত্তরীয় আছে সবার গলায়। অনেকেই ফেট্টি বেঁধেছে কমলা রঙের। কপালে তিলক। সর্বত্র বিলি হচ্ছে কমলা রঙের লাড্ডু। হামলে পড়ে খাচ্ছে লোকে। কেউ না খেলে ঠুসে দিচ্ছে মুখে জোর করে, রীতিমতো ঘাড় ধরে।

জুবিনের  মুখেও ঠেসে দেয় একজন খানদুয়েক লাড্ডু। জুবিন দাঁত চেপে আটকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বজ্র কঠিন আঙ্গুলের চাপে ফাঁক হয়ে যায়  তার মুখ। জুবিন চোখ তুলে দেখে দুটো প্রখর কমলা চোখ চেয়ে আছে তার চোখের দিকে। বিকট হাসিতে হাঁ হয়ে আছে তার মুখ। বেরিয়ে আছে এক সারি ধারালো কমলা দাঁত।

জুবিন আর প্রতিরোধ করতে পারে না। বাধ্য ছেলের মত হাঁ করে কমলা  লাড্ডু খাবার জন্য। তখনই একটা বিরাট কমলা থাবা উঠে আসে তার মুখের কাছে আর তার গলায় ঠেসে ঢুকিয়ে দেয় খান কতক কমলা লাড্ডু। ওপর দিয়ে বোতল থেকে কমলা রঙের পানীয়।

জুবিন ঢোঁক গেলে। খাবি খায়। তার অন্তঃস্থলে সেঁধিয়ে যায় বস্তুগুলো। স্বাদ গন্ধ লেগে থাকে নাকে মুখে।

এরপর কি জানি কেন সারাদিন আর খিদে তেষ্টা পায় না জুবিনের। মনে হয় পেটটা তার ভরাট হয়ে আছে। তার ভেতরকার সমস্ত খালি জায়গা গুলোর দখল নিয়েছে ওই লাড্ডুগুলো। আগের কোনও নীল খাদ্য যদি বা থেকেও থাকে পেটে, সেসব সরিয়ে তারও জায়গা দখল করেছে কমলা লাড্ডু। এখন আর তাকে তেমন করে বাইরের জিনিস বলে মনে হচ্ছেনা জুবিনের। অতটা বহিরাগত আর লাগছে না। হয়তো সেই জন্যই অনেক সহনশীল লাগছে নিজেকে। অতটা দম বন্ধকরা  আর লাগছে না এই কমলা বায়ুমণ্ডল। অন্তত যত শীঘ্র সম্ভব পালিয়ে বাঁচার তাড়না জাগছে না মনে। কমোডের ঢাকা খুলে বমি করে অবস্তু তুলে ফেলার উদগ্র টান উঠছে না ভেতর থেকে। কেমন যেন সয়ে গেছে একভাবে। যদিও সে বুঝছে আসলে এও এক অসুখ। কিন্তু সেরে ওঠার ইচ্ছেটা ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ নিজের ভেতর। হয়তো সেটাও একটা লক্ষণ এই অসুখের। নিজের শিকারকেই সে শরিক করে নেয়।

তাই জুবিনের বেশ আরাম হয় হোটেলের কমলা রুমে ফিরে কমলা বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে। খিদে তেষ্টার কথা তার মনেও থাকে না। মনে থাকে না সারা দিনের ক্লান্তির কথা, পরিশ্রমের কথা। এমনই আশ্চর্য সেই (অ)সুখ!

কিন্তু ঘরের আলো নেভার পর সব রং দূর হয়ে যায়। চোখ খুললেও আর কোনও রঙ দেখা যায় না। তখন জুবিনের মনে পড়ে তার রঙের খাতা। মনে পড়ে বড় ঝিলের পাড়ে সারিসারি কুসুম গাছ আর কুসুম পাতার হরেক রঙের বাহার।

ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে আসে জুবিনের। তার ভাবনা গুলো যে কখন স্বপ্ন হয়ে যায় সে বুঝতেও পারেনা। তখন সব উৎপাটন কান্ড ঘটতে শুরু করে তার ভাবনার ভেতর। না কি স্বপ্নের ভেতর! সত্যিই সব গুলিয়ে যায় জুবিনের। তবু ঘটনাগুলো ঘটতেই থাকে। আর সে অবাক হয়ে দেখে বড় ঝিলের সব গাছে একই রঙের ফুল ফুটেছে। শিমুল পলাশ জারুল, রাধা-কৃষ্ণচূড়া সোঁদল কাঞ্চন.., সব ফুল একই রঙের। এমনকি ঝিলের জলও সেই রঙের। ঝিলের পাড়ে ঘাস মাটি ঝোপ ঝাড়, সবই এক রঙের। যেন অসুখ করেছে গোটা পৃথিবীর, কোনও গভীর অসুখ!

সকালে উঠে জুবিনের আবার সুস্থই লাগে যদিও। মানে গত রাতের সেই সুখানুভূতি আর নেই। বিকট লাগছে এই একরঙা শহর। ঠিক কোনও বর্ণাশ্রয়ী অসুখের মত। পীতজ্বর কালাজ্বর জন্ডিস কি শ্বেত কুষ্ঠের মত। এক্ষুনি পালাতে না পারলে হয়তো তারও ধরে যাবে এই অসুখ।

যদিও জুবিন তাড়াহুড়ো করে না একে বারেই। ধীরে সুস্থে রওনা দেয় স্টেশনের দিকে। কারণ সে জানে যতই দূরে যাক, আবারও সে গিয়ে পড়বে কোনও না কোনও অসুস্থ শহরে যেখানে অসুখের এক রং বাকি সব রং বিনষ্ট করে বসে আছে।

আর হলও তাই। সারাদিন ট্রেন জার্নি করে সে গিয়ে পৌঁছলো আর এক শহরে। সেখানে সবকিছু হলুদ। সেই হলুদের ভেতর সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে সে দেহে মনে হাড়ে মজ্জায় টেনে নেয় হলুদ অসুখের জীবাণু। দিনের শেষে ছোঁয়াচে এক হলুদ দৈত্যের মত গাড়ি ধরে অন্য কোনও শহরের। আর গিয়ে পড়ে আর এক নতুন শহরে। সেখানে পৌঁছে আগের হলুদ আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। সে রূপান্তরিত হয় এক বিকট সবুজ সংক্রামিত অবজীবে। সেই সবুজ সংক্রমণের ঘৃণ্য বাহকের মত সে গিয়ে পড়ে আর এক শহরে। সেখানে আবার সবকিছু লাল।

 এভাবেই সে ঘুরে বেড়ালো বেগুনি বাদামি গোলাপি আসমানী সমস্ত রঙের শহরে। আর যেখানেই গেল সংক্রমিত হলো সেখানকার এক রঙ্গা অসুখে।

আশ্চর্য তার শরীরটাও। আশ্চর্য তার চুল চামড়া পোশাক-আশাক। যে রংই পায় ধরে নেয়। একবার সাদা জলে চান করে নিলেই আগের রঙের আর কোনও চিহ্ন থাকে না। যেন নতুন রঙ টাই তার প্রথম রং। আদি রং।

শেষ পর্যন্ত জুবিন যদিও বুঝল তার মনটা সেই তালে চলছে না। শরীরের এমন নিরন্তর রং বদল পৌঁছচ্ছে না তার ভেতর পর্যন্ত। আর তাই ভেতরে ভেতরে সে নিজের সঙ্গেই জড়িয়ে পড়েছে এক বিকট সংঘাতে। সেখানে আগের সব রঙের যুদ্ধ কণিকারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার শিরা ধমনীর অলিগলি।

শেষে পকেটভর্তি বেতনের টাকা  নিয়ে যখন সে ছুটিতে বাড়ি এলো জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। সামলাতে পারছে না বমির বেগ। আর এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে অফিসের ব্যাগটাকে মনে হচ্ছে কাঠ লোহা দড়ি চামড়া গজাল আংটা শেকল-ওলা এক জোয়াল যে জোয়াল চাপানো আছে তার ঘাড়ে। গলায় বেড় দিয়ে আটকানো আছে শক্ত করে। আর তার কানে বেজে চলেছে বিরামহীন মন্ত্র– হ্যাট হ্যাট হ্যাট! হ্যাটা ট্যাট!

জুবিন জ্বরের ঘোরে চিৎকার করে ওঠে– কেন? কেন? কেন?

তার বিছানায় ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা তার পরিবার নিরুত্তর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে একে অপরের। কেউ কোনও কথা বলে না। তবু উত্তর বাজে জুবিনের কানে। একটা আবেগঘন কণ্ঠ কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে– দ্যাশের ভাইগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা…!

ডাক্তারবাবু আসেন। জুবিনের লক্ষণ পরীক্ষা করে বলেন– জন্ডিস! নিদান দেন রক্ত পরীক্ষার। পরীক্ষাকেন্দ্রে অসম্ভব ভিড়। কাতারে কাতারে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে হাতে হাতে রক্তের নমুনা নিয়ে। গুজব রটেছে ভিড়ের ভেতর, জন্ডিস! জন্ডিস! পরীক্ষা করার কোনও প্রয়োজন নেই, একশভাগ জন্ডিস। গ্রামকে গ্রাম শহরকে শহরে… সব জন্ডিস!

জুবিনের বিছানা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে আত্মীয়-বন্ধু প্রিয়জনেরা। তারা ফিসফাস করে নিজেদের মধ্যে। জুবিনের কানে আসে তারা বলছে, জন্ডিস মানে পীতরোগ। ওর কাছে গোটা দুনিয়া এখন পীতবর্ণ। যদি সেরে ওঠে তো আবার রংধনু দেখতে পাবে। না হলে এই বিশ্বাস নিয়েই ও মরবে যে পৃথিবীটা আসলে হলুদ রঙের একটা গ্রহ।

শুয়ে শুয়ে জুবিন ভাবে, হলুদ গ্রহ! হলুদ ঘরের ভেতর হলুদ আলোর মধ্যে ডুবে থেকে জুবিনের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে সে কথা। হলুদ পাহাড়। হলুদ হলুদ নদী মাঠ সমুদ্র আর আকাশ। হলুদ এক বায়ুমণ্ডলের ভেতর আটকে পড়া হলুদ এক প্রজাতি। এক প্রজন্ম। নবতম সংযোজনের মত সে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হচ্ছে হলুদ রঙা এক মানুষে। তার শিরা ধমনীর ভেতর বইছে হলুদ রক্ত। হাড়ে মজ্জায় গজাচ্ছে হলুদ জীবন রস।

অনেক রাতে যখন আলো নিভে যায়, জানলায় লেগে থাকে কালো একটা আকাশ। জুবিন উঠে বসে বিছানায়। হাত দিয়ে অনুভব করে তার পিঠের ঘামে চাদর ভিজে গেছে। আলো জ্বাললেই হয়তো দেখবে গাঢ় হলুদ ঘাম নির্গত হচ্ছে তার সমস্ত রোমকূপ দিয়ে। তার মুখের ভেতর হলুদ থুতু।  হলুদ লালা। মূত্রথলির ভেতর জমে আছে হলুদ পেচ্ছাপ। শিরা ধমনীতে হলুদ রক্ত।

এসব কিছুই সে দেখতে চায় না। তাই সে আলো জ্বালে না। অন্ধকারে সে থুতু ফেলে। বমি করে। পেচ্ছাপ করে বাথরুমে গিয়ে। তারপর একটা ব্লেড হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে।

গোটা বাড়ি তখন ঘুমোচ্ছে। হয়তো লোডশেডিং। তাই কোথাও কোনও আলো জ্বলছে না। কোথাও কোনও রঙ দেখা যাচ্ছেনা। সেই ভালো! ভাবে জুবিন। হয়তো সূর্যকে আটকানো যাবে না। সে উঠবে সময়মতো আর উজাগর করে দেবে তার এই আত্মপ্রবঞ্চনা। নিজেই নিজেকে ঠকিয়ে বেঁচেবর্তে থাকার এই অপকৌশল। তার আগেই করতে হবে যা করার। তার রাগেই! তার আগেই!

ভাবতে ভাবতে বাড়ির বাইরে আসে জুবিন। সাবধানে ফতুয়ার পকেটে রাখে ব্লেডটা। বাইরেও একই রকম ঘুটঘুটে অন্ধকার।

কিন্তু এই অন্ধকারেও তার পথ চিনতে কোন অসুবিধা হয় না। কারণ এই পথে সে নিয়ম করে হেঁটেছে বহুবছর। পায়ের তলায় এসে পড়া নুড়ি পাথর ঘাস মাটি কাঠ কুটোদেরও সে চেনে। তাদেরই দেখানো পথ ধরে যেন সে এসে পরে বড় ঝিলের ধারে।

বড় ঝিল তখন চারধারের সমস্ত বৃক্ষ দল নিয়ে নিঝুম হয়ে আছে কালো এক নিসর্গের ভেতর। অদৃশ্য তারাদের আলোয় হয়ত আবছা ঠাহর হচ্ছে তার জলরাশি। জুবিন এখানকার সমস্ত গাছেদের ছায়া মুখ চেনে। তাই সে বুঝতে পারে সার বাঁধা গাছেদের দলে কোনটা কুসুম কোনটা পলাশ। কোনটাই বা শিমুল জারুল কাঞ্চন রাধা-কৃষ্ণ চূড়া।

মৃদু বাতাস বইছে দূর দিগন্তে কোথাও। সেখানকার বর্ণ-বার্তা নিয়ে বড় ঝিলের ধারে এসে পৌঁছচ্ছে চাপা উত্তেজনা। গাছেরা অন্ধকারেই নড়েচড়ে উঠেছে। তাদের ডালপালায় সংযত আলোড়ন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে উত্তেজনা। বাড়তে থাকে শিহরণ। যেন হাত মাথা ঝাঁকিয়ে অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলতে চাইছে গাছেরা।

জুবিন গিয়ে বসে তার প্রিয় জায়গাটাতে। সেই কুসুম গাছের তলায়। আজ কতদিন পর। ঘরে ফেরার আশ্চর্য সুখানুভূতি ছাপিয়ে যায় তার হলুদ কষ্টগুলোকে। আরাম করে বসে সামনে তাকায় জুবিন। অন্ধকার তখনও আড়াল করে রেখেছে বড় ঝিলের সব রঙ। সব বাস্তবতা। তার ভাবতে ভালো লাগে সবকিছু আগের মতোই আছে। যেমন ছিল কিছুদিন আগেও। পলাশ গাছে ফুটেছে থোকা থোকা পলাশ রঙের ফুল। সোঁদলে সোঁদল, জারুলে জারুল আর কাঞ্চনে কাঞ্চন রঙের ফুল। কুসুম গাছ গুলো ছেয়ে গেছে কুসুম রঙের পাতায়। আর বড় ঝিলের ভেতর ভেসে থাকা আকাশি আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে সেই সব ফুলের ঝরেপড়া রাশি রাশি পাপড়ি আর পাতা।

ঘোরলাগা দুটো চোখ সামনে মেলে ঘাসের উপর বসে থাকে জুবিন। বসে বসে ভাবে তার রঙের খাতা গুলোর কথা। দিদির সঙ্গে তার রঙের টক্করের কথ। রঙের পাল্লাদারিতে তারা দুজনেই সেঞ্চুরি করেছিল। দিদির মত সেও একশোর বেশি রং খুঁজে পেয়েছিল এই বড় ঝিলের ধারে। কিন্তু তারপরেও বাড়তে থাকে রঙের যোগান। শেষে খেই রাখতে না পেরে হাল ছেড়েছিল সে। রঙের খাতাগুলো পুড়িয়ে বাধ্য হয়েছিল চাকরি করতে।

জুবিনের মনে পড়ে ঠিক এই জায়গাটাতেই সে জ্বালিয়েছিল রঙের চিতা, নিজের হাতে। সেই জায়গায় পুঁতে ছিল একটা কুসুম গাছের ফল।

সে কথা মনে পড়তেই সে ব্যস্ত হয়ে খুঁজে দেখতে যায় সেই জায়গাটা। আর অবাক হয় দেখে সে সত্যি সত্যি দেখতে পাচ্ছে। সেই ঘাসের পোড়া দাগ ঢেকে গেছে নতুন ঘাসের পরতে। আর তার মাঝখান ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে একটা কুসুম গাছের সতেজ চারা। ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে আকাশ লক্ষ্য করে।

মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকায় জুবিন। আলোর কুঁড়ি ফুটেছে বোধহয় দিগন্তের ওপারে। ফ্যাকাশে লাগছে এপারের অন্ধকার। আকাশ দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে ঝিলের জল আর তার চারপাশের গাছ গুলো। দেখা যাচ্ছে কুসুমের ছোট্ট চারা।

আবছায়ার মধ্যেই জুবিন ঠাহর করার চেষ্টা করে। আর হঠাৎই তীব্র শিহরণ খেলে যায় তার শিরদাঁড়া বেয়ে। আকাশের আলো এক দাগ বাড়তেই সে দেখে আকাশটা আকাশী হয়ে আছে এমাথা-ওমাথা। ব্যস্ত হয়ে সে তাকায় গাছগুলোর দিকে। গাছে আলো এখনো তেমন ধরেনি। এখনও কাটেনি আলো-আঁধারির ভ্রম। তবু জুবিন ঠাহর করার চেষ্টা করে আর মনে হয় যেন ফুলে ফুলে ভরে আছে গাছগুলো।

ব্যস্ত হয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। উত্তেজিত ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় গাছগুলোর দিকে। গাছের তলায় তলায় তখনও ঝুপসি অন্ধকার। ওপরের দিকে সামান্য আবছায়া। কিন্তু তাতেই তার মনে হয় সে থোকা থোকা ফুল দেখছে। পলাশে পলাশ, জারুলে জারুল…!

চোখ রগড়ে সে আবার তাকায়। ভাবে আর কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর ভোরের প্রথম আলো এসে পড়বে আর তখনই সে দেখতে পাবে সত্যিটা। কিন্তু তার তর সয় না।

সে আবার ফিরে আসে কুসুম চারার কাছে। ভেতরের সব উত্তেজনা সংযত করে শান্ত হয়ে বসে। পদ্মাসনে। ঝিলের ওপারে দিগন্তের দিকে মুখ ফিরিয়ে দু চোখ বন্ধ করে অনুভব করার চেষ্টা করে তার নগ্ন ত্বকের ওপর আলোর ছোঁয়ার রকমফের। বার্তাবাহী বাতাসের ওঠাপড়া। শ্বাস টেনে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করে ফুলেদের, ঘাস মাটি জল আর পাতাদের।

এভাবে কতক্ষন বসে থেকেছে জুবিনের খেয়াল নেই। একসময় সম্বিত ফেরে পাখির ডাকে আর সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে চায়।

চোখের সামনে যা দেখে সে বিশ্বাস করতে পারে না। অন্ধকার কেটে গেছে। ভোরের প্রথম আলো এসে পড়েছে সেই মগ্ন নিসর্গের ওপর। আর সেই আলোয় আপ্লুত হয়ে তার দিকে পালটা চেয়ে আছে যেন এক অকাল বসন্ত। বড় ঝিলের ধারে সমস্ত গাছ ভরে উঠেছে ফুলে ফুলে। যে যার নিজস্ব রঙে। পলাশে পলাশ, জারুলে জারুল, সোঁদলে সোঁদল…। মৃদু বাতাসে রংবেরঙের প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে তাদের খসে পড়া পাপড়িরা। গিয়ে পড়ছে ঝিলের জলে। জমতে জমতে যেন এক রঙিন গালিচা তারা বুনে ফেলেছে কম্পমান জলের ওপর।

অথচ একটুও অস্থির হয়না জুবিন। সে শান্ত চোখে চেয়ে থাকে এই অবাস্তব দৃশ্যের দিকে। মনে মনে সে বিশ্বাসই করে না এইসব বাস্তবে বিরাজ করছে তার চোখের সামনে। মনে হয় এক অপরূপ ভ্রম তাকে গ্রাস করেছে। এই বর্ণালী চরাচর এই, ঝিকিমিকি জলরাশি, এই রঙ্গবতী কুসুম গাছ, রংধনু মায়াকানন, আসলে বিগত দিনের ভ্রম। ঘটমান বাস্তবতা এ নয়।

সে জানে এই ভ্রম ক্ষণস্থায়ী। আর এক দাগ আলো ফুটলেই তা মিলিয়ে যাবে ফেটে পড়া বুদবুদের মত। তখন পড়ে থাকবে শুধু এক জন্ডিসে আক্রান্ত পৃথিবী।

কিন্তু সে অমর হয়ে থাকতে চায় এই অপরূপ ভ্রমের মধ্যেই। নিজের স্থায়ী আসন সে পাকা করতে চায় এই শতরংগী মায়াকাননে।

তাই সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। শান্ত সম্মোহিত ভঙ্গিতে পায়ে পায়ে নেমে যায় ঝিলের জলের দিকে। খালি পা জলে পড়তেই এক স্বর্গীয় ভালো লাগায় যেন পরিপূর্ণ মনে হয় নিজেকে। আরও সে এগিয়ে যায়, জলের যেখানে রঙিন গালিচা পেতে রেখেছে ফুলের সুগন্ধী পাপড়িরা। এগিয়ে যায় সেই দিকে, তারপর আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সেই গালিচার ওপর সে শুয়ে পড়ে চিৎ হয়ে। নিজেকে কল্পনা করতে চেষ্টা করে এই অপরূপ ভ্রমের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে। এই শতরংগী  ভ্রমের ভেতরে এক রঙিন মানুষ হিসাবে যে একদিন রং এর খাতা করেছিল।

#

সকালে পাঁচটা গ্রামের মানুষ জড়ো হয় ঝিলের পাড়ে। ভিড় করে তারা দেখে কোথাও কিছু নেই ঝিলের জলে কোত্থেকে এসে পড়েছে এক রাশ রঙিন ফুলের পাপড়ি। এক জায়গায় সেগুলো জড়ো হয়ে যেন জলের ওপর বিছিয়ে রেখেছে এক বর্ণময় শতরঞ্চি। আর সেই শতরঞ্চির ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে  সামন্ত পাড়ার জুবিন।

তার দুই হাতের শিরা কাটা। শরীরের সব রক্ত মিশে গেছে ঝিলের জলে। তার মুখ দেখে মনে হয় যেন সে কোনও হলুদ মানুষ।

****