ফাইনাল ম্যাচ – অভীক সাধু

        কনকপুর উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র সুমন পড়াশুনাতে আহামরি না হলেও খেলাধুলাতে দিব্বি ভালো। বিশেষ করে ফুটবলটা সে বেশ ভালো খেলে। পড়াশুনাতে সাদামাটা রেজাল্ট হবার একটা কারণ হলো স্কুলের বাইরে তার আলাদা করে কোনো প্রাইভেট টিউটর নেই। সুমন অবশ্য নিজেও তার জন্য আলাদা কোচিং আশা করে না। মামাবাড়িতে আশ্রিত হয়ে আর কতটুকুই বা আশা করা যায়! সুমন যে ছেলেবেলাতেই ওর বাবাকে হারিয়েছে।

সুমনের ঠাকুমার কাছে ওর মা ই যেন ওনার ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী! ওর মার জন্যই যেন সুমনের বাবা দুদিনের জ্বরে চলে গেছে অসময়ে। কথায় কথায় সুমনের ঠাকুমা তার মাকে মানসিক নির্যাতন করত। তাই একরকম অনন্যোপায় হয়েই সুমনের মা সুমনকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি কনকপুরে চলে আসে। তাই সুমন মামাবাড়িতে ওর মায়ের সাথে থাকে। সুমনের বাবার পোস্টাপিসে জমানো সামান্য কিছু টাকার এম.আই.এস তার মায়ের একমাত্র সম্বল। অবশ্য সে কটা টাকাও তার ঠাকুমা ছাড়তে চান নি। কিন্তু সুমনের কাকা তাঁর মাকে বোঝান যে ওই কটা টাকা তাঁর বিধবা বৌদিকে একটু হলেও সাহায্য করবে।

তার মামা বা মামী কেউই লোক খারাপ নয় কিন্তু তারা বড়োলোক নয়। মামা প্রাইমারি স্কুলের টিচার আর সামান্য কিছু জমিজমা আছে। সেখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে মামার ছেলে আর মেয়ের পড়ার খরচ করে সুমনের জন্য কি করেই বা তিনি আলাদা টিউটর রাখতে পারেন। সুমনের অবশ্য তা নিয়ে তেমন হেলদোল নেই। সে কিছুটা চুপচাপ – খালি ফুটবল খেলা বিশেষত মোহনবাগানের খেলা থাকলে সে একটু উৎসাহী হয়ে পড়ে। এদিকে সীমান্তের কাছের গ্রাম কনকপুরে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকই বেশি। তাই সুমনকে মাঝে মধ্যেই টিকা টিপ্পনি শুনতে হয়। এছাড়া সে মাঝে মাঝে এর ওর বাড়িতে বসে বিদেশী ফুটবল লীগের খেলা দেখে।

কনকপুর আর নসিপুর – পাশাপাশি দুই গ্রামের মধ্যে সব ব্যাপারেই একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এরা দুর্গাপূজার উদ্বোধন টিভি সিরিয়ালের নায়িকা দিয়ে করলে ওরা খুঁজে পেতে নিয়ে আসে আরেকটা টিভি সিরিয়ালের নায়ককে। এরা কালীপুজোর মেলাতে সার্কাস করলে ওরা কলকাতার মাঝারি মানের যাত্রাদল নিয়ে এসে ভাইফোঁটার দিন যাত্রার আয়োজন করে। সব ব্যাপারেই ছেলেমানুষি প্রতিযোগিতা চলে দুই গ্রামের মধ্যে! তবুও দুই প্রতিবেশী গ্রামের মধ্যে কোথায় যেন একটা পারস্পরিক সম্প্ৰীতিও আছে।

এর মধ্যে কয়েকবছর হলো কনকপুর আর তার চারপাশের কয়েকটা গ্রাম নিয়ে ব্লক থেকে ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এতে নাকি এলাকার মানুষজনের মধ্যে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়। কিন্তু ফুটবল প্রতিযোগিতা চালু হবার পর থেকে নসিপুর একটু অ্যাডভান্টেজ পেয়ে গেছে। ওখানকার দুজন ছেলে বারীন আর সুদেব কলকাতার সেকেন্ড ডিভিশন লিগে খেলে। তাদের সাথে প্র্যাকটিস করে করে নসিপুর ফুটবল টিমটা বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাই শেষ দুবার যারাই ফাইনালে উঠুক তাদের নসিপুর খুব সহজেই হারিয়ে দিয়েছে।

এইবছর কনকপুর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফাইনালে উঠেছে। আর ওদিকে প্রত্যাশা মতোই নসিপুরও ফাইনালে উঠেছে। এটা অন্য কোনো কিছুতে হলে কনকপুরের উত্তেজনার পারদ হতো ঊর্ধ্বমুখী- কিন্তু এই বিষয়ে তারা চুপচাপই আছে। গ্রূপ লিগেই এবার কনকপুর নসিপুরের কাছে ২ গোলে হেরেছে। এগারোজন মিলে বক্সের সামনে ডিফেন্স করে পায়ের জঙ্গল তৈরী করাতে নসিপুর আর ব্যবধান বাড়াতে পারে নি। তাছাড়া সেদিন ডিপ ডিফেন্সে সুমনও ভারী চমৎকার খেলেছিলো! সে দুটো গোললাইন সেভ না করলে ব্যবধান আরো বাড়ে। শেষ খেলাতে ইসলামপুরকে টাইব্রেকারে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে কনকপুর। বাকি দুটোতে কোনোক্রমে এক্সট্রা টাইমের গোলে জয় পেয়ে তারা উঠেছে। ওদিকে নসিপুর চারটে খেলাতে মোট দশ গোল দিয়েছে – আর এখনো পর্যন্ত একটা গোলও হজম করে নি।

সুতরাং নসিপুর ফাইনালে ক্লিয়ার ফেভারিট!

নসিপুরের লোকেরা তো কনকপুরের লোকেদের দেখলেই বলে – তোরা পারলে রেফারির অনুমতি নিয়ে আরো দুতিন জনকে এক্সট্রা ডিফেন্সে নামিয়ে দে! দ্যাখ তাতে যদি আমাদের বারীন আর সুদেবকে আটকাতে পারিস! বলে কেউ কেউ গা জ্বালানো হাসি হাসতে থাকে। কনকপুরের লোকেরা চুপচাপ মুখ বুজে এসব টিপ্পনি সহ্য করে – আর কি করবে!

কনকপুর পঞ্চায়েত প্রধান রাঘববাবু কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নন। উনি এবয়সেও খুব উৎসাহী, যথেষ্ট পড়াশুনা করেন। উনি গ্রামের মাতব্বর আর খেলোয়াড়দের নিয়ে একটা গোপন মিটিং ডাকলেন- “মিশন নসিপুর”। অসিত রাঘবকে বললেন, “দেখো রাঘব, আমাদের গ্রামের ছেলেরা চেষ্টা চরিত্তির করে যে ফাইনালে উঠেছে – সেটাই অনেক। ওদের দুটো ছেলে কলকাতার সেকেন্ড ডিভিশনে খেলে। আরো একজন হয়তো এবার খেলবে। ওদের সঙ্গে আমাদের লোকাল ছেলেরা কিভাবে পারবে?” রাঘব বলে ওঠেন – “তাহলে খেলে দরকার কি? ওয়াকওভার দিয়ে দিলেই হয়!” প্রশান্ত তরুণ ছেলে, উৎসাহী। সে বলে ওঠে – “হারার আগে আমরা কখনো হারবো না – আমি রাঘবদার সাথে একমত। চেষ্টা করেই দেখা যাক না -খেলাতে অঘটন তো ঘটেই!” অনুতোষ বলে ওঠেন – “হ্যাঁ অঘটনের আশাতেই বসে আছি – যদি বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে!” অনুতোষের কথাটা অনেকেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়তে থাকেন। মানববাবু এই টিমটার কোচিং করেন। চুপচাপ লোক, এককালে অফিস লিগে খেলেছেন। খেলা ভালোবাসেন। উনি বললেন -“খেলা মাঠে হয়, কাগজকলমে নয়! আপনারা এইটটিথ্রির ওয়ার্ল্ড কাপ জয়ের কথা ভুলে গেলেন? কে ভেবেছিলো যে বিশ্বসেরা লয়েডের টিমকে কপিলরা হারাতে পারবে? একশো তিরাশি করে অলআউট হবার পরে তো আরোই নয়! তবু তারা হাল ছাড়েনি- শেষ পর্যন্ত প্রবল পরাক্রান্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দিয়েছিলো। সেদিন যদি কপিলরা আপনাদের মতো ভাবতো, তাহলে কি তারা লর্ডসে জিততে পারতো?”

এরকম কথা বার্তার মধ্যে মিটিং শেষ হলো – যদিও অধিকাংশ লোকই নসিপুরের বিরুদ্ধে কনকপুরের জয় আশা করেন না। রাঘব ছেলেদের বললেন রোজ মন দিয়ে প্র্যাকটিস কর তোরা। মানব রোজ ডিফেন্স আঁটোসাঁটো করার প্র্যাকটিস করান ছেলেদের নিয়ে। কিন্তু সুমন চিন্তাতে থাকে। সে ভাবে এইভাবে খালি ডিফেন্স করে নসিপুরের মতো প্রবল শক্তিশালী দলকে বেশিক্ষণ আটকানো যাবে না – একসময় না একসময় ডিফেন্স চাপের মুখে ভেঙে পড়তে বাধ্য। কিন্তু কোনো প্ল্যান তার মাথাতে আসে না!

মাঠের খানিক দূরে পোড়ো মন্দিরের পাশের জমিতে সাপখোপের ভয়ে দিনমানেই তেমন কেউ আসে না। বড়ো কিছু গাছ আর মাটিতে আগাছা বেড়ে উঠে জায়গাটা একটা ছোট জঙ্গল হয়ে গেছে; সুমনের কিন্তু এখানে আসতে খারাপ লাগে না। বেশ চুপচাপ বসে নানা কথা ভাবা যায়। কখনো মন খারাপ হলে সে এখানে এসে বসে থাকে। সেদিনও সে মজা পুকুরটার পাড়ে বসে ভাবছিলো যে কিভাবে নসিপুরের সাথে টক্কর দেয়া যায়। হঠাৎ একটা গলা খাঁকড়ানির শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। সূর্যের আলো কমে এসেছে – আর এই জায়গাটা এতো ঝোপঝাড় যে ভালো করে মুখ দেখা যায় না। সুমন বলে “কে?” একটি লোক বলে ওঠে “নাম বললে কি চিনবে? আমরা এখানকার লোক নই, একটা কাজে এসেছি। সে যাক তুমি তো ফাইনাল ম্যাচের কথা ভাবছিলে – কি তাই না?” সুমন বলে – “কি করে বুঝলেন?” তখন আরেকজন লোক বললো (এর বাংলাটা একটু ভাঙা ভাঙা, ঠিক বাঙালিদের মতো নয়) -“আসলে কি হামরা খেলার মাঠের লোক আছি। এখুন যদিও আর খেলি না। কিন্তু মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে তুমাদের প্র্যাকটিস দেখছিলাম। পালবাবুর তুমার খেলা দেখতে ভালো লাগছিলো। উনি নিজেও তো একসময় ফুটবল খেলতেন – আর ডিফেন্সে ভালোই খেলতেন।” সুমন বলে – “আর আপনি? আপনি কি বাঙালি নন?” যাঁকে উনি পালবাবু বলে সম্বোধন করছিলেন তিনি এবার বললেন -“না। তাও তো এখন মেজর সাব আমাদের সাথে থেকে থেকে ভাঙা ভাঙা বাংলা শিখে গেছেন। উনি হকি খেলতেন। যাক সে কথা। তুমি ডিফেন্সে ভালো খেলেও বেশ কিছু ছোটোখাটো ভুল আমার চোখে ধরা পড়লো। ফাইনালে কিন্তু ছোট ভুলই বড়ো হয়ে দেখা দেবে। তাই মেজরকে নিয়ে তোমার সাথে দেখা করতে এলাম।” এইবার সুমনের একটু বিরক্ত লাগলো। গত কয়েকদিন ধরে চেনা অচেনা লোকের কাছে জ্ঞান শুনতে শুনতে সে তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে। কেউ কেউ হয়তো জীবনে ফুটবলে পা ই দেননি – তবুও জ্ঞান দিতে কসুর করেন না! সুমন বললো – “হুম।” এবার পালবাবু একটু হেসে বললেন “আচ্ছা, তুমি আমার পাশ দিয়ে বল নিয়ে বেরোতে পারবে?” সুমন অবাক হয়ে গেলো। ও এতক্ষণ খেয়াল করেনি পালবাবুর হাতে একটা ফুটবল। পালবাবু সিঁড়ির উপর কিছুটা ফাঁকা জায়গাতে বলটা দুবার ড্রপ করে সুমনকে ডাকলেন। সুমন এমনিতেই বিরক্ত ছিল। সে পালবাবু আর মেজর দুজনকে দেখে ভাবলো যে তারা কলকাতা থেকে এসেছেন – কেননা দুজনেই হাফপ্যান্ট পড়েছেন। এ গ্রামের কোনো লোক সাধারণত এই বয়সে হাফপ্যান্ট পড়ে না। সুমন বিরক্তি সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালো। পালবাবু বেশ বয়স্ক আর মেজরও তাই। সুমন বয়স্ক লোকেদের কথা পছন্দ না হলেও অসম্মান করতে শেখে নি! পালবাবু বলটাকে গড়িয়ে সুমনের দিকে দিলেন। বললেন – “ভাব আমি অপোনেন্টের খেলোয়াড় – স্ট্রাইকার। তুমি গোলের কাছে হঠাৎ বল পেয়েছো – একা। আমাকে কাটিয়ে এগোতে হবে। সুমন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়। কিন্তু পালবাবুকে ক্রস করার সময় বিদ্যুৎগতিতে পালবাবু একটা ট্যাকল করেন। সুমন এই বয়সে ওনার ক্ষিপ্রতা দেখে অবাক হয়ে যায়! সে ছিটকে সরে যায় – বল পালবাবুর পায়ে। পালবাবু বলেন -“এবার তোমার পালা।” এই বলে তিনি বল নিয়ে ড্রিবল করে এগোতে থাকেন। সুমন আগে ওনার ট্যাকল আর এখন ড্রিবল করার ভঙ্গি দেখে বোঝে যে উনি এককালে খেলতেন – এবং ভালোই খেলতেন। সুমনের কাছে এসে পালবাবু অদ্ভুত ভাবে টার্ন করে বলটাকে তার বাঁপাশে ঠেলে আবার ক্ষিপ্রগতিতে ধরে নেন। এতো দ্রুত ঘটনাটা হলো যে সুমন বুঝতেই পারলো না। খালি দেখলো পালবাবু সহজে তাকে ক্রস করে গেলেন! সে দেখে মেজর মিটিমিটি হাসছেন। মেজর বলেন -“পালবাবুর কাছ থেকে বল কাড়া খালি তোমার না – খুব কম আদমির অওকাত আছে । এতে শরমের কিছু নাই! তুমি আমাদের চিনতে পারো নি, না ?” সুমন হতভম্ব হয়ে বলে – “না আপনারা তো এখানকার নয়, চিনবো কি করে?” পালবাবু একটু ম্রিয়মান স্বরে বলেন -“মেজর জার্মানিতে থাকলেই ভালো করতে। ওখানে তো তোমার নামে রাস্তা পর্যন্ত বানাবে বলেছিলো?” মেজর বলে ওঠেন -“রেহনে দিজিয়ে ওহ সারে বাত! সেদিন মনসুরের সাথে আড্ডা হলো ..বললো যে এর পরে লোকে সুনীলকেই পহেচান করবে না ! ক্রিকেটেরই যদি আইসা হাল, তো হামরা তো অনেক দূরের আদমি! হকি আজকাল কোন খেলে?” পালবাবু এবার সুমনের দিয়ে তাকিয়ে বললেন – “আসি।” সুমন হঠাৎ বলে উঠলো – “আমাদের ম্যাচ তো চারদিন পর – রোববার । আপনারা কি কাল পরশু আছেন?” মেজর মাথা নাড়লেন – হ্যাঁ বাচক। সুমন ইতস্তত করে বললো “পালজেঠু আপনি যদি আমাকে একটু গাইড করেন ?” পালবাবু একটু হেসে বলেন -“দু’তিন দিনে কতটুকুই বা হবে? ঠিকাছে কাল পরশু এসো এখানেই – এইসময়ে। আর ভালো কথা – আমাদের কথা কাউকে বলার দরকার নেই। লোকে বলবে তোমরা বাইরে থেকে সাহায্য নিচ্ছ!” সুমন বলে -“না, না – এটা আমাদের মধ্যে থাকবে!” পালবাবু নিচুস্বরে বললেন -“একজন মোহনবাগান যখন বিপদে পড়ে, আরেকজন মোহনবাগানী কি চুপ করে থাকতে পারে?”  সুমন বলে “আমি যে মোহনবাগানকে সাপোর্ট করি সেটা আপনি জানলেন কি করে?” মেজর তখন বলেন -“এক আদমি বলছিলো কি যে সুমন ভালো খেলে লেকিন এটিচুড নেই। যেমন মোহনবাগান কে সাপোর্টার তেমনি সোচ।” সুমন বলে – “লোকটাকে কিরকম দেখতে বলুন তো?” তখন পালবাবু গম্ভীর স্বরে বলে ওঠেন – “সুমন, খেলোয়াড়দের জবাব দেবার জায়গাটা মাঠে। তুমি এখন এসো।” সুমন অবাক হয়ে চলে গেলো। পরের তিন দিনে সন্ধ্যেবেলাতে সুমন তার গোপন প্র্যাকটিস করে পালবাবুর সঙ্গে। কত ছোটোখাটো টেকনিক যে সে তার পালজেঠুর কাছে শেখে তার ইয়ত্তা নেই। সুমন বলে -“আপনি যদি আমাদের কোচিং দিতেন আমরা হয়তো অঘটন ঘটাতেও পারতাম।” পালবাবু বলেন -“অঘটন বলছো কেন? আক্রমণ করা যেমন খেলার অঙ্গ তেমনি ডিফেন্স করতে করতে হঠাৎ কাউন্টার আক্রমণ করে গোল করাও খেলারই অঙ্গ! নিজের আর অপোনেন্টের শক্তি আর দুর্বলতা ঘিরেই স্ট্র্যাটেজি সাজাতে হয়। মনে রেখো মাঠে ওরাও এগারো তোমরাও তাই।” সুমন বলে – “কিন্তু ওরা যে বেশ শক্তিশালী।” পালবাবু বলেন -“তুমি কি জানো ১৯১১ তে মোহনবাগান গোরাদের হারিয়ে শিল্ড জিতেছিল প্রথম ভারতীয় দল হিসাবে? তার আগে কেউ ভাবতেই পারতো না যে গোরাদের ফুটবলে হারানো যায়! তাও আবার এগারোজন ভারতীয় খেলোয়াড়। তার ওপর পক্ষপাতদুষ্ট রেফারি!” সুমন বলে –

“কিন্তু আমি একা কতটা কি করবো?” পালবাবু বলেন -“মানছি এটা একার খেলা নয় – কিন্তু একজন লড়াকু খেলোয়াড় গোটা টিমের মনোভাব বদলে দিতে পারে। মেজরসাব আপনি বলুন না – আপনি স্টিক ম্যাজিক দেখিয়ে কত ম্যাচ জিতিয়েছেন খালি ব্যক্তিগত স্কিলে!” মেজর বললেন -“আরে নেহি জি -হামারা টিমভি সলিড থা! উস ওয়াক্ত ইন্ডিয়া হকিকা বেতাজ বাদশা থা। আপ ম্যারাডোনাকা বাত লিজিয়ে।” যাই হোক এইভাবে খেলার দিন এসে গেলো ।

টানটান উত্তেজনা। সুমন মনটা শান্ত করতে সেই মজা পুকুরের কাছে চলে এলো। কিছুক্ষন বসে থেকে মাঠের পথে যেতে গিয়ে দেখে পালজেঠু আর মেজরসাব দাঁড়িয়ে আছেন। আজ পালজেঠু বহু পুরোনো একটা সবুজ মেরুন জার্সি পড়েছেন। হঠাৎ সুমন জিজ্ঞেস করেন – “আপনি মোহনবাগানে খেলতেন?” পালজেঠু অল্প হেসে মাথা নাড়ান। মেজরসাব তাড়া দিয়ে বলেন – “যা জলদি যা – খেল অভি স্টার্ট হোগা। বাদমে এসব বাতচিত করার অনেক টাইম মিলবে। অল দ্য বেস্ট!”

মাঠে লোক ভেঙে পড়েছে। বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে নাসিপুরের আক্রমণ বন্যার জলের মতো আছড়ে পড়তে থাকে কনকপুরে ডিফেন্সে। কিন্তু আজ সুমন আজ অদম্য, চীনের প্রাচীরের মতো অটল। একের পর এক আক্রমণ দক্ষ ট্যাকলে প্রতিহত করতে থাকে সে। খেলাটা একসময় যেন সুমনের নেতৃত্বে কনকপুর ডিফেন্সের সাথে বারীন সুদেবের নেতৃত্বে নসিপুর অ্যাটাকের মধ্যে হতে থাকে । বল ঘুরতে থাকে কনকপুরের হাফে! সুমন একবার থ্রোইনের জন্য বল নিতে গিয়ে দেখে পালজেঠু আর মেজরসাব দাঁড়িয়ে আছেন। ওদের মুখে চিন্তার ছাপ। কিন্তু সুমনের এতো চেষ্টা বৃথা হলো। বিরতির ঠিক আগে সুদেব জটলা থেকে একটা বল পেয়ে চকিত শট করে, যা বুল্টুর পায়ে লেগে দিক পরিবর্তন করে। গোলকিপার মোসাহারের কিছু করার ছিল না। গোলের পরেই রেফারির বাঁশি বিরতির জন্য বেজে ওঠে। সে টিমের সাথে যেতে গিয়ে দেখে মেজরসাব তাকে ইশারায় ডাকছে। মাঠের পিছনে একটু দূরের একটা ঝোপে পালজেঠু আর মেজরসাব ঢুকে গেলেন। সুমন ক্লান্তভাবে অনুসরণ করলো ওদের। পালজেঠু  বললেন – “খেলাটাকে এবার একটু ছড়িয়ে দে। এগারোজন মিলে ডিফেন্সে করলে আরো গোল খাবি। তোদের ডিফেন্স একলাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সেকন্ড হাফে আর চাপ নিতে পারবে না তোদের ডিফেন্স। উইংয়ের ছেলেদের বল একটু উঠতে – আর তুই বল কেড়ে পাস্ বাড়া।” মেজরসাব বললেন – “কাউন্টার অ্যাটাক স্টার্ট কর, যা, গুড লাক!” 

সুমন ওর টিমের কাছে ফিরতেই মানববাবু বলেন – “কিরে কোথায় বেপাত্তা ছিলি?” রাঘব বলেন “খুব ভালো খেলছিস। আমি ডি.এম সাহেবের কথা শুনছিলাম। তিনি তোর খুব প্রশংসা করছিলেন।” মানব বলে -“এসব কথা ছাড়ুন। এখন ওদের ফোকাস করতে দিন।” সুমন মইনুলকে বলে – “হ্যাঁরে, তোর এক্সট্রা মোজা আছে।” মইনুল  বলে, “দ্যাখ কোণের দিকটাতে- আমি এক্সট্রা মোজা বা জার্সি ওখানেই প্লাস্টিকে রেখে দিয়েছি।” মইনুলের বাবার ব্যবসা হোসিয়ারি হোলসেলের। ওই টিমের জার্সি আর কিট স্পনসর করে। সে প্লাস্টিকে হাত দিয়ে একটা হাঁটু পর্যন্ত লম্বা মেরুন মোজা পায়-একটু পুরোনো যেন! যা হোক আর সময় নেই – সেটাই সে পায়ে গলিয়ে নেয়। আর ওটা পড়তেই গায়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় সুমনের। সে বিকাশ আর মইনুলকে ডেকে বলে -” তোরা উইঙ্গে একটু এগিয়ে থাকে। আমি বল ফেলার চেষ্টা করবো।” মইনুল বলে -“কিন্তু মানবদা যে খালি পলাশ কে ওপরে থাকতে বলেছে।” সুমন বিরক্তস্বরে বলে ওঠে -” আঃ যা বলছি কর।” সুমনের স্বরে এমন একটা কিছু ছিল যে ওরা আর তর্ক করে না। বরং বিকাশ আর মইনুল অবাকভাবে সুমনের দিকে চেয়ে থাকে। চিরকালের চুপচাপ সুমনের যেন হঠাৎ একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে!

সেকন্ড হাফের খেলা ফাস্ট হাফের মতোই হতে থাকে। সময় এগিয়ে যেতে থাকে। কনকপুরের সমর্থকরা ঝিমিয়ে পড়তে থাকে। তারা বুঝে গেছে এই ম্যাচেও গ্রূপ ম্যাচের মতোই হতে চলেছে। ওদিকে নসিপুরের সমর্থকতা হুইসেল, সিটি মেরে উচ্ছাস প্রকাশ করতে থাকে। নসিপুরের ক্রমাগত আক্রমণ বাঁচাতে বাঁচাতে সুমনরা দিশেহারা! হঠাৎ সুমন শুনতে পায় পালজেঠু সাইড লাইনের ধার থেকে চেঁচিয়ে ওকে ধমকের স্বরে বলছেন – “খেলাটাকে ছড়া; ব্রেকে কি বললাম ভুলে গেলি নাকি!” তার পরেই সুমন একটা চমৎকার ট্যাকলে বল কেড়ে নিয়ে ডান দিকে একটা ঠিকানা লেখা পাস্ বাড়ায় মইনুলকে। সুমন নিজেই ওর পাসিংয়ের অ্যাক্যুরেসি দেখে অবাক হয়ে যায়! মইনুল বল নিয়ে তরতর করে উঠতে থাকে । একজন বাদে নসিপুরের সমস্ত ডিফেন্স রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো ধীরে ধীরে উঠে এসেছিলো সুমনদের হাফে। তাই স্রেফ গতিতে মইনুল ঢুকে যায় বিপক্ষ বক্সে – আর এগিয়ে থাকা গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে বল তুলে দেয় গোলে!

সারা মাঠে পিন পড়ার স্তব্ধতা। হঠাৎ কনকপুরের দিক থেকে গর্জন শুরু হয়ে যায়। নসিপুরের দর্শকতা যেন বিহবল। তারা ভাবতেই পারে না একটাও গোল না খাওয়া টিম হঠাৎ ফাইনাল ম্যাচেই গোল খেলো! এর পরেও নসিপুর আক্রমণ শানাতে থাকে আর সুমনরা কখনো ডান বা কখন বাম প্রান্ত দিয়ে কাউন্টার করতে থাকে। খেলা এখন বেশ জমে উঠেছে। খেলার একেবারে শেষ দিকে সুমন নসিপুরের দুজনকে গতিতে ডজ করে মাঝমাঠে এগিয়ে যায়। সে হঠাৎ দেখে নসিপুরের গোলকিপার, হয়তো ভুলবশতই, গোলপোস্ট ছেড়ে খানিকটা এগিয়ে এসেছে । সুমনের মাথার মধ্যে যেন পালজেঠুর কণ্ঠস্বর চেঁচিয়ে ওঠে -“গোলে উঁচু করে শট কর।” সুমন যেন একটা রোবটের মতোই নিখুঁত সোয়ারভিং কিক করে – যেটা উঁচু হয়ে ডিপ করে, পোস্টের কোণ দিয়ে গোলে ঢোকে। এরপর সুমনের আর কিছু মনে নেই। রেফারির ম্যাচ শেষের বাঁশি – টিমের কাঁধে চেপে মাঠ প্রদক্ষিণ করা বা ডি.এমের কাছ থেকে ম্যাচ সেরার পুরস্কার নেওয়া, এমনি বিপক্ষের খেলোয়াড়দের হাত মিলিয়ে যাওয়া ..সবই যেন কিরকম ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে।

আজ রাঘব সবাইকে ডিনারে ডেকেছেন। রাঘবের ছেলে মাধব কলকাতার কলেজে পড়ান। তিনি এমনিতে খেলাধুলাতে খুব একটা উৎসাহী নন। কিন্তু তিনিও আজ খেলা দেখেছেন আর সুমনের উচ্ছসিত প্রশংসা করছেন। সুমন একসময় একটু লজ্জাই পেয়ে গেলো। ও মাধবকে জিজ্ঞেস করলো – “মাধবদা আপনি পাল বলে মোহনবাগানের কোনো খেলোয়াড়ের নাম জানেন?” মাধব বললো -“না রে, ফুটবলের তেমন খবর রাখি না। ক্রিকেট হলে তাও দেখি – তবে আইপিএল।” বলে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলেন। মাধবের মেয়ে টিনা ক্লাস সিক্সে পড়লেও খুব চৌখস। সে বাবার খুলে রাখা ল্যাপটপে কি চালাতে চালাতে বলে – “সুমনদা, গুগল সার্চ করে একজন পাল দেখতে পাচ্ছি। মোহনবাগানের ফেমাস ফুটবলার, কিন্তু তিনি তো অনেকদিন মারা গেছেন! আর তো তেমন কোনো বিখ্যাত পাল মোহনবাগানে ফুটবল খেলেছেন বলে গুগল দেখাচ্ছে না!” সুমন এগিয়ে গিয়ে ল্যাপটপ স্ক্রিনে দেখে গোষ্ঠ পাল বলে একজন পুরোনো দিনের ফুটবলারকে দেখাচ্ছে – যিনি স্বাধীনতার আগে ফুটবল খেলতেন। তিনি চীনের প্রাচীর নামে বিখ্যাত ছিলেন! সুমনের মাথাটা ঘুরে উঠলো যেন। এ কি করে সম্ভব – সে যে এই লোকটাকে পালজেঠু বলে ডেকেছে। হ্যাঁ এই সেই লোক, কোনো ভুল নেই। আজো তো উনি মাঠে এসেছিলেন। তারপর সে ক্ষীণকণ্ঠে টিনাকে বলে – “দেখো তো মেজর সাব বলে কোনো হকি প্লেয়ার ছিলেন কিনা? টিনা বলে – “এটার জন্য গুগল করতে হবে না। হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ মেজর ছিলেন। দেখো ওনার ছবি – বলে ল্যাপটপে টিনা গুগল ইমেজ সার্চ করে ধ্যানচাঁদের ছবি দেখায় । টিনা বলতে থাকে -“অলিম্পিকে ওনার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে হিটলার ওনাকে জার্মানিতে থেকে যেতে বলেছিলেন। আজ জার্মানিতে ওনার নামে একটা স্ট্রিট আছে …” আরো সে কি কি বলে চলে কিন্তু সুমনের মাথাতে আর কিছু ঢোকে না। সে এক ছুটে বেরিয়ে যায়। টিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে!

সুমন মোহগ্রস্তের মতো রাঘবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়োতে থাকে – মাঠ পেরিয়ে সে পোড়ো মন্দিরের পাশের ঝোপে গিয়ে ঢোকে । গলা ফাটিতে ডাকতে থাকে -“পালজেঠু, মেজরসাব” কেউ সাড়া দেয় না। একটা হাওয়া যেন ঘূর্ণির মতো সুমন কে জড়িয়ে ওপরে উঠে যায়। কোথা থেকে একটা অশ্বত্থ পাতা উড়ে এসে তার মাথায় পড়ে – যেন কেউ ওকে আশীর্বাদ করে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই! কাছাকাছি একটা শিয়াল ডেকে ওঠে। ফিরে আসতে গিয়ে সুমন দেখে পুকুরের ভাঙা ঘাটের ধরে কি যেন পড়ে আছে। এটা সেই জায়গা – যেখানে সে প্রথম দেখেছিলো ওঁদেরকে! সে তুলে দেখে – একজোড়া জীর্ণ মেরুন মোজা। এই মোজাই কি সে আজ পড়ে খেলেছিলো সেকেন্ড হাফে? সে মাথায় ঠেকিয়ে মোজা দুটো পকেটে ঢোকায়। গোষ্ঠ পাল খেলা ছাড়ার প্রায় একশো বছর পরে – আজ সুমন বুঝতে পারলো গোষ্ঠ পাল ঠিক কিরকম ফুটবল খেলতেন আর কেনই সাহেবরা তাকে চীনের প্রাচীর বলতো!

প্রচ্ছদঃ অন্তরা ভট্টাচার্য

*****