ভোর হবার আগেই কাকেরা দল বেঁধে চেঁচাতে লাগল। তাদের ডাক শুনে ঘর থেকে ধরফর করে বেরিয়ে এল বনমোরগ, ‘কিরে, তোরা আজকে আমারও আগে উঠে পড়লি? ব্যাপার কি?’
কাকেরা অতি উৎসাহে সবাই মিলে হরবর করে কি যে বলতে লাগল বনমোরগ কিচ্ছু বুঝতে পারল না। সে বলল- ‘দাঁড়া দাঁড়া বাপু, সবাই মিলে বললে কি কিছু বোঝা যায়? একজন বল।’
‘আচ্ছা তাহলে বড়দা বলুক’।
কাকেদের দলের একমাত্র দাঁড়কাকটিকেই সবাই বড়দা বলে ডাকে। দাঁড়কাক এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে মনের সুখে ঘাড় চুলকোচ্ছিলো। হঠাৎ নিজের নাম শুনে সোজা হয়ে বসল। তারপর চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আমিই বলছি তাহলে শোনো। আজ তো ঘুমটা একটু তাড়াতাড়িই ভেঙে গেল। ভাঙতেই দেখি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কে যেন টর্চের আলো ফেলছে আমার বাসায়। ভাবলাম কে ফেলছে টর্চের আলো? ব্যাপারটা ইনভেসটিগেট করতে হচ্ছে। আমার গা টা ছমছম করতে লাগল। তাও সাহস করে মগডালে উড়ে গিয়ে দেখি কি জানো? টর্চ মারছে না কেউ। পূর্ণিমার চাঁদের আলো পাতার ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে আমার বাসায়।’
একটা কাক বিরক্ত হয়ে বলল- ‘আহ্ বড়দা, তুমি না খুব বাজে বকো! আসল কথাটা একটু তাড়াতাড়ি বলবে?’
‘দাঁড়াও বাপু, সব কথা ওরকম হুটোপুটি করে হয় না। সব গল্পের একটা বিগিনিং, মিডল, এন্ড আছে।’
‘তোমাকে কেউ গল্প বলতে বলেছে? যেটা আমরা বলতে এসেছিলাম ধানাই পানাই না করে সেটা বলো আগে।’
দাঁড়কাক মুখ ভার করে বলে- ‘আজকে সকালে কোকিলকে দেখা গেছে। জ্যোৎস্নায় স্নান করতে করতে গুনগুনিয়ে গান করছিলো।’
বনমোরগ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল- ‘ঠিক দেখেছিস? অন্ধকারে ভুল দেখিসনি তো?’
দাঁড়কাক রেগে গিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে বলল- ‘না হয় অন্ধকারে ভুল দেখেছি। গানটাও কি ভুল শুনেছি? কোকিলের গলা কি কেউ ভুল করতে পারে?’
‘তাহলে আর দেরি করো না হে। চলো সবাই মিলে প্রস্তুতি নিতে থাকি। এতদিন পর কোকিল ফিরল আর আমরা তাকে ভালো করে আদর-আপ্যায়ন করতে পারব না? এটা কি ঠিক হবে?’
তখন তারা সবাই মিলে ডেকে ডেকে অন্যদের ঘুম ভাঙাতে লাগল। শীতের ঠাণ্ডা কমিয়ে বসন্ত এসে গেছে বনে। কোকিল আসা মানেই তো বসন্ত আসা। এ বড় উৎসবের দিন।
কোকিলকে সব পাখিরাই খুব শ্রদ্ধাভক্তি করে। করবে না? কোকিল যে তাদের সবার থেকে খুব আলাদা। সবাই একই বনে বন্ধুদের সাথে, বাবা-মা, ভাই বোনদের সাথেই কাটিয়ে দেয়। আর কোকিল? কোনো এক জায়গায় বেশিদিন তার মনই টেকে না। এক বনে কিছুদিন থেকেই সে একদিন কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে ফুরুৎ করে পালিয়ে যায়। তারপর মাইলের পর মাইল উড়ে বনের পর বন পেরিয়ে কোথায় যে সে থামে আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। মনের মধ্যে যেনো তাদের ভয়-ডর বলে কিছু নেই। আগের বার দাঁড়কাক সাহস করে বলেই ফেলেছিল- ‘হ্যাঁ গা, অচেনা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে তোমার বুঝি ভয় করে না?’ কোকিল মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিল- ‘তা মাঝে মাঝে লাগে বটে। কিন্তু তারপর যখন দেখি বরফের পাহাড়কে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, যখন বিরাট বিরাট ঝরনা, মানুষের তৈরি প্রকাণ্ড সব ঘর বাড়ি দেখি তখন আনন্দে আমার সব ভয় বেলুনের মতো উড়ে উড়ে কোথায় চলে যায়…’
‘মানুষের তৈরি বাড়ি দেখতে তোমার বুঝি খুব ভালো লাগে? শুনেছি সেসব নাকি ভারি বিশ্রী! আবার বারান্দার মধ্যে খঁচা ঝুলিয়ে তারা নাকি পাখিদের আটকে রাখে!’
এই শুনে কোকিল হেসে ফেলে- ‘হ্যাঁ, তা হয় বটে। কিন্তু আমি সেইসব বাড়ির কথা বলছি না। আমি বলছি তাজমহলের কথা, চীনের প্রাচীরের কথা… ওসব জায়গায় গেলে তোমরা একেবারে অবাক হয়ে যাবে।’
দাঁড়কাক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- ‘থাক বাপু, আমাদের ভাগ্যে কি সেসব আছে? আমরা হলুম সাধারণ পাখি! নতুন কিছু করার সাহসও নেই, ক্ষমতাও নেই।’
কোকিল তখন তার লম্বা লেজ নাড়ায়, বলে- ‘ওসব কিচ্ছু লাগে না ভায়া। আসল হল স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে। নিজের স্বপ্নকে কখনও হারিয়ে যেতে দিও না। যতই খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাও না কেনো, স্বপ্নটাকে নিজের ছানার মতো দেখভাল কোরো।’
শুনে কাকেরা মহা উৎসাহে নিজেদের স্বপ্নের কথা বলে। একজন বলে- ‘আমি প্রতিদিন স্বপ্ন দেখি শেয়ালের রান্নাঘর থেকে এক স্লাইস পাঁউরুটি চুরি করে আনছি। দেখো, একদিন আমি ঠিক চুরি করে আনবো।’ আরেকজন বলে- ‘আমি ছানাটাকে তিনবেলা ভালো করে খাইয়ে দিতে চাই। যাতে বড় হয়ে ওর বাজপাখির মতো তাগড়াই চেহারা হয়। আহা তখন সবাই ওকে কত সম্মানই না করবে! বাজপাখির মতো ডানা মেলে যেদিন ও ওই উঁচুতে উড়ে বেড়াবে সেদিন আমার বুকটা জুড়াবে।’ কোকিল গলা নামিয়ে বলল- ‘বাজপাখি খুব একা, তা জানো তো?’ কাকটা বলে- ‘তা হোক। একা বলেই তো তাকে ওত ভালো লাগে। বাজপাখি একটা দুটো থাকাই ভালো।’ তখন কোকিল বলে- ‘না না না, আমি তা বলছি না। বলছি বাজপাখির কোনো বন্ধু নেই।’ কাক উত্তর দেয়- ‘ওমন একটা পাখি হতে পারলে বন্ধুবান্ধব বেশি থাকার দরকার কি বলো তো! বন্ধু হলেই বরং বিপদ। আমাদের দেখো না এত্ত বন্ধু! আমাদের কোনো দাম আছে, তুমিই বলো?’ কোকিল তার কিছু উত্তর দিতে পারেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে ছিল।
কাক আর বনমোরগ গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে দিল সবার ঘুম ভাঙিয়ে। যারই ঘুম ভাঙে খবর শুনে সেও জুড়ে যায় কাকেদের সাথে। সবার আনন্দে, উত্তেজনায় গোটা বন একেবারে ম’ম করতে থাকে। বাদ সাধে একমাত্র টিয়াপাখি। টিয়াপাখির খুব দেমাক, সে সুন্দরী বলে পাদুখানা যেন মাটিতেই পড়ে না। জিপ করে ধুলো উড়িয়ে বেড়াতে আসা মানুষজন তার সবুজ শরীরের দিকে যখন হাঁ করে দেখে, তখন তার বাঁকা লাল ঠোঁট অহঙ্কারে আরও লাল হয়ে ওঠে। সেই অহংকারই কাল হয় কখনও কখনও। যেমন হয়েছিল তার বড়দিদির। তিনবছর আগে দুষ্টু মানুষের ফাঁদে সে পা দিয়ে ফেলে। তারপর সারা জীবন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে ছোট্ট খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকতে হয় সারাজীবন! অবশ্য তাতে তার খুব দুঃখ আছে বলে মনে হয় না। মানুষগুলো যখন খাঁচার চারপাশে হামলে পড়ে তাকে দেখে মুখ দিয়ে নানারকম শব্দ করে আদিখ্যেতা করে তখন টিয়া যতই গম্ভীর মুখ করে থাকার চেষ্টা করুক না কেনো, মনে মনে ভারী খুশি হয়।
এত অহঙ্কারের জন্য কোনো পাখির সাথেই টিয়ার ভালো বন্ধুত্ব নেই। সবাইকেই সে নীচু চোখে দেখে। তবে সব চাইতে অপছন্দ করে কাকেদের। সুযোগ পেলেই সব্বার কাছে কাকের নামে অভিযোগ করে। তারা নাকি খুব কালো, দেখতে খুব খারাপ, তারা নাকি যেখান সেখান থেকে ছাইপাশ খেয়ে বেড়ায়, এমনকি এমনও বলে যে কাকেরা পৃথিবীতে না থাকলেই বোধহয় ভালো হত! এসব শুনে কাকেরা খুব কষ্ট পায়, মাঝে মাঝে কাঁদে। কাঁদবে না? তারা সবার জন্য কত কিছু করে অথচ কেনো যেন কেউই তাদের সম্মান করে না।
কাকেরা চোখ মুছে ভাবে এই হয়ত স্বাভাবিক! তারা তো আর টিয়া বা ময়ূরের মত সুন্দর না, কোকিলের মতো সাহসও তাদের নেই। তারা খুব সাধারণ মেহনতী পাখি, সারাদিন কাজ করে, দল বেঁধে থাকে, খুব উঁচুতে উড়তেও পারে না। অল্প জায়গার মধ্যেই ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। তবে এসব ছাড়াও তাদের একটা মুশকিল আছে। তারা ভালো করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। গল্পটি যতই ভালো হোক না কেন, বলার ধরন দেখে সবাই বিরক্ত হয়ে ওঠে।
আজ কাকেরা টিয়াপাখিকে ডাকতেই টিয়া মুখঝামটা দিয়ে উঠল- বেরো এখান থেকে, নইলে তোদের একদিন কি আমার একদিন!
কাকেরা মুখ ভার করে বলে- ‘চলে যাচ্ছি, তবে কোকিল এসেছে- এই খবরটা তোমাকে জানিয়ে রাখলুম! পরে আবার বোলো না যেন যে কেউ তোমায় খবর দেয়নি!’
টিয়া বলল- ‘ওমা! কোকিল এসেছে? কই আমার সাথে দেখা করল না তো! আমি বাপু ঘরে বসে থাকি, দেখি সে কখন আমার সাথে দেখা করতে আসে!’
কিছুক্ষণ পর বনের সমস্ত পাখিরা কোকিলকে ঘিরে জড়ো হয়ে এল! সবাই নিয়ে এল একটা করে ফুল। সেই ফুলের পাহাড়ের ওপর বসে কোকিল বলল- ‘বলো ভায়া, তোমাদের খবর কি?’
দাঁড়কাক বলে- ‘খবর খুব খারাপ ভায়া, সময় খুব খারাপ! আর ক’দিন যে এই বনটা আস্ত থাকবে তা কে জানে! সকালে সূর্যের দিকে তাকাও দেখবে কেমন ফ্যাকশে হয়ে গেছে, রাতে চাঁদের দিকে তাকাও দেখবে…’
দাঁড়কাক শেষ করতে পারল না, একটা ফচকে টাইপের ফিঙে পাখি চোখ টিপে মেরে বলল- ‘অ্যায় শুরু হল!’
তখন দাঁড়কাক অভিমান করে বলে- ‘বেশ আমি আর কোনো কথা বলব না তাহলে! তোমরাই বলো বরং।’
ফিঙে পাখি বলে – ‘না না, লেকচারটা শেষ করে নাও। তোমার লেকচার শুনতেই তো আমরা এখানে জড়ো হয়েছি!’
ফিঙের কথায় সবাই হেসে উঠল। হাসল না শুধু পায়রা! ঝগড়া-ঝামেলার সম্ভাবনা দেখলেই পায়রার বুক কাঁপে। সে শুধুই শান্তি চায়। শান্তির খোঁজে সে এক বেলা উপোষ পর্যন্ত করতে রাজি। এমনকি মারামারি, কামড়াকামড়ির প্রতিবাদে দু’একবার সে মগডালে উঠে অনশনেও বসেছে। কিন্তু হায়রে, সে উপোষ করলেই যদি সব মারামারি বন্ধ হত!
ফিঙের কথায় সিঁদুরে মেঘ দেখে পায়রাপাখি তাড়াতাড়ি বলল- আমরা বড়দার কথা অবশ্যই শুনব, কিন্তু তার আগে কোকিলভাই একটু নতুন অ্যাডভেঞ্চারের গল্পগুলো করবে না? সেই যে অতলান্তিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে কিভাবে তুমি বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেলে আটকে পড়েছিলে! কিভাবে তুমি সেখান থেকে বেঁচে ফিরলে! বলো না সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া গল্পগুলো!
কোকিল তখন মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে- ‘হুম, সে এক অভিজ্ঞতা বটে! কিন্তু সে গল্প তো আগেই বলেছি! আজকে তোমাদের অন্যরকম ঘটনা বলব। তোমরা তো ছোট্ট এই জঙ্গলের বাইরে কখনও যাওনি! যদি যেতে, দেখতে পেতে পৃথিবীর কত জায়গায় নদী শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, আজকের ঘন জঙ্গল কালকে হয়ে যাচ্ছে মরুভূমি, যেখানে ক’দিন আগে অবধি খুব বৃষ্টি হত সেখানে এখন মাটি ফেটে চৌচির- একফোঁটা জলও পাওয়া যাচ্ছে না। ‘হা বৃষ্টি, হা বৃষ্টি’ করতে করতে কত চাতক পাখিকে আমি টুপটাপ শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়তে দেখলুম! আর ওদিকে দেখো, ধুপধাপ গাছ কেটে মানুষেরা দেদার শহর বানাচ্ছে, সেসব শহরের কি ঠাঁটবাট, বাপরে! বড়বড় বাড়ি, দামি দামি গাড়ি, ঝকঝকে শমিং মল! নেই শুধু আমাদের থাকার একটু জায়গা। তোমাদের এই বনও যে কতদিন থাকবে তা কেউ বলতে পারে না! একবার মানুষের নজর পড়লেই ব্যস, কয়েক মাসেই গোটা জঙ্গল ফুটবল মাঠের মতো সাফ হয়ে যাবে।’
সব পশুপাখি তখন একসাথে বলল- ‘ওমা গো, তাহলে আমরা যাবো কোথায়?’
কোকিল বলল- ‘যাওয়ার কোথাও নেই রে ভাই! সেই গল্পই তো বলব! একদিন উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে আমি একটা পাইন গাছে গিয়ে বসেছি, ভাবলাম ঘণ্টাখানেক জিরিয়ে নিয়ে যাব উত্তরদিকে যমুনা নদীর তীরে। এক বন্ধু মাছরাঙার বাসায় কয়েকদিন ছুটি কাটিয়ে আসব। তো পাইন গাছে বসে আছি, ঠিক সেইসময় পাশের গাছে এসে বসেছে আরেকটা পাখি। তার রূপ দেখে আমি তো চোখের পলক ফেলতে পারি না, কি সুন্দর পাখি! কিন্তু মুখে তার হাসি নেই। মনমরা হয়ে বসে আছে। আমি তাকে গিয়ে বললাম- এই যে, তোমার বুঝি মনখারাপ? বলতেই তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদার পর বলল- “শুনতে চাইছো যখন শোনো তাহলে! বাংলাদেশের দক্ষিণে এক জায়গা আছে, তাকে বলে সুন্দরবন। সেখানেই আমরা থাকতাম। মানুষের ঝঞ্ঝাট, গাড়িঘোড়ার আওয়াজ, ধোঁয়াধুলো থেকে অনেক দূরে সমুদ্রের পাশে সেই জায়গা। সকাল সন্ধ্যে সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় পাখা মেলে উড়ে বেড়াতে আমার কি যে ভালো লাগত! কিন্তু কপালে যে আমার সুখ নেই! কয়েক বছর ধরে একটু একটু করে সমুদ্র কেবল রাক্ষসের মতো বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে একসময় আমাদের গাছগুলোকেও গিলে ফেলল। আমরা তখন পিছোতে পিছোতে মানুষের বসতির কাছাকাছি চলে এসেছি। এসে দেখি কি জানো? সে এক ভয়ানক অবস্থা। মানুষের মধ্যেই কত ভাগ! একদল মানুষ মোটে খেতেই পায় না! আরেকদল মানুষ খায় বেশি বেশি। ফেলে ছড়িয়ে নষ্ট করে। যারা খেতে পায় না, তারা আর কি করবে- কখনও রাস্তায় বসে হাত পাতে, কখনও খিদের চোটে যা পায় তাই খায়। এরকমই একটা লোক একদিন আমার বাবা, মা আর ছোট্ট বোনটাকে ধরে ফেলল। আসলে বাজার থেকে তো তার কিছু কিনে খাওয়ার টাকা নেই। তাই সে ফাঁদ পেতে পাখি ধরে, পাখি রান্না করে ভাত দিয়ে মেখে খায়। সে কি কষ্টের কথা ভাই, চোখের সামনে আমার মা বাবা আর বোনটাকে রান্না করে লোকটা খেয়ে ফেলল। আমি একটা পেয়ারা গাছের ডালে বসে সারাক্ষণ কাঁদলুম আর কষে অভিশাপ দিলুম। বলব কি ভাই, আমার অভিশাপ যে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল! রাত হতেই লোকটার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল গো! শুধু কি তার? তার থেকে ছড়িয়ে পড়ল বাড়ি শুদ্ধু সক্কলের। তারপর হল তাদের পাড়ায়, ছড়াতে ছড়াতে গোটা এলাকার সমস্ত লোকের জ্বর হতে লাগল। বাচ্চাবুড়ো কেউ বাদ গেল না। তারা সব এক-এক করে হাসপাতালে যায়, কেউ কেউ ভালো হয়, কেউ আর ফেরে না। যারা ফেরে না, তাদের বাবা-মা-বন্ধুবান্ধব হাত পা ছড়িয়ে কাঁদে। সেই কান্না দেখে শেষে আমারও এমন দুঃখু হল যে আমি একটানা উড়তে উড়তে এইখানে চলে এলাম। আসার সময় কি দেখলাম জানো? দেখলাম গ্রাম থেকে গ্রামে অসুখ ছড়াচ্ছে, শহর থেকে শহরে, দেশ থেকে দেশে…”। পাখিটার কথা শুনে আমার তো গা হাত পা হিম হয়ে গেছে! ভাবলাম, আরে! এর অভিশাপ যদি আমার গায়েও লাগে! তাহলে তো কেলেঙ্কারি ব্যাপার হবে! সেই ভেবে অল্প অল্প সান্তনা দিয়ে কি এক ছুতোয় আমি চটপট কেটে পড়লাম।’ বলে কোকিল খুব একচোট হাসল।
কাকেরা চোখ ছলছল করে বলল, ‘সেকি কোকিল ভায়া, এই দুঃখের দিনে তুমি ওর পাশ থেকে সরে গেলে? একটা পাখি আরেকটা পাখির পাশে না দাঁড়ালে আমরা সবাই কি মানুষের মতোই হয়ে যাবো না?’
এ’কথা শুনে কোকিল হঠাৎ হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। বলল- ‘তাই বলে কি নিজের প্রাণটা গচ্চা দেবো নাকি? তোমার মতো বুদ্ধু হলে আমি এতদিনে মরে কাঠ হয়ে যেতুম!’
‘ঠিক বলেছো, ঠিক বলেছো। কাকেরা এমন বোকার হদ্দ না, যে চিন্তাই করা যায় না! ওদের দেখতেও খারাপ, মাথাতেও গোবর ভর্তি!’
কে বলল কথাগুলো? কাকেরা পিছনে ঘুরে দেখে ওমা, কখন যেন টিয়া এসে দাঁড়িয়েছে তাদের মধ্যে।
আসলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও টিয়া যখন দেখল কোকিল তার সাথে দেখা করতে আসেনি তখন তার সব রাগ কেন যেন গিয়ে পড়ল কাকেদের ওপর। কোকিলের গল্পের লোভে সে চুপিচুপি সভায় এসে বসল বটে, কিন্তু সারাক্ষণ ভাবতে লাগল কিভাবে কাকেদের কঠিন শাস্তি দেওয়া যায়।
কোকিল আর টিয়ার কথা শুনে কাকেরা একটু দুঃখ পেল। কিন্তু পালটা কিছু বলল না।
এদিকে টিয়াপাখির মুখ দেখেই পায়রা ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। তাই ঝামেলা আটকাতে সে চেঁচিয়ে বলল- ‘চলো এবার সবাই মিলে কোকিল ভাইয়ের খাবার ব্যবস্থা করি। কি খাবে গো তুমি কোকিল ভাই’?
কোকিল এবার লজ্জা পেয়ে বলে- ‘সে তোমরা যা যোগাড় করে আনবে আমি তাইই খাবো’।
টিয়া বলল, ‘ধুস তা কখনও হয় নাকি? আমি বলে দিচ্ছি’। তারপর সে দাঁড়কাকের হাতে একটা লম্বা লিস্ট ধরিয়ে বলল- ‘এইসব খাবার তোমরা যেখান থেকে পারো নিয়ে এসো। ততক্ষণ কোকিল আমার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেবে। এসো কোকিলভাই, তুমি আমার সঙ্গে এসো।’
কাজ পেলে কাকেদের আর কিছু চাই না। সব কাজই তারা খুব যত্ন নিয়ে করে। আজও বহু পরিশ্রম করে বনের চতুর্দিক ঘুরে তারা কোকিলের জন্য নানারকম খাবার নিয়ে এল। তারপর সবাই মিলে গাছের ডালে ডালে বসে গল্প করতে করতে খেতে লাগল। সবারই খুব খিদে পেয়েছে। খিদে যেন নেই শুধু কোকিল আর টিয়ার। তারা ঠুকরে ঠুকরে অল্প অল্প খায় আর একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মিচকি মিচকি হাসে। দাঁড়কাক বলে- কি গো কোকিলভায়া, তোমার কি খিদে নেই নাকি? ব্যাপারটা কি বলো তো!
কোকিল কিছু বলার আগেই টিয়া চোখ পাকিয়ে বলল- ‘তোমার এত জেনে কাজ কি বুড়ো? নিজেরটা খাও তো! সবাই কি তোমার মতো পেটুক নাকি যে সারাক্ষণ ধরে হাতির মতো গিলে যাবে!’
টিয়ার ব্যবহারে সবার মুড খারাপ হয়ে গেল। আড্ডা আর জমল না। যে যার নিজের বাসায় ফিরে এসে বিশ্রাম নিতে লাগল।
অল্প-আধটু বিশ্রাম নিলেও কাকেরা দুপুরে ঘুমোয় না। কিন্তু সেদিন কিভাবে যেন বাসায় এসে বসতেই একটা কাকের চোখ ঘুমে জড়িয়ে এল। সাথে সাথেই সে স্বপ্ন দেখতে লাগল। দেখল একটা লম্বা সাপ গাছ বেয়ে বেয়ে তার বাসার দিকে উঠছে। লোভে সাপের সবুজ চোখ দুখানা জ্বলছে, সুরুৎ সুরুৎ করে চেড়া জিভ বার হচ্ছে আবার মুখের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। কাকের বাসার খুব কাছে চলে এসেছে সাপটা। সে জানে যে কাক এখন বাসায় নেই। কাক গেছে দূরে, রাতের খাবার সে এখনই জোগাড় করে আনবে। ডিম পারার পর থেকে যে তার খিদে পাচ্ছে বেশি। কাক যখন খাবারের খোঁজে উড়ে বেড়াচ্ছে গাছ থেকে গাছে ঠিক সেইসময় সাপ ঢুকে পড়েছে তার বাসায়। সাদা ধবধবে তিনটে ডিমের গন্ধে সাপের খিদে যেন বেড়ে গেছে। খিদের চোটে আর এক মুহূর্ত থাকতে না পেরে সে বিরাট একটা হাঁ করল। আর সাথে সাথে মুখের মধ্যে সূর্যের আলো পড়ে জ্বলজ্বল করে উঠল দুটো ভয়ঙ্কর বিষদাঁত। এখানেই ভয়ে ঘুম ভেঙে গেল কাকের। বুকটা তার ধরফড় করছে। কি ভয়ানক স্বপ্ন! কপাল থেকে ঘাম মুছে সে বাসার দিকে তাকায়- ওই তো! তিনটে ফুটফুটে ডিম পড়ে যাচ্ছে। কদিন বাদেই এই ডিম ফেটে মিষ্টি মিষ্টি তিনতে কাক জন্ম নেবে। একটু একটু করে তারা বড় হবে, ডানা মেলে উড়তে শিখবে। ছোট্ট ছেলেমেয়েদের প্রথম উড়ানের দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে থাকবে মা কাক…
কিন্তু তার আগেই যদি সাপ আসে? যদি ডিম নিয়ে যায়? না, সাপকে আগে থেকেই সাবধান করে দেওয়া ভালো। সে তখন উড়ে গিয়ে সাপের কোটরের সামনে বসে ডাকাডাকি শুরু করল। সাপ বিরক্ত হয়ে বলল, কি হল এমন বিশ্রীভাবে ডাকছ কেন?
কাক বলল- আমি তোমাকে ব্যাঙ ধরতে সাহায্য করব, কিন্তু কথা দাও তুমি আবার ছানাগুলোকে খাবে না।
সাপ তখন দাঁত খিঁচিয়ে উঠল- ‘ও সব দোষ আমার হয় না? সবসময় আমিই বুঝি ডিম খেয়ে যাই! আর ওই যে তোমরা কোকিলকে আদর করে খাওয়ালে সে যে তোমার ডিমটা এসে নষ্ট করে গেল তা তোমরা দেখতে পেলে না, না?’
‘কোকিল ডিম নষ্ট করে গেল?’ কাক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘তা না তো কি? ওই দ্যাখো মাটিতে তোমার ডিমটা ফেটে পড়ে আছে। তুমি যখন ছিলে না, তখন তোমার বাসায় কোকিল নিজে এসে ডিম পেড়ে গেছে। এ একেবারে নিজের চোখে দ্যাখা!’
হুলুস্থুলু বেঁধে গেল এরপর। সমস্ত কাকেরা দল বেঁধে ঝামেলা করতে শুরু করল। এদিকে কোকিলের দেখা নেই। সে টিয়ার বাসায় ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। আর তার হয়ে লড়ছে টিয়াপাখি।
কাকেরা বলল- ‘কোকিল একজনের ডিম নষ্ট করে সেখানে নিজে ডিম পেড়ে চলে গেছে।’
টিয়া বলল- ‘কি করে জানলে ওটা কোকিলের ডিম?’
কাকেরা বলল- ‘সাপ নিজে চোখে দেখেছে।’
টিয়া বলল- ‘সাপ কি পাখি? বরং সাপ তো পাখির ছানাগুলোকেই ধরে ধরে খায়। তাকে তোমরা বিশ্বাস করছ?’
কাকেরা বলে- ‘তাহলে মাটিতে পড়ে থাকা নষ্ট ডিমটা কোথা থেকে এল?’
এসব ঝুটঝামেলায় অতিষ্ঠ হয়ে পায়রা উড়ে চলে গেল অনেক দূরে। ঠিক করল আর এদের ধারে কাছে সে ফিরবে না। মরুক, এরা ঝগড়া করে মরুক।
এদিকে কাকেরা দল বেঁধে চেঁচামেচি করেছেই। কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। টিয়াপাখিও একা গলায় তাদের সাথে পেড়ে উঠছে না। আরও কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর টিয়াপাখির গলা যখন ধরে এল, তখন বলল- ‘আচ্ছা বেশ, তোমরা কোকিলের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইলে ওই ডিমটাও ফেলে দাও। তোমাদের যদি মনেই হয় ওটা কোকিলের ডিম, তাহলে এভাবেই কোকিল উচিৎ শাস্তি পাবে।’
টিয়ার কথায় কাকেরা সবাই কিছুক্ষণ চুপ হয়ে ভাবতে লাগল। ভাবছে তো ভাবছেই, কারুর মুখ দিয়ে কথাটি বেরুচ্ছে না। টিয়া মনে মনে হাসল, তারপর কোকিলের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বলল- ‘চলো চলো তাহলে ডিমটা নষ্ট করা যাক! কোকিল যদি করেই থাকে, শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে, তাই না?’ এই বলে যেই না সে কাকের বাসার দিকে পা বাড়িয়েছে অমনি সেই মা কাকটা পথ আগলে বলল- ‘না না, থাক।’ টিয়া বলল- ‘থাকবে কেনো গো, তোমরাই তো এতক্ষণ কোকিলের শাস্তি চাইছিলে। দাও এখন শাস্তি।’ কাকটা তখন টিয়ার দিকে তাকিয়ে থরোথরো গলায় বলল – ‘নাগো, নাই বা হল আমাদের ডিম, আমরা তবু ডিমে তা দেবো। ডিম ফুটে বাচ্চা হলে তাকে খাইয়ে দাইয়ে আমরাই বড়ো করব। সে কাক না কোকিল আমরা জানতে চাই না। আমাদের বাসা থেকে কোনো ডিম হষ্ট হবে না। সবাই শুনে রাখো, ডিম ফুটে যখন ছানা হবে তখন তার আসল মা কে আমরা জানতে চাইব না, আজ থেকে সে আমাদেরই ছানা, আমরা তাকে আদর-যত্নে বড়ো করে একদিন একটা পাখির মতো পাখি করে তুলবো।’
এই বলে কাকেরা আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। তারপর সবাই মিলে, আকাশ অন্ধকার করে, বিরাট একটা ঝাঁক হয়ে, উড়তে উড়তে আর গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে তারা চিৎকার করে বলতে লাগল – ‘সবাই দেখে নিও, ছানাদের আমরা এমন যত্ন করব, এমন খাওয়াবো, এমন উড়তে শেখাবো যে ঠিক তারা একদিন বাজপাখির মতো…’
কাকেদের বাকি কথাগুলো আর শোনা গেল না। তাদের স্বপ্নের মতোই কথাগুলো উড়তে উড়তে বসন্তের নীল আকাশের বুকে ক্রমে হারিয়ে যেতে লাগল।