মানদাসুন্দরী দাসী ও হাম্পটিডাম্পটি (দশম পর্ব) – তুষ্টি ভট্টাচার্য

পর্ব ৯
পর্ব ১১
পর্ব ৯
পর্ব ১১

-১০-

      আজিকের এই বয়সকালে পৌঁছাইয়া সুবিমলবাবুকে বিদায় করিয়া দেওয়া সহজ হইল বটে। কিন্তু তাহার যৌবনকালে সুবিমলবাবুকে হেলায় খেদাইয়া দেওয়া তত সহজ ছিল না। একে তো তক্ষণ তাঁহার যৌবনের দাপট, তাঁহার রূপ-যৌবন-অর্থ- প্রতিপত্তি সমস্ত কিছু মিলাইয়া তিনি এই পরিবারের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাঁহার নজর হইতে বাঁচিবার পথ সহজ ছিল না। তথাপি মানদা বাঁচিয়া গিয়াছিল। তাহা সম্ভব হইয়াছিল কেবল বড়মার কৃপায়। মানদা আজও নিজের গর্ভধারিণীর ন্যায় বড়মাকে স্মরণ করিয়া থাকে। নিজের মাতৃদেবীর স্নেহের পরিমাপ হয় না, তথাপি  বড়মার স্নেহ পরিমাপ যোগ্য হইলেও, অপ্রতুল ছিল না। বড়মার বিয়োগের পরেও তাঁহার আশীর্বাদী হস্তের ছায়া মানদার মস্তকে আঁটিয়া বসিয়াছিল। ইহার প্রভাবে সে বারংবার রক্ষা পাইয়াছে।  সুবিমলবাবুকে ফাঁকি দিবার পরও তাহার আশ্রয়হীন হইবার ভয় হয় নাই। তবে নিজেকে ফাঁকি দিতে পারে নাই সে।  সুবিমলবাবুর উপর তাহার মানসিক দৌর্বল্য সে অনুভব করিত। ঘোমটার ফাঁক দিয়া একবারের জন্য তাঁহাকে দূর হইতে দেখিবার জন্য সে উশখুশ করিত। তাঁহার সামনে উপস্থিত হইতে ইচ্ছা হইত খুব, মনকে সামাল দিতে পারিত না সে। এক আধবার চা, জল লইয়া যাইবার অছিলায় সে সুবিমলবাবুর সম্মুখে হাজির হইয়াছিল। আর সেই সুযোগ কাজে লাগাইতে তিনিও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নাই।

   “আজও সেই বৃষ্টিসিক্ত বৈকালের কথা স্পষ্ট মনে পড়ে। সেইরূপ বৈকাল কি আসিবে আমার জীবনে আর?’’ বৃষ্টির ছাঁট আসিতেছিল বলিয়া সুবিমলবাবু ঘরের সোফাকৌচে বসিয়া ছিলেন। তাঁহার দুহাতে ধরা ছিল একখানি পুস্তক। মনে পড়ে, সেদিন আমি তাঁহার দোরগোড়ায় দাঁড়াইয়া গলা খাঁকারি দিয়াছিলাম। বোধকরি প্রথমে তিনি তাহা শুনিতে পান নাই। পরে আমার থানের প্রান্ত দেখিয়া উঠিয়া আসিয়াছিলেন। বৃষ্টির জ্বালায় তক্ষণ আমার বসন সিক্ত হইয়া যাইতেছিল। তাহা দেখিয়া তিনি ত্রস্ত হইবার ভান করিলেন যেন! আর সেই সুযোগে আমার হাত ধরিয়া আমাকে ঘরে টানিয়া লইলেন। বৃষ্টির জলে সিক্ত হইয়াই হউক বা তাঁহার হস্তস্পর্শেই হউক, আমি ঠকঠক করিয়া কাঁপিতেছিলাম। হাতের চা জুড়াইয়া জল হইয়া যাইতেছিল। কোনোক্রমে তাহা ঘরের কোণে স্থিত টেবিলে রাখিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই, সুবিমলবাবু আমাকে ডাকিলেন নাম ধরিয়া। ‘তোমার নাম তো মানদা, তাই না? এই কাঁচা বয়সে কপাল পুড়িয়েছ দেখছি! জীবন কাটাবে কী করে এই ভাবে? মুখটা তোল তো একটু…’ এই বলিয়া তিনি তর্জনি দিয়া আমার থুতনিতে চাপ দিলেন। প্রচণ্ড উত্তাপে আমার শরীর পুড়িয়া যাইতেছিল যেন…সিক্ত মুখ তুলিয়া তাঁহার চক্ষে চক্ষু রাখিলাম। তামাকসিক্ত তাঁহার একজোড়া ঠোঁট আমার উত্তাপ শুষিয়া লইবার জন্য আমাকে গ্রাস করিল। আমি বোধকরি সংজ্ঞাহীন হইয়া যাইতেছিলাম। কোনো এক জাদুকর যেন তাহার মায়ার দণ্ড লইয়া আমাকে প্রস্তর বানাইয়া দিয়াছিলেন খানিক সময়। তাঁহার দুই হস্ত আমার পিঠ হইতে কোমরে নামিতেছিল, তাহার বক্ষে আমার সিক্ত শরীরকে টানিয়া লইয়াছিলেন তিনি। আর বোধকরি দুদণ্ড দেরি হইলেই সেদিন আমার সর্বনাশ হইত। হুঁশ ফিরিয়া আসিলে আমি নিজেকে ছাড়াইয়া লইয়া এক দৌড়ে ফিরিয়া আসিয়াছিলাম নিজ কক্ষে। দালানের ঘড়িটি যেন অত্যাধিক শব্দে প্রতিভাত করিতেছিল নিজেকে। কিছু কি বলিতে চাহিতেছিল উহা সেইদিন? সর্বনাশের সময় আসন্ন—ইহাই কি ছিল তাহার সাবধানবাণী? আর তাহার পরেই শুরু করিয়াছিলাম আমার স্বেচ্ছানির্বাসন।”

  হাম্পটি ডাম্পটি ইদানীং স্বাবলম্বী হইয়াছে। মানদাকে নিস্তার দিয়াছে উহারা। কেবল খাইবার সময়ে আসে, ঘুমাইবার সময়ে আসিয়া ঘুমায়, ইহার বাহিরে তাহাদের দৌরাত্ম্য কমিয়াছে। দুষ্টামি বাড়িয়াছে কুট্টুর। তাহার দুরন্তপনায় মানদা নাজেহাল হইয়া হাল ছাড়িয়াছে। সেও আড়েবহরে বাড়িয়া চলিয়াছে। সে বেচারি জানে না, তাহার মা পুনরায় তাহার ভাই-বোনের জন্ম দিতে প্রস্তুত। হাম্পটির উদর স্ফীত হইয়া এমন আকৃতি লইয়াছে যে, মনে হইতেছে এক্ষণেই তাহা ফাটিয়া বিদীর্ণ হইবে। উহাকে ওই রূপ স্ফীত উদর লইয়া শ্লথ গতিতে যাতায়াত করিতে দেখিলে, প্রাচীর গাত্রে লম্ফ দিতে দেখিলে মানদার ভীষণ ভয় হয়। এই বুঝি কোনো অঘটন ঘটিল! মনুষ্যকুলের সহিত উহাদের যে বিস্তর প্রভেদ, মানদা ভুলিয়া যায় প্রায়শই। যেন হাম্পটি কোনো মার্জার কন্যা নহে, যেন সে একজন আসন্নপ্রসবা নারী। মানদার আরও এক ভয় রহিয়াছে কিট্টিকে লইয়া। শক্ত খাবার খাইলেও সে বেচারি এক্ষণও মাতৃদুগ্ধের নেশা কাটাইতে পারে না। মা অন্ত প্রাণ সে। কিয়ৎকাল মায়ের দর্শন না পাইলে সে মনমরা হইয়া থাকে। খেলে না, খায় না পর্যন্ত। হাম্পটির অন্য বাচ্চা হইলে ইহাকে কে দেখিবে?

  অবশেষে সেই রাত্রি আসিয়া পড়িল। ইদানীং কিট্টিই কেবল মানদার সহিত শয়ন করিত। হাম্পটি ডাম্পটি উন্মুক্ত স্থানে ঘুমাইতে যায়, কিট্টি ছোট বলিয়া মানদার সহিত পড়িয়া থাকে। সে বড়ই মনুষ্য ঘেঁষা হইয়াছে। জন্ম হইতে মানুষের সহিত তাহার গাঁটছড়া বাঁধিয়া দিয়াছেন বিধাতা। সে সম্মুখে যাহাকেই পায়, তাহারই আদর কুড়ায়। তাহাকে তীক্ষ্ণ নজরে লক্ষ্য করিতে থাকে। কথা বুঝিয়া যায় সকলের, শুধু কহিতেই যা পারে না। যাহা হউক, সে রাত্রে যথারীতি মানদার মাথার পার্শ্বে সে ঘুমাইতেছিল। মধ্যরাত্রে জানালা দিয়া হাম্পটি প্রবেশ করিয়া কিট্টিকে ঠেলিয়া তুলিল। মানদারও ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল উহাদের নড়াচড়ায়। এতদিন আসন্ন প্রসবা হাম্পটি কুট্টুসকে দুধ খাইতে দিত না, নিকটে যাইলেই থাবা উদ্যত করিত। আজি এই রাত্রে সে নিজেই আসিয়া কুট্টুসকে স্তন্য দান করিতেছে। ভারি আশ্চর্য হইল মানদা। হাম্পটিকে তাড়াইতে চেষ্টা করিলেও সে নড়িল না। একঠায়ে বিছানায় কাত হইয়া পড়িয়া রহিল। বিচ্ছিন্ন নিদ্রার অসোয়াস্তির সহিত রাত্রি কাটিল। প্রত্যুষে হাম্পটিকে দেখিয়া বুঝিল, উহার প্রসব সময় আসন্ন। জল ভাঙিয়া গিয়াছে, রক্তরসও নির্গত হইতেছে উহার। উহাকে কোনোক্রমে বিছানা হইতে উঠাইয়া দাওয়ার এক কোণে কাপড় পাতিয়া শুইবার বন্দোবস্ত করিল। মানদার মস্তিষ্কে আগুন জ্বলিয়া উঠিল তাহার চাদরের অবস্থা দেখিয়া। একে বিধবা মানুষ, তায় এই অপবিত্র, কলঙ্কের দাগ বিছানায় পড়িলে কাহার মস্তিষ্ক স্থির থাকে? তাহার শুচিবস্ত্র কলুষিত করিল এই পোড়ারমুখী হাম্পটি। প্রসবকালীন অবস্থা না হইলে উহাকে তাড়াইয়া ছাড়িত এই গৃহ হইতে। কতগুলি বিড়ালের ভার সে লইবে? একে কুট্টুসের জ্বালায় অস্থির, তাহার উপরে পুনরায় নতুন শাবকদের সে পালিবে কী করিয়া? এই সকল ভাবনায় অস্থির হইয়া সে ঘাটে চলিল। প্রক্ষালন পর্ব মিটিলে সে হাম্পটির ডাক শুনিতে পাইল। কুট্টুসকে সে ছাদে আটকাইয়া আসিয়াছে; হাম্পটির সহিত বিচ্ছিন্ন হইবার সময় আসিয়াছে। একদিকে ছাদের আলসে হইতে কুট্টুস চিৎকার করিয়া তাহার মাতাকে ডাক পাড়িতেছে, অন্যদিকে, নিচে হাম্পটি তাহার ছানাকে ডাকিতেছে আকুল হইয়া। এই দৃশ্য দেখিয়া মানদা আর স্থির থাকিতে পারিল না। ছাদের দরোজার অর্গল মুক্ত করিল। কুট্টুসকে বিস্তর আদর আহ্লাদ দেখাইয়া হাম্পটি এই অবস্থাতেই ছানাকে লইয়া কোথায় জানি চলিল! ‘যাক গে! মরুক গে যাক্‌!’ এই বলিয়া নিজ কর্মে মন দিল মানদা। যদিও ভিতরে ভিতরে সে কুট্টুসের জন্য অস্থির হইয়া বারংবার বাহিরে উঁকি দিতেছিল। এক প্রহর অতিক্রান্ত হইল, উহাদের সাক্ষাৎ মিলিল না। উহাদের অদর্শনে বেবো আসিয়া কান্নাকাটি শুরু করিয়াছে। তাহাকে ভুলাইতে থাকিল মানদা। ‘বাবা, তুমি তো বড় হয়েছ এখন। তোমার কিট্টি তার মায়ের সঙ্গে চলে গেছে—এটাই মেনে নিতে হবে তোমাকে। আমরা তো ওদের কেউ না, তাই না? তোমার মা যদি তোমাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায়, তুমি কি যাবে না?’ অকস্মাৎ এই উক্তি করিয়া মানদা আরও খানিক বিপাকে পড়িল। কিন্তু বাক্য একবার নির্গত হইলে কি আর ফিরিয়া আসে? ফলে বেবো কান্না ভুলিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া পড়িল এইবার। ‘আমার মা মরে গেছে! তুমি জান না? ও আমার মা নয়, আর আমাকে কোথাও বেড়াতেও নিয়ে যায় না ওরা’। ‘এ আবার কী কথা বেবো? অ্যাদ্দিন ধরে ইস্কুলে পড়াশুনো শিখে এই বুঝলে? ওরাই তোমার বাবা-মা। ওদের এমন ভাবে বলতে নেই!’

   মানদা আর বেবোর এইরূপ টানাপোড়েনে অনেকখানি সময় চলিয়া গিয়াছে। কক্ষণ যে কুট্টুস আসিয়া এক কোনে মনমরা হইয়া শুইয়া পড়িয়াছে উহারা কেহ লক্ষ্যই করে নাই। নজরে পড়িল বেবোর। কান্না, ক্রোধ, সমস্ত ভুলিয়া হর্ষে চিৎকার করিয়া উঠিল সে। কিট্টিকে ক্রোড়ে তুলিতে যাইলে দেখিল সে নিস্তেজ হইয়া বসিয়া আছে। খেলায় মন নাই উহার। অদূরে হাম্পটি দাঁড়াইয়া উহাকে ডাকিতেছে, তথাপি কিট্টি সাড়া দিতেছে না, মুখ ঘুরাইয়া বসিয়া রহিয়াছে। যেন অভিমানে সে আর সাড়া দিবে না, স্থির করিয়াছে। মানদা কিছু বুঝিল, অনেকখানিই তাহার না বোঝা রহিল। ওই যে হাম্পটি কুট্টুসকে লইয়া এই গন্ডীর আড়ালে চলিয়া গিয়াছিল, উহা ছিল কুট্টুসকে বহির্জগতের পাঠ শিখাইবার তাগিদ। ইতোমধ্যে নিশ্চয় হাম্পটি কুট্টুসকে বুঝাইয়াছে, পুনরায় মা হইলে সে আর কুট্টুসকে সঙ্গ দিতে পারিবে না, সে যথেষ্ট বড় হইয়া গিয়াছে, শক্ত খাইতে শিখিয়াছে, এইবার আপন জগত চিনিয়া লও। কাহারও উপর অবলম্বন করিও না! অতঃপর এই ক্ষণে হাম্পটি বিদায় জানাইতেছে কুট্টুসকে। তথাপি ক্ষীণ স্বরে হাম্পটি কুট্টুসকে বারংবার পিছু ডাকিয়া যাইতেছে আর কুট্টুস অভিমানে মুখ ফিরাইয়া রহিয়াছে। উহাদের দেখিয়া মানদার চক্ষু উপচাইয়া অশ্রু নির্গত হইতেছে। শুধুমাত্র মনুষ্য সমাজের অধিপতিদিগেরই কি শিক্ষাদীক্ষায় অধিকার থাকিবে? প্রকৃতি তাহার নিজস্ব পাঠক্রম সাজাইয়া রাখিয়াছে। ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্রতম জীবও এই স্থানে অনবরত শিখিতে থাকে, শিখাইতে থাকে তাহাদের পুত্রকন্যাদের। সেই পাঠক্রমে আজ কুট্টুস ছাত্র। মাতৃদেবীর নিকট সে জীবনের পাঠ লইতেছে সে।

  অবশেষে মান ভাঙিল কুট্টুসের। মাতার মুখে আলতো চুম্বন করিয়া পিছন ফিরিয়া বসিল। মাতা চলিল প্রসব করিতে। হাম্পটির জিহ্বা নির্গত হইয়া গিয়াছে যন্ত্রণায়। এক কোণে নেতাকানির বিছানায় সে উপুড় হইয়া পড়িল তৎক্ষণাৎ। সেই দিকে একটিবারও চক্ষু ফিরাইল না কুট্টুস। একটিবারও যাইবার উদ্যোগ করিল না মাতার নিকট। কোনোক্রমে দুটি মুখে তুলিল, পুনরায় চুপ করিয়া শুইয়া পড়িল। বেবোর শত ডাকাডাকিতেও কর্ণপাত করিল না। তাহার ক্রীড়ার বয়স ঘুচিয়া গিয়াছে—এই বোধ জাগিল হয়ত! আরও কত বোধ ওই অবোধগুলার ভিতরে যে সঞ্চালিত হইতেছে, তাহার সবটা কি আর মানদা বোঝে! সত্যি বলিতে, অনেক… অনেক খানি না বুঝিবার জগতে সে পড়িয়া রহিয়াছে সারা জীবন। (ক্রমশ)

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী

পর্ব ৯
পর্ব ১১
পর্ব ৯
পর্ব ১১