পূর্ব কলকাতার জলাভূমি : শৌচ তথা নিকাশী ব্যবস্থা , কারিগরি বিদ্যা এবং ইকোলজির সমন্বয়সাধন – ধ্রুবা দাশ গুপ্ত

 সূচি :-

– ভণিতা

– ইতিহাসের কথা

বিদ্যাধরী: একই সঙ্গে বাণিজ্যপথ ও নিকাশী নালা

কলকাতার নিকাশী ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ল

একটি মৃতপ্রায় নদীর নিকাশীর নির্গমন পথ পরিবর্তন

নিকাশী এবং ময়লা জল সামলানো

ময়লা জল এবং তার পরিশোধন – পূর্ব কলকাতার জলাভূমির আবির্ভাব

– বিস্মৃতি ও পরিবর্তন

বর্তমান কিছু সমস্যার কথা

– সমাপ্তি ‍~ জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভবিষ্যতের পথ

– শ্রদ্ধেয় যাঁরা

কলকাতা শহরের অপরিহার্য ঐতিহ্য, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি। সারা বিশ্বে স্বীকৃত এই আংশিক প্রকৃতি-ভিত্তিক, আংশিক মানব-সৃষ্ট জলাভূমিটি ময়লা জল ব্যবহার করে একটা টেঁকসই পরিশোধন ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।  ২০১৭ সালে প্রকাশিত রাষ্ট্র-সংঘের World Water Development Report এর চর্চার বিষয় ছিল ময়লা জল বা wastewater। এই রিপোর্টে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে যে এই জলাভূমি যৎসামান্য খরচায় সম্পূর্ণ প্রকৃতি-নির্ভর উপায়ে, এলাকার জলাভূমি সমাজের উদ্যোগে ময়লা জল পরিশোধন করে। একই সঙ্গে এই রিপোর্ট উল্লেখ করেছে যে সারা বিশ্বে এখনও কেবলমাত্র ২০ শতাংশ ময়লা জল পরিশোধন করা হয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে বর্তমানে জল সংকটাপন্ন একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। বহু শহরে পানীয় জলের অবস্থা বেশ শোচনীয় হয়ে আছে। বারবার বহু বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাবধান বাণী দিচ্ছেন যে নদী তথা অন্যান্য জলাধারের উপযুক্ত ব্যবহার, পাশাপাশি ময়লা জলের ও উপযুক্ত ব্যবহার হওয়া উচিত। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব কলকাতার জলাভূমির উপযোগিতা, বহমানতা এবং গুরুত্ব নিয়ে মূল্যায়ন যথেষ্ট সময়োপযোগী হবে। কলকাতা এমন একটি ক্রান্তীয় শহরের দৃষ্টান্ত যেখানে সূর্যরশ্মির প্রাচুর্য গৃহস্হের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা ময়লা জল (domestic sewage) নদীতে ফেলে দেওয়ার আগে যৎসামান্য খরচায় পরিশোধন করতে সাহায্য করে। শহরবাসীদের এর জন্য আলাদা করে কোন কর দিতে হয় না, যান্ত্রিক উপায়ে ময়লা জল পরিশোধনের খরচটা বেঁচে যায়। নগর পরিকল্পনায় এই বৈশিষ্ট্যের গুরুত্ব অপরিসীম।






পূর্ব কলকাতার জলাভূমি – আমাদের কাহিনীর গন্তব্যস্থল

বিদ্যাধরী নদী আমাদের কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু। প্রকৃতির নিয়মে নদী থাকলেই তার পাশে জলাভূমি থাকবেই। জলাভূমি যেন নদীর আদরের সন্তান, নদীর জলে লালিত-পালিত হয় সে। আর নদী মরে গেলে সেও প্রাণ হারায়। নোনা জলের জোয়ার-ভাটা খেলা নদী বিদ্যাধরীর জলাভূমি সন্তান ছিল লবণ হ্রদ, যা Salt Lake নামে পরিচিত। এই নদী ব্যবস্হা যখন ভেঙে পড়ল তখন Salt Lake এর ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। সবচেয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়াল এই এলাকার বহু মৎসচাষীর জীবন ও জীবিকা। এখানেই মানুষের সৃজনশীলতা একটি অসামান্য ভূমিকা পালন করল। দূরদর্শী বাঙালী ইঞ্জিনিয়ার ড: বীরেন্দ্র নাথ দে নতুন নিকাশী ব্যবস্হা সৃষ্টি করে শহরের মাটির নীচের নিকাশী নালাকে শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়া নিকাশী ব্যবস্হার সঙ্গে এমনভাবে জুড়ে দিলেন যে সারা বছর ময়লা জলের যোগান পেয়ে জলাভূমির চরিত্র পাল্টে গেল। সে এবার নোনা জলের জলাভূমির থেকে পাল্টে ময়লা জলের জলাভূমি হয়ে উঠল, তাতে বিপুল সংখ্যক মৎস চাষীর ভবিষ্যত অক্ষত থাকল। এবং এটাই পূর্ব কলকাতার জলাভূমির বিবর্তনের কাহিনী, যা এই লেখার মার‍্ফৎ কথার জাল বুনে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই লেখাটি চারটি ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে, যে নিকাশী সমস্যা কলকাতা শহরকে বহুদিন জর্জরিত করেছিল, তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তারপরের ভাগে এই সমস্যা কারিগরি বিদ্যার সাহায্যে এবং এলাকা-বাসীদের প্রচেষ্টায় কিভাবে সমাধান হয়েছে, তা বিস্তারিত বোঝানো হয়েছে। পরবর্তী অংশে ময়লা জল এবং তার পরিশোধন সম্পর্কে কি ধারণা ছিল এবং কিভাবে তার বিবর্তন হয়েছে, তাই নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সর্বশেষে, এই জলাভূমির সংরক্ষণ সম্পর্কিত বাধা-বিপত্তির কথা বিশেষ করে উল্লেখ করা হয়েছে। উপসংহারে খতিয়ে দেখা হয়েছে যে শহরের পরিকাঠামো কি করে দীর্ঘমেয়াদি হবে, ইতিহাস ঘেঁটে আমরা এই বিষয়ে কি কি শিক্ষা পেতে পারি।

ইতিহাসের কথা –

ভারতবর্ষে আসার অব্যবহিত পরেই চতুর ইংরেজ ব্যবসায়ীরা দেশের নদীপথগুলি মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করতে থাকে এবং সেই বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠে। কলকাতাকে ইংরেজরা রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়েছিল, তাই ব্যবসা-বাণিজ্য সুচারু ভাবে চালু রাখার জন্য, বিশেষ করে সুজলা সুফলা বঙ্গভূমির ব-দ্বীপের পূর্ব এবং পশ্চিম দিকের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা খুবই প্রয়োজন ছিল। এর জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ছিল শহরের কাছে নদীর। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদী বলতে শহরের কাছে ছিল বিদ্যাধরী নদী (কে নাম দিয়েছিল কে জানে!)। পূর্ব বাংলার ব-দ্বীপ তখন অনেকটাই পরিপক্ক হয়ে গিয়েছে (mature delta)  কিন্তু পশ্চিম বাংলায় সেটা হয়নি। বিদ্যাধরীর কাজ ছিল জোয়ার-ভাটায় পলিমাটি এনে, তার বিভিন্ন শাখা উপশাখার মাধ্যমে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং ব-দ্বীপ তৈরীর কাজ সম্পন্ন করা। এই বিদ্যাধরীর সংলগ্ন অনেকগুলি জলাধার / জলাভূমি ছিল – এগুলি নোনা জলের জলাভূমি ছিল, যাদের ইংরেজরা নাম দিয়েছিল Salt Lakes বা লবণ হ্রদ। বিদ্যাধরীর একটি বড়শাখা (spill channel) ছিল Central Lake Channel – এইটি বিংশ শতাব্দীর গোড়া অবধি কলকাতা শহরের নিকাশী বহন করে সুন্দরবনের দিকে যেত। বিদ্যাধরীর আর্বিভাব সুন্দরবনে, তারপর এটি হাড়োয়া দিয়ে বইত এবং হাড়োয়া  গাঙ নামে পরিচিত ছিল। এর পরবর্তীতে এটি পশ্চিম দিকে গমন করে, এবং নোনা খাল বলে একটি ছোটো নদী এর সঙ্গে এসে মেশে। তারপর বিদ্যাধরী দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গিয়ে বেলেঘাটা খাল এবং টলির নালার সংযোগ-স্থলে পৌঁছায়, সেখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গিয়ে মাতলা নদীর সঙ্গে মিশে যায়।






প্রথম ম্যাপ – বিদ্যাধরীর যাত্রাপথ

বিদ্যাধরীর প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে একটি বাণিজ্যের উপযুক্ত জলপথ গড়ে উঠল, এই পথে কলকাতা এবং পূর্ববঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা পোক্ত হল।  প্রথম এল ১৭৭৫ – ৭৭ সালে টলির নালা – মেজর উইলিয়াম টলি এই খালটি নিজের খরচে খনন করেছিলেন। এইটি পুরানো আমলে আদি গঙ্গা নামে পরিচিত ছিল – এটি গঙ্গার পুরাতন যাত্রাপথ ছিল। মেজর টলি পুরাতন খিদিরপুর ডকের কাছে একটি পূর্ব অবস্থিত খালের মুখ এবং বিদ্যাধরী নদীর উপর তারদহের কাছে আর একটি খালের মুখ আবিষ্কার করে এই  দুটিকে জুড়ে দিয়েছিলেন, এইভাবে টলির নালা তৈরী হল। এই খালটি দিয়ে নৌকা পার হতে গেলে মেজর টলিকে কর দিতে হত।  এর আগে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সমস্ত নৌকা পূর্ববঙ্গ থেকে আসতে গেলে সুন্দরবনের নদী-নালা হয়ে আসতে  হত, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক ছিল। এই  জলপথ কে বলা হত Outer Boat Route.  জলপথে যাতায়াতের জন্য কলকাতার কাছে আর একটি খাল ছিল যার নাম Old Eastern Canal – এইটিও Salt Lake এর মধ্যে দিয়ে এসে কলকাতা শহরে ঢুকত। এইটি ধাপা এলাকার থেকে Entally পর্যন্ত আসত এবং এই খালটিকে Entally Canal অথবা বেলেঘাটা খাল (Beliaghata Canal) বলা হত। বেলেঘাটা নামটি ধাপার কাছে বালিয়াঘাট নামের গ্রাম থেকে নামকরণ হয়েছিল।

East India Company যখন ভারতবর্ষে আসে তারা বিভিন্ন শহর বেছে নেয় এবং আনুষঙ্গিক এলাকা প্রশাসনের জন্য Presidency আখ্যা দিয়ে এই সব জায়গায় প্রশাসনিক পরিকাঠামো তৈরী করে। Calcutta Presidency তৈরী হয় Madras Presidencyর পরেই। Calcutta Presidency এলাকায় সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে যেই কাজ করা হয়, তার দায়িত্বে ছিল Military Board। এই Military Board এর অধীনে একটি পদ ছিল খাল রক্ষণাবেক্ষণ করা যার দায়িত্বে ছিলেন Superintendent of Canals। এই পদে নিযুক্ত Lieutenant J.A, Schalch  ১৮২১ সালে প্রস্তাব দেন যে গ্রীষ্মকালে জলপথে যাতায়াত করার জন্য এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোরজন্য একটি খাল পরিকাঠামো তৈরী করা হোক। এতে বঙ্গদেশের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশে চলাচলকারী নৌকার থেকে যে জলকর পাওয়া যাবে, তাতে খাল খননের খরচ দ্রুত উঠে আসবে এবং কোম্পানির ঘরে যথেষ্ট পরিমানে অর্থ রোজগার হবে। খুলনায় গড়াই নদী এবং কলকাতার চিৎপুরে  হুগলী নদীকে, পরপর বয়ে যাওয়া বেশ কিছু চালু খাল এবং কিছু নতুন খনন করা খাল জুড়ে বাণিজ্য পথে যুক্ত করা হবে, এমনই চিন্তাভাবনা করা হয়ছিল।

টলির নালা তখন খুবই নৌকাবহুল খাল ছিল, এবং সেই ভারাক্রান্ত অবস্থার পরিবর্তন আনার জন্য Schalch প্রস্তাব দেন যে চিৎপুর থেকে বেলেঘাটা খাল পর্যন্ত তৎকালীন Circular Road এর সমান্তরালে একটি খাল খনন করা হোক, যার নাম দেওয়া হল Circular Canal, যদিও এটি গোলাকৃতি ছিল না। এই খালটি বেলেঘাটা খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। জোয়ার-ভাঁটার জন্য চিৎপুরে একটি জল-নিয়ন্ত্রক গেট বা Lock Gate তৈরী হয় ১৮৩৩ সালে। কলকাতা থেকে বিদ্যাধরী হয়ে তারপর কিছু পুরাতন খাল হয়ে ইছামতি নদীতে পৌঁছে হাসনাবাদ হয়ে পূর্ব বাংলায় পৌঁছানোর যাত্রাপথ তৈরী হল। চিৎপুর এবং ধাপায় কর দিতে হত সমস্ত পণ্যবাহী নৌকাগুলিকে। ওদিকে Hastings Bridge এর কাছে টলির নালার উৎসমুখে এবং ১১ মাইল পরে পাঁচপোতায় কর আদায় করা হত। পরে টালি নালার যাত্রাপথে আরও কর আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

এই দুটি বাণিজ্যপথই নিম্নোক্ত মানচিত্রে দেখানো আছে।






দ্বিতীয় ম্যাপ – ২টি বাণিজ্যপথ

১৮৪৩ সালে বঙ্গ সরকারের (১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ জয়ের পর ইংরেজ East India Company কলকাতাকে রাজধানী করে নিজেদের সরকার চালাচ্ছিল)। এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক (Undersecretary) Military Board কে জানায় যে এই বাণিজ্যপথ থেকে সরকার ১৫,১৪,৭৮২ টাকা লাভ করেছে, সমস্ত খরচ বাদ দেওয়ার পরে।

এই জলবাহী বাণিজ্যপথ (1814 km, তার মধ্যে 76 km ইংরেজদের খনন করা) বিশ্বের অন্যতম পথ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে – এখান দিয়ে বছরে এক মিলিয়ন টন পণ্যদ্রব্য যাতায়াত করত যার মূল্য ছিল চার মিলিয়ন পাউন্ড (£4 million)।  এই বাণিজ্যপথের দ্বারা যেই সব অঞ্চল যুক্ত হয়েছিল সেগুলি হল দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা, খুলনা, ফরিদপুর এবং বাখেরগঞ্জ (বরিশাল জেলার রাজধানী, এখানে ধান প্রধান ফসল ছিল)। এছাড়া ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের উপত্যকায় উৎপাদিত খাদ্যশস্য। তাছাড়া অন্যান্য অনেক খাদ্য পণ্য এবং ভোগ্যপণ্য এই জলপথ বেয়ে কলকাতায় আসত। নিম্নোক্ত মানচিত্রে এই বড় ছবিটা বুঝিয়ে দেওয়া আছে।






তৃতীয় ম্যাপ –বাণিজ্যপথের বড় ছবি

বিদ্যাধরী: একই সঙ্গে বাণিজ্যপথ ও নিকাশী নালা

টলির নালা এবং সার্কুলার খাল বানিয়েই থেমে থাকেনি ইংরেজরা। ১৮৫৯ সালে তারা New Cut Canal খনন  করে। উল্টোডাঙ্গায় এই খালটি Circular Canal এর সঙ্গে যুক্ত হয়, তারপর ধাপা পর্যন্ত যায়। এছাড়াও আরও জল নিয়ন্ত্রক গেট বা Lock Gate ১৮৮৩ সালে ধাপাতে তৈরী হয় এবং চিৎপুরে এই একই সালে পুরাতন Lock Gate পাল্টে নতুন Lock Gate তৈরী করাহয়। তারপর ১৮৯৫ – ১৮৯৭ সাল অবধি ভাঙ্গর খাল তৈরী হয় (কিছুটা পুরাতন খাল ছিল আর বাকিটা খনন করা হয়) এবং বিদ্যাধরী নদীর উপর (বামনঘাটা এলাকায়) এবং কুল্টি নদীর উপর Lock Gate তৈরী করা হয়। এই সমস্ত কাজ ক্ষতিগ্রস্ত ক্রমাগত করে যাওয়ার ফলে বিদ্যাধরী নদীর মূল শাখা – Central  Lake Channel – দ্রুত পলিমাটি জমে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিদ্যাধরী নদীর উপর এই কারিগরি প্রয়োগের কালপঞ্জি আসন্ন তালিকায় দেওয়া হল।

বিদ্যাধরী নদীর ক্ষতিগ্রস্ত হবার আরও কিছু কারণ ছিল। এক সময় নোনা গাঙ, নোওয়াই আর সুঁতি নদী বিদ্যাধরীতে মিশত, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা গতিপথ পালটে কুল্টি নদীতে গিয়ে মেশে। প্রকৃতির কোন অদ্ভুত এক খামখেয়ালিপনায় এই পরিবর্তন হয় এবং এর ফলে বিদ্যাধরী নদীতে নোনা জলের পরিমাণ আরও কমতে থাকে।  এছাড়া, ১৮৩০ সাল এর কিছু আগে থেকে বিদ্যাধরীর বয়ে যাবার রাস্তায় বেশ কিছু নোনা ভেড়ি ছিল যাতে মাছ চাষ, বিশেষ করে চিংড়ি চাষ হত।জোয়ারের সময়েই ভেড়িগুলিতে নোনা জল ঢুকিয়ে নেওয়া হত এবং এটা চিংড়ি চাষের পক্ষে উপযুক্ত ছিল। একই সঙ্গে এই এলাকায় নদী বাঁধও ছিল।এই সব কারণে নদী তার বয়ে আনা পলিমাটি পাড়ে এবং চারিপাশে জমিয়ে ব-দ্বীপ সম্পূর্ণ করার কাজে ক্রমাগত বাধা পেত। এতে শুধু উর্বর মাটির ব-দ্বীপ সৃষ্টিই ব্যাহত হল না, জোয়ার ভাটা খেলার স্বাভাবিক ধর্ম পালন না করতে পেরে পলিমাটি জমে নদীর স্বাস্থ্যও প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেল।  ১৯২৮ সালে সরকার ঘোষণা করলো যে বিদ্যাধরী নদীর পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করা কোনোভাবে সম্ভব নয়, সরকারের সেই রকম কোন ইচ্ছাও আর দেখা গেল না। 

সারণি– ১    বিদ্যাধরী নদীতে কৃত্রিম ভাবে খাল খনন ও তার কু-প্রভাবের কালপঞ্জি

সাল

কারিগরি বিদ্যা প্রয়োগ করে করা কাজের নাম

ফলাফল

মন্তব্য

১৭৭৭

টলির নালা খনন

বিদ্যাধরীর অনেকটা জলসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নদীর নীচের অংশে পলি জমে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে।

১৭৯০

দুধবিবি খালে (বিদ্যাধরীর শাখা) বাঁধ দেওয়া হল – এলাকাটি তারদহের কাছে

নদী উত্তরের দিকে বয়ে যাবার পথ বাধাপ্রাপ্ত হল।

 

১৮১০

বেলেঘাটা খাল কারিগরি বিদ্যা দিয়ে কিছু পরিবর্তন করে শিয়ালদহের কাছে Entally পর্য্যন্ত নিয়ে যাওয়া হল।

নদীর স্বাভাবিক নিকাশীর রাস্তা বাধাপ্রাপ্ত হল।

 

১৮৩০-৩৩

Circular Canal এবং চিৎপুর Lock Gate নির্মাণ।

বিদ্যাধরী বা Central Lake Channel এর বেলেঘাটার দিকের অংশ পলি পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে  লাগল।

 

১৮৫৯

উল্টোডাঙ্গা থেকে ধাপা পর্যন্তNew Cut Canal তৈরী হল।

 

পণ্যবাহী নৌকার চাপ কমানার জন্য করা হল।

১৮৬৫

পঞ্চান্নগ্রাম বাঁধ দেওয়া হল

স্বাভাবিকভাবে বিচরণে বাধাপ্রাপ্ত নদী তার স্বাভাবিক বিচরণ করা বন্ধ করে দিল।

নিকাশী সমস্যা দেখা দিল।

১৮৮৩

ধাপাতে এবং চিৎপুরে Lock Gate  নির্মাণ – চিৎপুরে পুননির্মাণ হল ।

Central Lake Channel ক্ষতিগ্রস্ত হল কারণ ধাপা থেকে Entally পর্যন্ত জলের গতিপথ বন্ধ হল।

১৯২৭ সালে ধাপা  Lock Gate অকেজো করে দেওয়া হয়।

১৮৯৬

বিদ্যাধরীর শাখা কাটাতলা গাঙে আড়াআড়ি বাঁধ (Cross Dam)পড়ল

নদীর ভেতর পলিমাটি দ্রুত জমে গেল।

 

১৮৯৫-১৮৯৭

পুরানো ভাঙ্গর খাল খনন করে বামনঘাটা থেকে কুল্টি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হল।

নদীকে বয়ের নালা এলাকায় বন্ধ করে দেওয়া হল।

বাণিজ্যের সুবিধার্থে করা হল।

১৮৯৭

বামনঘাটা Lock Gate তৈরী হল।

Central Lake Channel বা বিদ্যাধরী নদী অতি দ্রুতগতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে লাগল।

ভাঙ্গর খালের নির্মাণের প্রক্রিয়া সমাপ্ত হল।

১৯১০

New Cut Canal এবং ভাঙ্গর খাল জুড়ে কৃষ্ণপুর খাল তৈরী হল।

বিদ্যাধরীর 78 km2অববাহিকা এলাকা নষ্ট হয়ে গেল।

বিকল্প বাণিজ্য পথ তৈরী হল।






ম্যাপ ৪ – বিদ্যাধরী নদীর উপর কারিগরি

কলকাতা নিকাশী ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ল –

বিদ্যাধরী নদীর প্রধান অংশ Central Lake Channel কলকাতার তরল বর্জ্য বহন করে নিয়ে যেত এবং একই সঙ্গে বাণিজ্য পথ হিসেবেও কাজ করত। এই Central Lake Channel-এ কারিগরি বিদ্যার ক্রমাগত আক্রমণ কলকাতার নিকাশী ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল, উপরন্তু নদীর উপর অত্যধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে নদীরও প্রভূত ক্ষতি হয়েছিল। পুরোনো কলকাতার বেহাল নিকাশী ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন Lord Wellesley (১৮০৩ সালে), ডাক্তার James Ranald Martin এবং সরকারের দ্বারা সংগঠিত Fever Hospital Committee। কলকাতা পুরসভার প্রথম ইঞ্জিনিয়ার William Clarke কলকাতার শহরের জন্য মাটির তলায় অবস্থিত একটি নিকাশী ব্যবস্থার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এইটিই আজ পর্যন্ত বিদ্যমান। এটি প্রথম ১৮৫৫ সালে প্রস্তাবিত  হয় এবং চুলচেরা বিচারের পরে ১৮৫৮ সালে গৃহীত হয়। নির্মাণ কার্য্য শেষ হয় ১৮৭৫ সালে। তরল বর্জ্য Central Lake Channel-এ গিয়ে পড়ত।

বিদ্যাধরী নদীর পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বেশ কিছু প্রশাসনিক জটিলতা ছিল। বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে বঙ্গ সরকার তার Irrigation দপ্তরের মাধ্যমে নদী পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং তারই সঙ্গে রাজস্ব আদায় করত। এই দপ্তরই নিকাশী বয়ে নিয়ে যাওয়া নদীর স্বাস্হ্য বজায় রাখত এবং তার জন্য অর্থও ব্যয় করত। অপর দিকে কলকাতা পুরসভার কাজ ছিল পুর পরিষেবা হিসেবে নিকাশী নির্গমন ব্যবস্হার সুষ্ঠ পরিচালনা করা। এই কাজের জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তারাই করত, সেই ক্ষেত্রে আংশিক অথবা সম্পূর্ণ ব্যয়ভার তাদের বহন করতে হত। কিন্তু প্রতিটি পরিকল্পনার জন্য তাদের সরকারের থেকে সম্মতি তথা অনুমোদন চাইতে হত, আবার সরকার অনেক সময় প্রকল্পের জন্য অর্থও দিতেন। এই গোলমেলে দায়িত্ব ভাগাভাগির জন্য ময়লা জলের নির্গমন ব্যবস্হা নিয়ে বিভ্রাট উপস্হিত হল।

কলকাতার নিকাশী নক্সা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল (ক) Town System (খ) Suburban System. Clarke এর নক্সা শুধু Town System কে মাথায় রেখে তৈরী করা হয়েছিল, আয়তন ছিল 21 Km2। ময়লা জলের নালাগুলির জন্য যে নক্সা প্রস্তুত করা হয়েছিল তাতে তারা মাটির অন্তর্গত জল বা subsoil water, বাড়ীর থেকে নির্গত জল বা house drainage আর বৃষ্টির জল বা storm water শহরের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে। ২৪ ঘন্টায় ৬ ইঞ্চি বৃষ্টির জল গ্রহণ করা আর শুকনোর সময় প্রতিদিন ১০ মিলিয়ন গ্যালন ময়লা জল গ্রহণ করার ক্ষমতা ছিল এই ময়লা জলের নিকাশী ব্যবস্থার। নিকাশী খালের থেকে ময়লা জল গ্রহণ করতো Palmer’s Bridge Pumping station. হঠাৎ ১৮৮১-৮২ সালে সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী Circular Canal-এ ময়লা জল নিকাশীর অনুমতি বন্ধ করে দেওয়া হল এবং পুরসভাকে নিজের খরচে হালসিবাগান এলাকা থেকে pumping station অবধি একটি নতুন নিকাশী নালার নির্মাণ করতে হল। এই নালাটি সোজাসুজি একটি বড় নিকাশী খালে ময়লা জলের সম্পূর্ণটা ফেলে দিত।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে নানান কারণে নিকাশী খাল এবং তার পরিকাঠামোর উপর খুব চাপ পড়ে। এই কারণগুলি ছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পানীয় জলের সরবরাহ বৃদ্ধি, পাকা রাস্তা তৈরী (যার জন্য ওই জায়গাগুলিতে মাটির উপরের জল নীচে আর যেত না) এবং শহরের ভেতরের অনেক জলাধার বন্ধ হয়ে যাবার ফলে বৃষ্টির জল শহরের রাস্তায় নিত্যদিন দাঁড়িয়ে যেত। তখন ১৮৯৬ সালে Kimber এবং Hughes নামে দু’জন ইঞ্জিনিয়ার, Baldwin Latham  নামে আর একজন বিশ্ববিখ্যাত এবং অভিজ্ঞতা–সম্পন্ন ইঞ্জিনিয়ার-এর সঙ্গে পরিকল্পনা করে নিকাশী ব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারণ করে একটি নক্সা তৈরী করলেন। তৎকালীন সরকার এতে সম্মতি দেয় ১৯০০ সালে। এর কর্মসূচী রূপায়ন করতে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত লেগেছিল। এর তালিকা নিম্নে দেওয়া হল।

ক)    দুটো উঁচু ময়লা জলের খাল Town এবং Suburban System থেকে,  যথাক্রমে Palmer’s Bridge এবং Ballygunge pumping station থেকে নিকাশী এবং বৃষ্টির জল গ্রহণ করে বিদ্যাধরী নদীতে ফেলে দেবে, এই ব্যবস্থা করা হল।

খ)     Town এবং Suburban ব্যবস্থার সঙ্গে ময়লা জল ধরে রাখার আলাদা আলাদা জলাধার যুক্ত ছিল যার ক্ষমতা ছিল জোয়ারের ৮ ঘন্টা ময়লা জল ধরে রেখে ভাটার ৪ ঘন্টা সেই জলটাকে বের করে দেবার। নিম্নোক্ত ছবিতে এই কাজের নক্সা দেওয়া হল।






নিকাশী ব্যবস্থা সম্প্রসারণের নক্সা, হস্তচিত্র

বিদ্যাধরী নদীর গুরুতর ক্ষতির চিহ্ন ১৯০২ সালে নদীর কারিগরি নক্সা বানাতে গিয়ে প্রথম Jacobs সাহেবের চোখে ধরা পড়ে। দুই বছর Irrigation দপ্তর এই খবর চেপে রাখার পর Chief Engineer D.B. Horn এই তথ্য প্রকাশ্যে আনেন। তখন পুরসভা নিকাশী ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য ২৯,৪৩,০০০ টাকা লগ্নি করার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল, অথচ তারা এই গুরুতর ক্ষতির খবর পেয়েও বিন্দুমাত্র সাবধান হয়নি। কারণ হিসেবে হয়ত Horn এর রিপোর্টের একটি লাইন উদ্ধৃত করা যেতে পারে ‘Although deterioration of the Lake Channel will continue, it is more than probable, that it will remain sufficiently large to carry away sewage.’ অর্থাৎ নদী ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকলেও তার ময়লা জল বহন করে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা থেকে যাবে।

১৯১৩ সালে পূর্ত দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার O.C. Lees এবং C. Addams Williams স্পষ্ট ভাষায় সরকার এবং পুরসভাকে সাবধানবাণী জানান যে আগামী ৬ বছরের মধ্যেই নদীর ময়লা জল বহন করার ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে। ১৯১৪ সালে Addams Williams নদীর অববাহিকা এলাকার সম্প্রসারণ করবার পরিকল্পনা সরকারকে জমা দেন। সরকার ৩ বছরের জন্য কোন গুরুত্বই না দিয়ে পরিকল্পনাটি ফেলে রাখে এবং তারপরেও আংশিক কাজই করা হয়।

নদীর ক্ষতি প্রথমবার ধরা পড়ে ১৯০২ সালে এবং ক্ষতি রোধ করার চেষ্টা হয় ১৫ বছর বাদে, ১৯১৭-১৮ সালে – এই অত্যধিক লম্বা সময়ে নদী সমস্ত সংশোধনের সীমা অতিক্রম করে এবং Salt Lake এলাকা থেকে সরে যায়। কোন প্রকৃতি-বান্ধব উপায়ে তাকে ফিরিয়ে আনা যায়নি। 

যে সংশোধন প্রক্রিয়া ১৯১৮ সালে শুরু হয় তা ৬ বছর ধরে চলে এবং ২০ লক্ষ টাকা খরচ হয়, কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়। ১৯২৭ সালে ধাপা Lock Gate নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয় এবং ১৯২৮ সালে বঙ্গ সরকার কলকাতা পুরসভার Chief Executive Officer-কে জানিয়ে দেন যে এই জলপথে বাণিজ্য কমে গিয়েছে। সরকার আরও জানায় যে তারা এই বিষয়ে আর কোন দৃষ্টিপাত করবে না – প্রকারান্তরে বলা যে বাণিজ্য বহাল রাখা ছাড়া তাদের আর কোন বিষয়ে আগ্রহ অবশিষ্ট নেই। পুরসভার কাছে নদীর পরিচর্যা এবং সংরক্ষণের জন্য কোন প্রয়োজনীয় তথ্য ছিল না, সেটা বরাবর Irrigation দপ্তর দেখাশুনা করত। এই দপ্তর কেবল বাণিজ্য এবং রোজগারে আগ্রহী ছিল, তাই নদীর ক্ষতি নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি। নিজেদের তথ্য থাকলে হয়ত পুরসভা পূর্ব দিনের কিছু কিছু কার্যকলাপে বাধা দিত।

একটি মৃতপ্রায় নদীর নিকাশীর নির্গমন পথ পরিবর্তন –

১৯২৬ সালে কলকাতার পানীয় জল সরবরাহ দ্বিগুণ করা হয় কিন্তু নিকাশী সমস্যার কোন সমাধান না হওয়ায় ময়লা জলের নির্গমন পথের অবস্থা উত্তরোত্তর খারাপ হতে থাকে। সমস্যার সমাধানের জন্য বিদ্যাধরী কমিটি গঠন করা হয়, সেখানে প্রয়োজনীয় সব দপ্তরের প্রতিনিধিরাই ছিলেন। সকলে মিলে ঠিক করলেন যে ১,৭১,০০,০০০ টাকা খরচা করলে একটা নতুন স্হায়ী পরিকল্পনা বানানো যাবে। তাতে নতুন করে মাটির নীচে আরও বেশী এলাকা জুড়ে ময়লা জলের জলপথ বানাতে হবে, তৎকালীন দুটি pumping station তুলে দিয়ে একটি নতুন pumping station তৈরীর কাজ করতে হবে তোপসিয়ায়। কলকাতার পুরো ময়লা জল এবং বৃষ্টির জল একটি জায়গায় পৌঁছে যাবে যেখান থেকে পাম্প করে জোয়ার – ভাটা নির্বিশেষে বিদ্যাধরীতে নির্গমন হবে। পুরসভা এটি মেনে নিলেও নিজেদের অর্থনৈতিক ক্ষমতাসীমিত হবার জন্য প্রকল্পটি রূপায়ণ করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া বিদ্যাধরী নদীর অবস্থা খুবই খারাপ হওয়াতে নদীকে আরও বেশী করে ব্যবহার করা সম্ভব ছিলনা।

এই বিপদগ্রস্ত অবস্থায় ১৯২৯ সালে ইঞ্জিনিয়ারদের শীর্ষস্থান Glasgow শহর থেকে কারিগরী শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং বিদেশে কর্মরত মেধাবী বাঙালী ইঞ্জিনিয়ার ড. বীরেন্দ্রনাথ দে’কে বিদেশ থেকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি অনেক অনুরোধের পরে ফিরে এসেছিলেন এবং Special Officer Drainage হয়েছিলেন। ওনার দায়িত্ব ছিল কলকাতার এই ময়লা জল নির্গমনের পথ খুঁজে বার করা (Outfall Scheme) এবং একই সঙ্গে শহরের ভেতরের নিকাশী ব্যবস্থারও উন্নতি করা (Internal Drainage Scheme)। ওনার নিযুক্তির ছয় মাসের মধ্যে উনি Internal Drainage Scheme ৬৫ লক্ষ টাকার মধ্যে তৈরী করা যাবে বলে প্রস্তাব করেন এবং কুল্টি নদীর সঙ্গে যুক্ত Outfall Scheme ৩৭ লক্ষ টাকা ব্যয় করা সম্ভব হবে বলে প্রস্তাব দেন। Internal Drainage Scheme-এ চালু pumping station এর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করা হল এবং তপসিয়া ও ধাপাতে দুটি নতুন pumping station বসানোর ব্যবস্থা করা হল। নিকাশী খাল, জলাধার এবং আনুষঙ্গিক ময়লা জলের শাখা খাল এবং উপর্যুপরি পরিকাঠামো আরও বিস্তার করা হল, এবং বর্ষার ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ খাল দিয়ে নিকাশীর নির্গমনের ব্যবস্থা করা হল।

ঠিক হল যে শহরের নিকাশী এক জোড়া খালের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব দিকদিয়ে বয়ে যাবে,এটা গিয়ে মিশবে এমন নদীতে যাতে জোয়ার-ভাটা খেলে এবং যেটি রায়মঙ্গল নদীর মোহনার সঙ্গে যুক্ত। এই খাল দুটির নাম হবে Dry Weather Flow (DWF) এবং Storm Weather Flow (SWF)-এরা Kulti নদীতে গিয়ে মিশবে। DWF খালে cement এর প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল, যাতে যত তাড়াতাড়ি যত বেশী সম্ভব জল বহন করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্হা থাকে।

Dr. B.N. Dey হুগলী নদীকে নিকাশী গ্রহণ করার নদী হিসেবে দুটি কারণে ব্যবহার করতে চাননি। সেগুলি হল (ক) অত্যন্ত জনবহুল এই নদীর ধারে কাজের জন্য জমি পেতে বিপুল  অর্থব্যয় হত (খ) হুগলী যেহেতু পানীয় জলের নদী ছিল, ময়লা জল পরিশোধনের সঠিক ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত নদীতে নিকাশী ফেলা যেতনা এবং শহরের বিপদ অনেক বেশী বেড়ে যেত (Chicago শহরে এই কাজটি করতে ৮ বছর সময় লেগেছিল)। ১৯৪৫ সালে নিকাশী সম্পর্কে একটি অনুসন্ধান কমিটি তৈরী হয়। এই কমিটির নাম ছিল Committee to Enquire into the Drainage Condition of Calcutta and Adjoining Areas. এদের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে Dr. Dey বলেন হুগলী নদীর জল খুব সীমিতভাবেই নিকাশীর সঙ্গে যুক্ত থাকা উচিত – জোয়ারের সময় নিকাশী খাল পরিষ্কার করা এবং ভাটার সময় অতিবৃষ্টির জল বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া, এই উঁচু-স্তরে অবস্থিত হুগলী নদীকে কখনই নিকাশী নদী বা ময়লা জলের নদী হিসাবে ব্যবহার হওয়া উচিত নয়।

Dr. Dey ১৯৩০ সালে সরকারকে তার Outfall Scheme বা ময়লা জল নির্গমনের পরিকল্পনা জমা দেন কিন্তু তা গৃহীত হয়নি, বলা হয়েছিল যে ময়লা জল নদীতে ফেলার আগে জমে থাকা কঠিন বর্জ্য বা solid waste কে আলাদা করে tank তৈরী করে যতদূর সম্ভব ময়লা জলের থেকে আলাদা করে দিতে হবে। এই পদ্ধতি তখন England এ চালু ছিল। সরকারের নির্বাচিত ইংরেজ বিশেষজ্ঞদের দেওয়া বিকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিদ্যাধরী নদীকে অবশ্যই পুনরুজ্জীবিত করা যেত। আশ্চর্যভাবে, সরকারের নিজের ইঞ্জিনিয়ার Addams Williams অনেক আগেই বলেছিলেন যে এই শহর অচিরেই নিজের ময়লা জলে নিজেই ডুবে যাবে কিন্তু সরকার বা তার বিশেষজ্ঞরা, যারা Addams Williams এর পরে এসেছিলেন, তারা কিছুতেই এই কথা বিশ্বাস করতে চান নি। তারা অনেক সময় ধরে কোন সম্মতি দেন  নি। ইতিমধ্যে Dr. Dey পুরসভার প্রথম বাঙালী Chief Engineer হয়ে যান, আর দুই সহযোগী হন Executive Engineer (Drainage) P.C. Bose এবং নদী জরিপের কাজে নিযুক্ত Outfall Engineer A. N. Banerjee। সরকারের চাহিদা মত নদীতে আগে নিকাশী ময়লা জলে উপস্থিত কঠিন বর্জ্য বের করে দেবার জন্য Sedimentation Tank এবং Lagoon অর্থাৎ ময়লা জল থিতিয়ে যাবার আধার এবং অন্যান্য কিছু ব্যবস্থা সহ এনারা নতুন পরিকল্পনা এবং নক্সা জমা দেন। এই ব্যবস্থাগুলি শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে বানতলায় করা হবে বলে স্থির হয়। এর জন্য খরচ বাবদ ৪৮ লক্ষ টাকা  ধার্য করা হয়। সরকার ১৯৩৫ সালে এই প্রস্তাব অনুমোদন করে দেয়।

নিকাশী এবং ময়লা জল সামলানো– 

সরকার যে প্রস্তাব গ্রহণ করে তার দুটি অংশ ছিল; দুটি ময়লা জল নির্গমনের খাল তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল, তারই সঙ্গে ছিল কঠিন বর্জ্য খালে এবং নদীতে যাতে না যেতে পারে তার জন্য আলাদা করে tank এর দ্বারা কঠিন বর্জ্য ধরে রাখা এবং পরবর্তী কালে tank পরিষ্কার করে দেওয়ার পরিকল্পনা। Dry Weather Flow বা DWF খালটির বহন ক্ষমতা ছিল ৭০০ কিউসেকের কাছাকাছি (about 700 cusecs) অথবা 57m3/s.বর্ষার সময় অতিরিক্ত জল বের করে দেওয়া ছিল শহরের মূল সমস্যা। SWF খালের  ভিত ছিল 45.72m চওড়া (বা 150 ফুট)। DWF খালের ভিত ছিল 4.87m চওড়া (বা 16 ফুট)। দুটি খালের ঢালের আনুপাতিক সংখ্যা বা ratio ছিল 1.5:1. SWF খালটি কলকাতা শহরের জন্য তৈরী হলেও তার ১৭ মাইল (17 miles বা 28 km) যাত্রাপথে এটি একটি বিশাল গ্রামীণ এলাকার মধ্যে দিয়ে যায় এবং 331.5km2বা ১২৮ স্কোয়ার মাইল এলাকার নিকাশী সমস্যার সমাধান করে দেয়। SWF খাল DWF খালের দক্ষিণে ছিল, এবং শেষ অংশে পৌঁছে কোনো পাম্পের ব্যবহার ছাড়াই জমির ঢালের সহায়তায় এবং প্রাকৃতিক উপায়ে শহরের নিকাশী যথাসময়ে পরিশ্রুত হয়ে কুল্টি নদীতে পড়ত। যেখানে এটি সম্পন্ন হত, এবং আজও হয়, সেই জায়গাটির নাম ঘুষিঘাটা।






Dr. B.N. Dey পরিকল্পিত নতুন নিকাশি ব্যবস্থা, হস্তচিত্র

SWF এবং DWF খাল ঘুষিঘাটায় নিয়ন্ত্রিত হয় Sluice Gate এর মাধ্যমে। কুল্টি নদীতে জোয়ার ভাটার সময় অনুযায়ী এই Sluice Gate গুলি জল আটকে রাখে অথবা ছেড়ে দেয়। প্রথমে SWF খালের উপর ১৬টি sluice gate এবং DWF খালের উপর ৫টি Sluice Gate করা হয়। এই কাজ ১৯৪০ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যায়।

এই নতুন নিকাশী ব্যবস্থার কাজ চলাকালীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং মাল-মশলার তীব্র সংকট দেখা দেয়। তা সত্ত্বেও sedimentation tank নির্মিত হয়ে যায় এবং ১৯৪৫ সাল থেকে এই tank দুটি কাজ চালু করে দেয়। কঠিন বর্জ্য বা solid waste খালে পৌঁছবার আগে এখানে থিতিয়ে যেত। যুদ্ধের সময় আকাশ থেকে বোমা পড়ার প্রবল আশঙ্কা ছিল। তাই এই  নিকাশী ব্যবস্থার কাজ করবার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল, এবং খুব কষ্ট করে হলেও কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়। তবে DWF-এর দ্বিতীয় অংশের কাজ ১৯৪৫-এ শেষ করা যায়নি।

বিদ্যাধরীর বহন-ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবার ফলে এত সঙ্কটাপন্ন অবস্থা হয়েছিল যে SWF খাল অর্ধ-সমাপ্ত অবস্থাতেই চালু করতে হয়েছিল।

কলকাতা পুরসভার একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ১৯২৩ সালে চালু হয়েছিল যার নাম Calcutta Municipal Gazette. এটি সুভাষচন্দ্র বসু চালু করেছিলেন এবং বিদ্যাধরী নদীর সঙ্গে যুক্ত নিকাশী সঙ্কটের কাহিনী বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। এইখানে লিখতে গিয়ে Outfall Engineer A.N Banerjee ১৯৪১ সালে বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন স্থানীয় জমিদারেরা বুঝতে পেরেছেন যে তারা অল্প কিছু পয়সার বিনিময়ে তাদের সুবিধাগুলি ভবিষ্যতে ধরে রাখতে পারবেন। তাদের দেয় অর্থ দিয়ে পুরসভার খাল পরিচর্যার কাজ করবে এবং বেশ কিছু জমিদার এই অর্থ দিতে রাজি হয়ে পুরসভার কাছে প্রস্তাব রেখেছেন।






জলাভূমির প্রথম ম্যাপ

ময়লা জল এবং তার পরিশোধ– পূর্ব কলকাতার জলাভূমির আবির্ভাব

সরকারি Irrigation Engineer এবং পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে বিদ্যাধরী নদীতে অপরিশ্রুত ময়লা জল ফেলার ব্যাপারে তীব্র মতপার্থক্য ছিল। প্রথম দল সবসময় দাবি করত যে ময়লা জল ফেলার জন্যই বিদ্যাধরী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় দল দাবি করত যে Sanitary Commissioner of Bengal এর রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতার ময়লা জল খুব বেশি পরিমাণে ক্ষতিকারক ছিল না, কারণ এটা মানুষের বাড়ি থেকে নির্গত হয়েছিল।

১৯৪৪ সালে Chief Engineer হিসেবে পুরসভায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন P.C. Bose, যিনি আগে Dr. B.N. Deyর executive engineer ছিলেন। ইনি ময়লা জলের চরিত্র বিশ্লেষণ করার দায়িত্বে ছিলেন এবং নিজের গবেষণাগারে (Laboratory) অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। গৃহস্থের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা ময়লা জলের গুণগত চরিত্র নিয়ে গবেষণা করেছিলেন এবং তৎকালীন বিজ্ঞানীদের লেখা পড়েছিলেন। উনি বলেছিলেন যে নদী নালা খাল ইত্যাদি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার জন্য একটা দূষণ নিয়ন্ত্রণের মাত্রা ঠিক করে দেওয়া উচিত এবং এটি বজায় রাখা উচিত।

১৯২৮ সালে যখন বিদ্যাধরী নদী তার নোনা জলের সরবরাহ হারিয়ে ফেলল, তখন স্থানীয় একজন জমিদার ১৯৩০ সাল থেকে অল্প অল্প করে ময়লা জল ব্যবহার করেমাছ চাষ শুরু করে। তার চেষ্টার ফল খুব ভাল হয় এবং ক্রমে ক্রমে একটা বড় এলাকা জুড়ে মাছ চাষ শুরু হয়। কিন্তু এলাকায় নিকাশীর সমস্যা ছিল বলে মাছ উৎপাদনের ক্ষতি হত। SWF খাল বেশ নীচু করে তৈরী হবার ফলে নিকাশী সমস্যার যথোপযুক্ত সমাধান হল। DWF খালের মাধ্যমে সারা বছর মাছের ভেড়িকে ময়লা জলের যোগান দেওয়া হবে–এই পরিকল্পনা করেই তৈরী হয়েছিল। গরম কালে বিশেষ করে এই ময়লা জলের চাহিদা থাকত, তবে শুধু DWF এর উত্তর ভাগের ভেড়িগুলিই সুবিধা পেত। এরপরে বানতলাতে ময়লা জল নিয়ন্ত্রণের জন্য ১০ টি জল নিয়ন্ত্রক Lock Gate তৈরী হল, একটি ৮ কিমি লম্বা শাখা খাল তৈরি করা হয়েছিল  যা থেকে উপশাখা দিয়ে বিভিন্ন ভেড়িতে ময়লা জল যেত। জল যাতে DWF-এর দক্ষিণ ভাগেও পৌঁছোয়, তার জন্যে লালকুঠি এলাকায় ১৯৬০ সালে একটি Siphon এর ব্যবস্থা করা হয়, তাতে DWF-এর জল দক্ষিণ ভাগের মানুষের মাছ চাষের জন্য যোগান দেওয়া হল।

যে পরিকল্পনার দ্বারা সারা বছর ময়লা জলের যোগানের ব্যবস্থা হল, তাতে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ময়লা জলে মাছ চাষ এবং অন্যান্য চাষ ছড়িয়ে পড়ল। এর ফলেই তৈরী হল পূর্ব কলকাতার জলাভূমি।






মাছের ভেড়ির বিস্তারিত ছবি

সারণি ২ – কারিগরি বিদ্যার দ্বারা খাদ্য উৎপাদন তথা ময়লা জল পরিশোধনের জন্য পূর্ব কলকাতার জলাভূমির বিবর্তন ।

কাজের বর্ণনা

সাল

পরিণাম

মন্তব্য

SWF খাল তৈরী শেষ হল

১৯৩৯

মাছের ভেড়িরা ময়লা জলের যোগান এবং নিকাশী ব্যবস্থা দুই-ই পেল।

এই খাল দিয়ে বর্ষাকালের বাড়তি জল যেত এবং ঘুষিঘাটায় গিয়ে ১৬ কপাটের গেট (sluice gate) দিয়ে জল কুল্টি (Kulti)  নদীতে গিয়ে পড়ত।

১৯৬৫ সাল অবধি বামনঘাটা থেকে ভাঙ্গড় (ঘুষিঘাটার কাছে) অবধি নৌকা চলত।

DWF খাল দুই ভাগে সম্পূর্ণ  হল।

১৯৩৬-১৯৪৫, প্রথম ভাগ

১৯৪৭-১৯৫৩, দ্বিতীয় ভাগ

ভেড়ির মালিকেরা ময়লা জল পেতে আরম্ভ করে।

ময়লা জলের বিতরণ আরও ছড়িয়ে দেবার জন্য ব্যবস্হা করা হল।

ঘুষিঘাটায় ৫ কপাটের গেট (sluice gate) তৈরী হল।

৯ থেকে ১৭ মাইল পর্য্যন্ত খাল খননের কাজ হল, কপাটের সংখ্যা ৫ থেকে ২০ অবধি বেড়ে গেল।

বানতলা জল নিয়ন্ত্রক গেট তৈরী হল

১৯৪৫-১৯৪৬

DWF এর উত্তর ভগের মাছের ভেড়িরা বেশী জলের যোগান পেল।

শহরে Town অংশ থেকে যে নিকাশী খাল বানতলায় এসেছিল, তার উপর এই Sluice Gate তৈরী হল।

Fishery Feeding Channel বা ফিসারী ফিডিং খাল

১৯৪৭ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যে নির্মিত

বানতলা Sluice Gate থেকে কারিগরি কৌশলে ৮ কিমি (8 km) দূর পর্যন্ত ময়লা জল পৌঁছে দেওয়া গেল।

শাখা খাল যার থেকে অনেক উপ-শাখা খাল বেরিয়েছে, বহন ক্ষমতা 12.74m3/s বা ৪৫০ কিউসেক (450 Cusecs) – বানতলা থেকে কড়াইডাঙ্গা এলাকা পর্যন্ত যায়।

লালকুঠী Siphon

১৯৬০

এই এলাকার দক্ষিণ অংশে মাছ এবং ধান উৎপাদন বেড়ে গেল

Siphon এর ৩টে মুখ আছে, প্রতিটি ১২০০ মি.মি চওড়া।

কয়েকটি siphon যার মাধ্যমে কিছু ভেড়ি Town অংশের নিকাশী খালের সঙ্গে জুড়ে যায়।

১৯৪৭-১৯৫০ এর মধ্যে

উত্তর দিকের মাছের ভেড়ির মালিকরা উপকৃত হল।

পরাণ চাপরাসী খাল এবং নাওভাঙ্গা খাল Town অংশের নিকাশী খালের সঙ্গে যুক্ত হল।

ধাপা লক (Dhapa Lock) pumping station নির্মাণ

বিল্ডিং ১৯৪১ সালে হয়, pumping station ১৯৫৮ সালে হয়।

গ্রীষ্মের সময়ের ময়লা জল Town অংশের নিকাশী বড় খালে পৌঁছে দেবার জন্য নতুন Feeder/সংযোজক খাল তৈরী করতে হয়।

মানিকতলা pumping station থেকে ময়লা জল এই নতুন নির্মিত station-এ আসে – মানিকতলা station-এ Town অংশের কিছু নতুন নিকাশী এলাকা জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।

তোপসিয়া pumping station নির্মাণ

১৯৭২

Palmer’s Bridge এবং বালিগঞ্জ pumping station-এর একটি  অংশের ময়লা জল DWF খালে এসে মেশে, আরও পাওয়া যায় তোপসিয়া এলাকার নিকাশী ময়লা জল।

শহরের Suburban অংশের বেড়ে যাওয়া জায়গাগুলির নিকাশী এখানে আসে। এই এলাকায় কিছু পূর্ব অবস্থিত পুকুর বুজিয়ে ফেলা হয়েছে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য – শহরের Town অংশের মূল নিকাশী বহন নালা এবং Suburban অংশেরনিকাশী বহন নালা বানতলায় পৌঁছে যাবার পরে মিশে যায় এবং SWF খাল চালু হয়।

১৯৪৪ সালে কলকাতায় একটি আলোচনাসভা হয় যাতে মৎস্য চাষে শহরের বাসিন্দাদের বাড়ির ময়লা জল ব্যবহার বিষয়ক কথাবার্তা হয়। কলকাতা পুরসভা এবং মৎস্য দপ্তর এতে অংশগ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরে সারাদেশে প্রবল খাদ্য সংকট দেখা দেয় এবং একটি স্লোগান চালু হয় Grow More Food, আরও খাদ্য উৎপাদন কর। এই সময়ে অল্প দামে পুষ্টিকর খাবার হিসেবে মাছের চাহিদা খুবই বেড়ে যায়। তৎকালীন মৎস্য অধিকর্তা ডঃ সুন্দর লাল হোরা বলেন যে এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে ময়লা জল ব্যবহার করে মাছ উৎপাদন করলে সবচেয়ে উপযুক্তভাবে ময়লা জল পরিশোধনের কাজ সম্পন্ন হবে।

এই কথাটাই এই এলাকার মাছ চাষীরা গ্রহণ করেছিলেন, তাদের জীবন দর্শন হিসেবে। এই বানতলা থেকে কড়াইডাঙ্গা পর্যন্ত নির্মিত Fishery Feeding Channel অনেক মাছের ভেড়িতে ময়লা জল যোগান দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখে। বিদ্যাধরী এই এলাকা থেকে চলে গেলেও তার শাখা উপশাখা এবং পরে সরকারের দ্বারা নির্মিত তথা ব্যক্তি মালিকদের কিছু নির্মিত খাল বা প্রশাখা খাল–সব একে অপরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পুরসভার ময়লা জলের খালের সঙ্গে যুক্ত হবার ফলে এদের চাষের এলাকা বেড়ে গেল এবং পরে মাছ চাষের সঙ্গে সঙ্গে সব্জী এবং ধান চাষেরও বৃদ্ধি হল। এই এলাকার ভৌগলিক চেহারা নিম্নোক্ত ছবিতে দেওয়া আছে। ১৯৬৬ সালে পুরসভা এই নিকাশী দায়িত্ব irrigation দপ্তরকে দিয়ে দেয় তখন কঠিন বর্জ্য আটকে দেবার tank গুলিতে আর তেমন কাজ হচ্ছিল না। কিন্তু ময়লা জল থিতানোর কাজ ভেড়িগুলিই করছিল।






কারিগরি নির্মাণ এবং পূর্ব কলকাতার জলাভূমির ভৌগলিক চিত্র

বিস্মৃতি ও পরিবর্তন –

১৯৬৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) Engineering Consortium নামে আমেরিকার কারিগরি-বিদ্যার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কে কলকাতা পাঠায়। তারা এখানে এসেছিল নগর পরিষেবার ব্যবস্থা (পানীয় জল, নিকাশী এবং ময়লা জল) আরও উন্নত করতে, জলবাহী রোগ যাতে সম্পূর্ণ কমে যায়। ময়লা জল পরিশোধনকে এঁরা কোন গুরুত্বই দেয়নি। তারা বলে যে বানতলায় অবস্থিত জল পরিশোধন ব্যবস্থা বাঁচিয়ে তোলার কোন প্রয়োজন নেই। সেই সময় হুগলী নদীর জল সুপেয় ছিল। তাঁরা DWF-কেও গুরুত্ব দেননি, শুধু SWF এর পরিচর্যা করবার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। পূর্ব কলকাতার জলাভূমিকে শহরবাসী মনে রাখেনি, তাই কেউই সঠিকভাবে Engineering Consortium-কে এই জলাভূমির গুরুত্বের কথা জানাননি, কারণ তারা নিজেরাই জানতেন না। বরং ভারত সরকারের আয়ত্তাধীন গঙ্গাকে পরিশ্রুত করার পরিকল্পনা Ganga Action Plan পূর্ব কলকাতার জলাভূমির পরিশোধনের এই ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়েছিল। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গার উপর অবস্থিত সমস্ত শহর যারা নদীতে ময়লা জল অপরিশুদ্ধ অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে, তাদের ময়লা জল পরিশোধনের বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান খুঁজতে সাহায্য করা।

এই জলাভূমির মুখ্য প্রবক্তা ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ যখন ১৯৮০ র দশকে প্রথম এই জায়গায় আসেন, তিনি বুঝেছিলেন যে এই জলাভূমি হল অগভীর পুকুর যা DWF থেকে ময়লা জল পায় এবং সেই জল পরিশোধন করে। এতে শহরের কৃত্রিম ব্যয়বহুল উপায়ে ময়লা জল পরিশোধনের খরচ বাঁচে। Ganga Action Plan এর প্রকল্পে কলকাতার জন্য যখন কম খরচের ময়লা জল পরিশোধনের ব্যবস্থা অনুসন্ধান করার নির্দেশ এসেছিল তখন, তিনি কঠোর পরিশ্রম করে জাতীয় পরিবেশ মন্ত্রকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই জলাভূমিকে প্রকৃতি–বান্ধব উপায়ে কম খরচে ময়লা জলের পরিশোধন-ব্যবস্থা অর্থাৎ low cost sanitation option for wastewater treatment হিসাবে স্বীকৃতি নিয়ে এসেছিলেন।

ময়লা জলের যথেষ্ট জোগান পেয়ে সময়ের সাথে সাথে এখানকার চাষীরা এই জলটাকে সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করে মাছ, সব্জী এবং ধান চাষ করার সুসংগতিপূর্ণ উপায় বার করে ফেলে। তারা ময়লা জলকে পোষক হিসেবে দেখতে শেখে, দূষক হিসেবে নয়। তথাকথিত পুঁথিবিদ্যায় পারদর্শী না হওয়ার জন্যই তারা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে নিজেদের জীবনদর্শন পরিপুষ্ট করেছিল এবং পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিল। এই সাধারণ জ্ঞানের গুণপনার থেকে আমাদের শিক্ষিত সমাজের অনেক কিছু শেখার আছে।

একই সঙ্গে  ময়লা জল ও যত্ন করে পরিশোধিত হল। ময়লা জল মাছের পুকুরে (একে ভেড়িও বলা হয়) একটা নির্দিষ্ট পরিমাপে প্রবেশ করানো হয় এবং ২১ দিন পুকুরে থিতোনোর সময় দিতে হয়। পুকুরে Algae বা শ্যাওলা থাকে, আর ময়লা জলে এক ধরনের পোকা থাকে যার নাম Faecal Coliform, এদের দুজনের মধ্যে Carbon Dioxide এবং Oxygen আদান প্রদান হয়, পদ্ধতিটিকে বলে Algae Bacteria Symbiosis. এছাড়া সূর্য-রশ্মির সাহায্যে জৈব প্রথায় খাবার তৈরী হয় সালোক- সংশ্লেষের (Photosynthesis) এর মাধ্যমে। এই একাধিক জৈব-রাসায়নিক (Biochemical) পদ্ধতির দ্বারা Algae-র পরিমাণ বেড়ে যায় এবং সেটিই মাছের খাবার হিসেবে কাজ করে। একই সঙ্গে Faecal Coliform-এরও রাসায়নিক পরিবর্তন হয় এবং সে তার ক্ষতিকারক চরিত্র হারিয়ে ফেলে। ক্রান্তীয় দেশের শহরে যেখানে প্রচুর সূর্যরশ্মি আসে, সেখানে শহরের ময়লা জল পরিশোধনের সবচেয়ে ব্যয়সাধ্য উপায় হল অগভীর পুকুরে সূর্য-রশ্মির উপস্থিতিতে ময়লা জলে মাছ চাষ।

এই মাছ খাবারের পক্ষে কতটা উপযুক্ত এবং নিরাপদ এই নিয়ে বিভিন্ন সময় গবেষণা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। মনে রাখতে হবে যে খাবার সময় মাছের আঁশ, কানকো এবং ডানার অংশ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে, মাছ ভালো করে ভেজে তবে খাওয়া হয়, তাই তাদের ক্ষতিকারক কোন অংশ খাবার হিসেবে আমাদের খাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। বর্তমান গবেষণার দ্বারা এটা প্রমাণিত যে সঠিক নিয়ম ও প্রযুক্তির মাধ্যমে ময়লা জল ব্যবহার করে উৎপাদিত খাবার গ্রহণ মানব শরীরের পক্ষে নিরাপদ।

ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ ১৯৮১ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত এই জায়গার নামকরণ,  মানচিত্র অঙ্কন, বিশ্বের দরবারে তার কাহিনী তুলে ধরা, Ganga Action Plan-এর প্রেক্ষিতে জলাভূমির স্বীকৃতি প্রাপ্তি এবং তারপরে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন Ramsar জলাভূমির স্বীকৃতি প্রাপ্তি – এই সবকিছুর পেছনে নিষ্ঠা সহকারে কাজ করেছেন। তারপর তিনি তার সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে East Kolkata Wetland Management Authority তৈরী হয় যাতে জলাভূমি সংরক্ষণের প্রশাসনিক দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা যায়।

জলাভূমির কিছু টুকরো ছবি

বর্তমান কিছু সমস্যার কথা

১৯৬০ এর দশকে এই এলাকাটির একটা বড় অংশকে জলাভূমির চরিত্র পালটে মানুষের বসবাসের জায়গা হিসেবে তৈরি করা হয় এবং এখানকার মাছ উৎপাদন অনেকটা কমে যায়। সেই নগরায়ণ ছিল পরিকল্পিত নগরায়ণ আর আজকের দিনে জলাভূমিতে চোরাগোপ্তা অপরিকল্পিত নগরায়ণ জলাভূমির চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মৎস্যজীবীদের ক্ষতি আগেও হয়েছিল, এখনও হচ্ছে। ২০১৫ সালে Indian Council of Social Science Research এর সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান Eastern Regional Centre একটি গবেষণার সূচনা করে যার দ্বারা বোঝা যায় যে ১৯৯৭ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সারা বছর চলে এমন ভেড়ির সংখ্যা ২৬৪ থেকে কমে ২০২ হয়েছে। জলাভূমির মানচিত্র যখন প্রথম করা হয়, তখন মৌজা সংখ্যা ছিল ৩২। তার মধ্যে একটি বড় মৌজা ছিল ভগবানপুর মৌজা। ২০০১ থেকে ২০১১ এর মধ্যে এই মৌজার জনসংখ্যা চারগুণ বেড়ে যায়। জল অংশ ২০০২ সালে ছিল ৮৮ শতাংশ, ২০০৬ সালে ৫৭ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ১৯ শতাংশ। বসবাসের অংশ ২০০২ তে ০.১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে ১৩ শতাংশ হয়ে যায়।

ময়লা জলের অভাব

শহরের জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ময়লা জলের যোগান কমে যাচ্ছে। এর কারণ খতিয়ে দেখার তেমন চেষ্টা করা হয়নি, তবে বর্তমানে কিছু গবেষণা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে শহরের মাটির নীচের ময়লা জলের বাহক খালগুলি পরিষ্কার করা দ্রুত প্রয়োজন। তাছাড়া ভেড়ি খনন ও প্রয়োজন। অর্থের অভাবে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি হচ্ছে না। এর জন্য যে সমস্যা তৈরী হচ্ছে তাতে খাদ্যের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, মানুষের জীবিকার অনিশ্চয়তা বেড়ে যাচ্ছে। আমরা এক অবশ্যম্ভাবী বিনাশের দিকে তাকিয়ে আছি।

এখনকার নিকাশী ও ময়লা জল নির্গমনের সমস্যা

২০০১ সালে World Bank কলকাতা পুরসভার অনুরোধে নিকাশী ও ময়লা জল নির্গমনের উপর একটি রিপোর্ট তৈরী করে যাতে বলা হয় ৪.৪ মিলিয়ন লোক এখানে বসবাস করছে, গত ৩-৪ দশকের এই অতি-দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ময়লা জলের বহমানতা পরিবর্তিত হয়েছে এবং pumping station এর সংখ্যা প্রচুর বেড়েছে। রিপোর্টে বলা হয় যে খাল সংস্কার নিয়মিত করতে হবে, বানতলার Lock Gate সারাতে হবে (সম্পন্ন হয়েছে) আর ঘুষিঘাটাতে pumping station বসাতে হবে। এটি সম্পর্কে আরও গবেষণার মাধ্যমে pumping station এখন আদৌ দরকার আছে কিনা, তা IIT Kharagpur খতিয়ে দেখছে। যে সমস্যাটি একটুও আলোচিত হয়নি সেটি হল সাধারণ মানুষের চেতনার অভাব, তারা কঠিন বর্জ্য ময়লা জলের খালে ফেলে দেয় এবং তাতে খাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।






Storm Weather Flow, Dry Weather Flow and Town Head Cut are long-lead channels that carry sewage out of the city to the River Kulti, out of Kolkata, over a distance of 17 miles. Prepared by Dhruba Das Gupta on behalf of SCOPE, Kolkata

সমাপ্তি ‍~ জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভবিষ্যতের পথ

কলকাতা শহরের ময়লা জল পূর্ব কলকাতার জলাভূমিকে টিকিয়ে রেখেছে, আবার জলাভূমি নিখরচায় ময়লা জল পরিষ্কার করে শহরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই পারস্পরিক সহাবস্থানের রূপকারেরা আজ থেকে নব্বই বছর আগে যে কতটা দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন, সেটা আজকের এই জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম বাস্তবের দিনে তীব্রভাবে উপলব্ধি করা যায়। শহরের বাইরে নিকাশী নিয়ে যাওয়া যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ততটাই প্রয়োজনীয় ছিল শহরের অভ্যন্তরীণ নিকাশী ব্যবস্থার সঠিক পরিকল্পনা, সেই সবকিছুই ড: বীরেন্দ্র নাথ দে’র হাত ধরে গড়ে উঠেছিল‍ – তিনি pumping station এর সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে আরো বৃদ্ধি পায়। এই ১৭ মাইল লম্বা নিকাশী খাল তৈরী হবার ফলে অতিবৃষ্টিতেও শহরের দীর্ঘ সময় জলমগ্ন হবার আশঙ্কা থাকেনা। জলবায়ু পরিবর্তনের নিরিখে অতিবৃষ্টি এবং দীর্ঘায়িত প্লাবনের হাত থেকে আমরা রক্ষা পাই। নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে শহরের নিকাশী ব্যবস্থা, ময়লা জল পরিশোধন ব্যবস্থা এবং খাদ্য উৎপাদক জলাভূমির এই সমন্বয় সাধন আমাদের শহরকেটিকে থাকতে সাহায্য করেছে।

কারিগরি বিদ্যা জনস্বার্থে এবং প্রকৃতি-বান্ধব উপায় মেনে কাজে লাগালে যে ফল ভালো হতে পারে, এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ পূর্ব কলকাতার জলাভূমি। শহরের কাছে খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকলে আসলে যে শহরটার টিকে থাকার ক্ষমতা (sustainability) বৃদ্ধি পায়, এই জলাভূমিটি তার প্রমাণ হিসেবে বিদ্যমান। বিশেষ করে Irrigation দপ্তর খুব ভালো করে বোঝেন যে এই নিকাশী ব্যবস্থা কলকাতা শহরকে ধারণ করে রেখেছে। সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হল যে জলাভূমি সমাজ এই এলাকার ecology-কে ধরে রেখেছে এবং ময়লা জল ব্যবহার করে গ্রাম এবং শহরের পরিকাঠামোগত সমন্বয়কে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মানুষের সৃজনশীলতা সঠিক দিকে পরিচালিত হলে যে Ecology এবং সমাজ দুটোই টিকে থাকে, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি তা প্রমাণ করে দেখিয়েছে।

শ্রদ্ধেয় যাঁরা

এই লেখাটি কয়েকজন নমস্য ব্যক্তিত্বের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন। ড: বীরেন্দ্র নাথ দে অন্যতম, তিনি আমাদের শহরের আগামীর নিকাশীর রূপকার ছিলেন। পি.সি বোস তাঁর পরেই এসে কেবলমাত্র পূর্বসুরীর কাজ এগিয়ে নিয়ে যান নি, তিনি স্মরণীয় থাকবেন ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার জন্য এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আগামী প্রজন্মকে সজাগ করার জন্য। ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ এই আশ্চর্য অথচ বিস্মৃত জলাভূমির কাহিনী পুনরুজ্জীবিত করে সারা বিশ্বকে ময়লা জল দিয়ে জীবিকা নির্বাহের জীবনদর্শনের সঙ্গে পরিচিত করিয়েছিলেন, সেটি মনে দাগ কেটেছিল। আর আছেন বর্ষীয়ান মৎস্যজীবী তপন মন্ডল যিনি জলাভূমিকে নিয়ে আমার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। জলাভূমি সমাজ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের দ্বারা এই শহরের বেঁচে থাকার চাবিকাঠিকে টিকিয়ে রেখেছেন। সব শেষে শ্রদ্ধা জানাই মাকে, ওঁর খুব আগ্রহ ছিল পুরো লেখাটা দেখে যাবার, কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত ওঁর আশীর্বাদের উপলব্ধিটুকুই আমার সম্বল ছিল।

 
প্রচ্ছদ ও ছবিসমূহঃ ধ্রুবা দাশগুপ্ত ও অমৃতা চট্টোপাধ্যায়
দোহাই
 

 

*****

 

পুনশ্চঃ   এই লেখাটি এর আগে Institute of Civil Engineering (ICE), UK দ্বারা  প্রকাশিত ” Engineering History and Heritage” সংকলন -এ “East Kolkata Wetlands : Integrating sanitation, Engineering and Technology” নামে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। ধ্রুবা দাশ গুপ্ত থার্ড লেন-এর পরিবেশ সংকলন উপলক্ষে ICE-এর অনুমতিসহ লেখাটি অনুবাদ করেছেন।