লাতিন আমেরিকান সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের দরবারে একটি সমীহ জাগানো নাম। তবে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার সমসাময়িক সাহিত্যিকরা এখনো তেমনভাবে বাংলায় অনুদিত নন। এইসব দেশগুলির সমকালীন সাহিত্যধারায় এখন একটা ঝোঁক দেখা যাচ্ছে যে, অনেকেই নিটোল একটা গল্পের বদলে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিপুণ আঁচড়ে তুলে আনছেন সমাজের নিচুতলার মানুষের প্রতিদিনকার লড়াইয়ের কথা।
কবি ও সাহিত্যিক সান্তিয়াগো ভাসকেসের জন্ম এল সালভাদোরের আউয়াচাপান প্রদেশে। তাঁর মরমী কলমে ফুটে উঠেছে এল সালভাদোরের ‘চিলাতে’ বিক্রয়িনী এক বুড়ি ঠাকুমা আর তার নাতির একটি দিনের গল্প। গল্প ? নাকি কবিতা? …
‘Yo no fui’ ~ সান্তিয়াগো ভাসকেস
আর একবারের জন্যও কথাগুলো বলবি না, পাজি, বজ্জাত কোথাকার- ঠাকুমা ওকে কথাটা বলল। মুখচোখের ভাব এমন করে বলল যে দেখে মনে হবে দানো ভর করেছে। সে মুখের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ মুখের কোন সাযুজ্য নেই। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে বলে যে মেজাজ ভাল হবে তেমনটাও নয়। বরং দেখে মনে হচ্ছিল ভেজা রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে সে মুখ, তাতে ফলাফল যত সাংঘাতিকই হোক না কেন।
যে কোন ধরনের কঠিন পরিস্থিতি সহ্য করার জন্য রেইনিতার একেবারে সন্তের মত ধৈর্য ছিল। কিন্তু এখন বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। তার ধৈর্যের কলস কেবারে ভরে উপচে পড়ছিল।
প্রতিবেশীর বাড়িতে জঘন্য একটা মিউজিক সিস্টেমে বেজে যাওয়া কর্কশ উচ্চগ্রামের আওয়াজ যে কোন লোকের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারত।
স্মৃতি মেদুরতার উত্তাল নদীতে সাঁতরাতে থাকা ছোট ছোট মাছের মত কটা অলিভ পাতা মাটির ওপর পড়ে আছে।
ছোট ছোট পিঁপড়ে সার বেঁধে টেবিলের পা বেয়ে উপরে উঠছে। ওখানেই রাখা আছে বিক্রির জিনিষ। টেবিলে রাখা মাটির হাঁড়িতে টগবগে ফুটন্ত সুস্বাদু চিলাতে থেকে এত তাপ ছড়াচ্ছিল যে পা বেয়ে উঠতে গিয়ে মাঝরাস্তায় পিঁপড়েরা পথ হারিয়ে ফেলছিল। (চিলাতে নারকেল, চাল, দারচিনি আর চিনি দিয়ে তৈরী এল সালভাদোরের পানীয়। এটি ঠান্ডা খেতে হয়। ডোনাটের সঙ্গে এই পানীয় মেক্সিকো, হন্ডুরাস, এল সালভাদোর সহ বিভিন্ন দেশে প্রবল জনপ্রিয়)
রেনিইতা তার দুই মেয়ে এভেলিন আর সোনিয়া এবং বোনপো উইলিয়ামকে নিয়ে দুপুর দুটো বাজার আগেই সমস্ত খাবার তৈরী করে রাখে। সে সময়টা প্রচুর কাজকর্মের ঘনঘটা চলতে থাকে। অবশ্য মাঝে মধ্যে বিক্রিবাটা তত ভাল না হলে ওদের উৎসাহে কিছুটা ভাটাও পড়ে যায়
-ইয়ে মা…
-আমার কথাটা একটু শোনো না
মুখ কাঁদো কাঁদো করে, চারপাশে ভাল করে তাকিয়ে নিয়ে বা খুব ক্বচিৎ চোখ নামিয়ে বোকাটা ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে। মনে হয় যেন দুঃখে মাটিতে মিশে যেতে পারলে ভাল হয়।
রেইনিতা খুশি মনে রোজ বিকেলে চিলাতে নিয়ে বেচতে বের হয় পাশের ব্লকের এক কোণে। সেখানে বুড়ো আমাতে মোড়ের বিল্ডিং এর ছায়ায় বসে ক্লান্ত পথচারীদের কাছ থেকে ভিক্ষা চায়। রেইনিতা ওইখানে তার বাঁধা বা নিত্য নতুন খদ্দেরদের জন্য খুব যত্ন করে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করে।
-দোন ফিলেমোন, বাদাম তক্তি, না কামোতে পিঠে (মিষ্টি আলুর পিঠে) না কি কলা খাবেন?
আর তুমি এলভিরা খুকী?
কতটা চাও?
সোনা মেয়ে, এই তো একটা বেঞ্চি খালি আছে, এখানে বসো।
ও বাছারা একটু আনাকে বলে আসবি কিছু বাদাম তক্তি বানিয়ে রাখতে? আমার দরকার। আসলে আমার এখানে মাল ফুরিয়ে গেছে আর প্রচুর খদ্দের আসছে।খুকীরা সুযোগের সদব্যবহার করা দরকার, বুঝলি? রোজ রোজ এমন বিক্রি বাটা হয় না।
মোরো পাতা দিয়ে বোনা (নারকেলের খুরির মত বাটি) বা তুল (নাইলনের বা রেশমের সুতোর মত বস্তু) পেঁচিয়ে বানানো বাটি ভর্তি করে ডোনাট রেখে তাকে বিড়েয় বসিয়ে সাজানো হয়। কেননা যারা কিনতে আসে তারা সঙ্গে কোন পাত্র আনে না। বহু বছর ধরে এমন রীতিই চলে আসছে। তুলের বিড়ে আমাদের পূর্বপুরুষদেরই সৃষ্টি।
টেবিলে থরে থরে সাজানো ওইসব গরম পিঠে ভরা বাটি খুব তারাতাড়ি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
সুস্বাদু চিলাতে খুব উৎসাহের সঙ্গে গরমগরম বাটিতে ঢেলে দেয়া হত। বাটি থেকে ধোঁয়া বের হত। সেসব যেন পূর্বপুরুষদের প্রতি সাজানো আমাদের নৈবেদ্য।
-ইয়ে, হয়েছে কি মা…
-তোকে বলেছি না ছুঁড়ি, বারবার আমার কাছে ঘ্যানঘ্যান করবি না।
পিছন পিছন হাঁটবি না।
দাঁড়া, এইতো বাড়ি এসে গেছি প্রায়!
কোণে একটা টেবিলের উপর ছ’ বছরের একটা মেয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠল।
-আইইইইই, মা!!!!
পুড়ে গেল!!!!
-ইস! কী বোকা!
একদম বুদ্ধু না হলে এরকম কেউ করে!
বললাম না অল্প করে বেড়ে দিচ্ছি?
বিল্ডিং মোড়টা প্রতিদিন বিকেলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হুল্লোড়ে সরগরম হয়ে থাকত। খদ্দেররা কেউ নিজেদের মধ্যে বন্ধুর মত আড্ডা দিত কিংবা কোন প্রেমিকা হয়ত তার প্রেমিকের বাহু আঁকড়ে হাঁটত। ভালবাসার হ্যারিকেন ঝড়ে উথালপাথাল তাদের মন আনন্দে যেন গলে পড়ত।
-হাত চালা। অনেক খদ্দের। তুই তো জানিস, পরে এরা কিছু না কিছু খুঁত বের করবেই।
-কিন্তু লুসিতা, পুয়ে আমাকে ভালবাসে না কেন?
হয়ত জানে না… আমার মন তোমার, শুধু তোমারই- আর কারো নয়।
-হুম। জানি, এদিকে লোকজন আমার দিকে বড্ড তাকাচ্ছে।
-কারণ ওরা জানে আমার লুসিতা আছে। আমার চোখ ঠিক ওদের ওপরেই রয়েছে।
থরথর জ্বলন্ত আবেগের গলিঘুঁজির ভেতরে জড়িয়ে গেল কথাগুলো। যেভাবে উনুনে ঢুকে ভুট্টার পানীয় নিজেকে উষ্ণ করে রাখে।
একটা মথ গরম খুরির ভেতর পড়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে বদলে দেওয়া হল।
-বাছা খুরিতে কি একটা পড়ল!
কী কান্ড!
-আন্দ্রেয়া খুকী কিছু মনে করো না। কিন্তু পোকামাকড় তো ঠেকানো যায় না।
বিল্ডিং এর গেটের সামনে এসব যখন ঘটছিল, চারপাশ তখন যে স্বাভাবিক ছিল তেমনটা বলা যায় না।
আসলে হল কি বোকা ছেলেটা রাগে ফুঁসছিল। সে যখন দেখল অন্যান্য দিনের মত আজ ওর হাতে কামোতে পিঠে দিতে গিয়ে মহিলা অন্যান্য দিনের মত তার দিকে চেয়ে হাসল না, তখন সে প্যান্টের পকেট থেকে বড় বড় কাকেমিকো মার্বেলের গুলি বের করে আনল। একা একা খেলতে আরম্ভ করল। সেই অবসরে তার ঠাকুমা খদ্দেরদের প্রাণপণ তুষ্ট করতে ব্যস্ত ছিল। এর মধ্যে ক’জন আবার তার নিয়মিত খদ্দের।
নিজের ভুল শেষবারের মত ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চেয়ে সে ময়লা হাতদুটো তুলল। ছলছল চোখে বলল-
-মা! দোহাই বলছি …
নিষ্পাপ কথাবার্তার মাঝপথেই, চোখের কোটরে জল উঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু সামান্যই। গলা দিয়ে শব্দ বের হতে চাইছিল না।
আমি ছিলাম না!
চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়াতে শুরু করল।
চিলাতের বাটির ওপর লাফ দিয়ে গেছিল একটা ছুঁচো।
-ছুঁচো?
ভদ্রমহিলার মাথার ভেতর কথাটা পাক খেতে লাগল।
-ছুঁচো?
ওই এক মুহূর্তে পৃথিবীর সবটুকু ভালবাসা জড়ো করে দিতে চাইছিলেন মহিলা। নরম চোখে তাকালেন ওর দিকে। হাসলেন। বাচ্চাটার কোমর জড়িয়ে ধরলেন। গালে চুমু খেলেন। আলগোছে এক হাতে বেড় দিয়ে ধরলেন।
-আহ বোকা!
আমি জানি!
খেয়াল করেছি!
পাগল কোথাকার!
জানি তো তুই ছিলি না।
-আর একটা চিলাতে দাও রেনিইতা!
-কামোতে পিঠে যদি বেশি থাকে আমাকে আরো কটা দাও।
-আহ কলাগুলো কী মিষ্টি গো।
-রেইনিতা আমাকে ডোনাট দেওয়া বাটির ছটা ভাগ দাও ।
বিল্ডিং মোড়ে একটা অ্যাভোকাডো গাছের পাশে দাঁড়িয়ে, এক বোকা সংখ্যা গুণতি করে যাচ্ছিল-
-সত্তর, একাত্তর, বাহাত্তর, তিয়াত্তর, চুয়াত্তর, পঁচাত্তর, ছিয়াত্তর, সাতাত্তর, আটাত্তর, ঊনআশি… সত্তর, একাত্তর,
গুনতে গুনতে এক মনে কাকেমিকো মার্বেলের গুলি নিয়ে খেলে যাচ্ছিল।
পাখিদের কিচিরমিচিরের সঙ্গে বিকেল নেমে আসছিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি সময়ের আয়না বিবর্ণ করে দিয়েছে। সেই অবসরে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে এক মাতাল লুটোপুটি খাচ্ছিল। হাত দিয়ে বল লোফালুফি করছিল।
-যাঃ এখান থেকে! লোকজন এলে তোকে দেখলে ভয় পাবে তো!
মাতাল হেসে একটু সরে বসে। বাতাসে মদের ভারী কটু গন্ধ ভাসতে থাকে।
-আমি ছিলাম না!
-আমি ছিলাম না!
বাচ্চা ছেলেটা দাঁতের ফাঁকে বার বার কথাগুলো বিড়বিড় করে বলছিল, বয়সটা ছোট বলে নিজেকে তার বড় অসহায় মনে হচ্ছিল।
তার ঠাকুমা তাকে দেখল। চোখের কোলে জল চিকচিক করছে, তারপর গড়াতে শুরু করলে মনে মনে বলল-
-আহ রে আমার সোনাটা!
-পাগল!
দু চোখ ভরা আদর নিয়ে তার দিকে তাকাল। এলোমেলো চুলে আঙুল চালিয়ে ঠিক করে দিল।
আধফালি চাঁদের মত ছাঁচে গড়া ডোনাট অপূর্ব ফিনফিনে মোরো পাতার বাটিতে সাজানো।
খেলতে খেলতে একটা কাকেমিকো মার্বেলের গুলি গপ করে গিলে ফেলেছিল বাচ্চাটা। চোখে জল এসে গেছিল।
দেখে সেই মাতালটা খ্যাকখ্যাক করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
ব্যাপারটা মন দিয়ে খেয়াল করল খোকা। অন্যরা তখন সুস্বাদু চিলাতে খেতে ব্যস্ত। এক অপূর্ব শিল্পসৃষ্টির নমুনা সে পানীয়।
বিকেলের আনন্দকে পূর্ণতা দিয়ে বিদ্যুতের মত এক ঝাঁক পাখি হইহই করে বেরিয়ে পড়েছে আকাশে।
-এই যে সেন্যিওর, আপনি টাকা দেন নি।
-আমি নই।
-আর তুমি রাফা খুকি, তুমিও তো দিলে না!
-আমায় পাঁচ ভাগ ডোনাট দিন।
মাতালটা কড়াইয়ে হাতা নাড়িয়ে ওয়াই আঁকার চেষ্টা করছিল।
যারা খাচ্ছিল তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে গর্ত খুঁজে যাচ্ছিল পাজিটা। কাকেমিকো গুলিটা গেল কোথায়।
-আমি ছিলাম না
একই কথা সমানে বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছিল।
-ওই খদ্দের বুড়ো তিন ভাগ ডোনাট খেয়েছে, কিন্তু টাকা তো দেয় নি!
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি চারপাশের পরিবেশের চাদর ফুটো ফুটো করে দিচ্ছিল।
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী
*****