প্রচ্ছদবর্ণনা:
তিন দিক থেকে তিনটি হাত বিভিন্ন মাপের টুকরো একত্রে এনে একটা গোটা ছবি তৈরি করার চেষ্টায় আছে। ডান দিকে উপরের হাতটির রঙ হলুদ, সেটি নীলচে বেগুনি রঙের একটি টুকরো জুড়ছে। এতে কালো রঙের সরলরেখা ছড়িয়ে রয়েছে, মাঝে মাঝে একটি তথাকথিত স্বাভাবিক চোখ ও একটি লেখনরত হাত রয়েছে। উপরে বাঁ দিকের হাতে ত্বকের রঙ বাদামি, হাতটি হলুদ একটি অংশ নিয়ে আসছে, যার উপর লাল ‘Approved’ লেখা স্ট্যাম্প দেওয়া রয়েছে। এদের মাঝে একটি কালো অংশ রয়েছে, যাতে সাদা রঙের সুতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বাঁ দিকে নিচের দিকে একটি হাত এসেছে যার ত্বকের রঙ সাদাটে। এটি যে অংশটি নিয়ে এসেছে, তা লালচে বেগুনি, ও তাতে নীল রঙে একটি লাউডস্পিকার ও কতগুলি সুতো রয়েছে। মাঝে একটি বেগুনি অংশ রয়েছে যাতে conversation bubble রয়েছে। একটি সাদা অংশে নীল-সাদা-কালোতে একটি ‘evil eye’ ও একটি হলুদ অংশে ‘eye of Horus’ রয়েছে।
সম্পাদকীয় মুখবন্ধ: Disability সম্পর্কে পড়াশোনা করে জানা এবং Disability-কে যাপনের অঙ্গ হিসেবে জানা, দুই অভিজ্ঞতার মধ্যে বিস্তর ফারাক থেকে যায়। তাই থার্ড লেনের Disability-কে চিনতে চাওয়ার যে যাত্রাপথ, তাতে সবার আগে এসে পড়ে ব্যক্তিগত যাপনের অভিজ্ঞতা। সক্ষমতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সমাজে সেই যাপনের অভিজ্ঞতার ঘাটতি থেকে যায়। অক্ষমতা, বিশেষ চাহিদা, বিশেষভাবে সক্ষম, দিব্যাঙ্গ, ইত্যাদি বিভিন্ন শব্দ সমাজে প্রচলিত বটে, তবে প্রতিটি শব্দের সাথে নির্দিষ্ট কিছু ইতিহাস জড়িত। আলোচনার পরিসরে Disability শব্দটিই বারবার ব্যবহৃত হয়েছে, তাই আমরাও এক্ষেত্রে এই শব্দটিকেই বহাল রেখেছি।
Disability সম্পর্কে আমরা যারা প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, তারা প্রত্যেকেই তথাকথিত সক্ষম সমাজের প্রতিনিধি।
এই কথাবার্তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল Disability-র যাপনকে কাছ থেকে জানা এবং পাঠকের কাছে তার কিছু অংশ তুলে ধরা। সচেতনভাবে সক্ষমবাদের প্রভাবকে এড়ানোর চেষ্টা করলেও কথাবার্তার চলনে কখনও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সক্ষমতাও প্রতিফলিত হয়েছে, যা যত্ন করে শুধরে দিয়েছেন সাক্ষাৎকারদাতারা। প্রাথমিকভাবে সকলের কাছে প্রশ্ন থাকলেও একেকজনের পৃথক উত্তরের মধ্য দিয়ে কথাবার্তা ভিন্ন ঢঙে এগিয়েছে। এই আলাপের যাত্রাপথ খানিক দীর্ঘ যা ব্যক্তিপরিচয় থেকে দৈনন্দিন জীবন হয়ে সরকারি নীতি, ভ্রান্ত ধারণা ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে মূলত দৃষ্টিহীনতাকে কেন্দ্র করে। প্রথম পর্বে কেবল থাকছে সমাজে পরিচয় সংক্রান্ত আলোচনা। পরবর্তী পর্বগুলিতে বাকি অংশগুলি আলোচিত হতে থাকবে।
সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন – যীশু দেবনাথ, মনজিৎ কুমার রাম, ও সোমেন দত্ত
মুখ্য পরিকল্পনা ও সাক্ষাৎকার গ্ৰহণে: সোমালী
সহায়তা: চিরায়ত কুশারী
স্থান : যাদবপুর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস
প্রশ্ন: কাউকে নিজেদের পরিচয় দিতে হলে কেমন করে দেবেন?(সকলের প্রতি প্রশ্ন)
যীশু: আমার নাম হচ্ছে যীশু দেবনাথ। আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করি বাংলা বিভাগে। প্রাথমিকভাবে এইটাই আমার পরিচয়। আসলে বিভিন্ন লোকের সাপেক্ষে বিভিন্ন রকমভাবে পরিচয় দিতে হয়। ধরা যাক, এমন যদি হয়, যিনি আমি কী করছি সেটাতে ইন্টারেস্টেড নন, আমি কোথায় থাকি সেটাতে ইন্টারেস্টেড, তাকে আমি কোথায় থাকি সেই পরিচয় দিতে হয়। বা যিনি আমার ডিসেবিলিটি নিয়ে ইন্টারেস্টেড, তাকে বলতে হয় যে আমি কোন স্কুলে পড়েছি বা অন্য কোন ডিসেবেলড মানুষকে চিনি কিনা, কোন অর্গানাইজেশনের সাথে যোগাযোগ আছে কিনা – এরকম বিভিন্ন আইডেনটিটি থাকে। ডিসেবিলিটির আইডেন্টিটি ও বিভিন্ন জায়গায় দিতে হয়।
প্রশ্ন: যদি মানুষ যীশুদার কথা বলি, তাহলে কীভাবে পরিচয় দেবেন?
যী: তাহলে তো শুধু এইটুকুই পরিচয় – আমার নাম যীশু, আর আমি যা যা ভালবাসি, সেগুলো দিয়েই আমার পরিচয়..যেগুলো করতে পছন্দ করি..
প্রশ্ন: কী কী পছন্দ করেন?
যী: যেমন.. আমি অল্পবিস্তর পড়াশুনো করতে পছন্দ করি, গান গাইতে পছন্দ করি, লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে পছন্দ করি, খাওয়াদাওয়া করতে পছন্দ করি, বেড়াতে যেতে পছন্দ করি। এগুলোই আইডেন্টিটি, আদারওয়াইজ কিছুনা। হুমম…ইউনিক আইডেন্টিটি কিছু নেই আরকি। এগুলো দিয়েই আমাকে চিনতে হবে।
প্রশ্ন: আর ডিসেবিলিটি এক্ষেত্রে কিভাবে চলে আসে?
যী: হ্যাঁ.. অনেক..অনেক এরকম জায়গা আছে যেখানে আমার এই ডিসেবিলিটি.. আমি যে একজন ডিসেবেলড মানুষ, সেই আইডেন্টিটিটা জানা খুব জরুরী। সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে, কিংবা ডিসেবিলিটি সার্টিফিকেট বের করার ক্ষেত্রে, কিংবা যেখানে ডিসেবেলড হিসাবে আলাদা কোন ফেসিলিটি আমাকে নিতে হবে সেইসব ক্ষেত্রে। তখন ডিসেবিলিটি আইডেন্টিটি বলতে গিয়ে লোকজনকে খুব চলতি ভাষায় যেগুলো বলতে হয়— যে ‘আমি প্রতিবন্ধীইই’(বিদ্রূপাত্মক), ‘আমার চোখের সমস্যা আছে’, কিংবা ‘আমার দেখার সমস্যা আছে’, এধরনের কথা বলতে হয়। রিসেন্টলি যেটা এক্সপিরিয়েন্স করেছি, সেটা হচ্ছে যে এয়ারপোর্টে গিয়ে। ঐ সোমেনের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আমি ত্রিপুরা গেছি, এসেছি। তারপরেও গেলাম কয়েকদিন আগে একবার। তো তখন এয়ারপোর্টে গিয়ে বলতে হল যেহেতু আমি লো ভিশন, সবসময় খুব খেয়াল করে না দেখলে বোঝা যায়না যে সমস্যা আছে। লোকজনকে গিয়ে বলতে হল যে আমার ডিসেবিলিটি আছে, চোখের অসুবিধা আছে, চোখে দেখার। আমাকে একটু অ্যাসিস্ট করুন।
এটা মাঝে মাঝে বলতে হয়না। অ্যাসিস্ট সবসময় করতে হয়না। যখন প্রয়োজন হয় তখন এটা এভাবেই বলতে হয়। আর এটা কখনো কখনো খুব এমব্যারাসিং। যেমন কখনো কখনো লোকজন জিজ্ঞেস করেন, ‘কী ব্যাপার আপনি এখানে কেন?’ তখন বলতে হয় যে, ‘আমার ডিসেবিলিটি আছে’, কিছুক্ষণ লোকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। মানে বুঝতে পারেনা, আইডেন্টিফাই করতে পারেনা সেইজন্য। এইভাবে বলতে হয়, আদারওয়াইজ কিছু নয়।
##
মনজিৎ : আমি মনজিৎ কুমার রাম, আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে গবেষণা করছি। পরিচয় দেবার সময় আমি এইটুকুই বলি। প্রাথমিকভাবে নামটাই বলি, তারপরে যদি, যেটা যীশুও বলল, যেখানে যেরকম প্রয়োজন হয়, সেরকমভাবে আমি আমার পরিচয়টা দিই। তবে বেশীরভাগ সময়েই আমি এই পরিচয়টাই বলি, যে আমি কী করি এবং কোথায় থাকি।
প্রশ্ন: এছাড়া কোনরকম পরিচয় দিতে হয়?
ম: এছাড়া আর কোন পরিচয় দিতে হয়না। গবেষণার পার্সপেক্টিভে যদি কোন পরিচয় দিতে হয় যে তুমি কী নিয়ে গবেষণা কর, তখন আমায় বলতে হয়, আমি এটা নিয়ে গবেষণা করি। বা তুমি কেন বেছে নিলে, এই জাতীয় আর কি! অনেকসময় ক্লাস স্টেটাস নিয়েও কথা বলা হয়। যেমন – তোমার বাবা কী করেন? তাতে তো বোঝা যায় যে আমি কোন শ্রেণী থেকে আসছি, তাই ওটাও জিগ্যেস করা হয়। যেখানে যেরকম জিগ্যেস করা হয় সেই অনুযায়ী আমাকে বলতে হয়।
প্রশ্ন: আর যদি মানুষ মনজিৎ কথা বলি, তাহলে কীরকম পরিচয় দেবেন?
ম: যদি ব্যক্তিগতভাবে নিজের, মানে মানুষ মঞ্জিত যদি হয়, তাহলে আমি কখনো নিজের পদবীটা ব্যবহার করতে চাইনা। এবং আমি এটা প্রোমোটও করি যে পদবীটা যাতে কম ব্যবহার করা হয়। এবং খুব সামান্য, যতটুকু না জানালেই নয়, ততটুকুই আমি জানাই।
প্রশ্ন: কেন পদবী ব্যবহার করার বিপক্ষে আপনি, সেই নিয়ে একটু বলবেন?
ম: পদবী আসলে ঐ হায়ারার্কিটাকে দেখায় আরকি! মানে আমি সমাজের কোন স্তরে আছি। ফলে ঐটা যখনই কেউ মানে আমার পদবীর সাহায্যে ওটাকে রেকগ্নাইজ করতে পারে, তখনি সে কিন্তু আমাকে একটা কিছু লেবেল দিয়ে দেবে। এটা আমার মনে হয় আরকি। এটা হয়েওছে অনেক ক্ষেত্রে। আমাকে জিগ্যেস করা হয়েছে, “তোমার পদবী ‘রাম’ কেন?”
প্রশ্ন : কী উত্তর দেন তখন?
ম: আমি আমার কারণটাই বলি যে আমার পদবী ‘রাম’, আমি একটি খুবই দলিত জনগোষ্ঠীর অংশ, মানে মানুষ আর কি… এবং সে কারণে অবশ্য আমি গর্বিতও!
প্রশ্ন: আর ডিসেবিলিটি সংক্রান্ত পরিচয় দিতে হয় কখনো?
ম : হ্যাঁ, ডিসেবিলিটি সংক্রান্ত পরিচয় দিতে হয়, যেটা যীশুও বলল, যেখানে প্রয়োজন, সেখানে তো অবশ্যই দিতে হয়। কিন্তু, পথেঘাটে, পথচারীদের সঙ্গে কথা বলার সময় যেমন বাসে বা ট্রেনে, অথবা অফিসে বা হাসপাতালে যেখানে সোশ্যাল গ্যাদারিং হয়, সেখানে একরকম পরিচয় তো দিতেই হয়। এছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে বা কিছু সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য দিতে হয়, সেরকম। তো সেক্ষেত্রে ঠিকই আছে, মানে যেমনটা আমার সার্টিফিকেটে আছে, সেই অনুযায়ী বলি। কিন্তু যখনই নিজেকে ভাবি যে আমি একজন প্রতিবন্ধী, সেই পরিচয়ের কথা যখন ভাবি, তখন আমার মনে হয় আমার ইতিহাস, বা আমার সংস্কৃতি, এগুলো আদৌ কতটা… মানে এখানে কতটা আমি আছি। একজন প্রতিবন্ধী মানুষ হিসেবে ইতিহাসের কোন জায়গায়, বা সংস্কৃতির কোন অংশে আমি আছি, বা আমাকে নিয়ে আদৌ সমাজ খুব একটা ভাবিত কিনা।
প্রশ্ন: নিজের দিকে তাকালে কি মনে হয় যে, এই পরিচয়গুলো আপনার জীবনের উপর, মানে মানুষ মঞ্জিতদার উপর এইটা কতটা পরিমাণে প্রভাব ফেলছে? এই যে কাস্ট আইডেন্টিটির কথা বললেন…
ম: ডিসেবিলিটি…
প্রশ্ন: হ্যাঁ, ডিসেবিলিটি আইডেন্টিটি, এগুলো কিভাবে আপনাকে প্রভাবিত করছে? মানে মানুষ মঞ্জিতকে কিভাবে প্রভাবিত করছে?
ম: এগুলো তো অবশ্যই করে ইমপ্যাক্ট। সেজন্য আমাকে ভাবতে বাধ্য হতে হয়, মানে এইখানেই এক্সপেরিয়েন্সের প্রশ্নটা চলে আসে। ধরা যাক কাস্ট— এক্ষেত্রে খুবই নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ আমি, সেখান থেকে উঠে এসেছি। আমি ফার্স্ট জেনারেশান লার্নার, সেক্ষেত্রে আমার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, সেটা আমাকে মানতে হয়। কাস্টের ক্ষেত্রেও আমি একটা নির্দিষ্ট মানুষদের মধ্যে থাকি, যারা আমারই কাস্টের। তাদের মধ্যেই আমি থাকি, আমি বড় হয়েছি। যদিও আমি কাস্ট সার্টিফিকেট… বা কোন পরিচয় আমার নেই। কিন্তু আমি ওটা স্বীকার করি, যে আছে একটা কিছু। আর ডিসেবিলিটির যেটা হয়, যখনই Disabled বলে ভাবি, তখন আমি আর কাস্ট বা কোন দেশের আমি মানুষ সেই বেসিসে ভাবিনা। তখন আমার মনে হয় বৈশ্বিকভাবে আমি কিরকম, কোথায়, গোটা বিশ্বের প্রতিবন্ধী মানুষদের যে অবস্থা তার সঙ্গে আমার অবস্থার মিল আছে কিনা। প্রত্যেকটা সমাজের যে আলাদা আলাদা পরিস্থিতি সেইরকমভাবে, সেই সমাজগুলোতে প্রতিবন্ধীদের যে অবস্থা, আমি সেখানে আছি কিনা। আমার অভিজ্ঞতাও তাদের সাথে মেলে কিনা, এইগুলো ভাবি…
প্রশ্ন: আচ্ছা। এই যে আপনি দুটো আলাদা কথা বললেন যে একটা, কাস্ট রিলেটেড যে সমাজ, তারপর, ডিসেবিলিটির ক্ষেত্রে আপনি বিশ্বের কথা বলছেন…এই দুটো কোথাও জুড়ে যায়? একসাথে চলে আসে?
ম: …বৈষম্যের ক্ষেত্রে তো আসেই। মানে যখনই, কোন বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, তখন আসে। কিন্তু, এমনিতে আসেনা খুব একটা।
##
সোমেন: আমি সোমেন। সোমেন দত্ত আমার নাম। আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে গবেষণা করছি, আর এখন ত্রিপুরা সরকারের একটা কলেজে পড়াই। এইটাই আমার পরিচয়। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে ‘আপনি কে, কি করেন’, তাহলে আমি এইভাবেই পরিচয় দেব। হ্যাঁ, যদি না বিশেষ কোন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেমন যিনি আমাকে, আমি জানি… যদি আমি জানি, যে আমি কোন প্রতিবন্ধী সংগঠনের কারোর সঙ্গে কথা বলছি তাহলে আমি সেইভাবে তাকে পরিচয় দেব। বা এই যে, যে কথাগুলো এসেছে অলরেডি সেরকমই, সাধারণভাবে মানুষ হিসেবে আমি এইভাবেই নিজেকে পরিচয় দিই।
প্রশ্ন: আর আপনার কাছে মানুষ সোমেনের পরিচয় কী?
সোমেন: আমি এমনি সাধারণ একজন মানুষ। আমার নানানরকম দোষত্রুটি আছে। আমার জীবনে প্রচুর আলস্য আছে। আমি অনেককিছুই পারিনা ভালো করে করতে। আবার কিছু কিছু জিনিস হয়ত অল্পবিস্তর পারি। এরকম, সাধারণ, মানে সমস্ত সীমাবদ্ধতা নিয়ে একজন মানুষ। আর অনেকসময়ই এরকম হয় যে আমার ডিসেবিলিটির পরিচয় আমাকে দিতে হয়, আমার নিজের প্রয়োজনে দিতে হয়। আবার অনেকক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে, আমি বলছি সেটা। একটা ঘটনা তো এই রিসেন্টলি, ত্রিপুরাতে যখন যাই, ওখানকার মানুষদের কাছ থেকে যেরকম ব্যবহার পেয়েছি, সাধারণ সমাজ, কিন্তু তারা যেভাবে বিহেভ করেছেন সেইটা কিন্তু কলকাতার নাগরিক সমাজের যে ব্যবহার তার থেকে অনেক বেশি পরিণত। মানে, একজন প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ বা এমন মানুষ, যার সাধারণভাবে হয়ত প্রান্তিকতা আছে বা যার একটু সমস্যা রয়েছে, তাকে অ্যাক্সেপট করার ক্ষেত্রে ওখানকার জনসমাজের মধ্যে যে পরিণত রিঅ্যাকশন, আচরণ, সেটা চোখে পড়ার মত। কিন্তু, এখানেই শেষ নয়। ইউনিভার্সিটি থেকে আমাদের খাতা দেখতে হয়, স্পট ইভালুশ্যান হয়। তার মানে, আমাকে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস মানে যেটা আমার কলেজ থেকে প্রায় একশ-পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে, সেখানে আমাকে গিয়ে থাকতে হবে, গিয়ে স্পট ইভালুশ্যান করতে হবে। যেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যখন এই অর্ডার এলো, জনে জনে বলতে হল যে দেখুন আমার এরকম সমস্যা আছে, আমি কিন্তু যেতে পারবনা। যেটা আমাকে পড়ানোর সময়, জয়েন করার সময় কাউকে বলতে হয়নি, কেউ আমাকে এসে, কোন এমব্যারাসিং কোন কোশ্চেন করেন নি। কিন্তু যখনই এটা সরকারি নীতির প্রশ্ন হল, তখন কিন্তু আমাকে আবার জনে জনে বলতে হচ্ছে। এখন আবার ইলেকশন ডিউটি আসছে, এই সময় আবার বলতে হবে যে আমাকে ইলেকশন ডিউটি দেবেন না। আর একটা জায়গা আছে, সাধারণভাবে আমরা কী পারি, মানে আমাদের কী ক্ষমতা আছে সেইটা তো আমরা বলিনা। এইটা তো একটা সাধারণ মানুষেরই ব্যবহার যে আমরা আমাদের পরিচয় সম্পর্কে, আমাদের ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা সবাইকে বলিনা। বলিনা আর কি, মানে সেটা কি আমরা বলতে চাই? তাহলে তো লোকে বলবে যে এরা ভদ্রতা জানেনা আর কি! এখন দেখা যায় যে, কেউ আমাকে প্রশ্ন হয়ত করল যে, ‘ও আপনি অমুক জায়গায় পড়াচ্ছেন, কিভাবে পড়ান?’ বা ‘ও আচ্ছা, আপনি পিএইচডি করছেন, কিভাবে পড়েছেন?’ এবার এই প্রশ্নগুলোকে আমি এখনো ডিল করতে পারিনা। কীভাবে ডিল করা উচিত, বুঝতে পারিনা। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন জন, বিশেষ করে আমাদের পরিবারের লোকজনও… আত্মীয়দের মধ্যে যখন এই প্রশ্ন আসে তখন কিন্তু এইগুলোকে ডিল করা খুব মুশকিল হয়। আমি আমার কথা বলছি, আমার বাবা-মায়েদের যে এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে সেটাও কিন্তু কম আশ্চর্যজনক নয়। পরিবারে এমনি যত রকমের কুসংস্কার আছে; সেটা পাপ-পুণ্য হতে পারে, পূর্বজন্মের হতে পারে, কৃতকর্মের ফল হতে পারে, এইসব তো রয়েছে কুসংস্কার সমাজে। ফলে আমার যে দৃষ্টিহীনতা, আমার যে প্রতিবন্ধকতা, সেইটার দায় কিন্তু আমার মায়ের ঘাড়ে মূলত.. কখনও বাবা-মায়ের ঘাড়ে সম্মিলিতভাবে… এটা কিন্তু নিতে হয়েছে প্রথম থেকেই। এর ফলে পরিবারের মধ্যে একটা অস্বস্তি থাকে আমার প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কথা বলাতে, আমি ফিল করি। এই একটা অস্বস্তি থাকে এবং এখন রিসেন্টলি চাকরি পাওয়ার পরে এটা খানিকটা কমেছে। যাদের আমার প্রতি বিশ্বাস ছিল, ভালবাসা ছিল একটু বেশি, তারা অনেক বেশি ভোকাল হয়েছে। কিন্তু, আমার বিষয়ে কথা- পারটিকুলারলি আমার ডিসেবিলিটির ব্যাপারে কথা বলাতে এখনো একটা অস্বস্তি রয়েছে। বিশেষত ঝগড়াঝাঁটির ক্ষেত্রে, এটা আমি শুনেছি, আমার সামনে কখনো এক্সপেরিয়েন্স হয়নি, কিন্তু আমি শুনেছি ঝগড়াঝাঁটির প্রশ্নে আমার প্রসঙ্গ এলেই আমার মাকে-বাবাকে কিন্তু ব্যাকফুটে চলে যেতে হয়, হয়েছে আরকি। ফলে এইটা একটা সাধারণ ঘটনা, প্রত্যেকেরই জীবনে কমবেশি হয়েছে এরকম অভিজ্ঞতা।
প্রশ্ন: এই যে পরিণত ব্যবহারের কথা বলছিলেন, কয়েকটা উদাহরণ শুনতে চাই, মানে কোন ঘটনা যদি মনে পড়ে এই প্রসঙ্গে?
সোমেন: একদম সাধারণ ব্যাপার, আমার মনে পড়ছে… এই যে কৌতুহল প্রকাশ করা… প্রথম যখন আমরা ত্রিপুরায় যাই, এটায় যীশুও আমার সঙ্গে ছিল ও ব্যাপারটা দেখেছে সরাসরি। সাধারণত আমরা যেখানেই যাই পশ্চিমবঙ্গে, মানে কলকাতাতে… লোকে কৌতূহল প্রকাশ করে— “আপনি কী করেন?” চেনেও না হয়ত, সে এসে জিগ্যেস করল হঠাৎ, বা তাকিয়ে দেখছে। এইরকম ব্যবহার কিন্তু, যা সাধারণভাবে ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করে, সেইটা কিন্তু ওখানে লোকে করেনা সাধারণত… কেউ করেনা। এইটাই বলতে চাইলাম পরিণত ব্যবহার বলতে।
প্রশ্ন: আর এই যে, ‘কীভাবে পড়তে?’ .. এই ধরণের যে প্রশ্নগুলো যেগুলো সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে কোথাও গিয়ে, যেগুলো ডিল করতে অসুবিধা হয়, সেটা নিয়ে আরেকটু বলবেন?
সোমেন: যদি এসে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কোথায় থাকেন?”… আসলে উনি জানতে চাইছেন, আস্তে আস্তে বোঝা যায় ব্যাপারটা… “কোথায় থাকেন?”, “কী করেন?”, “বাড়ীতে কে কে আছে?” (বিদ্রূপাত্মক)… “বাড়িতে আমি একাই আছি… সঙ্গে আমার ফ্যামিলি থাকে”, “ওও… মানে বাবা-মা আছেন?” – “হ্যাঁ আছেন”। উনি আসলে ভাবছেন, ধরেই নিচ্ছেন যে আমার বাবা-মা হয়ত নেই, কারণ আমি একা চলাফেরা করছি। মানে… আমি একা চলাফেরা করছি, তার কারণ-আমার বাবা-মা নেই। এইটা উনি ধরছেন, ধরে নিয়ে তারপর প্রশ্নটা করছেন। পরে হয়ত অবাক হন, যে বাবা-মা থাকতেও কেন একা চলাফেরা করছি। যাইহোক, সেটা আর কেউ বলেন না। কিন্তু সেটা বোঝা যায়।
প্রশ্ন: এই সময় আপনার মাথার ভিতর সাধারণত কী ধরণের রিঅ্যাকশন চলে?
সোমেন: আমি আমার কথা বলছি, এগুলো এতটাই দেখেছি যে এগুলো নিয়ে, রিপালসিভ আর হইনা। একসময়, প্রথম প্রথম হয়ত বিরক্ত লাগত। নানারকম কথা বলতাম, এখন আর এসব করিনা। কারণ এটাই, এটাই সাধারণভাবে হয় এবং যারা এটা করেন, তারাও যে সবসময় এমব্যারাস করার জন্য করেন… ওহ হ্যাঁ, এমনও হতে পারে যে অনেকে কিন্তু জানেন না। সত্যিই অনেকে জানেন না যে আমি কিভাবে পড়াশুনো করি, বা আমার মত যাদের দৃষ্টির সমস্যা রয়েছে তারা কিভাবে পড়াশুনো করেন। জানেন না, এটা তো তাদের দোষ নয়! এবার মুশকিল হচ্ছে যে, ওই স্থান-কাল নিয়ে সমস্যা হয়। প্রশ্নটা এমন সময় হল যে সময়টা আমি এমব্যারাসড হলাম। এইটাই সমস্যা হয়, এটা একটু বুঝতে হয়।
প্রশ্ন: আরেকটা প্রসঙ্গ আপনার কথায় উঠে এল, যেটা হচ্ছে ওই পলিসি…
সোমেন: সরকারি পলিসি… এর আগেও বোধহয় এই কথাটা কারোর একটা কথায় এসেছে যে আমাদের যখন এনটাইটেলমেন্টস্ নিতে হচ্ছে, ডিসেবিলিটি সার্টিফিকেট-টা কেন লাগে…বা সার্টিফিকেশন দরকার, আমার… আমার যা যা প্রয়োজন, একটা সাধারণ দেশে একজন নাগরিকের যা যা প্রয়োজন, তার যা যা অসুবিধে, সেই অসুবিধের কথা শুনে প্রশাসনের তো সেই প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের এখানে তো সেটা হয়না, আমাদের এখানে সার্টিফিকেশন করতে হবে নানানরকম। আমার সমস্যার কথা আমাকে চার জায়গায় বলে বেড়াতে হবে, তারপর পরীক্ষা দিতে হবে, মেডিকাল ভেরিফিকেশন হবে, ইত্যাদি হয়ে সার্টিফিকেট নিতে হবে। তারপরে আমি, রাষ্ট্র যেসব অধিকার দিচ্ছে বা যেসমস্ত এনটাইটেলমেন্টস্ দিচ্ছে, তার জন্য আমি অ্যাপ্লাই করতে পারব। তাহলে যখনই এনটাইটেলমেন্টসের প্রশ্ন আসছে, ধরুন কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমি ভর্তি হতে যাচ্ছি; তখন আমাকে declare করতে হচ্ছে – আমার এই সমস্যা রয়েছে। কারণ সেই ডিক্লারেশনের বেসিসেই আমার জন্য যে রিসার্ভড সীট আছে, সেইটা আমি ব্যবহার করতে পারব, বা স্কুল বা কলেজ আমার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করবে, প্রয়োজন অনুযায়ী… স্কলারশিপ বা চাকরিতে… সব জায়গাতেই…কর্মক্ষেত্রে…এটা বলতে হচ্ছে। এই সার্টিফিকেশনটা জরুরি… এবং তখনি আমাকে বারবার বলতে হচ্ছে দেখুন আমার কিন্তু সমস্যা আছে…এইটাই আর কি।
প্রশ্ন: আরও যে ধরণের কুসংস্কার বলছিলেন যে পরিবারে থাকছে… মায়েদের কিংবা বাবা-মাকে একত্রে সেটা বইতে হচ্ছে একটা সময় ধরে, আপনার ছোটবেলায় এটা কি ইমপ্যাক্ট করতো? মানে এই কুসংস্কার বা এই চিন্তাভাবনাগুলো…
সোমেন: না, ছোটবেলায় আমি তো বুঝতাম না। এখন বড় হয়েই বুঝতে পারি… ছোটবেলায় আমি কিছুই বুঝতাম না। ইনফ্যাক্ট, ছোটবেলায়, বাড়িতে তো কেউ বুঝতে দেয়নি। অতটাও যে খারাপ এক্সপেরিয়েন্স, তা নয়। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই শুনেছি খুব খারাপ এক্সপেরিয়েন্স হয়। সৌভাগ্যবশত, আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। আর আমি যখন স্কুলে পড়ি, আমি স্পেশাল স্কুলে পড়েছি… সেখানে বিভিন্ন ধরণের ছেলে বিভিন্ন ধরণের ব্যাকগ্রাউণ্ড থেকে আসত। ফলে সেটা সত্যি-সত্যিই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আরকি; ফলে সেখানেও ওই ধরণের যে জাতিগত বা বর্ণ বা ধর্মের যে ইয়েগুলো সেইগুলো খুব একটা তৈরি হয়নি, সেটা স্কুলের পরিবেশের সুবাদেই। সেই ধরণের কোন গোঁড়ামি আমাদের মধ্যে তৈরি হতনা। এখন বড় হয়ে সেগুলো বুঝতে পারি যে পরিবারে এই ধরণের কতগুলো আনকমফর্টেবল জায়গা ছিল, যেগুলো বলা যায়না, বলা যেত না…
প্রশ্ন: কীভাবে রিয়ালাইজ করলেন সেটা ?
সোমেন: সেটা বিভিন্নভাবে। মানে সেটা একদিনে নয়। ক্রমশ বুঝেছি কথায়-বার্তায় বা বিভিন্ন রেফারেন্সে, অনুমান করেছি। ওইভাবে যে কোনও বিশেষ ঘটনা আমাকে বুঝিয়েছে তা নয়। ধীরে ধীরে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, ব্যাপারগুলো বুঝেছি।
(চলবে…)
যারা সাক্ষাৎকার দিলেন…
যীশু দেবনাথ
যীশু দেবনাথ, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ছাত্র। গবেষণার ক্ষেত্র মধ্যযুগের বাঙালী সংস্কৃতি। ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি আর ‘প্রতিবন্ধকতা’ বিষয়টিকে নানান দিক থেকে বুঝতে চেষ্টা করা একটা স্থায়ী নেশা।
মনজিৎ কুমার রাম
পিএইচডি গবেষক, বাংলা বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
সোমেন দত্ত
ইতিহাসের অধ্যাপক, রামকৃষ্ণ মহাবিদ্যালয়, কৈলাশহর, ত্রিপুরা। রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতিসহ সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ আগ্রহী। প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। বৈকল্পিক নামের প্রতিবন্ধী বিষয়ক মাসিক পত্রিকার একজন সহ-সম্পাদক।