১
– আপনি প্লিজ কিছু করুন ডঃ মজুমদার। এইভাবে চলতে থাকলে আমি কিন্তু সত্যিই পাগল হয়ে যাব।
– অত উতলা হবেন না সামন্ত বাবু। মাথা ঠাণ্ডা করুন। এটা যে একটা স্নায়ুরোগ, এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আপনার অবান্তর ভয়টা এখন একটা নার্ভের ব্যামোর রূপ নিয়েছে।
– তাই যেন হয় ডাক্তার বাবু, ভদ্রলোক প্রায় ফুঁপিয়ে উঠলেন। রোগ হলে তার একটা নিরাময় নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু কোনও অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপার হলে তো তার কোনও সহজলভ্য সমাধান নেই। এই মানসিক চাপ আমি যে আর নিতে পারছি না।
– আপনি এত তাড়াতাড়ি এমন ভয় পেয়ে গেলে কি করে চলবে মিস্টার সামন্ত? আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার সামনের চেয়ারে বসা লোকটাকে পর্যবক্ষেণ করতে করতে বললাম, “ঘটনাগুলো প্রাকৃতিক না অতিপ্রাকৃতিক, তা নির্ধারণ করা আমার কাজ। আগে আমাকে জিনিসটা দেখান।”
ভদ্রলোক তার সাইডব্যাগ থেকে জিনিসটা বার করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। একটা পুরনো আমলের ফাউন্টেন পেন। গাঢ় নীলবর্ণ কলমটা টিউবলাইটের আলোয় ঝকঝক করছিল। ক্যাপটা খুললাম। পেনের নিবটা সম্ভবতঃ সোনার। নিবের ডগায় একবিন্দু লাল কালি লেগে ছিল। সব মিলিয়ে একটা সাধারণ গড়পড়তা সেকেলে ফাউন্টেন কলম ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হল না। রাইটিং প্যাডটা কাছে টেনে নিয়ে তাতে আঁচড় কাটার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অনেক ঝাঁকাঝাঁকি করা সত্ত্বেও, কলমটি থেকে একফোঁটা কালিও নিঃসৃত হল না। সামন্তবাবু হাসলেন….খানিকটা ব্যঙ্গমিশ্রিত হাসি। বললেন-
– এই কলম তখনই লেখে, যখন এর নিজের ইচ্ছে হয়। মালিকের ইচ্ছের কোনও দাম নেই এর কাছে।
উপরের এই কথোপকথনগুলো চলছিল আমার চেম্বারে। আমি ডঃ মিত্রজিৎ মজুমদার, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সামনের চেয়ারে আমার মুখোমুখি বসে আছেন মিস্টার সামন্ত। পেশায় একজন চিত্রকর। বয়স হবে এই পঞ্চাশ-বাহান্ন’র কাছাকাছি। একসময় ভদ্রলোক বেশ সুপুরুষ ছিলেন বলেই মনে হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ আর রাতজাগার ফলে এখন তার অবস্থা শোচনীয়। লম্বা অথচ রোগাটে দড়ি পাকানো গড়ন, মাথা ভর্তি উস্কোখুস্কো চুল, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা আর কপালে অজস্র বলিরেখা….সব মিলিয়ে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমার সামনে বসে থাকা এই স্থবির মূর্তি অতীতের সুদর্শন অবয়বটির এক আবছা স্মৃতি মাত্র। শুধু তাঁর চোখদুটো অত্যন্ত কালো ও উজ্জ্বল, দৃষ্টিটা অন্তর্ভেদী। তাঁর সমস্যা হল এই যে, আজ থেকে প্রায় পাঁচ মাস আগে তিনি একটা কলম পেয়েছিলেন। আর সেখান থেকেই তাঁর জীবনে শুরু হয়েছে সমস্ত অশান্তি। সামন্ত বাবুর জবানবন্দি অনুসারে, এ কলম দিয়ে যা কিছুই আঁকা হয়, তাই নাকি চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরে সত্যি হয়ে যায়। প্রমাণ হিসেবে তিনি তাঁর ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে আমার চোখের সামনে মেলে ধরলেন। লাল কালি দিয়ে আঁকা একটা স্কেচ। তাতে দেখা যাচ্ছে কাঠের একটা খাড়া সিঁড়ি। আর সেই সিঁড়ির ঠিক নীচে পড়ে আছে একজন বয়স্কা মহিলার মৃতদেহ। সম্ভবতঃ সিঁড়ি থেকে নামার সময় পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছেন; তার ফলেই মৃত্যু।
– কি বুঝলেন এই স্কেচটা দেখে?
– একটা কাঠের সিঁড়ি, তার নীচে দেখা যাচ্ছে একজন বৃদ্ধার প্রাণহীন….
– আমার কাকিমা, সামন্ত বাবু আমাকে মাঝখানেই থামিয়ে দিয়ে বললেন, “এই যে এখানে এই রক্তাক্ত মৃতদেহটি দেখতে পাচ্ছেন, এই হলেন আমার কাকিমা। এই ছবিটা আমি এঁকেছিলাম পঁচিশে ফেব্রুয়ারির দিন, সকাল আটটা নাগাদ। আর আমার কাকিমা’র মৃত্যু ঘটে সেদিনই, রাত সাড়ে ন’টার কাছাকাছি এবং দুর্ঘটনাটা ঘটে অবিকল এই ছবিতে যেমন দেখছেন, ঠিক সেই ভাবেই। সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে পা হড়কে….”
– বুঝলাম। কিন্তু ঘটনাটা সম্পূর্ণ কাকতালীয় ও তো হতে পারে, তাই না? শুধুমাত্র একটা ছবির উপর ভিত্তি করে কোনও মীমাংসা করা কি উচিত?
বৃদ্ধ চিত্রকর একটা ক্লান্তি মাখা হাসি হেসে বললেন-
– ডঃ মজুমদার, আমি কুসংস্কারী মানুষ নই। সারা জীবন সবকিছুকে যুক্তির মাপকাঠিতে মেপেই ওজন করে এসেছি। এমন ঘটনা যদি শুধুমাত্র একবার ঘটত, তাহলে আমি অবলীলায় তাকে কো-ইন্সিডেন্স বলে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু বিগত পাঁচ মাসে ছয় বার এমন ‘কাকতালীয়’ ঘটনা ঘটেছে। এবারও কি আপনি এটাকে কাকতালীয় বলবেন ডক্টর? জাস্ট এ মিয়ার কো-ইন্সিডেন্স?
আমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। বলেন কি ভদ্রলোক? ছয় বার? এটাও কি সম্ভব? এতক্ষণ ধরে তো সামন্তবাবুর সাথে কথা বলছি, কই….তাঁর মধ্যে তো কোনও রকমের মানসিক বিকৃতির চিহ্ন খুঁজে পেলাম না? যথেষ্ট ভদ্র, মার্জিত ও মিতভাষী একজন মানুষ বলেই মনে হল। তাই তিনি যে আমার সাথে কোনও প্রকারের মিথ্যাচার করবেন, এইটা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া আমাকে মিথ্যে বলে তাঁর কি লাভ? কিন্তু এইসব ঘটনাগুলো ঠিক হজম করতেও পারছিলাম না।
– আমাকে আরও কিছু ছবি দেখান, মাত্র একটা ছবি দেখে কিছু বলা সম্ভব নয়।
– অবশ্যই। এই দেখুন….
সামন্তবাবু আরও দুটো কাগজ বার করলেন। প্রথম কাগজে দেখলাম, একজন কমবয়সী ছেলে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। পাখার সাথে ফাঁস লাগানো মৃতদেহটা অসহায় ভাবে ঝুলছে। চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ভীষণ যন্ত্রণায়, জিভ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত। বীভৎস দৃশ্য।
আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সামন্তবাবু বললেন-
– আমার ভাইপো। পরীক্ষায় ফেল করার হতাশায় আত্মঘাতী হয়েছিল প্রায় মাস দুয়েক আগে। ওর মৃত্যুরও আগাম সঙ্কেত দিয়েছিল এই কলম।
– আচ্ছা। অন্য কাগজটা দেখি….
এই স্কেচে দেখলাম একটা ব্যস্ত রাস্তা। সেখানে অনেক মানুষের জটলা। আর সেই ভিড়ের মাঝে পড়ে রয়েছে একজন নারীর থেঁতলানো মৃতদেহ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা রাস্তাটা।
– আমার বাল্যবন্ধু রাশিদের একমাত্র মেয়ে রাজিয়া। দিন সাতেক আগে কলেজ থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। পিছন থেকে একটা অনিয়ন্ত্রিত বাস এসে পিষে দেয় মেয়েটাকে। স্পট্-ডেড।
আমি তিনটি ছবিই ভাল করে উল্টেপাল্টে দেখলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলাম-
– আচ্ছা মিঃ সামন্ত, এই কলম কোনও ভাল খবর দেয় না? শুধুই দুঃসংবাদ দেয়?
– আজ্ঞে হ্যাঁ ডাক্তার বাবু, ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, এই কলম বড়ই অপয়া। এ কেবলই অশুভ ভবিষ্যৎবাণী করে।
– তাই যদি হয়, তাহলে কেন মরতে এই কলম দিয়ে আঁকতে যান আপনি? না….মানে যখন আপনি জানেন যে এই কলম শুধুই খারাপ খবর আনে, তাহলে এই বিপজ্জনক জিনিসটাকে ব্যবহার না করলেই তো মিটে যায়। আপনার কি কলমের অভাব আছে নাকি?
ভদ্রলোক আবার ম্লান হাসলেন।
– সেই ক্ষমতা যদি আমার হাতে থাকত, তাহলে কি কখনও এত ঝামেলা হত? বললাম না….এই কলমের কাছে তাঁর মালিকের ইচ্ছের কোনও দাম নেই। বরং মালিক নিজেই এই কলমের দাস। এমনিতে আপনি হাজার চেষ্টা করা সত্ত্বেও এইটা দিয়ে একটা অক্ষর লিখতে পারবেন না। কিন্তু যখন এই কলমের ইচ্ছে জাগবে আপনাকে দিয়ে কিছু আঁকিয়ে নেওয়ার, তখন আপনি অনুভব করবেন এক আলাদা রকমের অনুভূতি। সে যে কি অমোঘ আকর্ষণ….তা আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না ডক্টর মজুমদার। তখন যেন মনে হয়, আমার ধ্যান-জ্ঞান সবকিছুই এই কলম। এই কলমের ডাককে আমি আজ অবধি উপেক্ষা করতে পারিনি। ডাক এলে আমাকে যে আঁকতেই হবে….তখন আমার অন্যান্য সব জরুরি কাজকর্ম এক নিমেষে গৌণ হয়ে যায়। সেই সময় থাকি শুধু আমি, আমার খাতা, আর এই অভিশপ্ত কলম। আরও একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, সাধারণত একটা স্কেচ বানাতে আমার মোটামুটি আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট মতো সময় লাগে। সেখানে এই কলমটা দিয়ে আঁকতে আমার সময় লাগে মাত্র পাঁচ থেকে দশ মিনিট। আপনিই বলুন, এমন ডিটেল্ড স্কেচ কখনও এত তাড়াতাড়ি আঁকা যায়? কিন্তু এটাই সত্য। কলম ধরলেই মনে হয় আমার হাত নিজে থেকেই কাগজের বুকে ছুটে চলেছে। ঠিক যেন কোনও অদৃশ্য সত্তা আমাকে দিয়ে ছবিটা আঁকিয়ে নিচ্ছে। আমি এখানে শুধু নিমিত্ত মাত্র।
দুজনেই কিছুক্ষণ বোকার মতো চুপ করে রইলাম। অস্বস্তি কাটাতে আমিই মুখ খুললাম-
– কোত্থেকে আমদানি করলেন এই ভূতুড়ে কলমটা?
– একটা অ্যান্টিক-শপ্ থেকে কিনেছিলাম। আমি পুরনো জিনিস আর আসবাবপত্র সংগ্রহ করার শৌখিন। তাই এইসব অ্যান্টিক-শপে আমার নিয়মিত যাতায়াত। খুব পছন্দ হয়েছিল জিনিসটা, সেই জন্য বেশী সাত-পাঁচ না ভেবেই কিনে ফেলেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি এই কলম কিনে আমি নিজেই খাল কেটে কুমির এনেছি। কে জানে কি কালো ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই কলমটার সাথে….
আরও কিছু টুকটাক কথাবার্তা বলে এবং যথাসাধ্য আশ্বাস দিয়ে ভদ্রলোক কে বিদায় জানালাম। সারাদিনের খাটনির পর বড়ই শ্রান্ত বোধ করছিলাম। হাতঘড়ি বলছে, এখন রাত ন’টা। নাহ্….অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলাম। রাতের ফাঁকা হাইওয়েতে ঝড়ের বেগে ছুটিয়ে দিলাম আমার হন্ডা সিটি। ড্রাইভ করতে করতেও লক্ষ্য করলাম, মাথায় সামন্তবাবুর কেসটাই ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে। দীর্ঘ দশ বছরের কেরিয়ারে অনেক কেস হ্যান্ডেল করেছি, কিন্তু কোনওদিন এমনতর উদ্ভট ঘটনার সম্মুখীন হইনি। এই কেসের মীমাংসা করতে গিয়ে নিজেকেই কেমন পাগল-পাগল লাগছে। আজকের এই বিজ্ঞানের যুগেও কি পৃথিবীর বুকে এমন সব অলৌকিক কাণ্ড সত্যিই ঘটে?
২
আজ আমার ছুটি। ক্লিনিকে যাওয়া নেই, তাই ঠিক করলাম যে আজকের পুরো দিনটা শুয়ে-বসে আর বই পড়েই কাটাব। প্রাতঃরাশ সেরে সবেমাত্র একটা পছন্দের উপন্যাস নিয়ে বসেছি, ঠিক তখনই আমার মোবাইলটা কর্কশ শব্দে বেজে উঠল। অচেনা নম্বর থেকে কল, ট্রুকলারে নাম দেখাচ্ছে….অভিরূপ সামন্ত। ফোনটা রিসিভ করলাম।
– হ-হ-হ্যালো, সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ মজুমদার আছেন?
– হুম, বলছি। কিন্তু আপনি এমন ভাবে তোতলাচ্ছেন কেন? ইজ এভরিথিং অলরাইট?
– আসলে….আসলে একটা বিরাট বিপদে পড়ে আপনাকে ফোন করতে বাধ্য হলাম, সামন্তবাবু ভয়ার্ত গলায় বললেন, “আপনার হেল্প এই মুহূর্তে আমার প্রচণ্ড দরকার স্যার।”
– প্লিজ কাম্ ডাউন মিঃ সামন্ত। কি হেল্প চাই, আমাকে বলুন?
– আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার বাড়িতে চলে আসুন।
– মানে? আমি অবাক হয়ে গেলাম, “আগে প্রব্লেমটা কি হয়েছে সেইটা খুলে বলবেন তো? তাছাড়া আমি কি করে আপনার বাড়ি যাব? আমি তো আপনার অ্যাড্রেসটাই জানি না।”
– ডাক্তারবাবু….এখানে যা ঘটেছে, তা সবকিছু ওভার-দ্য-কল বোঝানো সম্ভব নয়। জানি অন্যায় আবদার করছি, কিন্তু অন্য কোনও উপায় নেই আমার হাতে। আর বাড়ি চেনেন না তো কি হয়েছে? আপনি নিজের ঠিকানাটা বলুন, আমি আমার ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওই আপনাকে রিসিভ করে নেবে।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই একটা ঝাঁ-চকচকে কালো গাড়ি ঠিক আমার বারান্দার নীচে এসে হর্ন দিতে লাগল। তৈরি হয়েই ছিলাম, গাড়ির আওয়াজ পেয়ে তড়িঘড়ি নীচে নেমে এলাম। একজন মাঝবয়সী শিখ ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে আমাকে নমস্কার করে বললেন-
– ম্যায় রাজপাল সিং। সামন্তবাবু কা ড্রাইভার। সাহেব নে আপকে লিয়ে গাড়ি ভেজা হ্যায়।
আধঘণ্টা পর গাড়িটা এসে থামল একটা বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে। সামন্তবাবুর ফ্ল্যাটটা চার তলায়। দেখলাম ভদ্রলোক ঘরের বাইরেই উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি করছিলেন। আমাকে দেখা মাত্রই তিনি ছুটে এসে করমর্দন করলেন। আমাকে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন-
– আমার বাড়িতে আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু। ভিতরে চলুন, আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে আমার।
সামন্তবাবুর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করার পর জানতে পারলাম, এই ভদ্রলোক পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা ও নির্বান্ধব। মা কে ছোটবেলায় হারিয়েছেন, আর বাবাও গত হয়েছেন প্রায় বছর পাঁচেক আগে। উনি বিয়ে-থা করেননি। কাছের কোনও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও তাঁর বিশেষ যোগাযোগ নেই। এখন তাঁর ‘নিজের লোক’ বলতে শুধুই দুজন….প্রথম হলেন তাঁর শিখ ড্রাইভার রাজপাল, দ্বিতীয় হল একটা অল্পবয়সী নেপালি ছেলে তেজবাহাদুর। এই তেজবাহাদুর হল একাধারে এই বাড়ির পাহারাদার, পাচক, ভৃত্য এবং সামন্ত বাবুর কথা বলার সঙ্গী। এমন দুজন অচেনা অথচ বিশ্বস্ত মানুষকে নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন এই প্রৌঢ় চিত্রকর।
ভদ্রলোকের সাথে খানিকক্ষণ খেজুরে আলাপ করার পর আমি মোদ্দা কথাটা পাড়লাম।
– এইবার বলুন, কি জন্য এত জরুরি তলব?
সামন্ত বাবু এতক্ষণ বেশ ঝরঝরে ভাবেই গল্প করছিলেন, কিন্তু আমার এই আকস্মিক প্রশ্ন শুনে উনি কেমন যেন মুষড়ে পড়লেন। চোখে-মুখে নেমে এল গভীর আতঙ্কের কালো ছায়া। তেজবাহাদুর ওই সময় ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল। সামন্তবাবু ওকে ঘর থেকে বাইরে পাঠিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
– আমি আগেই বুঝেছিলাম, যখন থেকে এই অপয়া কলম আমার জীবনে প্রবেশ করেছে, তখন থেকেই আমি কোনো গভীর অশুভ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পড়েছি। কিন্তু আজ সকালে এই কলমটা আমাকে দিয়ে যা আঁকালো, তা দেখে আমি নিজেই থ হয়ে গেছি। কিছুতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না ডঃ মজুমদার, সব চিন্তাভাবনা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে আমার….
– কেন? এমন কি আঁকলেন আপনি?
চিত্রকর মহাশয় নিঃশব্দে তাঁর টেবিলে রাখা একটা কাগজের দিকে ইশারা করলেন। কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই যা দেখলাম, তা দেখার কল্পনা আমি স্বপ্নেও করিনি।
মেঝেতে ঘাড় মটকে পড়ে রয়েছে একটা রক্তরঞ্জিত লাশ। আর এই লাশ অন্য কারো নয়, স্বয়ং চিত্রকর অভিরূপ সামন্তর। মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে, ঘিলু বেরিয়ে এসেছে। ঘাড়টা ভেঙে একদিকে কাত হয়ে আছে। নিষ্প্রাণ চোখের মণি দুটো মরা ছাগলের মত ঘোলাটে। শান বাঁধানো মেঝেটা রক্তবন্যায় লাল হয়ে গেছে। আর সহ্য করতে পারলাম না। চোখ সরিয়ে নিলাম কাগজের উপর থেকে।
– এইবার আপনিই বলুন ডাক্তার বাবু, কিভাবে এই ফাঁড়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে
কি জানি কেন, কিন্তু হঠাৎ আমার ভীষণ রাগ হল এই বৃদ্ধ চিত্রকরের উপর। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ভাল রকমের ছিটগ্রস্ত। নির্ঘাত পাগলামির ঘোরে আবোল-তাবোল সব স্কেচ করে সেগুলোকে সত্যি প্রমাণিত করার চেষ্টা করেন। আমি বেশ কয়েকটা স্কেচ দেখেছি, এটা ঠিক কথা। কিন্তু সেইসব ঘটনার সত্যতা তো যাচাই করিনি। সবই শোনা কথা। যেমনটা সামন্তবাবু বলেছেন, ঠিক তেমনটাই গিলে গেছি। লোকটা নিশ্চয়ই হ্যালুসিনেশনের পেশেন্ট। একটা পাগলের পাল্লায় পড়ে আমি নিজের সময় নষ্ট করছি। নিজের উপরও খুব অসন্তুষ্ট হলাম। কি করে আমি প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া এই ধরনের গুলতাপ্পি বিশ্বাস করতে পারলাম?
– দেখুন সামন্ত বাবু, সব নষ্টের গোড়া হল আপনার কলম। আমাকে একবার জিনিসটা দিন।
ভদ্রলোক উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে কলমটা বার করে আনলেন। আমি আরেকবার জিনিসটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলাম। এই সাধারণ এক ফাউন্টেন-পেন নিয়ে এত ভয় কেন লোকটার? কলমটা আমি সযত্নে ভরে নিলাম পকেটে।
– কী হল ডঃ মজুমদার? ভদ্রলোক খানিকটা অপ্রতিভ ভাবে বললেন, “কলমটা ফেরত দেবেন না?”
– না। আমি এইটা নিয়ে যাচ্ছি।
– কবে ফেরাবেন?
– দেব না। আই অ্যাম গোইং টু ডেস্ট্রয় ইট। এই কলমই হল যত অশান্তির মূল। না থাকবে কলম, না থাকবে আপনার মানসিক টানাপোড়েন।
আমার এই কথায় যেন আঁতকে উঠলেন বৃদ্ধ চিত্রকর। ব্যস্ত হয়ে বললেন-
– পাগল হয়েছেন ডঃ মজুমদার? আপনি কলমটা ভাঙবেন কেন? এইটা আমার প্রপার্টি। আমার জিনিস নষ্ট করার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে?
শেষের কথাগুলো বেশ রূঢ়ভাবেই বললেন তিনি। আমারও জেদ চেপে গেল। চোয়াল শক্ত করে বললাম-
– পাগল আমি হইনি, পাগল হয়েছেন আপনি। আর কি তখন থেকে ‘আমার কলম আমার প্রপার্টি’ বলে যাচ্ছেন? এই মৃত্যুদূত কে নিয়ে কিসের এত মোহ আপনার? কি এমন আছে এই কলমটার মধ্যে?
– অতশত জানিনা মশাই। জিনিসটা আমার আর মৃত্যু পর্যন্ত এইটা আমার কাছেই থাকবে। আপনি আমার কলমটা ফেরত দিন।
– না, দেব না। একজন ডাক্তার হয়ে আমি নিজের পেশেন্টকে এইভাবে একটু-একটু করে পাগলামির দিকে এগিয়ে যেতে দিতে পারিনা। এই কলমটা আমি নষ্ট করে ফেলব। ইউ বেটার ফর্গেট ইট।
সামন্তবাবু আচমকাই হিংস্র শিকারির ন্যায় আমার দিকে তেড়ে এলেন, আমার হাত থেকে কলমটা ছিনিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমি আগেই সতর্ক ছিলাম, ঝটিতি সরে গেলাম তার নাগাল থেকে।
– কলমটা ফিরিয়ে দিন আমাকে, একটা চাপা জান্তব চিৎকার করে উঠলেন তিনি, “আমার জিনিস আমাকে ফিরিয়ে দিন বলছি….”
– না দেব না! আমিও নাছোড়বান্দা, “প্রাণ থাকতে এই অপয়া কলম আমি কিছুতেই ফেরত দেব না।”
মিঃ সামন্ত ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার উপর। কিন্তু হাজার হোক্, তিনি বৃদ্ধ। ধস্তাধস্তি করে কি আর আমার সাথে এঁটে উঠতে পারেন? কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ওনাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেললাম। কলমটা উঁচিয়ে ধরে বললাম-
– এইটাই যখন সব নষ্টের গোড়া, তখন এই কলমটাই নষ্ট করে ফেলব আমি। এক্ষুনি….এই মুহূর্তে।
– না, আপনি এমনটা করতে পারেন না! চিত্রকর মহাশয় কেঁদে ফেললেন, “আমি আপনার সব নির্দেশ মানতে রাজি। শুধু ওই কলমটা আমাকে ফিরিয়ে দিন।’’
কিন্তু ততক্ষণে আমার মাথায় খুন চেপে গিয়েছে। রাগের চোটে আমি কলমটা সজোরে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম ফ্ল্যাটের বারান্দার বাইরে। এই পর্যন্ত তো ঠিক ছিল। তবে এর পরে মিঃ সামন্ত যা কাণ্ড ঘটালেন, তা দেখে আমার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে গলায় উঠে আসার জোগাড়।
কলমটা ব্যালকনি দিয়ে নীচে পড়ার সাথে-সাথেই তিনি “আ-মা-র ক-ল-ম! আ-মা-র ক-ল-ম!’’ বলে চিৎকার করতে করতে বারান্দায় ছুটলেন। তারপর বারান্দার রেলিং টপকে সোজা নীচে ঝাঁপ দিলেন। ‘ধপ্’ করে বিরাট একটা শব্দ, তারপর সব শান্ত। দৌড়ে গেলাম বারান্দায়, নীচে গলা বাড়াতেই দেখতে পেলাম সেই নারকীয় দৃশ্য।
চারটে ফ্লোর নীচে পড়ে আছে মিঃ সামন্ত’র মৃতদেহ। ঘাড় মটকানো, মাথা ফেটে গলগল করে তাজা রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে।
আমি আর দেখতে পারলাম না। এক ঝটকায় নজর সরিয়ে নিলাম। কান দুটো আস্তে-আস্তে গরম হয়ে উঠছে। মাথাটা প্রচণ্ড ভাবে ঘুরছে। চোখের সামনে অন্ধকার দেখছি। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমার দুর্বল স্নায়ুগুলো পরিস্থিতির এই ভয়ঙ্কর চাপ সহ্য করতে পারছে না। নিজের সাথে আর লড়াই করতে পারলাম না। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম ব্যালকনির মেঝেতে।
৩
জানিনা কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল। চোখ খুলে দেখলাম, আমি একটা অচেনা জায়গায় শুয়ে আছি। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছিলাম। কিছুটা সময় লাগল ধাতস্থ হতে। চারদিকটা ভাল ভাবে নজর করে দেখলাম, মনে হচ্ছে কোনও হসপিটালের বেডে পড়ে আছি। আমি চোখ মেলেছি দেখে একজন নার্স শশব্যস্ত হয়ে ছুটে ডাক্তারকে খবর দিতে গেল। কিছুক্ষণ পরেই কক্ষে প্রবেশ করলেন বিখ্যাত নিউরোসার্জন ডঃ ব্যানার্জি। আমরা একে-অপরকে বিলক্ষণ চিনতাম, কারণ মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় উনি আমার সিনিয়র ছিলেন।
আমাকে দেখে তিনি মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন-
– হাউ আর ইউ ফীলিং ইয়াং ম্যান?
– মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছি….
– তা তো হওয়ারই কথা মিত্রজিৎ, এত বড় অ্যাক্সিডেন্ট করার পর এমন গুরুতর একটা হেড-ইঞ্জ্যুরি সাস্টেন করেছ, তার প্রভাব কি এত তাড়াতাড়ি উবে যাবে?
– অ্যাক্সিডেন্ট? হেড ইঞ্জ্যুরি? কি হয়েছিল ডঃ ব্যানার্জি? আমার যে কিছুই মনে পড়ছে না….
ডঃ ব্যানার্জি একটা টুল নিয়ে আমার মাথার কাছে বসলেন। তারপর একটু-একটু করে সব ঘটনা শুরু থেকে বলতে আরম্ভ করলেন-
“আজ থেকে চার দিন আগে তুমি গাড়ি চালিয়ে চেম্বার থেকে বাড়ি ফিরছিলে হাইওয়ে ধরে। তখন কোনও কারণে তোমার গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারে রাস্তার ধারে একটা গাছে। তাতে গাড়ির বিশেষ ক্ষতি না হলেও তোমার অনেক আঘাত লেগেছিল। মাথায় চোট পাওয়ার ফলে তুমি এই চারদিন কোমায় ছিলে। সিটিস্ক্যান রিপোর্টে তোমার মাথায় একটা বড় হেমাটোমা পাওয়া গিয়েছিল। সেইটা রিমুভ করতে আমাদেরকে একটা মেজর নিউরোসার্জরি করতে হয়েছে। অপারেশনের পর এই প্রথম তুমি চোখ মেলে তাকালে মিত্রজিৎ। থ্যাঙ্ক গড্ ইউ আর সেফ অ্যান্ড সাউন্ড!”
ও হ্যাঁ, তাই তো….এইবার অল্প-অল্প করে মনে পড়ছে সবকিছু। সেদিন চেম্বারে সামন্তবাবুর সাথে কথাবার্তা বলার পর গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। ফাঁকা হাইওয়েতে গাড়ির স্পিড বেশী ছিল, তাছাড়া সামন্তবাবুর ওই ভূতুড়ে কেসটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম বোধহয়। হঠাৎ সামনে থেকে একটা লরি….চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল তার জোরালো লাইটে। আমি পাশ কাটাতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু গতি বেশী হওয়াতে গাড়িটা স্কিড করে ধাক্কা মেরেছিল হাইওয়ের ধারে একটা গাছের গুঁড়িতে। একটা কান ফাটানো শব্দ, মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাত, আর তারপর….
আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। মাথার বাম দিকটা যন্ত্রণায় টনটন করে উঠল।
ডঃ ব্যানার্জি সিস্টারের সাথে কিছু জরুরি কথাবার্তা বলে আমার রুম থেকে বিদায় নিলেন। আমিও ক্লান্তিতে চোখ বুজলাম।
জ্ঞান ফেরার পর হাসপাতালে আরও দিন পনেরো অব্জার্ভেশনে ছিলাম। ডিসচার্জ হয়ে বাড়ি ফেরার পরও আমার সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ হতে প্রায় তিন মাস মতো সময় লেগেছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু একটা কথাই মাথায় ঘুরত….তবে কি সেদিন সামন্তবাবুর ফোন পেয়ে তাঁর পাঠানো গাড়িতে করে ওনার ফ্ল্যাটে যাওয়া, তারপর তাঁর আঁকা ওই বিভীষিকাময় ছবিটা দেখা, কলম নিয়ে ওনার সাথে আমার ধস্তাধস্তি, তারপর ব্যালকনি থেকে পড়ে ওনার মৃত্যু….কিছুই কি বাস্তবে ঘটেনি? আমি কি কোমায় থাকাকালীন গোটা দৃশ্যটা কে হ্যালুসিনেট করেছিলাম মাত্র? এমনটাও কি সম্ভব?
নাহ্, এমন অনিশ্চয়তা নিয়ে দিনের পর দিন বাঁচা যায়না। ফোনের কল লিস্ট ঘেঁটেও দেখলাম ওই তারিখে আমার ফোনে অভিরূপ সামন্ত নামে কারোর কোনো ফোন আসেনি। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর, একদিন বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে আমি গাড়ি নিয়ে বেরোলাম। ঘটনাগুলো কল্পনা না বাস্তব, তা জানার একমাত্র উপায় হল মিঃ সামন্ত’র ফ্ল্যাটে গিয়ে তার সাথে মুখোমুখি বসে কথা বলা। রাস্তাঘাট যেটুকু মনে ছিল, সেই অনুসারে দিক নির্ণয় করে খুঁজে বেড়ালাম ভদ্রলোকের ফ্ল্যাটবাড়ি। একটা ব্যাপার দেখে ভাল লাগল, মাথায় চোট পাওয়া সত্ত্বেও আমার স্মৃতিশক্তি কিন্তু অক্ষুণ্ণ আছে….কারণ সামন্তবাবুর অ্যাপার্টমেন্ট টা খুঁজে পেতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হল না। চার তলায় উঠে ফ্ল্যাট নং 405-B খুঁজে পেতেও তেমন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এ কি? দরজায় তো তালা ঝোলানো। তাহলে ভদ্রলোক কোথাও বেরোলেন নাকি?
কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বন্ধ দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আচ্ছা, পাশের ফ্ল্যাটের কোনও লোক কেও তো জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে চিত্রকর মহাশয়ের সম্পর্কে….তাতে যদি কিছু কাজের খবর আদায় করতে পারি, তবে মন্দ কি? এই কথা ভেবেই, একটু ইতস্তত করে পাশের ফ্ল্যাটের বেল বাজালাম। একজন বয়স্ক মহিলা এসে দরজা খুলে দাঁড়ালেন।
– কাকে চাই?
– নমস্কার, আমি মিত্রজিৎ। আপনি কি জানেন, আপনাদের পাশের ফ্ল্যাটের সামন্তবাবু কোথায় গিয়েছেন? ওনার সাথে আমার কিছু দরকার ছিল।
– সামন্ত বাবু? ভদ্রমহিলা ভ্রু কুঁচকালেন, “কোন্ সামন্ত বাবুর কথা বলছেন আপনি?’’
– কেন? আপনার প্রতিবেশী, ফ্ল্যাট নং 405-B এর অভিরূপ সামন্ত। যিনি পেশায় একজন চিত্রকর….
– ওহ, তাঁর কথা বলছেন? সে তো আর এখানে থাকেন না।
– কেন? উনি কি অন্য কোথাও শিফ্ট করেছেন?
– আপনি মনে হয় বহুদিন এখানে আসেননি। অভিরূপ সামন্ত আজ থেকে ছয় বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন ওনার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে পড়ে গিয়ে।
কথাটা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আমাকে ওইরকম ভাবে বজ্রাহত’র মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মহিলা বললেন-
– দুঃখ পাবেন না। মৃত্যু তো আর মানুষের হাতে নেই। বড় ভাল মানুষ ছিলেন অভিরূপ বাবু। শেষে ব্যালকনি থেকে পড়ে গিয়ে….ব্যাপারটা নিছকই একটা দুর্ঘটনা না হত্যা নাকি সুইসাইড, কিছুই বোঝা যায়নি। আমার তো আজও ওই দুটোর উপর সন্দেহ হয়।
– কাদের উপর?
– আরে ওনার ওই সর্দারজি ড্রাইভার আর নেপালি চাকরটার উপর। ওনার মৃত্যুর পর ওরা দুজনেও বেমালুম হাওয়া হয়ে গেছিল। হাজার হোক, অভিরূপ বাবুর পয়সাকড়ি তো নেহাৎ কম ছিল না। হয়তো সেই লোভেই দুজনে মিলে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে….যদিও পুরোটাই আমার কল্পনা, তবুও এই যুগে দাঁড়িয়ে এই কাজ করা খুব একটা অসম্ভব কি?
ভদ্রমহিলা আরও অনেক কিছুই বলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার কোনও কথাই আমার কর্ণকুহর দিয়ে ঢুকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। আমি তখন অন্য জগতে। সব কিছুতেই কেমন যেন একটা ধাঁধা লাগছিল। তার মানে কি সেদিনের সব ঘটনাই মিথ্যে? আমার এই ফ্ল্যাটে আসা, সামন্তবাবুর সাথে কথা কাটাকাটি হওয়া, তারপর ব্যালকনি থেকে পড়ে গিয়ে ওনার ওই বিভীষিকাময় মৃত্যু, সব কি শুধুই চোখের ভুল? না, ভুল তো নয়। কারণ মহিলা তো বললেন, অভিরূপ সামন্ত’র মৃত্যু বারান্দা থেকে পড়েই হয়েছিল। কিন্তু তা হয়েছিল ছয় বছর আগে। এ ছাড়া উনি তাঁর সর্দারজি ড্রাইভার রাজপাল এবং নেপালি চাকর তেজবাহাদুরের কথাও উল্লেখ করেছিলেন। তার মানে কি কোমায় থাকাকালীন আমার অবচেতন মস্তিষ্ক কোনওভাবে পৌঁছে গিয়েছিল অতীতে? টাইম লুপ জাতীয় কোনও ব্যাপার? তাও বা কি করে সম্ভব? অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার আগে তো তিনি সশরীরেই আমার ক্লিনিকে এসে অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলে গেলেন। তবে কি সেদিন তিনি সশরীরে আসেননি? এসেছিলেন অশরীরে? মৃত চিত্রকরের আত্মা এসেছিল বায়বীয় রূপ ধরে? উফ্!! আর ভাবতে পারছি না। সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।
– শুনছেন? ও দাদা! কি ভাবছেন তখন থেকে? বুঝলেন কিছু আমি কি বললাম?
ভদ্রমহিলার ডাকাডাকিতে আমার চমক ভাঙল। খানিক অপ্রস্তুত হয়ে বললাম-
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি। আচ্ছা….আচ্ছা একটা কথা বলতে পারবেন? সামন্তবাবুর কাছে আপনি পুরনো আমলের কোনও কলম দেখেছিলেন? গাঢ় নীল রঙের, নিবটা সোনা দিয়ে তৈরি। বলুন না, দেখেছিলেন কখনও?”
উনি মনে হয় আমার এই প্রশ্নে যথেষ্ট বিরক্তই হলেন। ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন-
– কলমের ব্যাপারে আমি কি করে জানব বলুন? জীবিতাবস্থায় তাঁর সাথে আমাদের তেমন কিছু আলাপ-পরিচয় ছিলনা। ওই ‘কেমন আছেন, ভাল আছেন’ ওই অভিবাদনটুকুই হত, প্রতিবেশী হলে যেটুকু ভদ্রতা রাখতে হয় আর কি। কিন্তু উনি কোন্ কলম ব্যবহার করতেন, তা আমি জানিনা। আপনি হঠাৎ তাঁর কলমের ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন বলুন তো?
– না না, ও কিছু নয়। এমনি জিজ্ঞাসা করলাম। আচ্ছা, আমি এবার আসি। অসময়ে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। ভাল থাকবেন।
কোনওমতে টলোমলো পায়ে অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। এখনও যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। ওই অবস্থায় ড্রাইভ করে কিভাবে যে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছলাম, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।
তখন কি আর জানতাম যে আমার জন্য এর থেকেও অনেক বড় চমক অপেক্ষা করছে আমার বাড়িতেই?
পাঁচ-ছয় দিন পরের ঘটনা। বইয়ের তাকটা পরিষ্কার করছিলাম। হঠাৎ পেন-স্ট্যান্ডটার দিকে চোখ পড়তেই আমার বুকের রক্ত জমাট বেঁধে গেল। আমার পেন-স্ট্যান্ডে স্বমহিমায় জ্বলজ্বল করছে সেই অভিশপ্ত কলম। ঝকঝকে নীলবর্ণ মসৃণ কলমটা যেন আমার দিকেই তাকিয়ে ব্যঙ্গের কুটিল হাসি হাসছে। এই জিনিসটা আমার কাছে কিভাবে এল? অদ্ভুত ব্যাপার তো! এই কলমটা আমার পেন-স্ট্যান্ডে? ভোজবাজি নাকি? খাপটা খুলে পরীক্ষা করলাম। সেই চেনা সোনার নিব। এখনও তার ডগায় একবিন্দু লাল কালি লেগে আছে। তাজ্জব ব্যাপার!
আরেকবার কলমটা চালিয়ে দেখব? খুব ইচ্ছে করছে সাদা পাতায় কলমটা দিয়ে আঁকিবুকি কাটতে। খাতাটা বার করলাম। কিন্তু এই কলম তো আবার নিজের ইচ্ছে ছাড়া লেখে না। দেখা যাক। সাদা পাতায় দাগ কাটলাম। স্ট্রেঞ্জ…! যে কলম থেকে এতদিন একফোঁটা কালিও বার করতে পারিনি, সে আজ অবলীলায় পাতার বুকে রক্তিম আঁচড় কেটে দিল। কিন্তু এখানেই আমি নিজেকে থামাতে পারলাম না। আরও কিছু আঁকতে ইচ্ছে করছে। কি আঁকি? গাড়ি আঁকব? তাই আঁকি। আর কি আঁকা যায়? একটা ব্রীজই এঁকে দেখি….
দশ মিনিটের মধ্যেই আঁকা কমপ্লিট। কিন্তু তারপর খাতাটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই যে দৃশ্য দেখলাম… তা দেখে আমার সর্বাঙ্গ আতঙ্কে নীল হয়ে গেল। একটা ব্রীজের রেলিং ভেঙে নীচে খাদের মধ্যে গিয়ে পড়েছে একটা কালো হন্ডা সিটি। তার নম্বর প্লেটে লেখা রয়েছে –
WB-02-AC-96*2
আমারই গাড়ির নম্বর।
তার মানে কি এইটাই আমার ভবিতব্য? চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরে কি আমার গাড়ি কোনওভাবে ব্রীজচ্যুত হয়ে খাদে পড়বে? এইভাবেই কি ঘটবে আমার প্রাণান্ত? রাগে দুঃখে আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। ইচ্ছে করছে কলমটাকে পুড়িয়ে ফেলি, দু’ভাগে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিই। শেষে কি না এই মৃত্যুদূতের অভিশাপ আমার জীবনেও থাবা বসালো?
কিন্তু কি যে অদ্ভুত মোহ আছে এই জিনিসটায়, কিছুতেই এটাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছি না। কি আভিজাত্যপূর্ণ কলম! কি অপূর্ব সুন্দর দেখতে! অতি বড় সৌভাগ্যবান না হলে এমন চমৎকার একটা জিনিসের অধিকারী হওয়া যায় না। নাহ্! যে যাই বলুক, কিন্তু আমি কোনও মূল্যেই এই কলমটা কে নিজের কাছছাড়া করতে পারব না। হোক্ না অভিশপ্ত, কিন্তু এখন থেকে এইটা আমার প্রপার্টি….মৃত্যুর আগে অবধি এ কলম আমার কাছেই থাকবে, শুধু আমার কাছে।
প্রচ্ছদঃ সায়ন্তনী দাশগুপ্ত
*****