বিকল্পবিজ্ঞান (?): বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞান, অবিজ্ঞান এবং তন্ত্রচর্চা (দ্বিতীয় পর্ব) – রাজর্ষি রায়

(প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন)

মুখবন্ধ:

প্রেমেন্দ্র মিত্র,সত্যজিৎ রায়, অদ্রীশ বর্ধন প্রমুখের হাত ধরে স্বাধীনোত্তর বাংলা কিশোরসাহিত্যের অন্যতম প্রধান প্রতিভূ হয়ে উঠেছিল কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু কথিত ‘Scientific Temper’কে মূল উপজীব্য করে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য তার সৃষ্টিমুহূর্তেই হয়ে উঠেছিল প্রবলভাবে রাজনৈতিক, যার মধ্যে সুনির্দিষ্ট ‘scientific method’ বা ‘প্রণালী’ র প্রতি আনুগত্য দেখা যেতে থাকে। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষণের পাশাপাশি বাংলা কিশোরসাহিত্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা বিকাশের পথও প্রশস্ত হয়। বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের এই পর্যায়ক্রমিক বিকাশ ও তার পিছনে ঘটে চলা সামাজিক- রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী ধরা রইল প্রথম পর্বে

প্রসঙ্গত, বাংলায় প্রথম প্রজন্মের কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের বিকাশকালেই সমান্তরালভাবে কথাসাহিত্যের আরেক ধারার আগমন ঘটে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর আপাত নিস্তরঙ্গ পল্লীজীবনের স্মৃতি আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে জন্ম হয় ‘তারানাথ তান্ত্রিকে’র। তারানাথ কলকাতা শহরতলীর এক মামুলি গণৎকার কিন্তু তার অলীক কথনভঙ্গিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে তন্ত্র-মন্ত্র সহ গ্রামজীবনের অভ্যস্ত লোকাচারসমূহ-তন্ত্রসাধনাকে পটভূমিকায় রেখে ‘শুভ-অশুভ’র দ্বন্দ্ব কাহিনীতে আলাদা মাত্রা যোগ করে। তারানাথ তান্ত্রিকের সেই ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে অধুনা বাংলা সাহিত্যে ‘folk horror’ এর বিবর্তন এবং পূর্বকথিত ‘method’ এর সাথে তার কোনো সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য আছে কিনা এই বিষয়টি আলোচিত হয়েছে এবারের পর্বে…   

বাংলা folk horror ধারার শুরু

স্বাধীনতার কিছু আগে থেকেই কয়েকজন বাংলা ছোটগল্পকারের কলমে বাংলার প্রচলিত সাহিত্যধারার বিপরীতে স্বতন্ত্র একটি ধারা জায়গা করে নিতে থাকে; নাগরিক জীবন ছেড়ে পল্লীগ্রামের আপাত-নিস্তরঙ্গ যাপন ও জীবনবোধ তাদের লেখায় উঠে আসতে আরম্ভ করে। বলা যেতে পারে যে, এ.কে. ফজলুল হকের প্রভিন্সিয়াল বেঙ্গল গভর্নমেন্টের জমিদারি-বিরোধী কর্মসূচি তৎকালীন বাংলা ছোটগল্প সাহিত্যিকদের গ্রামবাংলার ভবিষ্যতের প্রতি আশান্বিত করে তুলেছিল। বাংলা ছোটগল্প সাহিত্যের যে ধারাটি ‘নগর থেকে পল্লী’মুখী হচ্ছিল তার মূল উপজীব্য ছিল পল্লীজীবনের দ্রুত উন্নয়ন। ফজলুল হকের প্রজাপার্টি ও মুসলিম লীগের জোট সরকার ১৯৩৭ থেকে ‘পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট’ আইনের দ্বারা, ভাগচাষি এবং গরিব চাষিদের খাজনা বাবদ পূর্ব মাশুল প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনেন (১২.৫০ থেকে ৬.২৫ %) এবং টেন্যান্সি ল ’১৮৮৫ সংশোধন করে ভাড়ার মাশুল দশ বছরের জন্যে স্থায়ী করেন। এছাড়াও ‘নদী সিকস্তি’ আইনের দ্বারা নদীর গর্ভে তলিয়ে যাওয়া জমি দখল করতে পারার ক্ষেত্রে চাষিদের সুবিধা করে দেন। এইসমস্ত জনদরদী কর্মসূচির প্রভাবে বাংলার পল্লীজীবনে একরকমভাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয় ফলত জীবনধারণ কিছুটা স্বচ্ছন্দ হতে আরম্ভ করে। তাই বাংলা ছোটগল্পের এই বিশিষ্ট ধারাটি তার চরিত্র ও কাহিনিবিন্যাসে পল্লিজীবনকে কেন্দ্রে রেখে বিবর্তিত হতে থাকে। বাঙালি ছোটগল্পকারদের এই পল্লিমুখীনতার আরেকটি কারণ হতে পারেন গুরুসদয় দত্ত। ১৯২৫ থেকে শুরু করে গোটা ৩০এর দশক জুড়ে তিনি গ্রামবাংলাকে স্বয়ংসিদ্ধ করার জন্য এক বিপুল কর্মযজ্ঞ আরম্ভ করেন। ১৯২৫ থেকে ১৯৩০- পাঁচবছর উনি নিজে ঘুরে বেরিয়ে পল্লীসমাজের বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে গবেষণা করেছেন। ১৯৩০-র পরে ব্রিটিশ ফোকলোরিস্ট সেসিল শার্পের সংস্পর্শে এসে উনি  ‘ব্রতচারী সমিতি’ এবং ‘ব্রতচারী আন্দোলন’-এর সূচনা করেন। সুতরাং ৩০-র দশকে বাঙালি সাহিত্যিকদের একাংশের পল্লীপ্রীতি মূলত এই দুইয়ের মিলিত প্রভাবে বিকশিত হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় ছিলেন এই গোষ্ঠীর এক উজ্জ্বল উদাহরণ যিনি ‘নগর থেকে পল্লী’ এবং ‘পল্লী থেকে নগর’, এই দুটি  ঐতিহাসিক ‘event’ কে বাংলাসাহিত্যে নান্দনিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। পরবর্তীকালে একমাত্র নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর প্রাপ্তবয়স্কদের ছোটগল্পগুলিতে এই একই form নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। উল্লেখ্য যে, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নিজেও তাঁর ‘পল্লী-পর্যায়ে’ লেখা বেশ কয়েকটি ছোটগল্পে তন্ত্রসাধনাকে স্থান দিয়েছেন। ‘পুষ্করা’, ‘তমস্বিনী’ প্রভৃতি গল্পগুলিতে তন্ত্রচর্চা স্থান পেয়েছে গ্রামীণ অশিক্ষা, মন্বন্তরপূর্ব শস্যদানার অপ্রতুলতার দ্বারা তৈরী ভীতির প্রশ্রয়ে। সেই অর্থে বলতে গেলে হয়ত তাঁর এই পর্যায়ের লেখাগুলি Naturalist ধারার সঙ্গে যুক্ত এবং লেখক নিজে তন্ত্র সাধনাকে এভাবেই সমালোচনার পরিসরে আনতে চেয়েছিলেন। 

তারানাথ তান্ত্রিকের আবির্ভাব

বিভূতিভূষণের এইসময়ের এক অবিস্মরণীয় কীর্তি হল ‘তারানাথ জ্যোতির্বিনোদ’ বা ‘তারানাথ তান্ত্রিক’। এই প্রবন্ধের সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি – তারানাথ তান্ত্রিক একটা স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার নিউক্লয়াস হয়ে উঠেছে; বাংলা টিভি সিরিয়াল, ওয়েব-সিরিজ, রেডিও, গ্রাফিক নভেল- অর্থাৎ পপুলার কালচারের সমস্ত মাধ্যমে তারানাথের কাহিনী পাঠকদের মধ্যে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। আশ্চর্য এই যে, ‘তারানাথ তান্ত্রিক’ তার প্রথম প্রকাশের প্রাক্কালে (১৯৩৫) সেই রকম উন্মাদনার সৃষ্টি করতে পারেনি, যা বিভূতিভূষণের অন্যান্য গল্প বা উপন্যাসের ক্ষেত্রে দেখা যেত। কিন্তু বর্তমান বাংলাসাহিত্যে তারানাথ তান্ত্রিকের কাহিনীর আবেদন যেন আকাশচুম্বী! ১৯৩৭ এ “জন্ম ও মৃত্যু” সংকলনে প্রথম আবির্ভাবের পর জ্যোতির্বিনোদ মহাশয় কার্যত বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যান। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে বিজ্ঞানমনস্কতা এবং সাহিত্যে বিজ্ঞান ও অ্যাডভেঞ্চারের টানাপোড়েনে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পগুলি। বিভূতিভূষণের উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাগুলির জনপ্রিয়তার কারণেও তাঁর লেখালিখিকে কেন্দ্র করে গবেষণামূলক চর্চা সম্পূর্ণ অন্য খাতে বইতে থাকে।

ভাবলে সত্যি অবাক লাগে যে বিভূতিভূষণ তারানাথ তান্ত্রিকের প্রথম দর্শন এর গল্পে আকস্মিকভাবেই সেই সময়ের বিজ্ঞানমূলক কাহিনীর প্রধান দুর্বলতার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গল্পে আমরা দেখতে পাই যে তারানাথ আর গল্পকার একদিন এক সাধুর দর্শন করতে যান, যেখানে সাধুটি রুমালের মধ্যে বেলফুলের গন্ধ সৃষ্টি করে সবাইকে অবাক করে দেন। গল্পের রচয়িতা যুক্তি দিয়ে এই ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ‘প্রকান্ড এক বৈজ্ঞানিক অসম্ভব্যতা’ র সম্মুখীন হন:

‘কন্টাক্ট at ডিস্টেন্স এর মোটা সমস্যাই ওর মধ্যে জড়ানো’

অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক যুক্তি ধরে এগিয়ে চললে সাধুর ওই শক্তি অতিলৌকিক। পরবর্তীকালে তারানাথ জ্যোতিষী নিজেই বলেন যে সাধুর ওই ক্ষমতা নিম্নমার্গীয় সাধনার ফসল এবং তিনি নিজেই ‘দু-পয়সার আতর’ তৈরী করার তন্ত্রসাধনাকে ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’ এর আখ্যা দেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই তারানাথ নিজের তন্ত্রসাধনার পূর্বকথা বৈঠকি গল্পের আদলে বলতে থাকেন এবং বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত প্রথম ‘folk horror’(ফোক হরর) নামক genre এর জন্ম হয়। এই নব্য শ্রেণীর সাহিত্যে তন্ত্রসাধনার দ্বারা প্রাপ্ত প্রকৃতির এক অমোঘ, ভয়াল রূপের সাথে বাংলার পল্লীগ্রামের মেঠো জীবনযাপনের বিস্ময়কর সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন  বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। তারানাথের স্মৃতিরোমন্থনে তন্ত্রের উপযোগিতার সাথে উঠে আসে এক নতুন ধরনের প্রকৃতিবোধ যা স্থূল অনুভূতিতে ধরা দেয় না; এই প্রকৃতিবোধের হাত ধরে সামনে চলে আসে ‘দ্রব্যগুণ’এর তত্ত্ব। সাহিত্য-কল্পের এই নতুন ধারাটিকে পরবর্তীতে আরো রোমহর্ষক করে তোলেন তারাদাস বন্দোপাধ্যায়। তারানাথের ‘বেতাল’ গল্পে উনি লিখছেন:

‘দ্রব্যগুণ বুঝলে? দ্রব্যগুণ একটা বিরাট জিনিস তুমি মানো?…তুমি প্রকৃতির সংহারশক্তিতে বিশ্বাস করো? প্রকৃতির অনেক রকম শক্তি আছে…প্রকৃতি আমাদের শস্য দান করে, বাতাস দান  করে, বৃষ্টি দান করে- এগুলিতে আমাদের প্রাণ বাঁচে ,এগুলি শুভ শক্তি। আবার মহামারী, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, যুদ্ধ এগুলি হলো সংহারক শক্তি। এছাড়াও অনেক অদৃশ্য, অদ্ভুত মারক শক্তি আছে, সাধনার দ্বারা তাদের জাগ্রত করা যায় ; যেমন বেতাল জাগানো …’

যদিও দুটি ক্ষেত্রে (অর্থাৎ বিজ্ঞানচর্চা ও তন্ত্রসাধনা) প্রকৃতিকে ভিন্ন মাত্রায় কল্পনা করা হয় তবুও দ্রব্যগুণের এই তত্ত্বটি আমাদের এই ধারার সাহিত্যে প্রকৃতিবোধের দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে অবহিত করে। প্রথমত, তন্ত্রচর্চা নানান উপায়ে প্রকৃতির শক্তিকে করায়ত্ত করে লৌকিক ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানচর্চার মতোই তন্ত্রচর্চাতে প্রণালী-নিয়ম (methodology) এবং উপাচার ক্রিয়া বিশেষভাবে জরুরি। অর্থাৎ, খুব সহজভাবে বলতে গেলে তন্ত্রসাধনার ফলাফল বা outcome এবং তন্ত্রসাধনার উপাচারক্রিয়ার মধ্যে একটি methodological link বিশেষভাবে বিদ্যমান। এই ‘মেথডোলজিক্যাল লিংক’ এর তত্ত্বটি বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের একটি মৌলিক শর্ত। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে বিজ্ঞান চর্চার প্রসার এবং বৈজ্ঞানিক চেতনাকে প্রেরণা দিতে সাহিত্যিকরা কল্পনার দ্বারা এক বিজ্ঞানশৈলীর রচনা করেছেন যার মধ্যে বৈজ্ঞানিক প্রণালী কিংবা মেথড বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ এই ধারার সাহিত্যে বিজ্ঞানচর্চা প্রসূত ফলটুকু কল্পিত হলেও সেই ফল লাভের জন্যে যে বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড ঘটে তাকে বিশেষ জোর দিয়ে এই সাহিত্যে তুলে ধরা হয় যাতে ফল এবং তত্ত্বের মধ্যে বিভেদটিকে কাল্পনিক যুক্তির দ্বারা শক্তিশালী করা যায়। উদাহরণস্বরূপ সত্যজিৎ রায়ের ‘শঙ্কুর সুবর্ণ সুযোগ’ গল্পে আমরা আলকেমি সংক্রান্ত গবেষণার বর্ণনা পাই; মধ্যযুগীয় এক স্প্যানিশ বিজ্ঞানী রচিত একটি গবেষণামূলক নিবন্ধের ওপর ভিত্তি করে শঙ্কু এবং অন্যরা সোনা তৈরী করতে সমর্থ হন। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রণালীর তাৎপর্য কোথায় এই গল্পটি তার একটি আদর্শ উদাহরণ হতে পারে। আমরা বুঝতে পারি, বিজ্ঞানধর্মী গবেষণায় প্রণালীর গুরুত্ব এখানেই যে সেটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলের মধ্যে সেতুসংযোগ ঘটায়। সুতরাং এই ‘মেথডোলজিক্যাল লিংক’-এর ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে থাকে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের কাঠামো এবং তার উপসংহার। অধুনা বাংলা তন্ত্রসাহিত্যের অন্দরেও এই ‘মেথডোলজিক্যাল লিংক’ বিশেষ ভাবে বিদ্যমান। কিন্তু তন্ত্রের বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রচার সম্ভবত এর মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং তন্ত্রসাহিত্যে উল্লিখিত ‘মেথড’-এর ব্যবহার অনেকাংশে এই নব্য সাহিত্যধারাটিকে কল্পবিজ্ঞান ধারারই একটি বিতর্কযোগ্য অঙ্গ করে তোলে মাত্র। বিষয়টি বিশদে আলোচনা করা যাক-

অবিজ্ঞান এবং বর্তমান বাংলাসাহিত্যে তন্ত্রচর্চা

তন্ত্রচর্চার ইতিহাসকে পটভূমিকায় রেখে অভীক সরকার এবং তার সমগোত্রীয় লেখককুলের হাতে বর্তমান বাংলাসাহিত্যে ‘folk horror’ ধারাটির যে পুনরুজ্জীবন ঘটেছে, তার মধ্যে পল্লীসমাজকে উপলক্ষ্য মাত্র রেখে নগরকেন্দ্রিক হওয়ার একটি প্রবণতা খুব সহজেই চোখে পড়ে। এই জাতীয় সাহিত্যকর্মে তন্ত্রের ধারণা এবং তন্ত্রসাহিত্যের উপযোগিতার পর্যালোচনা করলে বিজ্ঞানচর্চার ‘methodological link’ এর  আদিম ভিত্তিটি  দেখা যায়। অভীক সরকারের ‘এবং ইনকুইজিশন’ সংকলনের ভূমিকাতে রাজা ভট্টাচার্য তন্ত্র-কল্পের আদিম কারণগুলি নিয়ে বলেন:

‘মানুষের প্রথম ও আদিম সমস্ত ধর্মচর্যাই আসলে তন্ত্র। এ হলো মানুষের ধূসর অতীতের কথা, যখন দেবতাদেরও জন্ম হয়নি; তারা তখন ভবিষ্যতের গর্ভে অপেক্ষমান – কতদিনে মানুষ প্রকৃতির আশ্চর্য ও অবোধ্য ঘটনাবলীর পশ্চাতে দেবতার ক্রিয়া আবিষ্কার করবে। বৃষ্টি হয় ইন্দ্রের ইচ্ছায়, সেই কথা কখনো ভাবেনি কোনো মানুষ। তার আগেই সে ভেবে ফেলে – এই নরদেহ, আর এই প্রকৃতিমাতা- এর মধ্যেই নিহিত আছে ব্রহ্মান্ডের সকল নিগূঢ়তম রহস্যের চাবিকাঠি। সৃষ্টিতত্ত্বীয় জিজ্ঞাসার উত্তরসমূহ লুকিয়ে আছে এর মধ্যে; কেননা উভয়ই নূতনের জন্ম দেয়। বৃক্ষ থেকে আরেকটি বৃক্ষ, মানুষ থেকে আরেকটি মানুষের সৃষ্টি হয়। কাজেই, এই উচ্চকিত প্রশ্নের উত্তর বাইরে নয়, এই দেহের ভিতরেই খুঁজতে হবে। এই ভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল তন্ত্রের আদি ধারণাগুলির..’

লেখকের তন্ত্রচর্চামূলক সাহিত্যের এই ভূমিকাতে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক চোখে পড়ে : উনি প্রকৃতির দিক থেকে তন্ত্রসাধনাকে ক্রমেই লৌকিক বলয়ে ফিরিয়ে আনছেন। দ্রব্যগুণের বিতর্কের ভিত্তিতে তারানাথ তান্ত্রিকের মতো  ‘folk horror’ যদি প্রকৃতি এবং অতিপ্রাকৃতকে সাধনার প্রধান অঙ্গ হিসেবে দেখে, তবে আধুনিক তন্ত্রচর্চামূলক ‘folk horror’ সেই সাধনাকে মনুষ্যসমাজের কর্তৃত্বের তলে ফিরিয়ে আনতে চায়। স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের সাহিত্যে ‘শস্য-শ্যামলা’ গ্রামবাংলার ছবির বদলে উঠে আসে আঞ্চলিক তন্ত্রচর্চার ইতিহাস, হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে তন্ত্ররীতির আপাত মিল এছাড়াও সাধক ও তার সাধনার এক স্বল্পচর্চিত ইতিহাস। তন্ত্রচর্চার প্রতি সাধারণের ভীতি এবং অজ্ঞতাকে অবলম্বন করে এই নব্য সাহিত্যকর্মটি সুচারুভাবে ‘অতিপ্রাকৃত’র বদলে এক ‘অতিলৌকিক’ অনুভূতির সৃষ্টি করতে চায় পাঠকদের মধ্যে। তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পে পল্লীসমাজ এবং পল্লীজীবনের বিবরণ আসলেই জরুরি ছিল নইলে প্রকৃতির ভীষণ রূপের সামনে তৎকালীন গ্রাম্যজীবনের অসহায়তার কথা বিশেষ তুলে ধরা যেত না। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই ধরনের লেখাগুলি লৌকিক অনুভূতির ওপরই বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে- বিভিন্ন অতিলৌকিক কল্পনার বিবরণ দিয়ে তাকে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করে; রাজা ভট্টাচার্যের মতে যার ফলস্বরূপ শহর কলকাতায় সকাল বেলা লেখাগুলি পড়লে ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে যায় ।

মনীষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ধূমাবতী সিরিজ’ (বেঙ্গল ট্রইকা পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত) এবং সৌমিক দে’র ‘কালিগুণিন সিরিজে’ও (বিভা পাব্লিকেশন থেকে প্রকাশিত) এরকম চমকপ্রদ এক method-এর প্রভাব লক্ষণীয়। ‘ধূমাবতী সিরিজ’এর লেখকের আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রতি মনোযোগ এই ধারায় এক নতুন দিকের নির্দেশ দেয়। তন্ত্রসাধনার বিবর্তন এবং তার প্রতি সামাজিক প্রতিক্রিয়া – এই দুই উপাদানই তন্ত্রের ইতিহাস ও বর্তমানের মধ্যে সংযোগ রচনা করে। স্বল্পদৈর্ঘ্যের দুটি উপন্যাসে এই উপাদানগুলিকে কুশলী দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন লেখক। ফ্রয়েদীয় উপমা ধার নিয়ে বলা যায় – এভাবেই একটি নান্দনিক ‘uncanny’ সৃষ্টি করা হয়েছে যা পুরো সিরিজটিকেই দারুণ উপভোগ্য করে তুলেছে। Non-linear narrative-এর ওপর ভিত্তি করে মধ্যযুগের নদীয়া জেলা এবং সদ্য মিলেনিয়াম পেরোনো কলকাতা হয়ে উঠেছে আরো ভীতিপ্রদ, অচেনা, অজানা আর অলৌকিক আবেদনসম্পন্ন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ধারার সাহিত্যে তন্ত্রপ্রয়াসের গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। বিশেষ করে তন্ত্রসাধনা এবং তন্ত্রসাধনার ইতিহাসের মধ্যে যে চর্চাগত ফারাক রয়েছে তা এই ধরনের সাহিত্যে অধিকাংশ সময়ে অনুল্লেখিত থেকে যায়। যার ফলে বেশিরভাগ সময়েই এই লেখাগুলির মধ্যে তন্ত্রধর্মী হওয়ার বদলে আঞ্চলিক ইতিহাস (local lore) এবং লৌকিক-অতিলৌকিক লোককথাধর্মী হয়ে ওঠার fallacy দেখা যায়। এই fallacy-র কারণেই এই ধারার লেখায় গভীরতার অভাব বিশেষভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। এক কালে বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য যেমন পরবর্তী কালে জনবিজ্ঞান এবং আরো বিভিন্ন জনমুখী আন্দোলনকে প্রেরণা যুগিয়েছিল এই ধারার কাহিনী হয়ত একই ভাবে কিছু অনভিপ্রেত সামাজিক কুসংস্কার এবং ভীতিকে প্রশ্রয় দিতে পারে বলে আমার ধারণা। বর্তমান কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে যখন প্রায়শই কল্পনাকে জিয়নকাঠি হিসেবে প্রয়োগ করে অবিজ্ঞান অবাঞ্ছিতভাবে বিজ্ঞানের মতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সেই সময় দাঁড়িয়ে উপরোক্ত method এবং তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপকে সম্বল করে বাংলা ‘folk horror’ গোত্রের লেখা তন্ত্রসাধনাকে অবিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করেছে এবং কল্পবিজ্ঞানের এক প্রকার অবৈজ্ঞানিক বিকল্প হিসাবে গড়ে উঠেছে। এই যুক্তিতে বর্তমান বাংলা folk horror কে ‘বিকল্প-বিজ্ঞান’ সাহিত্য হিসেবে আখ্যা দেওয়া চলে। সাহিত্যিকদের নান্দনিক চিন্তাকে দোষারোপ করা যায় না ঠিকই কিন্তু এটাও মনে রাখা জরুরি যে তন্ত্রচর্চাকে গভীরতা দিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা না করে নিছক ন্যারেটিভ সেট-পিস্ হিসেবে প্রয়োগ করলে একটা গোটা প্রজন্মের কাছে তন্ত্রবিদ্যার ‘কৌলিন্য’ হয়ত বশীকরণ, ব্ল্যাক ম্যাজিক এবং আরও কিম্ভুতকিমাকার কিছু সস্তা আর গতানুগতিক বিষয়ে এসে ঠেকবে।

সৌমিক দে’র ‘কালিগুণিন সিরিজ’-এর ক্ষেত্রে ফ্রয়েদীয় ‘uncanny’র তত্ত্বটি আবার আলাদাভাবে কাজ করে। ধূমাবতী সিরিজের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক স্থানের  ইতিহাস এবং পৌরাণিক মাহাত্ম্য যদি এই uncanny অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে, কালিগুণিন সিরিজে লেখক এর তুরুপের তাস হল ভাষা এবং আবারও কাহিনীর পল্লিমুখীনতা। পুরো সংকলনটি জুড়ে আমরা লক্ষ্য করি যে কালিগুণিনের যাবতীয় কারসাজি এবং অভিযানের গল্পগুলি সাজিয়ে উপস্থাপন করেন এক শহুরে ডাক্তার; ডাক্তারের ভাষার চয়ন সকলকেই তারানাথ তান্ত্রিকের শেষ পর্যায়ের লেখাগুলির কথা মনে করাতে বাধ্য। ফ্রয়েড এক জায়গায় শেলিং-এর সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন যে “According to him (Schelling), everything is unheimlich that ought to have remained secret and hidden but has come to light.” কিন্তু ফ্রয়েডের মতে uncanny-র নেপথ্যে থাকে  পুনরাবৃত্তির প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণ (repetition compulsion )। অর্থাৎ এই ধারার কাহিনীগুলির প্লট এবং সামগ্রিক কথনভঙ্গির মধ্যে ভৌগোলিক, পৌরাণিক, বৈজ্ঞানিক এমনকি রাজনৈতিক চেতনারও পুনরাবৃত্তি বিশেষভাবে লক্ষণীয় আর এই repetitionই পাঠকের মধ্যে ‘চেনা-তবু-অজানা’ এক দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। সেই দ্বন্দ্বের অন্তরেই ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের থেকে অনুপ্রাণিত (homologue) সেই ‘method’।

এই নব্য ধারার সাহিত্যচিন্তা আর তন্ত্রচর্চার অতিলৌকিক গাথা সমকালীন বাংলাসাহিত্যের পাঠকের মনে ফ্রয়েদীয় uncanny-র উন্মেষ ঘটাবে বলেই আমার বিশ্বাস। আর তাই ক্রমশই প্রকৃতিচিন্তারহিত কংক্রিট জঙ্গলে বন্দি কসমোপলিটান বাঙালির মননে এইধারার সাহিত্য একটি উপভোগ্য উপাদান হয়ে উঠবে এই আশা রাখি।  

*****

তথ্যসূত্রঃ

বিজ্ঞানের ইতিহাস , সমরেন্দ্রনাথ সেন , ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সাইন্স

‘গুরুসদয় দত্ত: ব্রতচারী ও সংগ্রহশালা’, ড. বিজনকুমার মন্ডল , গুরুসদয় সংগ্রহশালা

‘তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প’: অলৌকিকতা ও পরাবাস্তবতা, দীপায়ন পাল, তবু একলব্য: ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় বিশেষ সংখ্যা

বাংলার তন্ত্র, পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায়

প্রত্যন্ত বাংলায় গুপ্তবিদ্যা, দেবব্রত ভট্টাচার্য

জাদু- কাহিনী, অজিত কৃষ্ণ বসু

‘The Conspiracy Against The Human  Race  : A Contrivance of  Horror “, Thomas Ligotti

‘বিজ্ঞান আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’- সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় , উৎস মানুষ পত্রিকা

‘কালিগুণিন ও ছয় রহস্য ‘ সৌমিক দে, বিভা

‘ধূমাবতীর অভিশাপ’, মনীষ মুখোপাধ্যায় , বেঙ্গল ট্রইকা

‘ধূমাবতীর মন্দির’, মনীষ মুখোপাধ্যায়, বেঙ্গল ট্রইকা

‘এবং ইনকুইজিশন ‘, অভিক সরকার, The Cafe Table

‘A Story of Ambivalent Modernization in Bangladesh and West Bengal: The Rise and fall of Elitism in South Asia ‘, Pranob Chatterjee , Peter Lang

‘Magic, Science and Religion, and other essays’, Bronislaw Malinowski

The Historian’s Craft, Marc Bloch

The Raw and The Cooked, Claude Levi-Strauss