বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের প্রচলিত গতির বাঁকবদল দেবেশ রায়ের হাতে। তাঁর উপন্যাস রচনার কৃৎকৌশল অন্য আঙ্গিক এবং ভিন্ন বয়ান তৈরি করেছে। তিনি বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে বসে লিখছেন সত্তরের দশক ,আশির দশক ,নব্বই দশকের সমাজবাস্তবতা নিয়ে। বাংলা উপন্যাসের ঋতুবদল হচ্ছে তার হাত ধরে। নতুনের ডাক যখন আসে তা দশক শতকের বাধা মানে না। বাংলা কাব্য কবিতার ক্ষেত্রে যেটা ঘটে গেছে , উপন্যাসের ক্ষেত্রে তা হয়নি সোয়াশো বছরেও। তাঁর সমসাময়িক ঔপন্যাসিকদের থেকে তাঁকে স্বতন্ত্রভাবে চেনা যায় রচনা শৈলীর পার্থক্যে, বিষয় নির্বাচনের পৃথকতায়। আমরা লক্ষ্য করি কিভাবে তিনি প্রচলিত উপন্যাসের ধারা থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছেন , উপন্যাসের সার্বিক কাঠামো নিয়ে – অর্থাৎ আমাদের এতদিনের যে উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা তাতে আমরা দেখেছি যে বইয়ের পাতা যত উল্টেছে, কাহিনী তত খুলতে থাকে, ঔপন্যাসিক চরিত্রগুলোর জীবনের একটা নির্দিষ্ট সময়কে নির্বাচন করেন ও তার আবর্তন -বিবর্তন দেখান। তার একটা সুখকর বা দুখকর পরিণতি দেখান। দেবেশ রায় এই পথের পথিক নন। তাঁর উপন্যাস পড়তে গেলে দেখা যাবে ঔপন্যাসিক প্রায় গোটা উপন্যাসটিকে ন্যারেট করতে করতে হঠাৎ কাহিনীর গভীরে ঢুকছেন, সেখানে একটা চলমানতা রেখে আবার ফিরে আসছেন উপরিভাগে। একটা কাহিনী জন্ম দিচ্ছে আরো অনেক কাহিনীর। তিনি মূলত কথা বলছেন বর্ণনার মাধ্যমে, এবং সেটা গল্প বলার ভঙ্গিতে নয়, বর্ণনার মধ্য দিয়েই। লেখক নিজেই যেন সর্বজ্ঞ কথকের ভূমিকা পালন করছেন এবং উপন্যাসের চরিত্র হয়ে উঠছেন। তাঁর পরিচ্ছেদ নির্মাণের ক্ষেত্রে বঙ্কিমী সাদৃশ্য লক্ষণীয়। বঙ্কিমের মতই তিনি প্রতিটি পরিচ্ছেদের আলাদা নামকরণ করেছেন , কিন্তু পাঠকের সাথে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে বঙ্কিমকেও অতিক্রম করে গেছেন। তার কারণ, বঙ্কিম চরিত্রের কথা বলার মধ্যে সামান্য একটু সংযোগ স্থাপন করেন, কিন্তু দেবেশ রায় সম্পূর্ণ একটি আলাদা পরিচ্ছেদ নির্মাণ করেন এবং তার নামকরণ করেন এরকম – ‘পাঠকের কাছে নিবেদন ‘বা ‘লেখকের স্বীকারোক্তি’ । এ তো বাংলা উপন্যাসে একেবারে নতুন আর ব্যতিক্রম । তাঁর উপন্যাসের দৃশ্য বর্ণনা ভীষণ নিখুঁত এবং নিপুণ। যেন ক্যামেরাকে ক্লোজ আপে রেখে একটা একটা করে জিনিস দেখানো। এর মধ্যে দিয়ে যে জিনিসটা বলতে চাইছি সেটা হলো – এই সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে সময়টা যাচ্ছে বেশি, কারণ তাঁর উপন্যাসের চরিত্র তো আর নিজের স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে উঠছে না , চরিত্রগুলি পুরোটাই লেখকের বর্ণনা দ্বারা গড়ে উঠছে, ফলে যে কোনো ঘটনাই অতিরিক্ত বিস্তৃত হচ্ছে । কোথাও এক লাইনের বক্তব্যকে আলাদা আলাদা ভাবে বর্ণনাবহুল বাক্যে প্রেজেন্ট করছেন । Same structure – এর এতোবার প্রয়োগ এবং এতো কনফিডেনসের সাথে এর আগে দেখা যায় নি। বাক্য নির্মাণের এই কৌশলগুলো দেখে মনে হয় পাঠকের মতিভ্রম করার একটা সচেতন প্রচেষ্টা রয়েছে। এই প্রয়োগকৌশলের ফলে পাঠকের অধৈর্য বুড়িয়ে উঠতে চেষ্টা করে। তবে সবকিছুর মধ্যে একটা পাগলাটে নতুনত্ব আছে। বাক্যের গড়নের মধ্যে রয়েছে একটা আশ্চর্য বলিষ্ঠতা। একটা বাক্যে অনেক সময় দু তিনটি ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ক্রিয়াপদগুলি পরপর ব্যবহৃত হচ্ছে আর তাতে করে লেখায় আসছে একটা গতিময়তা। আবার অনেকক্ষেত্রে মনে হতে পারে বর্ণনাকর্তা গোটা ঘটনা থেকে এত শক পেয়েছেন যে, হয়তো বারবার এক কথা বলার মধ্য দিয়ে চরিত্রের বিকৃতির প্রকাশ ঘটাচ্ছেন।উপন্যাস পাঠ করে পাঠকের মনে হয়না যে উপন্যাস শেষ হয়ে গেলো। একটা গতিময়তা থাকবে, কাজ করবে ইতিহাসের চলন। মনে হবে উপন্যাসে বর্ণিত কাহিনী আগেই ঘটে গেছে। তিনি নতুন কোনো গল্প শোনাচ্ছেন না বরং সেই ঘটে যাওয়া কাহিনী বর্ণনার মধ্যে দিয়ে নির্মাণ করছেন গবেষণার সন্দর্ভ। প্রশ্ন করছেন রাষ্ট্র – প্রগতি – ইতিহাসকে। যুক্তির উপর যুক্তি সাজিয়ে উত্তর নির্মাণ করছেন, আর প্রশ্ন রেখে যাচ্ছেন উত্তরপ্রজন্মের কাছে। তাঁর কালচেতনায় ইতিহাস-বর্তমান-ভবিষ্যৎ মিশে যাচ্ছে গতিশীলতার মধ্য দিয়ে । দেবেশ রায় ইতিহাসের তন্নিষ্ঠ পাঠক, তাই তাঁর লেখনী অন্যতর এক বোধ সংক্রামিত করে পাঠকের মধ্যে ; পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসের সরলরৈখিক প্রগতিকে তিনি অস্বীকার করেন। তাই তো কি এক অনিবার্য তাড়নায় বিংশ শতকের শেষ দশকে লেখা এক উপন্যাসে তিনি ফিরে যান সত্তর দশকের সেই আগুনঝরা দিনগুলিতে। বিশ্বনাথ চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে উঠে আসে একটা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ইতিহাস। সেই রাজনৈতিক ইতিহাস আজ স্মৃতি কিন্তু বিদ্রোহের আঘাত এখনো শেষ হয়নি। যে ইতিহাস বারবার ফিরে আসে প্রতিরোধের স্পর্ধা হয়ে। রাষ্ট্রের নির্মমতার ইতিহাস যেমন সত্যি, মানুষের প্রতিরোধের ইতিহাসও তো চিরকালীন। যে ইতিহাসের নাগরিক মুক্তকন্ঠে বলে ওঠে – ‘ এই সংবিধান মানি না , এই রাষ্ট্র মানি না ‘। রাষ্ট্র মরিয়া হয়ে উঠলে শুরু হয় সাংবিধানিক নিগ্রহ। সেই নিগ্রহের সময়ের বৃত্ত শুরু হয় নকশাল আন্দোলনে এবং সম্পূর্ণ হয় শিল্পায়নকে কেন্দ্র করে মফস্বলের মানুষের এক অনিবার্য প্রতিরোধের কাহিনীতে (পাড়ারিয়া ধর্ষণকান্ড আর পুনাসি বাঁধ নির্মাণ) দুটো ঘটনার মধ্যে সাযুজ্য রক্ষিত হয়েছে সংবিধানের ছিদ্রপথে। গণতন্ত্রের পুলিশ সংবিধানকে লোপাট করে দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রর যে ভয়াল রূপচ্ছবি ফুটে উঠেছে এই আখ্যানে , আজকে দাঁড়িয়ে তার প্রাসঙ্গিকতা নতুন করে বলে দিতে হয়না। তিনি উপন্যাসে সময়ের দুটি মুখশ্রী নির্মাণ করেছেন। একটা শিল্পায়নকে কেন্দ্র করে নদীমাতৃক অরণ্যসংকুল জীবনযাত্রা বদলের আত্মসংকট , তার সাথে শিল্পায়নের নিগ্ৰহ- প্রান্তশায়ী জনজাতির গণঅভিমুখের অবয়ব বদল আর তার বিপরীতে নগরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা। ‘ইতিহাসের লোকজন’ উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্র – অধ্যাপক সৌরাংশু ও তার গবেষকছাত্রী শমিতা তাদের গবেষণার মধ্য দিয়ে শহরের কলোনি বা বস্তিবাসীদের জীবনযাত্রার সংকট উন্মোচন করেছেন। সোভিয়েত উত্তরকালে সারা পৃথিবীব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতনে মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ সৌরাংশু আজ অবলম্বনহীন । ‘..শ্লেষে, আত্মপীড়নে অধীত বিদ্যাকে উল্টেপাল্টে, নিজের জ্ঞানতত্ত্বকে ঠাট্টাবিদ্রূপে টুকরো-টুকরো করে, নিজের আস্তিক্যকে পরিহাসে-পরিহাসে বিপর্যস্ত করে’ সৌরাংশু নিজেই নিজের সাথে সংলাপ চালান। আর শমিতার গবেষণার ফাইল দেখতে দেখতে সৌরাংশু উপলব্ধি করেন – ‘ .. তাঁর, তাঁদের সমস্ত মার্ক্সবাদচর্চা ভারতীয় ধনতন্ত্রের সংকটকালীন আত্মসমালোচনা। ভারতীয় ধনতন্ত্রও ধনতন্ত্রই। ভারতীয় বলে সে কিছু আধ্যাত্মিক নয়, সে উৎপাদনকে কিছু কম বিমূর্ত করে তোলে না , সে কিছু কম তৎপর নয়। বরং যেনো প্রাক্তন উপনিবেশের ধনতন্ত্র বলে সে কিছু অতিরিক্ত লাম্পট্যের সুযোগ পেয়েছে। আর সেই লাম্পট্য সত্ত্বেও ধনতন্ত্রের নিয়মেই ভারতীয় ধনতন্ত্র সমস্ত কিছুকে গ্রাস করে নিতে পেরেছে। মার্ক্সবাদকেও।’ শমিতার গবেষণার বিষয় সেই কাজের মেয়েটিকে কেন্দ্র করে তারা তর্ক চালান – “..’ …কিন্তু আপনি যে রকম বলছিলেন মেয়েটি ইকোনমিক ম্যানের ধারণাটাই প্রত্যাখ্যান করছে, তাও হয়তো নয়।” নয়ই ত। এই কথাটাই তো আমরা ভুলে থাকি। ধনতন্ত্রের অপ্রতিহত যাত্রা সত্ত্বেও লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি মানুষের মধ্যে প্রাকধনতন্ত্রের সব বন্ধন, মনের বা কাজের, ঘুচে যায়নি, যাবে না। হয়ত এটা কলোনিবিস্তারের পর্বের পক্ষে সম্ভবও ছিলনা । …..মুশকিলটা কি জানো শমিতা? পুঁজি জমালেই ত আর ধনতন্ত্র হয়না, পুঁজি না জমালেও সমাজতন্ত্র হয় না। আমাদের দেশে গত চল্লিশ বছরে জনসংখ্যার মাত্র তিরিশ শতাংশকে ধনতন্ত্রের কব্জায় আনা গেছে । বাকি সত্তর শতাংশ , এখন ধরতে পারো সত্তর কোটি মানুষ ই, এই সবকিছুর আওতার বাইরে। কিন্তু মজাটা হচ্ছে ভারতবর্ষের জনসংখ্যার এই তিরিশ শতাংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বা সোভিয়েত ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। আর তাতেই তো তোমার ধনতন্ত্র যে ধনতন্ত্রই তা স্বীকৃত হয়ে যায়। এ সবই ত আসে ঐ একটা চিন্তা থেকে – মানুষের ইতিহাসে ধনতন্ত্র একটা অনন্ত শক্তি। এই ধারণা থেকেই তৈরি হয়েছে – টেকনোলজির আর আর্থিক উন্নয়নের ধারণা। অথচ মার্ক্স তাঁর ক্রিটিকে ইতিহাসে ধনতন্ত্রের স্থায়িত্বের ধারণাটাকেই সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করলেন। ‘…”পাঠক হিসেবে আমরা বুঝে উঠতে শুরু করি যে আস্তিক্য আর জ্ঞানতত্ত্ব সৌরাংশুর ব্যক্তিত্বের ওতপ্রোত উপাদান সেই বিশ্বাসে তিনি স্থিত থাকতে পারছেন না। কারণ ধনতন্ত্র নিজেকে সঙ্কটমুক্ত করতে সক্ষম এই সত্যের পাশাপাশি তাঁকে এ কথাও মেনে নিতে হচ্ছে -‘ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু।’ সমগ্ৰ উপন্যাস জুড়ে এই টানাপোড়েন চলতে থাকে ; লেখক প্রশ্ন তোলেন – ‘সৌরাংশু তাঁর আস্তিক্য আর জ্ঞানতত্ত্বের বিপরীতের সঙ্গে নিজের সারাটা যাপিত জীবনকে মেলাবেন কী করে? ‘ মনে হয় এ যেন লেখকেরও আত্মজিজ্ঞাসা। ‘তিস্তাপুরাণ’ উপন্যাসের বুনন বাংলাসাহিত্যে এক মৌলিক ব্যতিক্রম। এই উপন্যাস প্রচলিত উপন্যাসের গড়নশৈলী ভেঙে নির্মাণ করে টুকরো টুকরো অধ্যায় । কি নাম দেব একে? – পরিচ্ছেদ নাকি অধ্যায় ! উপন্যাসের সূচনা হয় ‘ বুড়িমা ‘ নামক পরিচ্ছদের মাধ্যমে । আশ্চর্য এই যে এই অংশে বুড়িমার চরিত্র বর্ণনা অনধিক দুই লাইন – বাকিটা লেখক নির্মাণ করেন প্রকৃতি দিয়ে এবং বুড়িমাকে বর্তমান থেকে ইতিহাসে নিয়ে যান। ঘটনাক্রম এগোয় আর বুড়িমা সাধারণ মানবী থেকে অলৌকিক হয়ে ওঠেন । বুড়িমা আদিম জনজাতির প্রণেতা । প্রকৃতির সাথে সেইসব মানুষের মিথোজীবিতা সুপ্রাচীন – যেন এরা প্রকৃতিমানুষ। যেখানে পুরাণকন্যা , পুরাণপুরুষের মতো মিথের নবজন্মের আশা বেড়ে ওঠে।তাঁর উপন্যাস আসলে অরণ্যসংকুল বা নদীতটবর্তী জীবনযাপন বদলের পথ । আধুনিক প্রযুক্তি গিলে নিচ্ছে সেই আদিম সভ্যতাকে। মানবজাতির এক দীর্ঘ পরিবর্তনের ইতিহাসকে ধরছে ‘তিস্তাপুরাণ’। তিস্তার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে ভূমিজ অধিবাসীদের যে যৌথযাপন, তাতে কোথাও ব্যক্তিমালিকানার স্থান ছিলনা। কিন্তু সেই অঞ্চলে ঝান্ডা বসিয়ে জমি জরিপ হলো, কালো রাস্তা , স্কুল, চাষবাসের উন্নত যন্ত্রপাতি আর তিস্তার বুক চিরে লোহার ব্রীজ – সব মিলিয়ে প্রযুক্তি মুছে দিলো আদিমতার গন্ধ , যৌথযাপনের ইতিহাস, শুধু আদিম সত্তার সেই আকুতিটুকু স্মৃতি হয়ে রয়ে গেল যা হয়তো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রূপকথা হয়ে ধরা দেবে – হয়তো আধুনিকতার আলোকপ্রাপ্তি তাকে মিথে পরিণত করবে। ইতিহাস বড় নির্মম। এই ঘটনাগুলি থেকে বোঝা যায় ভারতবর্ষ যে খন্ড খন্ড হয়ে শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে – দেবেশ রায় তাঁর লেখায় সেই নির্মমতার ইঙ্গিত রেখে যাচ্ছেন। তাঁর ৯০’ র দশকের উপন্যাসগুলিতে তথাকথিত নায়ক নির্মাণ নেই বললেই চলে, আর যেটুকু নায়ক নির্মাণের প্রসঙ্গ এসেছে তার একটা আলাদা ভাষ্য রয়েছে । ‘সময় -অসময়ের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসে কেলু চরিত্রটি বাস্তবতারহিত হয়ে প্রায় নায়ক হয়ে উঠছিল। বাকি আখ্যানগুলির সাথে তার সংযোগস্থাপন প্রায় অলৌকিক। কেলু্ উদাসীন, আধপাগলা এক চরিত্র – সে গণস্মৃতির আধার। তাকে নিয়েই লেখক রচনা করলেন প্রায় তিনখানা আখ্যান। ধর্ষণের ঘটনার পরে কেলুর নিজেকে আবিষ্কারের যাত্রা শুরু। কুশলী দক্ষতায় লেখক আঁকছেন- কেলুর মধ্যে গড়ে উঠছে শহুরে জীবনবোধ , খিদের বোধ। তার বাঁচার তীব্র আশা থেকে মৃত্যু পরিকল্পনা , সন্ন্যাসীর শিষ্য হওয়া – এই অংশে তার চেতনার বহিঃপ্রকাশ একরকম । এরপর শুরু হয় কেলুর জীবনে নতুন অধ্যায়। কেলু সভ্য নাগরিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। এই প্রথম কেলু সভ্য সমাজের খিদের সংযত রূপটা খানিক বুঝতে পারছে , তার নিজের চোখ দিয়েই কেলু কলকাতাকে আবিষ্কার করছে। লেখক যেন অঙ্ক কষে কেলুর জন্ম , মৃত্যু এবং যাপনের নিয়ন্ত্রণকর্তা হয়ে উঠছেন। পাঠকের সামনেই চরিত্রের জন্ম – মৃত্যু এবং বাঁচবার সীমারেখা নিয়ন্ত্রণ আর পাঠকের সাথে যৌক্তিক ভাবে আলোচনা করেই চরিত্রের পরিণতির সিদ্ধান্ত – যেন এটা উপন্যাস নয় , লেখক আর পাঠকের মধ্যে ঘটে চলা নিরন্তর মিথষ্ক্রিয়া। এখানেই দেবেশ রায় অনন্যপূর্ব ; দেবেশ রায় দেবেশ রায় ই। তাঁর উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলিতে আঞ্চলিক ভাষা বিশেষত রাজবংশী উপভাষার প্রভাব লক্ষণীয়। যেসব জনজাতির মুখে তিনি এই ভাষা বসিয়েছেন তাদের কাছে জীবনসংগ্ৰামের চেহারাটাই অন্যরকম। ‘ইতিহাসের লোকজন’ উপন্যাসের ঠিকের কাজ করা অশিক্ষিত মহিলাটি এটা পর্যন্ত জানে না সে কোথায় বাস করে, কোন ভূখন্ড থেকে উৎখাত হয়ে সে আজ কলকাতার উদ্বাস্তু ! সে শুধু জানে তার কাজের রেট । কলকাতাই তার বিলেত , প্যান্ট-শার্ট পরা কলকাতার বাবুরা তার বিলেতের বাবু। সে জানেনা তার নিজের বয়স, তার বিয়ে, এমনকি তার সন্তানদের বয়স ! হয়তো জানতে চায়নি , জোর করে ভুলে গেছে তার অপ্রয়োজনীয় অতীতকে। প্রত্যাখান করেছে স্মৃতিকে, ইতিহাসকে । নামগোত্রহীন এই মহিলা আর ‘তিস্তাপুরাণে’র পুরাণকন্যা , পুরাণপুরুষেরা ভানুমতীর মতই জানেনা ভারতবর্ষ কোনদিকে ! জন্মান্তর পেরিয়ে কেলুর মত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হাঁটতে হাঁটতে এরা হঠাৎই আবিষ্কার করে প্রগতিশীল ভারতরাষ্ট্রে তাদের ঠাঁই নেই। তারা সর্বহারা নয় – সর্বস্বহারা। দেবেশ রায়ের উপন্যাসের স্বতন্ত্রতা তার আঙ্গিকের অভিনবত্ব আর আখ্যান জুড়ে ঘটে চলা নির্মাণ – বিনির্মাণ। চরিত্রসৃষ্টির ক্ষেত্রে লেখক নির্মাণ থেকে বিনির্মাণ আবার বিনির্মাণ থেকে নির্মাণের পথে যাত্রা করেছেন। নির্মাণ বিনির্মাণের মধ্যে যে গতিময়তার প্রবাহ তাকেই তিনি ধরেছেন, ছেড়েছেন আবার নিজের খেয়ালে ভেঙেছেন । এই দুইয়ের মধ্যবর্তীকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়েছেন চরিত্রগুলিকে। তাই তিনি শুধুমাত্র একজন ঔপন্যাসিক নন – তিনি একজন তত্ত্বনির্মাতা। তাঁর সারাজীবনের সন্ধান ছিল এক ভারতীয় আখ্যানরীতির , যে আখ্যানের শিকড় পৌঁছে যাবে আমাদের ভারতীয় চৈতন্যের গহনে । তাঁর নিজের ভাষাতেই -” …সারা পৃথিবীর মধ্যে আমাদের এই বাংলার উপর দিয়েই বয়ে যায় রহস্যময় এক সামুদ্রিক বাতাস তার নাম মৌসুমী বায়ু । অথচ আমাদের উপন্যাসে সে-বিবরণ লেখা হল না – কোন খাত দিয়ে কী বাতাসে আমাদের গাছপালা দোলে। আর,এই নদী, এই বৃষ্টি, এই বাতাস, এই পাহাড়, এই সমতল আর এই সমুদ্রকে অন্বিত করে যে-মানুষ সে তার নিজের বাঁচার কাহিনী নিয়ে আমাদের উপন্যাসে এল না। আমরা উপন্যাসে কাহিনী খুঁজেছিলাম, কাহিনীর সেই মায়ামৃগ আত্মপরিচয় থেকে আমাদের আরো দূরে দূরে সরিয়ে এনেছে। বাংলার গল্প- উপন্যাসের আধুনিকতা তাই এখনো তাত্ত্বিক তর্কের বিষয়। শ্বাসেপ্রশ্বাসে , ঘামে রক্তে , প্রতিমুহূর্তের স্বকীয় বাঁচার কঠিন আনন্দে স্পন্দ্যমান সেই আধুনিক মানুষ আমাদের উপন্যাসে তার মহিমময় বাঁচা নিয়ে এসে দাঁড়ায় নি যে তার দিকে তাকানো মাত্র সব তত্ত্ব অবান্তর হয়ে যাবে ।” (১৯৮৮, ‘উপন্যাস নিয়ে’)এভাবেই দেবেশ রায় এক আশ্চর্য মানবিক আলো জাগিয়ে রাখেন শেষাবধি। তাঁর তত্ত্বনির্মাণ বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে এক অন্য আধুনিকতার ঐতিহ্যের পত্তন ঘটায়। আর তাই বিশ শতকের শেষ দশকের রচনায় ঔপন্যাসিক দেবেশ রায় হয়ে ওঠেন বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের আঙ্গিকের নতুন মডেল।
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী
****