একটি বাতিল উপন্যাসের আঠেরো বছর – সরোজ দরবার   

-১-

‘আঠেরো বছর কেটে গেছে। আঠেরোটা বছর। এতদিন পর খেয়াল হল?’ – প্রশ্নটা এরকম হতে পারে। আবার এরকমও হতে পারে যে, ‘আঠেরো বছর কেটে গেছে। এতদিন কারও খবর নেওয়ার কথা মনে পড়ল না। এখন কেন?’ অথবা আর-একটু ঘুরিয়ে এভাবে প্রশ্নটা করা যায় যে, ‘আঠেরো বছর কেটে গেছে। তবু সেই মনে করে ফিরে আসতে হল তো? না এসে কি পারলে?’

প্রশ্নটা যে কোনও রকম হতে পারে। তাতে সত্যিটা বদলায় না। অর্থাৎ প্রশ্নের ভিতর যে কথাগুলো লুকিয়ে আছে, সেগুলো মোটের উপর একই থাকবে। প্রশ্নটা তবু করে উঠতে পারা যাবে কি-না কে জানে! আর গেলেও তা কতটা সঙ্গত!

বসে বসে ভাবছিলেন অনন্য।

গত আঠেরো বছর তিনি এই নিয়ে একটা কথাও বলেননি। কোনও প্রশ্ন করেননি। সাল-তারিখের হিসেব রাখেননি। একটা লেখাও লেখেননি আর। প্রথম প্রথম কিছুদিন বন্ধুবান্ধবদের কয়েকজন খোঁজ নিয়েছিল, ব্যক্তিগত স্তরের খোঁজখবর, কিছুটা লেখালিখিরও; তারপর সব বন্ধ। যেন নিয়ম হয়ে গেল যে, অনন্যর সঙ্গে লেখালিখির আর সম্পর্ক নেই। টানা আঠেরো বছর এই চলছে।

আশ্চর্য শুধু এই যে, অনন্য এখনও বেঁচে আছেন। মরে তো যাননি। ছোটবেলায়, লেখালিখির গোড়ার দিকে, অনেকের থেকে শুনে শুনে, অনন্যরও বিশ্বাস ছিল যে, যিনি লেখেন, তিনি লেখা ছাড়া বাঁচতে পারেন না। অনন্য এখন জানেন, মানুষ বিস্তর ভুল জানা নিয়েই ক্রমশ বড় হয়ে ওঠে।

একটা কাজ চালানো চাকরি তো ছিলই। সংসারটা চলে গেছে দিব্যি। ফলে কোথাও কোনও দিন তাঁর বেঁচে-থাকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। নইলে পিছু ফিরে অনন্য দেখেন, এই বেঁচে থাকা তাঁর প্রাপ্য ছিল না। এমন নিষ্ফলা বেঁচে থাকা! অনন্যর মনে পড়ে পৈতৃক বাঁজা জমির কথা। সেই কতদিন আগের কথা, কী করে যেন আজও স্মৃতিতে থেকে গিয়েছে। অথচ কত প্রিয় মুখ, কত প্রিয় মুহূর্তের কথা আজ আর মনেও পড়ে না। যাই হোক, সেই জমি একদিনের সিদ্ধান্তে বেচে দিয়েছিলেন অনন্যর ঠাকুদ্দা। যে-জমি ফসল দেয় না তাকে রেখে কী লাভ! জমি, গাছ, জীবন- নিষ্ফলা মানেই মৃত। অনন্য ভাবেন, যদি তিনি গাছ হতেন, ধরা যাক কোনও আম কি জামরুল গাছ, তাহলে আঠেরো বছর এমন নিষ্ফল হয়ে বেঁচে থাকতে পারতেন! পারতেন না নিশ্চিতই। মানুষ কবেই সে গাছ কেটে ফেলত। পৃথিবীর প্রায় সবকিছুর উপরই মানুষের জোর বেশি। জোর না বলে জুলুম বলাই ভালো। সেই জুলমেরই একটা দিক হল ব্যাপক চাহিদা বা প্রত্যাশা। তুমি জমি হও বা গাছ – হয় নিয়মিত ফল দাও, নইলে বাতিল। এই হল মানুষের চাহিদা এবং তার নিরিখে রূপ নেওয়া সিদ্ধান্ত। মানুষ, যেহেতু নিজেই নিজেকে ক্ষমতা-কাঠামোর শীর্ষে বসিয়ে রেখেছে, তাই যে কোনও কিছুকে অনুমোদন বা বাতিলের সিদ্ধান্ত সে অনায়াসে নিতে পারে।

অবশ্য মানুষ তো মানুষকেও বাতিল করে দেয়। সেখানে একজন মানুষ আর একজনের থেকে উঁচুতে থাকে। বাকি সব একই। একই জোর জুলুম এবং চাহিদা। উঁচু মানুষ রাতারাতি যে-কোনও মানুষকে খাটো প্রতিপন্ন করতে পারে। তারপর চাকরি থেকে, সম্পর্ক থেকে, বাতিল করে দিতে থাকে। মানুষে মানুষে অদ্ভুত কাটাকুটি খেলা, রক্তপাতহীন তবু নিষ্ঠুর রকমের নিষ্ঠুর।

 যদি একে একরকমের বাতিলতন্ত্র বলা যায়, তবে দেখা যাবে এর একটা সাধারণ নকশা আন্দাজ করা যায়। বড়র দ্বারা ছোটর বাতিল হয়ে যাওয়া, ক্ষমতার দ্বারা ক্ষমতাহীনের বাতিল হওয়া- যেমনটা অনন্য এতক্ষণ ভাবছিলেন। কিন্তু ওই নকশাখানাই আবার বড্ড জটিল হয়ে ওঠে যখন তা কোনও একজন, একেবারে একা মানুষের উপর খেলা করে। এই যে বিগত আঠেরোটা বছর, এই বছরগুলোয় কি অনন্য নিজেই নিজেকে ক্রমাগত বাতিল করেছিলেন! তিনি কি চাইলে বাতিল উপন্যাসটি কোথাও প্রকাশ করতে পারতেন না! পারতেন তো! তাহলে করলেন না কেন!

নিজেকে এই খারিজ করার যে সিদ্ধান্ত তা কি তাঁর স্বেচ্ছায় নেওয়া! নাকি চারপাশ জুড়ে তৈরি হওয়া একটা কোনও জাল বাধ্য করেছিল অনন্যকে এই সিদ্ধান্ত নিতে! ভাবনার ঠিক এইখানে এসে অনন্যর সবকিছু যেন কেমন ঘেঁটে যায়! তিনি বুঝতে পারেন না, একজন মানুষের নিজস্বতা বলতে ঠিক কতটুকু বোঝায়! একজন মানুষের বেঁচে-থাকা, গ্রহণ, বর্জন, অর্জন, স্বপ্ন, মৈথুন সব সবকিছু তার একান্ত নিজের! নাকি অন্য কার মর্জিমাফিক চলতে থাকা অনেকটা অংশকেই মানুষ তার নিজের অংশ বলে ভাবতে শুরু করে! বিশ্বাসও করে; নিজের ঠিক কতখানি যে একজন মানুষের নিজস্ব আর কতখানি অন্যের, মানুষ তা কোনোদিন জেনে উঠতে পারে কি! অনন্যর ধারণা কেউ তা জানে না। তাই তিনিও আর হিসাব মেলাতে চান না। শুধু একটা টেলিফোন এসে মনে করিয়ে দিল, প্রশ্নগুলো ওই ভাবে করা গেলেও যেতে পারে। আর হিসাবটা যদি করা হত তবে আসলে তা আঠেরোটা বছরই হতো।

এখন মোবাইলের যুগ। পুরনো ল্যান্ডলাইনটা যে এতদিন রয়েই আছে যেন কারুর খেয়ালই ছিল না। সে-ও কি আঠেরো বছর মুখ বন্ধ করেই ছিল! কে জানে! সেদিন আচমকা বেজে উঠতে সবাই চমকে উঠল! মালতী কী-একটা কাজ করছিলেন, আচমকা শব্দ শুনে অনন্যর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অনন্য চোখের ইশারায় জানালেন তিনি ধরছেন ফোনটা; তারপর রিসিভারটা তুলে মৃদু কণ্ঠে বললেন, হ্যালো। এই ‘হ্যালো’ বলেই তিনি টের পেলেন, বহু বহুদিন পর তিনি এমন করে সম্ভাষণ করলেন। মোবাইল ফোনে নাম দেখে হ্যালো বলার মধ্যে এই অচেনার আহ্বান নেই। এই সম্ভ্রম-কৌতূহলের মেলানো স্বর থাকে না। এখন তো অচেনা বলে কোথাও কিছু নেই। এমনকী ফোনের ওপারের ব্যক্তি যদি পরিচিত না-ও হন, তাও প্রযুক্তি তার নামখানা দেখিয়ে দেবে। কখনও সখনও তাতেই অনেক কিছু বোঝা যায়। কিন্তু ল্যান্ডলাইনে হ্যালো বলতে গিয়ে অনেকদিন পিছনে ফিরে গেলেন অনন্য। এ কেমন অপরিচিত, যে ল্যান্ডলাইনে ফোন করছে! নাকি খুবই পরিচিত কেউ!

আর তারপরেই উঠল সেই বাতিল উপন্যাসের কথা। আঠেরো বছর হল, যা বাতিলের দলে পড়ে আছে।

-২-

কুমুদবাবু বলেছিলেন, উপন্যাসটা লিখবেন মানুষের মনের গহন ছুঁয়ে ছুঁয়ে। একটুও ফাঁক যেন না পড়ে, কেমন! একটা লেখার মতো লেখা চাইছি।

ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলেন অনন্য। কুমুদবাবুর পত্রিকা বেশ নামী। অনন্য লিখছেন অনেকদিন হল। তবে এমন এক পত্রিকার সম্পাদক ডেকে লেখা চাইছেন, সে তো এই প্রথম। ভারি খুশি হয়েছিলেন তিনি মনে মনে। কত জায়গায় পড়েছেন, অমুক সম্পাদক তমুক লেখককে ডেকে বললেন, এই পুজোয় একটা উপন্যাস লিখে দিন তো। এমন কথা তাঁকে কেউ কখনও বলেনি। এই-ই প্রথম।  

কুমুদবাবু সেদিন অনেক কথাই বলছিলেন। বললেন, আপনার কথা আমাকে বলেছে, রবিদা। বলেছে, আপনার কলমে জোর আছে। আর আমি কি বিশ্বাস করি জানেন তো?

অনন্য সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালে কুমুদবাবু ফের বলতে শুরু করেন, বাঙালির কবজিতে চিরকাল ক্ল্যাসিক লেখার জোর আছে!

অনন্য আর কিছু বলেন না। মনে মনে শুধু ‘ক্ল্যাসিক’ শব্দটা বারকয় উচ্চারণ করেন। ক্ল্যাসিক কি এমন বলেকয়ে লেখা যায়! সকালে উঠে কোমরে গামছা বেঁধে বসে বললাম সন্ধেয় একটা ক্ল্যাসিক লিখে শেষ করব। এরকম হয়! কে জানে বাবা! অনন্য শুধু ফিরে এলেন এই কথা ভেবে যে, তাঁকে একটা উপন্যাস লিখতে হবে। আর ফালাফালা করে দেখতে হবে মানুষের মন।

তারপর আঠেরো বছর পার।

সেদিন ফোন করে একটা বাচ্চা ছেলে আচমকা জানতে চাইল সেই উপন্যাসের খবর। কথোপকথন ছিল এরকম –

– অনন্যবাবু, আঠেরো বছর আগে আপনি একটা উপন্যাস লিখেছিলেন…

– কে বলছেন?

– কুমুদবাবু আপনাকে উপন্যাসটা লিখতে বলেছিলেন, কিন্তু শেষমেশ তা ছাপা হয়নি।

– আপনার পরিচয়টা জানাবেন, প্লিজ।

– আমি আপনার সেই উপন্যাসটি ছাপাতে চাইছি।

– কেন?

– বলতে পারেন, ব্যবসাই করতে চাইছি, তবে…

– বলুন

– আপনার উপন্যাসটির কথা আমি শুনেছ, আমার নিজেরও পড়ার ইচ্ছে, আর আমি চাই পাঠক একবার সেটি পড়ুন।

– কোথায় শুনলেন?

– সাহিত্যিক প্রাণকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় আমাকে উপন্যাসটির কথা বলেছেন।

– কিন্তু তিনি তো উপন্যাসটি পড়েননি…

– না মানে, তিনি আপনার লেখার খুব প্রশংসা করছিলেন, আর বলছিলেন যে, আপনার একটা বাতিল উপন্যাস আছে, বাতিল হওয়ার পরই আপনি লেখালিখি ছেড়ে দেন। আমাকে যদি উপন্যাসটা ছাপতে দেন প্লিজ। আমি শুধু ব্যবসার জন্য প্রকাশনা করি না। সত্যিকারের কিছু ভালো লেখা ছাপাতে চাই।

ফোন নামিয়ে রেখেছিলেন অনন্য। কুমুদবাবুও বলেছিলেন, একটা উপন্যাসের মতো উপন্যাস ছাপাতে চাইছি জানেন। জানেনই তো, আমি সব কাজ ব্যবসার জন্য করি না।

আঠেরো বছর পর সেই একই কথা শুনলেন অনন্য। কথারা ঘুরেফিরে আসে। একইরকম হয়ে আসে। কিন্তু কথা হল, তাতে উপন্যাসের কী আর এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়!

সেদিন কুমুদবাবুর থেকে উপন্যাস লেখার প্রস্তাব পেয়ে এক বন্ধুকে ফোন করেছিলেন অনন্য। তিনি অভিনেতা, মঞ্চে দাপিয়ে কাজ করেন। অনন্য জানতে চাইলেন, হ্যাঁরে শিশির, তুই তো মঞ্চে রোজ নতুন নতুন চরিত্র হয়ে উঠিস। সেইসব চরিত্রদের মনের গতিবিধি নিশ্চিত আন্দাজ করতে পারিস! শিশির একটু ভেবে জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ-ও বটে, আবার একটু কিন্তুও আছে। অনন্য অবাক হয়ে বললেন, মানে? শিশির জবাব দেন, এই যে বিভিন্ন মনের অবস্থা, তা প্রকাশ করার জন্য অভিনেতাদের হাতে কতকগুলো চিহ্ন থাকে। যে যত ভাল অভিনেতা সে তত নিখুঁত করে সেই চিহ্ন প্রয়োগ করে। ধর, বিষণ্ণতার চিহ্ন, নিষ্ঠুরতার চিহ্ন, প্রেমের চিহ্ন। প্রতিদিন স্টেজ করতে করতে, সেই চিহ্নের প্রয়োগ একসময় অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তাতে মন বোঝা যায় কি-না জানি না। ধর, চরম কষ্টের মুহূর্তে অভিনয় করছি, সারা শরীর জুড়ে দুঃখের চিহ্ন ভাসছে, এদিকে লোকে যখন তা দেখে হাততালি দিচ্ছে, তখন তো মনে মনে আনন্দই পাচ্ছি। অর্থাৎ, কোনটা যে আমার মন আর কোনটা চরিত্রের মন… কখন যে একসঙ্গে আছে, কখন আলাদা… এই যে একটাই লোক, তবু আলাদা আলাদা থাকাটা…  বুঝলি তো… খুব একটা সোজা না বিষয়টা, একটু জটিল।  

আর দেরি করেননি। বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল মাথায়। একটা অন্য পৃথিবী যেন দেখতে পাচ্ছিলেন অনন্য। সেদিন থেকেই লেখাটা লিখতে শুরু করেছিলেন। তারপর সেই উপন্যাস যখন নিয়ে গেলেন কুমুদবাবুর কাছে, তিনি সানন্দে পাণ্ডুলিপি নিলেন। বললেন, কটা দিন সময় দিন, পড়ে দেখি।

তারপর একদিন ফোন এল। কুমুদবাবুর উত্তেজিত গলা। এ কী করেছেন মশাই? – কেন কী করলাম?

– কোনও চরিত্রের তো মন-ই নেই!

– হ্যাঁ, মানে সেটাই ভেবেছি আর কী!

– দোহাই অনন্য…

– কী হল? পছন্দ হয়নি লেখাটা?

– পছন্দ, অপছন্দের কথা নয়। এ উপন্যাস এখন আমায় ছাপতে বলবেন না কিন্তু।

– সে কী! আপনিই তো লিখতে বললেন!

– হ্যাঁ, তা বলেছিলাম। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি যে আপনি এরকম একটা লেখা লিখবেন।

– আপনিই তো বললেন, মানুষের মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে…

– বলেছিলাম, অনন্য। কিন্তু এ কোন মানুষের কথা লিখেছেন আপনি, আমি তো ভাবতেই পারছি না। আপনার উপন্যাসের মানুষ চাইলে তো তার মনটাকে যন্ত্রের মতো করে ফেলছে! ইচ্ছেমতো মানুষ হাসছে কিংবা কাঁদছে – কিন্তু আসলে একটাও সে মন থেকে সেটা করছে না। আমি তো ভাবতেই পারছি না যে, কী সাংঘাতিক এই যন্ত্র-মনের মানুষরা!

– তা একটু সাংঘাতিক বটে!

– দ্বিতীয় খণ্ডে এসে একটা জায়গায় আপনি যে দেখাচ্ছেন, একজনের কান্না দেখে অন্যজন দুঃখ পাচ্ছে, তাতেও আসলে ক্রন্দনরত মানুষটা গোপনে আনন্দই পাচ্ছে! কী ভয়াবহ, বাপরে! এই উপন্যাস ছাপা হলে, এই পৃথিবীর মানুষের এত দুর্দশা, এত চোখের জল সব যে মেকি প্রতিপন্ন হয়ে যাবে অনন্য। মানুষ মানুষের কষ্টে আর যে পাশে দাঁড়াতে চাইবে না। এ আমি কেমন করে হতে দেব! মানুষ কাকে ভালোবাসবে! মানুষের মন অপর মানুষের মনকে কী করে ছুঁতে পারবে! কী ভয়াবহ ডিসটোপিয়া মশাই! এ উপন্যাস ছাপা হলে তো মানুষের উপর মানুষের বিশ্বাস চলে যাবে!

– কিন্তু এ তো বাস্তব কুমুদবাবু। দস্তয়েভস্কির সেই দাঁত ব্যথা আর তার জেরে একজনের গোঙানির উদাহরণটা মনে করুন। সেখানেও তো ব্যথার গভীর থেকে গভীরে এক ধরনের আরামবোধের কথাই বলা আছে। নাকি? সেই যে- থ্রু হিজ গ্রোনস দ্য সাফারার ইজ এক্সপ্রেসিং হিজ প্লেজার… মনে পড়ছে?

– আরে জানি জানি। এবার নিশ্চয়ই আপনি সেই কথাটা টেনে আনবেন, যে, ম্যান মে এডভান্স স্টিল ফারদার টু দ্য স্টেজ হোয়্যার হি উইল ফাইন্ড প্লেজার ইন ব্লাডশেড।

– ঠিক ধরেছেন। এই কথাটাই বলতে যাচ্ছিলাম।

– শুনুন অনন্য, দস্তয়েভস্কি আমিও একটু আধটু পড়েছি। আমি জানি, মানুষ বড়, বড় বিচিত্র এক প্রাণী। এই আপনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে হচ্ছে, আপনিও বোধহয় একটা যুগান্তকারী উপন্যাস লিখে ফেলেছেন। তবু আমাকে যত মন্দই বলুন না কেন, এই অবিশ্বাসের পৃথিবীর কথা আমি কিছুতেই ছাপতে পারব না!

– সে কী! আপনি তো সম্পাদক হিসেবে একবার তারিফ করছেন লেখাটার, পরক্ষণে আবার নিজেই নিজেকে নাকচ করছেন।

– হয়তো সেটাই করছি। কিন্তু মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো যে পাপ! সেটাও তো অস্বীকার করতে পারছি না।

– কিন্তু কুমুদবাবু, ধরুন এমন একটা দিন এল যে, মানুষ একটা চিহ্ন মাত্র হয়ে দাঁড়াল। আপনি জানেন না, যার সঙ্গে কথা বলছেন, সে কেমন মানুষ। জানেন না তার মন। কেবল যোগাযোগ আর প্রয়োজন মিটছে, দুটো চিহ্ন-মানুষের। ধরুন, দুটো মানুষের যৌনতা হচ্ছে, কিন্তু তারা পরস্পরকে চেনেনই না। একজন অপরজনের যৌনাঙ্গটুকুর ছবি চিনে রেখেছে শুধু, তারপর স্বমেহনে মিটিয়ে নিচ্ছে শরীরের স্বাদ। কোনোদিন যদি উলটো দিকের মানুষটার সঙ্গে দেখা হয়েও যায় সামনাসামনি, তাও তারা পরস্পরকে চিনবে না। এমনকী সত্যি যৌনাঙ্গ আলাদা করে দেখলেও চিনতে পারবে না। কিন্তু একটা চিহ্ন আর একটা যৌনাঙ্গের ছবি যেই জুড়ে যাবে, অমনি দুয়ে মিলে একটা মানুষের ধারণা হয়ে উঠতে পারে। এমন পৃথিবী কি আসতে পারে না?

– কী বলছেন, অনন্য? কেন এমন অদ্ভুত জিনিস আপনি কল্পনা করছেন। আর যদি এমন হয়ও, সে পৃথিবীকে তাহলে পৃথিবী বলা হবেই বা কেন?

– তা আমি জানি না। কী আর বলবেন পৃথিবী ছাড়া! কিন্তু আমার উপন্যাস তো এমন ছিন্ন অঙ্গের মানুষে গিয়েই শেষ হচ্ছে। যার মন নেই। শুধু একান্ন অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা হাত, একটা চোখ, একটা যোনি, একটা স্তন, একটা লিঙ্গ, একটা পা, একটা নাসা… সমগ্র মানুষ বলে কোথাও কিছু নেই। কোনও আন্দোলন নেই, যূথবদ্ধতা নেই। বিচ্ছিন্ন অঙ্গ শুধু নিজের নিজের কাজ করছে। আহার, নিদ্রা, মৈথুন…  মৈথুন, নিদ্রা, আহার। অঙ্গের মন নেই, তার সংকটও নেই। মানুষ তার মনকে যন্ত্র করে ফেলেছিল বলেই তো মানুষকে এমন বিচ্ছিন্ন অঙ্গ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। 

– উপন্যাসের শেষে পৌঁছে আমি তো আঁতকে উঠেছিলাম। ওই পরিণতি দেখেই তো আপনাকে ফোন করছি। ওই ভয়াবহ পৃথিবীকে ছড়িয়ে দিতে বলবেন না। অন্তত আমার দ্বারা সে কাজ হবে না।

– তাই যদি আপনি চান, তবে তো সকলকে সাবধান করতে আপনাকে এই উপন্যাস ছাপতেই হয়।

– না অনন্য, এই অনুরোধটি করবেন না। এই উপন্যাস আপনি রেখে দিন। হয়তো পরে কেউ ছাপবেন, হয়তো কেন, আমি নিশ্চিত…

– রাখুন তো মশাই।

ফোন রেখে দিয়েছিলেন অনন্য। কলমও নামিয়ে রেখেছিলেন। আঠেরো বছর আর হাতে তুলে নেননি।

-৩-

তরুণ প্রকাশক বললেন, আপনাকে একটা মিথ্যে কথা বলেছিলাম ফোনে। আগাম মার্জনা চাইছি। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান অনন্য। প্রকাশক বলেন, প্রাণকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় আপনার তেমন কিছু প্রশংসা করেননি। বরং…

অনন্য হাত তুলে বললেন, জানি আমি। থাক আর বলতে হবে না।

– কিন্তু এটা ঠিক যে, একটা উপন্যাস ছাপা হয়নি বলে আপনি লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেটা উনিই বলেছিলেন। পুরনো ডায়রি খুঁজে আপনার ল্যান্ডলাইন নাম্বার উনিই দিয়েছিলেন।

বেশ ভালো- বলে অনন্য কাঁধ ঝাঁকান। এ সব কথা তাঁকে যে স্পর্শ করে না, তা বুঝিয়ে দেন। তারপর বলেন, আপনি নিশ্চিত যে, উপন্যাসটি ছাপাবেন?

– হ্যাঁ, স্যার। পাণ্ডুলিপি দিন আর কয়েকটা মাস সময় দিন। সামনের বইমেলাতেই…

হুম বলে উঠে দাঁড়ান অনন্য। তারপর বলেন, কুমুদবাবুর মৃত্যুর দিন আমি শ্মশানে গিয়েছিলাম, জানেন। কত লোকের লেখা ছাপিয়েছে লোকটা! কিন্তু কেউ আসেনি। শুধু বাড়ির লোকজন। আর যে লোকটার লেখা ছাপায়নি, মানুষের বিশ্বাসের পৃথিবী ভেঙে যাবে বলে ছাপায়নি, সেই আমি মাত্র গিয়েছিলাম।

তরুণ প্রকাশক বলেন, কুমুদবাবু নমস্য মানুষ, অনেক শুনেছি ওঁর কথা। কিন্তু কাজটা উনি মোটেই ঠিক করেননি। একটা ভাল লেখাকে চেপে দিয়েছিলেন। কী জানি, কোথাও থেকে চাপ এসেছিল কি-না!

অনন্য হাত তুলে তাঁকে থামান। বলেন, আপনি কিছুই বোঝেননি।

তরুণ প্রকাশক একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে যান। অনন্য বলেন, কুমুদবাবুরা পৃথিবী গড়তে চেয়েছিলেন। লেখা ছাপাতেনও সেই বিশ্বাসে। লেখা যে ছাপাননি, তাও সেই একই বিশ্বাসে। আচ্ছা বলুন তো, এই যে বাংলায় এত এত মানুষ এত পত্রিকা বের করলেন সারা জীবন ধরে, সবাই কি নামী লেখক বা সম্পাদক কি বাণিজ্যসফল প্রকাশক হবেন বলে?

অনন্যর প্রশ্নে কী জবাব দেবেন ভেবে পান না প্রকাশক। আবার সেই লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট ইত্যাদি প্রসঙ্গ যে আসতে চলেছে, তা বুঝতে পারছেন তিনি। তাঁকে অবাক করে দিয়ে অনন্য সে সব কিছুই টানলেন না। শুধু বললেন, আসলে একটা সময় ছিল জানেন, অনেক মানুষ একটা নতুন পৃথিবী দেখতে চাইতেন তখন; কিন্তু বললেই তো আর পৃথিবী নতুন হয় না, ওই পত্রিকাটাই হয়ে উঠত তাঁদের পৃথিবী। একটা নতুন সংখ্যা মানে, তাঁরা ভাবতেন কোনও এক নতুন পৃথিবীর দিকে এক কদম এগিয়ে যাওয়া গেল। একটা ভালো পৃথিবী, সত্যিকারের মানুষের পৃথিবী।… বলে একটু চুপ করে থাকেন অনন্য।

তারপর মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বলেন, ছাড়ুন ও কথা। তো যা বলছিলাম, সেই কুমুদবাবু যেদিন মারা গেলেন, সেদিন সবাই ফেসবুকে খুব লিখেছিল ওর কথা- কত ভাল সম্পাদক ইত্যাদি ইত্যাদি – তার অনেকটাই মিথ্যে, জল মেশানো, ভেজাল; আমি সবই দেখেছিলাম।

আপনি কনট্রাডিক্ট করলেন না কেন? প্রকাশকের বালকসুলভ প্রশ্নে হেসে ফেলেন অনন্য। বলেন, কী লাভ! ওইটেই তো বাস্তব পৃথিবী! ধরুন কেউ শিক-কাবাব খেতে খেতে কুমুদবাবুর মৃত্যুতে চমৎকার একখানা দু:খমাখা কবিতা লিখে ফেললেন! এখন আপনি কী বুঝবেন, তিনি শিক-কাবাবের স্বাদে আনন্দিত না মৃত্যু সংবাদে দু:খিত! ধরুন তাঁর কবিতাটাকে বহু লোক তারিফ করল; তাহলে কি তিনি আনন্দ পাবেন নাকি মৃত্যুজনিত দু:খই নিজের হাতে রাখবেন! এক্ষেত্রে কি আমি বলতে পারি না যে, এই মৃত্যুর দুখের ভিতর একরকমের আনন্দ লুকিয়ে আছে! মানুষ সেই আনন্দ পাবে বলেই দুখটাকে সেলিব্রেট করছে! বুঝতে পারছেন তো ধাঁধাটা। আমি এই কথাটাই কুমুদবাবুকে বললাম।

প্রকাশক জানতে চান, আবার কবে বললেন? উনি তো মারা গেছেন।

অনন্য বলেন, সেদিনই তো। সেই শ্মশানে আমি ওঁর কানের কাছে গিয়ে বললাম, পাণ্ডুলিপিটা তো ফেরত অব্দি দিলেন না। কিন্তু পৃথিবীটাকে কি আটকে রাখতে পারলেন কুমুদবাবু? নিজের চোখে তো দেখেই গেলেন, মনহীন একটা পৃথিবী কেমন শুধু অঙ্গ হয়ে বেঁচে আছে! এবার কী বলবেন? আমার প্রশ্ন শুনে কুমুদবাবু আমাকে কী বলেছিলেন জানেন?

এই অব্দি শুনেই উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েন তরুণ প্রকাশক। অস্ফুটে বলেন, মানে পাণ্ডুলিপিটা আপনার কাছে নেই-ই! সে নয় হল, কিন্তু মৃত মানুষ আপনাকে উত্তর দিয়েছিল, তার মানেটা কী!

মনে মনে অনন্যকে তখন উন্মাদ ভাবছেন সেই প্রকাশক, আর অনন্য হাসছেন। বলছেন, কুমুদবাবু সেদিন বলেছিলেন, গোটা পৃথিবীটাই আপনার উপন্যাস হয়ে প্রকাশিত হয়ে গেছে, অনন্য। এর থেকে ভালো করে তো আমি ছাপাতে পারতাম না। ও পাণ্ডুলিপিখানা আমার সঙ্গেই পুড়ে গেল, এই নাহয় ধরে নিন।

তরুণ প্রকাশক বলেন, কোনোভাবে কুমুদবাবুর বাড়ির কারুর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না! যদি পাওয়া যায়!

অনন্য হেসে ফেলেন। তারপর খুব মৃদু স্বরে বলেন, মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনও। আপনি আবারও কিসসু বুঝতে পারলেন না। আপনি আসুন ভাই এবার। প্রকাশিত উপন্যাস আর কতবার ছাপবেন? 

তরুণ প্রকাশক বিভ্রান্ত হয়ে চলে গেলে, আলমারি খুলে আঠেরো বছর আগের পাণ্ডুলিপিখানা বের করে আনেন অনন্য। একবার বাইরের দিকে তাকান, তারপর বলেন, স্যরি কুমুদবাবু, আপনাকে বলা হয়নি, একটা কপি আমার কাছেও ছিল এতদিন। কেমন যেন মায়া পড়ে গিয়েছিল, তাই ফেলতে পারিনি। এই আজ ফেলে দিচ্ছি। পৃথিবীতে এখন নতুন উপন্যাস লেখা হচ্ছে কুমুদবাবু, আপনি যদি দেখতেন! এবারের উপন্যাস কৃত্রিম মানুষের; মানুষকে ঠেলে সরিয়ে দেবে কৃত্রিম মানুষের দল; মানুষকে এবার প্রতিদিন প্রমাণ করতে হবে যে, সে মানুষ! কিন্তু কী করে করবে! তার মনই যে কৃত্রিম হয়ে গেছে অনেকদিন আগে! এবার বোঝো ঠ্যালা! আপনমনে হেসে ওঠেন অনন্য।

অনন্য টের পান, তাঁর চোখের সামনেই পৃথিবী বদলে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। অনন্য বেশ বুঝতে পারেন, বহুদিন হল কাজ শুরু হয়ে গেছে, আগামী আঠারো বছরে লেখা হবে আর-একখানা নতুন উপন্যাস। কে যে তা লিখছে অনন্য জানেন না; কিন্তু এটুকু জানেন চাইলেও কেউ আর সে উপন্যাসকে বাতিল করতে পারবেন না।

প্রচ্ছদঃ অন্তরা ভট্টাচার্য