চিলের সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য লেখক আলেখান্দ্রা দোয়েপকিং মারতিনি রচিত ‘La Cruz de Carl Richter’ নামক ছোটগল্পটির বাংলা অনুবাদ।
কালো ছোট্ট ফুল ফুল ছাপ পাজামা ছাড়া আমার আর কিছু নেই। সূর্য আমার দ্বিতীয় গা ঢাকার পোশাক, আমার শরীরকে সে আবেগে জড়িয়ে রাখে। কেবল এক আধ মুহূর্তে একটা নরম বৃষ্টি পায়ের ওপর ঝরে আমাকে ঠান্ডা করে দেয়। তোমার কথা ভাবছি কার্ল রিখটার। আর তোমার মত আরো কত জনের কথা যারা সিমেন্ট ও মার্বেলের বেদির ওপরে থাকা রাগী সিরুয়েলিও গাছের উথালাপাথালেও ঘুমিয়ে থাকে। নিস্তব্ধতার ভেতর আমি শুনতে পাই চড়াই পাখির কিচিরমিচির আর দূর বহুদূর থেকে পচা মাংস দেখে শকুনের তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনি। সরু খোয়া বিছানো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে প্রতি পদে পাথর ও পোকামাকড় মাড়ানোর শব্দ টের পাই। মুহূর্তে বুঝি কেউ একজন আমার পাশে শ্বাস ফেলছে… ভয়ে থেমে যাই। আমি যে বেঁচে আছি তা জানি।
মনে পড়ে যখন ছোট ছিলাম, শুলে-র ল্যাবরেটরিতে আলমারির ওপরে একটা খুলি রাখা ছিল। কখনও দেখা হয় নি ওগুলো সত্যি কী না- ছোঁয়া তো দূরস্থান। বিজ্ঞানের স্যার আমাদের বলেছিলেন সত্তরের ভূমিকম্পের পরে সমুদ্রতীর থেকে ওগুলোকে কুড়িয়ে এনেছিলেন। দুপুরের খাবার খেতে যখন বাড়ি এলাম, টেবিলের চারপাশে সবাই মিলে একসঙ্গে, উত্তেজিত হয়ে বলেছিলাম আমি একজন জার্মান কলোনিবাসীর খুলি হাতে ধরেছি। আর সেটা এত বড় ছিল যেন সমুদ্রতীরের একটা বল “লোমের চুল!” আমার ভাইরা বালির নিচে কাঁটাচামচ পুঁতে দিতে দিতে একে অন্যের সঙ্গে ঘুষোঘুষি করছিল। গরম চিজ ললিপপের মত চামচেগুলো নেয়ার জন্য কাড়াকাড়ি করছিল। দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে দুধসাদা ফুলের লতানে ডালগুলো এতোল বেতোল করে দুলছে। টেবিলের অনেক ওপরে ধরে থাকা কাঁটাচামচগুলো এলোমেলো মাকড়সার জাল তৈরী করেছে। আমার এত বিরক্ত লাগছিল যে মরিয়া হয়ে চিৎকার করে বললাম- শুয়োর কতগুলো! জন্তুর মত খালি খাস! মা কে নাক গলাতেই হল-
– চুপ কর এখন। মার গলায় জোর ছিল ঠিকই তবে ক্লান্তও। পরে একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসল। আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছিল যেন আমি একটা বোকাসোকা উয়াসা মেয়ে। [উয়াসা হল চিলের আদিম জনজাতি ও স্পেনীয়দের মিশ্রণে জন্ম নেওয়া মানুষের গোষ্ঠী]
-তোর হাতে নির্ঘাত অন্য গ্রহের প্রাণীর খুলি ছিল- এমন ভাবে কথাটা বলল মা যে দেখে হাড় পিত্তি জ্বলে গেল। বুদ্ধু মনে হচ্ছিল নিজেকে। চোখের পাতা খোলা বন্ধ করার আগেই ভাইদের সামনে মা আমাকে অগ্রাহ্য করল। বাবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল। মাথার ওপর বাবার ভারী আর বড় কিন্তু আদরের হাত টের পেলাম।
-এতখানি বড় হবে কি? – ঢং করে গলায় নরম ভাব এনে বলল বাবা।
– না বাবা! ওটা সত্যিই খুব বড় ছিল- উত্তর দিলাম। আমার আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছিল না।
এখন আমি এখানে আছি, কার্লের গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে। আমার নারী হাতদুটোকে দেখছি। আমার গায়েই তো লাগানো। চেস্টনাট গাছের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম। দূরে বদ্বীপ দেখা যাচ্ছে যা আমার মফঃস্বলকে আগলে রেখেছে। কাঠের ব্লকটা যেটায় জার্মান কলোনিবাসীর খুলি রাখা ছিল ওটাকে খুঁজে পেলাম। তারপর বরাবরের বিপজ্জনক সেই নিস্তব্ধ গিরিখাত দিয়ে হেঁটে গেলাম। সেখানকার ঘুমিয়ে থাকা বাসিন্দাদের কথা মনে পড়ল অনন্ত ঘুম যাদের শান্তির গ্যারান্টি দেয় নি। গিরিখাতের ধারে ঝুলতে থাকা ময়াল, খাড়াই পাহাড়ের গা থেকে আমার গোড়ালি শূন্যে ঝুলছিল। ভাল করেই দেখতে পাচ্ছিলাম আমার চটির নীচে কিভাবে শান্ত বালির ঢেউ একটার গায়ে আর একটা একভাবে আছড়ে মরে চলেছে। হঠাৎই খাড়াই সেখানে মিশে ছত্রখান হয়ে গেছে। আমি পা হারিয়ে ফেলি। বুড়ো গাছের গায়ে আমার হাত জড়িয়ে নিজেরই শরীর ভাসছে। সিমেন্ট আর মার্বেলের এক জলপ্রপাত টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে যাচ্ছিল। হাড়গোড়, খুলি মাটি, পোকামাকড় আর গাছের ডালগুলো একটা পিন্ড তৈরী করছিল যা গিরিসঙ্কটকে খাদ্য জোগাচ্ছিল। তারপর শান্তি ফিরে এল। হ্রদ সবকিছুকে গিলে নিল। দ্বিতীয়বারের মত তাদের মৃত্যু হল।
একটা নিশ্চিত জায়গার খোঁজে পিছিয়ে যাই। চোখের সামনে দাদু উঠে এল আমি যাকে কখনও দেখি নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার এক বছর আগে চলে গিয়েছিল। দাদুর কথা কেউ কখনও আমায় বলে নি। ঠাকুমাও নয়। এক অজানা অসুখে পাগল হয়ে মারা গেছিল। যে কারণে কিছুদিন আগে পর্যন্তও বংশ পরম্পরায় আমার পরিবার লজ্জিত থাকত। সেপিয়া রঙের ছেঁড়া খোঁড়া একটা ফটো ছিল দাদুর, সৈনিকের পোশাক পরা। মা জোর দিয়ে বলে দাদুর মুখ ইহুদিদের মত ছিল।। মাকে ডাক্তার বলেছিল শুচিবায়ু অসুখ হয়েছে। মার অবসেশন ছিল; আমাদের পুরনো সব স্মৃতি পুড়িয়ে ফেলত। বুড়োর ছবিটা কী করে যেন মায়ের চোখ এড়াতে পেরেছিল। এখন মার সেই নিষ্ঠুর অসুখটা সেরে গেছে। চিনতে পারে পরিবারে প্রবহমান এই পুরুষতান্ত্রিকতা, এ এক পারিবারিক অপরাধ, একটা দুর্ঘটনা বিশেষ। তাঁর পাশেই আমার ঠাকুমা বিশ্রাম নিচ্ছে নুড়িপাথরের নীচে। তুমি যাদের জানপ্রাণ দিয়ে বড় করে তুললে তোমার সেই ছেলেমেয়েরা এখন কোথায় ঠাম্মা? মনে পড়ে তুমি তুলোর বল দিয়ে আমায় একটা ক্রিমসন ক্যাপ বানিয়ে দিয়েছিলে? ওটা পরলে নিজেকে আমার সবসময় এত্তটুকু মনে হত। আমার কানের আধখানা পর্যন্ত ঢাকা পরত সে ক্যাপ পরলে। তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না বলে কখনও জানাই নি একথা। এখনও তোমার রান্নাঘরে বানানো বিস্কুট আর পেস্ট্রি থেকে ভুরভুর করে বেরনো সুগন্ধ, বনজোয়ানের সুগন্ধ নাকে আসে।
আলো ও উষ্ণতা খুঁজতে গিয়ে সাইপ্রাস গাছের ছায়া থেকে সরে আসি। আমার প্রতিবেশিনীর গায়ে ধাক্কা খাই। ওর সঙ্গে আমার স্বামী ছিল। ওরা বাড়ির মাথাটাকে প্ল্যাস্টিকের ফুলে সাজিয়ে দিয়েছিল, অন্যান্য ধরনের সব ফুলগুলো এর মধ্যেই ম্লান হয়ে গেছে। ব্লাঙ্কা গ্ল্যাডিওলাস পছন্দ করত, বিভিন্ন রঙের গাছ লাগিয়ে সে মফস্বলের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ বানিয়েছিল ফুলের। কেউ ওকে হারাতে পারত না। ব্লাঙ্কার ছেলেমেয়েরা দূরে চলে গেছিল। ছোটটা উত্তর দিকে থাকত আর বড়টা তো আক্ষরিক অর্থেই অন্য দেশে পালিয়েছিল। ওদের মেয়ের ব্যাপারে ওরা নিজেরাই খুব কম জানত। ওই একই জায়গায় ওদের বাবা মারা গেলে শেষযাত্রায় আলাপ হয়েছিল মেয়েটার সঙ্গে। তখন শোনা গেছিল যে ব্লাঙ্কা তাঁর মেয়ের বিয়ের পর জামাইয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল। আমার যখন আট বছর বয়স তখন সেকথা প্রথম জানতে পেরেছিলাম। এক গরমকালের সকালে ওদের বাড়ি গেছিলাম এক আঁটি পার্সলেপাতা আর অর্গানিক মুরগী কিনতে। ওদের বাগানে যখন পৌঁছই কানে এল ওদের কথাবার্তা। দুই মহিলার কান্নাকাটি। করিডোর থেকে সব শোনা যাচ্ছিল। আমি থেমে গেলাম, তারপর বাড়ির একমাত্র আপেল গাছটার পেছনে লুকিয়ে লুকিয়ে সব শুনেছিলাম। সেসব শুনে আমি এক ছুটে বাড়ি ফিরে আসি। একবারই শুধু থেমেছিলাম। সরু গলিটার মুখে। র্যাস্পবেরি লজেন্স কেনবার জন্য। চকমকে রাংতার মোড়ক লাগানো লজেন্স দিয়েছিল দোকানে। আমার ভালমানুষ মাকে গল্পটা বলতেই বোমা পড়েছিল। অস্থির মনে ভাঙা ভাঙা গলায় বেরিয়ে আসছিল যে কথাগুলো সেগুলো আমার নিজের জিভেই র্যাস্পবেরির মত স্বাদ দিচ্ছিল। ইনিয়ে বিনিয়ে বলা মুচমুচে গল্পটা বেশ বুঝতে পারছিলাম নিজেই। মা চুপ করে ছিল। পার্সলে পাতা আর মুরগী কেনার ফেরত টাকার হিসেব মা আমার কাছে আর কখনও চায় নি। ব্লাঙ্কা গো, এখন আমার মনে পড়ছে কুড়ি বছর আগে তুমি আমার কাছে কী উপকার চেয়েছিলে। অনন্তের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আধা অন্ধ তুমি বলেছিলে- “আমার বড় নাতি খোর্খের সঙ্গে তোর যদি দেখা হয় বলিস আমার সঙ্গে যেন দেখা করে।”
ছোট একটা লোহার খাঁচা এই শ্বাসরোধকারী সৌন্দর্যের দিক থেকে আমার মনটাকে সরাল। নিশ্চয় কোন শিশুর নিদেনপক্ষে কোন ছোট বাচ্চার ঘর অথবা এমন কারো ঘর যার নিজের অস্তিত্ব নিজের কাছেই অচেনা, এমন কোন মানুষ। বাদবাকি সব কিছুর মাঝখানে একলা পড়ে আছে। একপাশে পড়ে থাকা খাঁচাটার শরীর বেয়ে লতিয়ে উঠেছে ফুলের আচ্ছাদন। লোহার গরাদগুলোর তীক্ষ্ণ মাথারা যেন হাত বাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে। সোনালি তারের কারুকাজগুলো রোদের তাপে ঝলসে মরচে রঙ ধরেছে। দেখে মনে হয় যেন মাটিতে পড়তে বাধ্য হয়েছে খালি খাঁচাটা। পাখিটার মৃত্যুর কারণ কী হতে পারে? ওর মা কেন বাসায় থেকে ওকে আদর করছে না?
চেস্টনাট গাছের দিকে এগোনোর মাঝপথে রয়েছি আমি, দক্ষিণের দিকে যাব, আমার পায়ের যে শব্দ আশেপাশের মনোযোগ ছিন্ন করছে, হেঁটে যাওয়া সে পথে চিহ্ন রেখে যাই। সমাধিগুলোকে ঘিরে রাখা গাছেদের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাই। কোনো কোনো কবরে মার্বেলে লেখা নাম আমি পরিষ্কার পড়তে পারছি – এগোন, কোনরাদো, ইসোলদে… এরবের্ট আর্তা, ফেদেরিকো… কিংবা ওগুলোর বদলে অন্যদের আরো সুভদ্র বিনয়ী কোন মানুষের সমাধি। খেয়াল করলাম কেবল একটা মাত্র কবরের ওপরে কালো ভ্যাপসা কাঠের একটা ক্রস আছে। সমানে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ওটা কুচি করে কাটা গ্রানাইটের মত কালচে দেখতে হয়ে গেছে। সেখানে খোদাই করা নামগুলোও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুছে গিয়েছে। প্রত্যেক কবরের মাথায় বিচ্ছিন্ন ভাবে দুটো একটা অক্ষর পড়া যাচ্ছে। তবে সঙ্গীরা না থাকার দরুন অর্থও অন্যরকম ঠেকছে। প্রতি পদেই জার্মান আর চিলের মানুষজনের উত্তরসূরিদের নাম চোখে পড়ছে। বেঁচে থাকতে নিজস্ব সংস্কৃতি আর সামাজিক স্তর তাদের যে স্বাভাবিক শ্রেণীবদ্ধতায় ফেলেছিল, ঠিক সেইরকম ভাবে শ্রেণীবদ্ধ। নিয়তির শেষ নাটকে সেই ফারাক মুছে দেবার ও আমাদের আমন্ত্রণ করবার দায় মৃত্যুর, যাতে তারা কোন ফারাক ছাড়াই অনন্ত বিশ্রামে থাকতে পারে। যারা আসবে তাদের স্মৃতিতে সেইসব মাংসপিন্ড পরিণত হয় ধুলো ও আত্মায়।
কার্ল রিখটারের ক্রসে হাত দিয়ে আমি একটা প্রশ্নের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম- আমাকে যদি এখানে কোন জায়গা বেছে নিতে বলা হত কোথায় থাকতাম? নির্ঘাত পাহাড়ের গায়ে মুখোমুখি শুয়ে থাকতে জায়গা বেছে নিতাম। চেস্টনাট গাছের পাতারা গায়ে বুলাত আর আগ্নেয়গিরির ওপরে থাকা অনন্ত বরফের দিকে চেয়ে থাকতাম। পাশে ফেলিসিয়ানো মার্কেস, পায়ের দিকে এরবের্ট শোয়াব।
আকাশ ছেয়ে যাচ্ছিল একটা হালকা গোলাপি ধূসর আচ্ছাদনে। হাতের ওপর হালকা একটা নড়াচড়া টের পেলাম। তাকিয়ে দেখি একটা পোকা। দুআঙুলের ফাঁকে ঢুকবার পথ পেয়েছে। পোকাটা উঠল তারপর গোলাপি কড়ে আঙুলের নখে গিয়ে ওটার প্রায় সবটা ঢেকে বসল। পোকাটা কালো রঙের, চকচকে আর মনে হচ্ছে বিশ্রাম নিচ্ছে। মৃত্যুর পোকা।
প্রচ্ছদঃ রেশমী পাল
*****