আমার এক মনোবিদের বাড়ির দেওয়ালে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের একটা ছবি ঝুলতো। আইকনিক ফটো- ফুল স্যুট, কপালে ভ্রুকুটি, ঠোঁটে অর্ধেক জ্বলা সিগার। ছবির নীচে ফ্রয়েডেরই স্বাক্ষর। ছবিটা তিনি উপহার পেয়েছিলেন লোক ঠকানো ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া তাঁর এক প্রাক্তন রুগীর কাছ থেকে। একদিন থেরাপি চলাকালীন আমি সেই মনোবিদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তিনি ফ্রয়েডের তত্ত্ব নিয়ে কি ভাবেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- ‘ওঁর তত্ত্বকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না।’
তাঁর এই উপেক্ষা খুব আশ্চর্যজনক ছিল না। যেদিক থেকেই দেখি না কেন, এ’কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ফ্রয়েড ছিলেন উনিশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী চিন্তাবিদ। ১৯৩৯-এ তাঁর মৃত্যুর পর ব্রিটিশ লেখক ডব্লিউ এইচ অডেন ‘সিগমুন্ড ফ্রয়েডের স্মৃতিতে’ (‘In Memory of Sigmund Freud’) নামে একটি কবিতায় লেখেন যে ফ্রয়েডই নিয়ে এসেছিলেন ‘নতুন মতামত বেড়ে ওঠার এক আদর্শ জলবায়ু’। তারপর পরবর্তী দুই দশক ধরে চলেছিল মনোসমীক্ষার প্রবল জনপ্রিয়তা। সেই জনপ্রিয়তা ঝিমিয়ে পড়ে একসময়। অ্যাকাডেমিক বিদ্যাচর্চার বাইরে যাঁরাই এবিষয়ে ভেবেছেন তাঁদের কাছে মনোসমীক্ষা ছিল বর্ণবাদ বা সম্মোহনবিদ্যার মতোই মনোবিজ্ঞানের এক পরিত্যাজ্য প্রয়াস। মায়ের প্রতি ছেলেদের আসক্তি, মেয়েদের পুরুষাঙ্গের অভাবযন্ত্রণা- এইসব একাধারে উৎকট ও হাস্যকর ধারণাগুলোই জনমানসে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করতো।
ঠিক কি কারণে ফ্রয়েডের গ্রহণযোগ্যতা কমে এসেছিলো? ১৯৯৬-এ টম ওলফ লিখেছিলেন- ‘ফ্রয়েডবাদের পতনের কারণ একটি শব্দে ব্যাখ্যা করা যায়- লিথিয়াম।’ এই আমেরিকান লেখক আমাদের দেখান ১৯৫০-র প্রথম দিকে দীর্ঘ সময় ধরে মনোসমীক্ষার অসাড় প্রয়োগের পর কিভাবে বাইপোলার ডিসওর্ডারে আক্রান্ত রুগীদের দ্রুত উপশম এনে দিয়েছিলো সদ্য বাজারে আসা ওষুধ (পিল)। তাঁর উদাহরণটি আরও বৃহত্তর চালচিত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আধুনিক নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞানের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই ধীরে ধীরে মনোসমীক্ষার বৈজ্ঞানিক ধারাটি শীর্ণ হয়ে পড়ে। স্নায়ুবিজ্ঞানের ফিজিকালিস্ট অভিমুখ মনোচিকিৎসার (সাইকিয়াট্রি) মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠল। আজকে প্রায় যেকোন মানুষ সেরেটোনিন, ডোপামিন বা প্রোজাক কি সেবিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারবেন। অন্যদিকে খুব কম জনই হয়ত প্রাইমাল সিন বা সুপার ইগোর সংজ্ঞা দিতে সফল হবেন। আমেরিকান লেখক সিরি হাস্টভেট তাঁর বই ‘দ্য সেকিং উইম্যান’ বা ‘এ হিস্টরি অফ মাই নার্ভস’-এ লিখেছেন যে এখন বেশিরভাগ মানুষের চোখে ফ্রয়েড হলেন ‘একজন অতীন্দ্রিয়সাধক (মিস্টিক) যাঁর চিন্তা ও মতবাদের সাথে প্রাকৃতিক বাস্তবতার কোন যোগ নেই, যিনি তাঁর ভিত্তিহীন ভাবনার বীজ মানুষের মনে প্রোথিত করে আধুনিক ভাবধারাকে বিপথে চালিত করেছিলেন। বিপুল সংখ্যক সরল হুজুগে মানুষ এইসব আজগুবি তত্ত্বে বিশ্বাস রেখেছেন, আজও হয়তো তাই চলতো যদি না ফার্মাকোলজির হাত ধরে আধুনিক মনোচিকিৎসার প্রতিষ্ঠা ফ্রয়েডিয়ান তত্ত্ববিশ্বকে ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ করে ফেলতো।’
কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকদশকে এই দার্শনিক বৈরিতার ছবি কিছুটা বদলেছে। বছর কুড়ি আগে একটি নতুন বিষয়ের উদ্ভব ঘটেছে- যার আনুষ্ঠানিক নাম নিউরোসাইকোঅ্যানালিসিস বা স্নায়ুমনোসমীক্ষা। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন ইউনিভার্সিটির স্নায়ুমনোবিদ ও মনোসমীক্ষক মার্ক সোল্মসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নেওয়া এই গবেষণা প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে ফ্রয়েডের ভাবমূর্তি কিছুটা ফেরানোর চেষ্টা হয়। এই গবেষকরা আমাদের মনে করিয়ে দেন যে ফ্রয়েড একজন স্নায়ুবিদ হিসেবেই তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। প্রথম দুই দশক তিনি ‘হার্ড সায়েন্সের’ চর্চায় ব্যাপৃত ছিলেন। ১৮৯০-এর দশক থেকে তিনি যে শাস্ত্রটিকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন তা একদিন একটি ন্যাচারাল সায়েন্স হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে- এরকমই ইচ্ছা ও প্রত্যয় তাঁর ছিল। তিনি বারবার এই বিশ্বাসটি জোরের সঙ্গে বলেছেন যে একদিন নিশ্চয়ই মানুষের মস্তিষ্কের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক (এমপিরিকাল) ফলাফল তাঁর তত্ত্বকে শুধু সমর্থনই করবে না, আরও প্রসারিত করবে। স্নায়ুমনোসমীক্ষার চর্চার জন্য প্রতিষ্ঠিত অ্যাকাডেমিক জার্নালটির প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশ পায় ১৯৯৯ সালে। প্রথম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় তার এক বছর পর। তখন থেকে অনেক মনোসমীক্ষকই স্নায়ুবিজ্ঞানের দিকে ঝোঁকেন, দেখতে চান কিভাবে স্নায়ুবিজ্ঞান মনোসমীক্ষার তত্ত্বে সমর্থন ও সংযোজন ঘটায়। একইসাথে আন্তনিয় দামাসিও, জোসেফ লেডক্স, জাক প্যাঙ্কসেপ, ভি এস রামাচন্দ্রন এবং সর্বোপরি এরিক ক্যান্ডেলের মত স্নায়ুবিজ্ঞানীরা এবিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন।
লিথিয়ামের সূচনাই ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের সমাপ্তিফলক বলে দাবি করে ওলফ কি তাহলে ভুল করেছিলেন? মনোসমীক্ষকের কাউচ এবং মস্তিষ্কের স্ক্যানার কি একে অপরের সহযোগী হয়ে উঠতে পারে?
ফ্রয়েড মনে করতেন মানবেতিহাসের ধারায় নির্বোধ আত্মপ্রেমে মগ্ন হয়ে মানবসভ্যতা তিনটি ঐতিহাসিক ভুল করে। প্রথম ভুলটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন কোপার্নিকাস, যিনি মানবসভ্যতার দৃঢ় বিশ্বাস ভেঙে দেখিয়েছিলেন পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে- অর্থাৎ জগতের সবকিছু আমাদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে না। দ্বিতীয় ভুলটি ভেঙেছিলেন চার্লস ডারউইন যিনি তাঁর বিবর্তনের তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছিলেন যে আর পাঁচটা পশুপাখির মতোই মানুষের উদ্ভব হয়েছে বিবর্তনের ধারায়- তার অস্বিত্বের পৃথক বা একক কোন জন্মবৃত্তান্ত নেই। শেষ ভুলটি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেন ফ্রয়েড স্বয়ং- তিনি দেখান ‘মানুষ এমনকি তার নিজের ঘরেও প্রভু নয়’- অচেতন মনের হাতে এক পুতুলমাত্র। সেদিক থেকে ভাবলে স্নায়ুবিজ্ঞান ফ্রয়েডের এই ধারণায় সম্মতিই দিয়েছে। গভীর অচেতন মনের উপস্থিতির ধারণায় সিলমোহর বসিয়েছে এমআরআই স্ক্যানারের নৈর্ব্যক্তিক অনুসন্ধানের ফলাফল।
নোবেলবিজয়ী স্নায়ুবিজ্ঞানী ক্যান্ডেল হলেন স্নায়ুমনোসমীক্ষার সবচেয়ে বিখ্যাত সমর্থক। ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘The Age of Insight’ বইতে তিনি ফ্রয়েডের প্রতিধ্বনি করে লেখেন ‘যেকোন মুহূর্তে আমাদের মানসিক কর্মকান্ডের বেশিরভাগটাই, বিশেষত আবেগনির্ভর যাপনের সিংহভাগই আমাদের চেতনার বৃত্তের বাইরে অনুষ্ঠিত হয়’। ফ্রয়েডের আরও দুটি বড় ধারণার সমর্থন তাঁর লেখা থেকে পাওয়া যায়। তিনি লেখেন, ‘খাওয়ার বা জলপান করার প্রবৃত্তির মতোই আক্রমণাত্মক হওয়ার প্রবৃত্তি ও যৌন তাড়নার প্রবৃত্তি আমাদের মানসিক গঠনের অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ জিনবাহিত’। দ্বিতীয়ত, ‘আমাদের মানসিক সুস্থতা ও অসুস্থতা কোন বাইনারি নয় বরং এক নিরবিচ্ছিন্ন বিস্তারের (কন্টিনিউয়াম) অংশ।’
এছাড়াও আরও কিছু দিক থেকে মনোসমীক্ষার তাত্ত্বিক সমর্থন আসে, বিশেষত নতুন গবেষণার মাধ্যমে স্মৃতি সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধিটি বেড়ে ওঠার ফলে। In the Mind Fields (2015) গ্রন্থে কেসি শোয়ার্টজ মেমরি-কনসলিডেশন সম্পর্কিত আধুনিক গবেষণার উল্লেখ করে বলেন যে দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি সময়ের সাথে কখনও কখনও বদলে যেতে পারে- ঠিক যেরকম ফ্রয়েড ধারণা করেছিলেন যে ‘স্মৃতি স্বভাবত পরিবর্তনশীল’। অবদমন সম্পর্কে মনোসমীক্ষার তত্ত্ব অনুসারে সচেতন মন লজ্জাজনক আপত্তিজনক ভাবনাগুলো অবদমন করে অবচেতনের স্তরে পাঠিয়ে দেয়। ধারণাটিকে প্রাথমিকভাবে ফ্রয়েডের কষ্ট-কল্পনা বলে মনে হলেও অন্তত আংশিকভাবে তা আধুনিক মস্তিষ্কবিজ্ঞানের সমর্থন পেয়ে যায়। যখন মানুষ ভয়ানক পীড়ন-অভিজ্ঞতার (স্ট্রেস) মধ্যে দিয়ে যায় তখন অভিজ্ঞতাটি মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসকে* সম্পূর্ণ এড়িয়ে অ্যামিগডালায় নথিভুক্ত হয়- যার ফলে জোসেফ লেদো-কথিত (‘Psychoanalytic Theory: Clues from the Brain’ (1999)) ‘অচেতন স্মৃতি’ তৈরি হয়।
[অনুবাদকের নোটঃ হিপোক্যাম্পাস- মস্তিষ্কের যে অংশে মানুষের স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি নথিভুক্ত হয়। অ্যামিগডালা- মস্তিষ্কের যে অংশ আপদকালীন ‘ফ্লাইট অর ফাইট’ প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করে।]
একইসাথে এটাও বলা জরুরি যে ফ্রয়েডের সব ধারণাই যে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা অনুমোদন করেন এমনটা মোটেই সত্য নয়। অনেক রঙিন চমকপ্রদ ধারণার ক্ষেত্রেই ফ্রয়েড সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। খুব কম বিজ্ঞানীই আজ ইডিপাস কমপ্লেক্সের ধারণায় বিশ্বাস করেন যেখানে মায়ের প্রতি সন্তানদের সুপ্ত যৌন বাসনার হাস্যকর তত্ত্ব খাড়া করা হয়েছিল। কোন সিরিয়াস মনোবিদই তাঁর সাইকোসেক্সুয়াল বিকাশের পর্যায়গুলিকে (stages of psychosexual development) অনুমোদন করেন না যেখানে জীবৎকালে একজন মানুষের লিবিডো শৈশবে মুখগহ্বর-নির্ভর (oral) ও বয়সের সাথে পর্যায়ক্রমে সরে অবশেষে যৌনাঙ্গনির্ভর (genital) হয়ে ওঠে। এসব ছাড়াও আরও মৌলিক বিষয়েও আপত্তি উঠেছে। মনোসমীক্ষার একটি মূল মতবাদ হল ‘মানসিক নির্ধারণবাদ’ (psychic determinism) – যে ধারণা অনুসারে যেকোন মানসিক প্রক্রিয়া ও মৌখিক প্রকাশেরই (তা সে যতই তুচ্ছ, বিক্ষিপ্ত বলে মনে হোক না কেন) কোন না কোন গূঢ় অর্থ আছে।
অন্যদিকে আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানে মনে করা হয় আমাদের ভাবনাচিন্তার সিংহভাগই স্বল্পস্থায়ী চৈতন্য ও উপলব্ধি-সঞ্জাত মানসিক আবর্জনা ছাড়া আর কিছু নয়। ফ্রয়েডীয় স্খলন* (Freudian slip) হয়ে ওঠে একরকম রসিকতা যা মূলত ব্যঙ্গ বা খুনসুটি করার জন্যই অধিকাংশ সময়ে ব্যবহৃত হয়। *[অনুবাদকের নোটঃ ফ্রয়েডীয় স্খলন- কোন অনিচ্ছাকৃত ভ্রান্তিকে যখন অবচেতনের কোন অবদমিত অনুভূতির প্রকাশ বলে মনে করা হয় তখন তাকে ফ্রয়েডীয় স্খলন বলে।] একইভাবে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের আরেকটি কেন্দ্রীয় ধারণা হল ‘প্রতিটি স্বপ্নের মধ্যেই একটি তাৎপর্যমন্ডিত মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো আছে’। এই ধারণাটি নিয়েও কঠিনভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। জে অ্যালান হবসন, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এমেরিটাস অধ্যাপক এবং অন্যান্য আরও অনেকে দশকের পর দশক ধরে বলে বলে আসছেন যে স্বপ্ন আসলে কিছু বিক্ষিপ্ত ছবি ও এলোমেলোভাবে তৈরি হওয়া গল্পগাছা। এর সাথে অচেতন মনের লুকানো কোন সত্য বা গোপন ইচ্ছেপূরণের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।
ফ্রয়েডকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিচার করার ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হল তিনি প্রায়শই তাঁর মতবাদ ও তত্ত্বগুলি ব্যক্ত করেছেন একজন দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক সমালোচক হিসেবে। ১৯৩০ সালে ফ্রয়েড লিখেছিলেন ‘Civilisation and its Discontents’। মানবসভ্যতা পারমাণবিক বোমার ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা চাক্ষুস করার ১৫ বছর আগে এই বইটিতে তিনি লেখেন- মানবসভ্যতা প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে এতদূর এগিয়ে গেছে যে শেষতম মানুষটি অবধি এরা একে অপরকে হত্যা করে যেতে পারে বিনা বাধায়। এই সত্যটি সম্পর্কে মানুষ অবহিত, আর এই জ্ঞানই তাদের বর্তমান অস্বস্তি, অশান্তি ও উদ্বেগের মূল কারণ।
ফ্রয়েডের এই ধারণাটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সমস্যা হল বৈজ্ঞানিক উপায়ে এর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয়। আমরা সারাদিন বসে ভেবে যেতে পারি ফ্রয়েড কোনখানে ঠিক ছিলেন আর কোনখানে ভুল, কিন্তু ল্যাবরেটরিতে মস্তিষ্কের রক্তসঞ্চালন পরীক্ষা করে যেরকম সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয় সেভাবে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারব না। এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে- যদিও স্নায়ুমনোসমীক্ষার ধারাটি স্নায়ুবিজ্ঞান এবং মনোসমীক্ষার গবেষণায় মিলের জায়গাগুলিকে তুলে ধরে শুরু হয়েছিল, বিষয়টি কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেনি। এই ধারার মূল স্রোতটি চলেছে আরও গভীরে। এর সমস্ত বিতর্কে, সমর্থন ও সমালোচনায় স্নায়ুমনোবিজ্ঞান আসলে দুটি মৌলিক চিন্তাধারার টানাপোড়েনটিকেই তুলে ধরেছে। প্রশ্নটি হল যে ‘চৈতন্যবান কর্তা’ হিসেবে এবং একটি ‘জটিল যন্ত্র’ হিসেবে মানুষের স্বরূপটি কেমন? আরও সহজভাবে বললে এই টানাপোড়েন মানুষকে দু’ভাবে দেখার পার্থক্য – মনের আলোকে এবং মস্তিষ্কের আলোকে।
আমরা মানসিক ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে যেভাবে ভাবি তার নিরিখেই নির্ধারিত হয় মানসিক ক্রিয়াকার্যের উন্নতিসাধনের পন্থাগুলি। নিওলিথিক যুগে মানুষ বিশ্বাস করত মানসিক ব্যাধির জন্ম হয় অশুভ আত্মার প্রভাবে। সেই বিশ্বাসের ফলেই অশুভ আত্মাকে বের করার জন্য তারা মাথায় ফুটো করত। মধ্যযুগে, বিষাদগ্রস্ততার (melancholic) কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হত কৃষ্ণপিত্তকে। ফলে রক্তমোক্ষণ, রেচক ওষুধ বা অনেকসময় ঝাড়ফুঁকের প্রচলন ছিল। একইভাবে মনোসমীক্ষার ক্ষেত্রেও মানসিক কার্যকারণগুলির ব্যাখ্যা এবং ব্যাধিমুক্তির ওষুধ ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। ফলে ফ্রয়েড যখন স্বল্প আলোকিত ঘরে কাউচের ওপর রোগীকে শুইয়ে তাদের শৈশবের বিশেষ ঘটনাগুলিকে নিয়ে কথা বলবেন তখন একই সঙ্গে তিনি মনের কাঠামোটি উন্মোচন করছেন এবং ব্যাধিমুক্তির পথটিকেও খুঁজছেন।
বহু পন্ডিত মনে করেন আজকের দিনে আমরা এক ‘স্নায়ুসংস্কৃতি’-র মধ্যে বাস করি। কি এই স্নায়ুসংস্কৃতি? বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফার্নান্দো ভিদাল সুন্দর করে বুঝিয়েছেন স্নায়ুসংস্কৃতির অর্থ। এটি জীবন সম্পর্কে এমন একটি ধারণা যেখানে মস্তিষ্ক আর ব্যক্তির একটি অঙ্গবিশেষ নয়, বরং মস্তিষ্কই ব্যক্তি হয়ে উঠেছে। ফলে আধুনিক মনস্তত্ত্ব বোঝা ও ব্যাধিমুক্তির পথ খোঁজার ক্ষেত্রে এক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থিতি সুস্পষ্ট। কোন বিষাদগ্রস্ত ব্যক্তিকে প্রোজাকের মতো Selective Serotonin Reuptake Inhibitor দেওয়া হয় কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে আনন্দ, দুঃখ, বিষাদের মতো আবেগগুলো আসলে সম্পূর্ণভাবে শারীরিক ও ভৌত ঘটনা। সেইকারণেই ভৌত বা রাসায়নিক উপায়েই এর প্রতিকার সম্ভব। রুগী তার রোগের চরিত্র বা কারণ সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করে তা বিবেচ্য হয় না। রোগমুক্তির কার্যকরী উপায়টি হল মানবদেহের জটিল মেশিনটাকে বোঝা এবং বাইরে থেকে তাকে প্রভাবিত করার রাস্তাটি ছকে ফেলা।
সাম্প্রতিক সময়ের ধর্মের পশ্চাদপসারণ থেকে শুরু করে ট্রান্সহিউম্যানিস্ট আন্দোলনের ধার্মিকতা – সবকিছুরই নেপথ্যে আছে মানুষ সম্পর্কে ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির এই ব্যাপক পরিবর্তন, জার্মানীর মেইনজ্ বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক থমাস মেটজিঙ্গারের ভাষায় ‘naturalistic turn in the human image’। মানুষকে মেশিন হিসেবে দেখার এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিই মনোসমীক্ষাকে উদ্ভট, অপরিণত এবং সম্ভবত অক্ষম শাস্ত্র বলে প্রতিপন্ন করে।
মনোসমীক্ষা সম্পর্কে এই উদাসীনতা যে শুধুমাত্র মনোচিকিৎসার দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রতিভাত হয় তাও কিন্তু নয়। আগে যাকে ‘টক থেরাপি’ বলা হত তার আধুনিক সংস্করণ হল cognitive behavioural therapy (CBT) – মনোবিজ্ঞানের আধুনিক সম্প্রসারণগুলির মধ্যে অন্যতম। এই থেরাপি পদ্ধতিগতভাবে কিন্তু একেবারেই ফ্রয়েডপন্থী নয়। আমার পুরোনো থেরাপিস্ট, যাঁর কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তিনি এই ধারাতেই বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ভদ্রমহিলা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, তাঁর সাহায্যেই আমি প্রবল যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- CBT-এর পদ্ধতি ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের মতো মানবমনের অন্ধকার অঞ্চলটিকে জরিপ করার কোন আধা-অতীন্দ্রিয় প্রচেষ্টা নয়। কারণ সেখানে মানসিক যন্ত্রণার বিষয় ও বৈশিষ্ট্যগুলিকে উপেক্ষা করা হয়। চারপাশের বাস্তবতা সম্পর্কে কিছু ভয়ানক ও করুণ ভাবনাকে সরলীকৃত করে শুধুমাত্র মাথার মধ্যে ক্রমাগত চলতে থাকা একটি ভ্রান্ত অ্যালগরিদম বা বারবার ঘুরতে থাকা বিষাক্ত গানের সুর হিসেবে দেখা হয়। রুগীর ভাবনায় যে শূন্যতা গ্রাস করেছে, যে শূন্যতা পরিব্যাপ্ত হয়েও অধরা থেকে যায়, মৃত্যু ছাড়া যার থেকে মুক্তির কোন পথ সে ভাবতে পারে না- সেই ভাবনাটির উপরেই বিধিসম্মত জোর দেওয়া হয়, কেন ভাবছে তার সুলুকসন্ধান করা হয় না। অর্থাৎ ক্ষতিকারক ভাবনার ধরনটিকে চিহ্নিত করে তাকে পালটে দিতে পারাটাই এই থেরাপির মূল লক্ষ্য। সেই দিক থেকে মনোসমীক্ষা যদি হয় খ্রিষ্টান স্বীকারোক্তিখানা তবে CBT হল অনেকটা ধ্যানের আসনের মতো। সেখানে আলোটা ফেলা হচ্ছে রুগী কিভাবে বিশেষ ভাবনাটিকে দেখছে বা তাড়িত হচ্ছে সেই দিকে, কিন্তু সেই ভাবনাগুলির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে বলা হচ্ছে না কিছুই।
ছবিটা মনোচিকিৎসার ক্ষেত্রে যেমন দৈনন্দিন জীবনেও খুব আলাদা নয়। আত্মানুসন্ধানে (Introspection) হাল আমলের মানুষের তেমন আগ্রহ নেই। প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই মানসিক উন্নতিসাধনের আধুনিক পন্থাগুলি শারীরবৃত্তীয় কার্যপ্রণালীর ওপর ভিত্তি করেই নির্ণীত হয়েছে। মানুষের রক্তমাংসের শরীরটারই সেখানে জয়জয়কার। আমরা সুখ-দুঃখকে বস্তুত মানসিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে না দেখে শারীরিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। একই কাজকে দেখার চশমাটা তাই বদলে যাচ্ছে। আগে যা ছিল নেহাত রোদে পিঠ দিয়ে বসা আজকে তাই হয়েছে ভিটামিন ডি বাড়িয়ে নেওয়ার উপায়। শরীরচর্চা করে উঠে আমরা ভাবছি বেশ কিছুটা এন্ডরফিন-ক্ষরণ হল। যদি আপনি ধ্যান (meditation) ও মননশীলতার (mindfulness) ভক্ত হয়ে থাকেন আপনি কি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন না যখন সন্ন্যাসীদের উপর পরীক্ষা করে fMRI মেশিন এসবের কার্যকারীতাকে প্রমাণ করে? আপনি হয়ত সালমন মাছ পছন্দ করেন, তবু খাওয়ার সময় কি আপনি এটা ভেবে খুশি হন না যে যাক কিছুটা ওমেগা-থ্রি-ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরে ঢুকল? আমার একটি বন্ধু বলেছিল সে সম্প্রতি বিষাদগ্রস্ততা (depression) কাটিয়ে উঠতে পেরেছে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যর্ধক কিছু অভ্যাস আয়ত্ত করে- যেমন স্বাভাবিক ও পর্যাপ্ত ঘুম, দীর্ঘক্ষণ হাঁটা এবং প্রচুর পরিমাণে সবুজ সবজি খাওয়া। এখানে প্রোজ্যাক ব্যবহার না করলেও আদতে প্রক্রিয়াটা একই- বাইরে থেকে শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের মোড় ঘুরিয়ে মানসিক ব্যাধি দূর করার প্রচেষ্টা। অ্যালডস হাক্সলির ‘Brave New World (1932)’-এর সেই যে আদর্শ সুখানুভূতির ওষুধটির কথা মনে পড়ে যায় না কি যেটার প্রয়োগে মানুষকে আর কখনও অপ্রিয় অনুভূতির শিকার হতে হবে না, বরং সে এক স্থায়ী পরিতৃপ্তির আবেশে আচ্ছন্ন হবে? আমরা সবাই জানি হাক্সলির বর্ণিত পৃথিবী একটি ডিসটোপিয়া। কিন্তু মিশেল ওয়েলবেকের উপন্যাসের একটি চরিত্র যেমন বলে ওঠে- ‘সবাই বলে Brave New World হল একটি টোটালিটারিয়ান দুঃস্বপ্ন… সম্পূর্ণ বাজে কথা। বরং ঠিক উল্টোটাই সত্যি- Brave New World হল আমাদের স্বর্গের ধারণা।’ এক দিক থেকে দেখলে সত্যিই Brave New World স্নায়ুসংস্কৃতির যুগের ধ্যানধারণার যুক্তিসঙ্গত পরিণতি যেখানে আত্মানুসন্ধানের বদলে বাইরে থেকে আরোপিত শারীরবৃত্তীয় সমাধানটিকেই শ্রেয় বলে গ্রহণ করা হয়।
অন্যদিকে মনোসমীক্ষার ভিত্তিতে আপেক্ষিক (সাবজেক্টিভ) অভিজ্ঞতাকেই প্রধান বলে ধরা হয়, আত্মানুসন্ধান একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে মান্যতা পায়। সেই কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনও কখনও বছরের পর বছর, কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে শুশ্রুষার চেষ্টা করা হয়। মনোসমীক্ষার মূলকথাটি আমাদের এক বিরাট শক্তি আয়ত্ত করার আশা দেখায়। বলা হয়- মনের নিজস্ব কিছু উপাদান আছে, সেগুলিকে শনাক্ত করার পথও আছে, আমরা যদি ঠিক পথটি আয়ত্ত করতে পারি তাহলে মনের আঁধার কেটে ধীরে ধীরে একটা গোপন চালচিত্র চোখের সামনে ধরা দেবে। সম্পূর্ণ বদল হয়ত সম্ভব নয়। ফ্রয়েড একবার বলেছিলেন তাঁর ‘টক থেরাপি’র উদ্দেশ্য হল নিউরোটিক যন্ত্রণাকে সাধারণ আটপৌরে দুঃখ বা মনখারাপের স্তরে নামিয়ে আনা। যেভাবে হাস্টভেদ্ট বলেছেন, একমাত্র প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি হল- ‘শুধু কথা বলে কি কোন মানুষকে লক্ষণমুক্ত করা যায়?’ মনোসমীক্ষার গোড়ার কথাটাই হল- একমাত্র আপেক্ষিক উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতাই পারে একজনের মনের গভীরের চালচিত্রের পরিবর্তন ঘটাতে।
মস্তিষ্ক-বিজ্ঞানের (brain science) সাথে মনোসমীক্ষার এই টানাপোড়েনের মূলে আছে সেই অমোঘ প্রশ্নটি – চেতনা কি? কোন প্রামাণ্য ব্যাখ্যার অভাবে দুই বিপরীত অবস্থান আমরা দেখতে পাই মস্তিষ্ক-বিজ্ঞান ও মনোসমীক্ষার পথে- একদিকে বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবতাকে ব্যাখ্যার প্রয়াস, অন্যদিকে বাস্তবতার আপেক্ষিক, ব্যক্তিগত মূল্যায়ন- দুয়ের সতত বিরোধ দুই ধারাকে মিলতে দেয় না। ব্যক্তিগত অনুভব ও বীক্ষাকে স্নায়ুবিজ্ঞানের বৃত্তে জায়গা করে দিতেই স্নায়ুমনোসমীক্ষার উদ্ভব। অধ্যাপক সোল্মস (স্নায়ুমনোবিজ্ঞানের আহ্বায়ক) এক আলাপচারিতায় আমাকে বলেছিলেন যে স্নায়ুমনোসমীক্ষা মোটেই মনোসমীক্ষা-চিন্তার দীর্ঘ, বিভ্রান্তিকর ইতিহাস নিয়ে উৎসাহী নয়। একমাত্র উৎসাহী ফ্রয়েডের মূল দার্শনিক অবস্থানটিকে নিয়ে, যার একদিকে ছিল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মান্যতা, অন্যদিকে ব্যক্তিগত মনের বোধ ও বীক্ষার স্বীকৃতি।
সোল্মস ছাত্রদের আরও সহজ করে বোঝাতেন এই বলে যে – ‘মনোসমীক্ষা যা ব্যাখ্যা দেয় তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু মনোসমীক্ষা যার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে সোল্মস ও স্নায়ুমনোবিজ্ঞানের অন্য শরিকরা মস্তিষ্ক-বিজ্ঞানে সমর্পিতপ্রাণ। তাঁদের আপত্তি শুধু মানুষের বিশ্বাস, ইচ্ছা, অনুভব- এইসবকে বিজ্ঞানের চর্চা থেকে ছেঁটে ফেলার মতবাদটির (যা ‘পরিহারবাদ’ বা eliminativism) বিরুদ্ধে। ক্যালিফোর্নিয়া সান দিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্যাট্রিকা চার্চল্যান্ড, টাফ্ট্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডানিয়েল ডানেটের মতো পরিহারবাদের প্রবক্তাদের সাথে তাঁদের এই জায়গাটিতেই বিরোধ। সোল্মস একটি গবেষণাপত্রে লিখেছেন স্নায়ুমনোসমীক্ষা বিশ্বাস করে যে ‘মানসিক কলকব্জাগুলির প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু কিছু সত্য মানুষ জানতে পারে এই পথে। যতই উন্নত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হোক না কেন সেগুলি শুধু পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখা যায় না।’ ‘মন’-এর প্রসঙ্গ উঠলেই মস্তিষ্ক-বিজ্ঞান যেন হঠাৎ বিব্রত হয়ে পড়ে, এই অস্পৃশ্যতা দূর করতেই স্নায়ুমনোসমীক্ষার উৎপত্তি।
সেই কারণেই ফ্রয়েড বা ফ্রয়েডের বক্তব্য যত না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সেই বক্তব্যের বিষয়টি। এই প্রবন্ধটি লেখার সময়ে গবেষণা করতে করতে আমার অনেকবার মনে হয়েছে- ফ্রয়েডকে নিয়ে এখনও পড়ে থাকার কারণ কি? তিনি এতটাই চরমভাবে বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব যে তাঁকে কেন্দ্র করে আশি-নব্বইয়ের দশকে প্রায় একটি ‘ফ্রয়েড-যুদ্ধ’ (Freud Wars) ঘনিয়ে ওঠে দু’দল চিন্তাবিদের মধ্যে। তর্ক না বলে একে যুদ্ধ বলাই সঙ্গত কারণ কেউ কেউ এতটাই চরম অবস্থান নিয়েছিলেন যে দাবি করেছিলেন- ফ্রয়েড না জন্মালেই মানব সভ্যতার মঙ্গল হত। অতটা চরমভাবে ব্যক্ত না করলেও ওই দলের বেশিরভাগ চিন্তকই মনে করেছিলেন- ‘ফ্রয়েড যেভাবে সফল হয়েছেন, জনপ্রিয় হয়েছেন তা না হলেই ভালো হত’ (ঐতিহাসিক জন ফরেস্টারের ১৯৯৭ সালের এই উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য)। সেই কারণে এই প্রবন্ধের জন্য গবেষণা করার সময় আমি কিছুটা হতাশই হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আমি যে মতই প্রকাশ করি না কেন একদল লেখক, গবেষক, চিন্তাবিদ নিশ্চিতভাবেই ক্ষুণ্ণ হবেন। রাশি রাশি কড়া মতামত ধেয়ে আসতে থাকবে একের পর এক। কিন্তু ব্যক্তিসাপেক্ষ দর্শন রক্ষা করার দিকেই যখন আমার মতামত তখন আর বিরুদ্ধ মতকে ভয় পেলে চলে? কিন্তু ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের মতো বিতর্কিত একটি শাস্ত্রকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া কি সত্যিই অসম্ভব? আর্ভিন ডি ইয়ালোমের মতো অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মনোবিজ্ঞানের পাঠ নেওয়া যায় না কি? অথবা ভিক্টর ফ্রাঙ্কেলের লোগোথেরাপি? যেখানে ধরা হয় জীবনকে অর্থপূর্ণ করার ইচ্ছা মানুষের একটি মৌলিক প্রবৃত্তি এবং জীবনের অভিমুখ নির্ণয়ের জন্য এই প্রবৃত্তিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ। অথবা ফেনোমেনোলজির দার্শনিক ঐতিহ্য যার অন্যতম কথা- ব্যক্তিসাপেক্ষ বোধই হল সবচেয়ে মৌলিক, একমাত্র তার মধ্যেই চেতনার স্বরূপকে বোঝা সম্ভব। তাই যদি হয় তাহলে স্নায়ুমনোসমীক্ষার মূল উদ্দেশ্যটি প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের ধরতাই প্রয়োজন হয় না।
সরাসরি যদি নাও হয়, স্নায়ুমনোসমীক্ষার নামে ও মানে ফ্রয়েডের ছায়াটি ভীষণ প্রতীকী। আসলে তা স্নায়ুবিজ্ঞানী রামাচন্দ্রনের কথাটিকেই যেন সূক্ষভাবে বলতে চায়। রামাচন্দ্রন (Phantoms in the Brain (1998)) লিখেছিলেন, ‘একজন হৃদরোগবিশেষজ্ঞ যেভাবে হার্টের চর্চা করেন বা একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী যেভাবে গ্রহদের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করেন মানসিক জীবনের সূত্রগুলিকে সেইভাবেই চর্চা করা সম্ভব।’ চিকিৎসার দিক থেকে দেখলে এটাও প্রণিধানযোগ্য যে ফ্রয়েডের আগে থেরাপির ধারণাটাই ছিল না। য়ালোমের উপন্যাস ‘নিৎসের কান্না’তে (When Nietzsche Wept (1992)) আমরা দেখতে পাই ফ্রয়েডের মেন্টর জোসেফ ব্রিউয়ার প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিকটির গভীর হতাশা কাটাতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়ছেন। একসময় তিনি বলছেন- ‘হতাশার কোন ওষুধ নেই, আত্মার কোন চিকিৎসক হতে পারে না।’ শেষে তিনি শুধু একটিই উপদেশ দিতে পারেন, ‘কোন ধর্মগুরুর সাথে কথা বলে দেখুন’।
ফ্রয়েডের পরবর্তী সময়ে অবশ্য আত্মার ডাক্তারের কোন অভাব নেই। এই চিকিৎসা শুরু হয় অস্তিত্ব সম্পর্কে রুগীর আপেক্ষিক ও একান্ত নিজস্ব ধারণাগুলি থেকে। ব্যক্তিসাপেক্ষ মনোচিকিৎসার বিজ্ঞান যে সম্ভব তা ছিল ফ্রয়েডের একটি অটল বিশ্বাস। সোল্মস এবং অন্যান্যরা মানেন যে ফ্রয়েড অনেকাংশেই, হয়ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভ্রান্ত। তা সত্ত্বেও যে বিষয়টিকে তিনি প্রতিষ্ঠা করার জন্য আজীবন চেষ্টা করে গেছেন তা নিশ্চয়ই একপ্রকার ইন্টেলেকচুয়াল স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা দাবি করে। কেউ যদি বলেন যে স্নায়ুমনোসমীক্ষার নামের মধ্যে ফ্রয়েডের ছায়া থাকার ফলে বিজ্ঞানের একটি ধারা হিসেবে এর গ্রহণযোগ্যতা কমে যাচ্ছে- তাহলে খুব ভুল ভাবছেন না বলেই আমার বিশ্বাস। এবিষয়ে সোল্মসের কথাগুলোই আমি আবার বলতে চাই- ‘ফ্রয়েডকে আমাদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমাদের এমন একটা বৈজ্ঞানিক পন্থা দরকার যা মনের প্রকৃতি কি- এই প্রশ্নটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। যেহেতু ফ্রয়েড এই পন্থাটিকেই খুঁজে গেছেন সারাজীবন ধরে তাই আমার মনে হয়েছে তাঁকে দিয়ে শুরু করা যেতে পারে।’
ব্যক্তিসাপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিকে বিজ্ঞানের বৃত্তে জায়গা দেওয়ার প্রচেষ্টা তাই আমাদের মনে বৈধতা পেয়ে যায়। একইসঙ্গে তা মস্তিষ্ক-গবেষণার যুগের প্রতি আমাদের মানসিক দ্বিচারিতাকেই চিহ্নিত করে। একথা ঠিক যে আজকের মানুষের মনোযোগ এন্ডর্ফিন বা সেরেটোনিন ক্ষরণের উপায়গুলিতে আটকে আছে, বিজ্ঞানের থেকে তারা দাবি করছে অ্যামিগডালাকে সংযত করে প্রতিকূল অবস্থায় উদ্বেগ প্রশমিত করার জাদুমন্ত্র। যদিও সম্পূর্ণ শারীরবৃত্তীয় নিয়ন্ত্রণই তারা চাইছে, তা সত্ত্বেও ‘Brave New World’ আমাদের সময়ের এক শ্রেষ্ঠ ডিসটোপিয়া হিসেবেই থেকে গেছে। শারীরবৃত্তীয় যুক্তির দেখানো পথে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে নির্বাসন দেবার ধারণায় কোথাও একটা ভয়ঙ্কর ফাঁকি আছে আমাদের মনে হয়। আমাদের জীবনের লক্ষ্য, আশা, ভরসা, ভয়, স্বপ্ন- এই সমস্ত নিয়ে জীবনের যে অন্তঃপুর, তাকে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন হতে দিতে আমরা রাজি নই। মনোসমীক্ষা যে একটি চটকদার তত্ত্ব হয়ে এখনও মানুষের কাছে ধরা দেয় তার একটি কারণ হল তা মানুষকে নিজের কাছে সমৃদ্ধশালী করে তোলে, রহস্যময় করে তোলে। জীবন যেন শুখা পাঠ্যপুস্তক না হয়ে একটি গভীর উপন্যাস হয়ে ওঠে।
বলাই বাহুল্য, সেই উপন্যাস আমাদের মুগ্ধ করতে কার্পণ্য করে না। বিখ্যাত গ্রীক ট্রাজেডির হৃদয়বিদারী দ্বন্দ্বের মধ্যে আমাদের অস্তিত্বের একটি পরম সত্যের আদল আবিষ্কার করে আমরা চমৎকৃত হই। গোপন অর্থে পরিপূর্ণ স্বপ্নের ধারণাটিও আমাদের স্বভাবগত আত্মরতিকেই (narcissism) খুঁচিয়ে তোলে। হয়ত ভেতরে ভেতরে আমরা বিশ্বাস করি এমন কোন সাধারণ তত্ত্ব হওয়া সম্ভবই না যা একজন মানুষের মনটিকে পুরোপুরি ধরতে পারে। সমস্ত মানুষের মনের হদিস পাওয়া তো দূরস্থান। তাই নিজেকে র্যাশানালাইজ করে আমরা স্বস্তি পাই। আর কোন অস্পষ্টতা থাকে না, সবকিছু মাপা যায়, ধরা যায়, পরিবর্তন করা যায়।
আবার অন্যদিকে, আমরা পুরোপুরি জৈবরসায়নের সূত্র ধরেও জীবনধারণ করতে চাই না। যে জৈব-রসায়ন সাত’শ পঞ্চাশ কোটি মানুষের জন্য অভিন্ন তাকেই ব্যক্তিগত জীবনের চালিকাশক্তি করতে কোথাও যেন আমাদের বাধে। ঠিক কোথায় আমাদের অসুবিধে হয়, জীবনের কোন ধর্ম অপূর্ণ থেকে যায় আমরা পরিষ্কার করে বলতে পারি। মানবিক বিজ্ঞান, কলাবিভাগের ধারাগুলিতে তো এমনি এমনি আর মনোসমীক্ষার প্রভাব অটুট থাকেনি! ফ্রয়েডের লেখায় হ্যামলেট, ম্যাকবেথের উল্লেখ রয়েছে, গ্যেটের ফাউস্টের প্রসঙ্গ এসেছে। প্রায় এক শতক ধরে এইচ জি ওয়েলস, ভার্জিনিয়া ওলফ, জে জি বালার্ড, পল এস্টারের মতো লেখকরা বারবার ফিরে গেছেন ফ্রয়েডের কাছে। মনোসমীক্ষার মতো কলাবিভাগের ধারাগুলিতেও, বিশেষ করে সাহিত্যে, ব্যক্তিজীবনের বিবিধ অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিকোণ অন্যতম উপাদান হয়ে উঠে আসে। বাস্তবতা ধরা দেয় ব্যক্তিসাপেক্ষ অভিজ্ঞতার নিরিখে। মনোসমীক্ষার মতোই মানবিক বিজ্ঞানের ধারাগুলিতেও যেন আজ ভাঁটার টান। আধুনিক বিজ্ঞানের নিরস প্রযুক্তির পাশে তারা ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে বলেই অনেকে মনে করেন। দুইই যেন একই পথের পথিক, একই পরিণতির দুই অঙ্গাঙ্গী ভাগীদার। দু’য়েরই গর্ভে রয়েছে একই প্রবৃত্তি, একই চেতনা – আমরা নিজেদেরকে যা গল্প শোনাই, যে গল্প নির্বাচন করি, বিশ্বাস করি, সজ্ঞান কান পাতি সেই অনুযায়ী আমাদের জীবনের অর্থ গড়ে ওঠে, নিরীহ জীবন নিজের কক্ষপথটি চিহ্নিত করে নেয়।
এই পরস্পরবিরোধী আবহাওয়ায় স্নায়ুমনোসমীক্ষা আত্মপ্রকাশ করে। প্রথাগত মস্তিষ্ক-বিজ্ঞানের বিরোধী নয়, বরং সমান্তরাল পথে, এককের অভিজ্ঞতার নিরিখে শূন্যস্থানটি পূরণ করার উদ্দেশ্যে। ভ্লাদিমির নভোকভ যাকে বলেছিলেন ‘চেতনার বিস্ময়- অনস্তিত্বের অন্ধকার রাতে হঠাৎ খুলে যাওয়া জানলা, ভেসে ওঠা উদার আলোকোজ্জ্বল এক পৃথিবী’- তাকেই স্নায়বিক ব্যাখ্যায় প্রতিষ্ঠিত করার আশায় স্নায়ুমনোসমীক্ষার পথ চলা।
এই আয়াস আমাদের স্বরূপটিকে তুলে ধরে আয়নার মতো। ‘Illness as Metaphor (1977)’ –এ সুসান সোনটাগ লিখেছিলেন- ‘অনেকাংশে মনোবিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা ও আবেদনের কারণ এর পরিশ্রুত আধ্যাত্মিকতা; ধর্মনিরপেক্ষ ও আপাত-বৈজ্ঞানিক পথে বস্তুর তুলনায় আত্মার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায়।’ ফ্রয়েড ছিলেন আপাদমস্তক নাস্তিক, অসীমের সাথে একাত্ম হওয়ার অনুভূতিটিকে তিনি আধ্যাত্মিকতার চশমা দিয়ে দেখতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু আজকে, আত্মানুসন্ধানের কার্যকরী ভূমিকাটিকে স্বীকার করার অর্থই হল ব্যক্তিমানুষের এজেন্সির ধারণায় সিলমোহর দেওয়া*। যা আধুনিক বিজ্ঞানের তুলনায় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যেরই বেশি কাছাকাছি। একই কারণে আধ্যাত্মিকতা বারবার নতুন নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করে, বিজ্ঞানের প্রভূত অগ্রগতির পরও চট করে এর মৃত্যু হওয়া অস্বাভাবিক। ঠিক যেভাবে এই স্নায়ুসংস্কৃতির যুগেও মনোসমীক্ষাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না।
[*অনুবাদকের নোট- ব্যক্তিমানুষের এজেন্সি বলতে এখানে চেতনার এজেন্সির কথা বলা হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে স্নায়ুবিজ্ঞানের কিছু আবিষ্কারের সূত্রে একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। একদল স্নায়ুবিজ্ঞানী ও দার্শনিক পরীক্ষালব্ধ কিছু ফলাফলের সূত্রে দাবি করেছেন মানুষের সচেতন মন সম্পূর্ণভাবে অচেতন মন বা আরও স্পষ্ট করে বললে গভীর শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার দ্বারা পরিচালিত হয়। অর্থাৎ সচেতনভাবে আমরা যা ভাবি, করি সেসবই সম্পূর্ণভাবে অচেতন মনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে সচেতন মনের কোন এজেন্সি নেই। সেই হিসেবে ব্যক্তিমানুষেরও কোন এজেন্সি নেই- মানুষ একটি জটিল যন্ত্র ছাড়া এর কিছুই নয়।]
মনে করা যেতে পারে ব্যক্তির অপরিহার্য নিজস্বতা বলে আসলে কিছু হয় না। বক্তব্যটি হাল আমলে বেশ ফ্যাশনদুরস্ত। তার ওপর এমন এক অভূতপূর্ব মুক্তির বাণী নিয়ে আসে যে তার হাতছানি উপেক্ষা করা কঠিন। কিন্তু একটু ভাবলেই দেখা যাবে এই পথে জীবন ধারণ করা ভীষণ কঠিন। মাতৃক্রোড় থেকে শ্মশান অবধি বিবিধ অভিজ্ঞতায় আকীর্ণ এই দীর্ঘ পথ, প্রতি বাঁকের নতুন উপলব্ধি, নতুন বন্ধুত্ব, ঘাত-প্রতিঘাত এই সব কিছু যেন একটি বিন্দুতে এসে অর্থবহ হয়ে ওঠে। সেই বিন্দুটির নামে বড় পুরনো দিনের গন্ধ, আধুনিকতার প্রসাদস্পর্শ সেখানে পড়েনি। আমরা তাকে বলি ‘আত্মা’। সোল্মসের সাথে আমি একমত, আধুনিক বিজ্ঞানের রাজ্যে মনের এই নির্বাসনকে এক ধীর গতির ট্র্যাজেডি ছাড়া আর কিই বা বলা যায়? ফ্রেডরিখ নিৎসে মনে করতেন আমরা এখনও সত্যিকারের নাস্তিকতায় উপনীত হতে পারিনি, মানবসভ্যতাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিতে পেরেছি যা বাহ্যত নাস্তিক কিন্তু গভীরে তার ঈশ্বরবিশ্বাস এখনও অটুট। এর জন্য কি মানুষকেই দায়ী করা চলে? মানব-ব্যতিক্রমবাদ (Human exceptionalism) আমাদের সবচেয়ে বড় ধর্ম। অন্য সব ধর্মের স্থাপত্য ভেঙে ফেলেও এই উপসনালয়টি কী করে যেন অক্ষত থাকে। সত্য যদি তাই হয়, আমরা যদি আমাদেরই পুজো করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি, তবে ধরে নিতে হয় সোনটাগ -এর পরিশ্রুত আধ্যাত্মিকতা আসলে দুমুখো-ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। সেখানে বস্তুকে প্রধান ধরেও অবশেষে অপর এক বিগ্রহের পায়েই ফুলগুলি রাখা হচ্ছে!
স্নায়ুবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের বিস্ময় বললে ভুল হয় না। তাকে আমাদের প্রয়োজন। তার মহান আবিষ্কারগুলিতে চমৎকৃত না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। আমিও তাই দু-নৌকায় পা দিয়েই চলি। আর সবার মতো আমিও ভিটামিন ডি আর ওমেগা-থ্রি-ফ্যাটি অ্যাসিডের পেছনে ছুটি। কিন্তু একইসঙ্গে ফ্রয়েডীয় প্রকল্পটিও আমাকে টানে। যদিও স্বীকার করতেই হয় এর শুরুটা হয়েছিল একটু ঘুরপথে। বহু বছর আগে আমি এক জেনেরাল ফিজিশিয়ানের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি সম্ভবত অতিরিক্ত পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। নাহলে ১০ মিনিট আমার কথা শোনার আগেই কেন আমাকে জোলফ্ট-এর প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেবেন ? সেই সময়ের আশেপাশেই আমি আলবেয়ার কাম্যুর লেখার সাথে পরিচিত হই। তিনি আমাকে ভালো-মন্দে আকীর্ণ এই জীবনের অপার মহিমাকে গ্রহণ করতে শেখান। কাঁধের ওপর ঈশ্বরের অভয়স্পর্শের মতো সেই পাঠ আমি বহন করে চলেছিলাম। আমাকে জোলোফ্ট নিতে হয়নি। নতুনভাবে পৃথিবীকে দেখার যে ওষুধ কাম্যু আমাকে দিয়েছিলেন তা আমার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। দস্তয়ভস্কি, জর্জ অরওয়েল থেকে শুরু করে বৌদ্ধদর্শন বা রক ব্যান্ড টুল- আমার অন্তর্জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান আবিষ্কারগুলি চেতনার গভীরে প্রবেশ করেছিল। আমার কাছে তাদের নিয়ে এসেছিল বিশুদ্ধ চিন্তা, কোন ওষুধের বড়ি বা ইঞ্জেকশন নয়। আমি তাদের আত্মস্থ করে জীবনের কঠিন বাস্তবতাগুলিকে নতুন ভাবে দেখতে শিখেছিলাম। বাস্তবতার কোলে শিশুর মতো শুয়েও আমি তার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পেরেছি- যেভাবে একজন অভিনেতা পারে, যেভাবে একজন সাক্ষী পারে। জীবনের এই দিকটি কিভাবে স্নায়ুবিজ্ঞানের কাঠামোয় অঙ্গীভূত হতে পারে আমার জানা নেই। কিন্তু আমি মনে করি- ফ্রয়েডকে ধরেই হোক বা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে – সেই চেষ্টাটা বোধহয় আমাদের করা উচিৎ।
******
অনুবাদ ~ অর্ণব চক্রবর্তী
প্রচ্ছদঋণ : ইন্টারনেট