একটি সাক্ষাৎকার…
– আপনি কাক কেন পালন করেন?
– মন চায়!
– মানে?
– মন আমার কাক পালতে চায় তাই পালি!
– আপনার মন চায়?
– হ!
– একটু ভেঙ্গে বলবেন?
– ভাইঙ্গাই যদি কই তাইলে আস্ত থাকবোডা কী?
– বুঝি নি?
– কথায় আছে,‘বুঝো না ধোনও, কথা কও ঘোনো!’ তোমার অবস্থা হইসে তেমুন বুঝলা?
– আপনি মনে হচ্ছে গালাগাল করছেন, ক্যামেরা চলছে!
– তাতে আমার বাল ছিঁড়া! শোন পোলা, আসছাও সাক্ষাৎকার নিতে, যা কই তাই শুইনা বিদায় হও! তোমার উত্তর দিলে আমার উত্তরডা দিবো কেডা? তোমার বাপ? কাক পালি কারণ মানুষ পালতে আমার আর মন চায় না!
[ শেষ বাক্যে সামান্য মারফতি গন্ধ পাওয়ায় সাক্ষাৎকার নিতে আসা যুবকের কৌতূহলে লাফ খায়, ফলে সে মৌরিবিবিকে জিজ্ঞাস করে…]
– আপনার বয়স এখন কত?
– তা দিয়া তুমার কাম কী গো পোলা?
– না মানে আগ্রহ হচ্ছে!
– ১০০ মানলে ১০০, ৯০ মানলে ৯০ আবার যদি ৮০, ৭০ বা ৬০ মানো তাইলে ৮০, ৭০ বা ৬০!
– আপনি খুব ঘুরায়ে কথা বলেন!
– তাতে সমস্যা কী?
– খোলামেলা উত্তর হলে দর্শকদের কানেক্ট করতে সুবিধা হয়!
– খুইলা দিলেই বা কী আর মেইলা দিলেই বা কী? বয়স গেছে এহন আর কী দেখবা?
– দুঃখিত! আমি আসলে…!
– কইয়া ফেলাও!
– আপনি কবে থেকে কাক পোষেন?
– এইটা ভালো প্রশ্ন! তার আগে আমার এট্টু জানবার বাঞ্ছা আছে কাক দুনিয়ায় জন্ম নিলো কবে?
– আমার জানা নাই!
– তুমি যে ভোদাই সেইটা তোমার মুখ দেখলেই বুঝা যায়! আর তুমি যে জানো না সেইটা আমি জানি! আমার মনে পড়ে হাবিল কালিবের সময় কাউয়া আছিল, খুন কইরা পুইতা ফেলান শিখাইছে কাউয়া! তাই না? তাইলে হত্যার ইতিহাস কাউয়ার সমান বয়সী! কী কও?
– আমি আসলে মিস্টার হাবিল এবং কাবিল কে জানি না!
– তোমার জাইনা কাম নাই! কামলা খাটো যার তার জুতা চাইটা দিলেই খতম!
– জি!
– কী সুন্দর জি বল্লা!
– জি!
– কী যেন প্রশ্ন করছিলা?
– আপনি কাক কবে থেকে পালন করার সিদ্ধান্ত নেন!
– কাউয়া নিয়া কারবারটা আমাগোর রক্তের মইদ্দে আছে! আমার দাদার বাপ পরথম কাউয়া পালনের খোয়াব দেখেন! কিন্তু সেই জামানায় তিনি সমাজের কারনে হোক কিংবা অন্য কোন কারনে হোক কাজটা পুরাপুরি পারেন নাই! তয় শোনা যায় তিনি রোজ কাউয়াগোরে ভাত ছিটাইয়া দিতেন! তুমি তো জানো আমাগোর এই অঞ্চলে কাউয়ার সাথে ধর্মের একটা যোগাযোগ আছে! সে যাই হোক! তো আমার দাদার বাপ যিনি কাউয়াগোরে ভাত ছিটাইয়া দিতেন! তার নাম হইয়া যায় কাউয়া মুন্সি! লোকে তারে ভক্তি করত! খালি তার কাউয়াগোরে ভাত ছিটায়া খাওয়ানোর ব্যাপারটা তারা পছন্দ নিত না! তাই আবডালে তারে সবাই কাউয়া মুন্সি কইয়া ডাক দিতো!
– তারপর?
– তারপর আমার দাদা! মানে ব্রিটিশ জামানা! সেই জামানায় তিনি দাঁড়কাক পালন শুরু করেন! খাঁচায় একটা দাঁড়কাক পালতেন! এক মেম নাকি তার কাউয়ার প্রেমে পড়ছিল! রোজ নাকি সেই মেম দাদার কাউয়া দেখতে আইত! তয় আমার খেয়াল হয় মেম আসলে দাদার প্রেমে মইজা মাখাইতে আইত! শেষমেশ কী হইসিল জানো?
– জি না!
– জানবা কেম্নে? আমি তো কই নাই!
– জী!
– মেমের স্বামী আমার দাদার উপ্রে রাইগা গিয়া, মানে মেমের কাউয়া প্রীতি দূর করবার বাসনায় আমার দাদারে কালাপানি দিলো!
– বলেন কী?
– হ! তাজ্জব লাগে না? লাগার কথা যদি তুমি হিস্টিরির লাইনের কেউ হয়া থাকো! তয় আমি অবাক হই নাই! কারণ আমার দাদা আছিল ব্রিটিশগোর যম! মানে যাগোরে সন্ত্রাসবাদের তকমা দেয়া হইছিল! এহন কও দিহি কাউয়া কারে খাইল?
– কিন্তু মেম সাহেবের কি হল?
– তার একটা নেটিভ বাচ্চা হইছিল! তয় তার খোঁজ কেউ জানে না! তয় আমি জানি! যাইহোক! আমার বাবা আছিল নরম কিসিমের আদমি! হ্যায় কোন ঘিচিংয়ে যায় নাই! তয় রোজ সকালে এক থাল বাসিভাত ছাদে থুইয়া দিতো নাকি! কাক হোক কিংবা কোকিল যার ইচ্ছা খাইব! তয় আমার ধারনা যে, তিনি পূর্বপুরুষের ধারাবাহিকতায় এই কাম করতেন!
– তারপর আপনি?
– হ! আমি! এহন কও আমি কেন কাক পুষি?
– জানি না!
– এতক্ষণ কার বাল্ডা শুনলা তাইলে?
– সরি! আমি আসলে…!
– বিদায় হও! আর কোন কথা না তোমার সাথে! যেই প্রশ্ন জিজ্ঞাস করছি সেইটার উত্তর যদি আবিষ্কার করতে পার তাইলে আসবা নাইলে না!
ফলে যুবক তার ক্যামেরা সহযোগী সহ ভগ্নমনে বিদায় নেয়! কিন্তু এই দৃশ্য আশপাশের ছাদের লোকেরা দূর থেকে দেখে ফেলে! ফলে তারা অর্থাৎ এলাকার মানুষেরা অনেকদিন পর মৌরিবিবিকে নিয়ে একটা আলোচনার বিষয় খুঁজে পায় কিংবা মৌরিবিবি আবার আলোচনায় উঠে আসে পাড়ার লোকেদের কাছে, কেনোনা কাক পালন মৌরিবিবির নতুন কিছু না! কিন্তু যখন বাইরের কেউ এসে ক্যামেরা সহ হাজির হয় তখন এলাকার লোকেরা কদর বুঝতে পারে কিংবা নতুন কোন মর্তবা তালাস করতে থাকে এই কাক বা কাউয়া পালন বিষয়ে! ফলে পাড়ার মহিলা বা পুরুষেরা কেউ কেউ আসে মৌরিবিবির সাথে দেখা করতে!
মহল্লার জনৈক মহিলার সঙ্গে আলাপ…
– কাহিনী কি আপা? লোকে কইতেছিল এক পোলা নাকি ক্যামেরা নিয়া আইছিল তোমারে ভিডিও করতে?
– হ!
– কী করলো?
– এই বয়সে আর করবো কি?
– তওবা তওবা! আমি কইছি যে কী কামে আসছিল পোলাডা?
– কাউয়ার ডিম ভিডিও করতে!
– কাউয়ার ডিম?
– হ!
– কাউয়ার ডিম ভিডিও কইরা কি করবো?
– ভাইজা খাইব মনে কয়!
– কেম্নে?
– জানি না! তয় মনে হয়!
– তাইলে কেম্নে কী?
– ভাইবা দেখো!
– কী ভাব্ব?
– কুঞ্জায়গায়?
– যেইখানে চুল্কায়!
– এহ্! খামাখা!
– হ!
– এম্নেই আইছিলো পোলাডা মনে কয়, তাই না?
– হ! খামাখা!
– তাইলে যাই!
– যাও!
– খামাখা আইলাম! উরাধুরা খবর শুইনা!
– যাও, বাড়ি গিয়া ত্যাল দিয়া ঘুমাও!
– এম্নেই ঘুম হয়!
– তাইলে তো ত্যালের খরচ নাই!
– এক্কেবারে নাই!
– ত্যাল লাগ্লে নিয়া যাইয়ো!
– আচ্ছা! যাই!
– যাও!
মহল্লার জনৈক তরুণীর সঙ্গে আলাপ…
– চাচী লোকে কইতেছিল এক পোলা নাকি ক্যামেরা নিয়া আইছিল তোমারে ভিডুও করতে?
– হ!
– কী ভিডুও করলো?
-এই বয়সে আর কী করবো ক? তোর বয়স থাকলে কামে দিতো!
– এহ! খালি বেফাঁস কও! আমি কইছি যে কী কামে আসছিল পোলাডা?
– কাউয়ার ডিম ভিডিও করতে!
– কাউয়ার ডিম?
– হ!
– কাউয়ার ডিম ভিডিও কইরা কি করবো?
– বাড়িত নিয়া ভাইজা খাইব মনে কয়!
– কেম্নে?
– জানি না! তয় মনে হয়!
– তাইলে কেম্নে কী?
– ভাইবা দেখ্!
– কী?
-যা খুঁজিস!
– কুঞ্জায়গায় হেইটা?
– যেইখানে চুল্কায় সেইখানে!
– এহ্! খামাখা!
– হ!
– এম্নেই আইছিলো পোলাডা মনে কয়, তাই না?
– হ! তয় তরে দেখলে ফিরা যাইত না!
– এহ্! ফাউল কথা কইয়ো না! যাই!
– যা!
-খামাখা আইলাম! উরাধুরা খবর শুইনা!
-যা, বাড়ি গিয়া ত্যাল দিয়া ঘুমা!
-ঘুম আহে না ত্যাল দিলেও!
-তাইলে তো ত্যালের খরচ ম্যালা!
-উ!
-ঘানীওয়ালা জোগাড় কর!
-উফ! আমি যাই গা!
মহল্লার জনৈক মুরুব্বির সঙ্গে আলাপ…
– কাহিনী কি ভাবি? লোকে কইতেছিল এক পোলা নাকি ক্যামেরা নিয়া আইছিল তোমারে ভিডিও করতে?
– হ!
– কী করলো?
– নাচতে কইল পরথমে!
– অজতাগফিরুল্লাহ!
– আমি কইলাম, মাজায় বেদনা!
– তারপর কী কইল?
– কী আর কইবো! বল্লো তাইলে কি ভিডিও করি কয়া দেন দিহি!
– আপনে কি কইলেন?
– কইলাম, খোপে কাউয়ায় ডিম দিছে! শুইনা লাফায় উঠলো!
– তারপর?
– কাউয়ার ডিম ভিডিও করলো!
– কাউয়ার ডিম?
– হ!
– কাউয়ার ডিম ভিডিও কইরা কি করবো?
– ভাইজা খাইব মনে কয়!
– কেম্নে?
– জানি না! তয় মনে হয়!
– তাইলে কেম্নে কী?
– ভাইবা দেখো! আমিও ভাবছি, তয় দিশা পাই নাই!
– কোন দিকে ভাব্বমু?
– হাতায় হাতায় ভাবো!
– কুঞ্জায়গায়?
– যেইখানে যেইখানে চুল্কায়!
– এহ্! খামাখা! তামসা করতেছেন তাই না ভাবি?
– না!
– এম্নেই আইছিলো পোলাডা মনে কয় আমার, তাই না?
– মনে হয়! খামাখাই!
– তাইলে যাইগা!
– যাও!
– খামাখা আইলাম! উরাধুরা খবর শুইনা!
– যাও, বাড়ি গিয়া ত্যাল দিয়া ঘুমাও!
– ওষুধ খায়া ঘুম হয়!
– তাইলে তো ত্যালের খরচ নাই! ওষুধের খরচ শুধু!
– হ! সেইরকমই!
– ত্যাল লাগ্লে নিয়া যাইয়ো! পুরানা ঘিও আছে ঘরে!
– নাহ! যাই!
– যাও!
সেদিন এলাকায় ছড়িয়ে যায় যে, ফরেন থেকে এক সাংবাদিক আসছিল মৌরিবিবি যে কাকের ভাষা বোঝে সেটা ভিডিও করতে! কিন্তু মৌরিবিবি ইংরেজি না জানায় আলাপ জমে নাই! আবার পাড়ার বান্দর পোলাপানেরা কয়, ন্যাশনাল জিওগ্রাফী থেকে ক্যামেরা আসছিলো মৌরিবিবির কাউয়াবিদ্যা ভিডুও করতে! কিন্তু পাড়ার শঙ্কর মাস্টার কয়, ‘আজিব মাল মৌরিখালা! কাউয়ার ভাষা বুঝে কিন্তু ইংরাজি বুঝে না, বিটিস্ ফেল খাইলো হ্যার কাছে! নাকি দেশি কোন চ্যানেল আইছিল! কিন্তু কেন আইছিল?’ ফলে শঙ্কর মাস্টারের ইচ্ছা করে মৌরিবিবির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করতে পুরো বিষয়টা! কিন্তু সে যায় না কেনোনা মৌরিবিবির কাছ থেকে সে কয়েক বছর আগে তিন হাজার টাকা ধার নিয়েছিল, যেই টাকা সে এখনো শোধ দেয় নাই! তবে সে লোক মুখে শোনা কথাবার্তা থেকে আঁচ করার চেষ্টা করে আসল কাহিনীটা কি! এরপর আরও অনেকদিন যায় মৌরিবিবির কাকের অনেক বাচ্চা ফোটে! সেই বাচ্চারা কা কা কা স্বরে ডাকে আর আকাশে ওড়ে! পাড়ার লোকেরা বলে, ‘কি হইল সেই ক্যামেরাওয়ালা আর আইল না?’ কিংবা পাড়ার পঞ্চায়েতের লোকেরা মিটিঙয়ে বসে মৌরিবিবির কাক পালন নিয়ে! কেনোনা কাক আকাশে ওড়ে আর হাগে! এলাকার দুষ্টু মুরুব্বীদের গায়ে তারা হাগে, মাথায় তারা হাগে! এলাকার মুরুব্বীরা একদিন মিটিঙয়ে বসে…
– নাহ! এট্টা বিহিত না করলে আর টেকা যাইত না পাড়ায়!
– ঠিক! হালার পুত কাউয়ার বাচ্চা! রোজ আমার মাথায় হাইগা উইরা যায়! সক্কাল বেলা বাড়ির থিকা বাইরাইলেই হাইগা গায়েব!
– আরে বাল, আমি কাইল নামাজের জন্যে বাইরাইছি! চুতিয়া কাউয়া আমার কান্ধে হাইগা দিলো? মাঙ্গির পুত রে পাইলে কাবাব বানায় খায়া ফালাইতাম!
– সকাল হইতে না হইতে কা কা কা র গুতায় ঘুমান যায় না!
– ঠিক! তার উপ্রে কাউয়া হইল খারাপ পক্ষী! এইয়া কেউ পালে?
– বাপের জন্মে শুনি নাই কেউ কাউয়া পালে!
– তাইলে লও যাই তারে নিষেধ করি?
– আপনে মুরুব্বী বেশিই ভালো মানুষ! নিষেধ কিহের? একবারে বন্ধ করতে কইবেন হ্যাঁরে! পাড়ায় থাকতে হইলে কাউয়া পালা যাইব না!
– এইডা কী কও? মহল্লা সব থিকা পুরানা বাসিন্দা হইল মৌরিবিবি, তোমরা আইছ দুইদিন, হ্যাঁরে খেদাবা কেম্নে?
– পয়সা দিয়া জমি কিন্না আইছি, উইরা তো আহি নাই!
– এহ! বেশি হইয়া যাইতেছ! আস্তে কও!
– আস্তে কমু ক্যা?
– কত টেকা হইসে তুমার? দুইদিন হইসে বাল গজাইছে!
– কি কইলেন? আমি বাল?
– আপনে তাইলে চ্যাট একটা!
– কি কইলা? থাপড়াইয়া দাঁত ফেলায় দিমু!
– আমি নাই আপ্নেগর লগে! তয় যাবার আগে কইয়া যাই…আইজ যা হইলো তার শোধ আমি নিমু! দেখবুনে আপ্নের কত্ত টেকা!
– আজিব তো মিয়া! যাও দিহি তুমি! খামাকা কাইজ্যা পাকাইলা!
– আপ্নেও হ্যাঁর দলে তাল দিলেন মুরুব্বী! দিবেন তো যৌবনে আপ্নারা চায়া থাকতেন মৌরিবিবির ওলানের দিক! আমার কাছে সব খবর আছে!
– ঐ ফকিরের বাচ্চা, এইহান থিকা বিদায় হ!
– যাইতেছি তয় দেইখা নিমুনে!
– আমার নোমা ছিঁড়া নিস যা গা!
ফলে পাড়ার মুরুব্বী এবং মাঝবয়সীরা সেদিন বিব্রত হয়ে কিছুক্ষণ হ্যাং মেরে থাকে এবং তারা ঐ নব্য ধনী যুবকের সমালোচনা করতে করতে মৌরিবিবির প্রশংসা কিংবা মৌরিবিবি যে তাদের হিস্যা সেই বিষয়ে একমত হয়! ফলে তারা কাউয়া হাগা নিয়ে আর চিন্তিত হয় না! তারা ধরেই নেয় কাক পালন তাদের পাড়ার ঐতিহ্য! কেনোনা এর কয়েকদিনের মধ্যে জাতীয় দৈনিকে মৌরিবিবির উপর একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়, যার শিরোনাম দেয়া হয়,
‘রহস্যময়ীর কাক সংসার নাকি কাকচরিত?’
ফলে এলাকার লোকেরা আবার কৌতূহলী হয় এবং তাদের কেউ কেউ মৌরিবিবির কাছে আসে!
পাড়ার এক মহিলা মৌরিবিবির কাছে আসে…
– বুবু, আপনারে নিয়া নিকি সম্বাদপত্রে খবর হইসে?
– হ!
– কী লিখছে?
– জানি না!
– কও কি? পইড়া দেহ নাই?
– তুমি যহন পইড়া দেহ নাই তাইলে আমি পড়মু কেম্নে?
– তা ঠিক! তয় শুনলাম তুমি নিহি কাউয়ার ভাষা বুইঝা ভবিষ্যৎ কয়া দিতে পারো?
– তাতে লাভ কি?
– তা জানি না!
– আগে জাইনাই বা লাভ কি, পিছে জাইনাই বা লাভ কি? পোঙ্গায় আগুন লাগ্লে পুকুর আপনা আপনি সামনে হাজির হয়!
– বুঝলাম না!
– সব তুমি বুঝলে, কাউয়ার ভাষা বুঝবো কেডা?
– তা ঠিক!
– তাইলে এহন যাও!
– আচ্ছা!
– যাও!
– যাই তাইলে বুবু!
– মিউমিউ করতেছ ক্যান? আর কিছু বল্বা?
– না! এম্নিই!
– তুমি কি এট্টা কাউয়ার ছাউ পুষতে চাও?
– হ বুবু!
– বুঝছি! সোজা কইলেই পারতা! যাও, ছাদে গিয়া দেখো এট্টা ছোট খাঁচার মইদ্দে এট্টা কাউয়ার ছাউ রাখছি আমি তোমার জইন্নে! ওইটা নিয়া বিদায় হও!
– মহিলা আনন্দে ছাদে উঠে যায়!
– পাড়ার একজন তরুণী মৌরিবিবির কাছে আসে…
– চাচী আপনারে নিয়া নিকি সংবাদপত্রে খবর হইসে?
– হ!
– কী লিখছে?
– জানি না!
– পইড়া দেহ নাই?
– তুই যহন পইড়া দেহস নাই তাইলে আমি পড়মু কেম্নে?
– তা ঠিক! শুনলাম আপনে নিহি কাউয়ার ভাষা বুইঝা ভবিষ্যৎ কয়া দিতে পারেন?
– আগে জাইনাই বা লাভ কি, পিছে জাইনাই বা লাভ কি? পোঙ্গায় আগুন লাগ্লে পুকুর আপনা আপনি সামনে হাজির হয়!
– কেম্নে?!
– তুই যদি কেম্নে বুঝবি, কাউয়ার ভাষা বুঝবো কেডা?
– তা ঠিক!
– তাইলে এহন যা!
– আচ্ছা!
– যা!
– এট্টা কথা জিগাই চাচী?
– ক।
– আমি যা চাই তা কি পামু?
– না! তোর তকদির নাই! পুরা সাদা!
– যা তুই চাস তা তোর কপাল চায় না! এর থিকা আন্ডায় তা দেয়া কামের!
– মানে? ছাদে গিয়া বাম পাশের খোপের মইদ্দে দেখ্ কয়ডা কাউয়ার ডিম! এট্টা নিয়া যা! সময় হইলে জবাব পাবি!
– মেয়েটা ছাদের দিকে যায়!
– পাড়ার একজন পুরুষ মৌরিবিবির কাছে আসে…
– ভাবিছাব আপনারে নিয়া নিকি সম্বাদপত্রে খবর হইসে?
– হ!
– পইড়া দেখলাম! আপনে তো মর্তবাওয়ালা মহিলা!
– তাই নিকি?
– হ! তাই লিখছে! কাউয়ার ভাষা বুইঝা ভবিষ্যৎ কয়া দিতে পারেন আপনে।
– লাভ কি তাতে?
– বুঝি নাই!
– আগে জাইনাই বা লাভ কি, পিছে জাইনাই বা লাভ কি? পোঙ্গায় আগুন লাগ্লে পুকুর আপনা আপনি সামনে হাজির হয়!
– তা ঠিক! কিন্তু টাউনে এহন পুকুর নাই! কলতলা খুঁজতে হয়!
– এই তো বুঝছ তুমি!
– কি বুঝছি?
– সব তুমি বুঝলে, কাউয়ার ভাষা বুঝবো কেডা?
– তা ঠিক!
– তাইলে এহন যাও!
– আচ্ছা!
– যাও!
– যাই তাইলে ভাবিছাব?
– হ যাও!
– মিউমিউ করতেছ ক্যান? আর কিছু বল্বা?
– হ! আপ্নের স্বামী আছিলেন যিনি হ্যাঁয় না গুল্লি কইরা কাউয়া মারতেন রোজ? এই অঞ্চলে তহন এট্টাই পাকা দালান, আপ্নেটা! উনি তো উধাও হইছিলেন! বন্দুকটা কি আছে?
– উনি বন্দুক নিয়াই উধাও হইছিলেন! তয় মরা কাউয়া গুলান আছে! নিবা?
– মানে?
– আমি যেই কাউয়া গুলানরে পালি সেইগুলা উনার গুল্লিতে খুন হওয়া কাউয়া! জিন্দা করছি! এহন আণ্ডাও পাড়ে!
– আমি যাই!
– এট্টা কাউয়া নিয়া পুষতে পারো! নিবা? অন্তরে শান্তি আসবো! নিবা নি?
– নাহ! যাই গা!
– আচ্ছা! মন চাইলে নিয়া যাইয়ো!
সেদিন সন্ধ্যায় এলাকায় একটা মিশ্র হাওয়া ঘুল্লি খায়! কেউ কেউ বলে, মৌরিবিবির মাথা নষ্ট। কেউ কেউ বলে, মৌরিবিবি মিথ্যা গালগল্প ছড়াচ্ছে বাজারে! কেউ কেউ বলে, আছে আছে মাজেজা আছে মৌরিবিবির! এই অঞ্চলের অর্ধেক জমিন আছিল তার! ভাইয়েরা সব বিক্রি কইরা খাইছে আর মরছে! স্বামী হইছে উধাও! এহন একা থাকে কাউয়া নিয়া! ভাড়ার টাকা তুলে বাড়ি গুলান থিকা আর সেই টাকা দিয়া কাউয়া খাওয়ায়! কিন্তু আসলে হ্যাঁয় মর্তবাওয়ালা মহিলা! আবার কেউ কেউ বলে, কাক হল অশুভ পাখি, সেই পাখি যে পালে সেও ভালো মানুষ না! কেউ একজন বলে, কাক গুলান কাক না, তয় কাকের মতন, আসলে কাক গুলান আত্মা! তয় কেমন আত্মা সেইটা এখনো ক্লিয়ার না, ভালো আত্মাও হইতে পারে আবার খারাপ আত্মাও হইতে পারে! মহল্লার চায়ের দোকানে একজন কেউ বলে, মৌরিবিবি নিজেই একটা আত্মা! তার মউতের খবর এহনো আম্রা কেউ শুনি নাই কারণ সে কাউয়া দিয়া আসল গল্প আড়াল দিয়া রাখছে!
কিন্তু সেদিন মধ্যরাত্রে সেই মহিলা যাকে মৌরিবিবি একটা খাঁচায় বন্দি কাক দিয়েছিল তার বাড়ি থেকে বন্দি কাকের ডাক মহল্লার নীরবতার মধ্যে বারবার ডেকে উঠে জানান দেয় তার আর্তনাদ ফলে, ভোর হতে না হতেই শত শত কাকের মিছিল জমায়েত হয় সেই মহিলার বাসার চারপাশে ফলে মহল্লার লোকেরা বলে, হালায় এক বেটির কাউয়ার গুঁতায় বাচতেছিলাম না এহন আরেক বেটির বাড়ির উপ্রে কাউয়া ডাকে? কিন্তু ক্রমে কাকের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং কাকেরা চিৎকার করে তাদের বন্দি ভাইয়ের মুক্তির জন্য শ্লোগান দিতে থাকে! কাকেরা বিভিন্ন রকম কা কা… ক্রো ক্রো ক্কা ক্কা কাআআআ… শব্দ করতে থাকে এবং আমাদের ধারণা হয় কাকেরা বলছে…
– আমার ভাই বন্দি কেন? মুক্তি চাই… মুক্তি চাই!
– ইনকিলাব জিন্দাবাদ! স্বৈরাচার নিপাত যাক!
– জেলের তালা ভাঙবো, আমার ভাইকে আনবো!
– মনুষ্যত্ব নিপাত যাক! কাকবাদ মুক্তি পাক!
ঠিক এই সময় দেখা যায় মৌরিবিবিকে তার ছাদে! তিনি সূর্যের আলোর দিকে হাত উঁচিয়ে পুরো ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করে, তার খোপের কাক গুলোকে খুলে দিয়ে হাততালি দেন এবং খাবার ছড়িয়ে দিতেই, অন্য ছাদে শ্লোগান দিতে থাকা কাকেরা উড়ে আসতে থাকে একে একে! যেন এক ইন্দ্রজালে তিনি সকল কাককে বন্দি করে ফেলেন এবং তার দানাপানি খেতে খেতে অন্য ছাদ থেকে উড়ে আসা কাকেরা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তারা মৌরিবিবির কাকেদের সঙ্গে থেকে যাবে এবং বাকি জীবন এই ছাদে জীবন কাটিয়ে দেবে! পুরো ব্যাপারটা দেখে মৌরিবিবি মুচকি হাসেন এবং আমাদের মনে হয় যে, তিনি হয়ত ভাবছেন, কাউয়া দিয়া কাউয়া ধরার খেলায় তিনি অদ্বিতীয়!
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে মৌরিবিবি দেখেন তার সিঁড়ি বেয়ে একজন মাঝবয়সী নারী উঠে আসছেন। মহিলার সঙ্গে অনুগত দুজন মহিলা যাদেরকে সিঁড়িতে রেখে তিনি একা উঠে এসে মৌরিবিবির পা ছুঁয়ে সালাম করেন মহিলা! এবার তাদের মধ্যে কি আলাপ হয় তা আম্রা জানি না তবে আম্রা জানি যে, এই মহিলা হচ্ছে এই এলাকার জনপ্রতিনিধির স্ত্রী! এবং এই মহিলা মৌরিবিবিকে কানে কানে কিছু একটা বলেন এবং মৌরিবিবি তার মাথায় এবং গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে খাবার খেতে থাকা কাকদের মধ্য থেকে একটা কাক ধরে একটা খাঁচায় বন্দি করে ভদ্রমহিলাকে দিয়ে দেন এবং বিদায় নেবার সময় মৌরিবিবি বলেন, কাক যতো ডাকবো, ততো কাক তোমার ছাদের উপ্রে আসবো! ততো বেশি তোমার উপকার!
ফলে এর ঘণ্টা দুয়েক পর এলাকার জনপ্রতিনিধির বাড়ির ছাদের উপর কিংবা চারপাসের দালানের কার্নিশে শত শত কাকের মিছিল জড়ো হয় এবং সেই কাকেরা বলতে থাকে…
– আমার ভাই বন্দি কেন? মুক্তি চাই… মুক্তি চাই!
– ইনকিলাব জিন্দাবাদ! স্বৈরাচার নিপাত যাক!
– জেলের তালা ভাঙবো, আমার ভাইকে আনবো!
– মনুষ্যত্ব নিপাত যাক! কাকবাদ মুক্তি পাক!
ফলে, এলাকার লোকেরা বলে…
– তাজ্জব কারবার!
– হইলোডা কি? কাউয়া গুলানের মাথা নষ্ট হইসে নি?
– হ! কাউন্সিলরের বাড়ির উপ্রে হামলা দিছে!
– পাপ! পাপ! সব পাপের ফসল!
– ঠিক! কম লুট তো করে নাই! চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি সব করে! এহন কাকের গু খা!
– হে হে! ঐ দেহেন কাউয়ায় হাইগা সাদা বানায় ফেলতেছে বাড়ি!
– সব মৌরিবিবির কারবার!
– কি বললেন?
– চুপ!
– হিসসস!
বাড়ির ভিতর কাউন্সিলরের স্ত্রী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন! তার স্বামী লোকটা বাইরে বের হতে পারছেন না! পিশাচ মানুষটা আতঙ্কে অস্থির হয়ে আছে! ফলে তার স্ত্রী শান্তি পেতে থাকেন! এবং তার মনে হয় কাক থেরাপিতে কাজ হবে! কিন্তু কাউন্সিলর এই মহা বিপদ থেকে বাঁচতে পুলিশকে ফোন দেয়! কিছুক্ষনের মধ্যে এক গাড়ি পুলিশ এসে পুরো ব্যাপারটা দেখতে থাকে কয়েক মিনিট! এরপর ফাঁকা আওয়াজের নির্দেশ দেয়া হয় যাতে কাকেরা শব্দ শুনে পালিয়ে যায়! কিন্তু অতি উৎসাহী অফিসারটি ফাঁকা আওয়াজের উছিলায় একটা কাককে গুলি করে ভূপাতিত করে দেয়! রক্তাক্ত সেই কাকের দিকে কয়েক সেকেন্ড পুলিশেরা তাকিয়ে থাকে! গুলির এই শব্দ দূর থেকে শুনতে পায় মৌরিবিবি! এবং তিনি বুঝতে পারেন কিংবা কোন কাক হয়ত তাকে উড়ে গিয়ে খবর দেয় ফলে তিনি চোখ বুঝে কয়েক সেকেন্ড ঝিম মেরে থাকেন এবং এর পরের ঘটনার বর্ণনা আম্রা শুনতে পাই স্থানীয়দের মুখে যে, গুল্লি খেয়ে কাকটা মাটিতে পড়ার মিনিট খানেক পরে সবাই দেখে আকাশ ঢেকে যেতে থাকে উড়ন্ত কালো ছায়ায়! লক্ষ লক্ষ কাকের চিৎকারে সেদিন এলাকার আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে! আর ঘটনা যখন শেষ হয় তখন দেখা যায়, কাকের সাদা গু তে সমস্ত এলাকা মাখামাখি হয়ে গেছে! কিন্তু পুলিশদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না! শুধু তাদের বন্দুক গুলোকে পড়ে থাকতে দেখা যায়! আম্রা বুঝতে পারি মানুষ আসলে এভাবেই গুম হয়ে যায়! ফলে এলাকার লোকেরা বলে…
– আম্রা কিছুই দেখি নাই!
– আল্লার কসম!
– নবীর ক্বিরা!
– মা কালির দিব্যি!
– আম্রা সেদিন ঘুম ছিলাম!
– হ! পুরা এলাকার লোকেরা সেদিন ঘুম দিছিল!
– ঠিক না?
– হ! আমি ভোরে একবার উইঠা মুইতা আবার ঘুমায় গেছিলাম! জাগ্না থাকলে হয়ত দেখতে পারতাম!
– হ! জাগ্না থাকলে সাক্ষী হইতে পারতাম!
– আম্রা কেউই কিছুই দেহি নাই!
– একদম দেহি নাই কিছু!
ফলে কাউন্সিলরের স্ত্রী তাকে দেওয়া কাকটাকে মুক্ত করে দিতে গিয়ে দেখে কাকটা একটা ডিম পেড়ে বসে আছে! ফলে তার মায়া হয় এবং তিনি সিদ্ধান্ত নেন কাকটাকে তিনি পালন করবেন, ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বানাবেন! কাউন্সিলর কোন দ্বিমত করেন না স্ত্রীর এই কারবারে, কেনোনা সেদিনের পর থেকে তিনি বাইরে বের হন নি! কাকভীতিতে তিনি জর্জরিত!
এই ঘটনার পর সেই ছেলেটা আবার ক্যামেরা নিয়ে হাজির হয় মৌরিবিবির সামনে! মৌরিবিবির উপর একটা ডকুমেন্টারি বানাবার ভাবনা তার! কিন্তু মৌরিবিবির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েই প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে বারবার! সেদিন ছাদে হাজির হয়ে যখন তিনি মৌরিবিবিকে দেখেন তখন তাদের মধ্যে আলাপ হয়…
– আপনার কাকের সংখ্যা তো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে! ডিম পেড়েছে?
– উঁহু! কাকে কাক বাঁধাইছে! নাঙ ধরা বুঝো?
– মানে…!
– ‘যার যতো বড় গাঙ, তার ভাগ্যে ততো নাঙ!’ বুঝলা কিছু?
– না!
– এহনো শিশু আছো? ফিডাও খাও? হবে না! আসো, কামের কথায় আসো!
– আমি আসলে আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞাস করতে চাই প্রথমে!
– বল!
– আপনি কাক কেন পালন করেন?
– মন চায়!
– মানে?
– মন আমার কাক পালতে চায় তাই পালি!
– আপনার মন চায়?
– হ!
– একটু পরিষ্কার করে বলবেন?
– যা বলার বলছি, বুইঝা নেও!
– বুঝি নি?
– তোমারে দিয়া হবে না! বিয়া করো, তারপর দুনিয়াদারী!
– আচ্ছা প্রথম কবে কাক পালন শুরু করেন আপনি?
– আমি তো মুর্গির খামারি না বাজান! এই গুলান মুর্দা কাক! তয় জ্যান্তের মতন!
– মানে?
– দুই চক্ষে দেখো যা-ই, আসল নাকি নকল ছাই?
– বুঝি নাই!
– বহিস্কার হও তুমি!
– শোনা যাচ্ছে রাজনৈতিক লোকেরা আপনাকে ভয় পায়?
– আমি তো বিরোধী দল না! আবার সরকারি দলও না! ট্যাঙ্ক কামানওয়ালা আর্মিও না, আমারে ভয় পাওয়ার কিছু নাই!
– কয়েকজন পুলিশ কিছুদিন আগে কাক তাড়াতে এসেছিল এই এলাকায়! তারা নিখোঁজ! এর সঙ্গে নাকি আপনি জড়িত?
– পুলিশ কাউয়া তাড়াইতে আসবো ক্যান? কামকাজ নাই? আমি তো শুনছি পুলিশ একটা কাউয়ারে বিনাবিচারে গুল্লি কইরা মারছে! সেইটার বিহিত কি?
– কাক আর মানুষ তো এক না!
– তুমি এহনো হাফপ্যান্ট পরো বাজান! ফুলপ্যান্টের বয়স হইলো আলাপে আইস!
– আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন!
– বাবা! তুমি দেহি চালাক হবার মোরাকাবা কইরা আসছ! আমি কথা ঘুরাবো কোন দুঃখে! আমি নিজের মতন কাক পালি! তোম্রাই সাইধা আসছ ভিডিও করতে! এইটা বেইচা খাইবা তোমরা! আমার কথা ঘুরাঘুরির কি আছে? মার্কিনগোর মতন ঐ দেশে সন্ত্রাস আছে বইলা বোমা ফেলায়া দেশ দখলের ফর্মুলা?
– সরি আমি আসলে…
– জবান সামলাও বাবাজী! বিদায় হও! আর যেন না দেখি তোমারে আমার সীমানায়!
– সরি আমি আসলে…
– যাও! বিদায়!
– আসলে আমি খুবই দুঃখিত…
মৌরিবিবি উঠে যান! একটা কাক ছেলেটার মাথার উপ্রে কয়েকটা পাক খেয়ে হেগে দেয়! ছেলেটা আঙুল দিয়ে মাথার গু স্পর্শ করে নাকের কাছে আঙুল এনে নাক কুঁচকায়!
এরপর একদিন সেই তরুণী যাকে মৌরিবিবি একটা কাকের ডিম দিয়েছিল! সেই মেয়েটা দেখে তার ডিম ফুটে একটা কাকের বাচ্চা বেরিয়েছে! ফলে সে উত্তেজনায় বাচ্চা সহ মৌরিবিবির কাছে ছুটে আসে! মৌরিবিবি নিরাসক্ত চোখে তাকিয়ে বলে,
– আমার কাছে আনছস ক্যান?
– দেখাইতে আনলাম!
– এখন বিদায় হ!
– এরে করবো কি?
– একজন মা যা করে তাই করবি!
– মানে?
– সময় হয়া আসতেছে! এরে লালনপালন কর!
– আচ্ছা!
মেয়েটা তার বাড়ি ফিরে যাবার পর একটা বিরাট কাকের ঝাক মেয়েটার বাড়ির উপরের আসমানে ঘুরপাক খায়! এলাকার লোকেরা বলে, হাজার হাজার কাকের একটা বাহিনী যেন ঐ বাড়িটার উপর ঘুল্লি খাইয়া উধাউ হয়া যায়!
ফলে ক্রমে ঐ অঞ্চলে বাড়ির মহিলারা একে একে মৌরিবিবির কাছে তাদের বিচিত্র সমস্যা নিয়ে আসে আর তার সমাধান হিসেবে মৌরিবিবি প্রত্যেককে একটা করে খাঁচায় বন্দি কাক দিয়ে দেয়! এবং তারপর কাকেরা কাকবাজি করে সেই সেই বাড়ির উপর এবং এরপরদিন থেকে দেখা যায় সেই সেই বাড়ি গুলো কাকেদের নতুন ঠেক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ওঠে! ফলে ঐ অঞ্চলের আশপাশের অঞ্চলের লোকেরা আঙুল উঁচিয়ে কয়, ‘ঐ অঞ্চলে কাকের হুকুমত চলে! মৌরিবিবি হইলো তাদের মা!’ কিন্তু ক্রমে দেখা যায় মৌরিবিবির ঐ অঞ্চলে অন্য সব অঞ্চলের তুলনায় লোকেরা ধানাইপানাই কম করে! ওজনে কম দিতে তারা সাহস পায় না কেনোনা সবাই জানে মাথার উপ্রে খাম্বার তারে কিংবা বাড়ির কার্নিশে কাক বসে আছে! কমবেশি হলেই হুসসস করে উড়ে এসে মাথায় ঠোক্কর দিয়ে উধাও হয়ে যাবে! কিন্তু রাষ্ট্র তো এইসব পছন্দ করে করে না, রাষ্ট্র তার শরীরের মধ্যে অন্য কারোর অস্তিত্বকে পছন্দ করে না, ফলে একদিন এক মাইক্রোবাস ভর্তি গোয়েন্দা আসে মৌরিবিবি কাছে! তিনজন অফিসার উপরে ওঠে, বাকিরা নিচে দাড়িয়ে থাকে এবং দেখে বাড়ির কার্নিশে কার্নিশে কাক ঘুরে বেড়াচ্ছে! ছাদে মৌরিবিবি যখন একটা কাকের বাচ্চাকে নিয়ে খেলা করছিল তখন গোয়েন্দা তিনজন হাজির হয়!
গোয়েন্দাদের সঙ্গে মৌরিবিবির আলাপ…
– আসেন!
– আপনি কী জানতেন আম্রা আসছি?
– বসেন!
– বসেতে আসিনি! আম্রা এসেছি আপনাকে একটু নিয়ে যেতে!
– কই নিবেন?
– আম্রা আসছি যখন জানেন, কোথায় নিয়ে যাবো সেটাও নিশ্চয়ই জানেন!
– তা জানি! আপ্নেদের কাছে যেমন তামাম খাবর থাকে! আমার কাছেও সামান্য খোঁজখবর আসে দুনিয়ার!
– তাই?
– আপনিও গোয়েন্দা পোষেন?
– উঁহু! কাক! কাকেরা আমারে খবর দেয়!
– দেখেন আমাদের সাথে এইসব ভুংভাং কথাবার্তা বলে লাভ নাই!
– সত্য কখনো ভুংভাং হয় না!
– সেটা দেখা যাবে! এখন চলুন! ঘণ্টা দুয়েক পর ফিরিয়ে দিয়ে যাবো!
– কে কারে তুইলা নেয়, কে কারে ফিরায় দেয়! তাজ্জব না?
– আপনার কারবারটা কী বলুন তো?
– কিছু না! আপনেরা ক্যান ঘাড়ের উপ্রে পরেন?
– নিরাপত্তার খাতিরে!
– এতো ভয় দিলের মইদ্দে? গদি উল্টায় যাবার ভয়?
– কথা তো ভালোই বলেন! এখন চলেন!
– আমি কোথাও যাই না!
– লাভ নাই, আপনি মুরুব্বি মানুষ, না গেলে তুলে নিয়ে যেতে বাধ্য হবো!
– সেইটা তো বুঝতেছি!
– আমি তো কাউরে খুঁচাই না! নিজের মনে থাকি! তোমরা ক্যান খুঁচাইতে আসছ আমারে?
– আমাদের কাজই খোঁচানো! নেড়েচেড়ে দেখা!
– নিরীহরেও?
– নিরীহ বলে কেউ নেই! সবাইকেই সন্দেহের তালিকায় রাখতে হয়!
– কিন্তু আমি কেন যাবো?
– আপনাকে আম্রা সন্দেহ করছি তাই!
– কী সন্দেহ?
– আপনার কাছে কেউ তদবিরে আসলে আপনি সবাইকে একটা কাক দিয়ে দেন, তাই!
– পরথম কথা হইলো আমি তদবির দিই না কাউরে! ঐ লাইন আমার না! কাক দেই কারণ তাদের সবার মনের মধ্যে একটা কাক পাল্বার বাঞ্ছা উঁকিঝুঁকি দেয়! আমি সেই শখ মিটাই!
– তাতে ঝামেলা বাঁধে!
– ঝামেলা?
– হু!
– নাকি ঝামেলাওয়ালারা কাক নিলে ঝামেলায় পইড়া মুক্তি পায়?
– কথার প্যাঁচ খেল্বেন না! চলেন! ওঠেন আর কথা হবে না!
– আমি যাবো না বলেছি একবার!
– আম্রা কিন্তু গায়ে হাত দেবো! তুলে নিয়ে যাবো!
– আকাশের দিকে দেখো! ঐদিকে, যেইদিক সূর্য হেইলা পড়ছে!
গোয়েন্দারা তাকিয়ে দেখে একটা বিরাট মেঘের মতো কালো ছায়া এদিকে এগিয়ে আসছে! মৌরিবিবি বলে…
– এক্ষন বিদায় হও, নাইলে বিপদে পড়বা!
গোয়েন্দারা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে! তারা টের পায় লক্ষ লক্ষ কাকের মিছিল এগিয়ে আসছে! তাদের পা যেন পাথর হয়ে যায়!
এই ঘটনা ছড়িয়ে যায় দিকেদিকে! ফলে মৌরিবিবি বিব্রত বোধ করেন! তিনি এইসব কিছুই করতে চান্না! এবং তিনি নিজের প্রচারণাও চান্না! লোকের মুখ থেকে শোনা যায়, সেইদিন আকাশ অন্ধকার করে আবার কাকের দঙ্গলেরা কোত্থেকে যেন আসে আর ঘটনা ঘটিয়ে উধাও হয়ে যায়! গোয়েন্দাদের মাইক্রবাসটাকে খুঁজে পাওয়া যায় পাশের নদীতে ফলে ব্যাপারটার গুরুত্ব কয়েকগুণ লাফিয়ে উঠে যায়! এবং এরপর থেকে দেখে যায়, মৌরিবিবির বাড়ির চারপাশে ড্রোন উড়তে! আর ড্রোন দেখলেই কাকেরা ঘিরে ধরে ঠোকরাতে থাকে! ফলে এলাকার লোকেরা মৌরিবিবির কাছে আসে কৌতূহল নেভাতে…
একজন মহিলা আসে…
– আপা কী শুনলাম, আপনের নাকি মহা বিপদ?
– তাতে তোমার কী?
– পোলাপাইনেরা কইতেছিল, সরকার নাকি বিমান পাঠাবে বোম মারতে আপনের মাথায়!
– তুমি এইহানে বইসা আছো ক্যান তাইলে?
– তাইতো!
– বোমা ছাড়া রাক্ষসের আর আছে কী?
– তাইলে কী করার?
– বিদায় হও নাইলে বোমা পড়লে আমার সাথে তুমিও মরবা!
– তা ঠিক! যাই তাইলে!
– যাও!
একজন যুবক আসে মৌরিবিবির কাছে…
– চাচী কী শুনলাম, সরকার নাকি খেপছে আপনার উপ্রে?
– তাতে তোমার কী?
– পোলাপাইনেরা কইতেছিল, সরকার নাকি হেলিকাপ্টার পাঠাবে আপনেরে তুইলা নিতে?
– তুমি এইহানে বইসা আছো ক্যান তাইলে?
– তাইতো!
– তুইলা নেয়া ছাড়া রাক্ষস আর পারে কী?
– তাইলে কী করার?
– বিদায় হও নাইলে আমার সাথে তোমারেও তুইলা নিয়া যাবো!
– তা ঠিক! যাই তাইলে!
– যাও!
একজন বালিকা আসে…
– দাদী তোমারে নাকি মাইরা ফেলবে সরকার?
– তাতে তোর কী?
– সবাই কইতেছিল তাই!
– তুই তাইলে এইহানে বইসা আছো ক্যান?
– আমার তোমার জন্যে মায়া লাগে তাই!
– রাক্ষসের মায়া নাই বুঝছস?
– আমার বাড়ি চল? আমার ঘরে তোমারে লুকায় রাখবো!
– বাড়ি যা পাগলি মাইয়া! এইটা নিয়া যা!
মৌরিবিবি মেয়েটাকে কাকের পালক দিয়ে বানানো একটা মুকুট দেয়! মেয়েটা মুকুটটা মাথায় পড়তেই তার মনে হয় সে কাক সমাজের সম্রাজ্ঞী! মৌরিবিবি তাকে দেখে হাসে!
সেদিন মধ্যরাত থেকে কাকের কান্নার শব্দ শোনা যায়! এলাকায় যেন মাতম ওঠে! এলাকার বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির সরবারহ বন্ধ হয়ে যায়! আর কাকেরদের ভিড়ে যেন অন্ধকার আঁঠালো হয়ে যায় ক্রমে! এলাকার লোকদের খুব কষ্ট লাগে! মহিলাদের বুক ভেঙ্গে কান্না আসতে থাকে!
এই ঘটনার অনেকদিন পর সেই যুবক তার ক্যামেরা নিয়ে আবার হাজির হয় মৌরিবিবির ছাদে! সেখানে এসে সে দেখে, এক তরুণী কোলের মধ্যে একটা দাঁড়কাক নিয়ে আদর করছে! ছেলেটার সঙ্গে তার আলাপ হয়…
– মৌরিবিবি কোথায়?
– আছে!
– কই?
– বললাম তো আছে! এইখানেই আছে!
– মানে?
– আপনে এখনো ভোদাই আছেন!
– বুঝি নাই!
– মৌরিবিবি এখন ডিমের আকার ধারন করছেন!
– সেটা আবার কী?
– তিনি আমারে একসময় একটা কাকের ডিম দিছিলেন! যেইটা ফুইটা এই কাকটা জন্ম নিছিল! যেই রাত্রে এইখানে সেই ঘটনা ঘরে সেই রাত্রে আমি টের পাই, আমার এই কাউয়াটার পেটে ডিম আসছে! পরদিন কিংবা তারপরদিন আমি বুঝতে পারি, সেই রাত্রে মৌরিবিবি ডিমের আকার ধারন করে এই কাকের মধ্যে স্থান নিছেন!
– কী বলেন এইসব?
– বুঝলে আছে না বুঝলে নাই!
– খবর পেলাম আপনাদের এলাকার মহিলারা মানে যারা কাক পালত, তারা নাকি মৌরিবিবি উধাও হয়ে যাবার পরদিন থেকে যে যার বাপের বাড়ি গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসছে, আর সবাই সবার বাপ-মার দেশের মহিলাদের কাক দিয়ে আসছে?
– তার আমি কী জানি!
– আপনি জানেন না?
– সব কিছু জাইনা কাম কী? ঘটনা ঘটাইলেই কী ঘটনার শেষ হয়? কোন কোন জিনিস ছড়ায় যায়!
– বুঝলাম না!
– বুঝবেন না আপনে!
– কেন বুঝবো না আমি!
– আপনে আসলে কে?
– কে আমি?
– আপনে আসলে একটা ভোদাই!!
ছেলেটা ভগ্নমনে চলে যেতে যেতে ভাবে, মৌরিবিবি কি খোলস ছেলে এই মেয়েটার রূপ ধরেছে? মানুষ কি সাপের মতন খোলস পাল্টায়? কিন্তু ডিমটার মধ্যে যদি মৌরিবিবি থাকে তবে আগেরজন কে ছিল? ভুত? এবার কী মৌরিবিবি জন্মাবে? কিন্তু এই কাক গুলো তো মরাকাক! তাহলে এই তরুণী কে? হঠাৎ তার নিজেকে ভোদাই ভোদাই লাগে! সে টের পায় একটা কাক তার মাথার উপ্রে উড়তে উড়তে আসছে! এরপর থেকে কাকটা তার পিছু ছাড়ে না!
রচনাকাল: ফেব্রুয়ারী ‘২০২১
~~~~
প্রচ্ছদ : সুমন মুখার্জী