পরিবেশগত উদ্বাস্তু: বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদে মানুষের ঢেউ- গৌরাঙ্গ নন্দী

সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপ উপজেলার ঢাকি নদীর তীরে বাড়ি ছিল মনোরঞ্জন রায়ের। এলাকার মধ্যে ধনাঢ্য পরিবার হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু আচমকাই ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলায় তাঁর মহা-সর্বনাশ ঘটে। তাঁর বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এক বছরের মধ্যেই চোখের সামনে একটু একটু করে বাড়ি-ঘর, গাছ-গাছালি সহ ষাট বিঘে জমি নদীর সাথে মিশে যায়। তিনি এখন পাশের গ্রাম কামারখোলায় জমি কিনে বাড়ি করেছেন; তবে ছোট ভাইয়ের আবাস হয়েছে চালনায় (দাকোপ উপজেলা সদরে)। তিন ছেলের এক ছেলে থাকেন উপজেলা সদরে, এক ছেলে জেলা সদর খুলনা শহরে এবং আর এক ছেলে থাকেন ভারতের আসাম রাজ্যে।

সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদে মনোরঞ্জন রায়ের মত অসংখ্য গল্প ছড়িয়ে আছে। সামর্থ্য ছিল বলেই তিনি আবারও জমি কিনে কাছেই বাড়ি করতে পেরেছেন; যাঁর সামর্থ্য নেই তিনি কাজ পাওয়া যাবে এমন সুবিধামত জায়গায় চলে গিয়েছেন; তাই সেটি নিকটবর্তী উপজেলা বা জেলা শহর হোক, দেশের যে কোন প্রান্তে হোক অথবা দেশান্তরেই হোক, মানুষ এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে। এটি স্থানান্তর (মাইগ্রেশন), স্থানচ্যুতি (ডিসপ্লেসমেন্ট), না-কি পরিবেশগত উদ্বাস্তু তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে; তবে মানুষ যে এলাকা ছাড়ছে, এটা সত্যি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীতি-নির্ধারণী মহল একথা স্বীকার করতে চায় না, গোলটা বাধে, এখানেই।  

ভৌগোলিক অবস্থান

দুর্যোগে-দুর্ভোগে পড়ে মানুষের স্থানত্যাগ- এই বিষয়টি দেখা হয়েছে সুন্দরবন (বাংলাদেশ অংশ) সংলগ্ন খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কামারখোলা ও সুতারখালি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে গড়ে ওঠা একটি দ্বীপাঞ্চল কে কেন্দ্র করে। এটি বা-পাউবো (বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড)-এর ৩২ নং পোল্ডার। এর চারপাশেই নদী। উত্তরে ঢাকি নদী, পশ্চিমে শিবসা নদী, পূর্বে ভদ্রা এবং দক্ষিণে সুতারখালি (ভদ্রা) নদী। তিন দিকে বসতি; একপাশে সুন্দরবন। এলাকাটি একটি প্লেটের ন্যায়, নদীর ধারে বসতি এলাকা অপেক্ষাকৃত উঁচু, তুলনায় ভিতরকার ভূমি নীচু। ১৯৬০এর দশকে নদী-বাঁধ দিয়ে একটি সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বা পোল্ডার (নদী-বাঁধ, স্লুইস গেইট প্রভৃতি সমন্বয়ে গড়ে ওঠা পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে পোল্ডার বলে। এটি একটি ডাচ শব্দ) গড়ে তোলা হয়। ১৯৮০এর দশকে এই নদী-বাঁধ কেটে নদীর নোনা পানি তুলে বহিরাগতরা চিংড়ি চাষ শুরু করে; পরবর্তীতে স্থানীয়রাও চিংড়ি চাষে সম্পৃক্ত হয়। ২০০৭ সালের দিকে স্থানীয়রা চিংড়ি চাষ ছেড়ে আবারও ধান চাষে ফিরে আসেন। ততোদিনে নোনা পানি তুলতে বারংবার নদী-বাঁধ কাটায় তা দুর্বল হয়ে পড়ে, অন্যদিকে নদীতে জোয়ারের প্রাবল্য দেখা দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘন ঘন সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাসের দাপটে নদী-ভাঙ্গন একটি গুরুতর প্রাকৃতিক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়।

এলাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষেরা

মনোরঞ্জন রায়ের পরিবারে বিপর্যয় শুরু হয় ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় হতে। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা আঘাত হানে। দাকোপের ঢাকি নদীর পাড়ে বাঁধ ছিল, যা ওই ঝড়ের দিনে ভেঙ্গে যায়; যাতে একটি নালা তৈরি হয়। বাঁধের ভাঙ্গনটি যখন ছোট ছিল, তখন কেউই গুরুত্ব দেয়নি। পরে যখন ভাঙন মেরামত করে বাঁধ পুনর্গঠনের  চেষ্টা করা হলো, তখন আর নদীর শ্রোত আটকানো যায়নি। ভাঙন ততদিনে অনেক বড় হয়েছে।  নদীর জোয়ারের প্রবল চাপে সেই নালা ধীরে ধীরে বড় হয়। পানি হু হু করে বিলমুখো প্রবেশ করতে থাকে, আর ভাঙ্গনের স্থান আরও বড় হতে থাকে, যা এক সময়ে বিশাল এক নদীর আকার ধারণ করে। আর এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আশেপাশের জনপদ ভাঙতে শুরু করে। এর ফল হিসেবে ছোট জালিয়াখালি গ্রামটি সম্পূর্ণ নদীগর্ভে চলে গিয়েছে। পাল্টে গেছে খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কামারখোলা ইউনিয়নের মানচিত্র। এর ফলে ছোট জালিয়াখালির মানুষগুলো একেবারে পথে বসেছে। অবশ্য, এখন সেখানে বিশাল এলাকা বাদ দিয়ে বাঁধ (চিত্র-১) দেওয়া হয়েছে। বাদ দেওয়া এলাকাটি এখনও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়, ভাটায় পানি সরে গেলে ভেসে ওঠে।

চিত্র ১ঃ আইলার পরে জালিয়াখালিতে নতুন করে দেওয়া বাঁধের একাংশ।

গ্রামটি গিয়েছে, গ্রামের মানুষগুলোর মধ্যে ২২টি পরিবার এখনও বাঁধের কোণায় বসবাস করে; বাকি সকলেই তাদের সুবিধেমত জায়গায় চলে গিয়েছে। এলাকাবাসীর তথ্যমতে, ছোট জালিয়াখালি গ্রামে ৮০টি পরিবার বসবাস করত। লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০। (চিত্রসমূহ-২)






চিত্রসমূহ-২ঃ জালিয়াখালির নদীভাঙ্গনের কুলে (নদী-বাঁধের বাইরে) ভিটেহারা মানুষের বাস।

মনোরঞ্জন রায় (৭২) জানান, তাঁর বসতবাড়িসহ ফসলের জমি ছিল প্রায় ৬০ বিঘা। তিনি ও তাঁর ভাইয়ের চারটি একতলা পাকা ভবন ছিল। ধানের গোলা ছিল। তাঁর একারই নারকেল গাছ ছিল ৬৫টি। আইলার আঘাতে এলাকা প্লাবিত হলে তাঁর বাড়িঘরও পানিতে ডুবে যায়, তাঁর পরিবারসহ গ্রামটির সকলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাঁধের অক্ষত স্থানে ঠাঁই নেন। 

মনোরঞ্জন রায়

তাঁর বাড়িটি ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। প্রতিদিন একটু একটু করে তাঁর বাড়িটি নদীতে তলিয়ে যেতে থাকে। যতো দিন গেছে ততো তাঁর জমি নদীর পেটে গেছে। চোখের সামনেই তিনি এভাবে তাঁর সম্পদ হারিয়ে যেতে দেখেন। মনোরঞ্জন রায়ের কথায়, ‘চোখের সামনেই আমার বাড়িসহ গোটা গ্রামটি হারায় গেল। মানচিত্র বদলে গেল।’

নদী-বাঁধের বাইরে (নদীর কুলে) বসবাসরতদের খাবার ও পানি রাখার পাত্র

দুর্ভোগে পড়া মানুষেরা জানান, ভাঙ্গনের ওই স্থানে বাঁধ খুবই দুর্বল ছিল। বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য সেখানে বাঁধ কেটে ক্ষত তৈরি করা হয়েছিল। আইলায় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ওই ভাঙ্গা স্থানটি বড় হয়। যা পরে আরও বড় হয়ে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটায়।  আইলায় টিকে থাকা বাঁধের উপর বছরের পর বছর পরিবারগুলো টিকেছিল।

পুনর্বাসনের কোন আশা না দেখে একে একে প্রায় সকলেই স্থান ত্যাগ করেছে। এখানকার অনেকগুলো পরিবার ভারতে চলে গিয়েছে। এদের মধ্যে রণজিৎ রায়, মনোজিৎ রায়, ভূপতি জোদ্দার, ভবেন জোদ্দার, তপন মন্ডল, সুশান্ত মন্ডল, স্বপন মন্ডল, অর্ণব রায় ও পূর্ণিমা মন্ডলের পরিবার অন্যতম। বিপ্লব হালদার ও নিমাই ঢালীর পরিবার ভারতে চলে গিয়েছিল, তবে তারা ফিরে এসেছে।

দাকোপ উপজেলার সর্বশেষ জনবসতি সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগি গ্রাম। এখানে ভদ্রা (সুতারখালি) ও শিবসা নদী মিলিত হয়ে দক্ষিণে সাগরমুখো হয়েছে। নদীর দক্ষিণ পাড়ে সুন্দরবন। উত্তরে মাটির বাঁধ দিয়ে প্রমত্তা ভদ্রা-শিবসাকে আটকে রেখে জনপদ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে। জোয়ারের পানির দাপটে বারবার বাঁধ ভাঙছে। আর বসতি এলাকা কমছে। আইলা আঘাত হানার পর এই ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। জীবনধারণ এখানে কষ্টকর হয়ে পড়েছে। কাজ নেই। ফসল নেই। খাবার পানি নেই। আছে নোনা পানির চিংড়ি চাষ। তাও গুটিকয়েক মানুষ তা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে উপায়হীন মানুষগুলো এলাকা ছাড়ছে। বাড়ছে উদ্বাস্তুর সংখ্যা।

এলাকাবাসী জানান, যার যেমন সুযোগ আছে, সে সেদিকে চলে গেছে। পাশের কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নের রামনগর গ্রামে ২৬টি পরিবার নতুন বসতি গড়ে তুলেছে। তারা ওই নতুন বসতির নাম দিয়েছে ‘অতিথি পাড়া’। এদের সকলেরই বাস ছিল কালাবগিতে। তবে এখানকার পুরুষ সদস্যরা বেশিরভাগ কাজের জন্য এখনও সুন্দরবন বা কালাবগির উপর নির্ভর করে। ভোর হতে না হতেই তারা নৌকা নিয়ে মাছ, চিংড়ি পোনা, কাঁকড়া সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ে। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় ‘অতিথি পাড়া’র বাড়িতে ফেরে।

কামারখোলার ঠাকুরবাড়ি খেয়াঘাট পার হলেই কৈলাশগঞ্জের রামনগর। সামান্য এগোলেই চোখে পড়ে রাস্তার দুই ধারে গড়ে ওঠা ‘অতিথি পাড়া’। এখানে বসতি তৈরি করেছেন কেনা সরদার, মোতালেব মোড়ল, পুলিন মন্ডল, গৌরপদ মন্ডল, নীহার মন্ডল, ললিত চন্দ্র মন্ডলের পরিবার। তাঁদের সবারই বাড়ি ছিল কালাবগিতে। আইলার পর ধীরে ধীরে তাঁরা এখানে এসে বসতি গড়ে তুলেছেন। এখানকার একাধিকজন জানান, কালাবগিতে বাস করার সুযোগ কমে আসছিল। নদী-ভাঙ্গনে এলাকা নদীর পেটে যাচ্ছিল। আইলার পর থেকে ভিটেমাটি আঁকড়ে বেঁচে থাকার কোনো উপায় ছিল না, সে কারণে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। কালাবগির কবির খানসহ চার পরিবারের সদস্যরা এখন বসবাস করেন খুলনা শহরের গল্লামারীর জিরো পয়েন্ট এলাকার কাছে। কবির খান বলেন, ‘কালাবগিতে আমাদের জমিজমা বেশি ছিল না। থাকার জায়গাটুকু ছিল। দিনমজুরি ছিল আয়। আইলার পরে কাজের সংকট দেখা দেয়। বাধ্য হয়ে খুলনা শহরে চলে আসি। এখানে শহরের কাছাকাছি থাকায় কাজ জোগাড়ে সুবিধা হয়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো কাজ পাই, ভালোই আছি।’ এখানকার পরিবারগুলো আর গ্রামে ফিরে যেতে চায় না।

সুতারখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম আছেন খুলনা শহরের বসুপাড়া রহমতপাড়া মসজিদের কাছে। আইলার পর তিনি এখানে চলে আসেন। যখন যে কাজ জোটে তাই করেন। কখনো রাজমিস্ত্রির সহকারী, কখনো দিনমজুরি, কখনো রিকশাও চালান তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘গ্রামে কাজ নেই। এখানে কাজ আছে। ভালো আছি।’

কালাবগির ভূদেব রায়ের পরিবারও এলাকা ছেড়েছে। তিনি এখন একই উপজেলার বাজুয়ায় বসবাস করেন। সুকুমার রায়ের পরিবার এখন কৈলাশগঞ্জের হরিণটানায় বাস করে। উপার্জন গাইন গেছেন বাণিশান্তায়, শ্বশুরবাড়ি এলাকায়। তবে এখানকার বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরিবার ভারতে চলে গেছে। ২০০৯ সালেই আইলার পরপর নির্মল রায়ের পরিবার ভারত চলে যায়। ভবেশ রায়ের পরিবার গেছে ২০১০ সালে। তিনি এখন থাকেন মহারাষ্ট্রে। ওই একই বছরে গেছে অমল রায়, মৃণাল রায় ও প্রকাশ রায়ের পরিবার। অমল ও মৃণাল রায়ের পরিবার থাকে কলকাতা শহরে। প্রকাশ রায়ের পরিবার থাকে বারাসাতের পিয়ালিতে। ২০১২ সালে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে জিতেন্দ্রনাথ রায়, শ্যামল মন্ডল, অমল মন্ডল ও মহাদেব মন্ডলের পরিবার। আইলার পর ভদ্রা-শিবসার প্রবল ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে বুদ্ধিশ্বর গাইন ২০১৩ সালে ভারতে পাড়ি জমান।

সোনাই মল্লিকের বাড়িও ছিল সুতারখালী ইউনিয়নের নলিয়ান গ্রামে। এখন পুরো পরিবার নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন পাহাড়ি জনপদ বান্দরবানে। সোনাই মল্লিকের পরিবারটি আইলার পর খুলনা শহরে চলে যান। কিন্তু কিছুদিন পর জীবন-জীবিকা টিকিয়ে রাখতে চলে যান বান্দরবান। সেখানে পাহাড় কেটে জনবসতি তৈরি করা হয়েছে।

নলিয়ানের কেওড়াতলী গ্রামে নদীর পারে তাঁদের সাজানো-গোছানো ভিটে ছিলে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁদের ভালোই কাটছিল। ছিল গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি সবই। কিন্তু সর্বনাশা আইলা তাঁদের সব কেড়ে নিয়েছে। বসতির জমিটুকুও চলে যায় নদীগর্ভে। খুলনা শহরে গিয়েও দিন কাটানোর মতো স্বাচ্ছন্দ্য তৈরি করতে না পারায় চলে যান বান্দরবান। সেখানে পাহাড়ের ওপর ঘর তৈরি করেছেন। স্বামী ও ছেলে ফার্নিচারের কাজ করেন।

আইলা-পরবর্তী নদীভাঙনে কালাবগী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সালাম ঢালীর (৭০) ভিটেমাটি চলে গেলেও তিনি এলাকা ছাড়েননি। এখনো বাস করেন বাঁধে। কালাবগী বিলে তাঁর ৫০ বিঘা জমি ছিল। কিন্তু আইলার পর একটু একটু করে সব জমিই চলে গেছে নদীগর্ভে। তাঁর অভিযোগ, সরকার অনেক অনুদান দিলেও তিনি কিছুই পাননি।

নলিয়ান গ্রামের বাসিন্দা নগেন্দ্রনাথ ঢালী (৬৫) ও গুনারী বাজার এলাকার আবুল কাশেম গাজীর (৫৫) অবস্থাও তথৈবচ। তাঁরা উভয়ে একসময়ের সচ্ছল কৃষক। উৎপাদিত ধানে তাঁদের বছর চলে যেত। কিন্তু আইলার দাপটে সব কিছু খুইয়ে এখন রাস্তার ওপর বাস করেন। একই অবস্থা কয়রা, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায়ও। কয়রার গাতিরঘেরি গ্রাম, আশাশুনির প্রতাপনগর, শ্যামনগরের গাবুরা ও পদ্মপুকুর হতেও সাম্প্রতিককালে অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়েছেন।






ইয়াশে বাঁধের ভাঙ্গনে ডুবে যাওয়া সুন্দরবন পাড়ের কয়রা উপজেলার গাতির ঘেরী গ্রামের বিধ্বস্ত বাড়ি

ইয়াশে বাঁধের ভাঙ্গন, সামনে বিধ্বস্ত গাতিরঘেরী গ্রাম
নদী-বাঁধের উপর বসতি, গাতিরঘেরী, কয়রা; শাকবেড়িয়া নদীতীরে
রাস্তার উপর বসতি, গাতিরঘেরী

জনপ্রতিনিধিরা কি বলছেন

এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া সম্পর্কে সুতারখালী ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বাসুদেব রায় একটি ব্যাখ্যা দেন। তাঁর মতে, কাজের সুযোগ না থাকা এবং জীবন-জীবিকা চলার উৎস একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ এলাকা ছাড়ছে। কেউ তো আর জন্মভিটা ছেড়ে যেতে চায় না; কিন্তু যাচ্ছে, যেতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি আরো জানান, নোনা পানির দাপট থেকে মুক্ত থাকার জন্য স্বাধীনতার আগেই এখানে মাটির বাঁধ দিয়ে (নদী-বাঁধ বা পোল্ডার) নদীর নোনা পানি আটকানো হয়েছিল। কিন্তু পরে সেই বাঁধ কেটে চিংড়ি চাষ শুরু হলো। আর তিন দশকের অধিক সময় চিংড়ি চাষ করার কারণে এখানকার মাটি ও পানি নোনায় সয়লাব হয়ে যায়।  কোনো গাছপালা নেই। সবজি ফলে না। ধান চাষও মানুষ ঠিকভাবে করতে পারে না। আছে চিংড়ি, আর নদী থেকে চিংড়ির পোনা ধরা। গরিবরা নদী থেকে চিংড়ির পোনা ধরে। চিংড়ি চাষের জন্য নোনা পানি প্রবেশ করানোয় বাঁধের অসংখ্য জায়গায় ছিদ্র করা এবং স্থানে স্থানে কাটার ফলে বাঁধ দুর্বল হয়েছে। এখন সামান্য জোয়ারের পানির তোড়েই তা ভেঙ্গে যায়। আইলার আঘাতে বাঁধ ভেঙে এলাকাটি দুই বছর জলমগ্ন ছিল। ফলে জীবন-জীবিকা টিকিয়ে রাখতে মানুষ এলাকা ছাড়ছে।

দাকোপ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান গৌরপদ বাছাড় বলেন, পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করার জন্য তিনি সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করছেন। কোথাও খাসজমি পাওয়া যায়নি, তাই এদেরকে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি।

তাঁর মতে, আইলার কারণে চারদিকে নদীবেষ্টিত কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে। বাঁধ ভেঙে নদীর নোনা পানিতে দুই বছরেরও বেশি সময় এলাকা ডুবে ছিল। এলাকায় কোনো ফসল ফলেনি। ঘরবাড়ি ধসে যায়। ফলে মানুষজন উপায়হীন হয়ে এলাকা ছাড়তে শুরু করে। যার যেখানে সুবিধা আছে,  সে সেখানেই গেছে। প্রকৃতপক্ষে, এখানে  মানুষের জীবন-জীবিকা টিকিয়ে রাখার সুযোগ তৈরি করা খুবই কঠিন কাজ। রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এই এলাকায় জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের মিছিল ঠেকানো যাবে না। তাঁর কথায়, ‘আইলা-দুর্গত অনেক মানুষ এলাকা ছেড়ে গেছে। তাদের অনেকে যেমন ভারতে গেছে, তেমনি বান্দরবান, রাঙামাটিতেও গেছে। গুটিকয়েক মানুষ এখনও বাঁধের পাড়ে বসবাস করছেন।’

আইলা, আম্ফান, ইয়াশ-এর প্রভাব

ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা ও সাতক্ষীরায় প্রাণ হারান ১৯৩ জন। দুই লাখ ৪৩ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় এবং ৯৭ হাজার একরের আমন ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়। প্রাথমিকভাবে আইলার ক্ষয়ক্ষতি খুবই কম হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর ভয়ংকর প্রভাব পড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসে খুলনার দাকোপ ও কয়রা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ৭১১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়। ১২টি ইউনিয়নের ২২৫টি গ্রাম পুরোপুরি নোনাপানিতে তলিয়ে যায়। ঘরবাড়ি ও পেশা হারিয়ে উপদ্রুত এলাকা থেকে বাস্তুহারা হয়ে পড়ে দুই লাখ ৯৭ হাজার মানুষ। 

২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানে। এর চার দিন আগে ২১ মে উত্তর ভারত মহাসাগরে এই ঘূর্ণিঝড়টির জন্ম হয়। আর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে ২৫ মে আঘাত হানে। আইলা খুলনা ও সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা ছাড়াও পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করে। সরকারি হিসাবে, আইলায় খুলনা জেলার দাকোপ ও কয়রা উপজেলার প্রায় ১৫ হাজার মানুষ বিভিন্ন বেড়িবাঁধে ঝুপড়ি (তাঁবুর মতো ঘর) বেঁধে ঠাঁই নেয়।

২০০৯-র পরে আগত ঘূর্ণিঝড় গুলি যেমন মহসেন, বুলবুল বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় আঘাত করেনি; এমনকি ২০২০-র ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান (উমপুন) এবং ২০২১-র ২৬ মে ইয়াশ-এরও সামান্য আঁচড় পড়ে; এর মূল আঘাতটি ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা রাজ্যে। আম্ফান ও ইয়াশে দাকোপ উপজেলায় কোন ক্ষতি না হলেও খুলনা জেলার কয়রা উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার একাধিক জায়গায় বাঁধ ভেঙ্গে ব্যাপক এলাকা পানিবন্দী হয়ে পড়ে। এসব এলাকা হতেও মানুষ স্থানত্যাগ করছে। তবে কেউ কেউ আবারও এলাকায় ফিরে এসেছে। 

মাইগ্রেশন, ডিসপ্লেসমেন্ট, না-কি এনভায়রনমেন্টাল মাইগ্রেন্ট

ইংরেজি মাইগ্রেশন শব্দটির বাংলা অর্থ এক স্থান বা দেশ বা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অন্য স্থান, দেশ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন (বাংলা একাডেমি, ইংরেজি বাংলা অভিধান; পৃং ৪৭৬, ফেব্রুয়ারি ২০০৯)। একে এক কথায় স্থানান্তর বলা যায়। ডিসপ্লেসমেন্ট শব্দটির বাংলা অর্থ স্থানচ্যুতি বা স্থানচ্যুতকরণ (প্রগুক্ত, পৃং ২১৭)। মানুষের স্থানান্তর বা হিউম্যান মাইগ্রেশন কথাটি প্রসঙ্গে উইকিপিডিয়া বলছে, এর দ্বারা মানুষের এক স্থান হতে অন্য স্থানে গিয়ে সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে বসবাস বোঝায়। স্থানান্তরের এই বিষয়টি এক দেশ হতে অন্য দেশে হয়ে থাকে; তবে দেশের মধ্যেও স্থানান্তর বা মাইগ্রেশন হয়ে থাকে। সাধারণভাবে ভালো সুযোগ-সুবিধার আশায় মাইগ্রেশন হয়ে থাকে। ডিসপ্লেসমেন্ট শব্দটি মূলত জ্যামিতিতে ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে উদ্ভূত, যা এখন নানা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই আলোচনাতেও ডিসপ্লেসমেন্ট শব্দটি স্থানান্তর বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে বোধ করি এর জন্যে যুতসই শব্দটি হচ্ছে এনভায়রনমেন্টাল মাইগ্রেন্ট। উইকিপিডিয়া এই শব্দ-যুগলের ব্যাখ্যায় বলেছে, আচমকা ও ধীরগতির পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে এক স্থান হতে অন্য স্থানে চলে যেতে বাধ্য হওয়া। আলোচনাটিতে যেসব মানুষের স্থানান্তরের কথা বলা হয়েছে, তারা পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণেই চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাই তাঁরা এনভায়রনমেন্টাল মাইগ্রেন্ট।     

নীতি নির্ধারণীরা কি ভাবছেন

সাধারণভাবে এখনও নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের মানুষেরা স্থানান্তর বা মাইগ্রেশন বিষয়টিকে স্বীকার করতে চান না। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে এ সংক্রান্ত কোন তথ্য-উপাত্ত নেই। এ বিষয়ে খোঁজ-খবর বা অনুসন্ধান করাটাকেও সহজভাবে দেখা হয় না। সব-কিছুতেই কেমন যেন একটি লুকোছাপাভাব। তবে সত্যিটা হচ্ছে, দুর্যোগে-দুর্ভোগে নিরুপায় মানুষগুলো এলাকা ছাড়ছেন। যাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষ যে জায়গাটি তার জন্যে সহজ বিবেচনা করছেন, বিশেষত আয় ও অবস্থানের দিক দিয়ে সুবিধাজনক স্থানকেই স্থায়ী বসবাসের জন্য মানুষ বিবেচনা করছেন। তবে,  ক্লাইমেট মাইগ্রেন্ট-এর বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ে বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘ আয়োজিত বৈঠকসমূহে আলোচিত হয়। দুনিয়া জুড়ে ক্লাইমেট রিফিউজি বা মাইগ্রেন্ট বিষয়টি আলোচিত, চর্চিত। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও এই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং বৈশ্বিক সভায় এ নিয়ে তিনি কথাও বলেছেন। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ আয়োজিত এক উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন,

‘নদীভাঙ্গন, ভূমিধ্বস, ভূমিক্ষয়, বনধ্বংস প্রভৃতি কারণে দশ লক্ষাধিক মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। তারা আমাদের জনবহুল শহরগুলিতে ভীড় করছে।  চিন্তার বিষয় হল যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেলে আমাদের মোট আয়তনের ১৮ শতাংশ ভূমি তলিয়ে যাবে, যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার এগারো শতাংশ মানুষ বসবাস করে।’ (“River bank erosion, landslides, soil degradationand deforestation are causing millions of climate change refugees,” the Prime Minister said. “They are already all over our thickly populated cities. What is alarming being that a metre-rise in sea level would inundate 18 per cent of our land mass, directly impacting 11 per cent of our people.”)

তবে, এটিও ঠিক যে, জলবায়ু উদ্বাস্তু বা পরিবেশ বিপর্যয়গত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরে কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা কার্যক্রম নেই। অবশ্য, সরকারি পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মানিয়ে নেওয়া (অ্যাডাপ্টেশন) এবং ক্ষতিপূরণ (মিটিগেশন)-এর প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক সহায়তায় বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:

গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড-জিসিএফ-এর সহায়তায় মিটিগেশন-এর আওতায় –

  • ‘বস্ত্র ও রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি)-এর বেসরকারি খাতে এনার্জি সেভিং টেকনোলজি ও ইকুইপমেন্ট ব্যবহার উৎসাহিতকরণ (Promoting private sector investment through large scale adaptation of energy saving technologies and equipment for Textile and Readymade Garment (RMG) sectors of Bangladesh).

গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড-জিসিএফ-এর সহায়তায় অ্যাডাপ্টেশন-এর আওতায় –

  • জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহনশীলতা বৃদ্ধি (এক্সটেন্ডেড কমিউনিটি ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রজেক্ট-ফ্লাড (ইসিসিসিপি-ফ্লাড);
  • জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট নোনার সাথে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী বিশেষত: নারীদের বসবাসের সক্ষমতা বৃদ্ধি (Enhancing adaptive capacities of coastal communities, especially women, to cope with climate change indused salinity);
  • জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম অবকাঠামো তৈরি (Climate Resilient Infrastructure Mainstreaming (CRIEM).

এছাড়াও বেসরকারি সংগঠনগুলো (এনজিও) জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানুষকে খাপ খাইয়ে নিতে ছোট ছোট কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে থাকে। অন্যদিকে, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ছাড়াও নদীভাঙন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দুর্যোগ। প্রতিবছর প্রায় ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ হেক্টর জমি নদীভাঙনে হারিয়ে যায়। এতে প্রতি বছর প্রায় এক লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতির পরিমাণ প্রতিবছর ২৫ কোটি ডলার আর ভিটে-মাটি হারানো মানুষেরা শহরমুখী হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন শুরু করতে বাধ্য হয়। বর্তমানে সরকারি অর্থায়নেও বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে; তবুও দু:খজনক হলেও সত্যি, পরিবেশগত বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসনে পরিকল্পিত কোন কার্যক্রম গৃহীত হয়নি।   

পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে বলা হলেও দেশান্তরী হওয়ার বিষয়টি সাধারণভাবে স্বীকার করা হয় না। কর্মসংস্থান ও অন্যান্য সুযোগের কারণে মানুষ উন্নত দেশগুলোয় যায়, সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসও করে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতে বিশেষত: বাংলাদেশ সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশের মানুষের অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে, কেউ কেউ সেখানেও যান। তবে ১৯৪৭ উত্তর কাল হতে এটি একটি রাজনৈতিক ইস্যু। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ গঠিত হওয়ার পর পূর্ব বাংলা (পূর্ব পাকিস্তান) হতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অনেকেই ভারতে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। স্বাধীন বাংলাদেশ হতে ভারতে কেউ যায়, তা স্বীকার করা হয় না। অবশ্য, ভারত সরকার অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে বাংলাভাষীদের পুশব্যাক করানোর মত অমানবিক পদক্ষেপও অতীতে গ্রহণ করেছে। যাতে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বিতর্কও হয়েছে। যেহেতু ১৯৪৭-উত্তর কাল হতে এই দেশান্তরী হওয়াটি একটি রাজনৈতিক ইস্যু, তাই এটি পরিবেশগত ইস্যু হিসেবে কখনও আলোচনায় আসেনি। 

দেশের অভ্যন্তরেও যে মানুষগুলো এক স্থান হতে অন্য স্থানে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, তারা ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন। নিজস্ব ঠিকানা হারিয়ে মানুষগুলো একপ্রকার ঠিকানাহীন হয়ে পড়েন। সম্পদ ও জীবিকা সংস্থান -দুটোরই ক্ষতি হয়। এতে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর জীবিকার সংগ্রাম তথা টিকে থাকার সংগ্রাম প্রধান হয়ে ওঠে। এই দুর্গম পথে চলতে গিয়ে অনেকেই বিপথগামী হন, নারীরা হেনস্থা ও বিপর্যয়ের কবলে পড়েন, আবার অনেককেই বারেবারে স্থান বদল করতে হয়। স্থানান্তরের যে ছবিটি আমরা আগে বর্ণনা করেছি, তাতেও দেখা যায়, অনেকেই কাজের সুযোগ থাকায় দেশের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল হতে একেবারে দক্ষিণ-পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চল – রাঙ্গামাটিতে গিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ভারতে গিয়েছেন, সেখানে কেউ কেউ আছেন; আবার অনেকে ফিরেও এসেছেন। এই টানাপোড়েন প্রধানত বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

শেষের কথা

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দুনিয়াব্যাপী আবহাওয়ার খামখেয়ালী রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি। কয়েকদিন আগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একদিকে আগুন এবং অন্যদিকে বন্যার ভয়াবহ রূপ আমরা দেখলাম। জার্মানিতে বন্যা, অস্ট্রেলিয়ায় ও গ্রীসে দাবানল প্রভৃতির জন্যে জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করা হচ্ছে। অবশ্য, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের উপকূলের দেশগুলোতে ঝড়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব বরাবরই বিদ্যমান। ধনী উন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত কার্বন নি:সরণজনিত কারণে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে, উত্তরের বরফ গলছে, সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে, আগের চেয়ে অনেক বেশী ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছে। উপকূলীয় দেশগুলো সমুদ্রস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  অদূর ভবিষ্যতে উপকূলের অনেক এলাকা ধীরে ধীরে ডুবে যাবে। আর, বিপুল সংখ্যায় মানুষ সম্পদ, বাসস্থান ও কাজ হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে, হবে।

এই উদ্বাস্তু মানুষগুলোর দায় কে নেবে? এটা কি শুধুমাত্রই ভুক্তভোগী দেশ/দেশগুলোর সমস্যা, না-কি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে যে দেশগুলো দায়ী, তারাই আসল দোষী। যদি তাই হয়, তবে ওই দেশগুলোর উপরই এই জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দায়ও বর্তায়। অবশ্য, ধনী-উন্নত দেশগুলো এই দায় এড়িয়ে জলবায়ু দুর্যোগকে মানিয়ে নিতে বা দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা তৈরিতে ঋণ দিতে শুরু করেছে। যা আর এক ধরনের বিনিয়োগ! জলবায়ু-দুর্যোগকে নিয়েও ব্যবসা শুরু হয়েছে।

ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দের ব্যাখ্যা:

ইউনিয়ন পরিষদ: কয়েকটি গ্রাম নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত। স্থানীয় পর্যায়ের সর্বনিম্ন নির্বাচিত ইউনিট। ইউনিয়ন পরিষদে এলাকাবাসী ভোট দিয়ে একজন চেয়ারম্যান, ৯ জন সদস্য (৯টি ওয়ার্ড, ইউনিয়নকে ৯টি অংশে বিভক্ত করা, যার এক একটিকে ওয়ার্ড বলা হয়) এবং সংরক্ষিত তিনটি নারী সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন।

উপজেলা: এটি প্রশাসনিক কাঠামোর সর্বনিম্ন স্তর। কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে উপজেলা গঠিত। এর প্রশাসনিক প্রধান উপজেলা নির্বাহী অফিসার। এলাকাবাসীর ভোটে নির্বাচিত হন একজন উপজেলা চেয়ারম্যান, দু’জন ভাইস-চেয়ারম্যান। এটি অনেকটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ব্লক-এর মতো।

তথ্যসূত্রঃ

১।https://en.wikipedia.org/wiki/Human_migration

২।https://en.wikipedia.org/wiki/Environmental_migrant

৩।https://news.un.org/en/story/2009/09/314672

৪।https://bn.wikipedia.org/wiki/নদীভাঙন

ছবিঋণঃ লেখক। লেখার ভিতরের ছবিগুলি ২০২১ সালের ১৬ই আগস্ট ও ২০শে আগস্ট তোলা হয়েছে।

*****