সূচী
গত শতাব্দীতে এই পৃথিবীতে অর্ধশতাধিক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর ভেতর শতকরা আশি ভাগ গণহত্যার বিচার দূরে থাক, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও মেলেনি। ’৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যা গত শতাব্দীর নৃশংসতম গণহত্যার একটি। প্রায় চল্লিশ বছর পর ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচার আরম্ভ হলেও এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনও সুদূর পরাহত।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে বাংলাদেশে এক নজিরবিহীন গণহত্যা আরম্ভ করে, যা অব্যাহত ছিল মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী নয় মাস। পাকিস্তান সরকার এবং তাদের সমর্থকরা সব সময় এই গণহত্যাকে অস্বীকার করেছে। গণহত্যায় নিহত ৩০ লক্ষের সরকারি পরিসংখ্যান কমিয়ে ৩০ হাজার বলেছে, গণহত্যার দায় থেকে অব্যাহতি লাভের পাশাপাশি আরও গণহত্যা করার জন্য, যা এখন করা হচ্ছে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও সিন্ধ-এ। বাংলাদেশে পাকিস্তানপ্রেমীরা যখনই সুযোগ পেয়েছে ’৭১-এর গণহত্যায় নিহতদের সংখ্যা চ্যালেঞ্জ করে বিচার নিয়ে বিদ্রুপ করেছে।
১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার তেত্রিশতম বার্ষিকী উপলক্ষে জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ইতিহাসে যে সমস্ত গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তি নিহত হয়েছে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যায়। প্রতিবেদনে নিহতের সর্বনিম্ন গণনায় অন্ততপক্ষে ১৫ লক্ষ বলে উল্লেখ করে বলা হয় যে, ১৯৭১ সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার লোক নিহত হয়েছেন। মানব জাতির ইতিহাসে গণহত্যাযজ্ঞের ঘটনাসমূহে দৈনিক গড় নিহতের সংখ্যায় এটি সর্বোচ্চ।
মুক্তিযুদ্ধের পর সোভিয়েত সংবাদ সংস্থা তাস উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় তদন্ত করে মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লক্ষ বলে ঘোষণা করেছে। স্যামুয়েল টটেন সম্পাদিত ‘সেঞ্চুরি অব জেনোসাইড’ গ্রন্থে বাংলাদেশের গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ৩০ লক্ষ বলা হয়েছে। ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ ও ‘কম্পটন্স এনসাইক্লোপেডিয়া’তেও ৩০ লক্ষের কথা বলা হয়েছে। শুধু ’৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ঢাকায় নিহতের সংখ্যা, ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ লিখেছে ১০ হাজার (২৯-৩-৭১) সিডনির ‘মর্ণিং হেরাল্ড’ লিখেছে ১০ হাজার থেকে ১ লক্ষ (২৯.৩.৭১)।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমেরিকার ‘সেন্ট লুইস পোস্ট’-এ (১-৮-৭১) যুক্তরাষ্ট্রের একজন শীর্ষস্থানীয় সরকারী কর্মকর্তার বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোলান্ডে নাৎসীদের গণহত্যার পর এই হত্যাকা- হচ্ছে সবচেয়ে নৃশংস। সরকারী হিসেব অনুযায়ী প্রথম চারমাসে ২ লক্ষ থেকে ৭ লক্ষ বাঙালি নিহত হয়েছে এবং ৬৫ লক্ষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ এর প্রতিনিধি সিডনি শ্যানবার্গকে ৩০ জুন ’৭১ তারিখে ঢাকা থেকে বহিষ্কার করা হয়। নয়া দিল্লী এসে তিনি ঢাকার কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে বলেছেন প্রথম তিন মাসে দুই থেকে আড়াই লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। সেই সময় ঢাকায় অবস্থানরত ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংও মনে করেন ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লক্ষ হতে পারে। (লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, ২৯.৩.৯৭)
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নারী নির্যাতনের সংখ্যা সরকারী হিসেবে ২ লক্ষের বেশি বলা হলেও ’৭২-এর জানুয়ারিতে নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসা সাহায্য দেয়ার জন্য ঢাকায় অবস্থানকারী আন্তর্জাতিক রেডক্রসের চিকিৎসক ডাঃ জিওফ্রে ডেভিসের মতে এই সংখ্যা ৪ লক্ষেরও বেশি। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের গবেষণা থেকে জানা গেছে, ’৭১-এ নির্যাতিত নারীর সংখ্যা ৫ লক্ষাধিক।
গণহত্যায় দেশীয় দোসর
ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তার পক্ষে এই গণহত্যা ও নারী নির্যাতন সম্ভব হয়েছে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের মতো দলের সক্রিয় সহযোগিতার কারণে। জামায়াতে ইসলামী তখন শুধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা নিজেরাও হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠন করেছিল। ’৭১-এ ঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব ছিল তালিকা প্রস্তুত করে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা করা, যে বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিলেন সাবেক বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের মন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী। সেই সময় জামায়াতে ইসলামীর দলীয় মুখপত্র দৈনিক ‘সংগ্রাম’-এ আলবদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী তাঁর ঘাতক বাহিনীকে বাঙালি নিধন এবং বিশেষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘পাকিস্তান ও ইসলামের দুষমন’ এবং ‘ভারতের দালাল’ আখ্যা দিয়ে হত্যার জন্য প্ররোচিত করে বহু নিবন্ধ ও উপসম্পাদকীয় লিখেছেন।
গণহত্যায় দায়ীদের বিচার
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর সমগ্র বাঙালি জাতি আশা করেছিল যারা যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী, যারা ’৭১-এর নয় মাসে গণহত্যা ও নারীনির্যাতন সহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করেছে তাদের বিচার হবে। সেই সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষদের সহানুভূতি জানাবার জন্য বহির্বিশ্ব থেকে যাঁরা এসেছিলেন তারাও বিশেষ ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেছিলেন। বিশ্ব শান্তি পরিষদ প্রতিনিধি দলের নেত্রী মাদাম ইসাবেলা ব্লুম ২০/১/৭২ তারিখে ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে বাঙ্গালী হত্যাযজ্ঞের যে রোমহর্ষক নৃশংসতার স্বাক্ষর আমি দেখেছি তাতে আমি শোকাভিভূত ও সন্ত্রস্ত হয়ে গেছি। এই হত্যাকাণ্ড নাৎসী গ্যাস চেম্বারের হত্যাযজ্ঞের চেয়েও অনেক বীভৎস।’ তিনি দেশে ফিরে গিয়ে পরিষদের সভাপতির কাছ এই গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের দাবী জানাবেন বলে জানান। (আজাদ, ২২/১/৭২)
স্বাধীনতাযুদ্ধের সমর্থক মার্কিন সিনেটের ডেমোক্র্যাট দলীয় সদস্য এ্যাডলাই স্টিভেনসন কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বধ্যভূমিগুলো দেখে এসে ৩০ জানুয়ারি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে পাকবাহিনীর নৃশংসতা ছিল ভয়াবহ এবং মানবজাতির ইতিহাসে তার কোন নজীর নেই। এই বর্বরতা মানুষের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে।’ (আজাদ, ৩১/১/৭২) মার্কিন সিনেটের অপর সদস্য এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন, ‘মানুষের মস্তিষ্কে এ’ধরনের বর্বরতার চিন্তা আসতে পারে এ’কথা ভাবতেও কষ্ট হয়।’ (আজাদ, ১৭/২/৭২)
ফরাসী সাহিত্যিক আঁদ্রে মালরো বলেছিলেন, ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসীদের নৃশংসতার নিদর্শন আমি দেখেছি, কিন্তু এখানকার নৃশংসতা তার চেয়ে অনেক বেশি।’ (আজাদ, ১৩/৩/৭২)
১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই দিন রমনা রেসকোর্স ময়দানে তিনি বলেন, ‘বিশ্বকে মানবেতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক দল এই বর্বরতার তদন্ত করুক এই আমার কামনা।’ (দৈনিক বাংলা, ১১/১/৭২) ১০ জানুয়ারির জনসভাতে তিনি আরও বলেন ‘যারা দালালী করেছে, আমার শত শত দেশবাসীকে হত্যা করেছে, মা বোনকে বেইজ্জতি করছে, তাদের কি করে ক্ষমা করা যায়? তাদের কোন অবস্থাতেই ক্ষমা করা হবে না, বিচার করে তাদের অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে।’
২৬ এপ্রিল তিনি দিল্লী স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যারা গণহত্যা করেছে তাদের এর পরিণতি থেকে রেহাই দেয়া যায় না। এরা আমার ত্রিশ লাখ লোককে হত্যা করেছে। এদের ক্ষমা করলে ভবিষ্যত বংশধরগণ এবং বিশ্বসমাজ আমাদের ক্ষমা করবেন না।’ (দৈনিক বাংলা, ৩০/৪/৭২)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণহত্যা ও বিচার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে (১৯৩৯-১৯৪৫) জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি বাহিনী, ইটালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বাহিনী এবং প্রাচ্যে জেনারেল তোজোর রাজকীয় জাপানি বাহিনীর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের কথা বিশ্ববাসী কখনও ভুলবে না। হিটলারের নাৎসি বাহিনী এবং তাদের সহযোগী গেস্টাপো ও অন্যান্য বাহিনী যেভাবে ইহুদি, কমিউনিস্ট ও অজার্মানদের হত্যা করেছে সভ্যতার ইতিহাসে তার কোনও নজির নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ সালের ১৮ ডিসেম্বর মিত্রশক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘোষণা প্রদান করে। ১৯৪৩ সালে ৩০ অক্টোবর ঐতিহাসিক ‘মস্কো ঘোষণা’ স্বাক্ষরিত হয়। এতে বলা হয়েছে, অক্ষশক্তির যে সব রাজনৈতিক নেতা ও সমর অধিনায়কদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদের গ্রেফতার করে বিচার করা হবে। মস্কো ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৪৫ সালের ৪-১১ ফেব্রুয়ারি ইয়াল্টা কনফারেন্সে মিলিত হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, ইংল্যান্ডের প্রধামন্ত্রী চার্চিল এবং সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্টালিন। এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় বিজয়ের পর মিত্রশক্তি সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে। শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে তিন দেশের পররাষ্ট্র সচিবরা সম্মিলিতভাবে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে ইয়াল্টা সম্মেলনে চার্চিল বলেছিলেন, যুদ্ধজয়ের পর দেরি না করে পরাজিত সব নাৎসি নেতাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে। স্টালিন বলেছিলেন আমাদের দেশে আমরা কাউকে বিচার না করে শাস্তি দিই না। বিরক্ত চার্চিল বলেছিলেন, আমরা বিচার করেই তাদের ফাঁসিতে ঝোলাব।
ইয়াল্টা সম্মেলনের পর মিত্রশক্তি যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা ও প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। তাদের সামনে ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা; প্রয়োজনীয় আইন এবং আন্তরিকতার অভাব ঘটলে কীভাবে যুদ্ধাপরাধীরা বিচার ও শাস্তি থেকে অব্যাহতি লাভ করে। ১৯৪৫ সালের ৮ আগস্ট মিত্রশক্তি ‘লন্ডন চুক্তি’ স্বাক্ষর করে। এতে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে ‘ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইবুনাল’-এ। ট্রাইবুনালের নীতি ও কার্যবিধি এই চুক্তির ভেতর অনুমোদন করা হয়। এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর করেন জাস্টিস এইচ জ্যাকসন, ফ্রান্সের অস্থায়ী সরকারের পক্ষে রবার্ট ফ্যালকো, যুক্তরাজ্য ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের সরকারের পক্ষে জোউইট সি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারের পক্ষে আই নিকিশেঙ্কো ও এ ট্রাইনিন।
এই চুক্তি অনুযায়ী মিত্রশক্তির চারটি দেশ ট্রাইবুনালের জন্য নিজ নিজ দেশের আইনজীবী ও বিচারক নিয়োগ চূড়ান্ত করে। যুক্তরাষ্ট্র ‘আন্তর্জাতিক সামরিক আদালত’ (আইএমটি)-এর প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রবার্ট এইচ জ্যাকসনকে নিয়োগ করে।
নুরেমবার্গ ট্রায়াল
১৯৪৫ এর ২০ নভেম্বর নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালের বিচারিক কার্যক্রম আরম্ভ হয়। এর আগে ১৮-১৯ অক্টোবর মিশ্রশক্তির আইনজীবীরা ‘আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতে’ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২৪ জন শীর্ষস্থানীয় নাৎসি নেতা ও সমরনায়ক এবং ৭টি সংগঠনকে সুপরিকল্পিতভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে ৬৫ পৃষ্ঠার অভিযোগনামা পেশ করেন। বিচার শুরু হওয়ার আগে নাৎসি পার্টির প্রধান হিটলার এবং তার দুই শীর্ষ সহযোগী হিমলার ও গোয়েবলস আত্মহত্যা করার জন্য বিচার থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। অভিযুক্তদের তালিকায় ১ নম্বর আসামী ছিলেন ডেপুটি ফুয়েরার মার্টিন বোরমান। গ্রেফতারের আগেই তিনি আত্মগোপন করেছিলেন।
১৯টি তদন্ত দল অভিযুক্ত নাৎসি নেতাদের দুষ্কর্ম সম্পর্কে তদন্ত করেছেন। নাৎসি সরকারের দলিল, চিঠিপত্র, আলোকচিত্র ও চলাচ্চিত্র সংগ্রহ করা ছাড়াও তারা অনেকগুলো বন্দি নির্যাতন শিবির পরিদর্শন এবং প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি নথিবদ্ধ করেছিলেন।
ব্যক্তির বিচারের পাশাপাশি নুরেমবার্গে ৭টি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের কর্মকান্ড সম্পর্কে তদন্ত ও বিচার হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে : ১) নাৎসি পার্টির নেতৃত্ব, ২) রাইখ সরকারের মন্ত্রীসভা, ৩) এসএস, ৪) গেস্টাপো ৫) এসডি, ৬) এসএ এবং ৭) জার্মান হাই কমান্ড। বিচারে ৪টি সংগঠন দোষী প্রমাণিত হয়েছে এবং রায়ে এদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে বিচারের জন্য ৭টি নীতি বা ধারা প্রণয়ন করা হয়েছিল। ৬ নং ধারায় বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক আইনে যে সব অপরাধ শাস্তিযোগ্য বলে নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, ক) শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, খ) যুদ্ধাপরাধ ও গ) মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এরপর এই তিনটি অপরাধের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এর আগে এত নির্দিষ্টভাবে এই সব অপরাধ আইনশাস্ত্রে বিধিবদ্ধ হয়নি। নুরেমবার্গ নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানও অব্যাহতি পাবেন না। এই নীতিমালার ভিত্তিতেই প্রস্তুত করা হয়েছিল অভিযোগনামা।
নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালের নীতি ও আইন প্রণয়নের সময় মিত্রশক্তির আইনপ্রণয়নকারীদের এ বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হয়েছে, তারা নতুন কোন আইন তৈরি করতে যাচ্ছেন না যা আইনশাস্ত্রে ইতিপূবে বর্ণিত হয়নি। নুরেমবার্গে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ ও ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধে’র বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রথমবারের মতো সূত্রবদ্ধ করা হলেও হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, বাধ্যতামূলক শ্রম, যৌনদাসত্ব, বলপূর্বক বাস্তুচ্যুতি প্রভৃতি বহু আগে থেকেই অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। জাস্টিস জ্যাকসন লন্ডন বৈঠকের শুরুতেই মিত্রশক্তির সহযোগীদের বলেছিলেন, আমরা এমন সব কর্মকান্ডের বিচার করতে যাচ্ছি যা আদিকাল থেকে অপরাধ হিসেবে পরিগণিত এবং প্রতিটি সভ্য দেশে যার বিচার করা হয়।
নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালের নীতি ও কার্যবিধি প্রণয়নের সময় মিত্রপক্ষের আইনজীবীরা সম্ভাব্য সকল চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। জাস্টিস জ্যাকসন তাঁর উদ্বোধনী ও সমাপনী ভাষণে প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য সমালোচনা ও বিরুদ্ধ যুক্তি অত্যন্ত মেধা ও দক্ষতার সঙ্গে খনন করেছেন। একটি সমালোচনা নুরেমবার্গ ট্রাইবুনাল গঠনের সময় থেকে এখন পর্যন্ত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এটি ছিল ‘বিজয়ীর বিচার’ (Victor’s Justice)।
নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালের উদ্বোধনী ভাষণে জাস্টিস জ্যাকসন এ বিষয়ে বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, আদালত গঠন সহ আইনজীবী ও বিচারক সবই নিয়োগ করতে হয়েছে যুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তিকে পরাজিত অক্ষশক্তির অপরাধের বিচারের জন্য। অভিযুক্তদের বিশ্বব্যাপী আগ্রাসনের কারণে সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষ কেউ নেই বললেই চলে, যারা এই বিচারে আগ্রহী হতে পারে। এ ক্ষেত্রে হয় পরাজিতদের বিচার করতে হবে বিজয়ীদের, নয় তো পরাজিতদের অপরাধের বিচারের ভার তাদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়টির অকার্যকারিতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম থেকে।’
অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছিল ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে অভিযুক্তদের আপিলের সুযোগ নেই, এমনকি বিচারকদের সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপনেরও কোন সুযোগ কার্যবিধিতে রাখা হয়নি। এ বিষয়ে অক্সফোর্ডের অধ্যাপক এ এল গুডহার্ট লিখেছেন, ‘তত্ত্বগতভাবে এই যুক্তি আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, তবে তা যে কোন দেশের বিচারব্যবস্থার পরিপন্থী। এই যুক্তি মানতে হলে কোন দেশ গুপ্তচরদের বিচার করতে পারবে না। কারণ যে দেশের আদালতে সেই গুপ্তচরের বিচার হবে সেখানকার বিচারক তার শত্রুদেশের। এ ক্ষেত্রে কেউ নিরপেক্ষতার কথা বলতে পারে না। বন্দি গুপ্তচর বিচারকদের নিকট ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করতে পারে কিন্তু কোন অবস্থায় তাদের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে না। লর্ড রীট যেমন বলেছেন একই নীতি সাধারণ ফৌজদারি আইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। একজন চোর নিশ্চয়ই অভিযোগ করতে পারে না তার বিচার কেন সৎ লোকেরা করছে।
নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে জাস্টিস জ্যাকসনের উদ্বোধনী ভাষণের মতোই আকর্ষণীয় ছিল তাঁর সমাপনী ভাষণ। ১৯৪৫-এর ২৬ জুলাই-এ প্রদত্ত এই ভাষণের উপসংহারে শেকসপীয়রের ‘রিচার্ড দি থার্ড’ নাটকের একটি উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, … অভিযুক্তরা বলছেন তাঁরা হত্যা, হত্যার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের এই দীর্ঘ তালিকায় বর্ণিত অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁরা এই বিচারের সামনে এমনভাবে নিজেদের দাঁড় করিয়েছেন যেভাবে রক্তরঞ্জিত গ্লচেস্টার দাঁড়িয়েছিলেন তার নিহত রাজার লাশের সামনে। এদের মতো গ্লচেস্টারও বিধবা রাণীকে বলেছিলেন, আমি হত্যা করিনি। রাণী জবাবে বলেছিলেন, ‘তাহলে বল তারা নিহত হয়নি, কিন্তু তারা মৃত।’ যদি এদের (অভিযুক্তদের) সম্পর্কে বলা হয় এরা নিরাপরাধ, তাহলে তা এমনই সত্য হবে যুদ্ধ বলে কিছু হয়নি, কেউ নিহত হয়নি, কোন অপরাধের ঘটনাও ঘটেনি।’
অভিযুক্তরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় সকল অপরাধের দায় হিটলার, হিমলার ও গোয়েবলস-এর উপর চাপিয়েছিলেন, যারা জার্মানির আত্মসমর্পণের আগেই বার্লিনে ২৫ ফুট মাটির নিচে বাঙ্কারে সপরিবারে আত্মহত্যা করেছিলেন। এ বিষয়ে ব্রিটেনের প্রধান কৌঁসুলি স্যার হার্টলি শকরস তাঁর সমাপনী বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘কেউ হয়তো অন্যদের চেয়ে বেশি অপরাধ করতে পারে, হতে পারে কেউ অপরাধ সংঘটনে অন্যদের চেয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকায় ছিল। কিন্তু অপরাধ যদি গণহত্যা, দাসত্ব, বিশ্বযুদ্ধ দুই কোটি মানুষের প্রাণহানীর মতো গুরুতর হয়, যদি একটি মহাদেশ ধ্বংসের মতো এবং বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত দুঃখক্লেশ ও বেদনার কারণ হয় তখন কে কম অপরাধ করেছে আর কে বেশি করেছে তাতে এই ক্ষত মিটবে না। কেউ কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী, কেউ দায়ী কয়েক লক্ষের মৃত্যুর জন্য, এতে অপরাধের কোন তারতম্য ঘটছে না।’
নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালের গঠন প্রক্রিয়া এবং এর মান সম্পর্কে অনেকে তখন অনেক কথা বলেছেন। নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের উকিলরা বলেছিলেন এই ট্রাইবুনালে তারা ন্যায় বিচার পাবেন না। তারপরও বিচার চলাকালে কয়েকজন শীর্ষ নাৎসি নেতা এই ট্রাইবুনালকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। নাৎসি নেতা হ্যান্স ফ্র্যাঙ্ক ছিলেন অধিকৃত পোল্যান্ডের গভর্ণর জেনারেল। তিনি বলেছেন, ‘আমার বিবেচনায় এই বিচার হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছাধীন আদালতে, যেখানে এডলফ হিটলারের আমলের দুঃসহ যাতনার পর্যালোচনা ও সমাপ্তি ঘটবে।’ হিটলারের যুদ্ধসামগ্রী নির্মাণ মন্ত্রী এ্যালবার্ট স্পীয়ার বলেছেন, ‘এই বিচার জরুরি। এমনকি একটি একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও এসব ভয়াবহ অপরাধের সম্মিলিত দায় থাকে।’ অভিযুক্তদের একজন আইনজীবী ড. থিয়োডর ক্লেফিশ লিখেছেন, ‘এই ট্রাইবুনালের বিচার প্রক্রিয়া ও রায় সর্বোচ্চ পক্ষপাতহীনতা, বিশ্বস্ততা ও ন্যায়বোধ দাবি করে। নুরেমবার্গ ট্রাইবুনাল এই সব দাবি মর্যাদার সঙ্গে পূরণ করেছে। এই বিশাল বিচারযজ্ঞের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সত্য ও ন্যায় অনুসন্ধান ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যাতে কারও ভেতর কোন সন্দেহ না থাকে।
নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে ৪টি মিত্র দেশের ৮ জন বিচারক ছিলেন – যাদের একজন পূর্ণ সদস্য অপরজন বিকল্প সদস্য। বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন ইংল্যান্ডের লর্ড জাস্টিস জিওফ্রে লরেন্স। ৪টি দেশের ৫২ জন আইনজীবী ছিলেন সরকারের পক্ষে। প্রত্যেক দেশের এক মুখ্য আইনজীবী এবং কয়েকজন আইনজীবী ও সহকারী আইনজীবী ছিলেন, তবে সরকারি আইনজীবীদের পক্ষ থেকে আদালতে সূচনা ও সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস জ্যাকসন। তাঁর এই দুটি দীর্ঘ ভাষণ আন্তর্জাতিক আইনশাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে গণ্য করা হয়।
১ অক্টোবর ১৯৪৬ সালে নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে প্রথম পর্যায়ে শীর্ষস্থানীয় ২৪ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারে ১২ জনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। ৩ জনকে যাবজ্জীবন, ২ জনকে ২০ বছর, ১ জনকে ১৫ বছর এবং ১ জনকে ১০ বছর কারাদন্ড প্রদান করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৩ জন খালাস পায়। অভিযুক্ত বাকি দুজনের ভেতর জার্মান শ্রমিক ফ্রন্ট ডিএএফ-এর প্রধান গুস্তাভ ক্রুপকে শারীরিক অসুস্থতার জন্য মেডিকেল বোর্ড বিচারের সম্মুখীন হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করে। অপর অভিযুক্ত ডাঃ রবার্ট লাই বিচার শুরু হওয়ার আগে ২৫ অক্টোবর ১৯৪৫ তারিখে আত্মহত্যা করেন। নাৎসি পার্টির সেক্রেটারি, ডেপুটি ফুয়েরার মার্টিন বোরমানের অনুপস্থিতিতে বিচার হয়েছিল এবং তাঁকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়।
নুরেমবার্গ ট্রায়াল বলতে সাধারণভাবে প্যালেস অব জাস্টিসে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইবুনালে’র প্রথম বিচারকে গণ্য করা হয়, যার সময়কাল ছিল ১০ মাস। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত নুরেমবার্গের প্যালেস অব জাস্টিসে আরও ১২টি মামলার বিচার হয়েছিল যেখানে ২০০ জন নাৎসি রাজনৈতিক নেতা, সামরিক কর্মকর্তা ও পেশাজীবীর বিচার হয়েছিল। এদের ভেতর ২৪ জনকে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, পরে ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অবশিষ্টদের ২০ জনকে যাবজ্জীবন এবং ৯৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ৩৫ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। গুরুতর অসুস্থতা ও বার্ধক্যের কারণে ৪ জনকে বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ৪ জন বিচার চলাকালে আত্মহত্যা করেছিলেন।
আইএমটি ও আইসিটি : মিল-অমিল
নুরেমবার্গের ‘ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইবুনাল’ (আইএমটি)-এর সঙ্গে ঢাকার ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল’ (আইসিটি)-এর প্রধান মিল হচ্ছে ন্যায়বিচারের দর্শন ও চেতনাগত। যদি মনে করা হয় ‘গণহত্যা’ ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘যুদ্ধাপরাধ’ প্রভৃতি সাধারণ হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুন্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞের চেয়ে অনেক ভয়াবহ ও গুরুতর অপরাধ তাহলে অপরাধীদের অবশ্যই বিচার করতে হবে – ১) ইতিহাসের দায় থেকে মুক্তির প্রয়োজনে, ২) যুদ্ধের ভিকটিমদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের স্বার্থে, ৩) ভবিষ্যতে মানবজাতিকে গণহত্যা ও যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্তি প্রদান এবং ৪) সভ্যতার বোধ নির্মাণের প্রয়োজনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার এই উদ্দেশ্যে বিশেষ আইন প্রণয়ন করে বিশেষ ট্রাইবুনালে এসব অপরাধের বিচারের প্রয়োজনীয়তা প্রতিষ্ঠা করেছে। নুরেমবার্গের ‘আইএমটি’-র সঙ্গে ঢাকার ‘আইসিটি’-র পার্থক্য হচ্ছে – প্রথমটি ছিল আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল এবং দ্বিতীয়টি জাতীয় বা দেশীয় ট্রাইবুনাল। এছাড়া প্রথমটি ছিল সামরিক আদালত, দ্বিতীয়টি অসামরিক আদালত।
ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের প্রথম দফা বিচার প্রক্রিয়ায় ২৪ জন যুদ্ধাপরাধীর পাশাপাশি ৭টি সংগঠনকেও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। কারণ যুদ্ধাপরাধের ক্ষেত্রে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠনের আদর্শ, কাঠামো, নির্দেশাবলি ব্যক্তির যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে থাকে।
‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালসমূহ) আইন ১৯৭৩’ প্রণীত হওয়ার প্রাক্কালে এই আইনের রক্ষাকবচ হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় ’৭৩-এর ১৫ জুলাই। এই সংশোধনী সম্পর্কে তখন জাতীয় সংসদে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ৩ জুলাই এই সংশোধনী উত্থাপনের সময় আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর নুরেমবার্গ ট্রায়াল, টোকিও ট্রায়াল ও ইয়ামাশিতা ট্রায়াল (ম্যানিলা ট্রায়াল)-এর উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘আজকে আমি সংবিধানের যে সংশোধনী বিলটি এনেছি এর জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্ব এবং তাৎপর্য সম্পর্কে এই সংসদের প্রত্যেক মাননীয় সদস্য এবং এই সংসদের বাইরেও লক্ষ লক্ষ মানুষ, আমাদের বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি অধিবাসী সচেতন। যে পাক হানাদার বাহিনী তাদের নিষ্ঠুর দানবীয় নিষ্পেষণে আমার দেশকে নিষ্পিষ্ট করেছিল, যারা বিশ্ব মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিল, যারা সভ্যতার বিরুদ্ধে দুশমনী করেছিল, যারা বিশ্বশান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিল, যারা আমার দেশের ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল এবং যারা আমাদের দেশের প্রায় ৩ লক্ষ মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছিল, তারা আমাদের মানবিক স্বাধিকারের যে দাবী, তাকে পদদলিত করে তাদের সামরিক তা-বযন্ত্রের নিষ্পেষণে আমাদেরকে চিরদিনের মত বিশ্বের বুক থেকে বাঙ্গালী জাতি হিসাবে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল – তেমনি এক শ্রেণী, যারা যুদ্ধাপরাধী বলে গণ্য, তাদের বিচারের জন্যই আজকের এই সংশোধনী। … যে অত্যাচার, যে অনাচার, যে চ- দমননীতির তা-বলীলা আমাদের দেশের উপর দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার জন্য আমি মনে করি ইতিহাসে আজকের এই যুদ্ধাপরাধীর বিচার নূতন নয়। অনেক নজীর হয়েছে। নুরেমবার্গ ট্রায়াল, টোকিও ট্রায়াল, ইয়ামাশিতা ট্রায়ালের কথা আপনি জানেন, জনাব স্পীকার সাহেব। তাই বিশ্ব-সভ্যতা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী এই যে দুশমন, নরপিশাচ পাক-হানাদার তাদের বিচারের জন্যই আজকে আমাদের সংবিধানের সংশোধন হওয়া দরকার।
‘কারণ, আমরা তাদের বিচারানুষ্ঠান করতে যাচ্ছি; এবং তার জন্য একটা আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছি। আমি আশা করি মাননীয় স্পীকার সাহেব অনুমতি দিলে, আগামী কাল হয়তো এই সংসদে বিল পেশ করার সুযোগ পাব। কাজেই আজ constitution-এ যে মৌলিক অধিকার রয়েছে, দেশের যে আইনের বলে আমরা যুদ্ধবন্দীদের বিচার করতে যাচ্ছি, এইসব মৌলিক অধিকার বর্তমান অবস্থায় থাকলে, এই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সংবিধানে যা বিধিবদ্ধ রয়েছে, তাতে তারা দাবী করতে পারে, তাদের বিচার অবৈধ হয়েছে এবং তার ফলে সব বানচাল হয়ে যেতে পারে। সেই জন্য যাতে করে তারা মৌলিক অধিকারের সুযোগ না পায়, সেই উদ্দেশ্যে আমি এই সংশোধনী এনেছি। তবে আমরা চাই তাদেরকে সম্পূর্ণ সুবিচারের ও ন্যায় বিচারের সুযোগ দিতে। কিন্তু সংবিধানের মৌলিক অধিকারের দোহাই দিয়ে যাতে রেহাই পেতে না পারে, সেই জন্য এই সংশোধনী এনেছি। …’ (দ্রষ্টব্যঃ জাতীয় সংসদের ধারাবিবরণী)
পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশ, আমেরিকা, কানাডা, রাশিয়া, ইসরাইল ও আরও কয়েকটি দেশ যুদ্ধাপরাধ সহ মানবতাবিরোধী বহু কর্মকান্ড যা আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির পরিপন্থী সেসব তাদের দেশীয় আইনে সংজ্ঞায়িত করে বিচারের ক্ষেত্র প্রসারিত করেছে। নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে ‘গণহত্যা’ স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়নি। ঢাকার ট্রাইবুনাল গণহত্যাকে স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং এই ট্রাইবুনালে অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রথম রায়ে এ বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আগে কোনও দেশের নিজস্ব আইনে গণহত্যা (genocide)-কে স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।
কিলিং ও জেনোসাইড
ইংরেজি দুটি শব্দ killing ও genocide-এর বাংলা গণহত্যা, কিন্তু দুটির অর্থ এক নয়। mass killing হচ্ছে নির্বিচারে হত্যা, যা বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর। কিন্তু এই killing দ্রুত genocide-এ রূপান্তরিত হয়েছে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিশেষভাবে হিন্দুরা। একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয়, ভাষাগত, বর্ণগত নৃগোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও জাতিকে যখন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে হত্যা এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় নিশ্চিহ্নকরণের উদ্যোগ নেয়া হয় সেটা genocide। গণহত্যা বিশেষজ্ঞ মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর জে রুমেল এই ধরনের গণহত্যাকে আরও বিভাজন করেছেন। একটি হচ্ছে সরকার বা রাষ্ট্র কর্তৃক, অপরটি হচ্ছে সরকারের বাইরের কোন গোষ্ঠী, জাতি বা সম্প্রদায় কর্তৃক। সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে রুমেল অভিহিত করেছেন democide হিসেবে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে mass killing, genocide, politicide ও democide – সব ধরনের হত্যা সংঘটিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আইএমটির চেয়ে আইসিটির অবস্থান স্বচ্ছ এবং নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। দেশীয় আইন ও দেশীয় আদালতে গণহত্যার বিচার করে বাংলাদেশ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, গত শতাব্দীতে গণহত্যার শিকার অথচ বিচারবঞ্চিত এমন বহু দেশের জন্য তা অনুকরণযোগ্য বিবেচিত হবে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে নুরেমবার্গ ট্রাইবুনাল বিশাল আয়োজনের পাশাপাশি আইনি লড়াইয়ের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আইএমটির প্রতিদিনের ধারাবিবরণী পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় বিশ্বের বিচারব্যবস্থায় তা এক অনন্য ইতিহাস, অতীতে যেমনটি দেখা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে কি না সন্দেহ। বাংলাদেশে আইসিটির আয়োজন আইএমটির আয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। কিন্তু যে সীমিত সম্পদ, লোকবল ও রসদ সম্বল করে ঢাকার ট্রাইবুনাল যাত্রা শুরু করেছে, যে প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এই বিচারকার্য চলমান রেখেছে তাতে সংশ্লিষ্টদের দেশপ্রেম ও পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দৃঢ়তা প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার
নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধের বিচার আরম্ভ হয়েছিল অপরাধ সংঘটনের অব্যবহিত পরে অথচ বাংলাদেশে বিচার আরম্ভ হয়েছে প্রায় চল্লিশ বছর পর। সময়ের ব্যবধানে বহু প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী মৃত্যুবরণ করেছেন, বহু তথ্যপ্রমাণও হারিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে অধিকাংশ সময় ক্ষমতায় ছিল ’৭১-এর গণহত্যাকারীরা এবং তাদের সহযোগীরা। ক্ষমতায় থাকার সুযোগে তারা বহু তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করেছে এবং পাঠ্যপুস্তক ও প্রচার মাধ্যম থেকে ’৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ শুধু নয় সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাহীনতার এক অন্ধকার সময়ের ভেতর, যাদের অনেকে পাকিস্তানি লেখক এবং তাদের বাংলাদেশী দোসরদের মিথ্যাচারের শিকার। তারা মনে করে ’৭১-এ তিরিশ লক্ষ মানুষের গণহত্যা, পাঁচ লক্ষাধিক নারীর পাশবিক নির্যাতন ইত্যাদি পরিসংখ্যান অতিরঞ্জিত। তারা মনে করে ’৭১-এ কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ভাইদের কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে মতপার্থক্যকে হিন্দু ভারত গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত করেছে এবং এই গৃহযুদ্ধের সুযোগে ভারত পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগ ভারতের এই চক্রান্তের প্রধান সহযোগী ছিল এবং এখনও ভারতের স্বার্থে কাজ করছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষের অনন্যসাধারণ ত্যাগ, জীবনদান ও শৌর্যবীর্যের পাশাপাশি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা নৃশংসতম গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ যেমন সংঘটিত হয়েছে, পরবর্তীকালে একই নৃশংসতায় হত্যা করা হয়েছে ইতিহাসের এই অমোঘ সত্য। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ঢাকায় আইসিটি যে রায় দিয়েছে তা ইতিহাসের বহু বিস্মৃত সত্যকে মিথ্যার অন্ধকার বিবর থেকে মুক্ত করেছে।
’৭১-এর গণহত্যার নৃশংসতা উপলব্ধির জন্য আইসিটির প্রথম রায়ে বাচ্চু রাজাকারের কয়েকটি হত্যা, ধর্মান্তরীকরণ ও ধর্ষণের উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাচ্চু রাজাকার যাদের হত্যা করেছে ধর্মীয় পরিচয়ে তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের। রাজাকারদের গণহত্যার যে পদ্ধতি ফরিদপুরের নগরকান্দায় অনুসৃত হয়েছে, সারা দেশের চিত্র তারই সমার্থক। এই রায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর কিছু ভাড়াটে গণমাধ্যম, পেশাজীবী ও মানবাধিকার সংগঠন মন্তব্য করেছে- অভিযুক্ত ব্যক্তি একজন ধর্মপ্রচারক, ইসলামী চিন্তাবিদ তার বিচারের অর্থ হচ্ছে ইসলামকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, তার মৃত্যুদন্ড সরকারের ইসলামবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ ইত্যাদি। এরা মনে করে – হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুন্ঠন প্রভৃতি অপরাধ ইসলামের সমার্থক।
১৯৭১ সালে ইসলামের দোহাই দিয়েই জামায়াতে ইসলামী গণহত্যা ও নারীধর্ষণ সহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী নৃশংস অপরাধকে বৈধতা দিয়েছিল। একজন ধর্মপ্রচারক কীভাবে ভিন্ন ধর্মের অনুসারী বস্তু জগৎ ও পার্থিব স্বার্থের বিপরীতে আধ্যাত্মিক জগতের অনুসারী আটজন সাধু সন্ন্যাসীকে হত্যা করতে পারে এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন তারা মনে করে না। হত্যার হুমকি দিয়ে ধর্মান্তরীকরণের মতো নিষ্ঠুরতা কীভাবে অনুমোদন করা যায়? অঞ্জলী সাহাকে যেভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, যেভাবে তাকে দাহ করতে বাধা দেওয়া হয়েছে- এ ধরনের নৃশংসতার ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্টের পর পৃথিবীর কোথাও ঘটেনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চেয়ে তাদের সহযোগীদের অপরাধের নৃশংসতা কোনও অংশে কম ছিল না। ঢাকার ট্রাইবুনালের রায়ে এ বিষয়টি যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
সামরিক ও বেসামরিক আদালত
নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইবুনাল চরিত্রগতভাবে ছিল সামরিক আদালত। আদালতের রায় ছিল চূড়ান্ত। এর বিরুদ্ধে অভিযুক্তকে আপিলের সুযোগ দেওয়া হয়নি। ঢাকার ‘আইসিটি’র আইনে অভিযুক্তকে ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। নুরেমবার্গে অভিযুক্তদের আইনজীবী ও সাক্ষীদের যে সময় দেওয়া হয়েছিল ঢাকার ট্রাইবুনালে তার চেয়ে বেশি সময় দেওয়া হয়েছে। এমনকি ঢাকার ট্রাইবুনালে প্রসিকিউশনের চেয়ে বেশি ছিল অভিযুক্তদের আইনজীবী ও পর্যবেক্ষকদের সংখ্যা। মানবাধিকারের বিবেচনায় ঢাকার আইসিটি নুরেমবার্গ ও টোকিওর চেয়ে মানসম্পন্ন।
নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের যখন বিচার হয় তখন সমগ্র জার্মানি যুদ্ধবিধ্বস্ত। পৃথিবীর কোথাও অভিযুক্ত নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতি জানাবার মতো কেউ ছিল না। ’৭১-এর গণহত্যার সময় সৌদি আরব তথা মুসলিম উম্মাহ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের বাঙালি সহযোগীদের পক্ষে ছিল। আমেরিকা, চীন, আফ্রিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের গণহত্যাকে সমর্থন করেছে। ২০০৯ সালে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণের পর পরই অপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী বিচার প্রশ্নবিদ্ধ ও বিঘ্নিত করাবার জন্য শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে তাদের পক্ষে লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তাদের পক্ষে বহু গণমাধ্যম কর্মী, মানবাধিকার কর্মী এবং বিভিন্ন সংগঠনকে ভাড়া করেছে এই বিচার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য। আইসিটির ভেতরেও তাদের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহল অবগত রয়েছেন। নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালকে এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বহু কারণেই নুরেমবার্গে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের তুলনায় অনেক বেশি জটিল। ’৭১-এর গণহত্যাকে জামায়াত যেভাবে ধর্মের নামে বৈধতা দিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধকে আখ্যায়িত করেছে ইসলামের উপর আঘাত হিসেবে, একইভাবে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারকে তারা বলছে ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র। ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ ধর্মভীরু কিছু মানুষকে ইসলামের নামে মওদুদিবাদ তথা ধর্মের নামে ভিন্নমত ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের হত্যার জন্য প্ররোচিত করা কঠিন কোনও কাজ নয়। নাৎসি দর্শনের একনিষ্ঠ অনুসারী জামায়াতে ইসলামীর মিত্র যেমন দেশের ভেতরে আছে তার চেয়ে বেশি আছে দেশের বাইরে। পাকিস্তান সহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জামায়াতের কিছু প্রভুরাষ্ট্র এবং কয়েকটি দেশের আল কায়দার সহযোগীরা এই বিচার সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে অপপ্রচার ও নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করছে, যে সুযোগ নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে ছিল না।
নুরেমবার্গে ২২ জন অভিযুক্ত ও ৭টি সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলার রায় একসঙ্গে দেওয়া হয়েছে। আইসিটি প্রতিটি অভিযুক্তের জন্য পৃথক অভিযোগনামা প্রণয়নের পাশাপাশি শুনানি করেছে পৃথকভাবে এবং রায় প্রদানও আরম্ভ হয়েছে পৃথকভাবে। এতে অভিযুক্তরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ বেশি পেয়েছেন। নুরেমবার্গে প্রথম মামলার রায় পরবর্তী পর্যায়ের বিচারের ক্ষেত্রে কতগুলো বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ঢাকার আইসিটির বিভিন্ন রায়ের একাধিক পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য পরবর্তী মামলাসমূহের রায় কিছুটা সহজ করে দিয়েছে। বাচ্চু রাজাকারের বিচার হয়েছে তার অনুপস্থিতিতে, তার নিজস্ব আইনজীবী ছিলেন না, রাষ্ট্র তার জন্য আইনজীবী নিয়োগ করেছে। পলাতক থাকার কারণে তার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে আপিলেরও সুযোগ ছিল না যা অন্যদের ক্ষেত্রে যার সুযোগ গ্রহণ করা হয়েছে; তা সত্ত্বেও ‘প্রধান প্রসিকিউটর বনাম মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু (পলাতক)’ শীর্ষক মামলার রায়ে যেভাবে ‘ঐতিহাসিক পটভূমিকা’, ‘ট্রাইবুনালের এখতিয়ার’, ‘অভিযোগ প্রমাণের দায়’, ‘পটভূমি ও প্রসঙ্গ’, ‘ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ও ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর দায়মুক্তি’ ‘অপরাধের সংজ্ঞা ও উপাদান’, ‘অভিযোগের বিচার’, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখন্ডে বিরাজমান প্রেক্ষিত’ প্রভৃতি অনুচ্ছেদে এমন কিছু মন্তব্য রয়েছে যা বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হবে।
দেশীয় আইনে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার
দেশীয় আইনে এবং দেশীয় আদালতে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুরূহ কাজ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ট্রাইবুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থা, আইনজীবী, প্রশাসনিক বিভাগ ও বিচারকদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, কখনও তারা ভুল করেছেন, আমরা অনেক সমালোচনাও করেছি, তারা কিন্তু দ্রুত তা শুধরে নিয়েছেন। তাদের সামনে ছিল নুরেমবার্গ, টোকিও ও ম্যানিলা থেকে আরম্ভ করে চলমান কম্বোডিয়ার বিচারের ইতিহাস ও কার্যক্রম এবং এসব বিচারের ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়সমূহ। ঢাকার ট্রাইবুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা পড়াশোনা করেছেন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন এবং নিজেদের কর্মক্ষেত্রের বিশাল অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানবুদ্ধির আলোকে ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের মামলার রায় প্রদান করছেন।
নুরেমবার্গ থেকে আরম্ভ করে কম্বোডিয়া পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অপরাধের ঘটনার দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ব্যবধানে বিচার একমাত্র বাংলাদেশেই আরম্ভ হয়েছে। এই বিচার প্রমাণ করেছে দেশের জনগণ ও সরকার যদি চায় অপরাধ যত অতীতেই ঘটুক না কেন স্বজনহারাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে তাদের দুঃসহ বেদনা সম্পূর্ণ উপশম না হোক লাঘব করা সম্ভব।
গত ১১ বছরে আইসিটিতে শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এখন আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি পাকিস্তানি হাই কমান্ড সহ তাদের এদেশীয় দোসর দল ও ঘাতক বাহিনী, অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামী নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ ও পিডিপি সহ রাজাকার, শান্তি কমিটি, আল বদর, আল শামস, মুজাহিদ বাহিনী ইত্যাদি ঘাতক সংগঠনের বিচারের জন্য।
বাংলাদেশে গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ১৯৭৫-এর পরের দশকগুলোতে ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও মানবতাবিরোধীরা বিত্ত ও বৈভবের পাহাড় গড়ে তুলেছে, যে সুযোগ জার্মানী বা জাপানে ছিল না। তারা যাদের হত্যা করেছে, তাদের পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। আলবদরপ্রধান নিজামী ও মুজাহিদ রাষ্ট্রের মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন। যাদের তারা হত্যা করেছেন, তাদের পরিবার অভাবে, দারিদ্র্যে, দুঃখে, কষ্টে জীবন যাপন করেছে। ১৯৯৩ সালে বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে বরেণ্য আইনজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আমরা ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’ গঠন করেছিলাম। তখন আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবারগুলোর পরিস্থিতি দেখেছি। তাদের সাক্ষ্য নিয়েছি। এসব সাক্ষ্য ও প্রমাণ পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাজে লেগেছে।
’৭৫-পরবর্তী সরকারগুলোর আমলে যুদ্ধাপরাধীরা প্রভাব ও পয়সা খাটিয়ে তাদের অপরাধের বেশির ভাগ প্রমাণই নষ্ট করে ফেলেছিল। তারপরও যেসব দালিলিক প্রমাণ এবং সাক্ষী রয়েছে, এই যুদ্ধাপরাধীদের দশবার ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য যথেষ্ট। কথা হচ্ছে, শুধু যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি, যুদ্ধাপরাধী সংগঠন নিষিদ্ধ করাই শেষ কথা হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ ত্যাগ সৃষ্টিকারীরা দারিদ্র্যের কশাঘাতে বছরের পর বছর মানবেতর জীবন যাপন করেছে, আর যুদ্ধাপরাধীরা বিত্তের পাহাড় গড়েছে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। সরকারের উচিত হবে যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টন করা। আমার অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হান এবং অন্যান্য শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে দেখেছি স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের পরিবার কী কষ্টের ভেতর দিনযাপন করেছে। শেরপুরের সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর নারীদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। তারা দশকের পর দশক লাঞ্ছনা, বঞ্চনাবোধ ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন। সারাদেশে এমন লক্ষ লক্ষ পরিবার রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদানের জন্য আইন প্রণয়ন করা উচিত।
এভাবে যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের নজির বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে। বিশ্বের আর কোনো দেশে যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশের মতো স্বাধীন দেশে রাজনীতি করার অধিকার পায়নি। এভাবে বুক ফুলিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়তে পারেনি। অপরাধীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নজির বাংলাদেশে নতুন নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত কর্নেল রশীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের ক্ষেত্রেও এটি করা উচিত। এবং এই কাজটি বর্তমান সরকারকেই করতে হবে। কারণ বিএনপি ও জাতীয় পার্টির শাসনামলে আমরা দেখেছি, তারা তো যুদ্ধাপরাধেরই বিচার করতে চায় নি। বিচার করা দূরে থাক, তারা যুদ্ধাপরাধীদের যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, যতভাবে তাদের অপরাধের আলামত নষ্ট করা যায়, সবাই করেছে। বিএনপি সরকার তো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বাড়িতে গাড়িতে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা লাল পতাকা তুলে দেওয়ার মতো অমার্জনীয় অপরাধও করেছিল।
একই সঙ্গে আমি মনে করি, দন্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান, পরিবার ও স্বজন যেভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদেরও বিচার হওয়া উচিত। যারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অর্থের জোগান দিচ্ছে, তাদেরও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠনের পর যে উৎসাহ উদ্দীপনায় ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচার আরম্ভ হয়েছিল, যে দ্রুততার সঙ্গে বিচার সম্পন্ন হচ্ছিল কয়েক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর এই বিচার কার্যক্রম মন্থর হয়ে পড়েছে। শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের বিচার সম্পন্ন হলেও সংগঠনের বিচার কবে আরম্ভ হবে আমরা জানি না। বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে যখন আমাদের সম্পদ বলতে কিছুই ছিল না তখন আমরা সারাদেশে ৭২টি ট্রাইবুনালে প্রায় তিন হাজারের মতো গণহত্যাকারী এবং তাদের সহযোগীদের বিচার সম্পন্ন হতে দেখেছি, যাদের ভেতর ৭৫২ জনকে মৃত্যুদন্ড সহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এই বিচার বন্ধ করে দিয়ে ’৭১-এর গণহত্যাকাীদের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার বানিয়েছিলেন। এখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা একটানা বার বছর ক্ষমতায়। আমরা আর্থসামাজিক উন্নয়নের সূচকে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধন করেছি, সম্পদের সমুদ্রে ভাসছি। অথচ এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচারে সরকার কেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই ৩০ লক্ষ শহীদ পরিবার এবং বিচারপ্রত্যাশী গোটা জাতির নিকট জবাবদিহি করতে হবে।
আমরা চাই, নুরেমবার্গের মতো ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচার শেষ হওয়ার পর ঢাকার ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল’ ভবন একদিন জাদুঘরে পরিণত হবে। ‘গণহত্যা’, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’ ও ‘যুদ্ধাপরাধের’ স্থান জাদুঘরের বাইরে আর কোথাও হওয়া উচিৎ নয়। সকল দেশের সকল অপরাধীর বিচার ও শাস্তির মাধ্যমে এই প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব। বাংলাদেশ সেই প্রত্যাশা তখনই পূরণ করতে পারবে যেদিন ঢাকার আইসিটি শেষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকার্যের সমাপ্তি ঘোষণা করবে।
যুদ্ধাপরাধকে লঘু করার চেষ্টা
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ নিহতের সংখ্যা বাংলাদেশের সরকারী পরিসংখ্যান, যা চ্যালেঞ্জ করা -গণহত্যার অপরাধ অস্বীকার অথবা লঘুকরণের অপরাধের অন্তর্গত। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘হলোকস্ট’ বা গণহত্যা অস্বীকার করা কিংবা নিহতের সংখ্যা কমিয়ে বলা দণ্ডযোগ্য অপরাধ, কারণ এর অর্থ হচ্ছে প্রকৃত গণহত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তি থেকে শুধু রক্ষা নয়, বিশ্বের দেশে দেশে গণহত্যার মতো নৃশংসতম অপরাধকে উৎসাহিত করা।
’৭১-এর গণহত্যার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২৫ মার্চ সরকারিভাবে গণহত্যা দিবস ঘোষণার জন্য ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ দুই যুগেরও বেশি আন্দোলন করেছে। ১৯৯৩ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ২৫ মার্চ গণহত্যার কালরাত্রির অনুষ্ঠানে আমরা বলেছিলাম বাংলাদেশে ‘স্বাধীনতা দিবস’ আছে, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ আছে, কিন্তু যাদের রক্তের মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে সেই ৩০ লক্ষ শহীদকে স্মরণ করার কোন সরকারি দিবস নেই।
সে বছর ২৫ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আমরা দাবি করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার পাশাপাশি গণহত্যাকারীদের ধিক্কার জানাবার জন্য একটি দিবস পালন জরুরি এবং এর জন্য ২৫ মার্চ হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেমন একটি সংগঠন থেকে ধীরে ধীরে জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে, একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার ক্যানভাসও ক্রমশঃ প্রসারিত হয়েছে। খালেদা-নিজামীদের দুঃশাসনকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নির্মূল কমিটির কয়েকশ কর্মী ও শুভানুধ্যায়ী ছাড়া ২৫ মার্চ গণহত্যার ভিকটিমদের স্মরণ করবার গরজ তেমন দেখা যায়নি। দুঃসময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর বহু সংগঠন ২৫ মার্চ গণহত্যার ভিকটিমদের শ্রদ্ধা জানাবার জন্য মোমবাতি প্রজ্বলন সহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করছে।
আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস
২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে থেকেই আমরা সরকারিভাবে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা এবং এই দিনটি আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের জন্য বিদেশে আমাদের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে প্রচারাভিযান চালিয়েছি। গত দেড় দশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও আমরা বলেছি বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণহত্যার ভিকটিমদের স্মরণ, গণহত্যার অবসান এবং গণহত্যাকারীদের বিচার দাবির জন্য জাতিসংঘের একটি ঘোষিত দিন থাকা প্রয়োজন, যেখানে ২৫ মার্চের পক্ষে আমাদের যুক্তি তুলে ধরেছি।
আমাদের দাবি এবং গণহত্যার ভিকটিম আরও কয়েকটি দেশের দাবির প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ বছরের একটি দিনকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিকভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করেছে। এই অধিবেশনে জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। এর ফলে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির একটি অংশের আর কার্যকারিতা থাকছে না। এর পর থেকে আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশে গণহত্যার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য প্রচার অভিযান অব্যাহত রেখেছি।
গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের পাশাপাশি এই দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আমরা জানতে পেরেছি ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। তখন গণমাধ্যমের অনেক আলোচনায় আমরা দেখেছি ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনের জন্য বিজ্ঞজনরা নানা অভিমত ব্যক্ত করছেন। আমরা পরিস্কারভাবে বলতে চাই, ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণার সুযোগ আমরা ২০১৫ সালেই হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের এখন প্রয়োজন ’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ।
২০১৭ সালের ১৫ মার্চ আমরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ৫টি প্রস্তাব বিবেচনার জন্য প্রদান করেছি। এর ভেতর উল্লেখযোগ্য ৩টি প্রস্তাব হচ্ছে:
১. বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং অন্যান্য গবেষকরা যা লিখেছেন সেগুলো সহ এতদসংক্রান্ত আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র বাংলাদেশের সকল কূটনৈতিক মিশন, বিদেশে আমাদের সকল দূতাবাস, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী আইনপ্রণেতা, গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার সংগঠন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন দফতরে পাঠানো প্রয়োজন।
২. বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানাতে হবে, যাতে তারা তাদের পার্লামেন্ট এই মর্মে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ভারত, নেপাল, ভূটান, রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সহ যে সব দেশ ’৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ ও নিন্দা করেছিল তাদের অনুরোধ করা হলেই এ বিষয়ে তারা পার্লামেন্টে প্রস্তাব গ্রহণে সম্মত হবে বলে আমারা বিশ্বাস করি। এ ছাড়া ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রবাসী বাঙালি এবং নির্মূল কমিটির মতো সংগঠনসমূহের সহযোগিতা চাইতে পারে।
৩. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় গণহত্যা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে আগ্রহী করার জন্য দেশে ও বিদেশে গণহত্যা বিশেষজ্ঞ, আইনপ্রণেতা, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে নিয়ে ইংরেজি সহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় বাংলাদেশের গণহত্যা বিষয়ক প্রবন্ধ/গ্রন্থ/প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ ও নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি এ বিষয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন নিয়মিতভাবে আয়োজন করা প্রয়োজন। সরকার আগ্রহী হলে এ ক্ষেত্রে নির্মূল কমিটি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে পারে।
গণহত্যাকে পাঠসূচি করা
দেশের ভেতর নতুন প্রজন্মকে ’৭১-এর গণহত্যা সম্পর্কে জানাবার জন্য এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ২০১৭ সালের মার্চে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সহযোগী রাজনৈতিক দল ও বাহিনীসমূহের নৃশংসতম গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের কোনও উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। কী কারণে এই বিলম্ব তা আমাদের পক্ষে বোঝাও সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার কি প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ অগ্রাহ্য করে ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচার করছে না? এই বিচারের চেয়ে অনেক সহজ কাজ হচ্ছে ’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন।
মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের বছর আমরা ’৭১-এর গণহত্যার ৫০ বছর উপলক্ষে এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশে এবং জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে ব্যাপক প্রচারাভিযান পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এর একটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হচ্ছে ৩০ লক্ষ+ গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে জাতিসংঘ সহ সকল রাষ্ট্রের নিকট আমাদের গণহত্যার স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আহ্বান জানানো। আমাদের আবেদনপত্রে স্বাক্ষরদানকারীদের ভেতর থাকবেন বিভিন্ন দেশের নোবেলবিজয়ী ব্যক্তিত্বগণ, আইনপ্রণেতা, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, গণহত্যাবিরোধী মানবাধিকার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সহ সর্বস্তরের জনগণ। বিদেশে এই গণস্বাক্ষর সংগ্রহের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ভারত ও রাশিয়া সহ অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও সহযোগিতা করবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। প্রয়োজন হচ্ছে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ।
সরকারি স্বীকৃতি
মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছর পর ২০১৭ সালে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে ‘২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস’ পালনের মাধ্যমে ’৭১-এর গণহত্যার সরকারি স্বীকৃতি প্রকৃতপক্ষে ৩০ লক্ষ শহীদের মহান আত্মদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি দেশে ও দেশের বাইরে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিকৃতকারীদের গণহত্যা অস্বীকারের অপচেষ্টা নিরুৎসাহিত করবে। একই সঙ্গে আমাদের নতুন প্রজন্মের আত্মপরিচয়ের সংকটও মোচন করবে এই স্বীকৃতি। মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মকে জানতে হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জাতিকে যে চরম মূল্য দিতে হয়েছে তা অন্য কোনও জাতিকে কখনও দিতে হয়নি।
আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে গণহত্যার যে রাজনীতি বা দর্শন তার মূল উৎপাটন করা। ’৭১-এর গণহত্যা হয়েছে ধর্মের নামে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল। ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে সন্ত্রাস ও গণহত্যার অভিশাপ থেকে কখনও মুক্তি পাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধু এ কারণেই ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন।
ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্তা, ভাষা, অঞ্চল, যে কারণেই হোক, বিশ্বকে গণহত্যার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হলে গণহত্যার স্বীকৃতি খুবই জরুরি। এই স্বীকৃতি গণহত্যায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পাশাপাশি দেশে দেশে গণহত্যাকারীদের বিচারের পথ সুগম করবে। একই সঙ্গে অপরাধ থেকে দায়মুক্তির কলঙ্ক থেকে ইতিহাসকে মুক্ত করবে।
*****
প্রচ্ছদঋণঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ