অ মা র্জি ত – মলয় রক্ষিত

কী রে বাঁড়া, চিনতে পারছিস?
দুদিন আগেই চতুর্থ দফার লকডাউন ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল নবান্ন থেকে লিখিত অর্ডার জারি করেছে রাজ্য সরকার। ন-টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে, ব্রেকফাস্ট শেষ করে, চেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে চা খেতে খেতে টিভি চ্যানেলে তারই খবর শুনছিলাম। এমন সময়েই ফোনটা এল—কী রে বাঁড়া, চিনতে পারছিস?
এমন সম্বোধন করে আমাকে কেউই কোনোদিন ফোন করে না। কাজেই হঠাৎ বেসুরো এমন সুমধুর সম্ভাষণে হকচকিয়ে ‘রং-নাম্বার’ বলে আমি ফোনটা কেটে দিলাম।
হাজার হোক, অধ্যাপক বলে কথা। সোশ্যাল স্ট্যাটাস অনুযায়ী সোসাইটিতে সম্মানজনক ব্যবহারটা আমি ডিজ়ার্ভ করি। এ-নিয়ে বাইরে মুখে কোনোদিন কিছু না বললেও ভিতরে ভিতরে আমার ওই সম্মানের আকাঙ্ক্ষাটা যে প্রবল, সেটা নিজেও বিলক্ষণ বুঝি।
ফোনটা টেবিলে নামিয়ে রেখে জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। সিগারেটের প্যাকেট থেকে বের করে, একটা সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে লাইটার জ্বালাতে যাব—সঙ্গে সঙ্গে আবার রিংটোন বেজে উঠল।
সেই আগের অচেনা নম্বরটাই। ভাবলাম ইগনোর করব, কিন্তু একটা কৌতূহলও হচ্ছে, কে এমনভাবে খিস্তি দিয়ে আমাকে সম্বোধন করতে পারে? সিগারেটটা ধীরেসুস্থে ধরিয়ে, একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে, সাহস করেই ফোনটা রিসিভ করলাম।
—কীরে, কেটে দিলি যে বাল? চিনতে পারছিস না? নাকি বাঁড়া চিনতে চাইচিস না?
—দেখুন, বুঝতে পারছি আপনি হয়তো আমার চেনা কেউ হবেন, কিন্তু নাম না বললে চিনব কেমন করে?
—নাম বললে চিনতে পারবি? —শৈলেশ।
—শৈ-লে-শ?

এই এক মুশকিল। নাম বললেই বুঝি সবাইকে চিনে নেওয়া যায়? আমি আমার পরিচিত ছাত্রদের নামই ভালো একটা মনে রাখতে পারি না। মাঝে মাঝে ফোন আসে–‘স্যার আমি সারিকা বলছি’।
—সারিকা?
—স্যার থার্ড সেম থেকে, আপনাকে ডিপার্টমেন্টে সেদিন নোট দেখালাম?
—ও হ্যাঁ, সারিকা—আচ্ছা বলো?’
এরকম দু-একবার চিনতে-না-পারাটা রিপিট হবার পর সারিকা-রা কেউ আর আমাকে ফোন করে তাদের নাম বলে না, বলে ‘স্যার আমি থার্ড সেমের ছাত্রী বলছি’। সত্যি বলতে কী, দু-এক বছর পাস করে বেরিয়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর নামই আমার মনে থাকে না! মাঝেমাঝেই এর-ওর ফোন ধরে পনেরো মিনিট ধরে কথা বলার পর, ফোন রেখে ভাবি, এতক্ষণ ধরে আমি আসলে কার সঙ্গে কথা বলছিলাম!

তা, এই তো আমার স্মৃতির দৌড়। এখন কে কবেকার কোন মহাপুরুষ শৈলেশ, তার মুখ আমার মনেই বা পড়বে কেন? আর আলাপের প্রথম ধাক্কাতেই ও প্রান্ত থেকে যে সুমধুর সম্বোধন পেয়েছি, তাতে আমার পিলে চমকে গেছে। বললাম:
—কিছু মনে করবেন না, আপনাকে আমি ঠিক মনে করে উঠতে পারছি না।
—ধুর বাঁড়া, তুই ‘আপনি’ বলাটা বন্ধ করবি? আমি শৈলেশ রে, সেহারা স্কুলে উচ্চমাধ্যমিকের ব্যাচ, ভুলে গেলি?

শৈলেশ!! মানে— শৈলেশ দাস। হ্যাঁ দাস-ই সম্ভবত। উচ্চমাধ্যমিকে আমাদের আর্টস-এর সহপাঠী! সে উনিশশো চুরানব্বই পঁচানব্বই-এর কথা। সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতি যেন টাইমমেশিনে দৌড়ে পিছিয়ে গেল পঁচিশ বছর। কালো ছিপছিপে লম্বা শরীরের গড়ন। ছোটো করে ছাঁটা চুল। শোল মাছের চোয়ালের মতো উজ্জ্বল-কঠিন দুটি চোখের মাঝখান থেকে নেমে আসা বাটালির ফলার মতো ধারালো নাক। দুরন্ত সেই কিশোরের মুখ এবার মনে পড়ল আমার —শৈলেশ। ১৯৯৫-এ আর্টস থেকে একমাত্র ফার্স্ট ডিভিশনস পাওয়া এবং বিশেষ করে বাংলার দুটি পেপারে রেকর্ড –লেটার মার্কস তোলা সেই শৈলেশ। তাকে কি ভোলা যায়? ফোন হাতে আমি ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। বললাম:
—হ্যাঁ রে খুব মনে আছে। তোকে কি ভুলতে পারি?
—বাল মনে ছিল তোর। ভুলে কবেই মেরে দিয়েছিস। আর মনে রাখবিই বা কেন? শুনলাম, তুই নাকি এখন সেলেব-টেলেব হয়ে গেছিস!
—ধ্যাৎ, কার কাছে এ সব বাজে খবর শুনিস! আমার নম্বর তুই পেলি কার কাছে?
—কেন, গৌরাঙ্গ? নন্দনপুরের গৌরাঙ্গকে মনে আছে তো?
—হ্যাঁ রে, গৌরাঙ্গের সঙ্গে আমার লাস্ট—মাস সাতেক আগে একবার দেখা হয়েছিল। ও তো গলসির কোন এক স্কুলে পড়াচ্ছে। সেদিন তোর কথাও জিজ্ঞেস করেছিলাম।

ঘটনাটা মিথ্যে নয়। আমার উচ্চমাধ্যমিকের আর এক সহপাঠী গৌরাঙ্গর সঙ্গে ছ-সাত মাস আগে আরামবাগগামী একটা বাসে দেখা হয়েছিল। ইসকুল থেকে ও বাড়ি ফিরছিল। ওকে চিনতে আমার একটু সময় লেগেছিল। কেন না, এই তেতাল্লিশেই ওরম ভুঁড়ি বাগানো নাদুসনুদুস চেহারা যে আমার সহপাঠীর হতে পারে, সেটা বিশ্বাস হতে সময় লেগেছিল। তবে কিনা ঠিক চিনে নিয়েছিলাম গৌরাঙ্গর দুটো চোখ দেখে। ওর সেই জুলজুলে দুটো খুদে-খুদে চোখ দেখলেই আমার মনে হতো চিনা-ড্রাগনের জিহ্বার মতো কী যেন এক লক-লকে লোভ কিংবা সুতীব্র এক আকাঙ্ক্ষা ওকে ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে। গৌরাঙ্গর সঙ্গে কথা বলতেই বুঝতে পারি ওর সেই অসীম-অনন্ত ডিজ়ায়ার। সেই আকাঙ্ক্ষা যেন আজও এতটুকু কমেনি, বরং বেড়েছে। মাস্টারস করার পর গৌরাঙ্গ আমাকে খুব করে ধরেছিল, ও যাতে নেট পায় আমি যেন সে-সবের নোট সরবরাহ করি। আমি গাইড করলে নেট ওর নিশ্চিত। কলেজের অধ্যাপক ও হবেই। মনে আছে, নেটের কিছু মেটিরিয়ালস ওকে দিয়েওছিলাম। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত নেট ও ক্লিয়ার করতে পারেনি। তা মাস সাতেক আগে, সেই সেদিনও বাসের মধ্যেই গৌরাঙ্গ আমাকে খুব করে ধরল, বলল:

—বুঝলি, একটা বি এড কলেজে পার্টটাইম পড়াচ্ছি।

—বেশ তো, খুব ভালো।

—তোর নম্বরটা দে, একদিন তোর ডিপার্টমেন্টে যাব। শুনলাম, তুই এখন হেড হয়েছিস।

—কেন যাবি কেন? মানে তেমন কিছু কি দরকার আছে?

—সুকান্তকে নিয়ে যাব। তুই তো ওখানেই থাকিস? রিইউনিয়ন হবে। খাসির কষা-মাংস আর হুইস্কি।

       আমি হেসে বললাম —-তুই এখনও একটুও বদলাসনি, বল?

—-আরে যাঃ, হুইস্কির দামটা না হয় আমিই দেব।    

        তারপর একটু থেমে চুপিচুপি বলল, তোর সঙ্গে পার্সোনাল দরকার আছে।

—কী দরকার সেটা এখনই বলতে পারিস, আমার কোনো অসুবিধা নেই।

—না মানে, তোকে একটা কাজ করতে হবে।

—কী কাজ বল?

—তুই আমাকে পি এইচ ডি-টা করিয়ে দে। এখন হেড হয়েছিস, চাইলেই ব্যাপারটা তোর মুঠোর মধ্যে। কবে যাব বল?

       আমার গা রি-রি করছে। তবু শান্ত হয়ে বললাম—এই বয়েসে পি এইচ ডি করে কী করবি?

—পি এইচ ডি-টা করলেই আমি প্রিন্সিপাল হয়ে যাব।

—মানে? কীসের প্রিন্সিপাল?

—ওই বি এড কলেজের প্রিন্সিপাল হয়ে যাব। বেসরকারি কলেজ তো, মালিকের সঙ্গে আমার পাকা কথা হয়ে আছে। বলেছে আপনি ডিগ্রিটা করিয়ে নিন, কোনো সমস্যা হবে না। 

       বলেই আমার হাতটা খপ করে ধরে গৌরাঙ্গ বলল—মলয়, তুই করে দে আমাকে, তোকে আমি পুষিয়ে দেব।

      আমি তখন রীতিমতো ঘামছি। ও ভালো করে দেখলে বুঝতে পারত, আমার চোখ-মুখ-কান— সব রাগে এবং লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। হার্টবিটও স্বাভাবিক নয়। তবু নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে, ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে খুব স্পষ্টভাবে বললাম:

—শোন গৌরাঙ্গ, কিছু মনে করিস না, তোকে আমি পি এইচ ডি করাব না এবং এ নিয়ে তোর সঙ্গে আর একটা কথাও বলব না। 

       গৌরাঙ্গ উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং আমার মনোভাব বিবেচনা করে প্রসঙ্গ ঘোরালো। আমার ফ্যামিলি-ট্যামিলির কুশল জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করল। স্কুলের দু-একজন সহপাঠী-সহপাঠিনীদের কথা উঠল। পরিস্হিতি স্বাভাবিক হতে আমিই ওকে শৈলেশের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। শৈলেশকে নিয়ে গৌরাঙ্গ যা বলেছিল, তা বেশ ইন্টারেস্টিং!

উচ্চমাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করে শৈলেশ কালীপুর কলেজে বাংলা অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। বাংলা অনার্সে ও যে ভর্তি হবে, সে তো স্বাভাবিক। আমাদের সময়ে উচ্চমাধ্যমিকে বাংলায় ৬০% নাম্বার পেলেই সেটা ছিল যথেষ্ট, শৈলেশ সেখানে তুলেছিল ৮২%। স্কুলের বাংলা স্যারেরা ওর দিকে সম্ভ্রমের চোখে তাকাতেন। বলতেন বাংলা ভাষায় ওর দখল নাকি ব্যা-পক! আমরাও মাঝে-মাঝে পড়তুম ওর ভাবসম্প্রসারণ কিংবা সারাংশের নমুনা। সেসব গদ্য ছিল উপমাদীপ্ত, সংস্কৃতবহুল, সমাসবদ্ধ শব্দের জাল-বিছানো আলংকারিক গদ্য। আমরা স্বচ্ছন্দে উচ্চারণ করে পড়তে পারতাম না। মনে করতাম —একেই বলে বাংলা ভাষাজ্ঞান। এই হচ্ছে আসল গদ্য! আমাদের বাংলার স্যার ভবানীবাবু খুব প্রশংসা করতেন শৈলেশের বাংলা লেখার। বলতেন—‘শেখো শেখো বাংলা ভাষা কেমন করে লিখতে হয় শেখো’। সব মিলিয়ে, আমরা সাধারণের দল শৈলেশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম।

       আমার মনে আছে, অনার্সের সেকেন্ড ইয়ারে শৈলেশ আমাকে একটা চিঠি লিখেছিল। সেটাই ছিল আমাকে লেখা ওর প্রথম এবং শেষ চিঠি। সেই চিঠিতে, দারিদ্র্য আর কঠিন প্রতিবন্ধকতার ভিতর দিয়ে কীভাবে লড়াই করে ও পড়াশোনা করছে, সে-সব লিখেছিল তিন পাতা জুড়ে। আমাকে একটা কাল্পনিক উচ্চ অবস্থানে রেখে শৈলেশ বোঝাতে চেয়েছিল, আমার চেয়ে কতো হাজারগুণ লড়াই ওকে লড়তে হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই চিঠিটি কোনো বইএর ভাঁজে রেখে আমি হারিয়ে ফেলেছি। থাকলে আপনাদের দেখাতে পারতাম, তার দারিদ্র্য আর প্রতিবন্ধকতার কথা— প্রায় ছত্রে ছত্রে তৎসম-প্রেম ও আলংকারিকতার ভয়ংকর প্রাবল্যে —সে যে কী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল! সে চিঠির ভাষা হজম করতে আমার বিদ্যাসাগরের গদ্যের চেয়ে ঢের বেশি সময় লেগেছিল। তখনই বুঝেছিলাম, আর যাই হোক, শৈলেশ বাংলা লেখার ভাষা বলতে যেটা মনে করে, সেটা বড়োজোর বঙ্কিমীযুগের গদ্য। ওকে অবশ্য এই কথাগুলো আমি বলিনি।

        যাক সে কথা। তবে যেটা আমাদের বন্ধুদের খুব অবাক করেছিল, অনার্সে শৈলেশের কোনোরকমে পাসনম্বরটুকু পাওয়া। ফলে, ও মাস্টারস-এ কোথাও ভর্তি হতে পারেনি। শুনেছি কলেজের কোনো এক সহপাঠিনীর প্রেমে পড়েছিল, সে প্রেমের পরিণতি হয়েছিল শৈলেশের পক্ষে করুণ এবং যন্ত্রণাদায়ক। অবশ্য এর সঙ্গে ওর নিজের দারিদ্য প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদির ফলে শৈলেশ ওখানেই পড়াশোনার ইতি টেনে দেয়। এগুলোই নাকি তার ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। তবে ওর ব্যর্থতার আর একটা অন্য পয়েন্টও আছে মনে হয়—অবশ্য এটা পারসোনালি আমার পয়েন্ট অফ ভিউ। সেটা হল ওর বাংলা লেখার উনিশ শতকীয় স্টাইল। সে যাই হোক, কম নম্বর পাওয়ার ফলে, নিজের বাংলা ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা ওর ছিল, সেটা ভয়ানকরকম আঘাতপ্রাপ্ত হয়। স্বাভাবিকভাবেই শৈলেশ এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্রান্ত, ওর প্রতি শিক্ষকদের অবিচার, বেইমানি ইত্যাদি খুঁজে পায়। কিছুকাল গ্রামে টিউশুনি করে এবং অবশেষে পড়া ছাড়ার বছর পাঁচেক পরে ওর মা-র মৃত্যু হলে ভাই-এর হাতে সংসারের দায়িত্ব ছেড়ে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। দীর্ঘ কয়েকবছর ওর কোনো খোঁজ ছিল না। কেউ বলে শৈলেশ মারা গেছে, কেউ বলে সন্ন্যাসী হয়ে গেছে। অবশেষে বছর দশেক পর শৈলেশ হঠাৎ একদিন বাড়ি ফিরে আসে। 

       জানা যায়, বাড়ি ছেড়ে ও চলে গিয়েছিল ওড়িশার বালাসোর না ওরকমই কোনো এক ছোটো শহরে। সেখানে কী একটা কারখানায় কাজ পায়। এতদিন সেখানে কাটিয়ে, এ-কারখানা ও-কারখানা করে, অবশেষে একটা ছোটোখাটো সেরামিক কারখানায় ম্যানেজারির চাকরি পেয়ে থিতু হয়েছে। খানিক পয়সা জমিয়ে কয়েক বছর পর বাড়ি ফেরে। পুরোনো ভাঙা বাড়িটার সংস্কার-টংস্কার করে, ভাই-এর বিয়ে দেয়, তারপর ফের ফিরে যায় নিজের কাজে। 

       গৌরাঙ্গর মুখ থেকে শোনা, এই পর্যন্তই আমার জানা ছিল শৈলেশের নাটকীয় জীবনবৃত্তান্ত। সেই শৈলেশ, প্রায় পঁচিশ বছর পর, আজ আমাকে হঠাৎ ফোন করে ও প্রান্ত থেকে বলবে—কী রে বাঁড়া, চিনতে পারছিস?—এ আমার চোদ্দোপুরুষেরও কল্পনার বাইরে ছিল।

— তারপর, কোত্থেকে কথা বলছিস তুই? মানে বাড়ি ফিরেছিস? নাকি ওড়িশায়?

— তুই কোথায় আছিস, কলকাতায়?

— না রে, বর্ধমানেই আছি, আমার কোয়াটারে।

— ফ্ল্যাট কিনেছিস?

— না না, ইউনিভার্সিটির কোয়াটার।

— অনেক টাকা তোর, না?

— ধ্যাৎ! কী যা তা বলিস। কী জন্য ফোন করেছিস সেটা বল।

— না এমনিই। দেখছিলাম লকডাউনে কেমন আছিস? ঘরে মাল সব মজুত করেছিস?

       এই তো, মালটা এবার লাইনে এসেছে। আমি ভাবছিলাম, এত বছরের পর শৈলেশ কেন হঠাৎ আমাকে ফোন করবে! আসলে, আমার কেরিয়ারের এরকম উন্নতি ও আজও মেনে নিতে পারেনি। তাই কি আজ সুযোগ বুঝে খোঁটা দিতে এসেছে, কিংবা নিজের ব্যর্থতার ঝাল মেটানোর জন্য আমাকে বেছে নিচ্ছে। ওর মতলব আমার বুঝতে বাকি নেই। ঠিক আছে, একটু ওর চালেই খেলা যাক। দেখিই না, শৈলেশ কী বলতে চায়। লাটাই তো আমার হাতে, খানিক সুতো না হয় ছাড়াই যাক। বললাম:

— হ্যাঁ, মালপত্র মোটামুটি সবই তুলে রেখেছি। শুধু ওই টুকটাক প্রয়োজনে—। বাইরে বেরোবো কি, ঈদের বাজারে যা ভিড়। গ্যাদারিং…

— পুলিশ পেটাচ্ছে না?

— পুলিশ একটু অ্যাকটিভ হলে তো ভালোই হতো। একবার ছড়ালে আর দেখতে হবে না।

— কী দেখতে হবে না?

— কী আবার —সংক্রমণ, কোভিড।

— বো-কা-চো-দা…

— কী বলছিস?

— বলছি সব বোকাচোদার দল। 

— আরে কে বোঝাবে? পৃথিবী উল্টে গেলেও বাঙালির বাজারে বেরোনো চাই। সংক্রমণ একবার হলে টের পাবে। প্যান্ডেমিক হতে কতক্ষণ, বল?

— স্বার্থপ্পর বোকাচোদার দল।

— যা বলেছিস।

— তোদের কথা বলছি। সরকারি চাকরি করা প্রিভিলেজ়ড বোকাচোদার দল। মাইনে ঢুকছে, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স আছে, ঘরে খাবার মজুত আছে। বিগবাজারের হোম ডেলিভারি আছে। তবু বাবুদের বাড়ির ছেলে-বুড়োদের যাতে করোনা না হয়, তাই বাকি মানুষদের বাজারে বেরোনো চলবে না, তাই না? এতো সব বাগিয়েও বালগুলোর চাহিদার শেষ নেই। নিজেদের ইনসিকিওর ভাবছে! 

        আশ্চর্য, ঠিক এই কথাগুলোই গতকাল রাতে আমি আমার এক কলিগ-কে বলেছিলাম। মার্কেট খোলা আর পাবলিক গ্যাদারিং নিয়ে আমার সহকর্মী একের পর এর ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শেয়ার করছিলেন। সেগুলি সবই হয় বাজার করার নয় রেশন-লাইনের বা শ্রমিক বিক্ষোভের অথবা ধর্মীয় জমায়েতের। সহকর্মী আতঙ্কিত। এই সব মূর্খ আমজনতার জন্যই করোনা প্যান্ডেমিক হতে আর দেরি নেই। সহকর্মীর ঘরে দু-দুটি বাচ্ছা, বৃদ্ধ মা, কাজেই তিনি আতঙ্কিত, —লোকগুলোকে পুলিশ কেন দমদম দাওয়াই দিচ্ছে না! সহকর্মীর কথা শুনে আমি উত্তেজিতভাবে ওই কথাগুলোই উত্তর দিয়েছিলাম—যা এইমাত্র শৈলেশ বলল। অবশ্য অনেক মোলায়েম করে অধ্যাপকোচিত ভদ্রবুলিতে।

— দ্যাখ শৈলেশ, এটা শুধু সরকারি চাকরিওলাদের ব্যাপার নয়। সোসাইটিতে আরও অনেকরকম মানুষ বিলং করে যারা…

— আরে রাখ তোর বালের সোসাইটি। সোসাইটি মারাচ্ছিস। এই দেড়মাস ধরে রাস্তায় শ্রমিকরা ছোটো-ছোটো বাচ্ছা নিয়ে কীভাবে হাঁটছে দেখেছিস? এই গ্রীষ্মের রোদে ছাতা না ফুটিয়ে পিচ রাস্তায় কখনও হেঁটে দেখেছিস? পুলিশের ডান্ডা কখনও পড়েছে তোর পিঠে, পায়ের গোছে? ঠান্ডা ঘরে বসে সোসাইটি মারাচ্ছে! ঘরে ফেরার জন্য রাস্তায় বেরোনো ওই মানুষগুলো কোন সোসাইটিতে বিলং করে রে বাঞ্চোৎ?

       শৈলেশ খুব উত্তপ্ত। কী বলব বুঝে উঠতে পারছি না। এমন সময় আমার কোয়াটারের গেটের মুখে একটা মোটরবাইক এসে থামল। কোনো শপিং মলের ডেলিভারি বয়। উপর থেকে এক সহকর্মী নেমে এলেন। ডেলিভারি বয় বড়ো সাইজের এক প্যাকেট মোমবাতি, টর্চের ব্যাটারি, অ্যাকুয়াফাইনার দুটো বোতল ইত্যাদি তাঁর হাতে দিলেন। আম্ফান আসছে, আজ রাতের মধ্যেই হয়তো আছড়ে পড়বে। টিচার্সদের গ্রুপে এই নিয়ে অনবরত আপডেট ফরওয়ার্ড আসছিল কাল রাত থেকে। আম্ফান এখন দীঘা থেকে ক-কিলোমিটার দূরে, কতটা গতি, ঢেউএর উচ্চতা কতো, উৎসকেন্দ্রের গতিবেগ কত, কটা নাগাদ উপকূল পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করবে, বর্ধমানে রাত কটা নাগাদ তীব্র হবে, কত স্পিড থাকতে পারে, বলবুল বা ফণির চেয়ে এটা কতটা তীব্র, অমুকের চার-চাকার গ্যারেজ ঘর নেই, সেটাকে নিরাপদ জায়গায় স্ট্যান্ড করতে হবে, ঝড়ে গাছের ডাল এসে গাড়ির উপর না পড়ে। ইলেকট্রিক না থাকারই সম্ভাবনা। কার কাছে জরুরি জিনিস কী আছে আর কী নেই, তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন। সব্জী লাগবে কিছু, মুগডাল—খিচুড়ির আদর্শ সময় এটাই, টর্চের দুটো ব্যাটারি চাই, মোমবাতি নেই, এক্ষুনি অর্ডার দিতে হবে। ওয়াটার সাপ্লাই না থাকতেই পারে, কটা দু-লিটারের ওয়াটার বটল আনিয়ে রাখা ভালো। বিকেলের দিকে মাল ডেলিভারি নাও থাকতে পারে, কার-কী লাগবে বলুন, এখনই বুক করব— এই সবই চলছিল সকাল থেকে। ওঁদের রকমসকম দেখে আমার মনে হচ্ছিল, আমার সহকর্মীদের কাছে এই মুহূর্তে আম্ফানই পৃথিবীর একমাত্র সমস্যা। তবে এ-সব শুনলে শৈলেশ কি আমাকে আর আস্ত রাখবে! খিস্তির বন্যা বইবে। আমি প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইলাম। বললাম:

—শৈলেশ, এ-সব ছাড়। তুই আছিস কেমন বল? কত বছর পর তোর সঙ্গে কথা হচ্ছে। তোর ঘর ছাড়ার কথা আর সেই প্রবাসের গল্প বল।

— শুনতে চাস? সত্যিই শুনতে চাস?

       শৈলেশের গলা কাঁপছে। মোবাইলের এ প্রান্ত থেকে আমি বুঝতে পারছি আবেগ আর উত্তেজনায় ও হয়তো কেঁদে ফেলতে পারে। বললাম:

— একটু শান্ত হ ভাই। বল, এই লকডাউনের সময় বিপদ মাথায় নিয়ে ওড়িশ্যা থেকে তুই চলে এলি কেন?

— আমার চাকরিটা আর নেই। লকডাউন শুরু হতেই কম্পানি চাপ দিচ্ছিল। ভেবেছিলাম মার্চের মাইনেটা অন্তত দেবে, তাই ছাড়িনি। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর মালিকের কাছে গেলাম। বলল, ব্যাবসা বন্ধ। হাতে সাশপেনশন অর্ডার ধরিয়ে দিল। এদিকে আমার ঘরভাড়া, বাইকের লোনের ই এম আই, সব তো মাইনেটুকুর উপর ভরসা ছিল।

— বিয়ে তো করিসনি শুনেছিলাম।

— না রে, বছর তিনেক আগে বিয়ে করেছি। ওখানেরই স্থানীয় মেয়ে। 

       এরপর একটু থেমে নিচু স্বরে বলল—দেড় বছরের বাচ্চা ছিল।

       এ পর্যন্ত বলে শৈলেশের গলা যেন আচমকা থমকে গেল। ‘ছিল’—শুনেই আমি অশনি সংকেত টের পাচ্ছিলাম। বললাম:

— তারপর কী হল, বল?

       শৈলেশ এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। গুমরে-গুমরে সে কী কান্না। তেতাল্লিশ বছরের এক সন্তানহারা পুরুষ যেন দুমড়ে-মুচড়ে খান-খান হয়ে যাচ্ছে। ঢেউ-এর পর ঢেউ যেন উপকূলে আছড়ে পড়ছে। আমি স্তব্ধ বিস্ময়ে শুনতে পাচ্ছি, ফুলে ফেঁপে ওঠা এক উত্তাল সমুদ্রের গর্জন। এমন সময় একটি নারীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, অচেনা ভাষায় কান্না-জড়ানো কোনো আর্তি। শব্দ মৃদু হয়ে এল। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে রেখেছে হয়তো। শৈলেশ নারীটিকে কিছু বলছে, বুঝলাম ওড়িয়া ভাষা ওটা। আমার কল্পনার চোখে ভেসে উঠল সন্তানহারা এক মা তার স্বামীর বুকে মাথা রেখে কান্নায় ঙেঙে পড়ছে। কে-যে কাকে সান্ত্বনা জানাবে! 

       এই সিচ্যুয়েশনে আমার কি ফোন কেটে দেওয়া উচিত? কিন্তু শৈলেশ তো কিছু বলতেই ফোন করেছে। আমি কীভাবেই বা ওকে সান্ত্বনা দেব? কী করা উচিত আমার?—এই ভাবতে ভাবতেই ফের শৈলেশ ফোন ধরল:

— ছেলেটার লিউকোমিয়া ছিল। দু-তিন মাস অন্তর ওকে রক্ত দিতে হতো। লকডাউনে অনেক চেষ্টা করেছি। রক্ত জোগাড় হয়েছিল, কিন্ত কোনো হাসপাতালেই চিকিৎসা হয়নি। 

       আবার একটু থেমে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল:

— ছেলেটা আমার বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। 

— শান্ত হ শৈলেশ, মনকে স্থির কর।

       শৈলেশ তখনও ফোঁপাচ্ছে বুঝতে পারছি। আটকে থাকা নিঃশ্বাস দমকে-দমকে বেরিয়ে আসছে।

— না রে, আর কষ্ট পাই না। চোখের জল আমার চোখেই শুকিয়ে গেছে। কী মনে হয় জানিস? ছেলেটা আসলে মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। না হলে হয়তো রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়তো।

— কীভাবে ফিরেছিস তুই?

— শ্মশানে যখন ওকে পুড়িয়ে ফিরলাম, দেখি বাড়ির মালিক দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছে। দু মাসের ভাড়া বাকি ছিল। বউ-এর একজোড়া বালা বেচে সে-সব শোধ করে, মালপত্র ফেলে রেখে, দুটো ব্যাগ বেঁধে, বউকে নিয়ে বাইকে করে বেরিয়ে পড়লাম।

— তারপর?

— তারপর আর কী, প্রত্যেকটা বর্ডারে পুলিশের ধ্যাতানি খেতে খেতে, লাঠির শাসানি সহ্য করে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরেছি। চোখের সামনে দেখেছি পাঁচ-ছ বছরের ছোট্টো বাচ্ছা কীভাবে খালি পায়ে দুপুরের রোদে আগুনে রাস্তায় পথ হাঁটছে। ওই বাচ্ছাগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল জানিস, আমার বাচ্ছাটা মরে গিয়ে সত্যিই বেঁচে গেছে। আরও অনেকের মতো আমরা রাস্তাতেই মরে যেতে পারতাম। তবু যে বেঁচে ফিরেছি, এটাই খুব আশ্চর্য, জানিস!

— পরিস্হিতি হয়তো আরও খারাপ হবে শৈলেশ, তোকে শক্ত হতে হবে।

— পাথরের চেয়েও কঠিন হয়ে গেছি, বুঝলি। মৃত্যুকে দুহাতে নাচাতে-নাচাতে চারশো কিমি পার করেছি। মনে হচ্ছিল ওটা দু হাজার কিমি। মনে হচ্ছিল হাঁটতে থাকা ওই মানুষগুলোর সঙ্গে রাস্তাতেই লুটিয়ে যাব। দু প্যাকেট বিস্কুট আর দু বোতল জল—ওটাই মনে হচ্ছিল ভগবানের আশীব্বাদ। 

— হ্যাঁ রে, ফেসবুকে দিনরাত সে-সব ছবি দেখতে পাচ্ছি। অবাক হচ্ছি এটা ভেবে যে, দিনের পর দিন পুলিশের তাড়া খেতে খেতে, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত মানুষগুলো কীভাবে ধৈর্য ধরে রেখেছে। ওরা কেন যে খাবার ছিনিয়ে নিচ্ছে না? পাল্টা মার দিচ্ছে না কেন?

— সে-সব তোরা বুঝবি না মলয়। জীবনটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প নয়, বুঝলি? বাস্তবের মাটিতে নেমে এলে বুঝতিস— অন্যের মুখের খাবার ছিনিয়ে, কেড়ে, চুরি করে খাওয়ার অভ্যেস আছে ওই রাষ্ট্রের ছোটো-বড়ো দালালদের, পুঁজিপতিদের, মন্ত্রীদের, পার্টিকর্মীদের, আমলাদের, অফিসারদের। মানুষ কখনও অন্যের খাবার ছিনিয়ে নেয় না। নিলে সে আর মানুষ থাকে না। খেতে না পেয়ে লোকে শুকিয়ে মরে, পুলিশের ডান্ডার ঘায়ে হাড় ভেঙে যায়, তবু সে মানুষই থাকতে চায়, জানোয়ার হয়ে যায় না। তোদের ওই সরকারি চাকুরিজীবীদের মতো মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দেয় না।

       আমার ব্যালকনির গ্রিলে কতকগুলো ছাতার পাখি কলকল করছে। ওরা অনেকক্ষণ থেকেই আমার অ্যাটেনশন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি শৈলেশের কথাগুলোর থেকে মন সরাতে পারছি না। ওর কথাগুলো যেন নিক্ষিপ্ত তিরের মতো আমাকে বিঁধছে। আমার হাতে লাটাই আছে বটে, কিন্তু সুতো কখন যে ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। আশ্চর্য বটের মতো সুদৃঢ় কঠিন কিন্তু ঋজুবাক এখন শৈলেশের কণ্ঠ। আমি চুপ করে ওর কথা শুনে যাচ্ছি। উচ্চমাধ্যমিকের সেই আলংকারিক বাংলা লেখা ছেলেটা আজ কীভাবে এতটা কঠিন কঠোর নিরলংকার গদ্যভাষী হয়ে উঠল সেটা অনুভব করতে পারছি। 

      ওর কথা শেষ হলে বললাম:  

— শৈলেশ, তোর কি টাকার দরকার? আমাকে নিঃসংকোচে বল ভাই, পাঠিয়ে দিচ্ছি।

— পকেটে মাত্র দুশো-টা টাকা পড়ে আছে। ভাইএর দোকানও দেড়মাস বন্ধ। হাজার পাঁচেক পাঠাতে পারবি? আমি ঠিক শোধ করে দেব।

—  সে-সব পরের কথা শৈলেশ। তুই অ্যাকাউন্ট নম্বর আর আই এফ এস সি কোডটা সেন্ড কর। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

       ছাতারদলের কল-কাকলি ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠছিল। ওরা রোজ তিনবেলা আমার ব্যালকনিতে দানা খেতে আসে, আমার মুষ্টিভিক্ষার প্রত্যাশী ওরা।। আমি ঘরে ঢুকে একমুঠো চাল এনে বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়ে বললাম—নে, খা তোরা এবার। চিৎকার করে মাথা খেয়ে নিল একেবারে!  

~~~