প্রতিবন্ধকতা, দৃষ্টিহীনতা এবং যৌনতার অধিকার (পর্ব ১) – মনজিৎ কুমার রাম

প্রচ্ছদবর্ণনা:

পাতার শুরুতেই একটি ছবি রয়েছে, যা একটি কোলাজ ছবি, যেখানে উপর নীচে দুইটি সারিতে মোট সাতটি ছবি রয়েছে (উপরের সারিতে তিনটি ও নীচের সারিতে চারটি)। ছবিগুলির বিবরণ দেওয়া হল –
১। (উপরে বাঁ দিকে) একটি ফটোগ্রাফ। একটি প্রায়ান্ধকার ঘর, সম্ভবত জানলার দুইপাশে পর্দা সরানো আছে এবং মাঝের ফাঁকা অংশে হলুদ আলো জানলা দিয়ে এসে ছায়া ছায়া ঘরটির মধ্যে পড়েছে যার মধ্যে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ বেহালা বাজাচ্ছেন। মানুষটির পুরো শরীরটি দেখা যাচ্ছে না। কেবলমাত্র কাঁধ থেকে আঙুলের অংশটুকু দেখা যাচ্ছে।
২। (উপরের সারির মাঝের ছবি) একটি সাদা কালো পেইন্টিং। দুটি মানুষকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখা যাচ্ছে। একজনের কাঁধ থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, চোখ-নাক-মুখ ইত্যাদি দৃশ্যমান নয়, কেবল বাঁ কানটি দেখা যাচ্ছে তিনি অপরজনের মুখটি কান ও চোখের পাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খাচ্ছেন। অপরজনের কেবল মুখ এবং ডান হাতটি দৃশ্যমান। তার চোখ বন্ধ, এবং হাত দিয়ে চুম্বনরত মানুষটির গালে চাপ দিয়ে ধরে রয়েছেন।
৩। (উপরের সারির ডানদিকের ছবি) একটি রঙিন পেইন্টিং। লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে দুটি অবয়ব দেখা যাচ্ছে, যারা চুম্বনরত। বাঁদিকের অবয়বটি তুলনামূলক লম্বা, চুল ঘাড়ের উপরে শেষ হয়েছে, এবং ডান দিকের অবয়বটি তুলনামূলক বেঁটে এবং চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে। দুজনেই উজ্জ্বল ছাইরঙা কিছু পরেছে, এবং গলার কাছটাতে গাঢ় ছাইয়ের আনাগোনা রয়েছে। লম্বা অবয়বটির কানের নীচের অংশে এবং বেঁটে অবয়বটির কপাল ও চোখের বাঁ দিকের অংশে ফিরোজা রঙ রয়েছে। দুজনের কারোরই মুখের কোন আদল আঁকা হয়নি, বরং সেই অংশ দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ডের লাল রঙ উপচে এসেছে।
৪। (নীচের সারির একেবারে ডানদিকের ছবি) একটি ফটোগ্রাফ, যেখানে দেখা যাচ্ছে কোন মানুষ জলের মধ্যে চারটে আঙুল ডুবিয়ে খেলছেন। কনুইয়ের খানিক নীচ থেকে হাতটি দেখা যাচ্ছে, এবং জলের মধ্যে ঠিক অতটুকু অংশেরই ছায়া পড়েছে। আঙুলগুলির অর্ধেক জলের মধ্যে ডুবে আছে।
৫। (নীচের সারিতে ডানদিক থেকে দ্বিতীয় ছবি) একটি সাদাকালো ফটোগ্রাফ। ছবির ডান দিকে একজনের চুলের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে, চুলে রোদ পড়েছে এবং চুল উড়ছে। ছবির বাঁ দিকে একজনের হাত সেই চুলের মধ্যে খেলছে। এর পেছনে অস্পষ্টভাবে সমুদ্র বোঝা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে দুপুরের রোদ রয়েছে পরিবেশে।
৬। (নীচের সারিতে বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয় ছবি) একটি ফটোগ্রাফ, যেখানে প্রায়ান্ধকার ঘরের প্রায় মাঝামাঝি উপর থেকে নিচের দিকে রঙধনু রঙের আলো পড়েছে। সেই আলোর মধ্যে দুটি হাত দেখা যাচ্ছে, যাদের ছায়া পড়েছে পিছনের দেওয়ালে। বাঁ দিকের হাতটির আঙ্গুলগুলি উপরের দিকে এবং হাল্কা ভাঁজ করা, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ বাদে বাকি আঙুলের মাথায় নীল রঙের আভা রয়েছে। ডান দিকের হাতটি বাঁ দিকের হাতের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে রাখা। এর আঙুলগুলি বাঁ দিকের হাতের আঙুলগুলির মধ্যে খুব আদরে রাখা এবং বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি ওই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের নিচে আলতো করে ছোঁয়ানো। নখের উপর রঙধনুর কমলা রঙটি পড়ে রয়েছে। হাতদুটিরই কবজি থেকে নিচের অংশ দৃশ্যমান। হাতদুটি কাদের তা বোঝা যাচ্ছে না।
৭। (নীচের সারির একেবারে বাঁ দিকের ছবি) একটি রঙিন পেইন্টিং। ব্যাকগ্রাউন্ডে নিচের দিকে গাঢ় নীল রঙ কখনও হাল্কা কখনও গাঢ় হয়েছে, কখনও ছাই ঘেঁষে রয়েছে। উপরে উঠতে থাকলে ধীরে ধীরে হলুদ এবং সবুজের আনাগোনা রয়েছে। ছবির ঠিক মাঝখানে দেখা যাচ্ছে দুটি অবয়ব একে অপরের সাথে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ। তাদের মিলিত অবয়বের ডান দিকের অংশ উজ্জ্বল হলুদে আঁকা, এবং বাঁদিকে রঙ গাঢ় হয়েছে, হলুদের পাশাপাশি এসেছে গাঢ় ও হাল্কা সবুজ, কমলা, বাদামি, কালো, ছাই, কমলা, নীল ও লাল রঙ। এই লাল ও কমলা কিছু কিছু সবুজের সাথে অবয়বের ডানদিকে নিচের অংশে এসে মিশেছে।

সম্পাদকীয় মুখবন্ধ: Ableism বা সক্ষমতাবাদ Disability Studies এর অন্যতম মুখ্য আলোচনার বিষয়। সমাজ জীবনের অভিযোজনে শারীরিক সক্ষমতা সব সময় গুরুত্ব পেয়েছে, উৎপাদনশীলতার প্রেক্ষিতে (তা সে বংশবৃদ্ধি হোক বা গোষ্ঠীর সম্পদ বৃদ্ধি)। কালের নিয়মে তা মানুষের যোগ্যতা ও নান্দনিকতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং তুলনামূলক অ-সক্ষম মানুষদের সক্ষমদেহীদের থেকে নীচুস্তরের মানুষ হিসেবে গণ্য করা শুরু হয়েছে। যার পরিণতি হয়েছে বিদ্বেষ, ঘৃণা, থেকে শুরু করে মৌলিক অধিকার হনন ও গণহত্যা।

“I’m on a rug in a spot of lamplight. The sauce simmers behind us. There’s a clatter of water pipes, there are apartments above. Dishes rattle somewhere. Bettina is astride me, and leaning, she kisses me forcefully, filling my mouth with her sip of cabernet.

  For the first time the vast silence that follows sex expands in my chest.

  “I love you!” I say it. “I love you!”

   I begin to cry. I who cannot see a woman’s face, who can’t look someone in the eye, I, I, who, what, never thought this could happen. I’m crying in earnest, copious sparkles.

  “Shhhhh!”

  She arches her back, I slip from her, a little fish, laughing and weeping.”

 

(Steve Kuusisto রচিত ‘Planet of the Blind’ থেকে নেওয়া)

   সাধারণত একজন দৃষ্টিহীন মানুষকে আমরা ‘ব্যক্তি’ মনে করি না। দৃষ্টিহীনতা তার ব্যক্তিপরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেও তা অতিক্রম করেও সে একজন ব্যক্তি, তা আমরা অনুভব করতে চাই না। দুজন দৃষ্টিমান মানুষ পাশাপাশি অবস্থান করলে বাহ্যিক আচার আচরণের ভিত্তিতে যেভাবে ‘ব্যক্তি’ হিসেবে তাঁদের আমরা অনায়াসে পৃথকভাবে চিহ্নিত করতে পারি, সেভাবে দুজন দৃষ্টিহীন মানুষকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘ব্যক্তি’ হিসেবে স্বীকার করতে আমাদের বাধে। কারণ দৃষ্টিহীনদের বাহ্যিক চেহারা এবং চালচলনে আলাদা করে বৈচিত্র্য অনুসন্ধানে আমরা অভ্যস্ত নই। আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের প্রত্যেকের বাহ্যিক চেহারায় আমরা কোনো না কোনো ধারাবাহিকতাহীন অসংগতি লক্ষ্য করি। তাঁদের সঙ্গে সমাজস্বীকৃত স্বাভাবিক আচার-ব্যবহারেও আমরা ব্যবধান রচনা করে চলি প্রতিনিয়ত। তাঁদের জোটবদ্ধ অথচ অসহায়, কোণঠাসা অবস্থাকে সুবিধা আদায়কারী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করি। তথাপি কোনো একজন বা দুজন মানুষকে আমরা গোষ্ঠীর বাইরে নিঃসঙ্গ জগতে বার করে আনতে একটুও কুণ্ঠা বোধ করি না এবং তাঁদের হাতে ‘সক্ষমবাদী’ ভাবাদর্শের মশাল তুলে দিতে গিয়েও মরমে মরে যাই না। এ জগতে আমরা ঠিক যতটা একা, ‘সক্ষমতা’র আফিম খাইয়ে তার চেয়েও একা করে তাদের এতদিনের অর্জিত পরিচয় চুরি করে নিতে আমরা সিদ্ধহস্ত।  

   সামাজিকভাবে লিঙ্গপরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গেই যৌনতাকেও ব্যক্তিপরিচয়ের একটি দিক হিসেবে গণ্য করা উচিত। ব্যক্তির বহুবিধ পরিচয়ের জটিলতাকে পাঠ করতে অথবা ব্যক্তিগতস্তরে কেউ কারোর সঙ্গে যৌন-পছন্দ বা অপছন্দের ভিত্তিতে সম্বন্ধ গড়তে আগ্রহী হলে এই বোধ তাকে সচেতন করে তুলতে পারবে। এত গুরুত্ব সত্ত্বেও আমাদের সমাজে দৃষ্টিহীন মানুষ নিজেদের যৌন চাহিদা জাহির করতে পারেন না। যৌন চাহিদার কথা যদি আপাতত ছেড়েও দেওয়া যায়, তথাপি পরস্পর পরস্পরের প্রতি তাঁরা যে শারীরিক আকর্ষণ বোধ করছেন, তাকে ব্যক্ত করা অথবা একজনের প্রতি অন্যজনের নিবিড় নৈকট্যে কোনো এক অভিপ্রেত মুহূর্ত যাপনের চিহ্ন শরীরে এবং মনে প্রকাশ্যে ধারণ করার স্বাধীনতাও তারা উভয়েই উপভোগ করতে অসমর্থ। আরও একটু সহজ করে বললে, যেভাবে দুজন দৃষ্টিমান মানুষ একে অপরকে ভালোবাসেন এবং অনেক সময়ে তাদের উভয়ের যৌন-ইচ্ছাকে স্বীকৃতি জানিয়ে ঘনিষ্ঠ হন, একে অন্যকে চুম্বন বা আলিঙ্গন করেন, অনেক সময়েই যে সব দৃশ্য আমরা প্রকাশ্যে, সর্বজনীন স্থানে দেখতে ইদানিং অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি; দুজন প্রতিবন্ধী মানুষও প্রকাশ্যে তেমন দৃশ্য রচনা করছেন দেখে আমরা হয়তো সেই অর্জিত অভ্যাসের কথাটি স্মরণ রেখে সুসভ্য নাগরিক হিসেবে নির্বিকার হয়ে নাও থাকতে পারি।  আর, একজন প্রতিবন্ধী এবং অন্যজন অপ্রতিবন্ধী মানুষ যদি প্রকাশ্যে নিজেদের  ভালোবাসাকে ব্যক্ত করেন তাহলে তো আর কথাই নেই, সবার মাথায় একেবারে আকাশ ভেঙে পড়ে! তখন ‘সক্ষমদেহী’ জনসাধারণ প্রতিবন্ধী মানুষটির সাহচর্যে অপ্রতিবন্ধী মানুষটির দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা এবং করুণ পরিণতি কল্পনা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে একটুও দ্বিধা করেননা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই জগতে, মানুষের এই সমাজে অনৈতিক যৌন-জীবন যাপন না করেও কেউ যৌনসম্বন্ধ গড়ে তুলতে বা প্রকাশ্যে যৌনস্বীকৃতিকে সীলমোহর দিতে গেলে সমাজ বাধা দিতে যাবে কেন, আপত্তিই বা জানাবে কেন? না, প্রগতিশীল এই সমাজ প্রকাশ্যে তার প্রতি আপত্তি জানাবে না ঠিকই। তবে প্রকাশ্যে স্বীকৃতিও জানাবে না। সমাজ এবং রাষ্ট্র দুজন প্রতিবন্ধী মানুষের সারা জীবন এক সঙ্গে কাটানোর অত্যন্ত ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন জানায় না। দুজন প্রতিবন্ধী মানুষ একে অন্যের সাথে ঘর বাঁধতে ভয় পান। কারণ এ দেশে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য স্বাধীনভাবে  জীবন ধারণ করার মতো পরিকাঠামো নেই। দোকান-বাজার, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবহনব্যবস্থা, চিকিত্সাব্যবস্থা, সরকারি এবং বেসরকারি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তি—সর্বত্র প্রতিবন্ধী মানুষ এখনও প্রয়োজনীয় প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিকাঠামোর অভাবে অনেকাংশে অপ্রতিবন্ধী মানুষদের মানবিক অনুভূতির প্রতি নির্ভরশীল হতে বাধ্য হন। তার ফলে প্রতিবন্ধী মানুষদের অর্জিত আত্মবিশ্বাসে আঘাত লাগে। সত্যি কথা বলতে কী, প্রত্যেক দিন অগণিত অপ্রতিবন্ধী মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে চাইতে প্রতিবন্ধী মানুষ অনেক সময়েই অসম্মানিত ও ক্লান্ত বোধ করেন। কাজেই, যে সমাজে একজন প্রতিবন্ধী মানুষই কোনোরকমে টিকে থাকার শক্তিটুকু সঞ্চয় করতে হিমশিম খাচ্ছেন, সেই সমাজে তিনি তার প্রতিবন্ধী জীবনসঙ্গীকে স্বাচ্ছন্দ্য এবং নিরাপত্তা দানের প্রতিশ্রুতি জানাতে সংকোচ বোধ করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরকে কামনা করেও সারা জীবন দুজন প্রতিবন্ধী মানুষকে আলাদা আলাদাভাবে নিজস্ব পারিবারিক গণ্ডিতে বসবাস করতে হয়। কিন্তু সে তো পরের কথা। আমরা তার আগের ধাপটি নিয়ে এখানে আলোচনা করছি। অর্থাৎ, দুজন প্রতিবন্ধী মানুষ অথবা আমরা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করেছি দুজন দৃষ্টিহীন মানুষের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের অব্যবহিত পরের পদক্ষেপ অনুযায়ী, পরস্পরের প্রতি তাদের প্রাথমিকভাবে ভালোবাসা অথবা যৌন-ইচ্ছা ব্যক্ত করার প্রসঙ্গকে। দুজন দৃষ্টিহীন মানুষের জন্য নিজেদের স্বাভাবিক যৌন-ইচ্ছা প্রকাশের পথে প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে উপেক্ষা করার মতো স্বাধীন এবং সুগম্য (Accessible) পরিকাঠামোনির্ভর কোনোরকম সুযোগ-সুবিধা আদৌ রয়েছে কি না তা আমরা বুঝতে চেষ্টা করছি। তবে সেক্ষেত্রে কিন্তু কয়েকটি সামাজিক মনোভাবগত এবং প্রয়োজনীয় প্রতিবন্ধীবান্ধব স্থাপত্যনির্ভর পরিকাঠামো সংক্রান্ত বাধা আছে।

প্রথমত, বৃহত্তর সমাজ এবং আমাদের পারিপার্শ্বে, প্রচলিত কোনো সর্বজনীন স্থানে স্বল্পক্ষণের একটু আড়াল খুঁজে নেওয়া দুজন দৃষ্টিমান মানুষের তুলনায় দুজন দৃষ্টিহীন মানুষের পক্ষে অতদূর সহজ নয়। কেননা জনপ্রিয় ও সর্বজনীন বিনোদনস্থল যেরকম পার্ক, নদী বা সরোবরের ঘাট মায় সিনেমা-ঘর অবধি সুগম্যতার (accessibility) অভাব দুজন দৃষ্টিহীন মানুষের গমনাগমনে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে।

দ্বিতীয়ত, দুজন দৃষ্টিহীন মানুষ প্রকাশ্যে তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বা ইশারা-ইঙ্গিতে যৌন চাহিদা সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে জানাতে কুণ্ঠা বোধ করেন। কারণ তাদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের যে গভীর ভালোবাসা, তা শারীরিকভাবে ব্যক্ত করার ঐ মাহেন্দ্রক্ষণে তাদের দুজনের দিকে যে ঠিক কতগুলি চোখ চেয়ে আছে, সে সম্পর্কে ধারণা করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়। বুঝি কেউ দেখে ফেলল, ভিডিও বানিয়ে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিল, বুঝি দূর থেকে ছুটে এল কোনো কটুমন্তব্য, তাদের মনে অনেক সময়েই এরকম আশঙ্কা থাকে। এমনকি, একজন দৃষ্টিহীন আর অন্যজন দৃষ্টিমান মানুষও পছন্দসই আড়াল পেয়েও শুধুমাত্র লোকে কী বলবে, লোকে কী ভাববে তাই মনে করে পরস্পরের থেকে শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করতে বাধ্য হন।

তৃতীয়ত, বিভিন্ন শ্রেণীর হোটেল/রেস্তরাঁ যেখানে কিছু অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করলে কাঙ্ক্ষিত আড়াল পাওয়া কার্যত সুনিশ্চিত করে ফেলা যায়, সেখানেও কর্তৃপক্ষের গোপনীয়তা লঙ্ঘণ এবং প্রায়শই নিরাপত্তা দানের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ঘটনা প্রতিবন্ধী অপ্রতিবন্ধী নির্বিশেষে যেকোনো দুজন মানুষকেই সন্ত্রস্ত করে তুলতে পারে। কিন্তু দৃষ্টিমানদের তুলনায় দৃষ্টিহীন মানুষ সহজে সেই পরিস্থিতির শিকার হন। কারণ তাদের পক্ষে হোটেলের ঘরে বসিয়ে রাখা গোপন ক্যামেরার উপস্থিতি টের পাওয়া সম্ভব হয় না। তার ফলে চার দেয়ালের কাঙ্ক্ষিত ও ‘সুরক্ষিত’ আড়াল খুঁজে পেয়েও দুজন দৃষ্টিহীন মানুষের পক্ষে নিরাপদ বোধ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে।

চতুর্থত, দৃষ্টিহীনরা সাধারণত স্পর্শের মাধ্যমে একে অন্যের কাছ থেকে সংবাদ আদানপ্রদান করেন। দৃষ্টির যেমন ভাষা আছে, স্পর্শেরও তেমনি নিজস্ব কিছু ভাষা আছে। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিকেন্দ্রিক(ocularcentric) সংস্কৃতিতে স্পর্শের ভাষা বহু ক্ষেত্রেই আজ ব্রাত্য হয়ে পড়ছে। সেই কারণে দুজন দৃষ্টিহীন মানুষ অতি নিকটবর্তী অবস্থায় একে অন্যকে স্পর্শ করছেন দেখলে আমাদের মনে হয়তো কিছুটা ভয়ের সঞ্চার হয়, কেননা আমরা তো স্পর্শকে একান্ত গোপন স্থানে দুজন শারীরিকভাবে মিলিত হতে আগ্রহী ব্যক্তির ব্যক্তিগত অনুভব এবং সম্মতি-অসম্মতির আওতাভুক্ত করে দিয়েছি। প্রকাশ্যে দুজন দৃষ্টিহীন মানুষকে একে অন্যকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করতে দেখলে, আমাদের মন তাদের বিকৃতকামী বলে দাগিয়ে দিতে চায়। সেজন্য দুজন দৃষ্টিহীন মানুষ সর্বজনীনস্থলে সাধারণত সক্ষমের দৃষ্টিশক্তিকেভয় করেন। সঙ্গীকে স্পর্শ করতে চাইলেও তারা কুণ্ঠা বোধ করেন। তাই আমরা তাদের সার্বজনীন স্থানে নির্বিঘ্নে দুজন প্রতিবন্ধী মানুষকে প্রেমবিহ্বল উল্লাসে উচ্ছস্বিত হয়ে উঠতে সাধারণত প্রত্যক্ষ করি না। কারণ সেটা এই ‘সক্ষমবাদী’ সমাজে তাদের জন্য দুঃসাহসের নামান্তর।

    দৃষ্টিহীন মানুষদের জীবন নিঃসঙ্গতায় পরিপূর্ণ হবে এটাই স্বাভাবিক বলে সমাজ আমাদের শিখিয়ে রেখেছে। আবার আমরাই অনেক সময়ে তাঁদের অতিরিক্ত যৌন চাহিদাসম্পন্ন এবং বিকৃতকামী বলে দাগিয়ে দিয়েছি। দৃষ্টিহীনদের যৌন চাহিদা সম্বন্ধে এই যে আমাদের মেরুকরণ এবং চরমপন্থী  ভাবনা, এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে দৃষ্টিহীনদের যৌন চাহিদা, তার ভাষা, যৌন পছন্দ-অপছন্দ, ইত্যাদি বিষয়ে আমরা প্রায় অজ্ঞ। আর যে ‘সক্ষমবাদী’ ভাবাদর্শের প্রসঙ্গ, যা আমরা এই নিবন্ধে ইতিপূর্বেই উত্থাপন করেছি, দৃষ্টিহীনদের যৌন ভাবনা বা যৌন চাহিদার সঙ্গেও তা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।

     সমাজ ও সভ্যতার সামগ্রিক উন্নয়নে দৃষ্টির এবং দৃষ্টিশক্তির অবদান অপরিসীম। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, অনেক ক্ষেত্রেই জীবজগতে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব কিংবা বিলুপ্তি নির্ভর করে শুধু তার দৃষ্টিশক্তির ব্যবহারিক দিকটির উপর। বিশেষ করে আত্মরক্ষা ও বংশবিস্তারের প্রয়োজনকে মনে রাখলে প্রাণীজগতে দৃষ্টিশক্তির বিকল্প পাওয়া ভার। তাই একভাবে বললে সমগ্র প্রাণীজগৎ তার দৃষ্টিশক্তির উপরই প্রধানত নির্ভর করে থাকে। মানুষের ক্ষেত্রেও প্রকৃতি-নির্ধারিত এই অবিসংবাদিত নিয়মের কোনো ব্যত্যয় নেই। কিন্তু বাকি প্রাণীজগতের তুলনায় দুর্বল শরীরধারী এবং সীমিত ক্ষমতার অধিকারী হয়েও একমাত্র মানুষই তার দৃষ্টিশক্তিকে ব্যবহার করে বাঁধনমুক্ত হয়েছে। এই মহাবিশ্বে সর্বত্র-প্রেরিত বৃহৎ থেকে বৃহত্তর এবং ক্ষুদ্র থেকে অতি ক্ষুদ্রতর সংকেত মানুষ গ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছে তার দৃষ্টিশক্তির সাহায্য নিয়ে। শুধু তাই কেন, সে চোখ চেয়ে দেখছে জগতের সর্বত্র। সে নির্ণয় করছে সুন্দর আর অসুন্দরের মাঝের বিভাজন রেখা, সৃষ্টি করছে শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য আর ভাস্কর্যের দৃষ্টিনির্ভর বিস্ময়। নিজের অন্তরের অন্তঃস্থলেও মানুষ তার দৃষ্টিশক্তিকে প্রসারিত করেছে। তাকে সে পৌঁছে দিচ্ছে চেতনার গভীর থেকে গভীরে। মস্তিষ্ক থেকে প্রেরিত তরঙ্গকে নিজের সৃষ্টি করা যন্ত্রে নিরুদ্ধ করছে। মনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করছে তা দিয়ে। মহাকাশবিজ্ঞান থেকে আরম্ভ করে মনোবিজ্ঞান, সমুদ্রবিজ্ঞান থেকে আরম্ভ করে স্নায়ুবিজ্ঞান, মানবসভ্যতার এই চরম অগ্রগতি সর্বত্রই দৃষ্টিশক্তি নির্ভর!

    অবশ্য, এ সব ক্ষেত্রে একমাত্র দৃষ্টিশক্তির গুরুত্বকে স্বীকার করলে মিথ্যাভাষণ হয়। আসলে মানবসভ্যতার উন্নয়নে এবং অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে দৃষ্টিশক্তির সঙ্গে মানুষের ক্ষুরধার বুদ্ধিবৃত্তিও যোগ দিয়েছে। দুইয়ের মিলনে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে বিজয়ীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পেরেছিল।

   মানুষের সামাজিক অগ্রগতির ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেও কিন্তু আমরা চোখ এবং দৃষ্টিশক্তির অপরিসীম গুরুত্বকে আরও একবার অনুধাবন করতে পারব। ক্রীতদাসনির্ভর প্রাচীন গ্রেকোরোমান সমাজ হোক বা প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয় সমাজ,  চোখ এবং দৃষ্টিশক্তির অনুপস্থিতিমাত্রেই সমাজের কাছে ছিল ভয়াবহ ব্যাপার। গ্রীক ও রোমক সমাজে কোনো দৃষ্টিহীন শিশু জন্মগ্রহণ করলে, তাকে সমাজের বাইরে নগরের কোনো পরিত্যক্ত ভূমিতে নিক্ষেপ করার জীবিতাবস্থাতেই সলিলসমাধি দেওয়ার রীতি ছিল। গ্রীসের স্পার্টায় এ ধরনের শিশু নিশ্চিহ্নকরণের লক্ষে সুবন্দোবস্ত ছিল। স্পার্টার অধিবাসীরা দৃষ্টিহীন অথবা অন্যান্য ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু নিধনের ব্যবস্থা করতে সর্বসম্মতিক্রমে একটি সমিতি গঠন করেছিল। কোনো পরিবারে প্রতিবন্ধী শিশু জন্মালে তার অভিভাবক সেই হতভাগ্য শিশুকে উক্ত সমিতির হাতে স্বেচ্ছায় বা সমাজের ভয়ে তুলে দিতেন। শারীরিক বা ইন্দ্রিয়গত ত্রুটিকে গ্রেকোরোমান সমাজ দেবতাদ্বারা প্রেরিত অশুভসংকেত বলে বিশ্বাস করত। কাজেই তাকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত তারা ক্ষান্ত হত না। তারা ধারণা করত যে ত্রুটিযুক্ত শরীরধারী কোনো শিশুকে জীবিত রাখলে দেবতা সমাজের প্রতি ক্ষুব্ধ হবেন। আকাশ থেকে নেমে আসবে খরা, দুর্ভিক্ষ এবং মহামারীরূপে ভয়ঙ্কর দৈব-অভিশাপ। কিন্তু এরকম সামাজিক আচরণের নেপথ্যে আরও একটি কারণ ছিল, তারা যে কোনো প্রকার অঙ্গবিকৃতিকেই সমাজশরীর থেকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে উৎসাহী ছিল। প্রাচীন ভারতের বর্ণভিত্তিক অথবা ধর্মীয় নীতিনির্ভর সমাজেও দৃষ্টিহীনতা ও অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জন্মান্তরবাহিত এবং কর্মফলপ্রসূত পাপচিহ্ন বলে স্বীকৃতি পেয়েছিল। প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে মানবসভ্যতার সেই কালে সমাজমনে ‘সক্ষমবাদ’-এর বীজ রোপিত হয়েছিল এভাবেই। প্রতিবন্ধীদেরকে আমরা এখনও সমাজে অন্তর্ভুক্ত করতে কুণ্ঠিত হই। অথচ আধুনিক সমাজব্যবস্থার রীতি অনুসারে তাদের মধ্যেই কেউ অন্যান্যদের তুলনায় একটু দক্ষ হয়ে উঠলে তাকে আমরা প্রতিবন্ধীদের নায়ক বানিয়ে তুলি। এটাও কিন্তু এক ধরনের ‘সক্ষমতা’ আরোপ। অর্থাৎ সেই প্রতিবন্ধী নায়ক আদতে ‘অক্ষম’ই রইল কিন্তু আমরা তাকে নিজেদের ‘সক্ষম’ পৃথিবীতে নিয়ে এসে খ্যাতি প্রদান করলাম, তথাপি তাকে কাঙ্ক্ষিত সঙ্গ প্রদান করলাম না। এই শতাব্দীতেও যে ‘সক্ষমবাদী’ মানসিকতা সমাজের সর্বস্তরে আমরা লক্ষ্য করি, প্রাচীন সময় থেকে শুরু করে আধুনিক সময় অবধি তার খুব বেশি বিবর্তন ঘটেনি। এখনও সমস্ত শ্রেণীর প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি আমাদের মনে এক ধরনের স্বাভাবিক উপেক্ষার বোধ রয়েছে। মধ্যযুগীয় ইউরোপে যখন খ্রিস্টান ধর্মের আবির্ভাব এবং দ্রুত বিস্তার ঘটল, প্রতিবন্ধী শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের গীর্জা এবং বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সেবাকেন্দ্রে আশ্রয় প্রদান করা আরম্ভ হল, ততদিনে প্রতিবন্ধী শিশুদের  নির্বিচারে ধ্বংস করা বন্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তখনও দেখা যাচ্ছিল এক প্রকার সমাজ-বহিষ্কৃত শ্রেণী হিসেবেই প্রতিবন্ধীদের গণ্য করা হচ্ছে। বস্তুত, এ সময়ে দৃষ্টিহীনদের জন্য বিভিন্ন এলাকাভুক্ত স্থানীয় গীর্জাগুলির অর্থানুকূল্যে এবং খ্রিস্টধর্মের ছত্রছায়ায় আশ্রয় ও আহারের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সে সময়ে দৃষ্টিহীন মানুষদের যখন বাঁচিয়ে রাখারই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল ধর্মভীরু সমাজ, তখনও কিন্তু মানুষ হিসেবে তাদের যে অধিকারগুলি প্রাপ্য, যেমন শিক্ষা, জীবিকার অধিকার, প্রভৃতি প্রদান করতে সমাজ নিজে থেকে অগ্রসর হয়ে আসেনি। এই সময়েও দৃষ্টিহীন (সামগ্রিকভাবে প্রতিবন্ধী) মানুষ পরিত্যক্তভাবেই জীবন ধারণ করছিলেন। তাদের পরিবারই তাদের ত্যাগ করেছিল। পরিবার পরিত্যক্ত হয়ে ও জীবিকাহীন অবস্থায় তারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় এবং ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছিলেন। দৃষ্টিহীনদের প্রতি সেই মধ্যযুগীয় উপেক্ষা এখনও আমাদের সমাজে বিদ্যমান। এখনও আমরা বাসে, ট্রেনে বা পথের ধারে বসে দৃষ্টিহীন মানুষকে ভিক্ষা গ্রহণ করতে দেখি। এখনও কলকাতা শহরের বুকেও, তথাকথিতভাবে দৃষ্টিহীনবান্ধব এবং অলাভজনক একাধিক সামাজিক সংগঠন সমাজের মূল ধারায় দৃষ্টিহীনদের অন্তর্ভুক্ত হতে উৎসাহিত না করে সামান্য কিছু অর্থ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে সংস্থার চৌহদ্দির মধ্যেই তাদের বন্দি করে রাখতে চায়। অবশ্য, এ কথাও ঠিক যে, ঐ তথাকথিতভাবে কল্যাণকামী সরকারি অথবা বেসরকারি সামাজিক অলাভজনক সংস্থাগুলো অসহায় এই মানুষগুলোকে আশ্রয় না দিলে তারা মাথা গোজার ঠাঁই কোথায় পাবেন? রাষ্ট্র তাদের খোঁজ রাখে না। পরিবার-পরিজন তো কবেই তাদের খবর রাখতে ভুলে গিয়েছে! প্রাচীন কালে যেভাবে প্রতিবন্ধীদের নিধন অথবা সমাজ থেকে বহিষ্কৃত করা হত, আধুনিক কালে আর সেভাবে তাদের অগ্রাহ্য করা হয় না। কিন্তু এই সময়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে এক ধরনের উদাসীনতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে হয়। কারণ আমরা প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ের মিছিলে সাধারণ মানুষকে খুব কম সংখ্যায় উপস্থিত থাকতে দেখি। প্রতিবন্ধীদের বিরুদ্ধে কোনোরকম বঞ্চনা ঘটলে খুব কম সংখ্যক অপ্রতিবন্ধী মানুষই জোরালোভাবে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেন। যেখানে প্রতিবন্ধী এবং অপ্রতিবন্ধী মানুষের মাঝখানে এত দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের অধিকার কিংবা যৌনতার অধিকার নিয়ে অপ্রতিবন্ধী মানুষও খুব সচেতন থাকবেন, এটা একটু আকাশকুসুম কল্পনা হয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা প্রতিবন্ধী  নায়কের প্রতি জনসাধারণের পক্ষপাতিত্বের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলাম ইতিপূর্বে। প্রতিবন্ধী নায়ক বলতে এখানে তারা, যারা সক্ষমবাদী সমাজে যথাসম্ভব শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতা অর্জন করে সাধারণ মানুষের শারীরিক বল ও বুদ্ধির কিছুটা হলেও কাছাকাছি পৌঁছেছেন। প্রাচীন ভারতে অষ্টাবক্র ঋষি ব্রহ্মজ্ঞানী হিসেবে খুব খ্যাতি পেয়েছিলেন বলে কথিত আছে। তিনি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ছিলেন। কিন্তু আমরা হয়তো জানি না যে, তাঁর পিতা এবং মাতামহও ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষি ছিলেন। অর্থাৎ, অষ্টাবক্র একজন অভিজাত বংশোদ্ভূত ব্যক্তি। তিনি বংশপরম্পরাক্রমে যথাযথ শিক্ষা পেয়েছিলেন ও বসবাস করতেন সমাজের উচ্চবিত্ত অভিজাতদের মধ্যে। তার ফলে তার জীবনের তুলনামূলক স্বাচ্ছন্দ্য অনুমান করা যায়। এ ছাড়া, মহাভারতে আমরা দীর্ঘতমা মুনির কথা পাই, তিনি দৃষ্টিহীন ছিলেন। এ প্রসঙ্গে মহাভারতে বর্ণিত দৃষ্টিহীন রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কথাও নিশ্চয়ই আমাদের মনে পড়বে। একবার মনে করে দেখুন, আমরা কিন্তু অষ্টাবক্র ঋষির ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে তেমন কোনো খবর পাইনি। আমরা কিন্তু জানতে পারিনি তার স্ত্রী বা পুত্রের নাম, আমরা জানতে পারিনি তার স্ত্রী তারই মতো শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ছিলেন না ‘স্বাভাবিক’ (Normal) ছিলেন। হয়তো অষ্টাবক্র আজীবন পত্নীবিহীন ছিলেন। তার গভীর প্রজ্ঞার কারণে তিনি হয়তো সমাজে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন প্রচুর। কিন্তু কোনো কাঙ্ক্ষিতার হাত ছুঁয়ে বরমাল্য প্রাপ্তির সুযোগ থেকে চিরকাল হয়তো তিনি বঞ্চিতই রয়ে গিয়েছিলেন! ভারতীয় কিংবা বৈশ্বিক, যে কোনো প্রাচীন কাব্য ও গল্পগাথায়, স্বয়ম্বর সভায় রাজকন্যাকে কোনো খ্যাতনামা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির গলায় আমরা বরমাল্য পরানোর দৃশ্যে কল্পনাও করতে পারি না। আমেরিকার হেলেন কেলার প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রধানত তার কল্যাণমূলক কাজের নিরিখে সমগ্র বিশ্বে বিখ্যাত হন। তিনিও আমৃত্যু জীবনসঙ্গীবিহীন ছিলেন। তার মেধা ও জীবনীশক্তি নিয়ে আমরা যতটা ভেবেছি, তার নিঃসঙ্গ জীবন সম্পর্কে আমরা ততটা খোঁজ রাখিনি। তাই বলছিলাম, প্রতিবন্ধী নায়ককে আমাদের সমাজে এনে আমরা খ্যাতি প্রদান করলেও তাকে কাঙ্ক্ষিত সঙ্গ দান করতে আমরা পারিনি।

     তথাপি এই বিষয়টিকে একতরফাভাবে দেখলেও হয়তো অবিচার হবে। কারণ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও তার অপ্রতিবন্ধী সঙ্গী বা সঙ্গিনীর প্রতি যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে অনেক সময়েই রাজি হননি। তিনি হয় তো নিজের সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে সমাজের আর সকল সক্ষম ব্যক্তির মতোই নিজের জীবনে গ্রহণ করেছেন, মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। তার সঙ্গী বা সঙ্গিনীকেও তিনি হয় তো ‘সক্ষমদেহী’ সমাজের একজন প্রতিনিধি বলেই মনে করেছেন। এমতাবস্থায় উভয়ের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটলে কোনো এক পক্ষের প্রতি দোষারোপ করা অন্যায় হবে।

     প্রতিবন্ধী মানুষদের ব্যক্তিগত জীবন, বিশেষ করে তাঁদের যৌনজীবন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা যে রাষ্ট্রীয়ভাবেই সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসে তার প্রমাণ রয়েছে। এ বিষয়ে তথ্য আহরণের প্রয়োজনে আমাদের খুব বেশি দূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে হবে না; গত শতকে ইয়োরোপ ও আমেরিকার ইউজেনিকস্ (Eugenics) আন্দোলনের কথা যদি আমাদের মনে পড়ে তাহলেই হবে। সেই আন্দোলন যে কীভাবে প্রতিবন্ধীদের ব্যক্তিগত জীবন এবং যৌন পছন্দ অপছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল তা এখন সর্বজনবিদিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে আরম্ভ করে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সময় জুড়ে ইউরোপ এবং আমেরিকা প্রধানত বিজ্ঞানের হাত ধরে অমানবিকতা ও বর্বরতার নতুন এক নজির সৃষ্টি করেছিল, মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অ্যাডল্ফ হিটলারের হাতে পূর্ণ পরিণতি পেয়েছিল। তবে এই বিষয়ে আমরা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করব।

     অতি প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজজীবনে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য ব্যক্তিত্ব অর্জনের পথ হয়েছে বন্ধুর। প্রথমত, প্রতিবন্ধীরা সম্মিলিত সামাজিক কর্মপ্রচেষ্টার পরিসরে, প্রধানত শারীরিক মানসিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশজনিত সীমাবদ্ধতার কারণে অংশগ্রহণ করবার সুযোগ পাননি। দ্বিতীয়ত, তথাকথিতভাবে প্রতিবন্ধীদের শারীরিক ত্রুটি সমাজের ‘সক্ষমবাদী’ ও সর্বাঙ্গীণ সামঞ্জস্যনির্ভর আধিপত্যকামী সৌন্দর্যভাবনায় কলঙ্কচিহ্ন বলে পরিগণিত হয়েছে। তার ফলে সমাজের নান্দনিক যৌথ চেতনাও প্রতিবন্ধীদের শরীরকে কুৎসিত বলে পরিত্যাগ করতে দ্বিধা করেনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবন্ধী শিশুর অনায়াস নিধনপ্রণালী এবং প্রতিবন্ধীদের থেকে সমাজের যৌথ সামঞ্জস্যনির্ভর সৌন্দর্যভাবনাপ্রসূত দূরত্ব রচনায় কিন্তু আদতে কোনো দূরত্ব নেই। উভয়ই উভয়ের পরিপূরক হিসেবে ক্রিয়াশীল রয়েছে। কেননা যে দেহ অসুন্দর, সমাজে তার জীবিত থাকবার কোনো অধিকার নেই কিংবা বিকৃতদেহমাত্রেই পরিত্যাজ্য ও চিহ্নিতকরণযোগ্য, এই দুটি সামাজিক ধারণাই কিন্তু পরস্পর-সংলগ্ন। কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে সম্ভবত গোটা পৃথিবীর সমাজভাবনাতেই প্রতিবন্ধীরা চিহ্নিত হয়েছে তাদের শারীরিক ত্রুটিজনিত বৈচিত্র্যের কারণে। এক্ষেত্রে ‘স্বাভাবিক’ শরীরধারী মানুষ নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘সক্ষমতা’ দ্বারা পরিচালিত সমাজে প্রতিবন্ধীদের বহিরাগত হিসেবেই গ্রহণ করে থাকে। তাই সাধারণত অপ্রতিবন্ধীরা প্রতিবন্ধীদের সমীহ করে, ঘৃণা করে, স্বীকার করে, প্রত্যাখ্যান করে, ভয় করে, মানিয়ে নেয়, সন্দেহ করে, বিশ্বাস করে, অবহেলা করে, অবলম্বন করে, দয়া করে, উপেক্ষা করে। কিন্তু স্বভাবত তাদের ভালোবাসে না। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না। তাদেরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করে না। তাদের সহকর্মী মনে করে না। তাদের সহচর মনে করে না। অন্যভাবে বললে, বৃহত্তর সমাজে এবং এই পৃথিবীতে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ শুধুই একজন অপরিচিত আগন্তুক। তার দেশ নেই, ভাষা নেই, জাতি নেই। তার ইতিহাস নেই, সংস্কৃতি নেই। তার ব্যক্তি-অধিকার নেই। সুতরাং তার যৌনতার অধিকারও নেই।

      আমি একজন দৃষ্টিহীন পুরুষ। একজন দৃষ্টিমান নারী ছিল আমার একান্ত কামনার ধন। আমি তাকে গভীরভাবে ভালোবাসতাম। কখনও তার চোখের জলে আমার হাত ভিজিয়ে নিতাম, কখনও সে হাসলে আমার মনে হত গাছের পাতাগুলোতেও তার হাসির কম্পন ছড়িয়ে পড়েছে। কত মূহূর্ত এমনভাবে কেটেছে যে শুধু তার একটা হাত ধরে সারাক্ষণ বসে থেকেছি কোনো কথা বলিনি। তখন বয়স ছিল অল্প। সহজেই তার শরীর নেশা ধরিয়েছিল মনে। শুধু তার সান্নিধ্য ভালো লাগত বলে কতবার মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে তাকে প্রাণপণে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। কেউ জানত না। শুধু আমি আর ঐ আকাশটা জানত আমি ওকে নিবিড়ভাবে কামনা করি। আকাশের সঙ্গে আমার বন্ধুতা অনেক দিনের। ওকে আমি দেখতে পাই না তো কি, আমি জানি ওর বিশাল একটা হৃদয় আছে। সেই হৃদয়ের কোনো কূলকিনারা নেই। কত দিন ওর নক্ষত্রগুলোকে আমি স্পর্শ করেছি স্বপ্নে। কত দিন ওর স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় স্নান করে আমি পবিত্র জলের শীতল স্পর্শ পেয়েছি শরীর জুড়ে। কিন্তু সে যাই হোক, সেই মেয়ে আমার সান্ধ্যকালীন সমস্ত অবসর চুরি করে নিয়েছিল। মেয়েটি কেন আমাকে পছন্দ করে জিজ্ঞেস করলে বলত, আমার কাছে বসতে পারলে সে একটু স্বস্তি পায়। দৃষ্টির সীমা অতিক্রম করে সে স্পর্শ হয়ে আমার কাছে ধরা দিয়েছিল। আমি তাই শুধু ভয় করতাম। মন বলত, এই সুখস্পর্শের আয়ু আর বেশিদিন নেই। দৃষ্টির জগৎ থেকে যেই তার ডাক আসবে, তৎক্ষণাৎ একে ভুলে যাবে সে। নিজের জগৎ সম্বন্ধে বড় হীন ভাবনা ছিল আমার। নিজেকে আমি এই দৃষ্টিকেন্দ্রিক সমাজের কারাগারে বন্দি একজন কয়েদি মনে করতাম। প্রত্যেক দিন আমার সঙ্গে তার দেখা হত। প্রত্যেক দিন আমরা দুজনে ঘনিষ্ঠভাবে পাশাপাশি বসতাম। যাতে সে  অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে সময় কাটায় তার জন্য তাকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনাতাম। তার পিঠছাপানো চুল ছিল। কখনও কখনও আমার  আঙুলগুলো তাতে হারিয়ে গিয়ে সুখ পেত। না, কোনো দিন তাকে শয্যাসঙ্গিনী করতে ইচ্ছা হয়নি। অত দূর ভাববার  মতো মনের জোর আমার তখন ছিল না। আমি পৌরুষের শক্তি প্রদর্শনের চেয়ে পৌরুষের সমর্পণ স্পৃহা প্রদর্শনে বেশি বিশ্বাস রাখি। রোজ দেখা হচ্ছে, রোজ গান গাইছি, গল্প করছি, আমার মনে হত এটাই বা কম কী? মনে মনে সন্দেহও ছিল, একটু বেশি চাইতে গিয়ে পাছে সমস্তটা হারাই। সে আমার জন্যে ব্রেইল লিপি শিখতে চেয়েছিল। বদলে আমি তাকে অভিযোজন তত্ত্ব সম্পর্কে পড়তে সাহায্য করতাম। সে আমাকে দৃষ্টিমান জগতের সব রঙ সম্পর্কে জানাত। আমি তাকে বলতাম আমার নিঃসঙ্গ পৃথিবীর সব রঙহীন অনুভূতির কথা। সে আমাকে আশ্রয় করে যখনই দাঁড়াতে চাইত আমি তখনই একটা গাছ হয়ে উঠতাম। ছায়া দিতাম, সবুজ উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে তুলতাম তার হৃদয়। কিন্তু সব কিছুরই একটা শেষ থাকে। আমার গল্পেরও শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে এল একদিন হঠাৎ। সে দিন দুপুরে হয়তো আকাশে মেঘ করেছিল, কারণ সেদিন একটুও রোদ ছিল না। সময় নিয়ে মনে সন্দেহ জেগেছিল। কিন্তু অন্য দিনের মতো সেদিনও  তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমি। মনে ভেবেছিলাম অন্য দিনের মতোই হয় তো গল্প হবে কিংবা নিছক মৌনতাযাপন। কিন্তু তা হল না। সে আমাকে তার নতুন বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করাতে ডেকে এনেছিল। সেই বন্ধু একজন দৃষ্টিমান পুরুষ, তার নিজের পৃথিবীর লোক। অতএব সে না বললেও সেদিন আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, তার পৃথিবীতে আমার ঠাঁই হবে না। পরের দিন খুব দুঃখিতস্বরে সে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। বলেছিল, কোনো দৃষ্টিহীন পুরুষকে সে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে ইচ্ছুক নয়। তারপর কেমন করে যেন তার সঙ্গে আমার অনুভূতি আর গভীর শারীরিক আকর্ষণের সম্বন্ধ ঘুঁচে গেল। আমার এবং সেই মেয়েটির মাঝখানে স্পর্শ দিয়ে, গান দিয়ে আর গল্প দিয়ে তৈরি একটা সেতু হঠাৎ একদিন জেগে উঠেছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো মাঝে-মধ্যেই ঘটতে পারে। তাতে একটা সেতু ভেঙে যাওয়া কি খুব অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা!

      অন্তরে প্রোথিত সক্ষমতার বোধ একজন দৃষ্টিহীন মানুষের সঙ্গে যৌনসম্বন্ধ গড়ে তুলতে বাধা দেয়। আমরা শুধু শরীর এবং যৌনসংসর্গের ইচ্ছা প্রকাশের ক্ষেত্রে যে ভাষাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকি তা হল চোখের ভাষা। এই ভাষা বুঝতে অক্ষম বলে দৃষ্টিহীনদের মনেও নানান ধরনের হীনমন্যতা কাজ করে। তারা নিজেকে তাদের দৃষ্টিমান সঙ্গীদের চেয়ে কমতি মনে করে। কারণ তাদের ভাবনাও এত দিনে সামাজিক আধিপত্য কায়েমের দরুন দৃষ্টিকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। আমাদের শিল্প সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ইতিহাসে চোখ এবং তার চাওয়াকে যে কতভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সামাজিক ভূমিকা অনুসারে একজন নারী আসলে পুরুষদৃষ্টির ভোগ্যা এবং পুরুষ তার শরীরের দ্রষ্টা। পুরুষদের দৃষ্টি অনেক ক্ষেত্রেই নারীর বেশভূষা এবং সাজসজ্জার ধরনকে নিয়ন্ত্রণ করে। একজন দৃষ্টিহীন পুরুষের এখানে কোনো সামাজিক ভূমিকা নেই। সঙ্গিনী নির্বাচনের দৃষ্টিকেন্দ্রিক খেলায় দৃষ্টিহীন পুরুষমাত্রেই আসলে ব্রাত্য। কিন্তু সে খেলায় কেউ যদি যোগ দিতে না চায়, কেউ যদি একটা স্পর্শের সেতু নির্মাণ করে তোলে, তাহলে তো আমরা উভয়েই এ পৃথিবীতে নতুন শরীর এবং অনুভূতির ভাষা সৃষ্টি করতে পারব। একবার ভেবে দেখুন, দৃষ্টিশক্তিই তো আমাদের মাঝখানে একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাহলে মাত্র একবার কিছুক্ষণের জন্য হলেও যদি  নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে রেখে আমরা আমাদের দৃষ্টিহীন বন্ধুদের হাত ধরতে পারি, তবেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় এক মুহূর্তে। তখন আপনি তাদের তৎক্ষণাৎ দৃষ্টির ভাষা শিখিয়ে দেবেন, আর আপনাকে তারা স্পর্শের ভাষা শিখিয়ে দেবে। আসুন, সকলে মিলে এক সঙ্গে আমরা এক সামাজিক আদানপ্রদানমূলক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি।

(ক্রমশ)

ঋণস্বীকার:

  1. Kuusisto. Steve. “Selections from Planet of the Blind”. Sighted in “The Disability Studies Reader” ed. Davis. Lennard J. fourth ed. Routledge. New York. 2013.  (p536)
  2. Hughes. Bill. A Historical Sociology of Disability. Routledge. New York. 2020.
  3. STIKER. HENRI-JACQUES. A History of Disability. Trans. Sayers. William. University of Michigan Press. 2019.
  4. MCRUER. ROBERT. AND MOLLOW. ANNA. SEX AND DISABILITY. DUKE UNIVERSITY PRESS. 2012.
  5. Thomson. Rosemarie Garland. STARING: How We Look. OXFORD UNIVERSITY PRESS. 2009.
  6. BOLT. DAVID. The Metanarrative of Blindness A Re-reading of Twentieth-Century Anglophone Writing. The University of Michigan Press. 2014.

*****