পর্ব ১৪
পর্ব ১৬
পর্ব ১৪
পর্ব ১৬
-১৫-
সুবিমলবাবুর সহিত দু’একজন মান্যগণ্য ব্যক্তির আনাগোনা শুরু হইয়াছে এই গৃহে। কদাচিৎ উহাদের সহিত এক ঢ্যাঙা, ঘোড়ামুখো ফিরিঙ্গীও আসে। সেইদিন এই গৃহে সাহেব দেখিবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়িয়া যায়। সাহেবের লাল চুল, লাল দাড়িগোঁফ দেখিয়া উহাদের বড়ই আমোদ হয়। সাহেবের সাদা গাত্রবর্ণকে মরা মাছের সহিত তুলনা করিয়া নির্মল আনন্দ লাভ করে! সাহেবের হ্যাট, কোট আর লাঠি দেখিয়া উহারা সাহেবের সম্মুখেই দন্ত বিকশিত করিয়া হাসিতে থাকে। সাহেবের অবশ্য দৃকপাত নাই। তিনি এই গৃহের প্রতিটি কোণাখামচি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করিতে থাকেন। আর বিজাতীয় ভাষায় খ্যাটম্যাট করিয়া কী যেন বলিতে থাকেন তাহার সঙ্গীদের। সেই ভাষা লইয়া আরও এক প্রস্থ হাসাহাসি চলিতে থাকে। বড় গিন্নীমার বয়স হইয়াছে। বাতের ব্যথায় কাবু হইয়া বৎসরের অধিকাংশ সময় বিছানায় পড়িয়া থাকেন। তাঁহার দুই পুত্র বয়ঃস্থ হইলেও তাঁহাদের সংসারে মতি নাই। কেহই বিয়ে-থা করেন নাই। তাঁহাদের কক্ষ হইতে বিলাইতি বাজনার শব্দ ভাসিয়া আসে। কখনও বা তাঁহাদের নাটকের পার্ট বলিতে শুনা যায়। অ্যাক্টো করেন নাকি তাঁহারা থ্যাটারে। কোনোক্রমে কানাঘুষায় সংবাদ পাইয়া একদিন একজনের মুখোমুখি পড়িয়া যাইল সুবিমলবাবুর দল। সুবিমলবাবুর দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি মেলিয়া ধরিলেন তিনি। খানিক অপ্রস্তুত হইয়া কোনোপ্রকারে সামলাইয়া লইলেন সুবিমল। ভ্রাতুষ্পুত্রকে স্নেহের সুরে কহিলেন, ‘এনারা এয়েচেন। কলকাতার মানীগুণী মানুষ। আলাপ কর্’। সেযাত্রা কোনোক্রমে পার করিলেও পুত্র মারফৎ এই খবর তাহার মাতার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। বড়গিন্নী শুনিয়া প্রথমে কোঁকাইতে লাগিলেন। তাহার পরে উদ্গত অশ্রু আঁচলে চাপিয়া বলিতে থাকিলেন, ‘হায় হায়! এ কী হল গো! আজ তোর বাপও নেই যে এই নিয়ে কথা বলবে। আর তোরাও চোখ উল্টে থাকিস। এই ঠাকুরপো কোনোদিনই সুবিধের লোক ছিল না। বাড়ি বিক্রি করে আমাদের কি শেষে পথে বসাবে? এর একটা বিহিত কর্ তোরা। আমি জিজ্ঞেস করলে বলবে, তুমি এসব বুঝবে না। তোরা ওর থেকে সব জেনে নে আগে’। এই বলিয়া তিনি আবার পাশ ফিরিয়া শুইয়া পড়িলেন। অমাবস্যায় বাতের ব্যথাটা চাগাড় দিয়াছে। কিছুক্ষণ আগে এক দাসী আসিয়া উষ্ণ তৈল মালিশ করিয়া দিয়াছে। গতরাত্রে ব্যথায় ঘুমাইতে পারেন না, তাই এই অসময়ে আরামে তাহার চক্ষু মুদিয়া আসিল।
ডাম্পটিরও শরীর গতিক ইদানীং সুবিধার নাই। বৃষ্টিতে ভিজিয়া বুকে শ্লেষ্মা বসিয়াছে। বুকে ঘর্ঘর শব্দ হইতেছে আর নাসিকা হইতে সর্দি গড়াইতেছে। আহারে রুচি নাই তাহার। প্রায় অনাহারে কাটাইতেছে সে দুইদিন। তথাপি তাহার ক্রীড়া ও কিট্টিকে দেখভাল করিবার প্রয়াস অব্যাহত রহিয়াছে। মানদারও শরীরে জুত নাই। ঘামে ও জলে ভিজিয়া সর্দি বসিয়া গিয়াছে। বাসক পাতা চিবাইয়া কিঞ্চিৎ সুস্থ হইতেছে। মানদা ডাম্পটিকেও বাসক পাতা খাওয়াইতে চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু কিছুতেই সক্ষম হয় নাই। সেই হেতু ডাম্পটির শরীর সারিবার লক্ষণ নাই।বিমলবাবু মানদাকে তলব করিয়াছেন অকস্মাৎ। অগত্যা বেজার মুখে মানদা বাসক পাতা ফেলিয়া তাঁহার ঘরের দিকে চলিল। এই তলব পাইয়া সে আশ্চর্য হইয়াছে তো বটেই, উপরন্তু ভাবিতেছে না জানি কী অপেক্ষা করিয়াছে তাহার জন্য। না জানি আবার উনি কোন ফন্দি আঁটিয়াছেন ! এক্ষণে তো আর যৌবন নাই, সেই এক নিশ্চিন্তি! তাঁহার ঘরের সম্মুখে আসিয়া মানদা সাড়া দিল। সুবিমলবাবু একখানি খাতায় কী যেন হিসাব করিতেছিলেন। মানদাকে দেখিয়া মুখ তুলিলেন, বলিলেন—‘চেহারা তো এখনও দিব্য রয়েছে দেখছি। পরের বাড়ির খেয়েমেখে গতর বাড়ছে দিনকে দিন। বলি, কোনো ধারণা আছে তোমার একজনের খোরাকি বাবদ আজকাল কত লাগে!’ মানদা চুপ করিয়া থাকিল, রাগে অপমানে তাহার শরীর মন জ্বলিয়া যাইতেছিল। একটা আধপোড়া মানুষের আর কত সহ্য ক্ষমতা থাকে! মাথা নীচু করিয়া কোনোক্রমে মানদা উত্তর দিল, ‘কাজের বদলে খাওয়াপরা পাই। এটুকুই জানি।’ মানদার স্পষ্ট উত্তর পাইয়া সুবিমলবাবু আরও ক্রোধান্বিত হইয়া উঠিলেন। তিনি ভাবিয়াছিলেন মানদা হয়ত আহত হইবে, কাঁদিবে। তবে এই ধরনের প্রত্যুত্তরের জন্য তিনি বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলেন না! চোখ গরম করিয়া তিনি বলিলেন, ‘আচ্ছা??!! তাহলে এবার নাহয় কাজ আর খাওয়াপরা অন্য কোথাও জুটিয়ে নিও।’ এই কথা শুনিইয়া মানদার পায়ের তলা হইতে ভূমি সরিয়া যাইল। সুবিমলবাবু তাহাকে এই কথা বলিতে পারেন, মানদা ভাবিতেও পারে নাই! তাহার মাথা টলিতে লাগিল। কোনোক্রমে সেই ঘর হইতে ফিরিয়া আসিয়া নিজের ঘরের দাওয়ায় বসিয়া পড়িল। আজ এই বয়সে, এত বৎসর বাদে, তাহাকে উচ্ছেদ হইতে হইবে? পুনরায় আশ্রয়হীন হইতে হইবে? কোথায় যাইবে সে আবার? এই কি তোমার অন্তরের সুপ্ত বাসনা ছিল ঈশ্বর!
পলু আর কলু দুই পিঠোপিঠি ভাই। বড় গিন্নীমার সন্তান তাহারা। ইহাদের এই সংসারে বিশেষ ভূমিকা নাই। ভালমন্দ কোনো কিছুতেই ইহাদের সাক্ষাৎ মেলে না। খাওয়া, শোওয়া ব্যতীত এই গৃহ ইহাদের কোনো কাজেও লাগে না। দুই ভাই এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। তাহারা কলিকাতার থিয়েটার লইয়া এমনই মাতিয়া থাকে যে, এই গৃহই শুধু না, দেশ, দুনিয়া, কোনো কিছুতেই উহাদের নজর পড়ে না, যেমন এই কাহিনিতেও এতকাল তাহাদের সাক্ষাৎ মেলে নাই। পলু দিবারাত্রি নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখিতে ও তাহা কাটাকুটি করিতে ব্যস্ত থাকে অথবা মোটা মোটা বিদেশী পুস্তক লইয়া তাহাতে ডুবিয়া থাকে। এই সময়ে বিশ্বসংসার এদিক ওদিক হইলেও তাহার টনক নড়িবে না। আর কলু ততোধিক ব্যস্ত থাকে বাদ্যযন্ত্র লইয়া। সুরের হাওয়ায় ভাসিতে ভাসিতে তাহার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সে নিজেই সন্দিহান হইয়া পড়ে। বাঁশি, তবলা, হারমোনিয়াম ছাড়াও বেহালা এবং আরও কিছু নাম না জানা বাদ্যযন্ত্রের সহিত তাহার গভীর সখ্যতা। শোনা যায় বারবনিতাদের ধরিয়া আনিয়া তাহারা অ্যাক্টো শিখায়। নটী বিনোদিনীর দৃষ্টান্ত তুলিয়া ধরে তাহাদের সম্মুখে। ইহা ব্যতীত অনাথা বিধবাদের লইয়াও তাহারা এক উদ্যোগ গড়িয়াছে। এই কর্মযজ্ঞে থিয়েটারের বেশ কিছু সদাশয় ব্যক্তি তাহাদের সাহায্যের হাত প্রসারিত করিয়াছে। এই উদ্যোগে অনাথা আতুরদিগের রোজগারের কিছু সুরাহা হইয়া থাকে। তাহারা বড়ি, আচার, পাঁপড়ের মতো সামগ্রী প্রস্তুত করে, সেই সকল আবার আরেকটি সংস্থা বাজারে বিক্রয় করিয়া থাকে। তাহা হইতে যা আয় হয়, কারিগরদের খাওয়া, পরা, সংস্থানে ব্যয় করা হয়। এহেন মহৎ কর্মে সামিল হইলেও সমাজে দুই ভ্রাতার কিঞ্চিৎ বদনাম রহিয়াছে। তবে সেসব গুজবের মতো স্বল্পমেয়াদী হাওয়া। ইহাদের পিতা পরিমলবাবুও ছিলেন সংসার সম্বন্ধে উদাসীন। নিজের পূজাপাঠ ও গুটিকয়েক শিষ্য লইয়াই তাহার সকল সময় কাটিয়া যাইত। পুত্রদের প্রতি তাঁহার কর্তব্য ছিল লালন ও প্রতিপালনের; সেটুকু তিনি করিয়াছেন। তাহাদের বিদ্যালয় হইতে কালেজ, ইউনিভার্সিটির দুয়ারে লইয়া গিয়াছেন। খাওয়া পরার কোনো অভাব রাখেন নাই। ইহা ব্যতিরেকে তাহাদের চালচলনের উপর তিনি কোনোরূপ খবর্দারি করেন নাই। তিনি জীবিত থাকাকালীন পুত্রেরা বাধ্য হইয়া তবুও কিছু শৃঙ্খলা মানিত। তাঁহার মৃত্যুর পরে তাহাদের মাতৃদেবী বৎসরের বেশির ভাগ সময়েই অসুস্থ হইয়া শয্যাশায়ী থাকেন। ফলে মাতা পুত্রদের প্রতি তদরূপ নজর দিতে পারেন নাই।
বাকি রহিল মানদা। মানদাকে এই গৃহের ছোট সদস্যরা প্রায় সকলেই পিসী সম্বোধন করিয়া থাকে। কেবল পলু ও কলু তাহাকে ছোটমা বলিয়া ডাকে। ইহার নেপথ্যে রহিয়াছে সেই পুরাতন কাহিনী। এই পলুই সেই রাত্রে কালীবাড়ির গঙ্গার ঘাটে ডুবিয়া যাইতেছিল, আর মানদা সেইসময়ে তাহার প্রাণরক্ষা করে। পরিমলবাবুর মা, এক্ষণের বড় গিন্নীমার শাশুড়ি, বড়মার আদেশ অনুসারে মানদাকে দুই ভাই তখন হইতেই ছোটমা ডাকিয়া থাকে। শুধু সম্বোধনটুকুই নয়, ইহারা মানদাকে কিছুটা মানেও বটে। সাতসকালে উঠিয়া স্নানাদি কর্ম সম্পন্ন করিয়া ফেলে দুই জনে। মানদা তাহার পূর্বেই চা লইয়া উপস্থিত হয়। তারপর তড়িঘড়ি দুইজনের জন্য জলখাবার করিয়া আনে। কোনোক্রমে নাকেমুখে গুঁজিয়া উহারা একপ্রকার এই গৃহরূপ খাঁচা হইতে পলায়ন করে। সপ্তাহে দুইচারিদিন ব্যতীত মধ্যাহ্নভোজনে তাহাদের টিকি মেলা ভার। এই দুইচারিদিন মানদা নিজ হাতে তাহাদের যত্ন করিয়া ভাত খাওয়ায়। রাত্রেও সেই একই চিত্র। মানদা খাবার না আনিলে ইহারা হয়ত অভুক্তই রহিয়া যাইত। ক্ষুধা, তৃষ্ণার বোধও জাগে না এই দুই ভ্রাতার। রাত্রের খাওয়া সমাপন হইলে মানদা তাহাদের পইপই করিয়া অধিক সময় অবধি রাত জাগিতে বারণ করিলেও তাহারা নিজ কর্ম লইয়া মধ্যরাত পর্যন্ত জাগিয়া থাকে। নিত্যকার এই অভ্যাসেই চলিতেছিল তাহাদের জীবন ও যাপন। অকস্মাৎ সুবিমলবাবুর ক্রিয়াকর্মে ও বহিরাগত সাহেবসুবোদের আগমনে এবং তাহাদের মাতৃদেবীর ক্রমাগত অনুযোগে পলু ও কলুর টনক নড়িল।
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী