-এক-
১৯৫০-র শারদীয় সংখ্যার জন্য নতুন জীবন পত্রিকার তরফ থেকে দম্পতিদের জন্য একটি ‘রচনা প্রতিযোগিতা’র আয়োজন করা হয়েছিল। প্রবন্ধের বিষয় ছিল বিবাহের পর ‘প্রথম মিলন রাত্রি’ কেমন কাটিয়েছেন বর-বধূরা, তার আখ্যান বর্ণনা।

এখানে বলে নেওয়া দরকার নতুন জীবন পত্রিকাটি রাষ্ট্র এবং সমাজের চোখে বেশ বিপজ্জনক ছিল। বর্গ বিচারের প্রশ্নে ১৯৪৪-এ প্রথম প্রকাশিত নতুন জীবন-এ উল্লেখ থাকত- ‘স্বাস্থ্য, যৌনবিজ্ঞান ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ক পত্রিকা’। ১৯৫০ সালে নতুন জীবন-র বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সম্পাদক সুনীল কুমার ধর-এর বিরুদ্ধে ‘প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে’ মামলা হয়। ‘ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীযুক্ত কে, সি সেন’ সম্পাদককে অপরাধী সাব্যস্ত করে ২৫০ টাকা জরিমানা অথবা অনাদায়ে তিন সপ্তাহ সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন।১ যাই হোক, পূর্বের কথায় ফিরি। নতুন জীবনের তরফ থেকে ‘প্রথম মিলন রাত্রি’ নিয়ে বিজ্ঞাপন প্রদান করা হলেও, এই ধরনের প্রতিযোগিতাকে সমাজ কিন্তু মোটেও ভালো চোখে দেখে না। সমাজপতিরা অশ্লীলতার গন্ধ খুঁজে পান এসবের মধ্যে। খোদ সম্পাদক মশাই লিখছেন-
“রচনা প্রতিযোগিতা আহ্বান করার সময় আমার মনে সংশয় ছিল যে এই শ্রেণীর প্রতিযোগিতায় যোগদান করাকে আমাদের দেশের লেখক-লেখিকা এবং পাঠক-পাঠিকারা অশ্লীলতার পরিপোষণ বলে মনে করবেন! অবশ্য এই মনে করার পিছনে কোন যুক্তিই নেই এ কথা আমি বার বার জোর দিয়েই বলে আসছি কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি দেখেছি যে আমার দেশের শিক্ষিত নর-নারীরা এই একটি বিষয়ে এখনও ভণ্ডামী ছাড়তে পারে নি। ব্যক্তিগত জীবনে একান্ত দুশ্চরিত্র এবং বিকৃতরুচিসম্পন্ন ব্যক্তিকেও আমি পোষাকী জীবনে যৌন বিষয়ে বৈজ্ঞানিক অনুশীলনেও উন্নাসিক হতে দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেছি”।২
সম্পাদক অবশ্য একথাও বলেন যে, বর্তমানে দেশের হাওয়া একটু একটু করে বদলাচ্ছেও বটে। তারা এই প্রতিযোগিতার জন্য ১১৪ টি চিঠি পেয়েছেন। সর্বোপরি এই চিঠিগুলির মধ্যে অনেক নারীর চিঠিও রয়েছে। মহিলাদের চিঠির ক্ষেত্রে দু’ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। অনেকে চিঠিতে নিজের সম্পূর্ণ নাম প্রকাশ করেছেন। যেমন- মহিলা বিভাগে তৃতীয় স্থান অধিকারী শ্রীরাজলক্ষ্মী দেবী। আবার অনেকে শুধুমাত্র নামের আদ্যাক্ষর এবং পদবীর ব্যবহার করেছেন। যেমন মহিলা বিভাগের প্রথম স্থানাধিকারী- মী. সেনগুপ্ত। তবে পুরুষের রচনাতে স্পষ্ট ভাবেই সম্পূর্ণ নাম ব্যবহার করা হত। যেমন পুরুষ বিভাগের তৃতীয় স্থান অধিকারী- নবকুমার সিংহ।৩ মহিলাদের রচনাগুলির মধ্যে সেকালের Arranged Marriage-র অভ্যন্তরীণ ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হই আমরা। একটি মেয়ে বিবাহ রাতে কী চায়? তার কামনার রূপ কেমন? অচেনা পুরুষটির কাছে যেতে কী তার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হয়? এমন প্রশ্নই বার বার উঠে আসছিল রচনাগুলির মধ্যে। রাজলক্ষ্মী দেবী তার বয়ানে লিখছেন-
“সেই প্রথম দ্বৈধের সাক্ষী আমার ফুলশয্যার রাত্রি। সে রাতে তোমরা যারা আমায় সযত্ন প্রসাধনে সাজিয়ে মিলন কক্ষের দরজায় পৌঁছে দিয়ে গেলে; তোমরা কি একবারও ভেবে দেখেছিলে; প্রিয় সম্ভাষণে যাবার সত্যিকারের প্রস্তুতি আমার কতটুকু? আমার চরণ কাঁপে নি কোনো সপুলক সংকোচে, হৃদয়ে ছিলো না আবেগের আলোড়ন, কুন্ঠায় নত হয় নি ব্যাকুল নয়ন। শুধু অন্তরে ছিল সেই ছবি,- তাই বারে বারে ধিক্কার দিচ্ছিলাম ভাগ্যাহত হৃদয়কে। তবু সেদিন যে ছিলো সত্যি সত্যি আমার মিলনেরই পিপাসু, যার ছিল প্রথম যৌবনের সচেষ্ট অনুরাগ, সহজ দৈহিকতা, তাকেও তো সহ্য করতে পারি নি। যে তিক্ততা আমার হৃদয়কে আকণ্ঠ ভরেছিল,- মিলনের মধুপাত্রে তাই পরিবেশন করলাম আমি তাকে”।৪
একদিকে সমাজকে রাজলক্ষ্মী প্রশ্ন করছে যে, কেউ কী তার কাছে জানতে চেয়েছে, সে ফুলশয্যার মিলনের জন্য প্রস্তুত কী না। আবার অন্যদিকে নিজের শারীরিক কামনার কথাও সে গোপন করেনি। আমার শরীর তোমার সাথে মিলিত হতে চাইছে মানেই যে আমার এই মিলনে সমর্থন আছে এমন কিন্তু নয়। সদ্য স্বাধীন দেশের নাগরিক পরিসরে নাগরিক মহিলাদের একাংশ তখন রীতিমত ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। তারা নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন নতুন করে। আর এহেন পরিসরে সেকালের যৌন পত্রিকাগুলি তাদের জীবনের প্রথাগত গোপনতা গুলোকে বারে বারে যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছিল। রাজলক্ষ্মীর রচনা, মহিলাদের ব্যক্তিগত Interiority-র ইতিহাসকে সামনে আনছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে, এভাবে মহিলাদের ব্যক্তিগত Interiority-র কথা বলে আমরা কী আখেরে এক ধরনের সাধারণীকরণ-র (Generalization) ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি না? উত্তরটি হবে, অবশ্যই তাই। বিভিন্ন মেয়ের যৌন জীবনের ইতিবৃত্ত বিভিন্ন রকম হয়। কিন্তু তাও বিভিন্ন লেখা থেকে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বেরিয়ে আসে মাঝে মাঝে। তেমনই একটি বৈশিষ্ট্য হল, তাদের ব্যক্তিগত Privacy-কে, এক ধরনের গোপন পাঠক/দর্শকের সামনে তুলে ধরা। পাঠকের এই গোপনীয় বর্ণনা পাঠ করার প্রবণতা আর ব্যক্তি লেখিকার গোপনতার মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরী হয়। আরো ভালো করে বললে- একে সম্পর্ক না বলে সমঝোতা বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। যে সমঝোতার বলে দীর্ঘদিন ধরে পুরুষ শাসিত সমাজ, মহিলাদের যৌন ইতিবৃত্তের Confession কে অস্বীকার করে গেছে। পাঠকের রূপে এই ধরনের লেখা পড়ার পর সমস্ত কিছু জেনেও চুপ করে থেকেছে। History of Silence-র পরম্পরায় তাই সামাজিক ভাবেই মহিলাদের History of Privacy-র Confession হারিয়ে গেছে। মহিলাদের এই History of Privacy-র Confession কিন্তু ফুকো কথিত মধ্যযুগের চার্চ কেন্দ্রিক ক্ষমতায়ণের নঞর্থক দিক নয়। বরং তা মহিলা জীবনের নানান দ্বিধা-দ্বন্দ্বের গল্প। ঠিক এখান থেকেই অনিবার্য হয়ে ওঠে মহিলা এবং যৌনতা বিষয়ক লেখালেখি এবং ছবির একটি যথাযথ Archive তৈরি করা। আর যতদিন না যৌন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের একটি যথার্থ্য তালিকা প্রস্তুত করতে পারছি ততদিন প্রশ্ন উঠবে- মহিলা লেখিকারা কী আদৌ মহিলা, নাকী তারা আদপে ছদ্মবেশী পুরুষ? সেই ১৯৫০ নাগাদ রাজলক্ষ্মী দেবী তার স্বামীর উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন-
“প্রথম সম্বোধনের দূরত্ব নিয়ে অভিযোগ করল সে। আরও নিকটতর করে নেবার চিরাচরিত অনুরোধ জানালো। আপনির বদলে তুমি করলেই কি নিকট হওয়া যায়, অন্তরে যদি থাকে দূরত্ব? -অপ্রত্যাশিত জবাব দিলাম আমি তাকে। তবু সে বুঝলো না, এ খেলার ছলে বলা নয়, -তপ্ত হৃদয়ের অগ্ন্যুৎপাত। তার জীবনের প্রথম মিলন রাত্রিকে বাঁচাবার অন্ধ আগ্রহেই ভুল বুঝলো হয়তো। বললো- দূরত্বকে হৃদয়ের মূল্যে জয় করার সাধনাই আমার। ওর দুরাশাকে হিমালয়ের মত মনে হল। মনের মধ্যে চেয়ে দেখলাম, ভবিষ্যতের আকাশে কোথাও আলোকরেখা চোখে পড়ল না। তবু সামনে আমার ভবিষ্যতের কর্ণধার, নির্ব্বোধ স্পর্ধায় দিতে অশেষ আশা এবং আশ্বাস। এবার করুণা করলাম আমি তাকে। তার দুই চোখে উৎসাহী যৌবন,- হয় তো কতো স্বপ্নের রচনা তার হৃদয়ে,- প্রথম প্রেমের উন্মাদনায় সে দুঃসাহসিক,- কুমার-চিত্তের ধ্যানলোক থেকে বাস্তুক পৃথিবীতে নির্ব্বাসন এখনও তার সম্পূর্ণ হয় নি।” ৫
সামাজিক বিচারে দু’ভাগে বিভক্ত ‘লক্ষ্মীমন্ত’ এবং ‘পিশাচিনী/ মায়াবিনী/বাজে মেয়ে’-র বৈপরীত্যের বাইরে অবস্থান করে রাজলক্ষ্মীর মত মহিলারা। সে লক্ষ্মীমন্তও নয় আবার ‘পিশাচিনী/মায়াবিনী/বাজে মেয়ে’ -ও নয়। সে শুধু নিজের কথা লিখতে চায়। সমাজ কিন্তু কোনো পক্ষের স্বরকেই কোনোদিন চাপা দিতে চায়নি। লক্ষ্মীমন্ত মেয়েদের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তো বিপক্ষে ‘তথাকথিত বাজে মেয়ে’ দের ই চাই। পৃথিবীর নানান সমাজে কোনো না কোনো ভাবে এই পদ্ধতিই অনুশীলন করা হয়ে এসেছে। ‘পিশাচিনী/মায়াবিনী/বাজে মেয়ে’, অর্থাৎ যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তৈরী নিয়মের বুলি মানে না। এমন মহিলাদের বিরুদ্ধে পুরুষ নিজের পেশিশক্তি প্রয়োগ করে। পীড়নের রাস্তায় হাঁটে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় রাজলক্ষ্মীর মত মহিলাদের নিয়ে, যে ফুলশয্যার রাতে স্বামীকে নিজের দেহভোগ করতে দিয়ে বলতে পারে- আমি আসলে করুণা করলাম তোমায়। রাজলক্ষ্মী নিজের Home Space-র মধ্যেই নীতি নিয়মের বেড়া জাল মেনে তার প্রতিরোধের পথ তৈরি করে।
‘প্রথম মিলন রাত্রি’ এক অর্থে মহিলাদের মানসিক বলের গল্প শোনায়। কিন্তু আধুনিক নারীর শুধু মানসিক নয় শারীরিক বলও প্রয়োজন। শ্রাবণ ১৯৫০-র নতুন জীবন পত্রিকায় সদ্যস্নাতা নামে একটি আর্টপ্লেট প্রকাশিত হয়।

ছবির মহিলা একজন বিদেশিনী। এই ধরনের ছবিতে Erotic যাত্রার পাশাপাশি আধুনিক নারীর প্রতি শরীর সচেতনতারও একটা বার্তা লুকিয়ে থাকে। আধুনিকতার প্রতর্ক শুধুমাত্র মহিলাদের ঘর থেকে বাইরে আসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জড়তা কাটিয়ে সুস্থ সবল শরীর গড়ার ডাকও দেয়। সেকারণেই ১৯৫০-র কালপর্বে মহিলাদের শরীরচর্চার ইতিহাস এবং যৌনতা প্রায় অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে ছিল। শরীর চর্চার জন্যদেহ অনেক খানি উন্মুক্ত করতে হয়। ছোট পোশাক পরতে হয়। আর ঠিক এই উপাদান গুলিকে ব্যবহার করেই বাংলা যৌন পত্রিকা শরীরচর্চাকারী বা ক্রীড়ার সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের যৌন কামনার উপকরণ বানিয়ে তোলে।
-দুই-
১৯০৩ সালে প্রকাশিত অন্তঃপুর পত্রিকায় ‘জনৈক হিন্দু মহিলা’ লিখিত ‘মহিলার স্বাস্থ্য’ প্রবন্ধটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ‘কেবল মহিলাগণকর্ত্তৃক লিখিত ও সম্পাদিত’ এই পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক শ্রীমতী হেমন্তকুমারী চৌধুরী হলেও, ১৮৯৭ সনে এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বনলতা দেবীর হাতে। ‘মহিলার স্বাস্থ্য’ প্রবন্ধের লেখিকা আমাদের দেশে রমণীদের জন্য প্রকাশ্য ব্যায়ামশালা না থাকার জন্য আক্ষেপ করেছেন। ‘জনৈক হিন্দু মহিলা’ লিখছেন- আমাদের দেশে তো রমণীদের প্রকাশ্য ব্যায়ামশালা নাই, যে রমণীরা অবলীলাক্রমে পুরুষগণের সহিত সমকক্ষভাবে ব্যায়াম করিবে।৬

কিন্তু লেখিকার ব্যায়ামশালা না থাকা নিয়ে এত আক্ষেপের কারণ কী? একটা উত্তর অবশ্যই যে তিনি মহিলাদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে চান। কিন্তু স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা কী কারণে? কিছু কারণের কথা উল্লেখ তিনি করেছেন- তার মধ্যে বিভিন্ন রোগ ব্যাধির হাত থেকে মুক্তি যেমন একটি কারণ তেমনি অন্য একটি কারণ হল, সুস্থ শরীরের অধিকারী হলেই পুরুষদের ব্যভিচারী জীবন থেকে সৎ পথে আনতে পারবেন মহিলারা। দ্বিতীয় কারণটাই খানিক খোলসা করে বলা যাক। ‘জনৈক হিন্দু মহিলা’ লিখছেন যুবকদের চরিত্রহীনতার কারণ নাকি ‘পত্নীর অক্ষমতা’। আমরা বরং প্রয়োজনীয় অংশটি উদ্ধৃত করি-
‘কেন যে এতদ্দেশে যুবকগণ চরিত্র হারাইয়া দিন দিন এত নূতন নূতন ব্যাধির করালকবলে পড়িয়া অকালে প্রাণ হারাইতেছে ও জীবিত অবস্থায় নানাবিধ কুৎসিত পীড়ায় আপনি পত্নী ও ভাবী বংশধরগণের স্বাস্থ্য পর্যন্ত্য এসব বিষয় কি কেহ একবার ভাবিয়া থাকেন? সকলেই কিন্তু অসচ্চরিত্র নয়, কিন্তু বড় বড় নগরে কিরূপ হারে ঐরূপ প্রকৃতির লোক আছে বা বৃদ্ধি পাইতেছে তাহা সকলেই জানেন। আমারত বোধ হয় যে এ সকল কারণের মূল শুধু পত্নীর অক্ষমতা। গৃহে যদি লোক বিশুদ্ধ আমোদ পাইত, তবে সুধা ফেলিয়া হলাহল পান করিতে বাহিরে ছুটিত না। যে স্ত্রী স্বামীর সর্ব্ববিষয়ে সহকারিণী ও মনোরঞ্জন না করিতে পারেন তাঁহারই পতি বাহিরে যান।৭
লেখিকার আরো অভিমত- পুরুষকে পোষ মানাতে গেলে শুধু রূপ, স্বাস্থ্য বা গুণ দিয়েও সম্ভব নয়, এর জন্য একটা নতুন সাংস্কৃতিক রুচি দরকার। সেই সাংস্কৃতিক রুচির একটি উদাহরণ হতে পারে মহিলাদের গান গাওয়া অভ্যেস করা। তিনি লিখছেন-
সন্ধ্যার সময় আফিস হইতে আসিয়া একটু আমোদ-প্রমোদ গান বাজনা সকলেরই ভাল লাগে। আমার তো বোধ হয় এখনকার মেয়েরা পরচর্চাতে পটু না হইয়া যদি একটু সুকুমারবিদ্যা আরম্ভ করেন (অর্থাৎ একটু আধটু গান বাজনা শিক্ষা) তাহা হইলে তাঁহারা অনেকটা পতিদের মনোরঞ্জন করিতে পারেন; কিন্তু কেমন যে আমাদের দেশাচার ভালটুকুর দিকে কোনমতেই দেশের লোকের নজর পড়েনা। গৃহে যদি বৌ-ঝিরা পতির সহিত গান বাজনা ইত্যাদি আমোদ-প্রমোদ করিতে থাকে, তাহা হইলে শ্বশুর শাশুড়ী ও অন্যান্য গুরুজনদের তীব্র বাক্যবাণে তাহাদিগকে একেবারে নাকের জলে চোখের জলে হইতে হইবে। ছেলে বাহিরে গিয়া রাশি রাশি অর্থ উড়াইবে, নৈতিক চরিত্র হারাইবে, তাহা প্রাণে সহ্য হয়, কিন্তু বৌ যদি ছেলেকে বাধ্য বশ করিতে পারে তাহা হইলেই মহা বিপদ।৮
‘জনৈক হিন্দু মহিলা’-র কথা মাফিক ১৯০৩ নাগাদ মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যায়ামশালা না থাকলেও অন্ত উনিশ শতক থেকেই ভদ্র বাঙালি পরিবারের মহিলারা শরীরচর্চা তথা ক্রীড়ার জগতে প্রবেশ করেছিল। সবার প্রথমে বলতে হয় শ্রীমত্যা শিবকালী দেবীর কথা। পাঞ্জাব প্রদেশের রাউলপিণ্ডিতে ১৯০০ খ্রিঃ শিবকালীর জন্ম হয়। পিতা সৈন্য বিভাগে চাকরি করতেন। পিতার দেখভালেই শিবকালীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন স্বামীর মৃত্যু হলে শিবকালী বঙ্গদেশে এসে বসবাস করতে শুরু করে। ১৯২৯ সাল থেকে জনসেবা এবং শরীর চর্চায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদিত করেন শিবকালী। ১৯৩৮ নাগাদ তার প্রচেষ্টায় কলকাতায় অনেক কটা ব্যায়াম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত হতে শুরু করে। কলিকাতার Gov. Training College of Physical Education for Women –র ছাত্রী শ্রীমতী লীলা রায় ১৯৪৯ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন যাত্রা করেন পৃথিবীর প্রথম নারী শরীরশিক্ষা সম্মেলনে যোগ দিতে। লীলাই ভারতের একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি রূপে যোগদান করেছিলেন সেদিন। শক্তি সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যায়ামকুশলী শ্রীমতি শোভা ব্যানার্জী ১৯৩৪ সালে কলিকাতায় পৃথিবী বিখ্যাত হেগেনবেগ সার্কাসের ক্রীড়া প্রদর্শনী বয়কট করেন। সার্কাসের বিশাল দেহধারী ম্যানেজার তার প্রতি অসৌজন্য প্রকাশ করলে, শোভা এবং ম্যানেজারের শারীরিক যুদ্ধ শুরু হয়। রীতিমত লোকজন জমা হয়ে যায় পুরুষ এবং নারীর এই যুদ্ধ দৃশ্য দেখতে। অবশেষে যুযুৎসুর পাঁচে ম্যানেজার কুপোকাত হয়।৯
এই সব মহিলা শরীরচর্চাকারীদের অল্প পোশাক পরিহিত ছবি সেদিনের মূল ধারার পত্র-পত্রিকাতেও প্রকাশিত হত। আর এই ছবিগুলি পাঠক/দর্শকের মনে এক ধরণের Erotic বার্তা পৌঁছে দিত। ১৯৪০-র কালপর্বে ছাপা ছবি হিসাবে যেসব মহিলা শরীরচর্চাকারীদের চিত্র ছড়িয়ে পড়েছিল তারা ছিলেন শ্রীমতীলক্ষ্মী পুরকাইত(বামদিকের ছবি), শ্রীমতি শান্তি দাস, শ্রীমতী লাবণ্য পালিত প্রমুখ।

১৯৫০ সালের শারদীয় নতুন জীবন পত্রিকায় সাঁতারের পোশাক পরিহিত কুমারী নীলিমা ঘোষের ছবি প্রকাশিত হয়। ছবির Photographer ছিলেন নিতাই ঘোষ। ছবিটি সেকালের পাঠক দর্শকের মন কেড়ে নিয়েছিল। নিতাই বাবুর তোলা এই ছবি (নীচে) কিন্তু ক্রমশই চিত্রটি যৌন বাজারে পণ্য হয়ে ওঠে। ১৯৭০-র বিভিন্ন বাংলা যৌন পত্রিকায় নীলিমার এই ছবিটি প্রকাশিত হতে শুরু করে। এমনকি Blue-Photo Album-র মধ্যেও স্থান করে নেয় নীলিমার এই ছবি। অবশ্য সেখানে নীলিমার নাম ব্যবহার করা হয় নি। যে দর্শক সেই ছবি দেখছে তার কাছে নীলিমার নামের কোনো গুরুত্ব নেই। গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে ছবির Photographer-র নামও। এই সবকিছুর মধ্যে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ‘বিষয়’ রইল নীলিমার শরীর।
শারদীয় ১৯৫১-র নতুন জীবন-এও নীলিমার আরো একটি এমন সাঁতারের পোশাক পরা ছবি প্রকাশিত হয়েছে(নীচে)। এ ক্ষেত্রেও Photographer নিতাই ঘোষ। এই ছবিতে নীলিমা সাঁতার কাটতে এসে বাঁধানো ঘাটে বসে রয়েছে। এতদিনে Camera-র সঙ্গে তার একরকম বন্ধুত্বও তৈরী হয়েছে। সে জানে লাস্যময়ী হতে গেলে কেমন ভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করতে হয়। মহিলাদের স্নান সামাজিক বিচারে একটি অত্যন্ত গোপন বিষয়। তাই জলের সাথে সম্পৃক্ত রমণীদের ছবি পুরুষ পাঠক/দর্শকের মনে যৌন উদ্দীপনার ঝড় তোলে। পুরুষ কোন গোপন কিছুকে জয় করার আনন্দ অনুভব করে। তাই মহিলাদের শরীরচর্চা, ক্রীড়া এবং সরোবর বা Swimming Pool এক সারিতে রেখেছে নতুন জীবন-র মত যৌন পত্রিকা।


১৯৫১-র শারদীয় নতুন জীবন-এ মহিলা শরীরের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য ব্যায়ামের নানা ভঙ্গিমা প্রদর্শিত হয়েছে। সৌন্দর্য্যের জন্য ব্যায়াম অনিবার্য। ‘দেহ সৌন্দর্য্যের ব্যায়াম’ শিরোনামের ছবিটিতেও সেই বার্তাই যেন দেওয়া হয়েছে। ছবিতে দুটি বৃত্ত রয়েছে। বাইরের বৃত্তে ব্যায়ামের নানা অঙ্গ ভঙ্গিতে অনেক গুলি নারী শরীর। মেয়েদের মুখ স্পষ্ট নয়। ভেতরের বৃত্তে একজন সুন্দরী রমণীর মুখ। ছবিটি যেন আমাদের জানান দেয় যে এমন সৌন্দর্যের অধিকারী হতে গেলে নিয়মিত শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তা আছে।

আর সেই সুন্দর শরীর নিয়ে যদি কোন নারী জলে সাঁতরে চলে এবং সেই দৃশ্য ধরা পড়ে Camera-য় তবে পুরুষ পাঠককে আর পায় কে! অগ্রহায়ণ ১৯৫২-র নতুন জীবন পত্রিকায় এমনই একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। ছবির নাম ‘সাঁতারু মেয়ে’। দুটি মেয়ে জলে সাঁতারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শ্যামলকান্তির তোলা এই ছবি দেখে একেবারেই মনে হয় না যে এখানে চিত্রগ্রাহক সাঁতারের কৌশলকে আদৌ প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন; বরং সাঁতারু রমণীদের শরীরের হিল্লোলকেই ক্যামেরাবন্দী করতে চেয়েছেন (নীচে বামদিকে)। একইভাবেই সাঁতারের পোশাক পরিহিত আরতি সাহার ছবি ছাপা হয়েছিল ১৯৫২-র শারদীয় নতুন জীবন-এর (নীচে ডানদিকে) পাতায়। যদিও আলাদা করে চিত্রগ্রাহকের নাম উল্লেখ করা হয় নি।


উপসংহার
নীলিমা ঘোষ বা আরতি সাহা-রা সেদিনের ক্রীড়া জগতের উজ্জ্বলতম বাঙালি কন্যা। প্রথম এশিয়ান কন্যা হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পার করে ছিলেন আরতী। কিন্তু এই সব কিছু বাইরে একটি যৌন-বিজ্ঞান পত্রিকার হাত ধরে তাঁরা পাঠক/দর্শকের গোপন ব্যক্তিগত পরিসরে প্রবেশ করেন। ক্রীড়া সংস্কৃতি এবং যৌন-বিজ্ঞান পত্রিকার এই পারস্পরিক পথ চলা একটি অত্যন্ত বৃহৎ গবেষণামূলক বিষয়, তাই এই ক্ষুদ্র নিবন্ধকে তার প্রস্তাবনাও বলা চলে না।
তথ্যসূত্রঃ
১। সম্পাদনা- সুকান্ত কুমার হালদার, ‘নর-নারী’, (কলিকাতা, নর-নারী পাবলিশিং হাউস, ফাল্গুন ১৩৫৭), পৃ ১৫০
২। নতুন জীবন, শারদীয় সংখ্যা ১৩৫৭, পৃ ২০৪
৩। তদেব, পৃ ২০৫-২১৫
৪। তদেব, পৃ ২১০
৫। তদেব
৬। অন্তঃপুর, আষাঢ় ১৩১০, পৃ ৬০
৭। তদেব, পৃ ৫৯-৬০
৮। তদেব, পৃ ৫৯
৯। শ্রী বিধুভূষণ জানা, স্বাস্থ্য ও ব্যায়াম, কলিকাতাঃ কমলা বুক ডিপো, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৫০, পৃ ২১০, ২১১, ২২১৫, ২১৬
*****