সেসব বহু পুরনো কথা। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ শতকের ইতিহাসচর্চায় ইংল্যান্ডের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন নিয়ে খুব হইচই হচ্ছে। সেই সময়েই ১৯৬৪ সালে বের হল ই পি থমসনের বই, দ্য মেকিং অব দ্য ইংলিশ ওয়ার্কিং ক্লাস। শ্রমিকদের শ্রেণী হিসেবে গড়ে ওঠার সে ইতিহাস যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তা মানেন ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ আর সমাজবিজ্ঞানীরা। কিন্তু প্রশ্ন হল, ইংল্যান্ডের তথাকথিত জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে শ্রমিকদের প্রাপ্তি কী? এই বইতেই থমসন ব্যঙ্গের সুরে লিখেছেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে তাঁদের লাভের ঘরে জমা পড়েছিল একটু বেশি আলু, পরিবারের জন্য কিছু কাপড়চোপড়, সাবান আর মোমবাতি, কিছু চা আর চিনি আর ইকোনমিক হিস্ট্রি রিভিউ-তে অনেক অনেক নিবন্ধ! থমসনের নিজের ভাষা উদ্ধৃত না করলে বোধহয় সবটা বুঝিয়ে উঠতে পারা যাবে না। তিনি লিখেছিলেন, [the laborer’s] “own share in the ‘benefits of economic progress’ consisted of more potatoes, a few articles of cotton clothing for his family, soap and candles, some tea and sugar, and a great many articles in the Economic History Review” (p. 318).
এই পুরনো কথা মনে পড়ল হাল-আমলে শ্রমিকদের কথা ভাবতে গিয়ে, তাঁদের নিয়ে লিখতে গিয়ে। ইতিহাস হোক কি বর্তমান, শ্রমিকদের নিয়ে আলোচনায় শ্রমিকদের প্রাপ্তি কী? কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান আর সহানুভূতি? সমানুভূতি ছাড়া কি কোনো আলোচনা আদৌ শ্রমিকদের কাজে লাগতে পারে? নাকে চশমা-আঁটা গবেষক সমাজবিজ্ঞানীরা শ্রমিকদের নিয়ে যা লিখবেন বা বিতর্কসভায় যা বলবেন তাতে চায়ের কাপে তুফান উঠতে পারে কিন্তু চা-শ্রমিকদের অবস্থার হাল ফেরাতে পারবে কি?
আবার এই সমানুভূতি আর চা-শ্রমিকদের প্রেক্ষিতে আরও এক পুরনো কথা মনে পড়ল। দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় আসামের চা-কুলিদের দুরবস্থা বোঝার জন্য ১৮৭৬-৭৭ সালে নিজেই চা-কুলির ছদ্মবেশে চলে গিয়েছিলেন সেখানে। তারপরে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন কৃষ্ণকুমার মিত্র সম্পাদিত সঞ্জীবনী সাময়িকপত্রে। আজকের সংবাদমাধ্যমের ভাষায় যাকে বলে “অন্তর্তদন্তমূলক সাংবাদিকতা” তারই পুরোধা হিসেবে চিহ্নিত করা যায় দ্বারকানাথের এই উদ্যোগকে। তাঁর এই অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে বই বের হয় স্লেভারি ইন ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন নামে।
পুরনো কথা থাক। একেবারে হাল আমলের কথা বলি। মার্চ ২০২০ থেকে এদেশে কোভিডজনিত রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ জারি হয়। জনতা কার্ফু দিয়ে সে-প্রক্রিয়ার শুরু। পরে তার সঙ্গে যুক্ত হয় দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন। এই লকডাউন এমনই হঠাৎ করে শুরু হয়ে যায় যে যাঁরা যেখানে ছিলেন তাঁরা কেউই আর তাঁদের বাড়ি ফিরতে পারেন নি। ফলে এই অবস্থায় সবচেয়ে সমস্যায় পড়েন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। আর তখনই সবার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায় দেশে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কত! পরিযায়ী শ্রমিক অর্থ হল যাঁরা তাঁদের স্থায়ী বাসভূমি ছেড়ে অন্য জায়গায় কাজের সন্ধানে যান। বলা বাহুল্য সেখানে থাকার পরিবেশ মোটেই ভাল থাকে না। একটা ছোট ঘরে অনেক শ্রমিককে থাকতে হয়; “ঘেঁষাঘেঁষি আর ঠেসাঠেসি করে গায়ে গায়ে শুধু কুট কুট।” অনেকেই তাঁদের পরিবার নিয়ে যেতে পারেন না। আর যাঁরা পরিবার নিয়ে যান তাঁদের অবস্থা যে বিশেষ ভাল থাকে তাও তো নয়। স্ত্রী হয়ে যান কম মজুরির নারীশ্রমিক, শিশুসন্তান অনেক ক্ষেত্রেই আরও কম মজুরির শিশুশ্রমিক বা বিনা পয়সার ফাই-ফরমাস খাটার লোক। কোথায় সর্বশিক্ষা অভিযান আর কোথায়ই বা মিড-ডে মিলের গল্প! ফলে স্কুলের চৌকাঠ পেরোনোই হয় না সপরিবারে পরিযায়ী শ্রমিক হওয়া পরিবারের শিশুদের। এগল্প অতিমারি ব্যতিরেকে ‘স্বাভাবিকতা’র কাহিনী। আর অতিমারির সময়ে আমরা দেখেছি শ্রমিকদের তাঁদের বাড়ি ফেরার প্রাণান্তকর চেষ্টা। কোলে-কাঁখে শিশুসন্তান আর তার সঙ্গে ভারি ব্যাগ। ট্রেন বন্ধ বলে রেললাইনের ওপর দিয়ে পথ হাঁটার নিদারুণ চেষ্টা। তাঁদের ওপর দিয়ে মালগাড়ি চলে যাওয়া আর তার ফলে শ্রমিকের রক্তে লাইন ভিজে যাওয়ার কথাও আমরা খবরের কাগজে পড়েছি। দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে দেখেছি রক্তভেজা রেললাইনের ছবি। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, কেন পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফেরার চেষ্টা করলেন? এর উত্তরে বলা যায়, উৎপাদন না হলে কোন নিয়োগকর্তাই বা এই শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে যাবেন? তাহলে এঁদের চলবে কি করে? আয় নেই অথচ খাবার যোগাড় করা, বাড়ি ভাড়ার সংস্থান করাই বা সম্ভব হবে কি করে! কাজেই “ঘরে ঢুকে পড়ুন” জাতীয় স্লোগান যে মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা বেশ বুঝতে পারা যায়।
ভাবছেন, অতিমারি শুধু শ্রমিককে বাড়ি ফেরার জন্য পথে নামাল? না, আক্ষরিক অর্থে শ্রমিকদের পথে বসাল এই মহামারি। খবর রাখেন কি যে এই অতিমারির সুযোগে দেশের শ্রম আইনে সাংঘাতিক সব বদল ঘটে গেছে রাজ্যে রাজ্যে?
বিভিন্ন বণিকসংস্থার তরফে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন করার যেসব প্রস্তাব সরকারকে দেওয়া হয়েছিল তা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে অধ্যাদেশের মাধ্যমে বলবৎ হয়ে গেছে। এই তালিকায় রয়েছে গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, আসাম। বণিক সংস্থার প্রস্তাব ছিল দেশের সমস্ত শ্রম আইন তিন বছরের জন্য মুলতুবি রাখার। আর উত্তরপ্রদেশ সরকার সেটাই পুরোপুরি কার্যকর করেছে। গুজরাট সরকার শ্রম আইনে ছাড় দিয়ে দিয়েছে বারোশো দিনের জন্য আর মধ্যপ্রদেশ সরকার হাজার দিনের জন্য। শিল্পপতিদের দাবি মেনে শ্রমিকদের দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে বারো ঘণ্টা। অর্থাৎ আগে শ্রমিকদের সাপ্তাহিক কাজের সময় ছিল আটচল্লিশ ঘণ্টা আর অতিমারির অজুহাতে তা এক ধাক্কায় বাড়িয়ে করা হল বাহাত্তর ঘণ্টা। কম শ্রমিকদের বেশি সময় কাজ করানোর অধিকার পেয়ে গিয়ে শিল্পমালিকরা স্বাভাবিকভাবেই অবাধ ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটবে। আর সে সুযোগের সংস্থানও রয়েছে এই সমস্ত অধ্যাদেশে।
আপনাদের মনে আছে কি যে ২০২০-র ২৯শে মার্চ প্রথম দফা লকডাউনের সময় সংঘ সরকার যে নির্দেশিকা জারি করেছিল তাতে বলা হয়েছিল লকডাউন পর্বে বেসরকারি সংস্থার কর্মীদেরও সরকারি সংস্থার কর্মীদের মতো পুরো বেতন দিতে হবে। কোনো কোম্পানি এই নির্দেশ লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এর দেড় মাস পরেই সরকারি সিদ্ধান্ত পালটে যায়। ২০২০-র ৭ই মে-র নির্দেশে বেতন দেওয়ার আগের নির্দেশটি তুলে দেওয়া হয়। কাজেই বুঝতেই পারছেন, এই অতিমারির সময়ে সরকার কতখানি শ্রমিকদরদী ভূমিকা পালন করেছেন!
তবে আগেই বলেছি, অতিমারিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশায় যারা আহা আহা করছেন তাঁরা তথাকথিত স্বাভাবিক অবস্থায় তাঁদের দুর্গতির দিকটাও ভেবে দেখুন। ১৯৯১ পরবর্তী পর্বে বিশ্বায়ন, উদারীকরণ আর বেসরকারিকরণের হাত ধরে যে নতুন ভারতের যাত্রা শুরু তাতে ভারি শিল্পের ভারে নাভিশ্বাস উঠেছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের। বেসরকারি দেশি-বিদেশি পুঁজি আনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আর রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন সরকারের মধ্যে শিল্পপতিদের নানান সুযোগ সুবিধা দেওয়া আর বিভিন্ন বিধিনিষেধ থেকে ছাড় দেওয়ার যেন প্রতিযোগিতা চলছে দেশজুড়ে। ফলে শ্রমিকের অধিকার নানানভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে অধিকার অর্জন করা একরকম অসম্ভব। সেখানে নিয়োগকর্তার বিষয়টিই অস্পষ্ট। আজকের এজেন্সিনির্ভর চুক্তিভিত্তিক কাজেও একইরকম অস্পষ্ট নিয়োগকর্তার বিষয়টি। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে, সরকারি এবং সংগঠিত ক্ষেত্রেও শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার ক্রমহ্রাসমান। শ্রম আইন বদলাচ্ছে। আর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা সেজ (এস ই জেড, স্পেশাল ইকোনমিক জোন)-এ তো শ্রমিকের মূল অধিকারগুলোই স্বীকৃত নয়। তথ্য হিসেবে জানানো যাক যে কেন্দ্রীয় স্তরে ২০০৫ সালে ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ চালু হওয়ার ঢের আগে ২০০৩ সালে এ-রাজ্যে সেজ আইন জারি হয়েছিল। সেই মর্মে রাজ্যের শিল্পসচিব নির্দেশনামা জারি করেন (মেমো নম্বর ১৮২৫/ জে এস/ ডি সি/ ২০০৩)। কাজেই জীবন জীবিকার বহু অধিকার অর্জন করার ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা বঞ্চিত। শ্রমজীবী মানুষদের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। আর ভাববেন না যে সবকিছু অতিমারির সময়েই হচ্ছে। ২০১৯ থেকেই দেশের শ্রম আইনে বড় পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে। কিরকম সেই বদল? খুব ছোট করে বলা যাক সে-কথা।
আগেকার ২৯টি শ্রম আইন বদলে এখন দেশে চারটে শ্রম কোড তৈরি হয়েছে। এগুলি হল, দ্য লেবার কোড অন ওয়েজ অ্যাক্ট ২০১৯ বা মজুরি সংক্রান্ত শ্রম কোড, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশান কোড ২০২০ বা শিল্প সম্পর্ক কোড, কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি ২০২০ বা সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোড এবং অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশনস কোড ২০২০ বা পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কাজের শর্তাবলি সংক্রান্ত কোড।
মজুরি সংক্রান্ত কোডে যা আছে তা শ্রমিকের মজুরি কমাবে; শিল্পপতিদের লাভ হবে এই যে সস্তার শ্রমিক মিলবে আরও বেশি করে। শিল্প সম্পর্ক কোডে “সামাজিক ও মানবকল্যাণের কাজে যুক্ত” সংস্থার মালিকানাধীন কোম্পানি আদৌ শিল্প হিসেবে বিবেচিত হবে না বলে বলা হয়েছে। ভারতের সার্বভৌম কাজের সঙ্গে যুক্ত কোনো ক্ষেত্রের (যেমন প্রতিরক্ষা, পারমাণবিক শক্তি, মহাকাশ গবেষণা) কাজও শিল্প নয়। শিল্প নয় গৃহকর্ম (মনে রাখুন বিশ্বায়িত দুনিয়ায় বড় শিল্পের টুকরো টুকরো অংশের কাজ কারখানায় হয় না, হয় বাড়িতে, ছোট কারখানায়- বড় কারখানায় শুধু চলে অ্যাসেম্বলিং বা জোড়ার কাজ) আর তাছাড়া সংঘ সরকার ইচ্ছে করলে যেকোন ক্ষেত্রই ‘শিল্প নয়’ বলে দেগে দিতে পারে। শিল্প নয় মানে শিল্প সম্পর্ক আইনের আওতাতে নেই এইসব ক্ষেত্র।
এই আইনে আগেকার লেবার কমিশনারের সালিশির সংস্থানেরও অস্ত ঘটে গেছে। আরও শুনবেন? আগেকার শ্রম আইনে একশোর বেশি শ্রমিক আছে এমন সংস্থায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ে বিধিনিষেধ ছিল। নতুন কোডে তা আর থাকছে না। আগে ফ্যাক্টরি আইন প্রযোজ্য হত কোনো সংস্থায় ১০ জন কাজ করলে এবং বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে। সেটা বাড়িয়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ ২০ জন করা হয়েছে। আগে নিয়ম ছিল বিদ্যুৎ ব্যবহার না করলেও যদি ২০ জন শ্রমিক কাজ করে তবে তা ফ্যাক্টরি আইনের আওতায় আসবে। এটাও দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪০ জন করা হয়েছে। ফলে ছোট ছোট এককে কাজ বাড়িয়ে শিল্পমালিকরা কাজ করালে কোনো শ্রম আইনই সেখানে কার্যকর হবে না।
আগে শিল্পে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগে বিধিনিষেধ ছিল। লুপ্ত হয়েছে সে ধারা। এখন ঠিকাদাররাও নিয়োগকর্তা। ফলে কোনো সংস্থা স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ না করে নির্দিষ্ট সময়ের চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করে দিব্যি কাজ চালাতে পারবে। তাদের শ্রমের যাবতীয় সুবিধা শিল্পকর্তারা পাবে অথচ সেই শ্রমিকদের ন্যূনতম স্বার্থপূরণের কোনো দায় তাদের নিতে হবে না। আর ঠিকা শ্রমিক নিয়োগে কোথায়ই বা চুক্তি আর কোথায়ই বা শর্ত; ঠিকাদার সংস্থা যা চাইবে তাই হবে!
আগের আইনে নিয়োগকর্তাকে শ্রমিক নিয়োগের সময় জানাতে হত চাকরির শর্ত; কাজের সময়, মজুরি, কাজের পরিবেশ এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সম্বন্ধে। ১০০ জন বা তার বেশি শ্রমিক থাকলে আগে এই নিয়ম কার্যকর হত; এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩০০ জন বা তার বেশি। একই গল্প শ্রমিক ছাঁটাই, ক্লোজার বা লে অফের ক্ষত্রে। সেক্ষেত্রেও আগে তা প্রয়োগের সীমা ছিল ১০০ বা তার বেশির ক্ষেত্রে যা এখন বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য আজকের যন্ত্রায়নের দিনে এত বেশি শ্রমিক প্রায় কোনো কারখানাতেই কাজ করেন না। ফলে বকলমে শিল্পমালিকদের সবরকম দায়দায়িত্ব থেকে ছাড় দিয়ে দেওয়া হয়েছে! এর প্রতিবাদে শ্রমিকরা ধর্মঘট করবেন? না, সে সুযোগও নেই। চোদ্দ দিন আগে ধর্মঘটের কথা মালিককে না জানালে তা হবে ‘বেআইনি’; অর্থাৎ শ্রমিকরা ধর্মঘট করার অধিকারও হারালেন। আর এমনভাবে সব বদল আনা হল তাতে আগের শ্রমিকরা আর শ্রমিকই রইলেন না। ফলে সামাজিক নিরাপত্তার দিকেও কার্যত দাঁড়ি পড়ে গেল!
অবশ্য ব্যাপারটা এমন নয় যে আগে শিল্পমালিকরা সবাই খুব আইন মেনে চলতেন! সেখানেও অনিয়ম ছিল শ্রমিকের নিত্যসঙ্গী। শ্রমিকের বেতন থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কাটা হচ্ছে অথচ তা সরকারি তহবিলে জমা দেওয়া হচ্ছে না এমন অভিযোগ তো ভুরি ভুরি ছিল। ছিল আরও নানান নৈরাজ্য। কিন্তু সেইসব নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করার অস্ত্র শ্রমিক বা শ্রমিক সংগঠনের হাতে ছিল। আইন বদলে এখন আক্ষরিক অর্থেই শ্রমিকদের হাতে রইলো পেন্সিল!
পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কাজের শর্তাবলিতেও বড় বদল ঘটে গিয়েছে। আগে ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পে তো বটেই, অন্য শিল্পেও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকতেন ‘সেফটি অফিসার’ অথচ এখন ‘সেফটি অফিসার’ থাকার কথা সেই সব জায়গাতেই যেখানে ৫০০ জনের বেশি শ্রমিক কাজ করেন, যে বিপজ্জনক কাজে ২৫০ জন কাজ করেন (যেমন নির্মাণ কাজ) বা যে খনিতে ১০০ জন কাজ করেন। বুঝতেই পারছেন খনিশিল্পের মত ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পেও নিরাপত্তার বালাই থাকবে না। বলা হয়েছে, নিরাপত্তার দায়িত্ব শ্রমিকের। হঠাৎ করে কোনো কারখানা পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়ার যে ক্ষমতা আগে ইনস্পেক্টরের ছিল লোপ পেয়েছে সেই ব্যবস্থা। সবই নাকি শিল্পের স্বার্থে! (পড়ুন শিল্পমালিকদের স্বার্থে)। এতো গেল সংগঠিত ক্ষেত্রের কথা। আইন থাকা বা না থাকার বিষয় সেখানেই প্রযোজ্য। এখন নতুন শ্রম কোড চালু করার মাধ্যমে সংগঠিত ক্ষেত্রকেও অসংগঠিত করে দেওয়া হচ্ছে।
আগে ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিকদের পক্ষে যে লড়াই করত তাতে যেমন নিষ্ঠা ছিল আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফাঁক ও ফাঁকিও থাকত। একটা চালু অভিযোগ এই যে শ্রমিক নেতারা অনেক সময়ই শ্রমিকস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থে বা তাঁরা যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের পক্ষে কাজ করতেন। তথাকথিত ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ বলি দেওয়া হত সাধারণ শ্রমিকদের রুটি-রুজি-নিরাপত্তার ‘ছোট স্বার্থ’। এরই প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের পরিবর্তে কোনো কোনো শিল্পে গড়ে উঠেছিল কারখানাকেন্দ্রিক ট্রেড ইউনিয়ন যাদের টিকি বাঁধা ছিল না কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে। আবার শ্রমিক সমবায়ের মাধ্যমে কারখানা চালুর দৃষ্টান্তও রয়েছে। তবে লড়াইটা এতটাই অসম যে সেখানে হাল ধরে রাখাই কঠিন।
এদেশে শ্রমিকদের মাত্র সাত শতাংশ কাজ করেন সংগঠিত ক্ষেত্রে আর বাদবাকি তিরানব্বই শতাংশের কর্মক্ষেত্র অসংগঠিত ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে লড়াই আরও কঠিন। বিড়িশ্রমিক, নির্মাণশিল্পের শ্রমিক বা হকার হলেন এই অসংগঠিত ক্ষেত্রের বড় অংশ। এক্ষেত্রে সরকারের দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। সামাজিক নিরাপত্তার নানান বিধি, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প রচনা ও তার যথাযথ প্রয়োগ করার দায় পুরোপুরি সরকারের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার দায় পালন করেছেন আবার দায়িত্বপালন না করার অভিযোগও ভুরিভুরি। একাজে এক বড় সমস্যা শ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে নথিভুক্ত না থাকা। গৃহসহায়িকা (পড়ুন পরিচারিকা), ফেরিওয়ালাদের বেশির ভাগই নথিভুক্ত নন। ফলে তাঁরা সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প থেকে বঞ্চিত। আর তাছাড়া এঁদের বেশির ভাগেরই জীবিকা নির্দিষ্ট নয়। আজ যাঁরা ঠিকা শ্রমিক, কাল তাঁরাই কাজ হারানো ফেরিওয়ালা।
আবাসনে বাস করা শহুরে মধ্যবিত্তরা যে নিরাপত্তারক্ষীদের ভরসায় নিরাপদে বাস করার অনুভূতি লাভ করেন তাঁরা কতটা সচেতন এজেন্সির মাধ্যমে নিযুক্ত সিকিউরিটি গার্ডদের অবস্থা সম্পর্কে? আজকের গৃহশ্রমের একটা বড় অংশ বহন করেন এজেন্সির মাধ্যমে নিযুক্ত আয়ারা। তাঁরা কতটা বঞ্চিত হন সেখবর ক’জন রাখেন! চাহিদাভিত্তিক অর্থনীতির এই বদল ঘটে চলেছে চোখের সামনেই। এজেন্সি নামক দালাল সংস্থা মধ্যবিত্তকে যে নিরাপত্তার আশ্বাস দেয় তা কতটা যথার্থ? আর সেই ছদ্মনিরাপত্তার আড়ালে মধ্যবিত্ত কি শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে সম্পৃক্তি হারাচ্ছে?
এদেশে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস বলে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী শ্রমিক স্বার্থরক্ষায় প্রয়াসী হয়েছিলেন ব্রিটিশ আমলে। অবশ্য সেই পাশে দাঁড়ানো যে একমাত্রিক ছিল তা নয়। আজকের সরকার যেমন শিল্পবন্ধু হয়ে শ্রমিক স্বার্থ বিঘ্নিত করছে সেরকম দৃষ্টান্ত ব্রিটিশ আমলেও মেলে। কংগ্রেসের এক অধিবেশনে খনিশ্রমিকদের কাজের সময় কমানোর, মজুরি বাড়ানোর সরকারি প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয়েছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী খনিমালিকদের স্বার্থে। সেই বিরোধিতার পক্ষে যুক্তিও ছিল। কারণ ব্রিটিশ সরকারি প্রস্তাব যে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় দেওয়া হয়েছিল তা নয়। ব্রিটিশদের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ খনিমালিকদের স্বার্থে ভারতীয় খনিজ দ্রব্য উত্তোলনের উৎপাদন ব্যয় বাড়ানো। ফলে বিষয়টা জটিল এবং বহুমাত্রিক।
যে কথা দিয়ে এ-লেখার শুরু আবার সে প্রসঙ্গে আসি। সব মিলিয়ে শ্রমিকদের প্রাপ্তি কী? শ্রমিককে শ্রেণী হিসেবে না দেখে তাদের নানান নামে বিশেষিত করার যে নতুন রাজনীতি শুরু হয়েছে তার মাধ্যমে যে অ-রাজনীতির বিকাশ শুরু হয়েছে তা কি শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থহানি করছে না? মধ্যবিত্ত অংশ কি শ্রমিকের সহযোগী নাকি শ্রেণীশত্রু? যে কর্পোরেট সংস্থার কর্মী তার বাড়ির কাজে আয়া-গৃহসহায়িকা বা আবাসনে নিরাপত্তাকর্মীকে কাজে নিয়োজিত করছেন তিনি কি ভাবছেন ঝাঁ চকচকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অফিসে কাজ করলেও তিনি আদতে তাঁর কোম্পানির ভাড়া করা চুক্তিবদ্ধ ঠিকা শ্রমিক বৈ কিছু নন? সেই ভেবে শ্রমিকদের প্রতি তাঁর কি শ্রেণী-সংহতি তৈরি হচ্ছে?


মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের সরকার যত শ্রমিকবিরোধী পদক্ষেপ নেবে তত দায়িত্ব বাড়বে নাগরিক সমাজের। শ্রমিক স্বার্থে কাজ করা কোনো দয়া নয়, বরং দায়। সেই দায় কোনো কোনো ব্যক্তি তাঁদের পড়াশোনা ও গবেষণায় পালন করছেন। কোনো পত্রিকা সেই বিষয়ে আলোচনার পরিসর দিয়ে তাঁদের দায়বদ্ধতার প্রমাণ দিচ্ছেন। কোনো সংগঠন সীমিত সামর্থ্যে লড়াই চালিয়ে শ্রমিক অধিকার আদায় করে নিচ্ছেন। ভুলে গেলে চলবে না ঝাড়গ্রামের পাথরখাদানের শ্রমিকদের সিলিকোসিস রোগজনিত অসুস্থতা এবং মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব হয়েছিল বিজ্ঞানকর্মী বিজন ষড়ঙ্গী ও তাঁর পত্রিকা টপ কোয়ার্ক-এর লড়াই এবং নাগরিক মঞ্চের মত সংগঠনের সহযোগী ভূমিকা পালন করার জন্য। তার ফলেই সুপ্রিম কোর্ট থেকে মিলেছিল শ্রমিকের পেশাগত রোগের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার মত তাৎপর্যপূর্ণ রায়। এই সব লড়াইয়ের কাহিনী নিশ্চয়ই আজকের লড়াইকেও উদ্বুদ্ধ করবে।
বিজন ষড়ঙ্গী ও কোয়ার্ক পত্রিকার ছবিঃ বিজন স্মরণে
*****