লাভ ডিয়াজ ও শয়তানের ঋতু – কৌশিক মুখার্জী

চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করেন বিগত শতকের ৯০-এর দশকের শেষ পর্যায় (১৯৯৮) থেকে। সে সময়ে তিনি নির্মান করেন তিনটি ছবি। সেসব মোটের ওপর ছিল গতানুগতিক পূর্ণ দৈর্ঘ্যের রঙিন বাণিজ্যিক ছবি। ২০০১-এ তৈরী বাতাং ওয়েস্ট সাইড বা ওয়েস্ট সাইড এভিনিউ থেকেই সম্ভবত তাঁর ছবি তৈরীর যাত্রায় এক লক্ষ্যণীয় বদল আসে। বাতাং ছিল পাঁচ ঘন্টার চেয়েও দীর্ঘতর আখ্যানমূলক (ন্যারেটিভ) রঙিন ছবি। যদিও তা কন্টিন্যুটি সম্পাদনারীতির যুক্তি মেনে শট-কাউন্টার শট পদ্ধতিতেই মূলতঃ বানানো। তার পরের ছবি এভোল্যুশন অফ আ ফিলিপিনো ফ্যামিলি (২০০৪) ছিল প্রায় সাড়ে দশ ঘন্টা লম্বা। সে ছবিতে মূল আখ্যানের পাশাপাশি সে দেশের রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক বিভিন্ন নিপীড়ন ও প্রতিরোধের ফুটেজ (বেনিনো অ্যাকুইনো র শবযাত্রা) দেখতে পাওয়া যায়; এমনকি দেখা যায় তথ্যচিত্রসুলভ সাক্ষাৎকারও (বিখ্যাত প্রতিবাদী ফিলিপিনীয় চলচ্চিত্রকার লিনো ব্রোকা-র সাক্ষাৎকার)। যদিও এই ছবি থেকেই তাঁর ‘এক শটে এক দৃশ্য’ পদ্ধতিতে ছবি বানানোর ধরন স্পষ্টতা পায়। স্পষ্টতা পায় শটের এমন এক দৈর্ঘ্য, যা প্রাতিষ্ঠানিক/বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে মূলতঃ অনুপস্থিত। এরপরের ছবি হেরেমিয়াস বুক ওয়ান (২০০৬) ৮ ঘন্টা ৩৯ মিনিট লম্বা। এ ছবির নির্মাণরীতিও গতানুগতিকতার প্রেক্ষিতে অ-প্রথাসিদ্ধ। সে ছবির প্রায় শেষাংশে আছে প্রায় সোয়া এক ঘন্টা লম্বা হাত-ক্যামেরায়-তোলা (হ্যান্ডহেল্ড) আধা-প্রতীয়মান একটা দৃশ্য। তাঁর ছবিতে শুধুমাত্র শটের দৈর্ঘ্য বা সামগ্রিক ছবির দৈর্ঘ্যই যে ‘বড়’, তা নয়; ফ্রেমের ভেতর যা ঘটছে বহু সময়েই সেসবের গতিও ‘মন্দ’ থেকে মন্দতর লয়ের। আখ্যান নির্মাণও হচ্ছে ‘মন্দ’ লয়ে। এমন নয় যে তিনি কম দৈর্ঘ্যের ছবি তারপর থেকে আর একদমই বানাননি; এই যেমন গত দু-এক বছরেই তিনি দু-তিন ঘন্টা দৈর্ঘ্যের ছবি বানিয়েছেন। আবার তাঁর ২০২১-এর ছবি হিস্ট্রি অফ হা-র দৈর্ঘ্য চার ঘন্টার কিছু বেশি। কিন্তু মূলতঃ যে ছবিগুলোর জন্য তাঁর খ্যাতি, সেগুলি গতানুগতিক ছবির চেয়ে দীর্ঘতর। এবং তার মধ্যে ২০১৩-র নর্তে, দ্য এন্ড অফ হিস্ট্রি-র মতো ছবি ছাড়া অন্যান্য ছবিগুলি মূলতঃ মোনোক্রোম—সাদাকালো। ২০১৪-য় এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক জানিয়েছিলেন যে— ইতিহাস-সংগ্রাম-দারিদ্র-যন্ত্রণা দেখানোর জন্য উপযুক্ত এই রঙ পরিকল্পনা। তবে এ সমস্ত (পরি)সংখ্যায়িত তথ্য তাঁর ছবিকে যে মাপে সঙ্কুচিত করে, তাঁর ছবি সে তুলনায় ততটাই প্রসারিত।

আসলে এই ভূমিকাটুকু ভূমিকার জায়গা বাদে অন্যত্রও লেখা যেতে পারত। কিন্তু কোথাও না কোথাও লিখতে হতোই, যেহেতু যাঁর, যে ধরনের ছবি নিয়ে আলোচনা করতে চাওয়া হচ্ছে; তাঁর সম্পর্কে ইংরেজি ভাষায় লেখালিখি কিছু হলেও বাংলা ভাষায় তেমন আলোচনা বর্তমান লেখকের চোখে পড়েনি এখনও।






পরিচালক লাভ ডিয়াজ

আমাদেরই এশিয়া মহাদেশের পূর্ব প্রান্তের এক দ্বীপপুঞ্জসম্বলিত রাষ্ট্র ফিলিপিন্স বা ফিলিপাইন্স। ফিলিপিন্সে ছবি তৈরীর ইতিহাস বেশ পুরনো। তবে ফিলিপিন্সবাসীদের দ্বারা তৈরী ছবির ইতিহাস যে তেমন প্রাচীন বা শক্তিশালী, একথা একেবারেই বলা যাবে না। লাভ ডিয়াজ (জন্ম— ডিসেম্বর, ১৯৫৮) একজন ফিলিপিনীয় পরিচালক। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ডিয়াজের লেন্সে ভর দিয়েই ফিলিপিনীয় চলচ্চিত্র দৃঢ়তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাটি ছুঁয়েছে। এ হেন ডিয়াজের ২০১৮-র ছবি সিজন অফ দ্য ডেভিল। ১২৭-টা শট পাশাপাশি রেখে তৈরী এই ছবির দৈর্ঘ্য ২৩৫ মিনিট বা প্রায় চার ঘন্টা।

ফিলিপিন্সের রক্তাক্ত হওয়ার ইতিহাস বহু দীর্ঘ। ফিলিপিন্স স্প্যানিশ ইস্ট ইন্ডিজ উপনিবেশের অংশ ছিল ১৫৬৫ থেকে ১৮৯৮ পর্যন্ত। তার মধ্যে অষ্টাদশ শতকের বছর বিশেক ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলা ছিল ইংল্যান্ডের অধীনে। ১৯০১ থেকে আবার আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আবার কিছু বছরের জন্য জাপানের অধীন। বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামও ফিলিপিন্সবাসীকে মুক্তি দিতে পারেনি। শেষে ১৯৪৬-এ পূর্ণ স্বাধীনতার শান্তি পেলেও স্বস্তি আজও অধরা। মানবাধিকার হরণে ফিলিপিন্সের প্রায় সবক’টি সরকারই কমবেশি সিদ্ধহস্ত। জাপ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করা ‘হাক আন্দোলন’-জাত বিপ্লবীদের শেষ করল যে ফিলিপিনীয় রাষ্ট্রপতি ম্যাগসেসে, তার নামেই চালু হ’লো মানবসেবার জন্য প্রদত্ত পুরস্কার। তবে নির্মমতার বিচারে রাষ্ট্রপতি ফার্দিনান্দ মার্কোসের ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৬-র সময়কালটিকে হয়তো কাঠামোগত ও প্রত্যক্ষ নির্মমতার বিচারে সবচেয়ে বিপজ্জনক বলা যেতে পারে। প্রত্যক্ষ মার্কিন মদতে ১৯৭২-এ মার্কোসের জারী করা মার্শাল আইনপ্রসূত স্বৈরাচারী নৃশংসতার নিদর্শন পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি নেই।






‘সিজন অফ দ্য ডেভিল’ ছবির দৃশ্য

সিজন অফ দ্য ডেভিল শুরু হয় একটি নারী-আবহ-কন্ঠ দিয়ে, যেখানে বলা হয়—“১৯৭৭ সালে মার্কোস প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রি ১০১৬ জারী করেন। যার ফলে ইন্টিগ্রেটেড সিভিলিয়ান হোম ডিফেন্স ইউনিট (সি এইচ ডি এফ, আধা সামরিক বাহিনী) তৈরী হয়, যাতে প্রায় ৭০ হাজার (প্রকৃত সংখ্যা ৭৩ হাজার—নজরটান লেখক) ফিলিপিন্সবাসীর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়, মূলতঃ কম্যুনিস্ট পার্টি অফ দ্য ফিলিপিন্স ও মিন্দানাওতে মোরো ফিলিপিনোজ-এর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য। মার্শাল আইনের সময়কালে সি এইচ ডি এফ মারাত্মক মানবাধিকার হরণ করে। এই গল্প ১৯৭৯ সালের, যা দক্ষিণ ফিলিপিন্সের প্রত্যন্ত গ্রামে ঘটা সত্য ঘটনা ও বাস্তব চরিত্রদের নিয়ে তৈরী। তারা আমার বন্ধু ছিল। এই ছবি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য ও স্মরণস্বরূপ।”






‘সিজন অফ দ্য ডেভিল’ ছবির দৃশ্য

সম্পূর্ণ ছবিটার সংলাপ গাওয়া হয়। গেয়ে গেয়ে বলা হয়। অনেকটা যন্ত্রানুসঙ্গহীন কাপেলা সঙ্গীতের ঢঙে, কিম্বা বলা চলে শোকসন্তপ্ত মন্ত্রোচ্চারণের সুরে। (যন্ত্রানুসঙ্গহীন গানের উপস্থিতি ডিয়াজের প্রায় সব ছবিতেই লক্ষ্য করা যায়। এই সুর আসলে অনুপ্রাণিত হয়েছিল মালয় শোকাচারের ধরন থেকে (এ ছবির শুটিং-ও মালয়েশিয়ায়), যেখানে মৃতের আত্মীয়েরা মৃতের নামে ক্রমান্বয়ে সন্তাপ করতে থাকে একটা গোটা দিন ধ’রে। বলা যায়, এ ছবির গানগুলো বলা হয় আর সাধারণ কথাগুলোকে গাওয়া হয়। সুর ক’রে বলা কথাগুলো কখনো দু’বার-তিনবার পুনরুক্ত হয়, কখনো একক কখনও বা সমবেতভাবে। গোটা ছবিটা যেন মাত্র একটা গান দিয়েই নির্মিত এক “রক অপেরা” যা রক্তাক্ত অতীতের সঙ্গে সাশ্রু প্রলাপে রত হয় বিষণ্ণ বর্তমানে (বর্তমানের বিষণ্ণতা বিষয়ে পরে আসছি)। অসাড় দেহ-মন নিয়ে টিকে থাকা একটা সমাজ, বিলাপ ছাড়া যেন আশ্রয়হীন। সুর টেনে টেনে বলার এই ধরন দর্শকের সঙ্গে ছবিটার এক জাতীয় বিচ্ছিন্নতা তৈরী করে। তাই অচেনাকরণ (ডিফ্যামিলিয়রইজেশন)-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই বিষয়টাকে পড়তে গিয়ে খেয়াল করছি, এ ছবিতে নির্যাতক আর নির্যাতিত একইরকম সুর টেনে টেনে নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এমনকি একইসঙ্গে গলা মিলিয়ে “লা লা লা লা” ধুয়া (পশ্চিমী শব্দে/ধারণায়— রিফ্রেন) দেয়। হিংসার প্রতিরূপায়নের (রেপ্রেজেন্টেশন) যে প্রত্যক্ষতা (অ)মূলধারার ছবিতে থাকে, তা এখানে স্বভাবতই অনুপস্থিত। কিন্তু একটা অতন্দ্র নজরদারি আর চিরন্তন সহিংসতার গন্ধ লেগে থাকে গোটা ছবিটা জুড়ে। আর থাকে হিংসাদগ্ধ প্রায়োন্মাদ মানুষের অপার জড়ত্ব। এ ছবির সমস্ত গানই ডিয়াজের নিজের লেখা। জনপ্রিয় ফিলিপিনীয় গায়িকা বিতুইন এস্কালান্তে এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন এক কথিকার চরিত্রে।






‘সিজন অফ দ্য ডেভিল’ ছবির দৃশ্য

দক্ষিণ ফিলিপিন্সের প্রত্যন্ত গিন্টো গ্রামে ডাক্তার লোরেনা হানিওয়ে একটা সামান্য ডাক্তারখানা খোলে, যা সি এইচ ডি এফ-এর কর্মীদের হাতে ধ্বস্ত হয়। সি এইচ ডি এফ চালাতে থাকে অসংখ্য প্রকাশ্য ও গুম খুন ও নির্বিচার অত্যাচার। মানুষ খুন ক’রে তার বুকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় পোস্টার—“আমি একজন বিপ্লবী। আমায় অনুকরণ করতে যেও না।” লোরেনাকেও বীভৎস অত্যাচার ও ধর্ষণ করে সি এইচ ডি এফ। তারপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। লোরেনার স্বামী একজন শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী ও কবি— হুগো হানিওয়ে লোরেনার খোঁজে সেই গ্রামে আসে এবং নৃশংসতাবিদ্ধ গ্রামসমাজটিকে প্রত্যক্ষ করে। শেষে সে নিজেও সি এইচ ডি এফ-এর হাতে ভয়ালভাবে অত্যাচারিত হয়। কাহিনী এটুকুই। ডিয়াজের এর আগের ছবি আ লালাবায় টু দ্য সরোফুল মিস্ট্রি (২০১৬) বা দ্য ওম্যান হু লেফ্‌ট (২০১৬) –ছবিতে ঘটনার বাহুল্য যেটুকুও বা লক্ষ্য করা গিয়েছিল, এ ছবিতে যেন সেটুকুও খ’সে পড়েছে। নিরাভরণতার দিকে আরও এক ধাপ এগোনো এই ছবি।






‘সিজন অফ দ্য ডেভিল’ ছবির দৃশ্য

এক কিশোরকে দু’টি দৃশ্যে দেখা যায় এক গাছপালা ঘেরা স্থানে কাগজের তৈরী উড়োজাহাজ নিয়ে খেলে, যেখানে সে এক মানুষী অবয়বের অদ্ভুতদর্শন মুখোশসাঁটা কাউকে প্রত্যক্ষ ক’রে ভয় পায়। আবার ঐ একই মুখোশযুক্ত অবয়ব দেখা যায়, যখন যুবক হুগো কবিতা পাঠ করে। হয়ত কিশোরটি হুগোর ছোটবেলাকে প্রতিবিম্বিত করে। আর এই অবসরে ডিয়াজ ছুঁয়ে আসেন দেশজ পুরাণ-রূপকথা। প্রসঙ্গতঃ ডিয়াজের ছবিতে আত্মজৈবনিকতা যেমন প্রত্যক্ষ তেমনই অতল।

এই ছবির প্রত্যেকটা শট যেন এক-একটা স্বতন্ত্র বাক্য, যা একটা আখ্যানেরই অংশ। কিন্তু আখ্যানের পারম্পর্য রক্ষার্থে/বোঝাতে ‘অর্থাৎ/কিন্তু/তবুও/ফলতঃ’— জাতীয় শব্দ দিয়ে প্রায় কোনো বাক্যই শুরু হয় না। প্রত্যেক বাক্য নির্দিষ্টভাবে শেষ হয় দাঁড়ি (কাট) দিয়ে। বাক্যে ‘এবং’ এসে বসে যখন ল্যারি মান্ডা-র ওয়াইড লেন্সযুক্ত স্থির ক্যামেরা খানিক বাদে একই অবস্থানে থেকে ঘাড় ঘুড়িয়ে (প্যান) বা উঠিয়ে-নামিয়ে (টিল্ট) প্রত্যক্ষ করে ঘটনার চলমানতাকে। প্রতিটা বাক্যের (অর্থাৎ শটের) স্বাতন্ত্র (অটোনমি অর্থে) একটা সম্পূর্ণ আখ্যানকে তার সামগ্রিকতায় বোঝার ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করে। তাই আখ্যানটিকে কার্যকারণে সাজিয়ে নিতে হয় দর্শকের মনে। সাজিয়ে না নিলেও তেমন সমস্যা হয় না, যেহেতু এখানে আখ্যানকেন্দ্রিকতার বদলে ছবিটি অভিজ্ঞতা করার বিষয় হয়ে ওঠে। ইতিহাসের, চলচ্চিত্রের, আখ্যানের স্থান-কালের গতি অথবা গতিহীনতার অভিজ্ঞতাই ডিয়াজের ছবির মূল দর্শনের দিকে নিয়ে যায়। আর্ট সিনেমা বিষয়ক তত্ত্বে চলচ্চিত্রপন্ডিত ডেভিড বর্ডওয়েল “প্যারামেট্রিক ন্যারেশন” নামক এক ধারণার অবতারণা করেন (সেই শব্দবন্ধ আবার আর এক তাত্ত্বিক নোয়েল বার্চ-এর তত্ত্বভিত্তিক)। প্লটের দাবি-নিরপেক্ষভাবে শৈলী বা স্টাইল তৈরী করা হয় যে জাতের ছবিতে, তাকে পাঠ করা যায় প্যারামেট্রিক ন্যারেশন-এর ধারণা দিয়ে।

গত শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক, তাত্ত্বিক জিল দ্যলুজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর একধরনের চলচ্চিত্রকে টাইম ইমেজ হিসেবে পড়েন, মুভমেন্ট ইমেজের বিপ্রতীপে। এ ধরনের ছবিতে ঘটনার ঘনঘটার পরিবর্তে প্রাধান্য পায় কালাশ্রয়ের ধারণা। এ ধরনের ছবি কিছু উপযোগিতাবাদী নীতিমানতান্ত্রিক দৃশ্য-শ্রাব্য তথ্যের (ইউটিলিট্যারিয়ন নর্ম্যাটিভ অডিও-ভিস্যুয়াল ইনফর্মেশন) ওপর দাঁড়িয়ে থাকেনা। ইনফর্মেশন-কাট-ইনফর্মেশন-কাট এমনতর হয় না ছবির ফর্মেশন। একেবারে অ-বিশেষ সাধারণ ন্যূনতম পার্থিব কিছুর অভিজ্ঞতাই ছড়ানো থাকে এখানে। প্রবাহমান সম্পূর্ণ কালীক অভিজ্ঞতা এ জাতীয় ছবির মূল প্রাণস্বরূপ। এই ছবির ধীর ‘দীর্ঘ’ শটগুলি স্থির-আলোকচিত্র এবং সদাচঞ্চল চলচ্চিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে এক সংলাপ তৈরী করে। এখানে কোনো এক বিশেষ চরিত্র বা বিশেষ ক্ষণ বিশেষতা পায় না। ডিয়াজের এই জাতীয় সমস্ত ছবিকেই সেই প্রেক্ষিত থেকে অবশ্যই খানিক পাঠ করা যায়। কিছু চলচ্চিত্রবেত্তা এ জাতীয় ছবিকে ধীর চলচ্চিত্র (“স্লো সিনেমা”) গোত্রভুক্ত করেন। ডিয়াজের ক্ষেত্রে অবশ্য গোত্রটা মূলতঃ হয়—লং সিনেমা। কিন্তু তিনি অবশ্য তাঁর ছবিকে স্লো সিনেমা অথবা লং সিনেমা—কোনো অভিধাতেই আখ্যায়িত করতে চান না। তিনি বলেন—আমরা কী ক্যানভাসের মাপ দেখে বিচার করি ছোট চিত্রকলা বা বড় চিত্রকলা! ডিয়াজ বারবার স্বিকৃত হয়েছেন যে ডিজিটাল প্রযুক্তি ছাড়া এই ধীর ও দীর্ঘ-নান্দনিকতার পথে হাঁটা সম্ভব ছিল না। তাঁর কাছে “ডিজিটাল হলো মুক্তির ধর্মতত্ত্ব”। এই স্বিকৃতিটুকুর ওপর দাঁড়িয়ে, আমরা হয়ত গোত্রান্তর ঘটিয়ে তাঁর ছবিকে ‘কালিকতার সিনেমা’ (ড্যুরেশনাল) গোত্রভুক্ত করতে পারি বড়জোর। আবার খেয়াল রাখা দরকার যে, হাঙ্গেরির পরিচালক বেলা টার যে মিকলস জাঙ্কসোর ছবির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাঁর লম্বা শটগুলো কিন্তু ডিয়াজের থেকে একেবারেই আলাদা এবং টারের শটও একেবারেই জাঙ্কসোর শটের সাধারণ (টিপিক্যল অর্থে) অনুসরণ নয়।






‘সিজন অফ দ্য ডেভিল’ ছবির দৃশ্য

সময় এক পশ্চিমী ধারণা—ডিয়াজের মত। স্থান (স্পেস) তাঁর ছবিতে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে আসে। ঐ নির্দিষ্ট স্থানগুলোকে বাদ দিয়ে তাঁর দীর্ঘ শট অসম্ভব। ছবির চরিত্রেরা ঐ স্থানগুলোতেই (ব্যাকগ্রাউন্ড, সেটিং) একমাত্র অবিশ্বাস্য বিশ্বাসযোগ্যতায় উপস্থিত থাকতে পারে। দার্শনিকভাবে পরিসর/স্থান ডিয়াজের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাইই হয়ত ফিলিপিন্সের সেইসব বাস্তব মাঠঘাট-রাস্তা-গ্রাম-জঙ্গল তার ছবি জুড়ে থাকে যেখানে কবর দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে সে দেশের রক্তাক্ত ইতিহাস। অর্থাৎ ইতিহাসের দীর্ঘ ছায়া সমাজ/ব্যক্তিমানসে যে দীর্ঘ জায়গা জুড়ে পড়ে, সে পরিসরটিকেই দেখেন ডিয়াজ। কালিকতার আগে স্থানিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে বিচার করতে হবে ডিয়াজের ছবি পড়ার সময়ে। আঘাত-যন্ত্রণা-শুশ্রূষার বোধ (সমাজের, সময়ের) শারীরস্থান জুড়ে ছড়িয়ে থাকে যে।

ছবিতে একটা শট দীর্ঘস্থায়ী হ’তে হ’তে এমন এক বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গায় যায় যেখানে ‘উইলিং সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফ’ (মূলতঃ নাট্যতত্ত্বে ব্যবহৃত)-এর প্রশ্নের মতো কিছুও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে প’ড়ে, এক বাস্তব ধরনের পথ ধরে। এই চলচ্চিত্রীয় বাস্তববাদ কিন্তু আবার প্রচলিত অর্থে ইতালীর সেই নয়া-বাস্তববাদ অর্থে বাস্তববাদ একেবারেই নয়। আধুনিকতার সঙ্গে এর সম্পর্কও যথেষ্ট জটিল। আলোকসম্পাতের প্রশ্নেও একই কথা বলা যায়। কিছু দৃশ্য যেমন শুধুই সূর্যের আলোতে তোলা, কিছু কিছু দৃশ্যের আলো ঠিক ততটাই কেতাদুরস্ত (স্টাইলাইজড)। চরিত্রদের মুখে আলো ফেলার বদলে অনেক সময়েই চরিত্রদের/জায়গার পেছন থেকে এমন কৌণিকতায় তীব্র আলো এসে পড়ে, যা একেবারেই বাস্তবানুগ নয়। এমনকি প্রপের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য একথা। ছবির প্রায় তিন ঘন্টার মাথায় আবক্ষ মূর্তি ভেঙে ফেলার দৃশ্যতে মূর্তিটাকে থিয়েটরের সাজেস্টিভ প্রপ মনে হয়। স্থান-কাল সম্পর্কিত চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা বিষয়ক প্রথাগত চোখটাই বদলে যায় ডিয়াজের ছবিতে। ডিয়াজ এক সাংস্কৃতিক সংগ্রামের কথা বলেন। তিনি সওয়াল করেন ফ্রি বা ইমানসিপেটেড বা মুক্ত চলচ্চিত্রের পক্ষে। আখ্যানধর্মী ছবি হলেও এখানে লরা মালভি-কথিত পোজেসিভ দর্শকের যুক্তিতে দৃশ্যসুখ (ভিস্যুয়ল প্লেজার)-এর অনুপস্থিতির ফলে তারকাবিগ্রহপুজা (আইকনোফিলিয়া) স্থানচ্যুত থাকতে বাধ্য হয়। তাঁর চলচ্চিত্রভাষার অনন্যতার কারণেই ডিয়াজ অত্যর-এর আসন পান (যদিও ডিয়াজ তাঁর ছবির সমস্ত কলাকুশলীকেই সেই উপাধি দিতে চান)।






‘সিজন অফ দ্য ডেভিল’ ছবির দৃশ্য

কিন্তু তাঁর ছবিতে কেন ফিরেফিরে হানাহানির কাহিনী উঠে আসে? শুধুই কী রক্তাক্ত নৃশংসতার ইতিহাসকে ভুলতে না চেয়ে! উত্তরটা স্পষ্টতই—না। উত্তরটা বরং এক জ্বলন্ত বর্তমান। আর এখানেই বর্তমানের বিষণ্ণতার প্রশ্ন। ২০১৮-য় যখন এই ছবি মুক্তি পাচ্ছে তখন দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রডরিগো ডুতের্তে “ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে”র নামে অকল্পনীয় হিংসা ঘটাতে এবং ছড়াতে বহু স্বৈরাচারী শাসককে হেলায় পেছনে ফেলে দিচ্ছেন (ন্যু ইয়র্ক টাইম্‌স কর্তৃক নির্মিত তথ্যচিত্র হোয়েন আ প্রেসিডেন্ট সেজ আ’ল কিল ইউ দ্রষ্টব্য)। সিজন অফ দ্য ডেভিল ছবিতে আমরা দেখি সি এইচ ডি এফ-এর এক স্থানীয় নেতা চেয়ারম্যান নারসিসো-কে। স্থানীয় অঞ্চলের সর্বত্র তার মুখের পোস্টার টাঙানো। সে উচ্চস্বরে ভাষণ দিতে থাকে। তার কথাগুলোর কোনো সাবটাইটল অবশ্য ডিয়াজ হাজির করেন না, সম্ভবত এ কারণে যে হিংসাকে ন্যায্যতা দেওয়া ভাষণ এতটাই মিথ্যে ও অন্তঃসারশূন্য হয় যে সেটা আর তার দর্শকদের নতুনভাবে শোনার/বোঝার কিছু থাকতে পারে না। সেই নারসিসোর মাথার দু’দিকে দু’টো মুখ। এই দু-মুখো নেতাকে দেখে মনে হয় মার্শাল ল-র সময় এ ছবির মূল প্রেক্ষিত হলেও এবং ডিয়াজ মার্শাল ল-র শিকারদের উদ্দেশে তাঁর এই ছবি উৎসর্গ করলেও; হয়ত একদিকের মুখ প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোসের হ’লে অন্য মুখটা বর্তমান প্রেসিডেন্ট রডরিগো ডুতের্তে-র। প্রসঙ্গতঃ আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে সিজন অফ দ্য ডেভিল-এর ছবি তোলা হয়েছিল মালয়েশিয়ার কুয়ালা লুমপুরে। এমনকি ডিয়াজ তাঁর ছবিতে ফিলিপিন্সের চলচ্চিত্র তারকাদেরও এখন অভিনয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনকি ডিয়াজের ছবির প্রযোজনা বিষয়েও সাহায্য করছেন। জন লয়েড ক্রুজের মতো তারকা-অভিনেতা তাঁর সঙ্গে এখন প্রায়শই কাজ করছেন।






‘সিজন অফ দ্য ডেভিল’ ছবির দৃশ্য

সিজন অফ দ্য ডেভিল-এর চরিত্রদের কেমন যেন ঘোরলাগা মানুষ ব’লে বোধ হয়। তারা যেন ডুবে আছে এক নিঃসীম নৈঃশব্দের মধ্যে। সেই নৈঃশব্দ তাদের মুখনিঃসৃত শব্দকেও গিলে ফেলে মনে হয়। দেখার চেয়ে শোনা অনেক বেশি জ্যান্ত হয়ে থাকে ছবিটা জুড়ে। যন্ত্রণার ইতিহাস যে চোখে দেখার নয়, তা যে বুক দিয়ে শোনার। শব্দসজ্জায় নিমজ্জিত হ’তে হ’তে মনে হয় ঝড়ের পরের এক বিধ্বস্ত পরিবেশের ভয়ালগ্রাসে আছে সময়টা। অথবা আছে ঝড়ের ঠিক পরের থমথমে পরিবেশে আধো সম্মোহিত অবস্থায়। এ অবস্থা কী উত্তর-আঘাত (পোস্ট ট্রমা)-এর মনোজগতের সঙ্গে তুলনীয় নাকি পূর্ব-আঘাতের সঙ্গে? উত্তর হয়ত লুকিয়ে আছে— পার্পেচুয়াল পার্সিক্যুটরি প্যারানয়ার দীর্ঘদীর্ণ ফিলিপিনীয় বাস্তবতার মধ্যে।

*****