সূচনাঃ
বিশ্ব ইতিহাসে ১৯১৭ একটি স্মরণীয় বছর। সেবছরই রাশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যার প্রভাব ছিল বিশ্বময়।প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে এক নতুন ধরনের ব্যবস্থা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই সময় ভারতেরও কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী ভাবছিলেন নতুনভাবে কিছু একটা করার কথা,তাদের সামনে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেস নেতৃত্ব আপামর ভারতবাসীকে যে স্বপ্ন,আশা দেখিয়েছিলেন,তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে আসতে থাকে। কংগ্রেসের ভেতরে নরমপন্থী চরমপন্থী বিবাদ, কংগ্রেসের বিভিন্ন সম্মেলনে পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুলতে টালবাহানা করা, আবেদন নিবেদন নীতির ব্যর্থতার কারণে একদল মানুষ ভিন্ন কিছু করার স্বপ্ন বোনা শুরু করেছিলেন। তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছিলেন ও বুঝেছিলেন যে,ভারত থেকে শুধু ব্রিটিশদের তাড়ালেই ভারতবাসীদের দুঃখ দুর্দশা দূর হবে না। তাঁরা গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখলেন,স্থানীয় স্তর থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় স্তর পর্যন্ত কংগ্রেস দলের নেতৃত্ব বড়,মাঝারি, ছোট জমিদার, জোতদার, উচ্চবিত্ত, মহাজনদের অধিকারে।সালিশির সুবিচার সাধারণ গরীব মানুষের পক্ষে যায় না। গুদাম ভর্তি চাল,ডাল, অন্যান্য খাদ্য দ্রব্য মজুত থাকলেও সাধারণ মানুষ অনাহারে,অর্ধাহারে মারা যাচ্ছেন। এরকম একটা অবস্থায় তাঁদের উপলব্ধি হল, শুধু ইংরেজ শাসন নয়, তাঁদের শোষণের সহযোগী সকল শ্রেণিকে উৎখাত করতে না পারলে ‘আম আদমি’র কাছে ‘আজাদি’র কোনো অর্থ থাকবে না। দেশের সাধারণ মানুষকে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শোষণের চরিত্র বোঝাতে না পারলে কোনোভাবেই দেশের মানুষের প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়। এই লক্ষ্য নিয়েই ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি তার যাত্রা শুরু করেছিল।
-১-
বাঁকুড়া জেলার ক্ষেত্রেও ঐ লক্ষ্যের ব্যতিক্রম হয়নি। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় কংগ্রেস ও সশস্ত্র বিপ্লবীরা অনেকেই ১৯৩০-এর আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বিভিন্ন জেলে বন্দি ছিলেন। জেলে বন্দি থাকাকালীন তাঁরা বুঝলেন, কংগ্রেসের গণ আন্দোলনের প্রতি অনীহা। অধিক সংখ্যক মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য তাঁরা জেলায় কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এই চিন্তা ও চেতনার পরিবর্তনে সাহায্য করেছিলেন বিভিন্ন জেলে বন্দি থাকা কমিউনিস্ট নেতৃত্ব। যেমন, বাঁকুড়া জেলায় অভয় আশ্রমের অন্যতম কর্মী ও সংগঠক জগদীশ পালিত কাঁথিতে লবণ আইন ভঙ্গ করতে গিয়ে কারাবরণ করেন। তিনি,বঙ্কিম মুখার্জির সংস্পর্শে এসে তাঁর চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন ঘটান। একইভাবে বাঁকুড়া জেলার রামকৃষ্ণ দাস,প্রমথ ঘোষ প্রমুখ কংগ্রেস আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অথচ বীতশ্রদ্ধ কর্মী ও নেতৃত্ব জেলায় কৃষক, ছাত্র-যুবদের সংগঠিত করতে শুরু করেছিলেন। এঁদেরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সমিতির প্রথম সম্মেলন (১৯৩৭) অনুষ্ঠিত হয় অবিভক্ত বাংলায় কৃষিতে পিছিয়ে থাকা বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়ের থানার হাটকৃষ্ণনগর গ্রামে। (আবদুল্লাহ রসুলঃ কৃষক সভার ইতিহাস, ২য় সংস্করণ, নবজাতক প্রকাশন, কলিকাতা -৭, ১৯৮০,পৃষ্ঠা -৫৩, তিনি সম্মেলনের স্থান হিসেবে পাত্রসায়েরের উল্লেখ করলেও হাটকৃষ্ণনগর গ্রামের উল্লেখ করেননি। অনুমান,পাত্রসায়েরের তুলনায় হাটকৃষ্ণনগর গ্রামটি অখ্যাত হওয়ার কারণেই তিনি তার উল্লেখ করেননি।)
আন্দামান ও অন্যান্য জেলে বন্দি থাকা কালে বাঁকুড়া অনেক বিপ্লবী কমিউনিস্ট ভাবধারায় আকৃষ্ট হয়ে মার্কসবাদী দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং জেল থেকে মুক্তিলাভের পর তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই বড়লাটের নির্দেশে বাংলার বারোটি কমিউনিস্ট সংগঠন বেআইনি ঘোষিত হয়। সেই সময় মুজফফর আহমেদ, আবদুল হালিম, সরোজ মুখার্জি প্রমুখেরা নানান অপরাধে কারারুদ্ধ। (অমলেশ ত্রিপাঠীঃস্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫-১৯৪৭), আনন্দ, কলিকাতা, ১লা বৈশাখ, ১৩৯৭, পৃষ্ঠা- ২১৩)। কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি থাকার সময়ই জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন জগদীশ পালিত। তিনি পাত্রসায়ের, ইন্দাস, সোনামুখি প্রভৃতি স্থানে কৃষক সংগঠন গড়ার কাজ শুরু করেন। জেলার অনেকেই সেই সময় তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। তাঁর নির্দেশেই তিনি জেলার কাজ পরিচালনা করতেন। বাঁকুড়া শহরে ‘ছাত্র-যুব সংসদ’ নামেও তিনি একটি সংস্থা গঠন করেছিলেন যার মাধ্যমে জেলার অনেক ছাত্র-যুবককে সাম্যবাদী দর্শনে আকৃষ্ট করা হয়। বিষ্ণুপুর মহকুমায় কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার পাশাপাশি আরও বেশি সংখ্যক মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি, নৈশ বিদ্যালয় প্রভৃতি স্থাপন করেন। জেলায় কৃষক সংগঠনকে উৎসাহিত করার জন্য প্রাদেশিক কৃষক সংগঠক অনন্ত মুখার্জি ও অফিস সম্পাদক রামেন্দ্র দত্ত বাঁকুড়ায় এসে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার কাজে জেলার কর্মীদের সাহায্য ও পরামর্শ দান করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, তখন ভারতে কংগ্রেস দলের মধ্যে থেকেই এবং কংগ্রেসের অংশ হিসাবেই কৃষক সংগঠন পরিচালিত হতো। কিন্তু কৃষকদের শ্রেণি সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সংস্থাটির পৃথক অস্তিত্ব স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন বামপন্থী নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে কমিউনিস্টরা। এরই ফলস্বরূপ ‘সর্বভারতীয় কৃষক সভা’ গঠন করা হয় এবং এর প্রাদেশিক শাখা হল ‘প্রাদেশিক কৃষক সভা’।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার প্রথম অধিবেশন সংগঠিত করার কৃতিত্ব এই জেলার। আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রাদেশিক কৃষকসভা গঠনের জন্যই এই সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছিল। এখানে গান্ধীবাদী কংগ্রেস, অনুশীলন, যুগান্তর, স্যোস্যালিস্ট, জাতীয়তাবাদী সকলকেই আহ্বান করা হয় এবং প্রতিনিধি প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা হয়। যেমন, শরৎ চন্দ্র বসু ও প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তাঁরা এই সম্মেলনে যোগদান করেননি। তাদেরই পথ অনুসরণ করেন বাঁকুড়ার সুশীল পালিত, গোবিন্দপ্রসাদ সিংহ প্রমুখ জেলার প্রথম সারির কংগ্রেস নেতারা। রামকৃষ্ণ দাস লিখেছেন, “… জাতীয় কংগ্রেস কৃষকগণের এই শ্রেণী সচেতনতা পছন্দ করে নাই তাই পাত্রসায়েরে যাহাতে প্রাদেশিক কৃষক সভার অধিবেশন না হইতে পারে তাহার প্রবল চেষ্টা হইয়া ছিল।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, “ডাঃ ঘোষ ও বর্দ্ধমানের কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এর বিরুদ্ধাচরণ করেন কিন্তু এই বিরুদ্ধাচরণের জন্যই সম্মেলন কার্য্য সহজ সাধ্য হয়ে উঠে।’’
এই সম্মেলন উপলক্ষে একটি কৃষি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল যার উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত সাংবাদিক, তাঁকে বলা হয় ‘ভারতীয় সাংবাদিকতার জনক’ এই জেলার কৃতি সন্তান রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। কাস্তে-হাতুড়ি-তারা চিহ্নিত পতাকা উত্তোলন করে এই সম্মেলনের উদ্বোধন হয়েছিল। প্রাদেশিক কৃষকসভার প্রথম রাজনৈতিক সাংগঠনিক দলিল এখানেই গৃহীত হয়। তখন সারা প্রদেশে সংগঠনের মোট প্রাথমিক সদস্য ১১,০৮০ জন মাত্র। মুজফফর আহমেদ, সৈয়দ আহমেদ খাঁন (নোয়াখালি জেলার এমএলএ), ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ওসিমুদ্দিন আহমেদ (ত্রিপুরা জেলার এমএলএ), সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার (আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক) সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলন শেষে এই জেলার প্রায় পনেরো হাজার কৃষক মিছিল করে প্রকাশ্য সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। প্রকাশ্য সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।
-২-
বাঁকুড়া জেলাতেও কৃষকসভার সংগঠন গড়ে তোলার জন্য একটি কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়। জেলায় কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে কৃষকদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কারণ, জেলায় সামগ্রিকভাবে শিল্পের অনুপস্থিতি। অধিকাংশ মানুষের জীবন ও জীবিকা ছিল কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ কৃষকেরই, বিশেষ করে ছোট, মাঝারি, ভাগচাষি, ক্ষেতমজুর প্রভৃতির অবস্থা ছিল সংকটজনক। জোতদার ও মহাজনদের শোষণে এরা ছিলেন জর্জরিত। মুজফফর আহমেদ সম্মেলনে যে নীতিগত দলিল পেশ করেন তাতে কৃষকদের উৎপাদন প্রথার সঙ্গে জড়িত সমস্ত রকম শোষণের ও তারসঙ্গে যে সমস্ত ‘পরগাছা’ সম্প্রদায় জড়িত আছে তাদের উচ্ছেদের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এটা করতে না পারলে কৃষক সমস্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব নয়। জেলায় কৃষক আন্দোলনের জন্য সংগঠন গড়ে তোলা জেলার কমিউনিস্টদের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
রামকৃষ্ণ দাস স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন,
“… এই সম্মেলনই বাঁকুড়ায় কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। শ্রদ্ধেয় বঙ্কিম মুখার্জি, ডঃ ভূপেন্দ্র দত্ত, সৈয়দ মহম্মদ খাঁ, নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার, মুজাফফর আহমেদ প্রমুখ বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতাগণ কর্মীদের সাথে পরিচিত হন, তাঁহারা স্থানীয় কর্মীদের নিষ্ঠায় মুগ্ধ হইয়াছিলেন, যখনই তাঁহাদিগকে ডাকা হইয়াছে তখনই আসিতেন বিশেষভাবে ডঃ ভূপেন্দ্র দত্ত, নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার ও সৌমেন ঠাকুর জেলার কর্মীদের আশাতীত স্নেহ করিতেন।’’
এই কর্মীগণের সাথে কমিউিনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত, সদ্য জেল ফেরত যুবকরাও জেলায় নতুনভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির ‘অর্গানাইজিং কমিটি’ গঠিত হয়।এই কমিটির সদস্য ছিলেন জগদীশ পালিত, মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় (তখনো আন্দামান সেলুলার জেলে বন্দি, স্মৃতি কথা পৃ. ৩৩), বিমল সরকার (সদ্য আন্দামান সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন) দিবাকর দত্ত (১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর-এ মুক্তি লাভ করে, বিষ্ণুপুর আসেন), প্রমথ ঘোষ, ইন্দুভূষণ সাঁই, গোবিন্দ মণ্ডল, দেবীসাধন বসু, বীরেন্দ্র সিংহদেব, প্রভাকর বিরুণী প্রমুখ। পার্টিকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য পার্টির ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক ও মহিলা সংগঠন গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও শুরু হয় এই সময় থেকে। কমিউনিস্টরা একইসাথে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাঁদের আশ্রয়ে পুষ্ট জমিদার, মহাজন, মিল মালিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার চেষ্টা করেন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে শ্রেণি সচেতনতা সৃষ্টি করে স্বাধীনতা আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা ও গতি আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন শাখা যে সমস্ত কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালনা করে সেগুলি পর্যালোচনা করলে আন্দোলনের প্রকৃতি কিছুটা উপলব্ধি করা যায়।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে রানিগঞ্জের কাগজকলে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে ধর্মঘট শুরু হয় কমিউনিস্টদের উদ্যোগে। কোম্পানির গাড়ি ধর্মঘট সমর্থনকারী কর্মী সুকুমার ব্যানার্জীকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলেন বলে অভিযোগ করেন শ্রমিকরা। এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। ফলে, ব্রিটিশ সরকার রানিগঞ্জে মিটিং মিছিল জনসভা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তাই, দামোদর নদীর এপারে বাঁকুড়ার মেজিয়া গ্রামে জনসভা করা হত। এই আন্দোলনের সমর্থনে কৃষকরাও এগিয়ে আসেন। গোপাল সাধু নামে এক কংগ্রেস কর্মীর বাড়িতে কৃষকদের নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল ‘জেলাব্যাপী কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলা, জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সকলকে সমবেত করা- ঐক্যবদ্ধ করা।”
জেলার বিভিন্ন স্থানে এই লক্ষ্যে কাজ করার পর পরবর্তী বৎসর মালিয়াড়া গ্রামে দ্বিতীয় জেলা কৃষক সম্মেলন হয়। মালিয়াড়ার জমিদার ‘বেগার’ অর্থাৎ বিনা পারিশ্রমিকে ক্ষেতমজুরদের কাজ করতেন এবং হাটে চাষিদের কাছ থেকে ‘তোলা’ আদায় করতেন। এর বিরুদ্ধে কৃষকসভা আন্দোলন শুরু করে সাফল্য পায়।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে বড়জোড়ায় কৃষক সমিতির তৃতীয় জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের পর কমিউনিস্ট কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়। পুলিশ নেতা, কর্মীদের খোঁজ করতে থাকেন গ্রেপ্তার করার জন্য কিন্তু তারা দিনের বেলায় লুকিয়ে থেকে রাতের বেলায় গ্রামে গ্রামে গিয়ে সংগঠন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ১৯৪৩-এ বীরসিংহপুরে, ১৯৪৪-এ হদল নারায়ণপুরে জেলা কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় নানান প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও। এই সব সম্মেলনে স্থানীয় দাবিগুলিই প্রাধান্য পায় যেমন : ক্ষেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি, দামোদর নদের উপর বাঁধ (মাটির) নির্মাণের দাবি, বেগার খাটানোর বিরোধিতা ও বন্ধ করা, তোলা আদায়, নজরনা নেওয়া বন্ধ করা প্রভৃতি। এই সময়ের স্লোগান ছিল – লাঙ্গল যার জমি তার, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করো, ধর চাষি ডান্ডা হোক জমিদার ঠান্ডা প্রভৃতি।
-৩-
জেলায় কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে জেলার কমিউনিস্ট নেতারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, স্থানীয় সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারলেই কৃষক, ক্ষেতমজুরদের সংগঠনে আনা সহজ হবে। কারণ, তাঁদের কাছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ ছিল পরোক্ষ কিন্তু জমিদার-জোতদার-মহাজনদের শোষণ ছিল তাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা। জেলায় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত একাংশের প্রকাশ্য বিরোধিতা, ব্রিটিশ প্রশাসনের ভীতি প্রদর্শন ও সন্ত্রাস এবং জমিদার মহাজনদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এই জেলায় কমিউনিস্টরা কৃষকদের সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এই সময়ে কৃষক সভা যে সমস্ত দাবির ভিত্তিতে সাফল্যের সঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচি রূপায়িত করেছিল তার মধ্যে ছিল : সেচ ব্যবস্থার সংস্কার, দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চলে খাদ্য ও রিলিফের ব্যবস্থা, মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান, খাদ্যশস্যের চোরাচালান বন্ধ করা, মজুত দ্রব্য উদ্ধার করা, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে সোনামুখিতে শুভঙ্কর দাঁড়া, (সেচের নালা) কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রম ও সাহায্যের উপর নির্ভর করে সংস্কার করা হয়। এরকম সব কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের বৃহৎ অংশকে তাঁদের মধ্যে সামিল করতে চেষ্টা করেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই সমস্ত কর্মসূচি জেলার উচ্চবিত্ত সম্প্রদায় ও তাদের স্বার্থরক্ষক ব্রিটিশ সরকারের মনঃপুত ছিল না।
-৪-
সংগঠনের কর্মীদের উপর অত্যাচার হয়েছে নানা দিক থেকে। কাঞ্চনপুরের জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য এবং তাঁর অত্যাচারের ঘটনা ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য পত্রিকা সম্পাদক বঙ্কিম মুখার্জির মতো ব্যক্তিকে মানহানির মামলায় জড়ানো হয়! এই যখন অবস্থা, তখন সাধারণ গরিব কৃষকদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। কৃষকদের নানান মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করার কৌশল, সেচের জল বন্ধ করা প্রভৃতি উপায় জমিদাররা অবলম্বন করেছিলেন। দামোদর-বাটী গ্রামে কৃষক সভার কর্মী জনৈক শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের চোখে ঘুমন্ত অবস্থায় অ্যাসিড ঢালার মতো ঘটনাও বাঁকুড়া জেলায় ঘটেছে। ব্যক্তিগত আক্রমণ ছাড়াও গুপ্তঘাতক দিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্রও হয়েছিল বেশ কয়েকটি। ইতিমধ্যে ১৯৪১ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জেলা কমিটি গঠিত হয়। মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় : ‘১৯৪১ সালে জেলা কমিটি গঠিত হল। আমি, ক্ষেত্রগোপাল চট্টোপাধ্যায়, বিমল সরকার, মানিক দত্ত, ডাঃ অজিত সিং, ডাঃ সুধাংশু মুখার্জী, প্রভাকর বিরুণী, শিশির মুখোপাধ্যায় ও দু’জন বিড়ি শ্রমিক (আজ নাম মনে নেই) জেলা কমিটির সদস্য। বিমল সরকার প্রথম সম্পাদক। এই সময় নীহার সরকার অধ্যাপক হয়ে আসেন বাঁকুড়ায়। তাঁকে ছাত্র সংগঠন গড়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়।” (স্মৃতি কথা পৃ: ৩৬)। সরোজ মুখার্জ্জী রচিত ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা’ গ্রন্থের তথ্য দেওয়া হোল : জেলা কমিটিতে ছিলেন বিমল সরকার (সম্পাদক), ইন্দুভূষণ সাঁই, জগদীশ পালিত, প্রমথ ঘোষ।
#
জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনে ও কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেস পরিচালিত আন্দোলনে, বা সশস্ত্র বিপ্লব প্রচেষ্টা বা কমিউনিস্ট আন্দোলনে সব ক্ষেত্রেই আমাদের দেশের ছাত্ররা এক সংগ্রামী ঐতিহ্যের সৃষ্টি করেছেন বললে অত্যুক্তি হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪০-এর গোড়ার দিকে বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে ছাত্রদের বিবাদ চরমে ওঠে। অনুষ্ঠানে ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতটি কর্তৃপক্ষ গাইতে দিতে অস্বীকার করলে এর প্রতিবাদে ছাত্ররা একদিনের প্রতীক ধর্মঘট করে ও বি পি এস এফের নেতৃত্বে মিছিল করে শহর পরিক্রমা করে। কলেজ কর্তৃপক্ষ এতে আরও অসন্তুষ্ট হয়ে কলেজ ও ছাত্রাবাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররা ২০ দিন ধরে অবস্থান ধর্মঘট করেন। ধর্মঘট উপলক্ষে শহরে প্রতিদিন মিছিল করা হত, তহবিল সংগ্রহ করা হত এবং দেশাত্মবোধক সংগীত পরিবেশন করা হত। কলেজ কর্তৃপক্ষ অনেক ছাত্রকে জোর করে বহিষ্কারের আদেশ দেন। বহিষ্কৃতদের মধ্যে ছিলেন, উদয়ভানু ঘোষ, ভোলানাথ কর্মকার, শান্তব্রত চট্টোপাধ্যায় ও মানিক দত্ত। এই সময়েই এদের সঙ্গে সত্য ঘোষাল, শিশির মুখার্জি ও ভূপাল সরকারকে নিয়ে বি পি এস এফ পরিচালনার জন্য কমিটি করা হয়। ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ক্ষেত্রগোপাল চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকাও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ওই বছরই (১৯৪০) বাংলার গভর্নর স্যর জন হারবার্ট যুদ্ধ তহবিলে অর্থ সংগ্রহের জন্য বাঁকুড়ায় আসেন। ক্রিশ্চান কলেজের তখনকার অধ্যক্ষ সি এফ বল ছাত্রদের দিয়ে গভর্নরকে ‘গার্ড অফ অনার’ দেওয়ার প্রস্তাব জানালে তার বিরোধিতা করে বিপিএসএফ। গভর্নর যেদিন আসেন সেদিন ছাত্ররা বিপিএসএফের পতাকা নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। এই মিছিলে পুলিশ বেপোরোয়া লাঠি চালায় এবং বহু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রায় চারশো জন ছাত্রকে জোর করে টিসি দেন। প্রসঙ্গত, এই সময়কার ছাত্র আন্দোলন জেলা সদরেই নয় গ্রামাঞ্চলেও এক বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বলে জানা যায়। ছাত্রদের অভাব অভিযোগের মীমাংশা করার জন্য ছাত্রদের সংগঠনের কতখানি গুরুত্ব তা উপলব্ধি করেন অনেকেই।
সুভাষ চন্দ্র বসুর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ছাত্ররা বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর শহরে হরতাল করে এবং মিছিল ও সভার মাধ্যমে এর প্রতিবাদ জানান। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি, ছাত্ররা স্বাধীনতার শপথ গ্রহণ করে। এসব আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্ররা সংগঠিত ভাবে জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তিশালী করেন এবং পরবর্তীকালে অনেক ছাত্র নেতাই কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে জেলায় শ্রমিক-কৃষকের আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলেন। এদের মধ্যে স্মরণীয় কয়েকজন হলেন : মানিক দত্ত, উদয়ভানু ঘোষ, শিশির মুখার্জি, শান্তব্রত চট্টোপাধ্যায়, দেবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অজিত সিং, সত্য ঘোষাল, ভোলানাথ কর্মকার প্রমুখ।
বাঁকুড়া জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির বিকাশে জেলার সদর শহর বাঁকুড়ার বিড়ি শ্রমিকদের ভূমিকাও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এমনিতে বাঁকুড়া জেলা ব্রিটিশ ভারতে পরিচিত ছিল শিল্পহীন জেলা হিসাবেই। কোনও ভারি শিল্প ছিল না। তবে জেলার এক বিশাল অংশের মানুষের দ্বিতীয় জীবিকা ছিল কুটির শিল্প। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে এখানকার তাঁত, হস্তশিল্প, পোড়ামাটির কাজ সবই অবহেলিত হয়। ইংরেজ শাসনব্যবস্থা ভারতের স্বয়ম্ভর গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। বাঁকুড়াতেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। এই অবস্থায় ১৯৩৮-৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাঁকুড়ায় তখন বিড়ি কারখানা ছিল অনেকগুলি। বিড়ি শ্রমিকরা ছিলেন অসংগঠিত। ১৯৪০-৪১ নাগাদ ক্ষেত্রগোপাল চট্টোপাধ্যায়কে বিড়ি শ্রমিকদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২২২ নং বিড়ি কারখানা ছিল তখন সবচাইতে বড়ো। সেখানে প্রায় ছ’শো শ্রমিক কাজ করতেন। দৈনিক মজুরির হার ছিল হাজারে চার আনা থেকে পাঁচ আনা। এর থেকে আবার বাদ যেত ‘ঈশ্বরবৃত্তি’। খারাপ বলে হাজারে ১৫০/২০০ বিড়ি বাতিল করে মজুরি কেটে নেওয়া হোত। এমতাবস্থায় বিড়ি শ্রমিকদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করা হয়। শিবু পণ্ডা, বিজন ব্যানার্জি, বিকনার ভোলানাথ সিং ও আরও অনেককে নিয়ে এই কমিটি তৈরি হয়। তারা দীর্ঘ প্রচার আন্দোলনের ফলে মজুরি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন, ‘ঈশ্বর বৃত্তি’ বন্ধ করেন এবং মালিক ও শ্রমিকদের যৌথ পক্ষের লোক দিয়ে বিড়ি পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু হয়। শ্রমিকদের এই জয় নেতা ও কর্মীদের মনে যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল তা জেলায় কমিউনিস্ট পার্টিকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি দিয়েছিল বলা যায়।
বিড়ি শ্রমিকদের সংগঠন শহরে এতই জোরদার ছিল যে পার্টির নেতাদের গ্রেপ্তারের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা প্রতিবাদ মিছিল বের করতে পারতেন। এছাড়াও গাড়োয়ান, তেলকল শ্রমিক, মুটিয়া মজদুর তাঁত শ্রমিক ও তাঁতিদের সমস্যা নিয়েও আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল।
-৫-
মহিলাদের লড়াকু মানসিকতা এ রাজ্যের ঐতিহ্য বলা যেতে পারে। বাঁকুড়াও তার থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বিষ্ণুপুর মহকুমাতে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত মহিলার সংখ্যা ছিল সমগ্র বাংলার মধ্যে তৃতীয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় গান্ধিবাদী নেত্রী শান্তশীলা পালিতের নাম। তিনি নিজে, তাঁর পাঁচপুত্র, এক কন্যা, পুত্রবধূগণ সকলেই দেশের কাজে এগিয়ে এসেছিলেন। আলোচ্য নিবন্ধে উল্লেখিত সুশীল পালিত, জগদীশ পালিতের তিনি জন্মদাত্রী। তার এক পুত্র পঞ্চানন পালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদ হয়েছিলেন। জেলায় কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হলে জেলার মহিলাদেরও সংগঠিত করা প্রচেষ্টা শুরু হয়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে সারা বাংলার মহিলাদের সঙ্গে একাত্মতা দেখিয়ে এই জেলাতেও ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ গড়ে তোলা হয়। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, জনগণের মধ্যে খাদ্য বণ্টন ও দুঃস্থ মহিলাদের সমাজে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার দাবিতে মহিলারা সোচ্চার হন। এর নেতৃত্বে ছিলেন ভক্তি সিং, মুক্তি সিং, সুলতানা বেগম (ইনি পরবর্তীকালে বাংলাদেশে চলে যান)। কুড়ানী বাউরি, মোহনি বাউরি, দাসী বাউরি প্রমুখ। ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ অনুযায়ী ১৯৪৪-এর ১৫ মার্চ, জেলা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির তৃতীয় সম্মেলন হয় বাঁকুড়া শহরে। এতে প্রায় পাঁচশো জন মহিলা যোগদান করেন। তার মধ্যে চারশো জন ছিলেন মজুর শ্রেণির ও একশো জন ছিলেন অন্যান্য শ্রেণির । ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ওই সমিতির সদস্য সংখ্যা ছিল এক হাজার। [ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা (২য় খণ্ড) সরোজ মুখাপাধ্যায়, ঐ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলি, ১৯৮৬, পৃঃ ৩১৬]
কমিউনিস্ট পার্টির জেলা সাংগঠনিক কমিটির কার্যালয় ছিল বিষ্ণুপুরে। সেখানে বিবেকানন্দ ক্লাবের অফিসটিই সাংগঠনিক কমিটির অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হত। ১৯৪১-এ বাঁকুড়া জেলা কমিটি গঠিত হলে (i) বাঁকুড়া শহরের গোপীনাথপুর মহল্লায় কার্যালয় করা হয়। (ii) কমিটির দ্বিতীয় কার্যালয় বাঁকুড়া শহরে ফেমাস চায়ের দোকানের (এখন আর চা দোকানটি নেই) সামনের গলিতে। কিছুদিন পরে তা স্থানান্তর হয় (iii) বাঁকুড়া শহরের পাঠক পাড়ায়। অনুমান, সদর রাস্তার উপর গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব ছিল না বলেই বোধ হয় এই স্থানাস্তর। ওখান থেকে (iv) কালীতলার একটি বাড়িতে তা দুর্গা হাজরার কাছাকাছি ছিল। (v) এরপর ১৯৫১তে ফিডাররোডে অস্থায়ীভাবে কিছুদিন থাকার পর: (vi) বর্তমান স্কুলডাঙ্গায় অফিসটি নিয়ে আসা হয়। (১৯৫১)
জেলায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয়টি প্রথম বিড়ি ইউনিয়নের অফিস থেকেই কাজ চালাতো। (মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়: স্মৃতিকথা, ঐ, পৃ. ৩৬)। তখন বিড়ি ইউনিয়ন ও দলের চাঁদা একই সঙ্গে নেওয়া হত। মুজফফর আহমেদ দল ও গণ সংগঠনের মধ্যে যে পার্থক্য আছে সে ব্যাপারে অবহিত করার পর নেতৃত্ব তাদের কর্মপদ্ধতি সংশোধন করে নেন। (ঐ. পৃ. ৩৮)
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় (মিহির রায় – প্রতিবেদন ৩৫) ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন ৩৯ জন। এদের মধ্যে সর্বক্ষণের (Wholetimer) কর্মী ছিলেন ৫ জন, শ্রমিক ৪ জন, কৃষক ৩ জন, ছাত্র ১৬ জন ও মহিলা ৬ জন (এখানে অন্যান্য শ্রেণি যেমন অধ্যাপক, উকিল, সরকারি কর্মী, শিক্ষক ইত্যাদি থেকে ৫ জন হলে সংখ্যাটি মোট ৩৯ জন হবে।)
এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় জেলায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ছাত্র ও যুবদের ভূমিকা ও তাৎপর্য কতখানি ছিল। ৩৯ জন মোট পার্টি সদস্যের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ছিল তাদের প্রতিনিধি। পরবর্তীকালে এরাই জেলাতে পার্টির সংগঠন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে জেলায় ‘সোভিয়েত সুহৃদ কমিটি’ গড়ে তালা হয়। যুদ্ধের সময় বিভিন্ন সভা সমিতির মাধ্যমে যুদ্ধর চরিত্র বদলের কারণ, যুদ্ধে জনগণের কি ভূমিকা হবে ইত্যাদি সেমিনার প্রভৃতির মাধ্যমে তুলে ধরেন। অধ্যাপক নীহার সরকার ও দেবনাথন, অধ্যক্ষ নির্মল ব্যানার্জীর, ডাঃ সুধাংশু মুখার্জী এবং বৈদ্যনাথ ঘোষ ছিলেন এই কমিটিতে। এখানে অধ্যাপক নীহার সরকার প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, তিনি তাঁর বেতনের সামান্য অংশ নিজের জন্য রেখে বাকি সবটা পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার জন্য ব্যয় করতেন বলে। জানিয়েছেন সেই সময়কার দলের নেতা কর্মী ও ছাত্ররা। ভারতে ১৯৩০এর আইন অমান্য আন্দোলনের পর এক গণজোয়ার আসে বলা যায়। যার প্রতিফলন পরবর্তীকালে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনগুলিতে দেখা যায়।
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের ৫০ তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় লক্ষ্ণৌতে এবং পরের বছর ৫১ তম অধিবেশন বসে ফেজপুরে, দুটি অধিবেশনই সভাপতি হন জহরলাল নেহেরু। তিনি তখন নিজেকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করতেন না। তিনি বলেছিলেন, “আমি যখন এই শব্দ (সোস্যালিজম) উচ্চারণ করি তখন কোন ধোঁয়াটে মানবিকতার কথা বলি না, বৈজ্ঞানিক অর্থনৈতিক অর্থে।’’ এই সমাজতন্ত্রের আদর্শে দেশের ছাত্র যুব সমাজ আন্দোলিত হয়েছিল তা তাঁদের কমিউনিস্ট জীবন পরিক্রমা করলেই বোঝা যায়। সুখী, সুন্দর, নিরুপদ্রব জীবনের মায়া ত্যাগ করে সমাজের সকলের মঙ্গলের জন্য, দেশ মাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষকে শ্রেণিচেতনার আলোকে আলোকিত করে তাদের ‘প্রকৃত মুক্তি’ এনে দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। এরজন্য তাঁদের হাতে ও মগজে অস্ত্র ছিল বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদ। অগণিত মানুষের মেহনতে, আত্মত্যাগে, শহিদের মৃত্যুবরণে যে রাজনৈতিক দলটি পথ চলা শুরু করেছিল তার পথ চলা শেষ হয়নি আজও। এখনো অধরা তাঁদের সেই লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য পূরণের ইতিহাস হয়তো তৈরি করতে পারেন দেশের যুবশক্তি।।
[আলোচ্য এই নিবন্ধটিতে অনেকেরই নাম উল্লেখ করা হয়নি।এখানে ঘটনা প্রসঙ্গে যাঁদের নাম এসেছে তাঁদেরই নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সহৃদয় পাঠকগণ যদি কেউ এই বিষয়ে তথ্যসূত্র সহ আলোকপাত করেন, তাহলে বিষয়টি আরো সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করি। তথ্যগত কোন ভুল পাঠকের নজরে এলে তাও জানাতে দ্বিধা করবেন না]
সূত্র নির্দেশঃ
১। মিহির কুমার রায় (সম্পাঃ): বাঁকুড়া জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্মৃতিকথা, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া৷
২। রামকৃষ্ণ দাস: ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঁকুড়া’, ‘পথের সংগ্রহ’ সম্পাদনা: রমাপ্রসাদ পাত্রকর্মকার, রামপুর, বাঁকুড়া, পূজাসংখ্যা: ১৩৮২
৩। তরুণদেব ভট্টাচার্য: বাঁকুড়া, ফার্মা কে. এল.এম. প্রাঃ লি। কলিকাতা- ১৯৮২
৪। রামকৃষ্ণ দাস: বাঁকুড়ার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি—সরণ, সম্পাদনা তারাপ্রসাদ শিকদার, স্কুলডাঙ্গা, বাঁকুড়া, ১লা আষাঢ়, ১৩৮৭
৫। সনৎকুমার ভট্টাচার্য: বাংলার বীরাঙ্গনা শান্তশীলা, কলি-৯, ১৩৭৬
৬। সুব্রত রায়: বাঁকুড়া জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস (১৯২৩-৪৭), বাঁকুড়া, ১৩৯১
৭। বীরেশ্বর ঘোষ: চলার পথে, বাঁকুড়া ১৩৮৯
৮। অমলেশ ত্রিপাঠী: স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫-১৯৪৭), আনন্দ, কলিকাতা, ১ লা বৈশাখ ১৩৯৭
৯। আবদুল্লাহ রসুল: কৃষক সভার ইতিহাস (২য় খণ্ড) নবজাতক প্রকাশন, কলি-৭, ১৯৮০
১০। সরোজ মুখোপাধ্যায়: কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা (২য় খণ্ড), এনবিএ, কলিকাতা ১৯৮৬
১১। ভজন কুমার দত্ত: বাঁকুড়া জেলায় স্বাধীনতা সংগ্রাম: একটি পর্যালোচনা (গবেষণাপত্র) জানুয়ারি, ১৯৯৩। ২০১৫তে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।
প্রচ্ছদঃ পাল রেশমী
*****