মানদাসুন্দরী দাসী ও হাম্পটিডাম্পটি (প্রথম পর্ব)– তুষ্টি ভট্টাচার্য

পর্ব ২
পর্ব ২

-১-

  অত্যন্ত বিরক্ত চিত্তে মানদাসুন্দরী এক ঠায়ে বসিয়া ভাবিতেছিল। এমনিতে তাহার বসিবার অবসর নাই। এই যে বসিয়া রহিয়াছে, না জানি ছাদের বড়িগুলায় কোনো হতচ্ছাড়া পোড়ারমুখো হনুমান মুখ দিল কিনা! আচারের বয়াম ছুঁইয়া দিলে তো সর্বনাশ! যাহা হউক, ইহারই নাম জীবন। যাহাদের গৃহে সুন্দরী মেনি বিড়াল রহিয়াছে, তাহারা ব্যতীত মানদার জ্বালা কেহই বুঝিবে না। আদদামড়া ঘাটের মড়া মিনসে হুলোগুলার উৎপাতে তাহার সুন্দরীর চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটিয়াছে। এমনকি মাছ ভাত মুখেও তোলে নাই। শুধু ওই মিনসেগুলার সঙ্গে পিরীতের বালির বাঁধ বাঁধিতে উৎসুক সে। রাতেও ঘুমায় না, দিনেও নহে। নিদ্রা উহার বিষ আপাতত। এমনকি মানদাকে একটিবারও থাবা বুলাইয়া আহ্লাদ দেখায় নাই। বালবিধবা মানদা এই রাবণের সংসারের ঘানি টানিতে টানিতে যৌবন জ্বালা কী বুঝিবার অবকাশ পায় নাই। কিন্তু উহাদের দেখিয়া কিঞ্চিৎ অনুমান করিয়াছে। প্রকৃতির ডাক এড়াইতে পারিবে না সে—ইহা মানদা বিলক্ষণ জানে। দুঃখ তাহার নাই এই বিষয়ে। দুঃখ ইহাই যে মানদাকে পর্যন্ত সে ভুলিয়া বসিয়াছে।

  সাদা থানের খুঁটে চোখের কোণা মুছিয়া লইল মানদা। এক্ষণও অশ্রু তাহার সঙ্গ বিসর্জন করে নাই। অজানিতে, আচম্বিতে আসিয়া ঝাঁপিয়া পড়ে জলদস্যুর প্রায়। বুকের ভিতর কোথা হইতে উথালপাথাল ঢেউ ফণা তোলে, হৃদয়খানি বুঝি তাহার ধুকপুক ভুলিয়া যাবে, এইরূপ আশঙ্কায় মানদা নিজেই নিস্তেজ হইয়া পড়ে কিয়ৎক্ষণ পরে। তবুও এই অশ্রু তাহার আশ্রয় ও গোপন অভিসার। এই অশ্রু তাহার বুকের ব্যথার মলম। দুই হাঁটুতেই আজিকাল পূর্ণিমা, অমাবস্যার সময়ে যন্ত্রণা বাড়ে। বেবো কোথা হইতে মালিশের তৈল আনিয়া দিয়াছিল এক শিশি। ব্যথা অসহ্য হইলে অতি যত্নে, কৃপণের মতো তাহাই মালিশ করে মানদা। হারিকেনের গায়ে আঁচল চাপিয়া সেঁক দেয়। রাত গভীর হইলে ব্যথায় অবসন্ন হইয়া গেলে নিদ্রা আসিয়া জোটে ওই পোড়া চোখে। যথার্থ ঘুম নহে, ঘুমের লেশ বলা যাইতে পারে উহাকে। কাক ডাকিবার শব্দ কানে আসে, বাহিরে তখনও সূর্যদেব দেখা দেন নাই। মানদা আঁচল জড়াইয়া বিছানা ছাড়িবার তোড়জোড় শুরু করে। তোড়জোড় অর্থাৎ হাঁটু সচল করিতে, শরীরকে টানিয়া নামাইতে কিঞ্চিৎ সময় লাগে। মাটিতে দুই পায়ে দাঁড়াইতে ইষ্ট নাম জপ করিতে হয় তাহাকে। বিছানার চাদরখানি ঝাড়িয়া, টানটান করিয়া পাতিয়া দেয়। বিছানা বলিতে কাঠের তক্তার উপরে একখানি পাতলা, শক্ত হওয়া তোষক। বালিশ নাই মানদার। বিধবার বালিশ লাগে না। হাতে মাথা দিয়া বা একখানি কানির উপর মাথা রাখিলেই বিশ্বসংসার নিশ্চিন্ত হয়। বিলাস উহাদের জন্য নহে।

  খানিক হাঁটাচলার পরে পায়ের ব্যথা কমিয়া আসে। উঠান ঝাঁটাইয়া, গোবর জলের ছড়া দিয়া মুছিয়া নেয় মানদা। পাঁচিলের উপর কালোভূতো কাকগুলি তাহার অপেক্ষায় থাকে। রান্নাঘরের শিকল খুলিয়া এঁটো বাসনের পাঁজা লইয়া ঘাটের দিকে রওনা দেয় মানদা। আজ ঝি আসিবে না। তাহার আজ মরিবার সময় নাই। পোড়ারমুখো কাক, তোরা মরগে যা আজ! মনে মনে গজগজ করিতে করিতে ঘাটের জলে বাসন ভিজাইয়া দিয়া আবার রান্নাঘরে ফিরিয়া আসে মানদা। শুকনা বাসি রুটি লইয়া কাকগুলিকে খাওয়ায়। বাসন মাজিয়া রান্নাঘর নিকাইয়া একখানি নিমের দাঁতন লইয়া ঘুরিতে থাকে। এইসময়টাই মানদার প্রাণাধিক প্রিয়। সত্যি বলিতে কী, এই সময়টুকু নিজের জন্য বাহির করিতে তাহার কালঘাম ছুটিয়া যায়। অন্ধকার থাকিতে থাকিতে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করিয়া নিত্যকার কাজ সারিয়া লইতে হয়। আকাশের দিকে ঘনঘন চাহিতে থাকে সে। যেন সূর্যদেবের সঙ্গে দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নামিয়াছে সে। আলো ফুটিলেই সে হারিয়া যাইবে। তাহার নিজস্ব সময় তাহার হাত হইতে পিছলাইয়া চলিয়া যাইবে এক অতল গহ্বরে। আজ সে হারে নাই। সূর্যদেবের লাল বলখানি এক্ষণ উঁচু জামগাছটির উপরিভাগে আলো দিতেছে। দাঁতন মুখে লইয়া মানদা হাঁ করিয়া দেখিতেছে সেই প্রভা। যেন তাহার হুঁশ নাই এই মুহূর্তে। ঘোমটা খসিয়া পড়িয়াছে, বিস্ফারিত আঁখির উপর নবকিরণ পড়িয়াছে এমনরূপে যে তাহার মুখমণ্ডল সোনার বরণ ধারণ করিয়াছে। খোঁচা খোঁচা কদমছাঁট চুলে আলো পড়িয়া তাহার কেশরাজির ঘনত্ব প্রতীত হইতেছে। আর তাহার মুখখানির সেই অপরূপ বিভা দেখিবার কেহই নাই এক্ষণ এই জগতে। ভাগ্যিস কেহ দেখে নাই উহাকে এই সময়ে। তাহার এই নিমগ্ন রূপ দেখিলে পুরুষ মানুষের চিত্ত বৈকল্য হইত নিশ্চিত। তাহার চরিত্রে কালিমা লেপনের সুযোগ পাইয়া যাইত কেহ কেহ। আর কোনো অপরিচিত নারী যদি তাহাকে এই সময়ে দেখিত, মুগ্ধ হইত অথবা হিংসায় জ্বলিয়া উঠিত। তাহার সংসারে এমন কোনো নারী নাই, যে তাহাকে দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া স্নেহের বাক্য কহিবে অথবা ঈর্ষায় গালি নিক্ষেপ করিবে। তাহার সংসারের নারীরা নিজেদের লইয়াই ব্যস্ত থাকে। মানদা শুধু উহাদের ফাই ফরমাস খাটিবার যন্ত্র মাত্র।

  সম্বিৎ ফেরে একসময়ে মানদার। লজ্জা পায় যেন খানিক। এই সময়েও কেহ তাহার এই অপার্থিব মুখচ্ছবি দেখিলে না জানি কী বলিত! তাড়াতাড়ি মুখ ধুইয়া সে ডেকচিতে চায়ের জল চাপাইয়া দেয়। মুখ ধুইবার সঙ্গে সঙ্গেই তাহার মুখের কোমল আভাটিও যেন ধুইয়া যায়। কঠিন, খসখসে মুখাবরণ চাপাইয়া লইয়া সে ডেকচির জলের বুড়বুড়ি দেখিতে থাকে। নিপুণ হাতে চা তৈয়ার করে। ঘটিতে চা ছাঁকিয়া একটি কাঁসার থালার উপরে পেয়ালা, পিরিচ সাজাইয়া সংসারের অন্য গৃহের দিকে চলিতে থাকে। তাহার পূর্বে অবশ্য নিজের জন্য এক গেলাস চা চাপা দিয়া রাখিয়া যায়। এই বিলাসটুকু না থাকিলে হয়ত মানদার জীবন ফুরাইয়া যাইত। তাহার এত যে জীবনীশক্তি সবই হেলায় শুকাইয়া আসিত। কে যে এই বাটিতে চায়ের আসর শুরু করিয়াছিল, মানদা জানে না। চায়ের অভ্যাস এখনও চারিদিকের মানুষজন রপ্ত করে নাই। জনান্তিকে শুনিয়াছে এই বংশের কোনো পুরুষের সাহেবদের গৃহে চাকুরি সূত্রে যাতায়াত ছিল। তিনিই এই গৃহে চায়ের আসর আমদানি করিয়াছিলেন। কী ভাগ্যিস করিয়াছিলেন! দুই হাত মাথায় তুলিয়া সেই অজানা পুরুষের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাইল মানদা। চিরঋণী থাকিবে সে উহার প্রতি। এই যে চায়ের গেলাস হস্তে সে ঠ্যাঙ ছড়াইয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া আছে, অল্প অল্প চুমুক দিতেছে গেলাসে আর এক দিব্য শক্তি তাহার শরীরে, মনে ব্যাপ্ত হইতেছে। রৌদ্র এক দশম বর্ষীয় বালকের ন্যায় খেলা করিতেছে তাহার সম্মুখে। আম, জাম, আর জম্বুরা গাছের পাতার ফাঁক দিয়া সে যেন মানদার সহিত লুকোচুরি খেলিতে উদ্যত। আর মানদাও তাহার সন্ধান করিতে এ কোণ, ও কোণ খুঁজিতেছে। গেলাসের চা প্রায় শেষ হইয়া আসিল। দাওয়ার অদূরে পাঁচিলের মাথায় চোখ যাইল মানদার। ক্রোধে গেলাস ঠক করিয়া নামাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল সে। পিঁড়ি ছুড়িয়া ওই দিকে নিক্ষেপ করিল সজোরে। কাঁঠাল কাঠের বেদম শক্ত আর ভারি পিঁড়িখানি পাঁচিলের গায়ে ধড়াম শব্দে পতিত হইল। তৎক্ষণাৎ বিদ্যুৎ বেগে মার্জারের ল্যাজখানি অদৃশ্য হইয়া গেল পাঁচিলের অন্য পার্শে। মাথায় কাপড় তুলিয়া গনগনে ক্রোধের আঁচে মানদার মুখ পুড়িয়া যাইতেছিল। দেওয়ালের দড়ির আলনা হইতে আরেকখানি থান লইয়া সে স্নানঘরের দিকে হনহন করিয়া চলিয়া যাইল। টিনের দরজার আড়াল হইতে ঝমঝম করিয়া গায়ে জল ঢালিবার শব্দে বোধ হইতেছিল, সারা পৃথিবীর সমস্ত ক্রোধ, জ্বালা যেন ঘটি ঘটি জল ঢালিয়া ধুইয়া দিতে চাহিতেছে কেহ।

  যে পুরুষের উদ্দেশ্যে মানদা চায়ের প্রচলন হেতু প্রণাম জানাইতেছিল কিয়ৎক্ষণ পূর্বে, সেই পুরুষকেই সাহেবিয়ানা আমদানি হেতু গালি পাড়িল সে। গাত্রদাহ জুড়াইল কিছু। সেই পুরুষেরই বংশধর বেবো। বাল্যকালে তাহার বাকবিস্তারে বিলম্ব হইয়াছিল বলিয়া তাহাকে বোবা আখ্যা দিয়াছিল কেহ কেহ। সেই বোবারই অপভ্রংশ বেবো নামটি তাহার গাত্রে চামড়ার ন্যয় আঁটিয়া বসিয়া রহিয়াছে। বর্তমানে সে বক্তিয়ার খিলজি। বিলাইদের নামকরণ তাহারই কৃত। হাম্পটি ডাম্পটি নাম ধরিয়া ডাক পারিলে বিলাইদ্বয়ও হাজির হয় দিব্য। পাঁচিলে বসিয়া থাকিলে বেবো সুর করিয়া বলিতে থাকে—হাম্পটি ডাম্পটি স্যাট অন আ ওয়াল…’বাকি বুঝিবার সামর্থ্য মানদার নাই। প্রথমটুকু বেবোই পাখিপড়া করিয়া শিখাইয়া দিয়াছে। (ক্রমশ)

 

পর্ব ২
পর্ব ২

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী

*****