কেওয়াইসি-দিলীপ কুমার ঘোষ

চলুন, আমরা সকলে মিলে একটা গল্প বলি। কী হল? ঘাবড়ে গেলেন! আরে ঘাবড়াবেন না। আপনাদের তো আর অকথা-কুকথা বলে রাজ্যিজয় অথবা উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলে দেশোদ্ধার করতে বলিনি। আবার কী ভাবছেন? যোগ্যতা আছে কি না! আরে ছাড়ুন তো মশাই। নিজেকে অযোগ্য ভেবে কে আবার কবে, কোন কাজ থেকে পিছিয়ে এসেছে! জানবেন সীমাহীন অযোগ্যতাই আমাদের যোগ্যতা। তাছাড়া সাকার্স আর এভরিহোয়্যার। ক্যালানেতে ভরা এ গবা জগৎ। তার-ই দু’-চারটের নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যে কিছুই যায় আসে না এ ব্লু প্ল্যানেটের।

 আর শুনুন, গল্পটাকে ছকে ফেলে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও দায় আমাদের নেই। নেই কোনও মেসেজ দেওয়ার দায়িত্বও। আমাদের ইচ্ছানুযায়ী গল্পটাকে আমরা বলতেও পারি, আবার ইচ্ছা না হলে যে কোনও মুহূর্তে থামিয়েও দিতে পারি। তাহলে আর দেরি কেন? আসুন শুরু করা যাক আমাদের এই ফালতু গল্প অথবা সেরেফ বকওয়াস।

 ওই দেখুন, একটা ছেলে পিটিএস-এ বাস থেকে নেমে দাঁড়াল। পিটিএস কেন জানেন? আসলে কলকাতার ওই একটা জায়গাই আমার ভীষণ চেনা। ছেলেটা কোথা থেকে এল, কোথায় যাবে, কিছুই আমাদের জানা নেই। জানা নেই ছেলেটার নাম-ধাম-বয়স-কাজকারবার। তবুও ওকেই আমাদের গল্পের অন্যতম চরিত্র ধরে ঝুলে পড়তে হবে। আসুন, ধানাই-পানাই না করে আমরা ছেলেটাকে অনুসরণ করি। আপনি, হ্যাঁ-আ, আপনি, বাসের রুট ভাল চেনেন। তাই এবার আপনি দায়িত্ব নিন ছেলেটাকে বাসে তুলে দেওয়ার। ততক্ষণ আমি দেখি, কোথা থেকে একটা মেয়েকে জোটানো যায়। কী বলছেন? মেয়ে কেন? ছেলে হলেই বা অসুবিধা কোথায়? না, অসুবিধা নেই। কিন্তু গল্পটা গৌরবে বহুবচন হলেও যেহেতু প্রকৃত প্রস্তাবে আমার, সুতরাং, আমাকে আমার মতো বলতে দিন। আর শুনুন, পলিটিক্যালি কারেক্ট হতে গিয়ে আমি কিন্তু কখনওই অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিতে পিছপা হই না।

 ওহ্, আপনি কী তৎপর! এর মধ্যেই ছেলেটাকে বাসে তুলে দিয়েছেন। অথচ বললেন না কোথাকার বাসে তুললেন– বাগনানের, না কাকদ্বীপের? যাক গে যাক! ভিড়বাসে ওঠা ছেলেটার দায়িত্ব আমি আবার নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছি। ওকে আমি সিটে বসাব না। দাঁড়িয়ে যাক। এতে কী সুবিধা হবে বুঝতে পারলেন কি? পারলেন না তো! তাহলে শুনে নিন। দাঁড়িয়ে গেলে যাত্রাপথে ওর অন্যতম প্রধান ভাবনা কেন্দ্রীভূত হতে থাকবে বসার একটু সুযোগ পাওয়া যাবে কি না তার ওপর। এখন বসে থাকলে তো আর দাঁড়ানোর ভাবনা থাকত না। ফলে ওর ভাবনার খানাতল্লাশী করতে গেলে ওর হয়ে আমাদেরই একটু বেশি ভাবতে হত। কী বললেন? আমার তালজ্ঞান মারাত্মক। হ্যাঁ, তা বটে।

 মেয়েটাকে এখনই গল্পে ইন্ট্রোডিউস করবেন কি না ভাবছেন? কী বলছেন, জীবন যেখানে ছকে বাঁধা, সেখানে গল্পের নায়িকার দ্রুত আমদানি হওয়াই ভাল। কে বললেন একথা? কে-এ? কী ভেবেছেন বলুন তো? জীবন কি ব্লু-ফিল্ম নাকি! একমাত্র ব্লু-ফিল্মেই সবকিছু ছক বাঁধা পথে এগোয়— মায়, অর্গ্যাজম পর্যন্ত। এই দেখুন কোথা থেকে কোথায় ঢুকে পড়েছি! আপনি এখানেই গল্পটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। না, আর ঘাড় হেঁট করবেন না। বিকৃত রুচির মানুষ বলে পরিগণিত হওয়ার দাসখৎ কেউ আপনাকে লিখে দেয়নি।

 কী বলছেন? আপনি নিজেও থামবেন না, থামাতে দেবেনও না? গল্প এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। হ্যাঁ-আ…!, আর কী বলছেন? এত দ্রুত যেন অর্গ্যাজমে না পৌঁছই? কারণ অর্গ্যাজমের আগের স্টেজ অর্থাৎ লিঙ্গোত্থান নিয়ে আপনি একটা অ্যানেকডোট শেয়ার করবেন। দেখেছেন কারবার! এ যে দেখি ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে/ যাবে না ফিরে’! ঠিক আছে, ইচ্ছে হয়েছে যেকালে উগরেই দিন।

  এক কলিগের হাজব্যান্ডের স্পার্ম কাউন্টের জন্য প্রয়োজন ছিল সিমেনের। অথচ প্যাথোলজিকাল সেন্টারের টয়লেটে সে বেচারার ইরেকশন-ই হচ্ছিল না, ইজ্যাকুলেশন তো দূর কী বাত! সে কথা জেনে তার ধর্মপত্নী নাকি গজগজ করতে করতে মোবাইলে স্বামীদেবতার উদ্দেশ্যে বাণীবিতরণ করেছিল, এত করে বলি, মোবাইলে দু’-চারটে পর্ন-সাইট দেখতে অভ্যস্ত হও, তা না, যতসব ম্যাদামারা বিবেকানন্দের বাচ্চা!

 এ কী! বাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা নায়ককে আপনারা ইতিমধ্যেই অনুসরণ করতে আরম্ভ করেছেন? তার মানে এখন আমরা বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে পড়েছি, আর নামা যাবে না। ঠিক আছে, তাহলে আপনি একটু দায়িত্ব নিন গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কী বললেন, আপনাকে দায়িত্ব দিচ্ছি, অথচ আমরা জানি না আপনি কে এবং কেমন? তা আপনারাও তো আমাদের জানেন না। তাতে কি গল্প এগিয়ে নিয়ে যেতে অসুবিধা হচ্ছিল? হচ্ছিল না তো! আরে মশাই এ হল পারস্পরিক বোঝাপড়া। পরস্পরকে না জেনে- বুঝেই তো একমাত্র নির্ভরশীলতা, বিশ্বাসস্থাপন, আস্থাজ্ঞাপন সম্ভব, নাকি! প্লিজ, গল্পটাকে একটু ধরুন। আমরা বরং একটু এনজয় করি। লেট’স এনজয়।

 মিহিরকে আজ একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। রিমা দেখা করতে আসবে বলে আজও এল না। মোবাইলও আনরিচেবল শোনাচ্ছে। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। দিনের পর দিন চাতক পাখির মতো এই অপেক্ষা তার আর ভাল লাগে না। কোথাও মর্যাদায় বাধে। অথচ রিমার কথা ভাবলেই বাস্তব জগতের সমস্ত কলুষতার ঊর্ধ্বে পৌঁছে যায় সে। তার হৃদয়ে উচ্চারিত হয় ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি,/ অন্ধকারে তোমার পবিত্র অগ্নি জ্বলে।’ রিমা ছাড়া তার বেঁচে থাকাই যে শূন্য মনে হয়।

 এই মেরেছে! আপনি তো পুরো গেঁজিয়ে তুললেন মশাই। এ তো রীতিমতো ধ্রুপদী সাহিত্য! আপনি আমার সেই মর্মব্যথা আবার জাগিয়ে তুললেন দেখছি। সেক্টর ফাইভে চাকরিরত আমার এক বন্ধু, আমার বাড়িতে এসে ঘরের বিছানা এবং অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পত্র-পত্রিকা, হ্যাংওভারের কারণে মুড অফ থাকলে কদাচিৎ তুলে নেয় এবং সেখানে প্রকাশিত গল্পগুলো পাতা উল্টিয়ে দু’-এক মিনিটে শেষ করে ভীষণ উন্নাসিকভাবে আমার মুখের দিকে তাকায় এবং আমার কষ্ট হচ্ছে জেনেও গল্পগুলো নিয়ে বিন্দুমাত্র আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করে না। তার কঠোর প্রাণে রেখাপাতই করে না নবীন লেখকের মর্মান্তিক প্রচেষ্টা। আমি হয়তো বলার চেষ্টা করি, এমনও শোনা যায়— অনেক লেখক প্রথম গল্পের প্রথম বাক্যটা লেখার জন্য দশ-বারো বছর অপেক্ষা করে থেকেছেন। কিন্তু ভবী ভোলবার নয়! আমার সেই বন্ধুবর চরম অসংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়ে নির্মম দন্ডদাতার মতো ঘোষণা করে, সো হোয়াট? কোনও লেখা যদি আমার অভিনিবেশ দাবি না করে, কোনও নতুনত্বের সন্ধান দিতে না পারে, তাহলে সে- লেখা ওই দু’-এক মিনিট সময়ই ডিজার্ভ করে। তার বেশি নয়।

আমি আর তর্ক বাড়াই না। কেবল নিও-ক্ল্যাসিক্যাল রচনা দেখলেই বন্ধুর সিনিক্যাল উদাসীন দৃষ্টি মনে পড়ে যায়, আর সহানুভূতি জাগে সেই নবীন লেখকের প্রতি।

 ঘাট হয়েছে মশাই আপনাকে গল্প বলার দায়িত্ব দিয়ে। এ কী করেছেন আপনি আমাদের নায়ককে! জানেন নায়ককে নিয়ে আমাদের ভাবনায় কোনও প্রেম নেই, কোনও কবিতা নেই। আমাদের নায়ক শুধুই লিঙ্গধারী একজন পুরুষ, যে ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ মনে রেখে অর্ধাঙ্গিনীর সঙ্গে বাধ্যতামূলক রমণে লিপ্ত হয়, সুযোগ পেলে বা সুযোগ তৈরি করে নিয়ে পরদার গমন করে, আবার নিঝুম সন্ধ্যায় অনালোকিত পার্কে বসে, পনেরো দিন অন্তর বদলে যাওয়া সো-কলড প্রেমিকার সঙ্গে ইয়ারো আনভিজিটেড, ইয়ারো ভিজিটেড, ইয়ারো রিভিজিটেড করে।

 এই তো, যে নায়িকাকে আপনারা আগেই আনতে চেয়েছিলেন, তাকে এনে ফেলেছি। আরে থামুন, থামুন। নায়িকা বলেই যে তাকে রেয়াত করতে হবে, আমরা তা একদমই মনে করি না। মেয়েটাকে কেমনভাবে উপস্থাপিত করা যায়— একটু ভেবে দেখতে দিন দেখি। দাঁড়ান, তাহলে…মেয়েটাকে একেবারে অকূলপাথারে না ফেলে একটা ব্যাকগ্রাউন্ডে নোঙ্গর করাই। মেয়েটির নাম?— আছে একটা। বয়স?— হয়েছে বইকি! অভ্যাস?—নিয়মিত স্বমেহন এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ খাদ্যাভ্যাসে মাংসাশী এবং ফ্রুট-ইটার (দ্বর্থক; দ্রষ্টব্য — পর্নোগ্রাফি)। ম্যারিট্যাল স্টেটাস?— বেশ গোলমেলে, পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনের ভাষায় ‘নামমাত্র বিবাহ’ গোছের। বর্তমানে সিঙ্গল। অভিজ্ঞতা?— গাছপাথর না থাকার মতো না হলেও অনেক ঘাটের জল খাওয়া।

 এবার ফ্ল্যাশব্যাক। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় মেয়েটার সঙ্গে একটা ছেলের ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের একটা সম্পর্ক হয়। দু’বছর পর ছেলেটা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য চলে যায় জলপাইগুড়ি। সম্পর্কটা যদিও তামাদি হয়ে যায়নি। পরবর্তী পর্বে দু’বাড়িতে জানাজানি এবং দুই পরিবারেই সম্পর্কের মান্যতা তৈরি হওয়া। মশাই, দুর্ দুর্, এ যে দেখছি এবার আপনি নিজেই ঘুমপাড়ানি গান শুরু করেছেন! হ্যাঁ, তাই তো! আমার আবার হঠাৎ এ কী ভীমরতি ধরল যে ভিয়ের মধ্যে গ্রামাটিক্যালি কারেক্ট খেলতে চাইছি! তবে কথা দিচ্ছি ঝোলাব না। টি-টেন এই শুরু হল বলে! এই দেখুন একেবারে তিন বছর এগিয়ে কোথায় এসে পড়েছি!

  এক দুপুরে সিক্সথ সিমেস্টারে পড়া ছেলেটা মেয়েটার বাড়িতে এল। বাড়িতে সেই সময় আর কেউ ছিল না। সুতরাং, এই সুযোগে তাদের যা করা উচিত, ঠিক সেই কাজেই তারা রত হল। এই প্রথমবার সম্পূর্ণ শরীর দেওয়া নেওয়ার সেই আদিম খেলায় তাদের সেফটি-ভালভ ছিল বিবাহের পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি। যদিও সেটা না থাকলে তারা যে আবশ্যিক কর্তব্য পালনে বিরত হত, এমন মিথ্যা বলার স্পর্ধা আমার নেই। অবশ্য প্রতিশ্রুতির মতো নৈতিক ন্যাকাপনা না থাকলে ব্যাপারটা যে আরও বেশি খোলতাই এবং উত্তেজক হত সে বিষয়ে কোনও গ্যারান্টি দেওয়া যায় না।

 মেয়েটা অবশ্য এ ঘটনার আগেই তার— কী যেন বলে—?…হ্যাঁ, কৌমার্য!— তা সেই কৌমার্য বিসর্জন দিয়েছিল। কৌমার্য ধরে রাখার বিষয়ে সে যে খুব প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল— এমনটা কখনওই নয়। কিন্তু তবুও যেভাবে সেটা নষ্ট হয়েছিল, সেভাবে তা ঘটুক এটাও সে নিশ্চয়ই চায়নি। নায়িকা আমাদের শুধুই শরীর। তবু সেই শরীরেরও তো একটা মন আছে, নাকি! মেয়েটা তখন সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। বসন্তের এক মেদুর সন্ধ্যায় চাঁদের হালকা আলো, মৃদুমন্দ সমীরণ, ছাদের টবে লাগানো বেল-রজনীগন্ধার আঘ্রাণ প্রেক্ষাপট তৈরি করেই রেখেছিল। খোলা ছাদে বসে মেয়েটা এবং তার বিবাহিত মাসতুতো দাদার গল্প সেই পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে ক্রমশ খোলামেলা হয়ে উঠছিল। গল্পের বিষয়বস্তু বিপজ্জনক মোড়ে পৌঁছে যাওয়া সত্ত্বেও কেমন একটা অন্যরকম নেশা বা উত্তেজনা পেয়ে বসেছিল দু’জনকেই। তাই বোধহয় আচমকাই কামশরে বিদ্ধ মদন বনে যাওয়া দাদা–সম্পর্কের মর্যাদাকে সহজেই টপকে–মেয়েটাকে রতি ভেবে তার আশুকর্তব্য পালনে অগ্রসর হলেও মাসতুতো বোন প্রাথমিক কোনও বাধা দেয়নি। অবশ্য ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছনোর আগেই সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দাদাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ছিটকে চলে এসেছিল ছাদের সিঁড়িতে। সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নেমে আসার আগে পিছন ফিরে সে শুধু দেখেছিল ছাদে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকা এক লিবিডোকে।

 কী বলছেন? গল্পের লাটাই এবার আপনার হাতে তুলে দিতে। তা নিন না মশাই। আপনার কথা শুনেই মনে হচ্ছে আপনি গল্পে ভাল টুইস্ট আনতে পারবেন। তা নায়িকাকে একটু খেলান দেখি। দেখবেন, সহজে যেন পাড়ে তুলে ফেলবেন না!

 আপনি মেয়েটাকে কোনও নাম দেননি। কিন্তু আমি আবার নাম ছাড়া এগোতে পারি না। আমি মেয়েটাকে উমা বলব। তা কারও আপত্তি নেই তো? না না, নেই, আপনি উমাকে তাড়াতাড়ি আনুন। আরে আনছি রে বাবা। উমার জন্য আপনাদের যে নালঝোল পড়ছে তা কী আর বুঝতে বাকি আছে নাকি আমার! তা বুঝলেন, কলেজে উমার সঙ্গে দু’জনের খুব দোস্তি জমেছিল। পার্বতী আর শিবা। পার্বতীর একটা ছেলের সঙ্গে বোল্ড রিলেশন ছিল। আর শিবা যে স্যরের কাছে পড়তে যেত, তিনি, তাঁর গর্ভিণী স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে, শিবারও গর্ভসঞ্চারের জন্য নিয়মিত প্রচেষ্টায় কোনও খামতি রাখতেন না। মাঝপথে কন্ট্রাসেপটিভ এসে পড়ায় তিনি অবশ্য সফলকাম হতে পারছিলেন না।

 শিবা-পার্বতীর এইসব ব্যাপার জেনে উমা আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। তাকে আরও অস্থির করে তুলল আর এক নতুন নেশা—অন্তর্জাল। গভীর রাত পর্যন্ত নেট সার্ফিং করতে করতে সে প্রায় নিয়মিতই পৌঁছে যাচ্ছিল আমোদিত অরণ্যের সেই কামানলে যা তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছিল। সে নিজেকে সামলাতে পারল না, অভ্যস্ত হয়ে উঠল স্বমেহনে। ভারচুয়াল রিয়েলিটির এমন এক জগতে সে সবসময় বিচরণ করতে আরম্ভ করল যে, পুরুষ অঙ্গ এবং তার কর্মকাণ্ড কেন্দ্রিক ভাবনাই তাকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলল। সে ফোনে যোগাযোগ করল তার প্রথম অভিজ্ঞতার সেই মাসতুতো দাদার সঙ্গে। উমার আহ্বানে সাড়া দিতে সে ছোঁকছোঁকে ছোকরাও অবশ্য দু’বার ভাবেনি। দীর্ঘস্থায়ী ফোর-প্লে শুরুতে উমাকে সুখের এমন এক সুউচ্চ শিখরে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল যে, তার মনে হল ভারচুয়াল রিয়েলিটির জগৎ যেন আসলে দুধের বদলে ঘোল! কিন্তু শেষে তার জন্য যে এমন ঝটকা অপেক্ষা করে থাকবে সে ঘুণাক্ষরেও বোঝেনি। আর বোঝার মতো অবস্থায় সে থাকলে তো! বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই তার তৈরি হওয়া শরীর চূড়ান্তের জন্য উন্মুখ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এ কী! এ যে আগুন জ্বেলে তাতে পর্যাপ্ত সমিধ না যুগিয়েই অকস্মাৎ জলসিঞ্চন! উমা প্রায় লাথি মেরে সরিয়ে দিয়েছিল নিঃস্ব নিমুরুদে ক্লীবটাকে। ভেঙে পড়েছিল সত্যিকারের কান্নায়— অনেক, অনেকদিন পর। আর নিজের মতো করে উপলব্ধি করেছিল—ফ্যান্টাসির মৌতাত পেতে স্বমেহনই ভাল আর বাস্তবে ফোর প্লে-র মধ্যেই হয়তো চরম সুখ!

 শুনছি এবং বেশ চনমনে লাগছে মশাই। দেহে-মনে অদ্ভুত পুলক অনুভব করছি। অনেকদিন পর এ যেন ন্যান্সি ফ্রাইডে অথবা বটতলা পাঠের আস্বাদ। যাই বলুন, করার থেকে দেখায় আর দেখার থেকে পড়ায় অথবা শোনায় বুঁদ হয়ে যাওয়ার মস্তিই আলাদা। করা মানেই পারফরম্যান্স! তার চাপ মারাত্মক মশাই। আর দেখা মানে তো সেই ডিরেক্টর’স কাট, যদি না লুকিয়ে-চুরিয়ে লাইভ দেখার সুযোগ পান! সাইটে গিয়ে তো রোজই দেখি, কিন্তু বলুন না, এই শিহরণ কি জাগে! সে যাই হোক, আপনি তো দেখছি মাসতুতো দাদাকে বড়ই পেড়ে ফেললেন। জানি যাদের খাইখাই ভাব বেশি, তারা বেশি খেতে পারে না। কিন্তু তা বলে এইভাবে রগড়ে দেবেন! তাছাড়া ছেলেটাকে নামহীন রাখলেন যে বড়! নাম না নিয়ে এগোতে না পারার প্রতিজ্ঞা আপনার গেল কোথায়? অবশ্য বলতেই পারেন প্রতিশ্রুতি দেওয়াই হয় তা না রাখার জন্য। নাহলে আবার প্রতিশ্রুতি কীসের!

 কী হল? আপনি আবার উশখুশ করছেন কেন? আপনার স্টকেও কিছু আছে নাকি? থাকলে খালাস করে দিন। আরে এ তো আর পারফর্ম করা নয়! তাহলে খামোখা চাপ নিচ্ছেন কেন? চাপ কাটিয়ে গুটি কাটা প্রজাপতির মতো উড়ে বেরিয়ে আসুন।

 না, আমি ভাবছিলাম এসবের বাইরে গিয়ে শিক্ষিত কর্মহীন নায়ক-নায়িকাকে এমনভাবে কল্পনা করতে পারা যায় কি না, যেখানে নায়ককে অন্নসংস্থানের জন্য জিগোলো হয়ে যেতে হয় এবং নায়িকাকে ম্যাসেজ পার্লারের জিম ইন্সট্রাক্টর হিসাবে এসকর্ট সার্ভিস শুরু করতে হয়; অথবা সামান্য মাইনের প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিতে বহাল হওয়া নায়ককে নাইট ডিউটিতে যেতে হয় সেখানে, যেখানে মালিকের বিলাসবহুল গেস্ট হাউসে সমবেত পয়সাওলা লোকেদের মনোরঞ্জনের জন্য শিল্পী হিসাবে হাজির হতে হয় নায়িকাকে আর শেষ পাতে ডাস্টবিনে পড়ে থাকে তার উচ্ছিষ্ট শরীর। এই যে মশাই, আপনার কী মতলব বলুন তো? খামোখা পাতি সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিতে চাইছেন কেন! এসব ছাড়ুন মশাই। তার থেকে বরঞ্চ আমাদের সেই বাসে দাঁড়িয়ে থাকা নায়কের একটু পতা করি চলুন।

 বাসে ঠাসা ভিড়। ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। তবুও ক্যাজুয়াল ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে সে। চাপ আসছে। কিন্তু পাত্তা দিচ্ছে না। দেখে মনে হয় চাপ নিতে অভ্যস্ত। আমরা নায়কের সম্পর্কে কিছুই জানি না। তবে নায়কের একটা কাঠামো আমরা খাড়া করেছিলাম, আপনারাও অনেক কিছু ভেবেছিলেন। কিন্তু বাস্তব-নায়কের ওপর যেহেতু কোনও কিছু আরোপ করা সম্ভব নয়, তাই নায়ক কাঠামো-ভাবনার বাইরে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ হিসাবে যে অন্যরকম কিছু হবে তার সম্ভাবনাই প্রবল।

 ছেলেটা এক হাতে ওপরের রড ধরে আছে। সেই অবস্থাতেই মাঝে মাঝে ঝুঁকে বুক পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখছে। প্যান্টের পেছনের পকেটের ওপরও সময় সময় হাত রাখছে— পার্সটা সুরক্ষিত আছে কি না বুঝে নেওয়ার জন্য। বোঝা যায় বেশ সাবধানী। মোবাইলটা এবার কানে চেপে ধরেছে। দাঁড়ান, একটু কাছে এগিয়ে যাই, শোনার চেষ্টা করি কী বলছে।

 — না, বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা সম্ভব হল না। বাস এসে গেল, উঠে পড়লাম। অপেক্ষা করতেই থাকব অথচ বাস এলে উঠব না— আমি এখনও ঠিক এটা পেরে উঠি না।

 দাঁড়ান মশাই, আর একটু চুপ করুন। ভাল করে ওদিককার কথা ওকে শুনতে দিন। আমরা কিন্তু শুধুই ছেলেটার কথা শুনব। ওর মোবাইল সেটটা খুব একটা ভাল নয়। একটু চেষ্টা করলেই যে কেউ ওদিকের প্রত্যেকটা কথা শুনতে পাবে। তবু আমরা ওদিকের কথা শুনব না। স্পোর্টসম্যান স্পিরিট বিসর্জন দিয়ে আমরা কোনও অন্যায় সুযোগ নেব না। সুযোগ নেব না এই কারণেই, কারণ সুযোগ নিলেও তাতে আমাদের কোনও বস্তুগত লাভ হবে না। হিসাবটা বুঝতে পারলেন?

 — দরকারটা কার? আমার না আপনার? আমার হলে পরে শুনে নিলেও চলবে। আপনার হলে আপনি আসুন। আমি বাস থেকে নেমে অপেক্ষা করছি। আমার পক্ষে আর ব্যাক করে যাওয়া সম্ভব নয়। হ্যালো…হ্যাঁ, শুনুন…এখানে ব্রিজের ওপর টাওয়ার পাওয়া যায় না, নেটওয়ার্কে প্রবলেম হয়। আমি আপনাকে পাঁচ মিনিট পরে কল করছি। রাখলাম। কলটা কেটে মোবাইল প্যান্টের পকেটে ঢোকায় ছেলেটা।

 কার সঙ্গে কথা বলছিল ছেলেটা? কে ছিল ফোনের ওপারে? আপনার ভাবতে বয়ে গেছে! আপনি নিজেকে নিয়েই ভাবা ছেড়ে দিয়েছেন, তো গল্পের নায়কের জন্য ভাবনা! তা ছাড়া আমরা শুধু অনুমানই করতে পারি। আসল সত্য কখনওই জানতে পারি না। ছেলেটা যদি আমাদের মধ্যে কেউ হয়, তা-ও জানতে পারব না। ওদিকে কে, তখনই নিশ্চিত করে জানতে পারব, যদি এদিকেরটা আমি হই। আর আমি হলেও ওদিকের আসল পরিচয় যে পাবই বা সবসময় নিজেই জানতে চাইব— এমনটা নাও হতে পারে। সেই যে— যার সঙ্গে নিয়ম করে প্রায় প্রত্যেকদিন একই সময়ে একই জায়গায় বছর পাঁচেক চোখাচোখি হয়েছে, আমি কি জেনেছি তার নাম-ধাম, না সে জানতে পেরেছে আমার সাকিন-ঠিকানা! অথচ যে ক’দিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি একটা বিপন্নতা যে গ্রাস করেনি তা নয়। দেখা না হওয়া দিনে তার মনের আকাশে কোনও মেঘ ঘনিয়েছে কি না তা অবশ্য জানি না।

 কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছি! পাঁচ মিনিট এখনও হয়নি নিশ্চয়ই। কারণ আমি খেয়াল করেছি আপনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে আছেন এবং সময় হলেই যে সতর্ক করে দেবেন তা-ও জানি। ওই তো মোবাইল প্যান্টের পকেট থেকে উঠে এসেছে ছেলেটার হাতে। রিং করে কানে লাগিয়ে তার ওপারের অপেক্ষা।

 — হ্যাঁ, আপনি আসছেন?…ঠিক আছে, আসুন। আমি টোলে অপেক্ষা করছি। সেটটা পকেটে রেখে ভিড় ঠেলে আরও দু’জনের সঙ্গে বাস থেকে নেমে আসে ছেলেটা। নেমে অপেক্ষমান আরও কয়েকজন যাত্রীর মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে সে।

 ছেলেটা প্রতীক্ষা করছে জ্ঞাত কারও জন্য আর আমাদের অপেক্ষা অজ্ঞাতর জন্য। আসুন, এই জায়গাতেই আপনাদের থামিয়ে দিই। ওরা শুরু করুক ওদের নিজস্ব গল্প। 

প্রচ্ছদঃ সৈকত পালিত

*****