সূচী
বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে সবচেয়ে গর্ব ও অহঙ্কারের ঘটনা বোধকরি মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের উপর দীর্ঘদিনের অবদমনের কারণে জনমানসে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের সঞ্চার হয়, তারই ফলস্বরূপ নয়মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। শুধু বিরূপ শাসকগোষ্ঠীই নয়, দীর্ঘ বঞ্চনাকে কখনও অস্বীকার কখনও লঘু প্রতিপন্ন করে, এই ভূখন্ডেরও অনেক মানুষ স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রস্তাবনার সরাসরি বিরোধিতা করেন। এই বিরোধী গোষ্ঠীকে সশস্ত্র লড়াইয়ে পরাস্ত করেই বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়। তবে এই বিজয়ের মধ্যেও সুপ্ত থাকে অনেক মর্মন্তুদ হৃদয়স্পর্শী ঘটনা। এইসব ঘটনাগুলোর একটি হল গণহত্যা। এর ভয়ঙ্করতা প্রকাশ করতে গিয়ে কবি সিকান্দার আবু জাফর ১৯৭২ এর ২০ জানুয়ারি ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকায় লেখেন, ‘গ্রামে গ্রামে বধ্যভূমি তার নাম আজ বাংলাদেশ।’
সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার তেত্রিশতম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ১৯৮১ সালে জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বিশ্বের ইতিহাসে যে সব গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যায়। প্রতিবেদনে নিহতের সর্বনিম্ন গণনায় অন্ততপক্ষে ১৫ লক্ষ উল্লেখ করে বলা হয় যে, ১৯৭১ সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার লোক নিহত হয়েছেন। মানব জাতির ইতিহাসে গণহত্যাযজ্ঞের ঘটনাসমূহে দৈনিক গড় নিহতের সংখ্যায় এটি সর্বোচ্চ।
গণহত্যা না এথনিক ক্লিনজিং?
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয় তা হল বেছে বেছে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে হত্যা করা। ২৫ শে মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য অংশে যে আক্রমণ হয়েছিল তাতে দেখা যায় যে পরিকল্পনামাফিক হিন্দু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হত্যা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু শিক্ষকদের যেমন রেহাই দেওয়া হয়নি, তেমনি হিন্দু শরণার্থীরাও রেহাই পাননি। খুলনা শহরের প্রথম পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডতেও প্রাণ হারান হিন্দু প্রভাবশালী সদস্যরা। এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল ২৭ থেকে ৩১ মার্চের মধ্যে কোন এক রাতে। ওই রাতে মুসলিম লীগ নেতা ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খান এ সবুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহাদেব চক্রবর্তীসহ ছয় জনকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি সঞ্চারিত হয়, প্রাণভয়ে বাসস্থান ছেড়ে তাঁরা পালাতে শুরু করেন।
প্রকৃতপক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আবহটি এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছিল যেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রটির পথে প্রধান বাধা হচ্ছে এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। প্রচারণাটি এমন ছিল যে, বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম বলে যা কিছু হচ্ছে, তা প্রকৃতপক্ষে ভারতের চক্রান্ত, আর সেই চক্রান্তের কুশীলব হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও হিন্দু জনগোষ্ঠী। ফলে আওয়ামী লীগ ও হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করতে পারলেই পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে। এ কারণে ধর্মীয় সংখ্যাালঘু এই জনগোষ্ঠীর ওপর নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে এই মাত্রা ছিল অভাবনীয় – তাঁদের সহায়-সম্পদ লুটে নেওয়া, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, নারীদের উপর অমানবিক-পাশবিক নির্যাতন করা এবং নির্বিচারে হত্যা করা। এই হত্যা পরিকল্পিতভাবে একজন, দু’জন নয়; বেছে বেছে প্রভাবশালীদের নয়, একসঙ্গে শত শত, হাজারে-হাজারে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। যাকে এক কথায় বলা যায় গণহত্যা। বিষয়টিকে এথনিং ক্লিনজিং বা জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণও বলা চলে। প্রকৃতপক্ষে, পাকিস্তানী শাসকেরা বাঙালি জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে চেয়েছিল; নির্মূলকরণের তালিকায় ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক গোষ্ঠী প্রভৃতি।
একাত্তরের ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানী সেনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করে। তারপর থেকেই সারাদেশে আক্রমণের ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। এপ্রিল ও মে মাস জুড়ে সারাদেশেই চলেছে ব্যাপকভাবে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড। একদিকে অত্যাচার; অন্যদিকে পলায়নপর মানুষের মিছিল। এইসব পলায়নরত ভীতসন্ত্রস্ত মানুষদের পাকিস্তানী সেনা সদস্য ও তাদের সমর্থকেরা জায়গায় জায়গায় নির্বিচারে হত্যা করেছে। এমন কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের স্থান হচ্ছে- খুলনার চুকনগর, বাদামতলা, বাগেরহাটের ডাকরা, সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা প্রভৃতি। এর মধ্যে কেবলমাত্র চুকনগরেই দশ হাজারের বেশী নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেন। যা শুধুমাত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্বে নয়, সারা দুনিয়ার মধ্যে নৃশংসতার দিক দিয়ে গণহত্যার ভয়াবহতম নজির। ঘটনার দিন-তারিখগুলোও চোখে পড়ার মতো। ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালানো মানুষগুলোকে ১৯শে মে হত্যা করা হয় ডাকরা ও বাদামতলায়; ২০শে মে চুকনগরে, পরদিন ২১শে মে ঝাউডাঙ্গায়। এ যেন পলায়মান মানুষদের পিছু পিছু ছুটে হায়েনাদের আক্রমণ ও হত্যা করা।
দেশভাগ-পাকিস্তান
দ্বিজাতি তত্ত্ব তথা ধর্মকে মূল উপজীব্য করে ১৯৪৭-এ এই উপমহাদেশে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। একটি ভারত এবং অন্যটি পাকিস্তান। এই পাকিস্তানের ছিল দু’টি অংশ। এর একটি অংশ পূর্বাঞ্চলে- নাম পূর্ব পাকিস্তান; আর অন্যটির নাম পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান প্রকৃতপক্ষে সাবেক বাংলার পূর্ব দিককার অংশ। এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মানুসারী তথা মুসলমানদের সংখ্যা বেশী হওয়ায় এটি পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। প্রায় ২০০০ কিমি দূরত্বে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন দু’টি অংশের অধিবাসীদের মধ্যে একমাত্র ধর্ম ছাড়া আর কোন মিল ছিলনা। ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, আচার-আচরণ সবকিছুই ছিল ভিন্ন। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পর থেকেই ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে শত্রু মনে করা হত। এ কারণে এক পর্যায়ে তাদের সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে ঘোষণাও করা হয়। পাকিস্তানের হিন্দু জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানি হিসেবে কখনই মান্যতা দেওয়া হয়নি। উপরন্তু এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের ভারতে চলে যেতে মানসিক পীড়ন করা হয়েছে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা যায়, ইংরেজদের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ব-পাকিস্তানী তথা আজকের বাংলাদেশীরা আবার নতুন এক শাসক চক্রের কাছে বন্দী হয়েছে। উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা এবং নীতিনির্ধারণের সকল পর্যায়ে ও পদে পূর্ব পাকিস্তানীদের উপেক্ষা করা হয়। শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রাম। দৃশ্যত: এই সংগ্রামটির রূপ ছিল বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০-এ অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। এতে পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদে ১৬০টি আসনে বিজয়ী হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। একই সাথে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় ৩০০টির মধ্যে ২৯৮টি আসন। কিন্তু সেই সময়ের সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি। বরং নির্বাচিতদের নিয়ে ১৯৭১এর ৩রা মার্চ নির্ধারিত সাধারণ পরিষদের প্রথম সভা তিনি স্থগিত ঘোষণা করেন।
এই ঘটনায় পূর্ব পাকিস্তানীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পশ্চিমা শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশব্যাপী হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সারাদেশে বিক্ষোভ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন-বিক্ষোভে মানুষের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় স্কুল কলেজ, দোকানপাট। স্তব্ধ হয়ে যায় জীবনযাত্রা। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে মানুষকে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে আহ্বান করেন
“রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বলা চলে, এটিই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, যা একটু ঘুরিয়ে, কৌশলে বলা হয়েছিল। কারণ, তখনও পূর্ব পাকিস্তান ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রটির অংশ। ওই সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে অভিযোগ তোলার সুযোগ ছিল, পাকিস্তানী শাসকেরা যেটি চেয়েছিলও। ওই ভাষণেই জনগণকে প্রস্তুত করার আহ্বান জানানো হয়, ‘তোমরা ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল।’ এটি প্রকৃতপক্ষে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে নিজেদের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা। দূরদর্শী নেতা হিসেবে শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানীরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না, বরং তারা পূর্ব বাংলার মানুষের উপর আক্রমণ করতে পারে।
২৫শে মার্চের গণহত্যা
৭ই মার্চের এই ভাষণের পর সারা দেশ জুড়ে মানুষের অভূতপূর্ব জাগরণ ঘটে। এই গণ-জাগরণ দমন করার জন্যে ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শুরু করে ‘অপারেশন সার্চলাইট।’ এই অপারেশনে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। ঘটে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যা। রাতের অন্ধকারে পাকবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী-কর্মকর্তাদের নির্বিচারে হত্যা করে। কত মানুষ যে এই বর্বরতার শিকার হয়েছিল, তা কেউ সঠিক করে বলতে পারে না। এর কিঞ্চিত বর্ণনা পাওয়া যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা ওয়ারলেস বার্তায়।
বিভিন্ন সময় আড়ি পাতা বার্তায় এক পাকিস্তানি কমান্ডারকে বলতে শোনা যায়- ‘আমি শুধু একটি ব্যাপারেই বিশ্বাস করি। আর তা হচ্ছে- বাঙালিদের যত সহজে হত্যা করা সম্ভব, অন্য কিছুই তেমন সহজ হবে না। আমি বলছি, তোমাদের নিহতের সংখ্যার ব্যাপারে কোন জবাবদিহি করতে হবে না। সাবাস! খুব ভাল করেছ।’ আণবিক শক্তি কমিশনের বাঙালি বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমএম হুসেইন এই বেতার বার্তা আড়ি পেতে একটি ‘গার্ডিং অডিও টেপে’রেকর্ড করেন। তার অনুলেখন নীচে দেওয়া হল।
কন্ট্রোল রুম : হ্যালো ৯৯, হ্যালো। তুমি বেতার চালু রাখো। তা না হলে “ইউনিট ২৬” এবং অন্যান্যদের কথা দুবার করে বলতে হবে। তাই বলছি, বেতার বন্ধ করবে না। এখন বিশেষ কোনো নতুন খবর নেই। রিজার্ভ লাইন দখল করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় লড়াই চলছে (বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হত্যা ও ধ্বংসের ভার ছিল ইউনিট ৮৮-এর উপর)। ইউনিট ৭৭ কন্ট্রোলকে বলে, ৮৮ জানাচ্ছে, তার কাজ ভালোভাবেই এগোচ্ছে। কিন্তু ঐ এলাকায় এতো বেশি বাড়ি যে তার প্রত্যেকটিকে আলাদা আলাদা করে শেষ করতে হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে, তাদের দিকে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। তাদের হাতে যা অস্ত্র-শস্ত্র আছে সবই কাজে লাগাচ্ছে।
কন্ট্রোল: ৭৭ শুনছো? ৮৮ কে বলো তার ‘বড় ভাই’(গোলন্দাজ বাহিনী) এখনই যাচ্ছে। আশা করি তাদের দিয়েই বাড়িগুলো ধসিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু আমার ধারণা “লিয়াকৎ” (বর্তমান সূর্যসেন হল) ও “ইকবাল” (বর্তমান জহুরুল হক হল) এখন শান্ত। আমার ধারণা কি ঠিক?
৭৭: চূড়ান্ত খবর পাইনি। তবে ঐ দুটি সম্পর্কে ৮৮ বেশি খুশি।
কন্ট্রোল: বা-বা-বা। এখন ছোকরাদের রাস্তায় রাস্তায় কারফিউর কথা জানাতে বলো। এটা পয়লা নম্বর। দোসরা নম্বর-তারা আরও বললো, সব জয়বাংলা পতাকা, নামাতে হবে। যদি কোনো বাড়িতে ঐ পতাকা উড়তে দেখা যায়, বাড়ির মালিককে তার ফল ভুগতে হবে। কোনো কালো পতাকা চলবে না। শহরের কোথাও কোনো কালো পতাকা দেখা গেলে তার ফল হবে খুবই খারাপ। সকলকে একথা পরিষ্কার বুঝিয়ে দাও।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইউনিট ২৬ জানায়, ‘দু’হাজার (পুলিশ লাইন) দখল করা হয়েছে। রমনা থানা, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন দখল করা হয়েছে।’ ইউনিট ৯৯ জানায়, ‘এখান থেকে পুরানা পল্টন এলাকায় আগুন দেখতে পাচ্ছি, দাউ দাউ করে জ্বলছে।’ ইউনিট ২৬ আবার জানায়, পুলিশ লাইন জ্বলছে। ৯৯ জানতে চায়, পিপলস ডেইলির অবস্থা কি? ২৬ জানায় গুড়ো করে দিয়েছি। ইউনিট ৫৫ জানায়, ‘আমরা চারিদিকে চিতা (ট্যাংক) ছেড়ে দিয়েছি।’ ইউনিট ২৬কে ৭৭ বলে, ‘সূর্য ওঠার আগেই যেন সব লাশ গুম করে ফেলা হয়। এটা ইমামের (কমান্ডিং অফিসার) আদেশ।’ ৮৮কেও একই নির্দেশ দেয়, ‘সব লাশ হাওয়া করে দেওয়ার ব্যবস্থা করো, যেন কারো চোখে না পড়ে।’ কন্ট্রোল ৮৮এর কাছে জানতে চায়, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার শিকার কত হলো?’ ৮৮ জানায়, ‘মনে হয় শ তিনেক।’ কন্ট্রোল জবাবে বলে, ‘অপূর্ব। খতম, বন্দি না জখম?’ ৮৮-এর জবাব, ‘আরে না না, একেবারে সাফ, খতম।’
গণহত্যায় মেতে ওঠা সেইসব পাকিস্তানি সেনাদের কথোপকথন আর উল্লাসে তাদের নৃশংসতার আন্দাজ করা যায়। এই গোটা অপারেশনটিই যে পরিকল্পনামাফিক সংঘটিত হয়েছিল তাও সহজেই অনুমেয়। এমন কিছু ঘটতে পারে বলে আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলেন মুজিবুর রহমান। তাই ওই দিন মধ্যরাতেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এবং ওই দিন মধ্যরাতেই তাঁকে পাকিস্তানিরা গ্রেফতার করে। ২৫শে মার্চের পর সারাদেশেই কার্যত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। আর পাকিস্তানি শাসকদের তাৎক্ষণিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসে মুসলিম লীগ ও ’৪৭এ দেশ বিভাগের কালে ভারত থেকে আসা উর্দুভাষী মোহাজেররা সাধারণভাবে বাংলাদেশে যাদেরকে বিহারি বলা হয়।
গণহত্যার কিছু নিদর্শন
খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার কয়েকটি গণহত্যা
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত খুলনা জেলা (বর্তমানের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা)। এই খুলনা অঞ্চলে অধিক সংখ্যায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর বাস হওয়ায় এখানে লুটতরাজের ঘটনা ঘটে অনেক। এক পর্যায়ে লুটেরাদের অত্যাচারে মানুষেরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। লক্ষ্য ছিল সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশটিতে আশ্রয় নেওয়া। আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলা এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে পাকিস্তানী হানাদাররা নির্বিচারে হত্যা করেছিল চলতি পথের নানান জায়গায়।
গল্লামারী বধ্যভূমি
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালে খুলনা শহরে এখনকার মত (২০২১) জনবসতি ছিলনা। ছিলনা ময়ূর (গল্লামারী) নদীর উপর পাকা সেতু। ছিল না খুলনা-সাতক্ষীরা রোড। শহর থেকে অদূরবর্তী এই গল্লামারী জায়গাটি ছিল বেশ নির্জন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনিক ভবনটি (বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের শুরুতে ভিসি যে ভবনটিতে অফিস করতেন) ছিল তখন একতলা। এই ভবন থেকে বেতার কার্যক্রম সম্প্রচার করা হতো। বেতার কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে শুরুতেই পাকিস্তানি সেনারা এ ভবনটির দখল নিয়ে নেয়। ভবনের পিছনের ছোট একটি দোচালা ঘর ও এর সম্মুখভাগটি নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বেতারকেন্দ্র ও এর আশেপাশের নির্জন এলাকা হয়ে ওঠে বধ্যভূমি। বঙ্গ সন্তানদের ধরে এনে এখানেই গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জবাই করে হত্যা করা হতো। শেষে নিথর দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হতো গল্লামারীর স্রোতে।
১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সংখ্যা দৈনিক বাংলায় (এই পত্রিকাটি এখন প্রকাশিত হয় না) এ প্রসঙ্গে লেখে, ‘সারাদিন ধরে শহর ও গ্রাম থেকে বাঙ্গালীদের ধরে এনে হেলিপোর্ট (এখন সেখানে নতুন সার্কিট হাউস ভবন) ও ইউএফডি ক্লাবে জমা করা হতো। তারপর মধ্যরাত হলেই সেইসব হতভাগ্য নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের পেছনে হাত বেঁধে বেতার কেন্দ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা ব্রাশ ফায়ার করা হতো। রক্তাপ্লুত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়তো। হত্যার আগে ট্রাকে ভরে যখন সেইসব নিরুপায় মানুষদের নিয়ে যাওয়া হতো, তখন সেসব মানুষের আর্তনাদ রাস্তায় আশেপাশের মানুষ শুনতো। কিন্তু তাদের কিছু করার ছিলো না। কারণ বাইরে কারফিউ। সেই আর্তনাদ সইতে না পেরে একদিন শেরে বাংলা রোডের এক ব্যক্তি জানালা খুলে মুখ বের করেছিল মাত্র, আর অমনি হানাদারদের গুলিতে তিনি লুটিয়ে পড়েন।’
দৈনিক বাংলায় নিজস্ব প্রতিনিধির ‘খুলনায় পাক বাহিনীর নরমেধযজ্ঞ’ শীর্ষক সংবাদে (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) বলা হয়, ‘ছবি তুলবার জন্যে গল্লামারীর অভ্যন্তরের ধানক্ষেতে ঢুকে দেখলাম এক নৃশংস দৃশ্য। একাধিক লাশ পড়ে আছে, সেদিকে একটি কুকুর খাচ্ছে আর দূরে অপর একটি লাশের পাশে আর একটি কুকুর হাঁপাচ্ছে। মনে হয়, মানুষ খেয়ে তার পেট অতিমাত্রায় পরিপূর্ণ।’
দেশ স্বাধীনের (আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পন) একদিন আগে পাকিস্তানী সেনারা গল্লামারী বেতার কেন্দ্র ছেড়ে চলে যায়। তখন তারা বেতারের স্টুডিও কক্ষ ও আসবাবপত্র ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়ে যায়। (ছবি নীচে)








Previous
Next
খালিশপুর নয়াবাটির মুন্সিবাড়ি
একাত্তরে আওয়ামী লীগ খালিশপুর থানা শাখার সভাপতি ছিলেন মুন্সি সিদ্দকুর রহমান। তাঁর বাড়িটি ছিল খুলনা-যশোর রোড ও রেল লাইনের গা ঘেঁষে। ওই বাড়িটি প্রতিরোধ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত হওয়ায় একাত্তরের ৭ই এপ্রিল ওই বাড়িতে পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায়। সাথে ছিল বিহারি জনগোষ্ঠীর সদস্যরা। তারা বাড়িতে এসে মুন্সি সাহেবকে খুঁজতে থাকে। তাঁকে না পেয়ে তারা সেদিন ওই বাড়িটির মোট বারোজন পুরুষ সদস্যকে হত্যা করে। এরা হচ্ছেন এস এম শহিদুর রহমান (রুনু), এসএম লতিফুর রহমান (মোহন), মুন্সি মিজানুর রহমান (তপন), মুন্সি মনিরুল ইসলাম স্বপন, মুন্সি আলতাফ হোসেন, হাবিবুর রহমান, কাজী শহিদুল ইসলাম (মুকুল), লিয়াকত হোসেন, হারেজ শরীফ, এনায়েত শরীফ, সম্ভু ও আব্দুল আজিজ।
রঙপুরের (ডুমুরিয়া) হত্যাকাণ্ড
দিনটি ছিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। একাত্তরের ১৪ এপ্রিল। ওইদিন পাকিস্তানী সেনাদের একটি বহর প্রবেশ করে ডুমুরিয়ার হিন্দু অধ্যুষিত রঙপুর গ্রামে। ওইদিনে রঙপুর, শলুয়া, ঘোণা, রামকৃষ্ণপুর, বটবেড়া, কৃষ্ণনগর, লতা প্রভৃতি গ্রামগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এর প্রথম শিকার হন ভোম্বল মন্ডল নামের সত্তর বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। রঙপুর কালীবাটি এলাকায় মারা যান ইন্দুভূষণ বিশ্বাস, লালচাঁদ বিশ্বাস এবং সকলের প্রিয় অভিভাবকতুল্য প্রফুল্ল কুমার বিশ্বাস। স্বনামে খ্যাত প্রফুল্ল কুমার বিশ্বাস ১৯৩৩ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৩৫ সালে বর্তমানের বিএল (ব্রজলাল) কলেজ থেকে আইএ, ১৯৩৭ সালে বিএ পাশ করে ১৯৪৬ সালে কলকাতা ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি পাশ করেন। গ্রামে এসে শুরু করেন শিক্ষকতা। একাধারে দশ বছর রঙপুর ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সকলে তাঁকে গুরু বলতো। এই বৃদ্ধকেও তাঁর বাড়ি থেকে ধরে পাশের বিলে নিয়ে হত্যা করা হয়। এই গ্রামের রতন বিশ্বাস ও নীহার বিশ্বাসকেও শলুয়া বাজার থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। ওইদিন পাকিস্তানী সেনাদের হাতে আরও হত্যার শিকার হন অমূল্য মন্ডল, নির্মল ঢালী, অমূল্য জোদ্দার, মথুর ঢালী, মহেন্দ্রনাথ ঢালী।
বাজুয়া, চালনা ও হড্ডায় গণহত্যা
বাজুয়া বাজার স্কুল ও স্কুলমাঠে তখন শরণার্থীদের ভিড়। দিনটি ১২ মে বুধবার। বেলা তিনটের দিকে পাকিস্তানী সেনারা বাজুয়া বাজারে আক্রমণ চালায়। তারা গুলি করতে করতেই বাজারে নামে। এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যারা ছুটে পালাতে গিয়েছে, তারাই মারা পড়েছে। সেখানে তখন বাগেরহাটের রামপাল এলাকার পিপুলবুনিয়া, জয়নগর, ভাগা, ভেকটমারী, নাদেরহুলা প্রভৃতি গ্রামের লোক ছিল। পাকিস্তানী সেনাদের হাতে জীবিত অবস্থায় ধরা পড়ে পিপুলবুনিয়া গ্রামের হরিপদ মুখার্জী। তাকে পাকিস্তানী সেনারা নানা কথা জিজ্ঞাসা করে সারা শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। মৃতদের নিথর দেহগুলো পাশের পশুর নদীতে ফেলে দেয়।
বাজুয়া থেকে তাড়া খাওয়া শরণার্থী দলটির বিশাল বহর নৌকা যোগে সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে ভারতে যাওয়ার পথে শিবসা নদীর পাড়ে হড্ডা (বর্তমানে কয়রা উপজেলাধীন) নামের এক জায়গায় খাবারের জন্যে জড়ো হন। গ্রামটির দক্ষিণ পাড়েই সুন্দরবন। এখানে এই বাহিনীর ওপর আবু সাত্তার নামের এক লুটেরা বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হন। সাত্তারের বাহিনীর গুলিবর্ষণে এখানে বিশের অধিক সদস্য মারা যায়। এই শরণার্থী দলের কাছে একটি বন্দুক ছিল, তারা তাই দিয়ে আক্রমণকারীদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। এতে আক্রমণকারীদের হোতা সাত্তারও সেখানে মারা যায়। তবে শরণার্থী দলটির স্বেচ্ছাসেবক ক্ষিতীশ ঢালী মারা যান। একইভাবে চালনা বাজারে পলায়নপর শরণার্থীদের ওপর ১৮ মে হামলা চালানো হয়। সেখানে বেছে বেছে দশজন পুরুষ সদস্যকে হত্যা করা হয়।
চুকনগর গণহত্যা
খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী ভদ্রা নদীর কোলঘেঁষা ডুমুরিয়া উপজেলাধীন একটি স্থানের নাম চুকনগর। স্থানটি তখন তিনদিকে নদী দিয়ে ঘেরা ছিল। ভৌগোলিক অবস্থানজনিত কারণে এটি ছিল পলায়নপর মানুষের ট্রানজিট। বটিয়াঘাটা, দাকোপ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, মংলা, মোড়েলগঞ্জ প্রভৃতি এলাকা থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (হিন্দু) মানুষেরা বেশীরভাগই নদীপথে নৌকাযোগে, কেউ বা সড়ক পথে ভারতে পৌঁছনোর উদ্দেশ্যে এই স্থানে একত্রিত হয়। নদীপথেই আসা মানুষেরা এখানকার পাতাখোলা বিলসহ গোটা এলাকায় বিশ্রাম নেয়। নদীর পাশে ছিল মন্দির। তার পাশে বিশাল বটগাছ। আর অদূরেই বাজার। ১৯শে মে সকলেই এই চুকনগরে রাত্রিবাস করেন। এলাকাবাসীর তথ্যমতে, ২০শে মে সকালে সাতক্ষীরার অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প হতে তিনটি ট্রাক (লরি) এবং একটি খোলা জীপে করে সেনারা চুকনগর এসে পৌঁছোয়। প্রথমে সেনাবাহী লরি থামে চুকনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে হতে এক কিলোমিটার দূরের চুকনগর টু সাতক্ষীরা রোডের ঝাউগাছ তলায়, বর্তমানে যেখানে ফুয়েল পাম্প স্টেশন হয়েছে, তার পাশে। সেখানেই গাড়ি থেকে নেমে সেনারা তিন ভাগে ভাগ হয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। একটি দল যায় মাটির রাস্তা ধরে ঘ্যাংরাইল নদীর দিকে। সামনেই খেজুরডাঙ্গিতে অগণিত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। এগোলেই সামনে পড়ে মালতিয়া গ্রামের ৬৯ বছর বয়সী চিকন মোড়ল। তিনি ধান ক্ষেতে কাঁচি দিয়ে নিড়ানি দিচ্ছিলেন। পাকিস্তানী সেনাদের সাথে চিকন মোড়লের কথা হয়; দু’-এক কথার পর তা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। আচমকাই সেনারা চিকন মোড়লকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তিনি ধান ক্ষেতেই লুটিয়ে পড়েন। তিনি-ই এদিনের গণহত্যার প্রথম শহীদ। আর একটু এগোলে সেনাদের সামনে পড়ে চুকনগর বাজারের ব্যবসায়ী সুরেন কুন্ডু (৪০)। পরনে ধুতি, গায়ে গেরুয়া বসন, গলায় ছিল রুদ্রাক্ষের মালা। পাকিস্তানী সেনাদের বুঝতে সহজেই বুঝতে পারেন যে তিনি হিন্দু। তারা কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সুরেন কুন্ডুকে গুলি করে হত্যা করে।
এরপরই সেনা দলটি নেমে পড়ে পাতাখোলা বিলে। শুরু হয় ব্রাশ ফায়ার। পাতাখোলা বিলে তখন জোয়ার, তার মধ্যেও অনেকে দৌড়োনোর চেষ্টা করেছে, সামান্য পানিতেই ডুবে থেকে কোনোপ্রকারে শ্বাস নিয়েছে। সেনারা এরপর কিছুটা চালাকির আশ্রয় নেয়, তারা দূরে থাকা মানুষদের ইশারায় কাছে ডেকে সোজা লাইন করে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয় এবং একে একে গুলি করে হত্যা করে।
সেনাদের আর একটি দল হিন্দু পাড়ায় যায়। অধিকাংশ বসতবাড়িতে হিন্দু বাসিন্দাদের পরিবর্তে আশ্রয় নিয়েছিল শরণার্থীরা। সেনারা প্রথমে নন্দীপাড়ায় প্রবেশ করে। সেখানে চুকনগর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আশুতোষ কুমার নন্দী এবং সংলগ্ন হাজরা নন্দী এবং রাখাল কবিরাজের বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
নন্দীবাড়ীর পরে তাঁতী পাড়া, সেটি পার হলেই সরদারপাড়া। স্থানীয় মানুষদের কাছে সেটি বেহারা পাড়া বলে পরিচিত। এরা সবাই মুসলমান, পাল্কী বহন করা তাদের পেশা। সেনাদের তাঁতীপাড়ায় প্রবেশ করে আগুন ও হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠতে দেখে তারাও বিপদের গন্ধ আঁচ করতে পারে। তারা ধরে নেয়, সেনারা তাদের পাড়াতেও আক্রমণ করতে পারে। এ কারণে তারা দলবদ্ধভাবে পাকিস্তানের পক্ষে শ্লোগান দিতে থাকে। প্রাণ বাঁচাতে বহু শরণার্থীরাও তাদের সাথে মিলেমিশে শ্লোগান দিতে থাকে। সেনারা এলে কলেমা পড়া ও কেউ কেউ তাদের মুসলমানিত্ব প্রমাণ করার জন্যে কাপড় তুলে খতনা (লিঙ্গমুন্ডের অগ্রভাগের চামড়া ছেদন) করার প্রমাণ দেন। সেনারা তুষ্ট হয়ে ওই পাড়ার কাউকে কিছু বলে না, তবে তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্যে বিশেষভাবে হিন্দুপাড়ার পথঘাট চিনিয়ে দেয়ার স্বার্থে শেরআলী সরদার ও রতন সরদারকে সাথে নিয়ে যায়।
সেনাদের আর একটি দল শম্বুকগতিতে গাড়ি চালিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাজারের দিকে এগুতে থাকে। বাজারে পৌঁছাতে তাদের পনেরো থেকে বিশ মিনিট সময় লাগে। এরমধ্যে বাজারে অবস্থানরত স্থানীয় লোকজন এবং কিছু শরণার্থী পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সেনারা সরাসরি বাজারের খেয়াঘাটে চলে আসে। অনেকেই তখন নদী পার হয়ে নিরাপদ স্থানের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। নদীতে থাকা নৌকা বহরে প্রচুর মানুষ ছিল। সেনাদের উপস্থিতি টের পেয়ে অনেকেই নদীতে লাফিয়ে পড়েন। শুরু হয় গুলিবর্ষণ। গুলির আঘাতে নৌকাগুলো সব ঝাঁঝরা হয়ে যায়। এতে নৌকার ছিদ্রপথে পানি প্রবেশ করে যাত্রীসহ নৌকাগুলো একে একে ডুবে যায়।
নদীতীরে বুড়ো বটগাছ। অনেক মানুষ সেখানেও আশ্রয় নিয়েছিল। নৌকায় করে পাকিস্তানী সেনারা এসে তাদেরও হত্যা করে। চুকনগরের মালোপাড়ার বাবুরাম বিশ্বাস সেখানে মারা পড়েন। মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের তারা টেনে-হিঁচড়ে বুট দিয়ে চেপে ধরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। নির্মম অত্যাচারের পরও অনেকেকে গুলি করে হত্যা করে। বটিয়াঘাটার গাইন পরিবারের ৯ জন সদস্য এই মন্দিরেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।বিকেল চারটে-সাড়ে চারটের সময় তিন দলে ভাগ হওয়া পাকিস্তানী সেনাদের দলটি বাজারে এক জায়গায় জড়ো হয়। অনেকেই মনে করেন, তাদের গুলির মজুত ফুরিয়ে গিয়েছিল। এ কারণে লাগাতার হত্যাকাণ্ড তারা ইতি টানে। সেনারা স্থানীয় খাঁ মিয়াকে লাশগুলো অপসারণ করে জায়গাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলার নির্দেশনা দিয়ে আবারও যে পথে এসেছিল, সেদিকে ফিরে যায়।
সেই হত্যাকাণ্ডের লাশ ফেলেছিলেন অনেকেই। এদের মধ্যে চার জন হচ্ছেন কাওসার আলী, দলিল উদ্দীন, আনসার সরদার ও ইনছান সরদার। কাওসার আলী বলেন, এলাকার ওহাব মোল্লা তাদেরকে লাশগুলো ভদ্রা নদীতে ফেলার কথা বলে। বাঁশের মাঝে লাশ রেখে দুইজন টেনে আবার লাশের পা ধরে টেনে-হিঁচড়ে নদীতে ফেলা হয়। কাওসার আলীর ভাষায় ‘সারাদিন ধইরে লাশ ছাপ করতি পারিনি। রক্তে গাঙের পানি এয়েবারে রাঙ্গা টুকটুকে হয়ে গিলো।’
লাশের সংখ্যা দশ-বারো হাজারের কম হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের একজন বিয়াল্লিশ শ’পর্যন্ত লাশ গুনেছিল। আর গুনতে পারেনি। লাশের গন্ধে নদীর পানিতে দুর্গন্ধ হয়। অনেক লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল আশে-পাশের বিলে। চুকনগর কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়ও সেখানে হাড়গোড় পাওয়া যায়।
আউশখালির যুদ্ধবিধবারা
বটিয়াঘাটার আউশখালি গ্রামের বৈরাগী বাড়ির পাঁচ সদস্য চুকনগরে গণহত্যার শিকার হন। এই পাঁচজনের চারজন ছিলেন বিবাহিত। আবার তিন জনের কোলে ছিল শিশু সন্তান। চার যুদ্ধবিধবার এই বাড়িটি বিধবাদের বাড়ি বলে পরিচিত। (২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর ছবির তিন জন বিধবার সাথে কথা বলেন লেখক)

এই বিধবাদের একজন বিলাসিনী বৈরাগী। ঘটনার সময় তার বয়স হবে আঠেরো কি বিশ। বিলাসিনী বৈরাগী বলেন, ‘বিয়ের পর বছর খানেক গেছে। ছেলে-পুলে হয়নি। দেশে যুদ্ধ লাগলো। স্বামী-ভাসুর-দেবর-জা-দের সাথে ভারতে আশ্রয় নেয়ার জন্য বাড়ি ছাড়ি। নৌকোয় করে চুকনগর যাই। সেইখানে সকালের রান্না বসাইছিলাম। হঠাৎ করেই গুলির শব্দ। গাড়ির হুইসেল। মিলিটারীরা আমাদের উপর গুলি করা শুরু করলো। ওইখানে তহোন (তখন) অনেক মানুষ। যেদিকে চোখ যায়, শুধু মানুষ দেহিছি (দেখেছি)। গুলি লাইগে সেই মানুষগুলো মাটিতি পড়তি লাগলো। আমার স্বামী পুলিন বৈরাগীও গুলি খাইয়ে মারা গেল। সেই ব্যথা বুকি নিয়ে আজও বাঁইচে আছি। আর বিয়ে করিনি। বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে খাই। কাঁদতে কাঁদতে চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। এখন আর কাজ করতি পারিনা। দেবরের ঘরের বারান্দায় রাত কাটাই। তারাই খাতি দেয়। সরকার থেকে বিধবা ভাতা দেয়। মাসে ৩০০ টাকা।’
স্বামী কিরণ বৈরাগীকে চোখের সামনে মরতে দেখেন, বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া ঊষা রানী বৈরাগী। কোলে তখন তার তিন বছরের শিশু কন্যা বিজলী। কম বয়সে স্বামীকে হারিয়ে নিজে বিধবা হয়েছেন। শিশু কন্যা বিজলীকে বড় করেছেন। তাকে বিয়ে দিয়েছেন। নিজে আর বিয়ের চিন্তা করেননি।
মাত্র চার মাসের শিশু কন্যাকে বুকে আগলে রেখে পাকিস্তানী বাহিনীর হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান, রেণুকা রাণী বৈরাগী। মেয়ে সন্ধ্যা রাণীকে কোলে পিঠে করে বড় করে তুলেছেন। বিয়ে দিয়েছেন ডুমুরিয়া উপজেলার হাজিডাঙ্গা গ্রামে। নিজে আছেন স্বামীর ভিটেয়। জমি-জমা বলতে কিছু নেই। পরের বাড়িতে কাজ করে দিন গুজরান করেন। তবে এখন কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন।
ঝাউডাঙ্গা গণহত্যা
কলারোয়ার ঝাউডাঙ্গায় ঘটে চুকনগরের মতোই গণ-হত্যার ঘটনাটি। চুকনগর গণহত্যার পরদিন ২১ মে। চুকনগর পার করে যে মানুষগুলো আগে চলে গিয়েছিলেন তারাই ওই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। শরণার্থীদের মিছিল চুকনগর থেকে কেশবপুরের ত্রিমোহিনী হয়ে দিনের বেলা বারোটা-একটার দিকে তপ্ত রোদের মধ্যে কলারোয়ার ঝাউডাঙ্গায় পৌঁছোয়। সেই শরণার্থীরা পাকিস্তানী সেনাদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়।
ডাকরার গণহত্যা
প্রতিদিনের মত স্বাভাবিকভাবেই ২১ মে’র দিনটি শুরু হয়েছিল। তবে ডাকরাবাসীর মনে এক অজানা ভীতি বাসা বেঁধেছিল। আগের দিন ২০ মে বৃহস্পতিবার শান্তি বাহিনীর সদস্যরা পাশের গ্রামে সভা করে নানা উত্তেজক কথাবার্তা বলে। তাদের লক্ষ্য ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী। বাগেরহাটের নানা অঞ্চলে হিন্দু নিপীড়ন শুরু হওয়ার ফলে বৃহস্পতিবার রাতে ডাকরা বাজারের মন্দির ও আশেপাশের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
২১ মে সকাল থেকেই নৌকায় করে কিছু মানুষ নিরাপদ জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বেশীরভাগ মানুষই রয়ে যান। সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী ডাকরার বাসিন্দা পরিতোষ কুমার ব্যানার্জীর মতে, প্রায় চার থেকে পাঁচশো নৌকার যাত্রী বাজার ও মন্দির এলাকার ঘাটে অপেক্ষা করছিল। যারা এসেছিল ষায়েড়া, খানপুর, বাঁশবাড়িয়া, সাড়ে চারআনি, বেতকাটা, ভোজপাতিয়া, মহিষঘাটা প্রভৃতি এলাকা থেকে। অনেকগুলো নৌকা ছিল মাঝ নদীতে। নৌকাবাসীরা খাওয়ার জন্যে নদীতীরের ফাঁকা জায়গায় রান্না করছিল। অনেকে কাপড়-চোপড় শুকোতে দিয়েছিল। বেলা দুটোর দিকে হবে। বেশ কয়েকটি বড় নৌকা আসতে দেখা গেল। সকলেই ধরে নিয়েছিল এগুলোও কোন শরণার্থীদের নৌকা হবে। নৌকার বহরটি ডাকরার পূর্বদিকের খালের কাছে সামান্য সময়ের জন্যে অপেক্ষা করে। পরে কয়েকটি নৌকা কালিবাড়ির সোজাসুজি নদীর উত্তরপাড়ে কালিগঞ্জ বাজারের ঘাটের কাছে ভেড়ে। বড় তিনটি নৌকা আরও এগিয়ে এসে কালিবাড়ি পিছনে রেখে মাদারতলী শাখা নদীতে গিয়ে ভেড়ে। এলাকাটিকে প্রায় ঘিরে এভাবে নৌকাগুলোর অবস্থান নেওয়ায়ও মানুষের মনে সন্দেহ তৈরি হয়নি।
কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই এর রহস্য স্পষ্ট হলো। শুরু হলো গোলাগুলি, ধারালো অস্ত্রের আক্রমণ। মানুষকে একের পর এক হত্যা। আত্মরক্ষার জন্যে মানুষ মরিয়া হয়ে পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেইসব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। লুকিয়ে থাকা মানুষগুলোকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে হত্যা করা হয়েছে।
একাত্তরে শান্তি (পিস) কমিটির বাগেরহাট শাখা প্রধান রজব আলি ফকিরের নেতৃত্বে ডাকরার এই গণহত্যা পরিচালিত হয়। সেদিন প্রধানতঃ কিশোর থেকে শুরু করে বয়সী পুরুষদের হত্যা করা হয়েছিল। লুটে নেওয়া হয়েছিল অস্থাবর সম্পদ। মেয়েদের ওপর বেপরোয়া নির্যাতন করা হয়। বেশ কয়েকজন নারীকে তারা তুলে নিয়ে যায় যাদেরকে আর কোনদিন ফিরে পাওয়া যায়নি। অন্যান্য গণহত্যার মত এই ঘটনার ও নিহতদের সংখ্যা সঠিকভাবে জানা যায় না। ডাকরাবাসী ছাড়াও সেদিন নিহত হন শরণার্থীরাও।
দেয়াড়া (দিঘলিয়া)
খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার দেয়াড়া গ্রামে একই পরিবারে ৬ জনসহ ৬০ জনকে তিনটি পৃথক স্থানে হত্যা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুর রহমান তাঁর দলবল নিয়ে দেয়াড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে অবস্থান করছে, এমন সংবাদের ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের ২৭ আগস্ট ভোররাতে কয়েকশ’ রাজাকার, বিহারী ও পাকিস্তানী সেনারা সম্মিলিতভাবে দেয়াড়া গ্রামটি ঘিরে ফেলে। তারা একই পরিবারের ৬ সদস্য ডাঃ মতিয়ার রহমান, তার চাচাতো ভাই পিরু ও আলী, ভাগ্নে ছোট খোকা, জামাই আব্দুল জলিল, সহোদর আব্দুল বারিকসহ ঐ গ্রামের ৬১ জনকে ধরে নিয়ে যায়। সকাল ৯ টার দিকে এদেরকে প্রকাশ্যে দেয়াড়া গ্রামের পৃথক তিনটি স্থানে গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হয়। মৃত্যুবরণ করেন ৬০ জন। রাজাকাররা ৬০টি লাশের মধ্যে ২২টি লাশ পৃথক তিনটি স্থানে গণকবর দেয় এবং বাকী লাশগুলো পার্শ্ববর্তী ভৈরব নদে ছুঁড়ে ফেলে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ধারালো অস্ত্রের একাধিক আঘাতের পরেও সৈয়দ আবুল বাশার একমাত্র ব্যক্তি যিনি ১৯টি ক্ষতচিহ্ন নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন।

শাঁখারীকাঠির গণহত্যা
বাগেরহাট জেলাধীন কচুয়া-মোড়েলগঞ্জের সীমান্তবর্তী শাঁখারীকাঠিতেও একটি গণহত্যার ঘটনা ঘটে। একাত্তরের শেষ অথবা নভেম্বরের শুরুর দিককার কোন এক শুক্রবার, দিনটি ছিল শাঁখারীকাঠির সাপ্তাহিক বাজারের দিন। স্থানীয় লোকদের কথায় হাটবার। শাখারীকাঠি বাজারটির পাশ দিয়ে একটি খাল বয়ে গেছে। এই খালটি কচুয়া এবং মোড়েলগঞ্জের মধ্যে সীমান্তরেখা। খালের ওপর একটি সেতু। যা দুই এলাকার মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখে। খালের একপাশে শাঁখারীকাঠি, এটি কচুয়া উপজেলার সীমানায়; অপর পাড়ে দৈবজ্ঞহাটি, মোড়েলগঞ্জের সীমানায়। দৈবজ্ঞহাটিতে ছিল রাজাকারের আস্তানা। তখন সেখানে ছিল রাজাকার রজব আলী বাহিনীর দাপট। যুদ্ধাবস্থা হলেও দিনটিতে সেখানে অনেক লোক জড়ো হয়। তখন সেখানে ছিল রাজাকার রজব আলী বাহিনীর দাপট। হঠাৎ করেই বাজারে বারো-চৌদ্দ জনের রাজাকারদের একটি দল উপস্থিত হয়। তারা বাজারটির উত্তর-দক্ষিণ বরাবর দাঁড়ায়। তারা বেছে বেছে হিন্দু ধর্মালম্বীদের এক জায়গায় জড়ো করে। তাঁদের পরনের ধুতি খুলে একসঙ্গে দু’জন করে বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়।
এদেরকে মেরে ফেলার প্রস্তুতি দেখে হোসেন জমাদ্দার ও কালো মুন্সি নামের দুই ব্যক্তি রাজাকারদের বেশ অনুনয়-বিনয় করে মানুষগুলোর প্রাণভিক্ষা চায়। তারা তাদের কথায় কর্ণপাত না করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো মানুষগুলোকে গুলি করে হত্যা করে। গুলি খেয়ে সকলে খালের মধ্যে পড়ে যান। মনোহর দাশ নামের এক তরুণও ওই দলে ছিলেন। তিনিও খালের মধ্যে পড়ে যান। তবে কোন কারণে তার শরীর গুলিতে বিদ্ধ হয়নি। তিনি কোনরকমে নাকটি পানির ওপরে তুলে ভেসেছিলেন। ঘন্টা দুয়েক এভাবে থাকার পর সবকিছু থেমে গেলে, চারিদিকে আঁধার হয়ে গেলে তিনি ডুব দিয়ে মোড়েলগঞ্জের পাড়ে গিয়ে ঝোপের মধ্যে লুকিয়েছিলেন। পরে এপারে আসেন। এলাকাবাসীর মেতে, সেদিন সেখানে মোট ৩৩ জনকে হত্যা করা হয়েছিল।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
মুক্তিযুদ্ধের দিনপঞ্জি ঘেঁটে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও এদেশীয় দোসরদের সম্মিলিত আক্রমণের কার্যকর ও পরিকল্পিত প্রতিরোধটি শুরু হয় জুলাই মাস থেকে। এর আগে ২৫ মার্চ ও এর কাছাকাছি সময়ে যেসব প্রতিরোধের ঘটনা ঘটে তা ছিল তাৎক্ষণিক। যুদ্ধের সময়কাল ছিল ৯ মাস। এই সময়ের মধ্যে ৩০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে। সরকারি হিসেবে দুই লাখ আর বেসরকারি হিসেবে চার লাখ নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এক কোটিরও বেশী মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এর দ্বিগুণেরও বেশী মানুষ স্বদেশে উদ্বাস্তুর ন্যায় বিড়ম্বিত জীবন-যাপন করেছেন। অন্তত:পক্ষে ২০ লাখ মানুষ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জনপদ ধ্বংস হয়েছে, সম্পদ লুণ্ঠিত হয়েছে। মাত্র ৯ মাস সময়কালে এখানে সংগঠিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ স্মরণকালের ইতিহাসে তুলনাহীন। যুদ্ধের সময় মানবতার বিরুদ্ধে সংঘঠিত অপরাধের অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করবার জন্যে জরুরি হচ্ছে, দোষীদের যথাযথ বিচার ও শাস্তি। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইন’ প্রণয়ন করেন।
প্রসঙ্গত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে দুনিয়াজোড়া আলোড়িত আদালত বসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির নুরেমবার্গে। মিত্রদেশগুলো নাৎসী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে ১৯৪৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইবুনাল গঠন করে, যা ন্যুরেমবার্গ ট্রাইবুনাল নামে বেশি পরিচিত। এর পাশাপাশি জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে গঠিত হয় টোকিও ট্রাইবুনাল। এই ট্রাইবুনালে বিচার্য অপরাধসমূহকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে: যুদ্ধাপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশনে গণহত্যার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়— ‘সামগ্রিকভাবে অথবা আংশিকভাবে কোন জাতিকে, কোনো সম্প্রদায়কে বা কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার উদ্যোগ।’
১৯৪৯ সালে জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে সাধারণ নীতিমালা গৃহীত হয়। যা ১৯৭২ ও ১৯৮৪ সালে আরো কিছু বিষয় সংযোজনের মাধ্যমে অধিকতর স্পষ্ট করে বলা হয় যে, কোন দেশের অভ্যন্তরেও যদি কোন জনগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্যোগ নেওয়া হয় সেটা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এর বিচার যে কোন দেশে অনুষ্ঠিত হতে পারবে। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধ যে দেশে সংঘটিত হয়েছে সে দেশে সম্ভব না হলে অন্য যে কোন দেশেও এর বিচার হতে পারে।
অনেক দেরিতে হলেও, স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ তারিখে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইনের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সরকার ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল’ গঠন করে। এই ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ কুড়ি জনেরও বেশী সদস্যকে সর্বোচ্চ সাজা (মৃত্যুদণ্ড) ঘোষণা ও কার্যকর করা হয়েছে। তবে এই ট্রাইবুনালের কার্যক্রম জেলা বা উপজেলাস্তরে সম্প্রসারণ করার পরিবর্তে ট্রাইবুনালের কার্যক্রম সঙ্কুচিত করা হয়েছে। এমনকি, ট্রাইবুনালে যেসব সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্র তাদেরকে সর্বাত্মকভাবে সুরক্ষা দিতে সক্ষ্ম হয়নি,অনেক সাক্ষীই যুদ্ধাপরাধীদের অনুসারী-সমর্থকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। তবে কি রাষ্ট্র আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চাইছে না! দেশের সাধারণ নাগরিক তা মানতে নারাজ। তাঁরা মনে করেন, শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধী নয়, যুদ্ধাপরাধ যে রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সিদ্ধান্তে কার্যকর হয়েছে, ওই সংগঠনকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে। নচেৎ বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত এই দেশটি আবারও ধর্মান্ধতার পাঁকে নিমজ্জিত হবে।
শান্তি (পিস) কমিটি
একাত্তরের ১০ই এপ্রিল খুলনায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির প্রথম বৈঠকে ২৫ মার্চ ভয়াবহতম নরহত্যাযজ্ঞের জন্য পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে ধন্যবাদ জানানো হয়। জামায়াতে ইসলামী নেতা মাওলানা একেএম ইউসুফ শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন। শান্তি কমিটি গঠনে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর বিশেষ ভূমিকা রাখেন। শান্তি কমিটি সম্পর্কে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকার ২৭ জুলাই ১৯৭১ সংখ্যায় লেখা হয়, শান্তি কমিটি পাকিস্তানের চর হিসেবে কাজ করতো। তারা হিন্দু এবং স্বাধীনতাপন্থীদের খবরাখবর দিতো। শান্তি কমিটির সদস্যরাই রাজাকারদের সংগ্রহ করে। ‘To help control of Bengali population, the army has been setting up a network of peace committees superimposed upon the normal civil administration, which the army cannot fully rely upon. Peace committee members are drawn from —-Beharis and from the Muslim Leagues and Jamat-e-Islami. The peace committees serve as the agent of army, informing on civil administration as well as on general populace. They are also in charge of confiscating and redistribution of shops and lands from Hindu and pro-independence Bengalis. The peace committee also recruits Razakars —-many of them are common criminals who have thrown their lots with the (Pakistan) army, (The Wall Stree Journal, July 27, 1971).
প্রচ্ছদঋণঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ
*****
(পড়ুন চুকনগর গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী চিকন মোড়লের ছেলে এরশাদ আলী মোড়লের কথা)