কবির মৃত্যু – রিমি মুৎসুদ্দি

      শরৎকালের আকাশে খুশীর ঝলক। অথচ আকাশের দিকে তাকাতে পারেন না হিন্দুস্থানের বাদশাহ বাবর। আগ্রার আকাশে সূর্যের প্রবল তেজ চোখ ঝলসিয়ে দেয়। গরমে তাঁর রেশমী কাপড় ভিজে একেবারে গায়ের সঙ্গে সেঁটে আছে।

বাদশাহের বিশ্বস্ত অনুচর ও সঙ্গী তাহির আফতাবচী এগিয়ে দেয় নরম সাদা রুমাল। একবার ঘাম মুছতেই রুমালটা ভিজে চুপসা হয়ে যাচ্ছে। তাহির অন্য আরেকটা নতুন রুমাল এগিয়ে দেয় শাহকে।

হিন্দুস্থানের বাদশাহ বাবর ‘জর আফশা’ বাগিচায় পরিভ্রমণ করছেন। তাঁর দুই বেগমও সঙ্গে আছেন। ঠাণ্ডা ফলের রস আনতে নির্দেশ দিলেন সম্রাট। ফলের রস ও একটি সোনার থালায় কয়েকটা টাটকা সাদা আঙুর এলো সম্রাটের জন্য।

বেগমরা সবাই ব্যস্ত শাহর মনোরঞ্জনের জন্য। কিন্তু সবার মনেই ক্ষোভ। হাসি তামাশা ও শাহর প্রশংসার মধ্যেও সেই ক্ষোভ ঠিক নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। এই যেমন, গুলরুখ বেগমের অভিযোগ শাহ তাঁর পুত্র মির্জা কামরানের দিকে বিশেষ নজর দেন না। দিলদার বেগম বাবরের দেওয়া আঙুর মুখে পুরে বললেন,

-আহা! কি মিষ্টি এই ফল। আমার আলোয়ার না জানি কোথায় আছে এখন? এক টুকরো যদি বাছার মুখে তুলে দিতে পারতাম? বাছা আমার বড় হয়ে ইস্তক আমার থেকে দূরে। বাদশাহর সব বাগীদের শায়েস্তা করতেই তার কৈশোর যৌবন এক এক করে পেরিয়ে যাচ্ছে।

দিলদার বেগমের দীর্ঘশ্বাস বাবরের কানে এসে লাগে। গুলবদন বেগমেরও মন খারাপ হয়ে যায়। প্রিয় ভাইদের অনুপস্থিতি এই আনন্দ সন্ধ্যায় যেমন কষ্ট দেয়, পিতার বিষাদাচ্ছন্ন মুখ আরও বেশী পীড়া দেয় তাঁকে।   

আঙুরের থোলো পড়ে থাকে সোনার থালায়। একটা আনন্দ সন্ধ্যায় চরাচর জুড়ে বিষাদ রাগিনী বেজে ওঠে।

শাহকে ক্লান্ত মনে হওয়ায় তাহির বিশ্রামাগারে তাঁর শয্যা প্রস্তুত করার জন্য অনুমতি চায়। কিন্তু বাবর নির্দেশ দেন,

তিনি এখন বিশ্রামাগারে কিছুক্ষণ একা থাকবেন। তাঁর লেখার সরঞ্জাম যেন সব প্রস্তুত থাকে।

সম্রাটের খোয়াবগাহ এখন এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতায় ঘেরা। সম্রাট সেখানে একাগ্র চিত্তে নিবিষ্ট তাঁর রচনায়।

তাহির জানে বাদশাহ কখনও কবিতা লেখেন। দু-এক ছত্র তাহিরকে পড়ে শোনান। আবার বেশীরভাগ সময়েই নিজের জীবনী লেখেন। এই জীবনী তিনি উপহার দেবেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র, সিংহাসনের উত্তরাধিকার মির্জা হুমায়ুনকে।

আগ্রায় এবার এখনও বড় গরম। খসখসের ঠাণ্ডা পানি খোয়াবগাহের ভেতরটা শীতল রেখেছে। তবুও শাহ ঘামছেন দরদর করে। তাহির সম্রাটের জন্য ঠাণ্ডা তরমুজের রস এনে রেখেছে। সম্রাট আজ খুব অন্যমনস্ক। পানপাত্রে পানীয় পড়ে রইল। সম্রাট লিখে চলেছেন। ঘরের বাইরে বসে তাহির ভাবার চেষ্টা করছে, কী এমন চিন্তা শাহর?

-তাহিরজান!

বাদশাহর গলা শুনে তাহির নীচু হয়ে ঝুঁকে কদমবুসি করে সিধে হয়ে দাঁড়ায়। চোখ মাটিতে। সম্রাটের মুখের দিকে সোজাসুজি তাকানো অন্যায়। 

-বাদখাশানের জঙ্গলে একবার এক বৃদ্ধ চাষী আমাকে চিনতে না পেরে বলেছিল, সে মির্জা বাবরকে খুঁজছে। মির্জা বাবরকে পেলে তার সর্বশক্তি দিয়ে মির্জার মাথা কাটবে না হলে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবে। মনে আছে তাহির? সেই বৃদ্ধের অশক্ত হাতে সামান্য একটা লাঠি যেন সর্বশক্তি দিয়ে মির্জা বাবরকে আক্রমণ করতে চেয়েছিল?

তাহির মাথা নীচু করে।

-মনে আছে আলমপনা। আমি তরবারি বার করতেই আপনি আমায় চোখের ইশারায় বারণ করলেন। আপনি পরম মমতায় সেই বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন তার মির্জা বাবরের প্রতি এত আক্রোশ?’

-সেদিন বাদখশানের জঙ্গলে সেই বৃদ্ধ গরীব পিতা আমাকে মারার জন্য হাতের লাঠিকেই তরবারি মনে করে দৃঢ়ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে কি জানে? ওশ পাহাড়ে তার মেষপালক ছেলের মাথা আমি কাটিনি। আমারই বেগ আহমেদ তনবাল তার লোভ চরিতার্থ করতে কয়েকজন নিরীহ চাগ্রাক মেষপালক কিশোরের মাথা কেটেছিল সেদিন। 

নিজের কাছে নিজেই যেন কৈফিয়ত দিচ্ছেন এভাবেই এখন কথা বলছেন সম্রাট বাবর।

-কর না দেওয়ার অপরাধে ওদের দণ্ডিত সেদিন আমি করিনি। কর ছাড়া আমাদের শাহী যেমন অচল, বেগ আমির ওমরাহদের সমস্ত বিলাসিতাও এই কর থেকেই আসে। ওরা সবাই যৌথ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আমি তো ঘটনাস্থলে সেদিন উপস্থিতও ছিলাম না। অবশ্য বেগদের মর্জির বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো শক্তি তখন তরুণ বাবরের ছিল না।

তাহির চুপ করে থাকে। সে নিজেও কৃষকসন্তান। সে জানে কৃষকেরা ইচ্ছে করে শাসনকর্তার সঙ্গে বিরোধ করে না। কত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এক চাষী পরিবারকে। ফসল ফললেই হলো না। অবিরত লুঠতরাজ মির্জার বেগদের, বাইরে থেকে আসা দুষমনদের। নিজেরা আধপেটা খেয়েও কর তারা বাকি রাখতে চায় না। কারণ, এই কর বাকি রাখার পরিণাম তাদের ঘরের মা বোন বিবি বাচ্চা সবাইকে ভুগতে হবে। এ তো এক চাষী ঘরের বাচ্চাও জানে।

তাহির এসব কিছুই বলে না। সম্রাটের মুখের ওপর কোনও কথা বলার অভ্যেস তার নেই।

বাবরই কথা বলেন,

-তাহিরজান! সেই পিতার চোখে আমি ক্রোধ দেখিনি সেদিন। সে চোখে যা ছিল তা একমাত্র পুত্রশোকের কাতরতা। নাহলে আমি ক্ষমা করার কে?

তাহিরের মনে হল, তার হুজুরের মনের ওপর আজ অসম্ভব চাপ পড়েছে কোনও কারণে।

-জাঁহাপনা, রাত অনেক বাড়ল। এইভাবে প্রতিদিন রাত জেগে আপনার শরীরের ক্ষয় হচ্ছে। হাকিমসাহেব বারবার আপনাকে বিশ্রাম নিতে বলেন।

তাহির তো বাবরের চাকর নয়, সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর। তাহিরকে ধনী বেগ, আমির বানাতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাহির এতদিন ধরে বাবরের সঙ্গে থেকেও অন্য বেগদের মতো লোভী নয়। বাবরের সেনাদের মধ্যে এক পয়লা নম্বর সৈনিক হয়েও ওর মনে কুভার সেই কৃষক তাহির এখনও বেঁচে আছে। বাবর সেই কৃষক তাহিরকে প্রবলভাবে অনুভব করেন আর কষ্ট পান ভেবে, সম্রাট বাবরের মধ্যেও কি কবি বাবর বেঁচে আছে এখনও? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন। তেমন কবিতা আর লিখতে পারেন না। যেমন তিনি লিখতেন সমরখন্দ থেকে বিতাড়িত হয়ে হীরাটে আশ্রয় নেওয়ার সময়। তাঁর নিজের লেখা একটা লাইন মনে পড়ে গেল,

‘এই বিশাল দুনিয়ায় আমি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে পেলাম না মনের মানুষ

আমার তামাম দুঃখ, আমার ভুল সব তাই আমি নিজেকেই করলাম সমর্পণ!’

সেই যে কবে আয়েষা বেগম, তাঁর জীবনের প্রথম নারী, প্রথম ভালবাসা, তরুণ বাবরকে ত্যাগ করলেন, আরও কত মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা, অপমান সহ্য করতে করতে বাবর লিখেছিলেন,

‘আমার সকল দুঃখের মাঝে দুঃখ হয়েই তুমি রইলে

আমার সকল ভুলের মাঝে একটা ছোট্ট চিরাগও

                    নাহয় তুমিই জ্বালালে!’ 

শেষ রাতে বাবর ঘুমিয়ে পড়েছেন। কোথাও যেন একটা শোরগোল শুনতে পেলেন। খুব কাছেই। অভ্যেস বশে দ্রুত কোমরবন্ধ থেকে টেনে বার করলেন তাঁর সবসময়ের সঙ্গী ধারালো একটা ছুরিকা। তরবারি হাতে তুলে নিতেও সময় লাগত না তাঁর বিশেষ। কিন্তু গোলমালটা স্পষ্টই একটা মেয়েলী কান্নার সুরের মতো শোনাচ্ছে। আর খুব চেনা সেই কান্নার আওয়াজ। ঘুমটা সবে একটু গাঢ় হয়েছিল তাই প্রথমদিকে ঠাহর করতে পারেন নি। এ তো দিলদার বেগমের কান্না। দ্রুত খোয়াবগাহের বাইরে এসে দেখলেন, দিলদার বেগম হাপুস নয়নে দ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।

-এ কি বেগম? তুমি এমন কাঁদছ কেন?

-সম্রাট! আপনার শয়নকক্ষে অনুমতি না নিয়ে ঢোকার মতো সহবৎ আমি আজও এই বিপদের সময়ও হারাইনি।

-বিপদ? কী বিপদ?

বাবর দ্রুত স্ত্রীর হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলেন। আইভানের(পালঙ্ক) ওপর বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-কী হয়েছে বেগম? আমাকে শীঘ্র বলো। আমার উৎকণ্ঠা হচ্ছে যে খুব!

কান্নায় ভেঙে পড়ে দিলদার বেগম জানালেন তাঁর জোয়ান ছেলে আলোয়ার মির্জা ঘোরতর অসুস্থ। হাকিম জবাব দিয়েছে। দ্রুত ছেলের কাছে যেতে চান তিনি। তাই বাদশাহর অনুমতি নিতে এসেছেন।

বাবরের সমস্ত প্রাণশক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে এল এই খবরটা শুনে। আলোয়ার তাঁর খুবই সুদর্শন ও শক্তিমান ছেলে। কত স্বপ্ন তিনি দেখেন ছেলেদের নিয়ে। হুমায়ুন, কামরান, আলোয়ার, হিন্দাল সবাইকে নিয়ে এমন শক্তিশালী ফৌজ তৈরি করবেন যে শুধু সমগ্র ভারতবর্ষই নয় একদিন তাঁর বংশধররা ঠিক ফিরে পাবে তাঁদের পিতার মাতৃভূমি, সমরখন্দ।

কালবিলম্ব না করে বাবর দিলদার বেগমের সঙ্গে রওনা দিলেন। গন্তব্য দেহেলী। অসুস্থ আলোয়ার সেখানে হাকিম কবিরেজের চিকিৎসাধীন। সমস্ত পথ চিন্তা করতে করতে গেলেন, কতটা অসুস্থ তাঁর সন্তান? একটা জোয়ান ছেলে পারবে না রোগের সঙ্গে লড়াই করতে? তিনিও তো এই বৃদ্ধ বয়সে বিষের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছেন। আলোয়ারও নিশ্চয়ই পারবে। সমস্ত পথ জুড়ে হিন্দুস্থানের বাদশাহ মোনাজাত করলেন।

সম্রাট দিল্লি পৌঁছেই পেলেন সেই মারাত্মক খবর। সব শেষ! আলোয়ার মির্জা আর নেই এ পৃথিবীতে।

মর্মান্তিক শোকে বাবর স্তব্ধ হয়ে গেলেন। আর আলোয়ারের মা দিলদার পুত্রশোকে পাগল হয়ে গেলেন। বাদশাহর বেগম ভুলেই গেলেন তিনি বাদশাহের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পাগলের মতো চিৎকার করে স্বামীকেই এই শোকের জন্য দায়ী করলেন। বারবার বললেন,

-আমার আলোয়ারের কাছে আমি থাকলে সে কখনওই তাঁর আম্মিকে ছেড়ে কোথাও যেতো না। কেন? কেন সম্রাট আলোয়ারের মা’কে আগ্রায় ডেকেছিলেন। কেন ওই বাচ্চা ছেলেকে বারবার যুদ্ধে পাঠানো হতো?

সমগ্র ভারতবর্ষকে যিনি এক শাসনের তলায় আনতে চলেছেন, ভারতের অধিপতি হওয়ার স্বপ্ন যাঁর চোখে সেই বাবরের চোখেও জল। নিজের স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তরে শুধুমাত্র অশ্রু বিসর্জন করে চলেছেন। কী করে বোঝাবেন এই সদ্য পুত্রহারা মা’কে? চাঘতাই বংশের রাজকুমারদের ছোটোবেলা থেকে যে বিষয়ে পারদর্শী হতে হয় তা হল যুদ্ধ। আর যেকোনো বিষয়ে যতই দক্ষতা থাক, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী না হলে সবটুকুই ব্যর্থ।

এর মধ্যে সম্বল থেকে চিঠি এসেছে। শাহাজাদা হুমায়ুন গুরুতর অসুস্থ। দিল্লির পথে রওনা দিয়েছে শাহাজাদা আর সেই খবর পেয়ে কাবুল থেকে হুমায়ুনের মা মহিম বেগমও দিল্লির পথেই রওনা দিয়েছেন।

অসুস্থ হুমায়ুন দিল্লি এসে পৌঁছালে তাঁর চোখে বাবর মৃত্যুর ছায়া দেখে আতংকিত হলেন। মহিম বেগমও কাবুল থেকে এসে পৌঁছেছেন।

হুমায়ুনের রোগশয্যায় মহিম বেগমের পাশে এসে বসলেন তিনি।

মহিম বললেন,

-‘বাদশাহ’র অন্য বিবি সন্তান আছে। তাই তিনি নিশ্চিন্ত। কিন্তু আমার হুমায়ুন ছাড়া কোনও জগত নেই।’

খুব আহত হলেন বাবর। একদিকে পুত্রের অসুস্থতা, আরেকদিকে মহিম বেগমের ভর্ৎসনা। শোকে দুঃখে কাতর হয়ে আবার শুরু হল তাঁর রাত্রি জাগরণ। আল্লাহের দরবারে মোনাজাত। নিজের প্রাণের বিনিময়েও যেন সুস্থ হয়ে ওঠে তাঁর প্রাণপ্রিয় হুমায়ুন।

দু’তিনমাস একভাবে ছেলের রোগশয্যার এক পাশে বসে রইলেন। হুমায়ুন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন।

সুস্থ হয়ে কালিঞ্জরে চলে গেলেন হুমায়ুন।

এরপর বাবরের রোগশয্যার পালা। লোকমতে দৃঢ়তর বিশ্বাস প্রতিষ্টিত হল, ঈশ্বর তাঁর প্রার্থনা শুনেছেন।

হুমায়ুনের অসুস্থতার মতোই বাবরের রোগের কারণ ছিল সেই একই পরিপাক জনিত সমস্যা। শাহী রন্ধনশালায় ভেসে উঠল কানাঘুষো। যে কানাঘুষোর নেপথ্যেও ছিল আরেক মাতৃস্নেহ ও সেই স্নেহসুধার রসে সিক্ত প্রতিশোধের কথকতা।

হুমায়ুনের রোগশয্যায় রাত্রি জাগরণের ফলে বাবরের অজীর্ণ রোগ হল। কিছু খেতে পারতেন না তিনি। শাহী পাচক আহমেদ চাসীন গীরকে একটা মশলার গুঁড়ো এনে দেন এক বৃদ্ধা রমণী। অশতিপর এই বৃদ্ধা রমণীর চোখের দিকে তাকাতে কেউই সাহস করতেন না। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ করলে সেই চোখে বিষাদ ও এক অসম্ভব তীব্রতা একইসঙ্গে দেখা যেতো। যে তীব্রতায় সমস্ত সৃষ্টির মধুরতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বাবর তাঁকে মা ডাকতেন। নিজের মৃত মায়ের মর্যাদায় বসিয়েছিলেন তাঁকে।

সুদূর দক্ষিণ থেকে সেই মশলা আনিয়েছেন বৃদ্ধা। পাচক দেখে বুঝল এলাচ ফলের গুঁড়ো। এলাচের গন্ধে রমণীর হাতদুখানি ভরপুর। সেই গন্ধে লুকিয়ে রয়েছে বাদশাহ-এর মৃত্যবাণ। একথা শাহী পাচক জানতেন না। তাই রান্নায়, পানীয়তে মিশল সেই মশলা। এলাচ গন্ধী খাবারে বাবরের অজীর্ণ রোগ সেরে যাবে। কিন্তু ফল হল উল্টো। বাবরের অসুস্থতা সমস্ত চিকিৎসার উর্ধ্বে চলে গেল।

রোগশয্যায় বাবর জানতে পারলেন সেই বৃদ্ধা রমণীর কথা। তিনি আর কেউ নন, তিনি সুলতানা বাইদা, বাবরের হাতে নিহত সুলতান ইব্রাহিম লোদির মা। আগেও যিনি বাবরকে বিষ দিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। বাবরের প্রিয় তাহিরবেগ, মহিম বেগম, হারেমের অন্যান্য বেগমরা ও শাহীর আরও গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী মানুষেরা সকলেই চাইলেন, এইবার সুলতানা বাইদার কঠোর শাস্তি হোক। নাহলে, প্রজাদের কাছে বার্তা যাবে, বাদশাহকে খুন করা খুবই সোজা। এতে চাঘতাই বংশের শৌর্যহানি হবে। অপরাধীকে শাস্তি দিতে সকলেই প্রস্তুত।

সম্রাট দূতকে নির্দেশ দেন, বন্দিনী সুলতানাকে তাঁর এই শয়ন কক্ষে নিয়ে আসতে।

সুলতানা বাইদাকে নিয়ে আসা হল বাবরের বিশ্রাম কক্ষে। বৃদ্ধ সুলতানার দুদিকে অস্ত্র হাতে দুই রক্ষী। সম্রাটের নির্দেশের অপেক্ষায়। নির্দেশ পেলেই প্রহরীরা বৃদ্ধার মাথা আলাদা করে দেবে তাঁর শরীর থেকে। দুই রক্ষীই প্রস্তুত এই আদেশ পালনের জন্য।

বাবর দেখলেন বৃদ্ধার চোখেমুখে কোনও শোক নেই, কোনও অনুতাপ বা ভয় কিছুই নেই। বরং বাবরের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে যে চোখ সেখানে এক ক্রুর হাসি। বিজয়িনীর অহংকার।

বাইদা বললেন,

-সম্রাট, অনেক হয়েছে। আমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করুন এবার। আমি যতদিন বাঁচব, আপনার মৃত্যুই আমার একমাত্র পথ। আমি সন্তানহত্যাকারীকে আমার শেষ নিঃশ্বাস অব্ধি ক্ষমা করতে পারব না। যদি বাঁচতে চান, এই বৃদ্ধার মৃত্যুই আপনার একমাত্র পথ।

অসুস্থতা চরম সত্ত্বেও বাবরের এখনও মনে হচ্ছে শারীরিক শক্তির বলে তিনি উঠে দাঁড়াতে পারবেন আর ওই উদ্ধত বৃদ্ধাকে উপযুক্ত জবাব দিতে পারবেন। শুধু ওই চোখ দুটোতেই তরবারির আঘাত হানতে তাঁর এখনও কোনও কষ্টই হবে না।

তিনি শাস্তি ঘোষনা করলেন।

সম্রাটের মুখে উচ্চারিত হল প্রথম শব্দ

-মা!

সম্রাটের কক্ষে উপস্থিত সকলেই চমকে উঠলেন ওই ‘মা’ ডাকে। কী ছিল ওই ডাকে? যে তীব্র প্রতিহিংসায় জর্জরিত লোদি সুলতানার বুকের ভেতরও কেঁপে উঠল!

বাবরের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিলেন তিনি।

বাবর সোজাসুজি চোখ রেখেছেন অপরাধিনীর চোখে। ক্ষীণ অথচ দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারিত হল,

-আপনি এখন আর পুত্রশোকে পীড়িত মা নন। আমি অত্যন্ত খুশী যে আপনার পুত্রবিয়োগের শোক দূর হয়েছে।

বাইদা কিছু একটা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন। বাবর থামিয়ে দিলেন।

-আপনি এখন কেবলমাত্র প্রতিহিংসাপরয়াণা, প্রতিশোধকামী এক নারী। যাকে আমি মা ডেকেছি। কিন্তু আমার শব্দেরা আজ প্রকৃত অর্থেই ব্যর্থ। তাই আপনি আমার মা ডাকের সাড়া দিলেন এইভাবে। আপনাকেও আমার সঙ্গে শাস্তি ভোগ করতে হবে। আপনি মুক্ত। সম্পূর্ণ মুক্ত। এই হিন্দুস্থানে আপনার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না কোনও সম্রাট, কোনও শাহাজাদা, কোনও সৈন্য। আমি আদেশ দিচ্ছি আপনাকে মুক্ত করা হোক। আপনি যান। আপনার নিজ গৃহে ফিরে যান। এই আমার আদেশ। আমার অনুকম্পা আর ক্ষমাই আপনার শাস্তি!

সমস্ত কক্ষ জুড়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ল কিছুক্ষণ। বাইদা প্রথমে হতবাক হয়ে চুপ করেছিলেন। তারপর প্রায় চেঁচিয়ে কেঁদে বললেন,

-চাই না আমি এই ক্ষমা! চাই না কোনও অনুকম্পা! আমি মরতে চাই। আমি সম্রাট বাবরকে সমস্ত ভারতবর্ষের কাছে হত্যাকারী হিসাবেই দেখতে চাই। আমাকে হত্যা করুন সম্রাট। ঠিক যেভাবে যুদ্ধে আহত আমার প্রাণের সন্তান ইব্রাহিমের মাথা আপনি কেটে আলাদা করেছিলেন শরীর থেকে! সেই যন্ত্রণা আমাকেও দিন! আপনি নিষ্ঠুর। রক্তে রাঙা ওই হাত সমস্ত ভারতবর্ষ ও তার ইতিহাস মনে রেখে দিক। এই ক্ষমা অনুকম্পা আমি চাই না!

নিষ্ফল হল বৃদ্ধার আর্তনাদ! বাবরের নির্দেশে প্রহরীরা বাইদাকে প্রাসাদের বাইরে এনে মুক্ত করে দিল।              

আর প্রাসাদের ভিতর গৃহকক্ষে বাবরের দীর্ঘশ্বাসে মিশে রইল কয়েকটা শব্দ-

‘আমি মরি তবুও তুমি বাঁচো!’   

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী

*****