-৬-
গৃহহীন হওয়ার যন্ত্রণা মানদাকে বারংবার তাড়া করিয়া আসিয়াছে। মায়ের কোলেকাঁখে চড়িয়া শিশুকালে তাহারা বাক্স প্যাঁটরা লইয়া কোথা হইতে যেন কোথায় যাইতেছিল। পিতার মাথায় ছিল একখানি তোরঙ্গ আর কাঁধে, বগলে সুটকেস। কাতারে কাতারে মানুষজন ছাগল, গরু, জিনিসপত্র লইয়া চলিতেছিল, এইটুকুই তাহার স্মৃতিতে রহিয়াছে। সেই প্রথম গৃহহীন হওয়া। হাওড়া স্টেশনে দিন যাপন। কাহারা যেন খিচুড়ি বানাইয়াছিল, শাল পাতার দোনায় তাহা ভক্ষণ—শিশু মানদার পুলক জাগিতেছিল তখন খুব। বিস্তর ছোটাছুটি করিতেছিল সে স্টেশন চত্বরে। দিন কয়েক বাদেই অবশ্য সেই পুলক আর রহিল না। স্টেশন হইতে পিতামাতার সহিত আবার যাত্রা। সে যাত্রায় ঠাঁই মিলিয়াছিল এক আত্মীয়ের গৃহে। মাসখানেক সেই স্থানে কাটাইয়া পিতার সহিত তাহারা নিজস্ব ছিটে বেড়ার ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল। মাতার মুখে হাসি, চক্ষে জল দেখিয়া সেও হাসিতে হাসিতে চিল চিৎকার করিয়া কান্না জুড়িয়াছিল। পিতা মজদুরি জুটাইয়া লইয়াছিল কোথাও। দুবেলা অন্নের সংস্থান কিভাবে হইত তাহা বুঝিবার বয়স তখন তাহার হয় নাই। খানিক বড় হইলে দেখিয়াছিল, মোটামুটি স্বচ্ছল জীবন। পিতা কর্ম জুটাইয়াছিল এক পাটকলে। খাতা লিখিবার কাজ। তাহার অক্ষর জ্ঞান হইয়াছিল সদ্য। সহজ পাঠে মুখ ডুবাইয়া সে পিতাকে আড়াল করিত। সে ছিল তাহাদের নিজস্ব খেলা। চটকল থেকে ফিরিলে পিতা এমন ভান করিতেন যেন মানদাকে তিনি খুঁজিয়া পাইতেছেন না। ‘কোথায় আমার মানু, মানু কোথায় গেলি মা…’ এই সবের পর মানদা পিতার ক্রোড়ে ঝাঁপাইয়া পড়িত। ততদিনে তাহাদের ছিটে বেড়ার ঘরে টিনের ছাউনি পড়িয়াছে। দেওয়াল, মেঝে পাকা হইয়াছে। বিলাসিতা না থাকিলেও শান্তি ছিল, সুখের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটিত না। কিন্তু উপরওয়ালার মর্জি ছিল ভিন্ন। তাঁহার অভিপ্রায় বুঝিবার সাধ্য বুঝি মনুষ্যকুলের কোনোদিনই হইবে না।
দিন দিন মানদার পিতা ক্ষীণজীবী হইয়া পড়িতেছিলেন। অভাবের সংসারে তাহার মাতা স্বল্প দুধ, ফলটুকু জুটাইত কোনোক্রমে। চটকলের ডাক্তারের কাছে ছাতি পরীক্ষা করিয়া তাহার পিতার যক্ষ্মা ধরা পড়িল। মানদার পিতার সহিত ক্রীড়াটুকুও চলিয়া যাইল। পিতার জন্য পৃথক বিছানা, পৃথক বাসনকোসন, গামছা। কাশির সহিত দলা দলা রক্ত উঠিতে দেখিয়াছিল একদিন মানদা। সেই হইতে তাহার রক্তে বেদম ভয়। রক্ত দেখিলেই তাহার হাত পা অসাড় হইয়া আসে। ছয়মাসের মাথায় পিতা চলিল উপরওয়ালা নিকট। অগত্যা মাতার ক্রোড়ে চাপিয়া মানদা পুনরায় গৃহহীন হইল। এক্ষণে তাহার বসতি হইল তাহার মাতুলালয়। মাতুলালয় ছিল তাহাদের অতীব আদরের স্থান। সে অবোধ তখনও বুঝে নাই, আদর, আহ্লাদের দিন তাহার ফুরাইয়াছে চির জীবনের ন্যায়। এক পরিত্যক্ত ঘর সারাইয়া তাহাদের থাকিবার জন্য বরাদ্দ হইল। রাত্রে ওই ঘরেই দুইখানি ছাগ শয়ন করে। নাদির গন্ধে ঘর ভরিয়া যায়, মানদার দুর্গন্ধে ঘুম আসিত না প্রথমদিকে। পরে সবই সহিয়া গিয়াছিল। অনাদরের অভ্যাসও সে রপ্ত করিয়াছিল কোনো ক্রমে। তাহার মাতা সে সংসারের সমস্ত কর্মের ভার নিজ স্কন্ধে তুলিয়া লইয়াছিল স্বেচ্ছায়। নহিলে যে অলিখিত পেটচুক্তি লঙ্ঘিত হয়! মামীদের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা জুটিলেও মামাদের কিঞ্চিত করুণার রেশ পাইয়া মানদা দিনে দিনে বর্ধিত হইতেছিল কলাগাছের প্রায়। মাতার শরীর, স্বাস্থ্য ভাঙিয়া পড়িতেছিল ততোধিক। মায়ের কর্মে সাহায্য করিতে যাইলে মানদাকে দূরে খেদাইয়া দিতেন তিনি। তবুও কি সে পরিত্রাণ পাইয়াছিল? মামাতুতো ভাইবোনেদের দেখভালের কাজ তারই স্কন্ধে চাপিয়াছিল।
বেবোকে মানদা যত দেখে, ততই বিস্মিত হয়। আজিকাল মনে হয় সে অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা। নিত্য নব নব পড়ালিখা শিখিয়া আসিয়া বেবো তাহার জ্ঞানপ্রসূত বাণী মানদার উপর বর্ষণ করিয়া থাকে। কতরূপ যে ছড়া বলিতে থাকে গড়গড় করিয়া, তাহার ইয়ত্তা নাই। সেসবের বিন্দুবিসর্গ মানদা বুঝে না। শুধু বেবোর মুখপানে হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকে। সে ভাবিতে থাকে, এও এক ভাষা! আর সে যাহা নিত্যদিন বলিয়া থাকে, সেও এক ভাষা। দুই ভাষাই তো মনুষ্য মুখনিঃসৃত, তবু একে অপরের কত পার্থক্য। বেবোর মাস্টারি ফলাইবার হেতু মানদা এযাবৎ দুই চারিটা ইংরাজি শব্দ শিখিয়া ফেলিয়াছে। বেড়ালদের ক্যাট বলে, কুট্টুস ছানাটি হইল কিটেন। আর ইঁদুর হইল র্যাট। আপেল নাকি অ্যাপেল। কেন রে বাপু! আপেল বলিলেই তো ল্যাঠা চুকিয়া যাইত। আর আম হইল ম্যাঙ্গো। এইরূপে মানদার হাতের সম্মুখে যাহাই দেখে, তাহারই ইংরাজি প্রতিশব্দ শিখিবার নেশা ধরিয়া যাইল। জামগাছ, জামরুল গাছ, তেঁতুল গাছ দেখাইয়া বেবোকে উহাদের ইংরাজি প্রতিশব্দ জানিতে চাহিল একদিন। বেবো গম্ভীর মুখে বলিল—এদের ইংরেজি হয় না। মানদা আতান্তরে পড়িল সেইদিন। তাহা হইলে কি ফিরিঙ্গী দেশে জাম, জামরুল, তেঁতুল নাই? মনকে স্তোক দিল খানিক। হয়ত নাই। রান্নাঘরকে কিচেন বলে, আজই শিখিল মানদা। ঝিকে ডাকিয়া বলিল—যা তো! কিচেন থেকে সকড়ি পেড়ে নে গা! ঝি হাঁ করিয়া বলিল—কোত্থেকে সকড়ি পাড়তে বলচ গো? মানদা আহ্লাদে মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল—পোড়ারমুখী, ও তুই বুঝবি না। রান্নাঘরে যা দেখি!
দেখিতে দেখিতে চৈত্র মাস শেষ হইতে আসিল, তবু কালবৈশাখীর দেখা মেলে নাই এই বৎসর। চারিদিক শুকাইয়া টুটিফাটা হইয়া রহিয়াছে। চাতকের ডাকে আকাশ, বাতাস চৌচির হইয়া যাইতেছে। তবে আজ এতদিনে বুঝি বিধাতার দয়া হইল। বৈকাল হইতে না হইতে কালো জলভরা মেঘ আকাশে ছোটাছুটি শুরু করিয়াছে। শনশন হাওয়ায় রাজ্যের ধূলা আর শুকনা পাতা ওলটপালট খাইতেছে। ঘরের বাহিরে ছুটিয়া আসিয়াছে মানদা। বেবোও হাজির হইয়াছে। তাহার পুলক আর ধরে না। মানদাকে আকাশ পানে তাহার কচি আঙুল তুলিয়া বলিল—ওই দেখো কিউমুলোনিম্বাস! মানদা আকাশে তাকাইয়া সেই বস্তুটিকে খুঁজিল আপ্রাণ। তবু পাইল না। অগত্যা বেবোর শরণাপন্ন হইল। ‘বাবা, ও কী জিনিস? আমি তো আকাশে ওসব কিছু পাইনি’। অবজ্ঞা আর খানিক বিরক্তির সুরে বেবো কহিল, ‘মেঘ দেখতে পাচ্ছ না? কালো কালো মেঘ? ওইগুলোই হল কিউমুলোনিম্বাস’। ‘কিউ-মুলো-নিম-বাস! কালো মেঘের নাম ঐ? এ কি বিচিত্র নাম ওদের? কে দিয়েছে ঐ নাম? হ্যাঁ রে?’ তাহার প্রশ্নে বেবো এবার হাসিয়া উঠিল খিলখিল করিয়া। নাচিতে নাচিতে কহিল, ‘আমি গো আমি। আমিই মেঘেদের নাম রেখেছি কিউমুলোনিম্বাস’। এতক্ষণে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল মানদা। যাক! বেবোর দেওয়া নাম যখন, তখন আর ভুল বলিলেও অসুবিধা নাই। কাটিয়া ছাঁটিয়া সে মেঘেদের নাম দিল মুলিবাঁশ। আর এই বিচিত্র নাম ধরিয়া মানদা চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিল মেঘেদের। বেবো কী করিবে ভাবিয়া না পাইয়া সরিয়া পড়িল।
হাম্পটি কুট্টুসকে লইয়া তক্তপোশের তলে আশ্রয় লইয়াছে ভয়ে। ডাম্পটি বিড়াল কুলের ব্যতিক্রম। সে বৃষ্টি ভালোবাসে। টিপটিপ নামিয়াছে দেখিয়া সে পাঁচিল দিয়া আনন্দে দৌড়াইতে লাগিল। মানদাও তাহার পিছে পিছে ছুটিল। কিছুদিন পূর্বেই ডাম্পটি বৃষ্টিতে ভিজিয়া বিস্তর সর্দি কাশি বাঁধাইয়াছিল। ‘আয় রে বাবা, আয় আয়…ভিজিস না! মরে যাবি নিমুনিয়া হলে…আয়, আয়…’ মানদা বেদম হইয়া দাওয়ায় বসিয়া পড়িল। বৃষ্টি পড়িয়া তাহারও শুষ্ক গাত্রে খানিক প্রাণ ফিরিয়াছে। জলের ফোঁটাগুলা মেঘের ফাঁক দিয়া অস্তগামী সূর্যের আভায় চিকচিক করিতেছে। আঁচল দিয়া মুখচোখ মুছিল মানদা। আর তক্ষুণি চোখ খুলিয়া দেখিল, তাহার পিছনে ডাম্পটি আসিয়া বসিয়াছে। তাহাকে দেখিয়া গুটিসুটি মারিয়া সুবোধ বালকের ন্যায় কাছে ঘেঁষিয়া আসিল। আঁচলের খুঁট দিয়া উহার গাত্র হইতে জল মুছাইয়া দিতেছিল মানদা। দেখাদেখি হাম্পটিও কুট্টুসকে লইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। কী এক ঘনঘোর মায়ায় আচ্ছন্ন হইয়া উঠিল মানদার হৃদয়। আকাশ ভাঙিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। কিঞ্চিত ছাঁট আসিতেছে বটে তবু সে বড় আরামের বলিয়া উহারা কেহই উঠিয়া ঘরে যাইল না। দূর হইতে উহাদের দেখিলে চিত্রার্পিতের ন্যায় স্থির মনে হইতে পারে। কিন্তু মানদার এই তিনটি বিজাতীয় প্রাণী লইয়া সংসার সুখের কিছুমাত্র অনুধাবন করিতে পারিবে না কেহ। (ক্রমশ)
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী