অন্ধত্ব – স্বর্ণেন্দু সাহা

পাখি ডাকছে। অনেকে একসঙ্গে যেন পালা করে ডাকাডাকি শুরু করেছে। পাখির ডাক শ্রুতিমধুর হলেও কোরাস-কিচিরমিচিরটা কোলাহল তৈরি করে। আর এই কোলাহল ঘুমের দফারফা করে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত। সিরোলির ঘুম ভাঙল। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই সে আড়মোড়া ভেঙে শরীরের পেশিগুলোকে কর্মে নিযুক্ত হওয়ার নির্দেশ পাঠিয়ে দিল।

তারপর চোখ খুলল। অন্ধকার! বন্ধ করে আবার খুলল। কী ব্যাপার? সব অন্ধকার কেন? চোখ বন্ধ আর খোলার পর সামনে আসা দুই দৃশ্যের মধ্যে তিলমাত্র ফারাক নেই। দু’ক্ষেত্রেই জমাট অন্ধকার ঝুলছে পুরো দৃশ্যসীমা জুড়ে।

সিরোলি এবার চোখ খুলে রাখল। সে শুধুমাত্র অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু তার হিসেবমতো এখন ভোর। শরীরে একফোঁটা ক্লান্তি নেই। ঘুম সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেছে। সতেজ ভাব ছড়িয়ে আছে দেহে। পাখি-রা ডাকতে শুরু করেছে তারস্বরে।

এ-ও হতে পারে, সে এখনও চোখ বুজে রয়েছে। হয়ত ঘুমের ঘোর কাটেনি। সে-ক্ষেত্রে অন্ধকার বোধ করাই সমীচীন। বন্ধ চোখ বন্ধ করা যায় না। চোখের পাতা একে অন্যের উপর চেপে বসে থাকলে হাজার চেষ্টাতে-ও চোখ বোজা যাবে না। সে সে-ই চেষ্টা করল। তাকে অবাক করে দিয়ে স্পর্শের অনুভূতি পাওয়া গেল। সে পারল চোখ বন্ধ করতে। অবিশ্বাসী মনে সে চাপ দিল চোখের পাতা নিয়ন্ত্রক স্নায়ুতে। চোখের ঠিক নিচের চামড়ায় চাপ পড়ল একটা। সে স্পষ্ট বুঝতে পারল, এ কোনও ঘোর নয়। তার চোখ খোলা ছিল। সে আবার চোখ খুলল। না, কোনও আলোর চিহ্ন নেই।

সে চোখ খুলে বিছানার উপর শুয়ে আছে চিত হয়ে। নিকষ অন্ধকার তার সামনে। নিকষ ও নিরেট। অন্ধকার রাতে-ও কি এতটা অন্ধকার থাকে?

সিরোলি উঠে বসল। অভ্যাসমতোন চোখ পিটপিট করেই বুঝতে পারল, এই প্রক্রিয়া নিরর্থক। ঘুম ভাঙার পর আলোয় চোখকে সইয়ে নিতে সে এমনটা করে থাকে। এখন তার দরকার পড়ছে না। আলোর প্রবেশ হচ্ছেই না চোখ-অভ্যন্তরে!

খাটের মাঝখানে বসে সে বারকয়েক চোখ খোলা-বন্ধ করল, অল্প-অল্প বিরতি দিয়ে। দুই দৃশ্যের মধ্যে সামান্যও তফাত নেই। অথচ পার্থক্য সে খুঁজছে। নিশ্চিত হতে চাইছে।

সে এবার অন্য ইন্দ্রিয়ের ব্যবহারে জোর দিল। ভোর হয়েছে এটা তার ধারণা। সেই ধারণা কতটা খাঁটি তা মিলিয়ে নেওয়া জরুরী। গভীর রাত হলে চারদিক নিথর হবে। ঘড়ির কাটার টিকটিক বাদে অন্য কিছুর শব্দ কানে পৌঁছবে না। কারণ, শব্দ সৃষ্টিকারী সকলে রাতে ঘুমায়। নিশ্চিন্তে আশ্রয় নেয় অন্ধকারের মধ্যে। আলোয় ফিরে আসতে পারবে জেনেই সে-নিশ্চয়তা।

কান খাড়া করল। সে শুনতে পাচ্ছিল পাখির কলকাকলি, পাশের ঘরে সন্তান ও তার মায়ের টুকরো-টুকরো আটপৌরে কথোপকথন, বাড়ির ঠিক পাশের নর্দমা দিয়ে দ্রুতবেগে জল বয়ে যাওয়ার অত্যন্ত মৃদু নিরবিচ্ছিন্ন শব্দ।

ভোর হয়েছে। তার অন্যান্য সচেতন ইন্দ্রিয় তাকে জানিয়ে দিল যে ভোর হয়েছে। সে টের পাচ্ছিল, তার অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে কিছুটা করে। সে বুঝতে পারছিল, এটাই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যার জন্য সকলে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে থাকে।

সে বিড়বিড় করল, “তা হলে আমি!”

বিড়বিড় করার আগেই সে মূল ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল, কিন্তু আচমকা বিপুল আনন্দের খবর পেলে সেটা বিশ্লেষণ করতে মস্তিষ্ক কিছুটা সময় নেয়। সময় লাগে খুশিতে পুরোপুরি আপ্লুত হতে।

সে হেসে ফেলল ফিক করে। সে অন্ধ হয়ে গেছে। আনন্দের স্বরে স্ত্রী-কে ডাক দিল, “কিরাসা!”

   স্ত্রী ঘরে এসে ঢুকতেই সে অবশ্য তার উপস্থিতি টের পেল না। কিন্তু অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মিলিত সমন্বয়ে সে বুঝতে পারল, ঘরে কেউ এসেছে। পরমুহূর্তে কিরাসা-র চেনা গলা শুনতে পেল, “কী বলছ?”

“আমি অন্ধ হয়ে গেছি।” সে হাঁসফাঁস করে বলে উঠল। তারপরেই ছোট্ট একটা আফসোশ হল। এই কথাটা শোনার প্রতিক্রিয়া কেমন করে স্ত্রী-র মুখে ফুটে ওঠে, তা সে দেখতে পাচ্ছে না।

“মজা করছ না তো!” কিরাসার-র চোখে আশঙ্কা, আশা ও লোভ খেলা করে গেল।

“না।” আন্দাজে স্ত্রীর দিকে চেয়ে সে জবাব দিল, “তুমি তো জানোই, যা আমরা প্রতিমুহূর্তে কামনা করে থাকি, তা নিয়ে মজা করা সুস্থ মানসিকতার পরিচয় নয়।”

ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনতে পেল সিরোলি। কিরাসা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সিরোলি স্ত্রী-র হাত চেপে ধরল।

“শেষ পর্যন্ত-” কিরাসা ফোঁপাচ্ছিল, “তা হলে আমরা এবার থেকে সপ্তাহে দু’দিন প্রাণীজ প্রোটিনের সরবরাহ পাব। আমাদের ঘরের বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রতিদিন দু’লিটার করে ছাগলের দুধ পাব। চিকিৎসার খরচে পঞ্চাশ শতাংশ ছাড় পাব।”

সিরোলি বউ-এর হাত চেপে ধরে রইল আলগোছে। হ্যাঁ, চতুর্থ শ্রেণীর পরিবারকে এই সমস্ত সুযোগ দেওয়া হয়ে থাকে। অষ্টম শ্রেণী থেকে এক ধাক্কায় তারা উঠে আসবে চতুর্থ শ্রেণীতে। এ-ছাড়াও পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীর মানুষেরা তাদের মুখোমুখি হলে মাথা ঝুকিয়ে সম্মান জানাতে বাধ্য। জীবনটাই বদলে যাবে তাদের।

“তোমার কেমন লাগছে?” কিরাসা তার গালে হাত ছোঁয়াল আলতো করে। আঙুল কি একবার তার চোখ-ও ছুঁল?

সিরোলি ভাবল একটু, “আমি তো ভীষণ খুশি হয়েছি। অভিভূত। আমি এমনটা চেয়েছিলাম, রোজই চাই, কিন্তু এটা যে হয়েছে এটা ভেবেই কেমন যেন বিশ্বাস হতে চাইছে না।”

“তুমি যাবে তো এখন?” কিরাসা-র কন্ঠ উদগ্রীব।

“হ্যাঁ।” যেতে হবে শহরের প্রধানের কাছে। তাকে জানাতে হবে। তারপর তারা পেয়ে যাবে চতুর্থ শ্রেনিতে উন্নত হওয়ার অনুমতিপত্র।

কিরাসা দ্বিধান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি…মানে হেঁটে…যাবে…?”

সিরোলি হাসল ঝর্ণার মতো, “অবশ্যই হেঁটে যাব।”

অন্ধরা একমাত্র হাঁটার অনুমতি পায়। হাঁটা শরীরের কলকব্জাকে সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু সবাইকে এই সুযোগ দেওয়া হলে ভিড়ভাট্টা ও হইচই তৈরি হবে। তাই নিয়মের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ও সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়েছে এই সুবিধা-প্রাপকদের জন-ঘনত্ব।

“আমি ব্যগ্র হয়ে রয়েছি হাঁটার জন্য।” সিরোলি হেসে বলল।

প্রতিটা রাস্তায় অন্ধদের চলার জন্য পৃথক অংশ রয়েছে। পথের বাঁ দিকের মিটার দুয়েক রাস্তা আবৃত মসৃণ পাতায়। বাকি অংশের পাতারা খসখসে। খালি পায়ে হাঁটার নিয়মের দরুন চলতে-চলতে ভুলবশত কেউ যানবাহন চলার জায়গায় পা দিয়ে ফেললেও লহমায় বুঝতে পেরে পিছিয়ে আসতে পারে, ফলে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে না।

আর সে দেখতে পাবে না! সামান্য কষ্ট হল তার। সামান্যই, কারণ আনন্দটা যে অনেক বেশি। কিরাসা ধোপদুরস্ত পোশাক এগিয়ে দিল। সে ঝটপট তৈরি হয়ে নিল বেরনোর জন্য।

সিরোলি হাঁটতে শুরু করবে একটু পরেই। মসৃণ পাতার রাস্তায় প্রকৃত অন্ধ ব্যতীত অন্য কেউ পা দিলে তৎক্ষণাৎ তার পা ঝলসে অঙ্গারে পরিণত হবে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। তাই ছলচাতুরি মারফত কেউ হাঁটার সাহস পায় না। এখানে হাঁটতে চাইলে একটা মাত্র যোগ্যতা চাই, আর তা হল অন্ধত্ব। এখন তার সে যোগ্যতা রয়েছে। লোলুপ নয়নে যে-পথের দিকে তাকিয়ে অন্যরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সেই পথ দিয়ে সে আজ হাঁটবে। পথ শুরু হওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করল আনন্দটা।

প্রথম পা ফেলল সন্তর্পণে। মসৃণ পাতার উপরিভাগ তার পায়ের তলদেশ স্পর্শ করল। কিছুক্ষণের জন্য আলগা রেখে সে তারপর পুরো ভর দিল। পা একটুও ভিতরদিকে ঢুকে গেল না।

অনেক পাতা সারিবদ্ধ করে সাজিয়ে বিশেষ সংকোচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতি দু’টো পাতার মধ্যন্তরস্থ বায়ু বার করে নেওয়া হয়। ঘনসন্নিবিষ্ট পাতার সারির উপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। ফলে তৈরি হয় পাতার এক-একটা ব্লক। সেই ব্লকের পাতা-রা মসৃণ হলেও ভার পড়লে ডেবে যাওয়ার মতো নরম নয়। এই রাস্তার উপর দিয়ে তীব্রবেগে দৌড়নোও সম্পূর্ণ নিরাপদ।

প্রধানের বাসস্থানে পৌঁছে সে বিস্তারিতভাবে জানাল সব কিছু। প্রধান শুনল কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে। তারপর নিরেট গলায় বলল, “তুমি যা বলছ তা প্রমাণ করতে পারবে?”

“আজ্ঞে!” সিরোলি ঘাবড়ে গেল।

প্রধান ধৈর্য সহকারে বলল, “তোমার যে আগে থেকেই কোনও চোখের রোগ ছিল না, এবং তার ফলেই যে অন্ধ হওনি তা প্রমাণ করতে পারবে? বা আজকেই যে অন্ধ হয়েছ তার প্রমাণ আছে?”

“প্রমাণ করব কী করে?” সিরোলি অবাক হয়ে গেল, “আর করতে হবেই বা কেন?”

প্রধান নির্বিকার গলায় বলল, “কয়েক ঘণ্টা আগে একজন এসে জানিয়ে গেছে যে, সে অন্ধ হয়েছে আজকে। পরশু দিনের চোখ পরীক্ষার ফলাফলও পেশ করেছে। সেই কাগজ অনুযায়ী একদিন আগেও তার চোখ সম্পূর্ণ ভাল ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে আগামীকাল বিকেলে নতুন শ্রেণীর অনুমতিপত্র প্রদান করা হবে।”

সিরোলি হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল।

প্রমাণ! সে প্রমাণ করবে কোন উপায়ে? তা ছাড়া প্রমাণ করতে হবে এমন পরিস্থিতির উদ্ভবও হয়নি কোনোদিন। প্রতি বছর সর্বাধিক পাঁচজন মানুষের একটা করে ইন্দ্রিয় বিকল হয়ে যেতে পারে। যে-কোনও দু’জনের একই ইন্দ্রিয় নষ্ট হবে না। এযাবৎ এটাই হয়ে আসছে।

“এখন তুমি এসে বলছ! তা হলে তো প্রমাণ লাগবেই। তোমার প্রমাণ অন্তত গতকালের হওয়া চাই। তবেই তুমি-”

“আমি অন্ধ হয়েছি আজকে ভোরে। কাল রাতেও দৃষ্টিশক্তি অটুট ছিল।”

“বলায় কিছু এসে যায় না। প্রমাণ-”

“আমি আগে থেকে জানতাম যদি যে অন্ধ হব আর প্রমাণের দরকার পড়বে, তা হলে অবশ্যই চিকিৎসক দেখিয়ে চোখের অবস্থা যাচাই করিয়ে রাখতাম। কিন্তু এমন তো কখনও দরকার হয়েছে বলে শুনিনি। আমরা যে সামাজিক নিয়মাবলীর তালিকা পড়ি, তাতেও তো-” সিরোলি ক্ষুন্ন গলায় বলছিল।

প্রধান বলল, “আগে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। দু’জন দাবীদার কখনও আসেনি। তা ছাড়া, দু’জন কখনই একই বছরে একই ইন্দ্রিয় খোয়াতে পারে না। তার কাছে প্রমাণ আছে, অর্থাৎ তুমি ভুল বলছ।”

 “আমি কেন ভুল বলব?”

“তুমি যে ভুল বলছ এতে কোনও সন্দেহ নেই। আচমকা অন্ধত্ব একটা বিশাল মাপের উপহার। তুমি জানো, একমাত্র দর্শনেন্দ্রিয় অকেজো হলে কেউ এক ঝটকায় সমাজে চারধাপ উঠে আসতে পারে, অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের ক্ষেত্রে এক ধাপ। একের বেশি দাবীদার দেখা দিলে যাচাই করে নেওয়া আমার অধিকার। যাই হোক, তোমার পরিবারকে চতুর্থ শ্রেণীর সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব নয়।” প্রধান একটু থেমে বলল, “হতে পারে তোমার মস্তিষ্কে সমস্যা হয়েছে।”

“কী!” লোকটা অস্ফুটে বলে উঠল, “আমি পাগল?”

“সেটা বিচার করার দায়িত্ব আমার নয়। এই নিয়ে ঝামেলা করে সুবিধা হবে না, কারণ তোমার কাছে কোনও প্রমাণ নেই।”

“এতদিন কারও প্রমাণ দরকার পড়েনি! আজকেই?”

“এক কথা কতবার বলাবে? এতদিন দু’জন দাবিদার দেখা যায়নি। এটা অদ্ভুত কান্ড। কিন্তু নিয়মের বাইরে গিয়ে তোমাদের দু’জনকেই চতুর্থ শ্রেণীর সুবিধা দেওয়া সম্ভব নয়। ওর কাছে প্রমাণ আছে, ও পাবে। বাড়ি যাও।”

সিরোলি নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল প্রধানের দিকে। চাপা গলায় বলল, “আমি সর্বশক্তিমানের কাছে বছরের প্রতিটা দিন প্রার্থনা করেছি আমাকে অন্ধ করে দেওয়ার জন্য। যদি কোনও লাভ না-ই হয়, তা হলে এ আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ। লাভ নয় বরং ক্ষতি। আমি তবে চাই না এই অন্ধত্ব।”

“চাও না!” বিস্ময়ে প্রধানের গলা ভেঙে গেল।

“না!” সিরোলি হিংস্র গলায় বলল, “চাই না। যদি এমন কোনও দুনিয়া থাকত যেখানে ইন্দ্রিয়ের অবলুপ্তিকে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয় না। গুরুত্ব দেওয়া হয় মানুষের মেধা, বুদ্ধি আর পরিশ্রমকে, আমি অবশ্যই সেখানে চলে যেতাম।”

“এ তুমি কী বলছ!” প্রধান চমকে গেলেও মুখাবয়বে সেইভাব প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকল। কড়া গলায় বলল, “ইন্দ্রিয় না থাকা মানে স্থূল অনুভূতির দুনিয়াটা থেকে সরে যাওয়া এবং ক্রমশ প্রকৃত মহামূল্যবান ঈশ্বরকে অনুভব করতে শেখা। ইন্দ্রিয়ের কারণেই জন্ম নেয় রিপু। স্থূল আনন্দ থেকে সরে গিয়ে বৃহত্তর আনন্দে লিপ্ত হওয়াই হল জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য। ইন্দ্রিয় ত্যাগ করতে পারা মানে সে সাধু। আর প্রত্যেকে-”

“নিকুচি করেছে ত্যাগের। আমি অন্ধ হয়ে গেলাম অথচ আমি নাকি ভুল বলছি! এই ব্যবস্থায় গন্ডগোল আছে। বিনীত ভাবেই জানিয়ে রাখছি, ব্যবস্থায় গলদ রয়েছে। নিয়মে সংশোধনী প্রয়োজন।”

প্রধান নিস্তব্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি একটা গুরুতর অভিযোগ করছ।”

“হ্যাঁ, করছি।”

“সেটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সারবত্তাহীন।”

“ভিত্তি না থাকলেই সব অভিযোগ খণ্ডিত হয়ে যায় না।” গোঁয়ারের মতো বলল সিরোলি।

প্রধান একটু সময় নিয়ে বলল, “বেশ। আগামীকাল বিকেলে এসো। তোমায় পরীক্ষা করে দেখা হবে। অন্যজন তো আসছেই। তারপর সিদ্ধান্ত নেব।”

পাঁচটা ইন্দ্রিয়। চোখ, কান, নাক, ত্বক ও জিহ্বা। ইন্দ্রিয় ব্যতিরেকে বেঁচে থাকা মানে ক্লীবলিঙ্গরূপে নিজেকে টিকিয়ে রাখা যা একটা প্রাণ হিসেবে মূল্যহীন। ইন্দ্রিয় না থাকলে পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীবনকে উপভোগ করা অসম্ভব।

যে পরিবারের কর্তার কমপক্ষে একটি ইন্দ্রিয় দৈবিক কারণে বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে অকেজো হয়, সেই পরিবার সমাজে আলাদা খাতির পায়। অকেজো ইন্দ্রিয়ের সংখ্যার সঙ্গে সামাজিক অবস্থানের উচ্চতাবৃদ্ধি সমানুপাতিক। কিন্তু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় হিসেবে গণ্য করা হয় চোখকে। তাই অন্ধরা এই সমাজের বিশেষ এক অংশ। ক্রমশ পাঁচটা ইন্দ্রিয়-ই একে-একে কাজ করা থামিয়ে দিয়েছে, এমন সৌভাগ্যবান মানুষ বিরল। সে হয়ে ওঠে শহরের প্রধান। তবে তাকে অন্যের দয়ায় বাঁচতে হয় না। সে লাভ করে অতীন্দ্রিয় শক্তি। সাধারণ মানবদেহের শারীরবৃত্তীয় গঠনের মধ্যে এই শক্তির অস্তিত্ব নেই। এরা জন্মায় মস্তিষ্কের স্নায়ুতে। যে-রহস্য এখনও বিজ্ঞানের অধরা।

কিন্তু তার বেলা কী হল? সিরোলি গভীরভাবে চিন্তা করতে করতে হেঁটে চলল। গতরাত্রের ঘুমানোর আগে অবধি দেখা দৃশ্যের ছবি সে ইচ্ছা করলেই মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। এ কেবল কল্পনা নয়। এ হল স্মৃতি।

বাড়ির কাছাকাছি এসে সে একটা গুঞ্জন শুনতে পেল। যেন কিছু মানুষ ভিড় জমিয়েছে। কথাবার্তা বলছে। সিরোলি কাছাকাছি যেতেই তারা ঘিরে ধরল।

“আরে! তুমি অন্ধ হলে এইবার!”

“দারুণ খবর যা-হোক!”

দেঁতো হাসি হেসে প্রতিবেশীদের কাটিয়ে দিয়ে সে ঘরে এল।

কিরাসা হেসে বলল, “ওরা শুভেচ্ছা জানাতে এসেছে।”

“ধুস ধুস!” সিরোলি বিড়বিড় করল।

“কী হল?” কিরাসা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি খুশি নও!”

সিরোলি নিচু গলায় বলল, “প্রধান বলল, আরেকজন অন্ধ হয়েছে।”

     কিরাসা স্তম্ভিত হয়ে গেল, “দু’জন! কেন!”

“জানি না। প্রমাণ লাগবে, আমি-ই যে অন্ধ হয়েছি আজকে, তার সুনিশ্চিত প্রমাণ দিতে পারলে তবেই-”

কিরাসা হড়বড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি গিয়ে বলব-”

    সিরোলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তখন বলবে আমাদের সবারই মাথা খারাপ হয়েছে এক সঙ্গে। তখন আর কোনও কথা-ই গ্রাহ্য হবে না। প্রধান বলেছে কাল বিকেলে যেতে। পরীক্ষা করবে কীসব! ধুস! আমি আর কিছু বলতে-ই যাব না। ঝামেলা করে লাভ নেই। ভাল লাগছে না।”

“পাগল তুমি? হক ছেড়ে দেবে? কেঁদে-ককিয়ে যা কেউ পায় না, তা পেয়েও ছেড়ে দেবে তুমি?”

“আর তো কিছু করার নেই!”

কিরাসা শক্ত গলায় বলল, “না। তোমাকে যেতেই হবে। তোমার অধিকার তুমি ছাড়বে না।”

কাজটা মোটেই শক্ত ছিল না।  অবশ্য বে-নিয়মের পথে চলার কাজ কখনই সহজ হয় না। প্রথমদিইকে বেশ শক্ত-ই ঠেকে, তারপর ধীরে-ধীরে অভ্যাস হয়ে যায়। এই প্রথম নয়, একেবারে ছোট থেকেই যাবতীয় নিয়ম চোখ বুজে মেনে নেওয়া তার ধাতে নেই। নিয়মটা তার বুদ্ধি অনুযায়ী যুক্তিযুক্ত ঠেকলে তবেই সে মেনে চলত, নচেৎ নয়। নিয়ম-না-মানা তার একপ্রকার অভ্যাস হয়ে গেছে।

চার বছর বয়স পূর্ণ হতে বাবা তাকে বলেছিল যে, তাকে শিক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে। সে অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল, “কী হয় সেখানে?”

“শিক্ষাদান।”

সে আবার অবাক হয়েছিল। শিক্ষা? কী হবে শিক্ষা দিয়ে? এই তো মা তাকে টুকটাক হাতের লেখা শেখায়, বাবা যোগ-ভাগ শিখিয়েছে কয়েকদিন আগেই। আবার নতুন কী শেখবার আছে?

“তোমরা সেই শিক্ষা দিতে পারবে না?”

বাবা হেসে বলেছিল, “না, আমরা ততটা জ্ঞানী নই। সেখানে আলাদা-আলাদা বিষয়ের শিক্ষক রয়েছেন যারা বিশদভাবে তোকে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদ্যায় ভরিয়ে তুলতে পারবেন।”

“অত শিখে কী লাভ বাবা?”

“লাভ কী বা কতটা তা হলফ করে বলা মুশকিল, কিন্তু না শিখলে লোকসান হবে। অশিক্ষিত মানুষকে সমাজে অগ্রাহ্য করা হয়। কেউ তোর কথায় কান দেবে না।”

যুক্তি আছে তাই মেনে নিয়েছিল সে। শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে নিয়মমাফিক শিক্ষায় মাথা বোঝাই করে এসেছে। তরুণ বয়সে পৌঁছনোর পর সরকার থেকে তাকে নির্দিষ্ট কাজে জুতিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজ কেন করতেই হবে এই প্রশ্নের অত্যন্ত যুক্তিসংগত উত্তর সে নিজেই বুঝতে পেরেছিল। জগত দাঁড়িয়ে আছে বিনিময় প্রথার উপরে। বেঁচে থাকতে হলে তাকে খেতে হবে আর সেই খাদ্যের যোগান পাওয়ার জন্য মূল্য হিসেবে তাকে দিতে হবে শ্রম। ইতিমধ্যে বাবা-মা আচমকা মারা গেছিল জীবানুবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে। সে একা হয়ে পড়েছিল। অবশ্য একা থাকা তার মন্দ লাগত না। তার বাড়ির পিছনদিকে একটা মাঝারি আকারের শস্যের ক্ষেত রয়েছে। তিনফসলি জমি। চাষ করার জন্য নির্দিষ্ট লোক রয়েছে। তার দায়িত্ব হল, মাঠে ফসল পেকে উঠলে তা সংগ্রহ করে ক্ষেতের লাগোয়া পরিখার মতো দেখতে লম্বা-লম্বা গভীর নির্জলা গর্তে সে-সব ফেলে দেওয়া। তারপর কী হয় সে জানে না। তার জানার কথাও নয়। কাজের বিনিময়ে প্রতিদিন সকালে তার ঘরে মাপমত কাঁচা খাদ্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। চাল, ডাল পায় নিয়মিত। কখনও কিছু সবজি। কালেভদ্রে দুধ, ডিম। এ ছাড়া কিছু পরিমাণ অর্থ। কোনও শখ নেই বলে পুরো টাকাটা-ই সে রেখে দেয় ধরে।

এই প্রকার খাদ্যের সরবরাহ শুধুমাত্র তার একার জন্য নয়। সকলের জন্য একই ব্যবস্থা। অষ্টম শ্রেনীর প্রত্যেকটা মানুষ একই রকম খাদ্যের জোগান পায়। যার কাজের প্রকৃতি যেমনই হোক না কেন খাদ্যের পরিমাণ বা গুনমান বদলায় না। একজন চাষি ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকর্তা, উভয়েই একই খাদ্য পাবে, যদি তারা দু’জনেই একই শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত হয়।

খাদ্য প্রাপ্তির পরিবর্তন ঘটে শ্রেণীর পরিবর্তন অনুযায়ী।

অন্তর্মুখী ও ঠোঁটকাটা এই দুই-গুনের সমন্বয়ে কেউ গঠিত হলে লোকজন তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সে সচরাচর নিজে থেকে কারও সঙ্গে খেজুর করতে যায় না। দৃষ্টিশক্তি সাধারণত অত্যন্ত ধীরগতিতে হ্রাস পায়। ফলে ভুক্তভোগী বা রোগি চট করে টের পায় না যে তার চোখের জ্যোতি কমছে। অনেকটা দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার পরে ব্যাপারটা আন্দাজ করা যায়। রিহাস যখন টের পেয়েছিল, তার কাছে তখন পথ খোলা ছিল চিকিৎসা কিংবা প্রয়োজনে চশমা ব্যবহারের। কিন্তু সে আগ্রহ পায়নি। চলে তো যাচ্ছে, চলুক। সে তো আর লেখাপড়ার কাজ করে না যে তীক্ষ্ণ নজর চাই। ফালতু হাঙ্গামা না করাই ভাল। স্বাভাবিকভাবে দেখতে পাওয়ার জন্য চামচের ফাঁদালো অংশের মতো দু’টো কাঁচ দিয়ে তৈরি জিনিসটা চোখের ঠিক সামনে নাকের উপর রাখা যায়! কি বিসদৃশ দেখাবে!

   তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে চলছিল। একেবারে সামনে ছাড়া দূরের কিছু দেখতে পাচ্ছিল না মাসখানেক যাবত। অথচ নিজের কাজটুকু করে যেতে তার তেমন সমস্যা হচ্ছিল না। যেটুকু দেখতে পেত, তা দিয়ে ফসল সংগ্রহের কাজে ঝামেলা হয় না। তাই কেউ ওর দৃষ্টিশক্তির গড়বড়ের ব্যাপার জানতেই পারেনি। দিনের পর দিন ক্রমশ পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছিল। পরশু দিন সকালে উঠে চোখ মেলে দেখল, কিছুই আর দেখার মতো নেই।

ভীষণ-ভীষণ আফসোস হতে শুরু করল রিহাসের। আর দু’দিন পরে এই ব্যাপারটা ঘটলে তার জীবনটা অন্য খাতে বইতে শুরু করত। তার শ্রেণী বদলে যেত। সে চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকে পর্যবসিত হত।

তখনই ভাবনাটা তার মাথায় এল। টং করে কিছু একটা যেন নড়ে উঠল মাথার ভেতরে। মস্তিষ্কের ঘুমন্ত কিছু কোশ সুষুপ্তি ছেড়ে সক্রিয় হল। রিহাস খতিয়ে দেখল তার পরিস্থিতিটা। সামান্য বুদ্ধিও যদি সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় খাটানো যায়, তবে তা নিছক বুদ্ধি নয়, জীবনযাত্রায় বিপ্লব আনবার জনক। ঈশ্বর হয়ত নিয়ম তৈরি করেছেন, কিন্তু তিনি যদি চাইতেন যে তার সন্তানেরা কখনও নিয়মের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না, তা হলে তিনি নিশ্চয়ই মানুষকে ভাবনার ক্ষমতা দিতেন না। কে হলফ করে বলতে পারে, ইশ্বরের অর্পিত নিয়ম আসলে নিয়ম নয়, বরং এক ধরণের পরীক্ষা। তিনি মনোযোগ দিয়ে দেখছেন, কে বা কারা তাঁর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে।

বছরের একটা মাত্র দিনে ইন্দ্রিয়ের অবলুপ্তি হলে রাষ্ট্র কর্তৃক সুবিধা পাওয়ার কনসেপ্টটা কখনও তার কাছে সঠিক বলে মনে হয়নি। দৈবিক আশীর্বাদ ছাড়াও রোগ, লোভ এবং কামনা মানুষকে অন্ধ করে দিতে পারে। অনেকে তো চোখ থাকতেও কত কিছু না দেখার ভান করে এড়িয়ে যায়। দৃষ্টিশক্তি একটা ক্ষমতা, সেটা থাকতেও যদি কেউ-কেউ স্বার্থঘটিত কারণে তা ব্যবহার না করে অথবা ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নির্বিকার থাকতে পারে এবং সেখানে কোনও নিয়ম চোখ রাঙা্তে আসে না, তবে সে-ই বা পরোয়া করবে কেন?

মতলবটা ঝালিয়ে নিয়ে চুপচাপ পুরো একটা দিন ঘরে বসে রইল রিহাস। পরের দিন সন্ধ্যায় কাঠবিড়ালির গলায় চিরকুট ঝুলিয়ে ডাকিয়ে আনল স্বনামধন্য এক চিকিৎসককে। কথা না বাড়িয়ে সঞ্চিত অর্থের অর্ধেক তার সামনে ধরে দিয়ে সোজাসুজি বলল নকল প্রেসক্রিপশন বানিয়ে দিতে।

ডাক্তারি চোখ সহজেই তার অন্ধত্ব ধরে ফেলল। হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেন এটা করতে চাইছ?”

রিহাস বলল। সে জানে, না বললে ডাক্তারের মনে সন্দেহ জন্মাবে, আর তার ফলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। বললে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। খাদ্যের সরবরাহ শ্রেণী অনুযায়ী হলেও পোশাক, বিলাস-ব্যসন কিংবা শ্রেনি-বহির্ভূত খাদ্যের জন্য অর্থ দরকার। অর্থের প্রয়োজন সকলেরই, বিশেষ করে ভোগিদের। কেউ-ই এতটা অর্থ আলটপকা পেয়ে গেলে ছাড়বার মতো বোকামি করবে না।

প্রত্যাশা মতো ডাক্তার ভদ্রলোক তার বক্তব্য শুনে তেমন গুরুত্ব দিল না। করুক এর যা ইচ্ছা। তার কী এসে যায়? মাঝখান থেকে এককাড়ি টাকা সে পেয়ে গেল! না, এখনও পায়নি। সে দ্রুত খসখস করে কলম চালিয়ে লিখে ফেলল একটা মনগড়া প্রেসক্রিপশন। তাতে বলা হল বিশ্রাম নেওয়ার কথা। রিহাসের চোখে কোনও গড়বড় নেই। কয়েকদিন ধরে কিছুটা মানসিক চাপে ভোগার দরুন মাথা ব্যথা।

রিহাস হাসল মূল্যবান হয়ে দাঁড়াতে চলা কাগজটা হাতে ধরে। এ-বছর যার-ই চোখ বিগরোক, তার কাছে এ-রকম কোনও প্রমাণ থাকবে না। কারণ কেউ ভাববেই না এইদিকটা নিয়ে।

ফলে সে জিতবে।

ডাক্তার এই অদ্ভুত আচরণ চেপে রাখতে পারল না। ঘটনাটা ফাঁস না-করার জন্য সে টাকা নিয়েছে, সুতরাং কাউকে বলা উচিত নয়। কিন্তু সত্যিটা এড়িয়ে গিয়ে লাভবান হওয়ার এই নীতি মন্দ নয়। আউটপুট যাতে সর্বাধিক হয়, সেই অনুযায়ী আমরা ইনপুটের ধারা পরিবর্তন করে থাকি। এ-ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আদতে একই। সত্যিটা অস্বীকার করে যদি অধিক সুবিধা-প্রাপ্তি ঘটে, তা হলে ক্ষতি কী?

রাতের খাবার খেতে-খেতে পত্নীকে এই নীতি ব্যাখ্যা করল ডাক্তার। বলার আগে বলবে কিনা তা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখল না। কারণ তার জানা ছিল না, অনিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খল বিক্রিয়া কীভাবে জন্ম নেয়।

 দুই দাবিদার প্রধানের  বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। রিহাস কাগজ হাতে করে এনেছে বুকের পাঁজরের মতো করে। সে জানে এটাই তার প্রধান ও একমাত্র অস্ত্র। এটা দিয়েই সে তার প্রতিযোগীকে হারিয়ে দিতে পারবে অনায়াসে। ব্যস আর তারপরেই চতুর্থ শ্রেনী! স্রেফ সামান্য কিছু সময়ের অপেক্ষা।

সিরোলি-র মেজাজ বড্ড খারাপ হয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে ঘরে সে ছাড়া অন্য একজন-ও আছে। সম্ভবত আরেকজন অন্ধ। এই খানিক আগেই কেউ একজন এসে তার মাথা একটা যন্ত্রে ঢুকিয়ে কীসব করল। তারপর হতাশার শব্দ বেরিয়ে এল যন্ত্র চালানো মানুষটার মুখ থেকে। কী দেখল কে জানে! দেখতে না পাওয়াটা এখন কেমন যেন বিরক্তিকর ঠেকছে! যদি শেষপর্যন্ত চতুর্থ শ্রেনীর-

প্রধান এসে ঘরে ঢুকল। দু’জনের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, “রিহাস, তুমি হঠাৎ দু’দিন আগে আচমকা চোখ পরীক্ষা করালে কেন?”

রিহাস বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিল, “সেদিন বিকেলে চোখটা কেমন যেন ব্যথা-ব্যথা করছিল। মা বলত, চোখকে কোনোদিন অবহেলা করবি না। মায়ের কথা মনে পড়ল। আমি তাই ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনলাম।”

প্রধান সহানুভূতির কন্ঠে বলল, “ভালই করেছ। মায়ের কথা মনে রেখেছ এটা খুব ভাল ব্যাপার। তুমি অবশ্যই তার একজন উপযুক্ত সন্তান।”

রিহাস মনে মনে হাসল। মা আদৌ এসব কিছু বলত কীনা তার জানা নেই। কিন্তু সমাজে মা-কে বিশেষ গুরুত্বের চোখে দেখা হয়ে থাকে। যে মাকে সম্মান দেয়, তাকেও সমাজ উঁচু নজরে দেখে।

প্রধান গলাখাঁকারি দিল, “সিরোলি বলতে চাইছে, আমাদের প্রকৃতির এতদিন ধরে চলে আসা নিখুঁত ব্যবস্থাপনায় নাকি গন্ডগোল আছে। ও অন্ধ হয়েছে আজকেই ভোরে। নিয়ম অনুযায়ী দু’জনের একই ইন্দ্রিয় খারাপ হতে পারে না। এ-ক্ষেত্রে, যদি সিরোলি-র কথা মেনে নিতে চাই, তবে এই বছর আজকের দিনে দু’জন অন্ধত্বের উপহার পেল, যা অসম্ভব।”

রিহাসের হাসি পেল। অসম্ভব আবার কী? নিয়মমাফিক কিছু না ঘটলেই অসম্ভব বলে দেগে দেওয়া যায়! নিয়ম এল কোন মুলুক থেকে? কে বানাল এত ঘড়া-ঘড়া নিয়ম? 

“সিরোলি!” প্রধানের গলা ঈষৎ গম্ভীর হয়ে গেল, “তুমি প্রশ্ন করেছিলে যে ও হঠাৎ চোখ কেন পরীক্ষা করিয়েছে। তার জবাব পেলে নিশ্চয়ই। এরপরেও কি বলবে-”

“হ্যাঁ। এরপরেও বলব যে কিছু একটা ভুল হচ্ছে। আমি আজকে অন্ধ হয়েছি। আমি সেটা খুব ভাল করেই জানি।”

“তোমার মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, সেখানে কোনও গোলযোগ হয়নি। মনস্তাত্বিক কোনও রোগের বিন্দুমাত্র আভাস মেলেনি। সত্যিই বড় অদ্ভুত পরিস্থিতি! তবে তো একটা হাস্যকর সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হচ্ছে যে, এই বছরে দু’জন তাদের একই ইন্দ্রিয় অবলুপ্তির আশীর্বাদধন্য হয়েছে।”

“তাই দাঁড়াচ্ছে।” সিরোলি আশান্বিত হল।

“কিন্তু রাষ্ট্রের সামগ্রিক ইতিহাসে এমন কখনও হয়নি।”

“ইতিহাস কী বদলাতে পারে না?” সিরোলি নিচু স্বরে বলল।

প্রধান জলদগম্ভীর স্বরে বলল, “সে ব্যাপারে তোমার কথা বলার কোনও এক্তিয়ার নেই। ইতিহাস তুমি তৈরি করোনি। ইতিহাস তোমার, আমার থেকে অনেক বড়। সভ্যতার ভিত হল ইতিহাস। এই ইতিহাস আচমকা, জানান না দিয়েই বদলানো শুরু হতে পারে না। ইতিহাসের উপর ভরসা থেকে অন্তত এটুকু নিশ্চিত ভাবে বলা যেতে পারে যে, সমস্যাটা অন্য কোথাও। তোমার কাছে প্রমাণ নেই। তাই সিরোলি, আমি আমার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কোনও কারণ পাচ্ছি না। তুমি অষ্টম শ্রেণীতেই থাকবে। রিহাস, তোমায় অভিনন্দন, তুমি আজ থেকে চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিক। নাও অনুমতি-”

“না!” সিরোলি চিৎকার করে উঠল, “আমার প্রাপ্য আপনাকে দিতেই হবে। নইলে-”

“নইলে?”

“নইলে-” সিরোলি মনস্থির করে নিল, “আমি এখানেই বসে থাকব মৃত্যু না-হওয়া পর্যন্ত। কেউ আমাকে সরাতে পারবে না।”

সিরোলি দাঁতে দাঁত চেপে প্রস্তুত হল কটু বাক্য শোনার জন্য। তার জেদ কম নেই। সে কিছুতেই হার মেনে নেবে না। সে কোনও অন্যায্য দাবী করছে না। তার ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। প্রধান যা-ই বলুক না কেন, সে নিজের অবস্থান থেকে বিচ্যুত হবে না।

তিরস্কার নয়। বদলে অকস্মাৎ সে ঠান্ডা হাওয়ার একটা ঝাপটা টের পেল। মুখের চামড়ার উপর শীতল পরশ বুলিয়ে গেল বাতাস।

হাওয়া! মানসিক চাপের মধ্যেও সিরোলি অবাক না হয়ে পারল না। চারদিক বদ্ধ একটা ঘরের ভিতরে তারা তিনজন রয়েছে। দরজা পিছনদিকে আর সেটাও বন্ধ। হাওয়া এল কোথা থেকে?

সে শুনতে পেল প্রধান বিড়বিড় করছে, “দেওয়ালটা উধাও হয়ে গেছে! একি!”

দেওয়াল উধাও! প্রধানের অতীন্দ্রিয় অনুভূতি আছে। তার সাহায্যে সে বুঝতে পেরেছে কিছু। সেই বোধগম্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার চিন্তাটাই অবাস্তব। কিন্তু দেওয়াল উধাও হবে কী করে? সিরোলি ও রিহাস কেউই কিছু বুঝতে পারল না।

প্রধান বলছিল বিড়বিড় করে, “এ কেমন অশৈলি কান্ড! দেওয়ালটা…”

দরজা খোলার শব্দ হল। কেউ একজন দ্রুত প্রবেশ করল ঘরে। উত্তেজিত এবং ভিত স্বরে বলল, “মাননীয়, চারদিক-চারদিক কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। গাছ, বাড়ি, রাস্তা সব অল্প-অল্প করে অদৃশ্য হয়ে-”

বলতে-বলতে সে থেমে গেল। পরক্ষণে চেঁচিয়ে উঠল, “মাননীয়, আপনার ডান হাত কাঁধ থেকে উধাও হয়ে গেছে!

সবাই কী একসঙ্গে পাগল হয়ে গেল নাকি! রিহাস বিরক্ত হয়ে ভাবল। আপনাআপনি একটা জড় দেওয়াল ‘নেই’ হয়ে যেতে পারে নাকি? আবার হাত উধাও! আচ্ছা, এটা কোনও পরীক্ষা নয় তো? না! প্রধান একবার যখন ঘোষণা করে দিয়েছে, তার আর নড়চড় হবে না। তা ছাড়া অনুমতিপত্র-ও বলামাত্র সে ঝট করে নিয়ে নিয়েছে। সে এখন চতুর্থ শ্রেনীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে। এটা একটা ভাল খবর। মুহূর্তটা উপভোগ করা যাক। লোকের পাগলামোয় নজর দেওয়ার দরকার নেই। তা ছাড়া, রিহাস হেসে ফেলল, অন্ধ হয়ে সে আর নজর দেবেই বা কী করে?

ঘরের মধ্যে তৈরি হওয়া বিশৃঙ্খলাকে উপেক্ষা করে অভ্যাসমতন প্রধানকে অভিবাদন জানিয়ে রিহাস ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সামনেই পায়ে হাঁটা রাস্তা রয়েছে। সে পা ফেলল।

কিন্তু পা শূন্যতা খুঁজে পেল। পথ নেই।

রিহাসের ভুরু কুঁচকে গেল। ব্যাপার কী! এখানেই তো রাস্তা ছিল। এখন না থাকার কোনও যুক্তি নেই। আর যুক্তি ছাড়া সে কিছুই মেনে নিতে-

ভাবনা শেষ করতে পারার আগেই যাবতীয় যুক্তিবাদকে টিটকিরি দিয়ে রিহাস নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। পথ আরম্ভ হওয়ার প্রান্তে একটু আগে যেখানে সে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে কয়েক মুঠো শুকনো বাতাস বিনা বাধায় বয়ে গেল এলোমেলোভাবে।

স্রেফ সত্যি ও পারস্পরিক বিশ্বাসকে ভিত করে গড়ে ওঠা একটা দুনিয়ায় শক্তিশালী ভাইরাসের মতো মিথ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করছিল। ফলে, সেই জগতটা আবছা হতে-হতে একসময় তার আর অস্তিত্ব রইল না কোথাও।

প্রচ্ছদঃ সায়ন্তনী দাশগুপ্ত

*****