বাগ আচ্ছে হ্যায় – সৈকত পালিত

-১-

৩১.১২.৯৯

জাপান।

ঠিক রাত ১২টায় ইশিকাওয়া শহরে বিকিরণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের সাংকেতিক আলো নিভে যায়।

ওনাগাওয়া অবস্থিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হঠাৎ অ্যালার্ম বেজে ওঠে।

ওসাকা-য় টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রকাণ্ড মনিটরে গোলযোগ শুরু হয়।

জাপানের বৃহত্তম সেলুলার অপারেটর এন.টি.টি. ডোকোমো-র দপ্তরে মিনিটে মিনিটে নথিত হতে শুরু করে অচেনা অসংগতির অভিযোগ।

ফ্রান্স।

রাষ্ট্রীয় পরিবেশ সংরক্ষণ কেন্দ্রের আধুনিক যন্ত্র বিশেষে বিবিধ বেনিয়মী-ঝঞ্ঝাট ক্রমাগত মাত্রা  ছাড়িয়ে যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

দাপ্তরিক সময় নির্ধারণে দায়িত্বরত ন্যেভাল অবসারভেটরির জাঁদরেল ঘড়ি অকস্মাৎ অচল হয়ে পড়ে।

বিবিধ গুপ্তচরী গ্রাউন্ড কন্ট্রোল বিভাগের তথ্য সংগ্রহক যন্ত্রও কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

এবং ডেলাওয়্যার লটারির সমস্ত স্লট-মেশিন অনুজ্জ্বলে অবস্থান করে।

এই ঘটনাগুলিকে অবশ্য পূর্বাভাস-বিরাগী বলা যায় না।

তিন দিন আগেই অনেক ব্যাঙ্কের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড অকার্যকরী হয়ে গিয়েছিল।

এছাড়াও, অস্ট্রেলিয়ার বাস-টিকিট নির্ধারক যন্ত্র ও সিঙ্গাপুরের সমস্ত ট্যাক্সির মিটার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, গত এক মাস যাবৎ।

হয়ত এরকম, বা ভিন্ন কোনও পরিস্থিতির আভাস পেয়েই, রাশিয়ায় অবস্থিত এমব্যাসির দরজা সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অস্ট্রেলিয় সরকার।

সন্ধিক্ষণ-সম্ভাবনার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ৭ বছর আগে প্রযুক্তি বিষয়ক পত্রিকা, “ কম্পিউটার-ওয়ার্ল্ড ”-এ প্রকাশিত একটি তিন পাতার অনুচ্ছেদে। এবং দু’বছরের ব্যবধানেই একটি যোগ্য ডাকনামও স্থির করা হয়।

১৯৯৩।

দক্ষিণ আফ্রিকা-জাত ক্যানাডিয় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার পিটার ডি ইয়্যাগার “ ডুম্‌স ডে ২০০০ “ নামে প্রকাশিত এই তিন পাতার অনুচ্ছেদে অদূর অবস্থিত এক যাপনস্পর্শী ঝঞ্ঝাটের বর্ণনা করেন।

১২ই জুন ১৯৯৫।

ম্যাসাচ্যুসেটসে কর্মরত মার্কিন প্রোগ্রামার ডেভিড এডি, তার চিন্তিত চিঠিতে একটি সমগোত্রীয় বক্তব্যে প্রথমবার যে শব্দবন্ধের ব্যবহার করেন, তা আগামী কিছু বছর প্রচন্ড প্রমাদ ও পরবর্তী সময়ে নস্ট্যালজিয়া উদ্রেক করে চির জনপ্রিয় হয়ে থেকে যায়।

“ ওয়াই টু কে বাগ “ বা “ মিলেনিয়াম বাগ “।

–২–

ভেবে দেখলে, আমেরিকায় ডাক্‌ট টেপ বিক্রির বৃদ্ধি আর ভারতে ইঞ্জিনিয়ার উৎপাদনের ঝড়ের মধ্যে প্রাকৃতিক যোগাযোগ প্রায় অসম্ভব। তবে মহাভারতে বলেছে “ম্যায় সময় হুঁ”। নায়কের নামই যথেষ্ট । প্রকৃতির গোলিয়াথ-গতরে কিছু আকাশ ভাঙ্গা টুইস্ট চলকে, টি.আর.পি আঁচানো রিয়্যালিটি-শো-এর দেবতা , যুক্তির অল্টার ইগো – সময়।

যারা হোয়াইট হ্যাট জুনিয়ারের লোন শোধ করা এখনও শুরু করেননি, সেই দৃশ্যমান ব্যক্তিত্বদের প্রতি খানিক ভূমিকা সহ আলোচ্য সমস্যার বর্ণনা :

অনেক বেশী কাজ, তুলনায় কম সময় আর বিরক্তি-মুক্ত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে মানুষের আবিষ্কার – শুরুতে মেশিন, পরে বিবর্তনের নিয়মে আরও বেশী ঝলমলে – কম্পিউটার।

ভাষার প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ ও অসাধারণ মেশিনের পারস্পরিক দুর্বোধ্যতার সমাধানে তৈরী হয় বিশেষ অনুবাদ মাধ্যম – প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গোয়েজ।

এই মাধ্যমে রচনা হয় স্বয়ংক্রিয় নির্দেশ বিন্যাস বা কোড এবং রচনা পদ্ধতিকে বলা হয় কোডিং।

দৈনিক যাপনের প্রায় সব কটা অভিমুখ, যেরকম ক্যান্ডি ক্রাশ, নেটফ্লিক্স, ইলেক্ট্রিক হিটার, ট্রাফিক লাইট, এমনকি ডিজিটাল ঘড়ি, সবের মূলে আছে একেকটা সফটওয়্যার, আর সফটওয়্যারের মূলে কোডিং।

কার্য্য-পরিধির প্যারামিটার অনুযায়ী, কোডিং বা নির্দেশ রচনায় যে কোনও মাপের ত্রুটিকে প্রযুক্তিজীবি আঁতেল গোষ্ঠি নাম দেয়  ‘বাগ’ ( বাংলায় জীবাণু)।

২০০০, অর্থাৎ Y2K এবং প্রোগ্রামিং ত্রুটি, অর্থাৎ বাগ; যুক্ত হয়ে জনপ্রিয় ক্ষুদ্রীকরণ Y2K বাগ।

কম্পিউটারে তথ্য সংগৃহীত হয় ০ এবং ১-এর ক্রমবিন্যাস পদ্ধতিতে। এই তথ্য নথিত হয় নির্দিষ্ট স্থান বা মেমরি স্পেসের বিনিময়ে। ৭০’ দশকে এই মেমরি স্পেসের মূল্য তুলনাহীন হলেও প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে কম্পিউটারের সমাদর দ্বিগুণ তুলনাহীন হওয়ায় সর্বসম্মত ভাবে স্থির হয় তারিখের সরলীকরণ। ১২ই জানুয়ারি ১৯৭৮-কে লেখা হল ১২-০১-৭৮। মানে, চার অঙ্কের ১৯৭৮ কে ছোট করে দুই অঙ্কের ৭৮ করা হল; অর্থাৎ অনায়াসে ধরে নেওয়া হল প্রথম দুটো সংখ্যা ১৯। আরো সহজ করে বললে, ৩১-১২-৯৯ অবধির সময় পুরোটা অশান্তিহীন হলেও, তার ঠিক পরের দিন ০০ সাল মেশিনের মতে ২০০০ না ১৯০০, তা মানুষের ধারণা ও দূরদর্শীতার বাইরে। প্রথম দর্শনে নিরীহ মনে হলেও, এর প্রভাবের সম্ভাবনা ছিল সার্বিক এবং গুরুতর।

বিদ্যুৎ ও ব্যাঙ্কিং বিভাগ ছাড়াও পরিবহন পরিষেবায় চূড়ান্ত প্রভাবের আশঙ্কা করা হয়েছিল।

ধরুন, ২০০০ সালের ৩রা জানুয়ারি ই.এম.আই-এর শেষ কিস্তি শোধ করতে গিয়ে জানতে পারলেন কম্পিউটারের মতে ওটা ১৯০০ সালের ৩রা জানুয়ারি, ফলে আরো ১০০ বছর আপনাকে লোন শোধ করে যেতে হবে।

অথবা, ২০০০ সালের ১লা জানুয়ারি এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেখলেন আপনার দুপুর দু’টোর ফ্লাইট ছাড়তে এখনও ১০০ বছর বাকি।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সময়ের ভূমিকা এতটাই মৌলিক যে শতাব্দীর শুরুতেই পৃথিবীময় লোডশেডিং-এর সম্ভাবনাও অগ্রাহ্য করার মত ছিল না।

১৯৯৯ সালের অনেকটা অংশ কেটে গেল এই অন্ধকার অ্যাপোক্যালিপ্‌সের আপাত কামনায়।

—৩—

সঙ্কট সম্ভাবনার সর্বপ্রথম প্রভাব এসে আছড়ায় পৃথিবীর উজ্জ্বলতম প্রমাদ কেন্দ্র, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

শুরুটা হয় রাষ্ট্রীয় স্তরে।

১৯৯৮ সালে রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন সমস্ত বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে “২০০০ রেডিনেস অ্যান্ড ডিসক্লোসার অ্যাক্ট”-এর অনুমোদন করেন । আসন্ন সমস্যায় নিজেদের পরিকল্পনা সম্পর্কে সরকারকে অবগত করার ফতোয়া দেওয়া হল এই অ্যাক্টে।

হোয়াইট হাউজ নিয়োজিত জন কসকিনেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি এবং আপদকালীন পরিষেবা নিয়ন্ত্রক একটি স্বতন্ত্র সংগঠন ‘ফেমা’ (FEMA), যৌথ উদ্যোগে নিরীক্ষণ শুরু করে।

তখনও অবধি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল ইন্টারনেট । প্রতিকূল পরিস্থিতির নিরিখে ১৯৯৯ সালের ৩০শে জুলাই Y2K রাউন্ডটেবল গঠন করে নিয়ন্ত্রণী আইন চালু করা হল।

অযাচিত ভ্রান্তির আশঙ্কায়, রুশ সরকারের সাথে পারমাণবিক তথ্য বিনিময়ের সাময়িক চুক্তি পর্যন্ত আয়োজিত হল।

১৯৯৯-এর মার্চ মাসে ইউনাইটেড নেশান আয়োজিত Y2K সহযোগিতা সম্মেলনে ১২০টি দেশের রাষ্ট্র প্রতিনিধি অংশ নেয়।

১৯৯৯ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে, শুধু এই সমস্যার নিরিখে মোট ২০,০০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছিল আমেরিকা।

সংবাদ মাধ্যমের প্ররোচনায়, এই উৎকণ্ঠা ক্রমে প্রশাসনিক স্তরের উচ্চতা ও গভীরতা থেকে নেমে প্রমাদপ্রবণ জনতার মধ্যে সঞ্চারিত হলে, প্রথম-বিশ্ব সুলভ স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় । খবর ছড়িয়ে পড়ে, ১৯৯৯সালের শেষে সভ্যতার বিলুপ্তি কেউ আটকাতে পারবে না । কিছু মৌলবাদী সংগঠন দাবি করল এটা ক্লিন্টন সরকারের ষড়যন্ত্র।  Y2K সহায়িকা লিখে ও উপদেশ-মূলক বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে কিছু ধর্ম প্রবক্তা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। জনতার একাংশ অতিরিক্ত খাদ্য-পানীয় সংগ্রহ করায় ওয়ালমার্টের মত সুপার-মার্কেটেও সরবরাহ ঘাটতি হলে, অন্য অংশের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। বাজারে আসে Y2K কিট : যথেষ্ট খাবারের অভাবে টানা ২ সপ্তাহ জীবিত থাকার ম্যানুয়াল সহ একটি বাক্স, তাতে থাকছে কিছু হাই ক্যালরির বিস্কুট, এনার্জি ড্রিঙ্ক এবং ডাক্‌ট টেপ। বিশেষ করে ডাক্‌ট টেপের চাহিদা ও বিক্রি অভূতপূর্ব মাত্রা ছোঁয়।

অন্যদিকে বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলি ইতিমধ্যে Y2K ত্রুটির সমাধান কষে ফেলেছে। তারা এটাও জেনে গেছে যে এত কম সময়ে এই সমস্যা অতিক্রম করার মত যথেষ্ট কর্মী সংখ্যা আমেরিকায় নেই। তার অন্যতম কারণ – এই সমস্যার সমাধানে প্রাসঙ্গিক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গোয়েজ COBOL, বেশ কিছু বছর আগেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে । সমকালীন মার্কিন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়াররা তখন উন্নততর মাধ্যমে কোড লিখছে। সমাধান জানা সত্ত্বেও তার প্রয়োগ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিল গোটা তথ্য- প্রযুক্তি বিশ্ব।

এই প্রকান্ড প্রশ্ন চিহ্নের উত্তর, কিছু মাস পরেই আবিষ্কৃত হয় ভারতবর্ষে।

—-৪—-

২৭শে ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯।

দিল্লী।

কেন্দ্রীয় বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিংহ –

“ মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়। ভারতীয় তথ্য প্রযুক্তির উজ্জ্বল ভবিষ্যত সম্পর্কে আমাদের কারোর দ্বিমত নেই। অতি দুঃখের বিষয় এই, যে আসন্ন Y2K-ক্রাইসিস সামলে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট পরিকাঠামো ভারতীয় বাণিজ্য বর্গে এখনও তৈরি হয়নি। আমার প্রস্তাব, পরিকাঠামো তৈরীর আর্থিক সাহায্যের উদ্দেশ্যে আমাদের রাষ্ট্রকোষ এগিয়ে দেওয়া হোক, অন্তত এবারের বাজেট পরিকল্পনায়। “

তখনের সংসদেও, ‘প্রস্তাব’  এবং ‘ঘোষণা’ ছিল ব্যবহারিক রূপে সমার্থক ও আজকের মতই গণতান্ত্রিক।

আগামী সময়ে তথ্য প্রযুক্তির অর্থনৈতিক অবস্থান অনেকটা নির্ধারিত হয় এই ঐতিহাসিক বাজেট অধিবেশনেই।

শুরুতে অর্থনৈতিক উদারীকরণ আর শেষের  দিকে প্রশাসনিক উদ্যোগ; এই ৯০ দশকীয় নিদর্শন ভারতীয় ভবিষ্যতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে থেকে যাবে।

ইনফোসিস, টি সি এস, উইপ্রো তথা সমগ্র তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্র তখন অসম্ভব উৎসাহে সিক্ত। হায়দ্রাবাদ ও ব্যাঙ্গালোর দ্রুত আই.টি হাবে পরিণত হয়ে উঠছে।

স্বাধীনতা প্রাপ্তির কম সময়য়ের মধ্যেই আই আই টি নির্মাণে যন্ত্রবিদ্যা-মনস্কতার প্রমান দেয় ভারত। তবে ৮০-র দশকে বিশ্বায়ন পরিপন্থী রাজনৈতিক অবস্থানের কারনে ভারতীয় যন্ত্রবিদ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে ছিল। ঘটনাক্রমে এখানের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়াররা COBOL-এর সাথে যথেষ্ট পরিচিত এবং পরিকল্পনা অনুসারে Y2K বাগ সংশোধনে পরিশীলিত । চিরকালের গরীব দেশ, ভারতের সাধারণ মানুষ তুলনামূলক কম বেতনে অভ্যস্ত।  তাই আন্তর্জাতিক নজরে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভাবনাতীত উজ্জ্বল হয়ে উঠল ভারত। আমেরিকান এক্সপ্রেস , গোল্ডম্যান শ্যাক্স , ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা, সিটি ব্যাঙ্ক-এর মত কর্পোরেট নক্ষত্রদের প্রথমবার ভারতের ভূমিতে নেমে আসতে দেখা গেল এবং সহস্র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পশ্চিমী জেল্লায় প্রবাহিত হল।  H1b ভিসার এমন বাহুল্য এর আগে দেখা যায়নি।

১৯৯৯-এর আগে ভারতের জি.ডি.পি-তে আই.টি.সেক্টরের অংশ ছিল ১.২ শতাংশ , যা আগামী ৭ বছরে ৮.৫ শতাংশে পৌছয়।

১৯৯৯ থেকে ২০০৪-এর মধ্যে ভারতীয় সরকারের নিত্য উদ্যোগ, সিলিকন ভ্যালীর প্রবাসী ভারতীয়দের প্রচেষ্টা ও অনুকূল পরিস্থিতির সমন্বয়ে ভারতীয় তথ্য প্রযুক্তির এই অনন্য উত্তরণের যে নজির, তার শুরুটা হয় একটি প্রোগ্রামিং ত্রুটি ও তাকে ঘিরে আন্তর্জাতিক অস্থিরতা থেকে।

—-৫—-

২০০০ সাল এলে, কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া বিশ্ব- ব্যাপী কোনও বড় মাপের ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে পূর্ববর্তী আন্তর্জাতিক গণ-উৎকন্ঠা সম্পূর্ণ অর্থহীন ছিল না।

যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড শহরে ১৫৪ জন স্থানীয় অন্তঃসত্ত্বার ত্রুটি বহুল নিরীক্ষণের দরুন সময়-পূর্ব অ্যাবর্শান এবং ডাউন সিন্ড্রোম আক্রান্ত সন্তান প্রসবের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

জাপানের অনেক পোস্ট অফিসে মুদ্রা বিতরণী প্রক্রিয়া ব্যাহত থাকে বেশ কিছু দিন।

বুল্‌গেরিয়ায় সরকারি নথি নিখোঁজ হয়ে যায়।

নেব্রাস্কা সহ অন্যান্য কয়েক এয়ার-পোর্টে দীর্ঘকালীন যানজট প্রত্যক্ষ হয় আগামী কয়েক সপ্তাহে।

সকল দেশের ইঞ্জিনিয়ারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০০০ শুরু হওয়ার আগেই প্রায় সমস্ত ত্রুটি সংশোধন করা সম্ভব হয়েছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবী জুড়ে মোট ৬০,০০০ কোটি ডলার খরচ করা হয় সংশোধন প্রক্রিয়ায়।

এটা ভারতের জন্য শুধুমাত্র আই.টি. উত্তরণের অকল্পনীয় ছবি ছিল না। অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং প্রীতি লক্ষ্য করা যায়।

২০০১ সালে থমাসন কলেজ অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জাতীয়করণ হয়ে নতুন নাম হয় ‘আই আই টি রুরকি’।

২০০২ সালে ১৫টি আঞ্চলিক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে জাতীয় স্তরে উত্তীর্ণ করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় সরকার। তাদের নতুন নামকরণ হয় ‘ন্যাশ্‌নাল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি‘। জনপ্রিয় ক্ষুদ্রীকরণে এন আই টি (N.I.T)।

 —ক্লিফ-সংহার

গুনতে শুরু করলে দেখা যাবে সংখ্যার শেষ নেই। সংখ্যা অসীম কারণ যে কোনও সংখ্যার চাইতে বড় এবং ছোট একাধিক সংখ্যা থাকে। কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা, সম্পর্কের গভীরতা অথবা আদর্শের বাস্তবতার মতই কম্পিউটার মেমরিতেও বিজ্ঞাপনের সামান্য আড়ালেই একটা বস্তুগত সীমাবদ্ধতা জ্বলজ্বল করে। তাই ১৯৭০-এর ১লা জানুয়ারি কে প্রথম স্থানে বসিয়ে সেকেন্ডের পিঠে সেকেন্ড যোগ করে সংখ্যাসীমা অন্তর্গত সময়ের অনুবাদ করে কম্পিউটার।

২০৩৮ সালের ১৭ই জানুয়ারির পর এই যোগফল, যন্ত্র-সামর্থের দেওয়াল অতিক্রম করে যাবে। তারপর ? এই প্রশ্ন চিহ্নের নাম ‘ Y2K38 বাগ ’।

৯৯৯৯ সালের পর ১০০০০ সালের নথিকরণ সমস্যার নাম ‘Y10k প্রবলেম‘।

আমেরিকায় কর্মরত এক প্রযুক্তিবিদের মতে “ আমারা বারবার এরকম সমস্যার সম্মুখীন হব। এবং এভাবেই আরও নতুন বাণিজ্যিক দিক খুলে যাবে । বাজারের গর্তে বাজার নির্মান, এটাই বাজার-সক্রিয়তার সংজ্ঞা। ”

কঠিন উত্তরের উপেক্ষায় এমন অবান্তর ওয়ান-লাইনার অতি সহজেই অকাট্য। শুধু বাজার নয়, প্রগতির উদ্দেশ্যেও এরকম পণ্যপায়ী মন্তব্যের ব্যবহার আমরা উদগ্রে গ্রহণ করে থাকি। যেমন – “স্থিতির সার্থকতা কেবল পরিবর্তনশীলতায়”। নিজেকে হজম করার মধ্যেই প্রকৃত পুষ্টি। মলিন বাস্তব দর্শনে ভার্চুয়্যাল-এর ঝকঝকে চশমা প্রয়োগ করেই এতটা পেশিপ্রধান ও চটকপ্রিয়, আমাদের অবচেতন।

ইউটোপিয়ার কল্পনায় যৌথ অবচেতনার এই উচ্ছিষ্ট, নিজের চরিত্র-সুলভ স্বাভাবিক নির্যাসে এরকম পরিচিত ওয়ান-লাইনার রচনা করে চলুক। সেটাই কাম্য। অন্যথায়, আনকোরা স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণ নিতান্তই ত্রুটি সাপেক্ষ।

প্রচ্ছদঃ সৈকত পালিত

*****