আমার দাদা – জয়ন্ত দে

   এক

আমাদের বংশের কারও চোখের সমস্যা ছিল না। একমাত্র আমার দাদার চোখই নাকি ছোটবেলা থেকে খারাপ। আর এই চোখ খারাপ হওয়ার জন্য দাদাকে চশমা পরতে হতো। সেই চশমাটার ফ্রেমটা ছিল গোল। এই গোল চশমার জন্য ছোটবেলায় আমার দাদাকে সবাই নেতাজি বলত।

—এটা আমার শোনা কথা। একটু বড় হয়ে এই কথাটা শুনে আমি তীব্র প্রতিবাদ করি। বলি, নেতাজি হতে গেলে সাহস লাগে, মানসিক দৃঢ়তা লাগে, সংকল্প লাগে।

যে দুর্মুখরা গোল চশমার কথা বলে আমার দাদাকে নেতাজি বলত, তারা বলল, ‘একটা গোল চশমা লাগে!’  

আমার দাদার একটা গোল চশমা ছিল।

ছোটবেলায় আমি যা দেখেছি, দাদা মানেই গোল ফ্রেমের একটা চশমা। এই চশমার জন্যই কি দাদাকে সবাই নেতাজি বলত? আমার মনে হয় শুধুমাত্র চশমা নয়। আরও অনেক কিছু গুণ ছিল, যা দাদাকে নেতাজি করেছিল তা বুঝতে পেরেও অনেকে না-বোঝার ভান করত।

আমি দেখতাম যেকোনও খেলাতে দাদাই ক্যাপ্টেন। দাদা যে দলের ক্যাপ্টেন হত, সবাই সে দলেই থাকতে চাইত। সবার ধারণা ছিল— দাদা মানেই সেই দল জিতবে। কিন্তু অনেকে সময়ই দাদার দল হারত, কিন্তু কী এক অদ্ভুত ম্যাজিকে দাদা হেরে যাওয়াটাকে তেমন পাত্তা দিত না।  তবে হ্যাঁ, ১৯৩৯ সালের কংগ্রেসের সভাপতি পদে ত্রিপুরী সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে সীতারামাইয়ার হেরে যাওয়ায় গান্ধীজির সেই দুঃখ আর আবেগভরা কথা— দি ডিফিট অব সীতারামাইয়া ইজ মাই ডিফিট’এর মতো কোনও কথা বলত না। দাদা হারটা সহজভাবেই মেনে নিত। বরং বলত,—

—উঃ আজ অমল অসাধারণ খেলেছে। দুটো নিশ্চিত গোল ছিল। বলটা হাওয়ায় কেটে গেল। ওদের পুরো ডিফেন্স আজ অমলের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল।  ভাগ্য খারাপ বলে গোল পেল না। আজ হয়নি, কিন্তু অন্যদিন অমল হ্যাটট্রিক করবে, এই আমি বলে দিলুম।

দাদার বন্ধুরা সেদিনের হেরে যাওয়া খেলার কথা কী অদ্ভুতভাবে ভুলে যেত। খেলার ফলাফল ভুলে যেত। অমলদার ইজি চান্স মিস করা ভুলে যেত। তারা সবাই তখন পরের ম্যাচে অমলের আসন্ন হ্যাটট্রিক নিয়ে মেতে থাকত। যেন অমল হ্যাটট্রিকটা করেই ফেলেছে, জাস্ট শুধু সময়টা আসার বাকি। মানে খেলাটা বাকি আছে।

আমার দাদার শুধু গোল চশমা ছিল না, তার স্বপ্ন দেখার চোখ ছিল। যেটা সে বয়েসে আমাদের বোঝার বাইরে। সে যেকোনও সময় সবাইকে চাঙ্গা করে দিতে পারত, এটাই তো নেতা হওয়ার গুণ। এই নেতা হওয়ার গুণই দাদাকে নেতাজি বানিয়েছিল। ফালতু একটা গোল চশমা পরে আমার দাদা নেতাজি সাজেনি।

যারা গোল চশমা পরিয়ে দাদাকে নেতাজি বানাত, আসলে তারা ফালতু।

তবে এসব কিছুর আগে ছোটবেলার একটা কথা বলি—

খুব ছোটবেলায় আমাদের স্কুলে স্পোর্টসের শেষবেলায় যেমন খুশি সাজো প্রতিযোগিতায় হতো। সেখানে আমার মা একবার দাদাকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস সাজিয়েছিলেন। দুর্দান্ত মানিয়েছিল। যেন সত্যি সত্যি সুভাষচন্দ্র বোস।

দাদার সেই ছবি এখনও আমাদের অ্যালবামে আছে। একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু সেই সাজ একদিনের, সেই সাজে কি সবাই এতদিন ধরে মেতে থাকে, এতদিন ধরে একজন মানুষকে নেতাজি বলে ডাকে?

কেউ না জানুক, আমি জানি, আমার দাদার বুকের ভেতর অন্য এক নেতাজি ছিল। সেটা শুধুমাত্র অবয়ব নয়, তার নাম আদর্শ।

দাদা স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিল। এইট পর্যন্ত ফার্স্টই হয়েছিল। কিন্তু নাইনে থার্ড হল। না, না, পড়াশোনায় আমার দাদা পিছিয়ে পড়ল না, পিছিয়ে পড়ল চোখে। দিন দিন চোখদুটো বড়ই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। একটু পড়লেই দরদর করে জল পড়ে। আরও বেশি পড়লে লাল লাল শিরা উপশিরা চোখের ভেতর দৃশ্যমান হয়। জেদ করে আরও পড়তে চাইলে হঠাৎ চারদিক ঝাপসা। ঝাপসা থেকে অন্ধকার নামে আর তীব্র যন্ত্রণা।

দাদার চোখে অন্ধকার নেমেছে, দাদা দেখতে পাচ্ছে না। এটা সবাই বুঝতে পারত, সেটা নিয়ে উদ্বেগে সবাই দৌড়াদৌড়ি করত। ঠিক করে ফেলত কাল আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। কালই যেতে হবে। বাবা জ্যেঠার সঙ্গে পরামর্শ করত— হায়দরাবাদ যাবে। কলকাতায় কিছু হবে না। কিন্তু সবাই দাদার চোখের অন্ধকারে আটকে থাকত। কেউ এসে অন্ধকার হয়ে যাওয়া দাদার কাছে জানতে চাইত না, তোর আর কী কষ্ট হচ্ছে? দাদার দুচোখ থেকে মাথার ভেতর তখন অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে। পট পট করে শিরাগুলো ফেটে যাচ্ছে। চারদিকে জুড়ে বাজি ফাটছে। দাদা দাঁত কামড়ে, ঠোঁট টিপে তা সহ্য করছে। সে চিৎকার করছে না, কাঁদছে না। সহ্য করছে। অন্ধকার আর যন্ত্রণা, যন্ত্রণা আর অন্ধকার।

দাদা আমাকে বলেছিল— সেই সময়ে সে তার দু’চোখের অন্ধকার আর মাথার ভেতরের যন্ত্রণা দিয়ে দেশমাতৃকার পরাধীনতার কষ্ট উপলব্ধি করেছিল! আমার কেমন আশ্চর্য লেগেছিল দাদার কথা, ব্যক্তিগত কষ্ট থেকে সর্বজনীনে পৌঁছানো যায়, সবার তো উলটো হয়।

অন্ধকার আর যন্ত্রণা নিয়েই আমার দাদা নেতাজি হয়েছিল— শুধুমাত্র ওই গোল চশমা নিয়ে নয়।

যন্ত্রণার কথা দাদার কাছে টুকরো টাকরা ভাবে পরে জেনেছি আমি। কখনও কখনও উদাসীন ভাবে বলেছে। তখন চোখের আলো অন্ধকার নিয়ে দাদার মনে আর কোনও সংশয় নেই। দুচোখের অন্ধকার চিরকালীন হয়ে গেছে। কিন্তু দাদা দেখতে পেত। সে দেখা মনের আলোতে দেখা, মগজের বোধে দেখা। আর তা যেন আমাদের থেকে অনেক অনেক বেশি। এমনভাবে আমরা তো দেখি না।

আমার দাদাকে আপনি চিনবেন, এই এলাকায় এসে ‘নেতাজি স্যার’ বলবেন যে কেউ দেখিয়ে দেবে। কিন্তু ভুল করেও যদি ‘অন্ধ স্যার’ বলেন, আর সেসময় যদি ধারেকাছে দাদার কোনও ছাত্রছাত্রী থাকে, তাহলে আপনি আজাদ হিন্দ ফৌজের হাতে পড়ে যাবেন, নির্ঘাত একটা অনর্থ হবে, সেটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।

দাদা ইংরেজি পড়ায়। সকালে বিকালে দলে দলে ছাত্রছাত্রী তার কাছে আসে। এর মধ্যে একটা ছোট্ট কথা বলে রাখি। দাদার স্টুডেন্টের বহর দেখে এদিককার এক বিখ্যাত টিউটোরিয়াল হোমের চোখ টাটায়। তারা এসে দাদাকে অফার করেছিল ওদের ওখানে পড়ানোর জন্য।

দাদা বলেছিল পড়াতে পারি, কিন্তু আমার অনেক স্টুডেন্টের টাকা দেওয়া ক্ষমতা নেই, এমন যদি কেউ আসে তাদের বিনা ফিজে পড়াশোনা করার ব্যবস্থা করবেন তো?

তারা রাজি হয়নি, ফলে দাদাও রাজি হয়নি। কিন্তু তার মধ্যেই ওই টিউটোরিয়াল হোমটি রটিয়ে দিল— নেতাজি স্যারের কোচিং ক্লাস অবৈতনিক! ফ্রি! ফ্রি! ফ্রি!

একথা শুনে ছাত্রছাত্রীরা দাদার কাছে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করল। বলল, ‘স্যার আমরা তো টাকা দিই।’

দাদা ওই টিউটোরিয়াল হোমের কর্মকর্তাদের ঠিক কী বলেছিল সেটা তার ছাত্রছাত্রীদের বলল। সেইসঙ্গে বলে দিল, আমার কাছে কোনও বিল বই নেই, কে কোন মাসের টাকা দিল, তার হিসেব রাখা নেই। আমি শিক্ষা বিক্রি করি না, দান করি। সেই দানের মূল্য তোমরাও দাও, সেটা গুরুদক্ষিণা, সেটা আমি গ্রহণ করি। এর বেশি কিছু নয়।

দাদার কথায় ছাত্রছাত্রীরা চুপ করে ছিল। কেননা অনেক ছাত্র ছাত্রীরই টাকা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। আর কেউ কেউ মাঝেমাঝেই ফিজ দিত না। নেতাজি স্যারের টাকা ঝেড়ে সিনেমায় যেত, খেতো, সেটা নিয়ে গর্বও করত। তারা মনে করত, তারা নেতাজি স্যারকে ফাঁকি দিতে পারছে। কিন্তু তাদের ফাঁকি যে ওই মানুষটা মনের আলোতে দেখতে পেত, তা তারা জানত না। যেদিন জানল সেদিন সবাই চুপ করে গেল।

কিন্তু সেই টিউটোরিয়াল হোম থামল না, তারা মজার করল জব্বর! খোরাক করল দাদাকে ও তার ছাত্রছাত্রীদের। বলল, ‘ওরা নেতাজি স্যারের পেঁয়াজি!’

ছাত্রছাত্রীরা শুনল মুখ বুজিয়ে। দাদা তার স্টুডেন্টদের বলল, মাথা ঠান্ডা রাখো। দাদা ‘তরুণের স্বপ্ন’ থেকে মুখস্ত শোনাল।

এরপর সেই টিউটোরিয়াল হোম ছড়া বানাল—

ফিজ নিয়ে মস্ত ধন্দ!

কার গায়ে বেশি গন্ধ?

এই নিয়ে সবার সন্দ!

অন্ধ স্যারের কোচিং বন্ধ!

এবার আর কেউ চুপ করে থাকল না, কয়েকটি মেয়ে তার সোজা চলে গেল সেই টিউটোরিয়াল হোমে। গিয়ে সেখানকার এক কর্মকর্তার জামার কলার ধরে নেড়ে, চোখের সামনে আঙুল তুলে বলে এল— আর একবার ছড়া কাটলে— অন্ধ করে দেব।

দাদা সেই মেয়েদের নাম দিয়েছিল, ঝাঁসি বাহিনী! দাদার কোচিং-এর মেয়েদের সবাই ভয় পেত।

তাহলে আবার সেই পুরনো কথায় ফিরে যাই, শুধুমাত্র গোল চশমা নয়। আমার দাদার ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ, ছিল ফাঁসি বাহিনী। আমার দাদা তাই নেতাজি!

এত অপমানেও আমার দাদা সোজা ছিল, ঋজু!

ক্লাসে সময় সুযোগ পেলেই নেতাজির বীরত্বের গল্প শোনাত। কিন্তু একদিন একটা ছেলে বলল, ‘স্যার নেতাজিকে ওরা কুকুরের সঙ্গে তুলনা করে, কী অপমান বলুন, তোজোর কুকুর!’

দাদা বলেছিল, ‘ওরা আসলে বাঘ আর কুকুরের মধ্যে তফাত বোঝেনি। ভুল ব্যাখ্যা করেছে। ব্রিটিশরা যদি সিংহ হয় একজন ভারতীয় যোদ্ধা তাহলে বাঘ! নেতাজি বাঘ! সে বাঘের বাচ্চা! কুকুর নয়! সেই অন্ধকার যুগে অন্ধরা ঠিক ঠাহর পাইনি!’

দুই

বারোটা থেকেই আমাদের পাড়ায় ঢোকার তিনদিকের রাস্তা বন্ধ। বাজার পাড়ার ছেলেরা ফলের পেটি, আনাজের বিশাল বিশাল ঝুড়ি, বাঁশ ফেলে গলির পূর্বদিকটা বন্ধ করে দিয়েছে। তার ওপরে তাদের হাতে তেলের খালি টিন। বিপদ দেখলেই সেগুলো পেটাচ্ছে।

এই গলির আর একটা মুখ আছে দক্ষিণ দিকে। সেদিকও বন্ধ। সেখানে একটা তক্তাপোশকে দেওয়াল বানানো হয়েছে। কাঠের দেওয়াল। সে দেওয়াল ভেদ করে গলি থেকে কেউই বেরুতে পারবে না।

বাকি থাকে পশ্চিমদিকে সরু পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য যে গলি আছে। সেখানেও ওদিকের লোকজনরা একটা ভ্যানরিকশকে উলটো করে শুইয়ে রেখেছে। তার সামনের চাকা শুন্যে বনবন করে ঘুরছে। তার পিছনে তারা একটা বাতিল টায়ারে আগুন দিয়েছে। ওই আগুন দেখে কুকুরটা ওদিকে কখনই যাবে না, যতই সে পাগলা হোক।

এই পাড়ার ভেতর তখন হইহই কাণ্ড। একটা পাগলা কুকুর সকাল সাড়ে দশটা থেকে বারোটার ভেতর তেরোজনকে কামড়েছে। কুকুরটাকে শাবল নিয়ে মারবে বলেই অনেকেই প্রস্তুত কিন্তু সাহস করে এগোতে পারছে না। কুকুরটার জিব বের করে লালা ঝরাতে ঝরাতে চলেছে, ভয়ঙ্কর দাঁত দেখলে রাতের দুঃস্বপ্নও হার মানবে। এই পাড়ার মোট দুটো বাড়িতে ফোন আছে। তার মধ্যে একটা আমাদের। আমরা ক্রমাগত ক্রেডেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে করপোরেশন থেকে লালবাজারে ফোন করে চলেছি। সবাই ব্যস্ত, এখন আসা যাবে না, কারণ, কাল নেহরু কাপের উদ্বোধন। কলকাতায় এর আগে এত বড় মাপের ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়নি। সেখানে করপোরেশন থেকে লালবাজার ব্যস্ত। কিন্তু আমাদের কী হবে?

দুপুরে জ্যাঠা দোকান থেকে খেতে আসতে পারেনি। ফোন করে বলেছে, কেউ বাড়ির বাইরে পা রাখবে না। পাগলা কুকুরের কামড় মানে শম্ভুনাথ পণ্ডিতে গুনে গুনে পেটে চোদ্দোটা ইনজেকশন।

অনেক বাড়ির দেওয়াল থেকে ফেলা হয়েছে খাবার আর তার সামনেই ঝুলছে দড়ির ফাঁস। একবার যদি পাগলা কুকুরটা ফাঁসে গলা দেয়— তাহলে ভবলীলা সাঙ্গ হবে।

জহরদাদের বাড়ি থেকে একপিস মাছ ফেলা আছে রাস্তায়। তাতে নাকি তিন তিনটে ঘুমের ওষুধ গুঁড়ো করে মাখানো আছে। কুকুরটা মাছটা খেলেই নাক ডেকে ঘুমাবে। কিন্তু পাগলা কুকুরটা মুখে সেই মাছ তোলেনি, শোঁকেওনি। সে শুধু এ পাড়ার এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো গর্জন করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

দাদা আর আমি দাঁড়িয়ে আছি পাঁচিলের এপারে। মাঝে মাঝে কুকুরের গর্জন। দাদার চোখে গলির আবছা ছায়া। সেখানে কুকুর নেই। হয়তো কালো মতো একটা ঝুল নড়ছে। আমি সঞ্জয় হয়ে দাদাকে ধারাবিবরণী দিয়ে যাচ্ছি — —ওই যে সরকারবাড়ির ছাদ থেকে একটা আধলা ছুঁড়ল।

—লাগল?

—না, লক্ষ্যভ্রষ্ট।

—ওই, টব ফেলা হল বিশ্বাস বাড়ি থেকে।

—লাগল?

—না, লক্ষ্যভ্রষ্ট!

দাদা অস্থির সেই সাড়ে দশটা থেকে এই পাড়া অবরুদ্ধ হয়ে আছে। এখন দুটো। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা হয়ে গেল। পুলিশ করপোরেশনের কোনও হুঁশ নেই। এর পরেই বিকেল হয়ে যাবে। আর একটু পরেই যারা স্কুলে গেছে তার ফিরবে। কিন্তু কেউ বাড়ি ঢুকতে পারবে না। কী হবে? তারপর অন্ধকার নামলে?

দাদা আমাকে বলছে, ‘অন্তু তুই একটা ব্যবস্থা কর, তুই পারবি।’

আমি বার বার গিয়ে চেষ্টা করছি লালবাজারে ফোনে খবর দিতে। বারোটা নাগাদ লালবাজারে একবার ফোন লেগেছিল। তারপর থেকে আর ফোনে পাচ্ছি না। দাদা পাঁচিলের এপার থেকে ওপারে চিৎকার করে জহরদাকে বলছে, ‘আর পারা যাচ্ছে না জহর! কী করা যাবে?’

জহরদা বলছে, ‘মাছের টুকরোতে ঘুমের ওষুধ আছে, একটু অপেক্ষা করো।’

‘না, না ওই আবেদন নিবেদন করে বসে থাকা যাবে না। অ্যাকশন নিতে হবে।’

সারা পাড়ার খাওয়া নেই, দাওয়া নেই। কঠোর কঠিন পরাধীন হয়ে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে। ছাদে ছাদে মানুষ। ছাদের সব ইট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সারা পাড়ার রাস্তায় ছড়িয়ে। শুকনো গোলাপ গাছের ডাঁটি নিয়ে কত টব রাস্তায় ছত্রাকার।

—অন্তু কী হবে?

—জানি না।

দাদা বলল, পরাধীনতার জ্বালা কী ভয়ঙ্কর বুঝেছিস অন্তু, মাত্র কয়েক ঘণ্টা।

পুবে তেলের টিন পেটাচ্ছে। পশ্চিমে টায়ার জ্বলছে। বাইরে পা রাখলেই পাগলা কুকুরটা ভয়ঙ্করভাবে তেড়ে আসছে।

—অন্তু কিছু একটা কর।

আমি নারকেল দড়ির ফাঁস ঝুলিয়ে বসে আছি। আর মাঝে মাঝে দৌড়ে যাচ্ছি ফোনের কাছে। রিং করছি। লালবাজার। রিং করছি। করপোরেশন। আবার ফিরে আসছি। ফাঁসের দড়ি ছুঁড়ে রেডি থাকছি।

দাদা বলল, ‘অন্তু এখন কটা বাজে?’

—আড়াইটে।

দাদা বলল, ‘কুকুরটা এখন ঠিক কোথায়?’

আমি বললাম, ‘আমাদের বাড়ির উলটোদিকে জহরদাদের গেটের কাছে, জিব বের করে হাঁপাচ্ছে।’

দাদা বলল, ‘অ্যাকশন ছাড়া হবে না অন্তু।’

—আবার ফোন করছি।

দাদা গর্জে উঠল, ‘সেই আবেদন নিবেদন!’

আমি আরও একবার লালবাজারে ফোন করতে চলে গেলাম।

আমি চলে গেলাম। আর তখনই দাদা পাঁচিলের ওপর গোল চশমাটা রেখে দেওয়াল থেকে ঝোলানো ফাঁসের নারকেল দড়িটা টেনে নিল হাতে। তারপর সেটাকে চারটে ভাঁজে ভাঁজ করে অস্ত্র বানাল। আর সেই অস্ত্র হাতে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। আবছা রাস্তা। দেওয়ালের কোণে জমে থাকা ঝুলের মতো কুকুরটা!

আমাদের বাড়ির সামনে তখন পাগলা কুকুরটা, হঠাৎ সে মানুষ দেখে হাঁ হাঁ করে ছুটে এল। সারা পাড়া তারস্বরে চিৎকার করছে— নেতাজি! নেতাজি!

ততক্ষণে আমি এসে গেছি পাঁচিলের ধারে। আমি চিৎকার করলাম— দাদা!

দাদা হুঙ্কার ছাড়ল। আমি স্পষ্ট শুনলাম— দাদা যেন বলছে, তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের…। আমি কাঠ পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে, আমি বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, দাদা আর কুকুরটা, কুকুরটা আর দাদা, দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে রাস্তার ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। সিমেন্টের রাস্তায় রক্ত আর লালা। কুকুর আর মানুষ। লালায় আর রক্তে…। পশুতে মানুষে।

পাগলা কুকুরটা তার দাঁতে নখে দাদার বুক উরু ফালা ফালা করে দিয়েছিল। আর দাদা চার ফেরতা করা নারকেল দড়িটা পাগলা কুকুরটার গলায় জড়িয়ে গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে টেনেছিল। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল কুকুরটা। তার শেষটুকু পাগলামি-শক্তি দিয়ে দাদাকে আরও ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। মরণ কামড়!

আশা করি, এরপর আপনি আর শুধুমাত্র চশমা দিয়ে আমার নেতাজিকে চিনবেন না। নেতাজিকে চিনতে হলে আপনার চোখের সামনে আমার দাদার চশমাটা ধরতে হবে। একবার তার ভেতর দিয়ে তাকান— কী দেখতে পেলেন?

কুকুর, না বাঘ!

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী

*****