কানাই মণ্ডলের বউয়ের সখ হয়েছে সে ভূত পুষবে। গল্পে পড়েছে ভূতেরা খুব অনুগত হয়। সব কাজ এক লহমায় করে দিতে পারে। তাই একটা ভূত পুষলে সব দিক দিয়েই লাভ। কিন্তু ভূত পায় কোথায়? ভূত এনে দিতে না পেরে কানাই গঞ্জনা শোনে বউয়ের। বাধ্য হয়ে কানাই ভর সন্ধ্যাবেলা বাড়ির সামনের রাস্তা যেখানে পূর্ব দিকে বাঁক নিয়েছে তার কোণের বটগাছের কাছে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু সেখানে আবার একটা লাইট পোস্ট আছে—তাই ভূতের দেখা মেলে নি। বাড়ির পিছনের দিকে মাঝিদের বরোজ আছে—তার দক্ষিণ সীমানায়, কানাই মন্ডলের উত্তর সীমানায় একটা চালতা গাছ আছে সেখানে দাঁড়ানোর কথা ভেবেছে কিন্তু দাঁড়ানো হয় নি। হয়নি এই জন্যই যে সেখানে যে সব পাড়ার ছেলেরা চালতা পাড়ে আর যে সব মেয়েরা চালতা কুড়োয়—তাদের কারোর মুখ থেকেই কোনদিন ভূতের খবর পায়নি। তাহলে ভূত পাবে কোথায়?
এসব কথা আবার পাঁচকান করাও যায় না। কানাই তক্কে তক্কে থাকে। ভূতের খোঁজ পেলেই সে যেমন করেই হোক, যে দামেই হোক একটা ভূত আনবে। তা একদিন সন্ধানও পাওয়া গেল। তা পাওয়া গেল জিগরি দোস্ত হরিপদ র কাছে। তেঁতুল তলায় চায়ের আড্ডায়। হরিপদ চা খেতে খেতে ভূতদের নানা গল্প বলছিল। আড্ডায় কানাই ছাড়া গোবিন্দ, মধুসূদন, গোপাল- এরাও ছিল। সবাই নানা রকম মন্তব্য করলেও কানাই চুপচাপ বসেছিল- যেন ভূতে তার কোন বিশ্বাস নেই, অন্তত আগ্রহ তো নেই-ই। কেবল আস্তে আস্তে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল আর শুনছিল তাদের কথা। এক সময় গোবিন্দ উঠে গেল, কাজ আছে বলে মধুসদনও উঠল, গোপালও চলে গেল তারপর । হরিপদ বলল- আজ উঠি রে কানাই। কানাই বলল, “আজ চা-টা বেশ সরেস হয়েছে। আর এক কাপ হয়ে যাক।” হরিপদ বলল, “নারে, অনেকটা বাকি পড়ে গেছে।’’ কানাই বলল, “দামটা নাহয় আমিই দেবো। বোস।”
এরপর না বসার কোন মানে হয় না। হরিপদ বসল। চা এল। চা আসতে কানাই বলল, “চল, একটু ফাঁকায় বসি।” একটু দূরে ফাঁকায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে কানাই খপ করে হরিপদর হাতটা ধরে ফেলল। বলল, “কাউকে বলবি না বল- তাহলে একটা কথা বলব।” “আর ছাড়, ছাড়। চা টা পড়ে যাবে যে!”
– আগে কথা দে, না হলে হাত ছাড়বো না।
– আচ্ছা ঠিক আছে। কাউকে বলবো না, বল।
-আমার অনেক দিনের সখ, একটা ভূত পুষবো ।
কানাই বউয়ের কথাটা বলল না। হরিপদ বলল, “সে তো ভালো কথা। কে বারণ করছে তোকে । করলে শুনবিই বা কেন?’’
-তোকে একটা কাজ করে দিতে হবে। না পারলে শুধু আমাকে খবর দে, আমি যে করেই হোক, করবো। না, না, এমনি করতে হবে না। আরও একদিন চা খাওয়াবো।
-কি করতে হবে?
-তোকে একটা ভূত এনে দিতে হবে!
-ওরে বাবা, আমি! এ আমি পারবো না।
-পারবো না, না দিবি না বল? কত ভূতের খবর তোর কাছে আছে, আর তুই পারবি না!
-সে সব তো ঠাকুরদার কাছ থেকে শোনা । তুই ভূতেদের সম্বন্ধে যা জানতে চাস বল, আমি সব খবর দেব। তবে দোহাই তোর, ভূতের কাছে আমাকে নিয়ে যাস না। আমি মরে যাব।
কিছুটা হতাশ হল কানাই। তারপর মনে পড়ল- “কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল
তুলিতে/ দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?” সুতরাং মাভৈ, সে নিজেই যাবে। শুধু
হরিপদর কাছ থেকে বিশদে জেনে নিতে হবে।
হরিপদ বলল, “পছন্দসই ভূত পেতে হলে ভূত-বাজারে যেতে হবে।”
-ভূত-বাজার! সেটা কোথায়? কেউ গেছে কোনদিন?
-তা ঠিক জানিনে। তবে ছোটবেলায় ঠাকুরদার মুখ থেকে শুনেছি, আমাদের গ্রাম
পেরোলে যোল ক্রোশ মাঠ। সেই মাঠের মাঝখানে একটা বিরাট জঙ্গল। তার মাঝে নাকি একটা পুকুর আছে। সেই পুকুরের পাড়ে যে অমাবস্যা শনিবারে পড়ে সেই অমাবস্যায় ভূতেদের হাট বসে। এ দিন অনেক ভূত আসে তাদের বাজার করতে। আবার শনিবারে অমাবস্যা না পড়া পর্যন্ত এই বাজারেই তাদের সংসার চালাতে হয়।
-তাহলে তো বেশ ভালোই হাট হয়, কী বল?
-তা তো হয়-ই, এই হাটেই ভূত কেনা-বেচাও হয়!
-কী রকম দাম এক-একটার?
-আমি কি কোনদিন কিনতে গেছি নাকি যে জানবো। ইচ্ছে হচ্ছে যাও, না হলে না যাও। আমার কাছে এর বেশি কিছু জানতে চেও না। উনারা রেগে যেতে পারেন।
চা শেষ হয়ে গেছিল। হরিপদ চায়ের কাপটা ছুঁড়ে দিয়ে উঠে পড়ল। গোবিন্দও
পরে পরে বাড়ি ফিরল। বৌ বলল, “এখন আবার পাঁজি কি হবে? সামনে তো কোন পরব-টরব নেই?
-যা বলছি তার জবাব দাও। পাঁজি-টাজি আছে?
বৌ কোথা থেকে একটা পাঁজি কোলে ফেলে দিয়ে কথা না বলে রাগ করে রান্নাঘরে চলে গেল। কানাই মনে মনে হাসল, “রেগে নাও, রেগে নাও। শেষে তোমাকে চমক দেব।’’ তারপর ভাবল- “না বলেই ফেলি। কবে শনিবার-অমাবস্যা কে জানে! ততদিন বৌকে সামলানো মুশকিল হবে।” সামনের অমাবস্যাটাই শনিবারে পড়েছে। তাহলে তো আর বেশি দেরি নেই। যা থাকে কপালে। আগামী অমাবস্যায় সে বেরিয়ে পড়বে ভূতের হাটে।
ভূতের হাটে পৌঁছতে তখন বাকি প্রায় আধ কিলোমিটার । শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে হাট বেশ জমে উঠেছে। কানাই জোরে জোরে পা চালাল। পুকুরের পাড়ে পা দিতে যাবে তা বলা নেই, কওয়া নেই, হাওয়া নেই হঠাৎ ঝুপ করে সামনে জাম গাছটার ডাল কানাইয়ের সামনে ঝুলে পড়ল। যেমন চেকিং পোস্টের কাঠ নেমে গাড়ি আটকায়।
-কে আসে?
কানাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না।
-কী নাম? কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
কানাই ততক্ষণে অনেকটা সামলে নিয়েছে। আজ্ঞে, আমি কানাই মণ্ডল। মনুষ্যনগরী থেকে আসছি।
-তাঁ কাঁগজপত্র কিঁছু আঁছে? ফিঁট সাঁর্টিফিকেট?”
কানাই কাগজপত্র কিছু আনেনি। ভাবতে পারেনি ভূতের বাজারে ঢুকতে হলে কাগজপত্র দেখাতে হবে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কাকেই বা বলবে? কাউকে তো দেখতে পাচ্ছে না। তবু সাহস করে বলল- আজ্ঞে?
এবার একটু রাগত স্বরে জবাব এল। মঁনুষ্যনগরী থেঁকে আঁসছ? মেঁডিক্যাল
সাঁর্টিফিকেট আঁননি। জাঁন নাঁ, সেঁটা রেঁড জোঁন। রেঁড জোঁন থেঁকে গ্রীঁন ঢুঁকতে
গেঁলে ‘নোঁ পঁজিটিভ’ রিঁপোর্ট লাঁগে!
-যাহ বাবা! এখানেও কোভিড-১৯ এসে গেছে!
অনেক বলে কয়ে শেষ পর্যন্ত একটা সুরাহা হল। কানাই রাজি থাকলে থার্মাল টেস্টিং করে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হবে। কানাই রাজি হতে কোথা থেকে একটা লম্বা ধবধবে সাদা হাত এসে কানাইয়ের কপালে হাত দিল। অন্ধকারে যদি কয়েকটা সরু মোটা টর্চের আলো এঁকে-বেঁকে যায় সেই রকম সাদা হাত। হাত বলছি বটে, আসলে একটা লোকের হাতের কেবল হাড়। আর কপালে হাত দিতে গোটা শরীর ঠান্ডায় হিম হয়ে গেল। তা এই ঠান্ডা হাতে কী তাপ মাপল কে জানে। বলল, “তিন তিন তিন।’’ কথাটার কী মানে কে জানে! একটা ভারী গলা বলল, “আঁসতে দেঁ?’’ যেমন ঝপ করে জামগাছের ডালাটা নেমে এসেছিল, তেমনি ঝপ করে ডালটা উঠে গেল। যে লোকটা তাপ মাপছিল বলল- “যাঁ।’’
‘যা’ তো বলল কিন্তু যাবে কোথায়? চারদিকে শুধু শ’ শ’ লম্বা লম্বা হাড়গুলো হাঁটাচলা করছে। বিচিত্রস্বরে কথা বলছে। হাড়গুলোর নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে জিনিস কিনছে, বস্তা বা থলেতে ভরছে। কিন্তু কী কিনছে, কী দাম দিচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না কানাই।
কী করবে তাই ভেবে উঠতে না পেরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কানাইয়ের মনে হয়েছিল সে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ঠ্যালা খেতে সে যে বাজারের অনেকটা ভিতরে ঢুকে পড়েছে বুঝতে পারে নি। বুঝতে পারল যখন একটা বড় অশ্বথ গাছ থেকে লম্বা লম্বা পা ফেলে চামড়া বাদ দিয়ে আস্ত একটা মানুষ সামনে দাঁড়াল।
বাজখাঁই গলায় জিজ্ঞেস করল- কী উদ্দেশ্যে?
একটা ভূত কিনতে?!
লোকটার গলা একটু নরম হল। তাদের রাজ্যেও বেকার সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। আগে এত অপঘাতে লোক মরত না। এখন তো আকছার আ্যকসিডেন্ট লেগেই আছে তাছাড়া খুনোখুনি, আত্মহনন- যেন জলভাত। যদি অন্য কোথাও কাজ পায় মন্দ কি? বলল, কিনবে যে দাম এনেছ?
দিনকাল বদলে গেছে। পুরনো প্রদীপ বা আংটি ঘষলে যে আজকাল ভূত পাওয়া যাবে না— এ সন্দেহ তার মনে উঁকি দিয়েছিল আগেই। তাছাড়া সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া ভালো ভেবে কানাই কাপড়ে কিছু কয়েন নিয়ে এসেছিল, যদি কাজে লাগে। তাই বেশ জোর দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিয়ে এসেছি।”
-তোমাদের মুদ্রা তো?
-হ্যাঁ
-চলবে না।
-তাহলে উপায়? এবারের গলাটা একটু হতাশ শোনাল।
-উপায় যে নেই তা নয়। এ খেজুর গাছটার কাছে যাও। এক্সচেঞ্জ অফিস আছে। সেখান থেকে চেঞ্জ করে আনো।
কানাই আরও কিছু বলার আগে স্যুট করে ঠ্যাংটা মগডালে উঠে গেল। অগত্যা কানাই খেজুর গাছটার কাছে গেল। কী করবে ভাবছে—সেই সময় একটা মেয়েলি মিষ্টি গলা ভেসে এল।
-এক্সচেঞ্জ করবেন?
কানাই আশেপাশে উপরের দিকে তাকাল। কিছুই দেখতে পেল না। বোধহয় অফিসে
কালো কাচ লাগানো আছে। তাই দেখতে পেল না। নিরুপায় হয়ে বলল, “হ্যাঁ।”
-গাছের নীচের গর্তে পয়সা ঢেলে দিন।
কানাই তাই করল। গাছের নীচে পয়সা ঢেলে দিতেই সেই পয়সা নিমেষে হাওয়া! বদলে ঝরঝর করে অন্য কয়েন ঝরে পড়ল গর্তে ।
-নিন। যান এবার মনের সুখে বাজার করুন। বৌদির জন্যও কিছু নিয়ে যেতে পারেন।
মেয়েটি বোধহয় ভালো। একে জিজ্ঞেস করলে অনেক কিছু জানা যেতে পারে।
বলল, “আমি একটা ভূত কিনতে চাই। কিভাবে কিনবো যদি সাহায্য করেন।”
-ওটা অন্য ডিপার্টমেন্ট। আপনি এনকোয়ারি অফিসে যান।
-অফিসটা কোথায়?
-এখান থেকে বাঁয়ে বাঁক নেবেন। তারপর দেখবেন সেখানে একটা তেঁতুল গাছ।
-বুঝেছি, তেঁতুল গাছের নীচে।
-বড্ড ধৈর্য্য কম। শুনুন, তেঁতুলগাছটাকে বাঁয়ে রেখে ডান দিকে বেঁকে যান। যেতে যেতে দেখবেন একটা পোড়ো চালা।”
কানাই বুঝতে পেরেছে পোড়ো চালাঘরটাই এনকোয়ারি অফিস। কিন্তু পাছে আবার কথা শুনতে হয় তাই চুপ করে থাকল।
মেয়েটি বলল, “চালা ঘরটা পুরনো এনকোয়ারি অফিস। এখানে কিছু জানতে পারবেন না। তবে ভুলেও ওর ফটো তুলবেন না। তাহলে একশোবার কান ধরে উঠবোস ফাইন। এবার চালাঘরটাকে পিছনে রেখে সোজা চলে যান ঈশান কোণে। ওখানেই পাবেন এনকোয়ারি অফিস।’’
-চিনবো কী করে?
-আপনি চিনবেন কেন? আমরাই চিনে নেব আপনাকে । আপনি শুধু ওই কোণে পৌঁছে যান।
সুতরাং কানাইয়ের আর কোন অসুবিধা থাকার কথা নয়। আস্তে আস্তে ভূত
বাজারের ঈশানকোণে পৌঁছে গেল। তারপর কী করবে ভাবছে দেখল হঠাৎ একটা বিরাট ঝাঁ চকচকে বাড়ি।
অফিসের ভিতর থেকে জলদ-গম্ভীর স্বরে কে একজন বলল, “কী জানতে চান?”
-একটা ভূত কিনতে চাই। যদি একটু সাহায্য করেন।
-ওকে একটা ক্যাটালগ দে। ওতে কী রকম ভূত, কী রকম দাম সব লেখা আছে।
বলতে না বলতে তার সামনে একটা কাগজ দুলতে থাকল। অনেকটা বড় বড়
হোটেলে খাওয়ার টেবিলে যে রকম থাকে। তবে একটু বড়। কিন্তু কানাই পড়বে কি করে, অক্ষরগুলো তো কিছুই বুঝতে পারেছে না। তখনই আগের গলা বলল, “বুঝেছি। আমাদের ভাষা পড়তে পারবেন না। ওরে সাউন্ড দে!”
কাগজ দুলল। আর ভয়েস বের হতে থাকল…
ভূতের প্রকার ভেদ। স্ত্রীভূত-পুরুষ ভূত। স্ত্রী-ভূত- পেতনি, শাকচুন্নি, ডাকিনী, যোগিনী। পুরুষ-ভূত- ব্রহ্মদৈত্য৷ অন্য জাতের ভূতের মধ্যেও স্ত্রী ভূত, পুরুষ-ভূত আছে৷ সে অন্য ক্যাটালগ ।
পেতনী- কুমারী ভূত। যে সমস্ত কুমারী মেয়েরা গলায় দড়ি দিয়ে মরে, বিষ খেয়ে মরে, হাতে ব্লেড কেটে মরে, ট্রেনে কাটা পড়ে- তারা পেতনি হয়। এরা যে কোন বেশ ধারণ করতে পারে। দরকার পড়লে পুরুষের আকারও ধারণ করতে পারে। যখন মেজাজ ঠিক থাকে তখন খুব ভালো কাজ করে, মেজাজ বিগড়ে গেলে একটু ঝামেলা পাকায়। একটু মন জুগিয়ে চলতে হয় । দাম একটু বেশি।
শাকচুন্নি- বিবাহিতা। হাতে শাঁখা থাকে। ঝামেলা কম, মজুরি কম। তবে এক-আধদিন কামাই হয় । এমনিতে খুব ভালো । এরা আম গাছে থাকে। বাড়ির কাছে আমগাছ থাকলে এদের পক্ষে সুবিধা হয়। ডাকলেই হাজির হতে পারে। ঘরের বউকে বশ করাতে হলে খুবই উপযোগী।
কানাই তো হতভন্ব। কী বলবে, কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না। ভূতেরা
বোধ হয়—মনের কথাও বুঝতে পারে। পাশ থেকে কে যেন বলল- “ওরে, ওকে একটু
ডেমোনস্ট্রেশন দে। শুধু শুধু মুখে বললে কী আর বুঝতে পারে। খরিদ্দার লক্ষ্মী।”
বলা শেষ হয়েছে কী হয় নি, সামনে একটা সাদা পর্দা। একটু দূরে প্রোজেক্টর
মেশিন। প্রথমে পর্দায় পেতনি। এমনিতে ছেলে কি মেয়ে বুঝতে পারতো না কানাই। তবে পা গুলো বেশ সরু সরু। আর নাচের ভঙ্গিটা মেয়েদের মতো । তবে পাগুলো উল্টো। সে নেচে নেচে চলে যাওয়ার পর এল শাকচুন্নি। তারপর একে একে বাঁশোভূত, দেও ভূত, ব্রহ্মদৈত্য …… একটা অদৃশ্য ভূত এক নাগাড়ে ক্যাটালগ আউরে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে কানাইয়ের সুবিধার জন্য ব্যাখ্যা দিচ্ছে। পর্দায় ফুটে উঠছে সেই সমস্ত ভূতের চেহারা, ভাবভঙ্গী।
যেমন— বাঁশো ভূত। বাঁশ গাছে থাকে। বাড়ির আশেপাশে যদি বাঁশের বাগান না থাকে এদেরকে সামলে রাখা দায়। দাম মাঝারী । দেও ভূত। খুব একটা কাজের না। দামও কম। কাউকে নদীতে ডুবিয়ে মারতে হলে দেও ভূত কেনা যেতে পারে। ব্রহ্মদৈত্য ৷ সব চেয়ে সম্মানীয় ভূত। ভূতেদের ব্রাহ্মণ বলা যেতে পারে এঁদেরকে। গলায় পৈতে থাকে। উপকার বৈ অপকার করে না। এদেরকে কেনা যায় না। মন দিয়ে ডাকাডাকি করলে কাজ করে দেয়। তবে কোন খারাপ কাজ এদেরকে দিয়ে করানো যাবে না। মামদো ভূত-
কানাই বলল “আরো ভূত আছে?’’
-আরো অনেক রকমের ভূত আছে। মামদো ভূত, মেছো ভূত, চোরাচুনি ভূত, পেঁচাপেঁচি ভূত, নিশি ভূত, গেছো ভূত, বেঘো ভূত- আরো কত নাম বলবো তোমায়। এক একজনের কাজের ধরন এক এক রকম। চাহিদা এক এক রকম। যেমন গেছো ভূত গাছে গাছেই থাকে। কাজের সময় নামে, কাজ শেষ হলেই গাছের ভালে দোল খায়। মেছোভূত, নামেই মালুম।
তবে সবচেয়ে খতরনাক ভূত- নিশি ভূত। কাউকে যদি ভুলিয়ে কোথাও নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়ে তাহলে এর জুড়ি মেলা ভার। একেবারে আপনজনের গলা নকল করে ডাকতে পারে । ডাকে সাড়া দিয়েছ কি মরেছ। নিশি ভূত ডেকে ইচ্ছে মতো জায়গায় নিয়ে চলে যায়। সে আর ফিরতে পারে না। তবে হ্যাঁ, দু-বারের বেশি নিশি কাউকে ডাকতে পারে না।
কানাইয়ের মনে পড়ল, ঠাকমা বলত- নিশিরাতে কেউ নাম ধরে ডাকলে সাড়া দিস নে কানাই। কমসে কম তিনবার ডাকলে তবে শুনবি।
—কী ভাবছ? ভাবছ ভূতের এত রকম ফের! আসলে মানুষ নিজেকে যতই জ্ঞানী ভাবুক তত জ্ঞানী সে নয়। ভূত সম্বন্ধে মানুষের অনেক ভুল ধারণা আছে। মানুষ ভাবে, ভূত বুঝি অমাবস্যা বা অন্ধকার রাতে বের হয়। আলোয় বের হয় না। ভুল, ভুল। নিশি ভূত পূর্ণিমা রাতেই বের হয়।
কার কী ধারণা আছে কানাইয়ের জানা নেই, তবে সে নিজে স্বীকার করছে তার এত কথা জানা ছিল না। জানা ছিল না যে ভূত পূর্ণিমা রাতেও বেরোয় । সব ভূত সব কাজ করে না। নানা রকম দাম। কাজের নানান শর্ত!
-কী হে! চুপ করে গেলে যে! আর ক্যাটালগ দেখাবো না এতেই হবে?
-না, না আর দেখাতে হবে না, আমি বলি কি—কিনবো কীভাবে?
-সে বলা আমার কাজ না। আপনি সেলস কাউন্টারে কথা বলুন।
সৌভাগ্যক্রমে সেলস কাউন্টারে তখন ব্রহ্মদৈত্য। সে বলল “বলুন, আর কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?”
কানাই এখানে আসার উদ্দেশ্য এবং আসার পর পর যা যা ঘটেছে কমা পূর্ণচ্ছেদসহ
সব বলল ব্রহ্মদৈত্য কে।
ব্রহ্মদৈত্য বলল, “আমি বলি কি, তুই বাড়ি ফিরে যা।”
-বাড়ি ফিরে যাব! কোন ভূত না কিনেই? বউ আস্ত রাখবে?
-রাখবে কিনা সে তুই-ই জানিস।। তার আগে একটা কথার উত্তর দে তো। ধর, সকালবেলা তখনও তোর বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না, মনে হচ্ছে, এক কাপ চা…বউ হাতে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিল। কী করিস?
-সঙ্গে সঙ্গে বাজারে ছুটি।
-বাজার করে ফিরলি। বউ বলল- ওগো শুনছ, হলুদগুঁড়ো শেষ হয়ে গেছে। পাড়ার
দোকান থেকে এনে দাও না। আর হ্যাঁ, যাবে আর আসবে, গল্প করতে বসে যাবে না যেন। কী করিস তখন?
-পাড়ার দোকানে ছুটি। হলুদ গুঁড়ো এনে দিই।
-বাড়ি গিয়ে দেখলি শালা উপস্থিত। বউ বলল, কত দিন পর ভাই এসেছে। একটু বাজারে যাও না।
-আবার বাজারে যাই। কচি পাঁঠা আনি।
-তাই তো বলছি, ফিরে যা। তুই নিজেই তো ভূতের বেগার খাটিস। বিনা মজুরিতে, বিনা বায়নাক্কায়। তোর বউ তোর চাইতে আর ভালো ভূত-চাকর পাবে কোথায়? যা, তুই বাড়ি ফিরে যা।
প্রচ্ছদঃ শতভিষা চক্রবর্তী
*****