মুখবন্ধ:
বাংলা কিশোর সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা নতুন বিষয় নয়। প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায়, অদ্রীশ বর্ধন প্রমুখের হাত ধরে স্বাধীনোত্তর বাংলা কিশোর সাহিত্যের অন্যতম প্রধান প্রতিভূ হয়ে উঠেছিল কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু কথিত ‘Scientific Temper’কে মূল উপজীব্য করে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য তার সৃষ্টিমুহূর্তেই হয়ে উঠেছিল প্রবলভাবে রাজনৈতিক, যার মধ্যে সুনির্দিষ্ট ‘scientific method’ বা ‘প্রণালী‘ র প্রতি আনুগত্য দেখা যেতে থাকে। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষণের পাশাপাশি বাংলা কিশোর সাহিত্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা বিকাশের পথও প্রশস্ত হয়। ক্রমেই কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য বিবিধ কিশোর সাহিত্যপত্রিকাগুলির প্রধান তুরুপের তাস হয়ে ওঠে; গড়ে ওঠে ‘আশ্চর্য্য‘র মতো পত্রিকা, যা শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞান এবং বিদেশী সাইন্স ফিকশনের অনুবাদের উপর ভিত্তি করে খুব অল্প সময়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের এই পর্যায়ক্রমিক বিকাশ ও তার পিছনে ঘটে চলা সামাজিক- রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলিকে সংহত করার চেষ্টা করেছি প্রথম পর্বে।
প্রসঙ্গত, বাংলায় প্রথম প্রজন্মের কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের বিকাশকালেই সমান্তরালভাবে কথাসাহিত্যের আরেক ধারার আগমন ঘটে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর আপাত নিস্তরঙ্গ পল্লীজীবনের স্মৃতি আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে জন্ম হয় ‘তারানাথ তান্ত্রিকে‘র। তারানাথ কলকাতা শহরতলীর এক মামুলি গণৎকার, কিন্তু তার অলীক কথনভঙ্গিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে তন্ত্র-মন্ত্র সহ গ্রামজীবনের অভ্যস্ত লোকাচারসমূহ-তন্ত্রসাধনাকে পটভূমিকায় রেখে ‘শুভ-অশুভ‘র দ্বন্দ্ব গল্পে আলাদা মাত্রা যোগ করে। তারানাথ তান্ত্রিকের সেই ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে অধুনা বাংলা সাহিত্যে ‘folk horror’ এর বিবর্তন এবং পূর্বকথিত ‘method’ এর সাথে তার কোনো সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য আছে কিনা- সেই নিয়েই আলোচনা জারি থাকবে পরবর্তী পর্বে ।
প্রথম পর্ব:
কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য : কি এবং কেন
স্বাধীনতাপূর্ব ভারতবর্ষের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার মূল অনুপ্রেরণা/উপাদান ছিল ইউরোপীয় বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারের ভিত তৈরী করা শিক্ষামূলক বইগুলি। ভারতীয় ভূখণ্ডে বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় তার অনুবাদ তৈরী হয়। বিজ্ঞানচর্চার জনভিত্তি প্রসারের এটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ – শিক্ষামূলক। এই ধাপের অধীনে ইউরোপে প্রচলিত বিভিন্ন স্কুলকেন্দ্রিক বিজ্ঞানশিক্ষার ‘টেক্সট’ বাংলা, হিন্দি এবং উর্দু তে অনুবাদ হতে থাকে। এর সবথেকে ভালো উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে ‘মে’স এরিথমেটিক’ বইটি, যার আত্মপ্রকাশ ১৮২০-২১ নাগাদ। এই বইটি এখনো বিবিধ নামে এবং বিভিন্ন মুদ্রণে কলেজস্ট্রিটে সহজলভ্য।
পরাধীন ভারতবর্ষে নিরবচ্ছিন্ন বিজ্ঞানচর্চার সূচনা ঘটেছিল এই ‘মে’স এরিথমেটিক’ বইটির হাত ধরেই এবং একপ্রকার এও বলা যেতে পারে যে আমাদের দেশে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার এটাই ছিল প্রথম ধাপ।
বাংলাতে তো বটেই – এমনকি ভারতীয় ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার দ্বিতীয় ধাপ বলতে আমাদের অবশ্যই বিভিন্ন ‘বৈজ্ঞানিক সংঘ’র (সাইন্স ক্লাব/সোসাইটি) কথা মনে আসবে। এভাবেই বাংলায় জনবিজ্ঞান আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। ‘উৎসমানুষ’ পত্রিকায় ‘বিজ্ঞান আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ শীর্ষক লেখায় সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় বিজ্ঞান-ক্লাবের সৃষ্টির ইতিহাস সম্বন্ধে বলেন যে : “যেকোনো মানুষের সত্তার সাধারণত তিনটি রূপ : ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক। এই সামাজিক সত্তার জন্যেই মানুষ বিভিন্ন সংঘ গড়ে তোলে …”। ১৮৩০-র দশক ছিল এই ‘বৈজ্ঞানিক সংঘ’ বা সমিতিগুলির বিজ্ঞানের সামাজিক মনন তৈরির শুরু। ১৮৩০-৪০ এর দশকে ‘ইয়ং বেঙ্গলে’র ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠে ‘একাডেমিক এসোসিয়েশন’, ‘সোসাইটি ফর দ্য একুইজিসন অফ জেনারেল নলেজ’ এবং ‘সোসাইটি ফর ট্রান্সলেটিং ইউরোপিয়ান সাইন্স’। প্রথম দুটি ক্লাবের মূল দর্শন ছিল বৈজ্ঞানিক চেতনা সৃষ্টিতে সাহায্য করা ; দৈবের প্রতি অনুরক্ত না হয়ে, বিজ্ঞানমনস্ক আর যুক্তিপূর্ণ বিচারক্ষমতার উন্মেষ ঘটানোই ছিল এই সভাসমিতির প্রধান কাজ। অন্যদিকে তৃতীয় ‘এসোসিয়েশন’টি বৈজ্ঞানিক চিন্তার জনভিত্তির প্রসার ঘটিয়ে ছিল মূলত অনুবাদ সাহিত্য এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মধ্য দিয়ে। পরাধীন ভারতে আঞ্চলিক ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে এই বৈজ্ঞানিক ‘সভা-সমিতির’ অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
বৈজ্ঞানিক ‘সভার’ জনপ্রিয়তা এবং তৎকালীন শিক্ষিত সমাজে বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান আবেদন – এই দুইয়ের যুগ্ম প্রভাবে বিজ্ঞানমূলক সাহিত্যের নতুন একটি ধারা সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানমূলক সাহিত্যের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞানমনস্ক চেতনার সাথে সাহিত্যের নান্দনিকতার মিশ্রণ ঘটিয়ে জাগতিক বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রতি জনসাধারণকে চিন্তাশীল করে তোলা। কঠোর বৈজ্ঞানিক শিক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা সাহিত্যে জায়গা করে দিতে লাগল বিজ্ঞানের প্রতি মনুষ্যত্বের ভবিষ্যৎচিন্তাকে। পাশ্চাত্য ‘সাইন্স ফিক্শন’এর সাথে এহেন বিজ্ঞানমূলক সাহিত্যের ফারাকটুকু ছিল মৌলিক: ‘ভবিষ্যৎ’দর্শী লেখন ‘সাইন্স ফিক্শন’ এর একটি দিক হলেও তার প্রধান উৎকর্ষতা ছিল বৈজ্ঞানিক সত্যের ভিত্তিতে সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উত্থান ঘটানো। এর উদাহরণ হিসেবে প্রথম পর্যায়ের বৈজ্ঞানিক সাহিত্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যেমন: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “বিজ্ঞান রহস্য”, জগদানন্দ রায়ের “শুক্র ভ্রমণ”, হেমলাল দত্তের লেখা ‘রহস্য’ (যা ১৮৮২ সাল নাগাদ অটোমেটিক ডোরবেল বা চোর ধরার এলার্মের কথা বলে ) এবং আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসুর ‘পলাতক তুফান’। প্রত্যেকটি উদাহরণের ক্ষেত্রেই, একটি স্থায়ী বৈজ্ঞানিক চিন্তার উপস্থিতি সবিশেষ লক্ষণীয়, যেমন বঙ্কিমচন্দ্র ‘বিজ্ঞান রহস্য’ লেখায় আন্তর্জাগতিক অভিযানে ব্যয়িত সময় নিয়ে কথা বলেন, জগদীশ চন্দ্র বসু কথা বলেন পরাধীন ভারতবর্ষে আবহাওয়া দফতরের খামখেয়ালি আর অবৈজ্ঞানিক মনোভাব নিয়ে।
বাংলাভাষায় বিজ্ঞানমূলক সাহিত্যের সাথে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যকে সমগোত্রীয় ভাবার অভ্যেসের সূত্রপাত স্বাধীনোত্তর ভারতীয় সাহিত্যের গবেষণার অন্দরে। বাংলা বিজ্ঞানমূলক সাহিত্যের গর্ভ থেকেই কল্পবিজ্ঞান চিন্তার উদ্ভব ও বিন্যাস একথা স্বীকার করলেও, আমাদের আদপেই বোঝা দরকার যে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য জন্মকাল থেকেই স্বাধীন ভারতবর্ষের বৈজ্ঞানিক চিন্তা এবং ভারতীয় রাজনীতির প্রতি সমভাবে ঋণী। তাই এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে যে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য তার জন্মক্ষণ থেকেই বিজ্ঞানের রাজনৈতিক সম্ভাবনার প্রতি গভীর ভাবে চিন্তাশীল। এহেন কারণেই কল্পবিজ্ঞান কথাটিকে সাবলীল ভাবে ‘সাইন্স ফিক্শন’ হিসেবে অনুবাদ করলে, তার মধ্যে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত প্রজাতন্ত্রে বিজ্ঞানের প্রতি আস্থার জায়গাটুকু স্বতঃস্ফূর্ত মূল্যায়ন পায় না। এর কারণ মূলত দুটি: প্রথমত বিজ্ঞানমূলক সাহিত্যের (পরাধীন ভারতে সৃষ্ট বিজ্ঞানমূলক লেখা ) প্রাথমিক চিন্তা ছিল শিশু-কিশোর-বয়স্কদের মধ্যে বিজ্ঞানচিন্তা এবং বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডের প্রতি আস্থা তৈরী করা। অন্যদিকে ঐতিহাসিক কারণেই কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য বৈজ্ঞানিক চিন্তা এবং মননকে সর্বতোভাবে সদ্য স্বাধীন চেতনার সাথে বেঁধে বিজ্ঞানমনস্কতাকে একরকম সর্বগ্রাসী রূপ দিতে সক্ষম হয়। এর ফলে প্রথম ধারার বিজ্ঞানমূলক সাহিত্যের মতো কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য নিছক বিজ্ঞানের প্রসারের দিকে না এগিয়ে চেতনাকে বৈজ্ঞানিক-অনুসন্ধিৎসা ও যুক্তিসম্পন্ন (scientific rationalism) করে তুলতে লাগল। ঠিক এই কারণেই কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে গোড়া থেকেই ভবিষ্যতধর্মিতার বদলে বর্তমান সময়ের কথা (real -time narratives) উঠে আসতে শুরু করে। সুতরাং লেখা চলতে লাগলো দু-দশক আগে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপে নিও-নাৎসিদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে অথবা নতুন নতুন মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন এর হাতে স্বাধীন বৈজ্ঞানিকদের শোচনীয় পরিসমাপ্তির কথা নিয়ে। উল্লেখ্য যে, পরবর্তী প্রজন্মের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে মাল্টিন্যাশনালের হস্তক্ষেপ এবং কর্পোরেট সংগঠনের রমরমা নিয়ে সেই সময়ে প্রথম চিন্তিত হয়েছিল কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যই: অনীশ দেব এবং অমিতানন্দ দাস সম্পাদিত ‘আশ্চর্য্য’ সাময়িকপত্রের প্রথম পর্যায়ের লেখা সেইদিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার পূর্ববর্তী বিজ্ঞানমূলক সাহিত্যের বুনিয়াদি শিক্ষামূলক (pedagogy) লেখনীর লেশমাত্র কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে বিদ্যমান ছিল না; কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য এই আপাত অভাবের ওপর ভিত্তি করেই শিশু-কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাবলীল ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছিলো। কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যকে তাই নিছক বিজ্ঞানমূলক সাহিত্যের সঙ্গে একই গোত্রবদ্ধ করলে আমরা একটি ঐতিহাসিক বিচ্যুতির সৃষ্টি করি। যদি বিজ্ঞানমূলক সাহিত্যের বাংলায় জন্ম হয় বিজ্ঞানের প্রচারের আলোকে জনসাধারণের চেতনাকে আলোকিত করতে, তবে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের মূলধনটুকুর সাথে তার সমষ্টিগত মিল থেকে থাকলেও আমাদের বুঝতে হবে যে দুটি ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক উপজীব্যগুলি ছিল ভিন্ন। কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা বহুলাংশে জওহরলাল নেহরুর ‘সাইন্টিফিক টেম্পার’( বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি)-এর সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
বাংলায় কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কান্ডারী, সাহিত্যিক এবং অনুবাদক, অদ্রীশ বর্ধন নিজেই স্বীকার করেছেন যে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য কঠোর বিজ্ঞানের অনুপ্রাসে সৃষ্ট নয় বরং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার বাস্তব প্রাসঙ্গিকতা এবং কল্পনার দ্বারা সযত্নে লালিত। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানকে সাহিত্যের পরিপন্থী হিসেবে স্বীকার না করলেও অদ্রীশ বর্ধন ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে কল্পবিজ্ঞান শব্দটির মধ্যে কল্পনা শব্দটিকে বিজ্ঞানের চেয়েও বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন; ‘প্রফেসর নাট বল্টু চক্র সংগ্রহ’র ভূমিকায় উনি বলেন: “ভূতের গল্প যেমন ভূতের নয়, ঠিক তেমনি কল্পবিজ্ঞানও বৈজ্ঞানিকদের জন্যে নয় – এই আপ্তবাক্য মাথায় রেখে কল্পবিজ্ঞান রচনায় একনিষ্ঠ হয়েছিলাম ১৯৬৩ সাল থেকে…” । বাস্তবিকভাবে এর দ্বারা একটি সূক্ষ্ম দার্শনিক দ্বন্দ্বের (dialectic) সৃষ্টি হচ্ছে এইভাবে: কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে বিজ্ঞানের চেয়ে কল্পনার প্রাধান্য বেশি অর্থাৎ কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে বিজ্ঞান কল্পনার দ্বারা চালিত। এই দ্বন্দ্বটি আরো গভীরে অনুধাবন করতে পারলে আমরা বুঝতে পারব যে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে কল্পনা কথাটির সাহায্যে সাহিত্যিক অদ্রীশ বর্ধন ‘scientific method’ বা ‘method’ অর্থাৎ নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে একপ্রকার ‘প্রণালী’র কথা বলতে চেয়েছেন। প্রকৃতপ্রস্তাবে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে উনি একটি বৈজ্ঞানিক প্রণালীর কথা তুলে ধরতে চেয়েছেন যার দ্বারা এই গোত্রীয় সাহিত্যের ফ্যান্টাসি কিংবা রূপকথা জাতীয় সাহিত্যে গোত্রান্তর ঘটেনা, উপরন্তু তাকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার ফসল এবং authentic ভাবে ‘বৈজ্ঞানিক’ বলা যেতে পারে! উনি ‘কল্পনা’ শব্দটিকে বিজ্ঞানের এক প্রকার প্রণালী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন, যার সূত্রে তৈরী হয় বৈজ্ঞানিক বিধি দ্বারা আবর্তিত/ বৈজ্ঞানিক বিধিসম্মত কল্পনা বা scientific imagination এর Scientific Imagination শব্দবন্ধে ইঙ্গিত মেলে যে বিজ্ঞানের method বা প্রণালীর দ্বারা কিভাবে ‘কল্পনা’ কথাটির অবিন্যস্ত দিকগুলি আরও পরিমার্জিত হয়ে ওঠে। অদ্রীশ বর্ধনের এই বক্তব্যটির সাথে জহরলাল নেহরুর বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির সংজ্ঞার কিছুটা মিল থাকায় কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য তৎকালীন জাতীয় রাজনীতিপ্রসূত বৈজ্ঞানিক চেতনার হাত ধরে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের অন্তর্গত লেখাগুলি তাই বৈজ্ঞানিক চেতনাসিঞ্চিত সুচিন্তিত প্রণালীর প্রয়োগে লব্ধ একটি ভবিষ্যতের কথা আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দিয়ে যায়। এই ‘প্রয়োগ-লব্ধ’ বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যৎগুলি আদপেই কাল্পনিক নয়, কিন্তু তা কল্পনা সৃষ্ট একটি method এর প্রতি আনুগত্যের কথা বলে। সেই সূত্রেই, কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য কল্পিত প্রণালীর দ্বারা এমন এক ক্যাথার্সিস তৈরী করে যার মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক বিভেদ এবং দ্বৈরথ খেলা করতে থাকে। ঠিক সেইকারণেই, কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য নিছক বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানসৃষ্ট ভবিষ্যতের কথা বলেই ক্ষান্ত হয়না; সে কথা বলে বিজ্ঞানের ইতিহাসের (প্রফেসর শঙ্কুর সুবর্ণ সুযোগ), কথা বলে জাতীয়তাবাদের (স্বর্ণপর্ণী) ও বর্ণ-বিদ্বেষের (সবুজ মানুষ) এমনকি সুপ্ত যৌন আকাঙ্খার, যার থেকে জন্ম হতে পারে বৈজ্ঞানিক এষণার (ময়ূরকন্ঠী জেলি)।
কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের এহেন মৌলিক সমাজবোধ যে নেহরু কথিত সাইন্টিফিক টেম্পার তত্ত্বের থেকে আগত এটা ভেবে নেয়া যেতে পারে। ১৯৬৭ সালে, ‘সোশিওলজি অফ সায়েন্স’ শীর্ষক বক্তৃতাতে scientific temper এর কথা বলতে গিয়ে উনি বলেন –
“The history of science shows that it does not simply better the old. It sometimes upsets the old. It does not merely add new truths to the old ones but sometimes the new truth it discovers disintegrates some part of the old truths and thereby upsets the way of men’s thinking and their way of lives. Science, therefore, does not merely repeat the old in better ways or add to the old but creates something that is new to the world and to human consciousness.”
অতএব নেহরুর বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞানমনস্কতার ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের এক নতুন ধরণের সমাজতাত্ত্বিক চিন্তার দিকনির্দেশ দেয়। তাঁর বিজ্ঞানসম্মত সমাজবোধ স্বাধীনতা-উত্তর বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাকে স্বাধীনতাপূর্ব বিজ্ঞানচেতনার থেকে তফাৎ করতে শেখায়। স্বাধীনতা-উত্তর বিজ্ঞানমনস্ক মনোভাব দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘method’ এর নতুন সংজ্ঞার ওপর যা স্বাধীনতাপূর্ব ইউরোপীয় আলোকায়নের (enlightenment) মুখাপেক্ষী ছিল। যদিও অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন যে নেহরুর সমাজবোধ ছিল ওনার রাষ্ট্র প্রজাতন্ত্রের পরাক্রমের পরিপন্থী এবং উনি ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চাকে সুচারুভাবে সরকারি নীতির নিগড়ে বেঁধে নিতে চেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও এই কথা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হয়না যে নেহরুর এই বৈজ্ঞানিক মনোভাব স্বাধীনোত্তর ভারতের ইতিহাসে প্রগতিশীল সমাজচিন্তার প্রথম রাজনৈতিক নিদর্শন।
কল্পবিজ্ঞান লেখকেরা স্বাভাবিক ভাবেই ‘প্রগতিশীল’ নেহেরুর কথায় অনুপ্রাণিত হলেন। বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্যের জোয়ার এলো। অদ্রীশ বর্ধন (আকাশ সেন ছদ্মনামে) , প্রেমেন্দ্র মিত্রর হাত ধরে শুরু হল ‘বিস্ময়’, ’আশ্চর্য্য’র মতো নতুন কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা, যা অধুনা পিডিএফ-এর যুগেও মোটামুটি সহজলভ্য। এইসময় কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত উন্মাদনার আঁচ পাওয়া যায় আকাশবাণী কলকাতা বেতারকেন্দ্রের ‘সবুজ মানুষ’ বেতার নাটকটি থেকে: কল্পবিজ্ঞান এর তিন প্রাণপুরুষ অদ্রীশ বর্ধন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায়, এবং দিলীপ রায়চৌধুরীকে নিয়ে তৈরী হয়েছিল চারটি বেতার নাটকের একটি সংকলন। (ক্রমশ..)
তথ্যসূত্রঃ
১। বিজ্ঞানের ইতিহাস, সমরেন্দ্রনাথ সেন, ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সাইন্স
২। ‘তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প’: অলৌকিকতা ও পরাবাস্তবতা, দীপায়ন পাল, তবু একলব্য: ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় বিশেষ সংখ্যা
৩। ‘The Conspiracy Against The Human Race : A Contrivance of Horror “, Thomas Ligotti
৪। ‘বিজ্ঞান আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় , উৎস মানুষ পত্রিকা
৫। ‘A Story of Ambivalent Modernization in Bangladesh and West Bengal: The Rise and fall of Elitism in South Asia ‘, Pranob Chatterjee , Peter Lang
*****
প্রচ্ছদ: সুমন মুখার্জী