পর্ব ১১
পর্ব ১৩
পর্ব ১১
পর্ব ১৩
-১২-
এমত অবস্থায় উহাদের নির্গত হইবার মিনিট পাঁচেকের ভিতরই বাড়ির ভিতর হইতে বন্দুকের আওয়াজ পাওয়া যাইল। বড়কর্তা খোদ বিলাত হইতে বন্দুক আনাইয়াছিলেন। লাইসেন্স প্রাপ্ত সেই বন্দুক তিনি নিজেই চালাইতে পারিতেন। আর ছিল দুইখান রাইফেল। বারুদ ঠাসিয়া ভরিয়া রাখা থাকিত ওই দুটি দারোয়ানদের জন্য। একত্র হইয়া গৃহের সকলে দাঁ, বঁটি, কাটারি, বন্দুক লইয়া হৈহৈ করিয়া বাহিরে আসিয়া পড়িল। ডাকাতের দল সম্মুখেই ছিল, নিশ্চিন্ত চিত্তে লুটের মাল ভাগবাটোয়ারা করিতেছিল সম্ভবত। হইচই শুনিয়া যে যেদিকে পারে দৌড় দিল। কয়েকজন পার্শ্বের পুষ্করিণীতে ঝোলা সহিত ঝাঁপ দিল। উহাদের লক্ষ্য করিয়া অতঃপর বন্দুক তাক করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল এক দল। দম বন্ধ করিয়া আর কতক্ষণ তাহারা জলের নীচে থাকিবে? শ্বাস লইতে যাইলেই উহাদের গুলি করিবে, এই ছিল ইহাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু সময় চলিয়া যায়, উহারা আর মাথা তোলে না। লন্ঠনের আলো, গ্যাসের আলো প্রজ্জ্বলিত ছিল, ফলে উহারা যে পলায় নাই, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল এই পক্ষ। শেষমেশ দেখা যাইল এক অদ্ভুত দৃশ্য। কয়েকখানি অতিকায় পিত্তলের হাঁড়ি জলের উপরিতলে ভাসিয়া উঠিল। কিয়ৎক্ষণ ইহারা স্তব্ধ হইয়া রহিল ঘটনার অভিঘাতে। তাহার পর সম্বিৎ ফিরিল। বুঝিল ডাকাতেরা হাঁড়ির ভিতর মস্তক লুকাইয়া শ্বাস নিতেছে। এইবার গুলি চলিল হাঁড়ি লক্ষ্য করিয়া। সে কী ভীষণ শব্দ বাহির হইল! ঠং ঠং শব্দে আকাশ, বাতাস কাঁপিয়া উঠিল থরথর করিয়া। ভয়েই হউক বা শ্বাসকষ্টে ডাকাতেরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আত্মসমর্পন করিল। হাঁড়ি টোল খাইল বটে, তথাপি অন্যান্য সামগ্রী সকলই ফিরিয়া পাইল ইহারা। পিছমোড়া করিয়া সারারাত্রি বাঁধিয়া রাখিয়াছিল ডাকাতদের। দয়াপরবশ হইয়া ইহাদের নাকি খাদ্য, পানীয়ও দেওয়া হইয়াছিল সেই সময়ে। ডাকাতদের মুখে গ্রাস তুলিয়া দিতেছিল চাকরেরা, আর অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাহারা সেই ফাঁসির খাওয়া গিলিতেছিল। পরদিন পুলিশ উহাদের ধরিয়া লইয়া যাইলে সেইবারের মতো ডাকাত পর্ব সমাপ্ত হইয়াছিল। আর সেই যে ঘড়ি বুড়া, যাহাকে কেহই খেয়াল করে নাই, সেই ডাকাত আসিবার সময়ে কোনোক্রমে লুকাইয়া পড়িয়াছিল চিলেকোঠায়। উহারা বাহির হইলেই বাবুদের ঘরের শেকল খুলিয়া দিয়াছিল সে-ই। সেইদিন হইতে বুড়ার সম্মান ও পরাক্রম বাড়িয়া গিয়াছিল এই গৃহে।
দেখিতে দেখিতে হাম্পটির তিনটি ছানা হৃষ্টপুষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। হাম্পটি যেন স্বর্গের কামধেনু। দুধের ধারায় তিনটি শাবকের পেট ভরিয়া যাইবার পর কিট্টিও কিয়ৎ পরিমাণ পান করিয়া থাকে। যদ্যপি মানদা উহাকে দুগ্ধ পানে নিরস্ত করে প্রতিনিয়ত। যেহেতু সে শক্ত আহারে অভ্যস্ত হইয়াছে, তাহার শরীরের বাড়বৃদ্ধি হইয়াছে, মাতৃদুগ্ধের তাহার আর কী বা প্রয়োজন! নেশাগ্রস্তের ন্যয় কিট্টি এক্ষণও মাতৃদুগ্ধের লোভ ত্যাগ করিতে পারে নাই। পরন্তু সকল আহার্য সে গোগ্রাসে ভক্ষণ করে বলিয়া, দুগ্ধ পান করিলেই তাহার বমন আসে। যাহা ছিল তাহার প্রাণসুধা, এক্ষণে তাহাই গরলসম হইয়া উঠিয়াছে। বেবোকেও মানদা শিখাইয়া দিয়াছে, ফলে সেও কিট্টিকে হাম্পটির দুধ পান করিতে দেখিলেই তাড়া করে। আর ওই দূরে পরিত্যক্ত পেটিকার ভিতরে তিলে তিলে বর্ধিত হইতেছে অনাদরের তিন প্রাণ। উহাদের হাম্পটি ছাড়া কেহ নাই। উহারা এ গৃহে অতিরিক্ত। চাকরবাকররা আলোচনা করে, চক্ষু ফুটিয়া উহারা হাঁটিতে চলিতে পারিলেই রাতের অন্ধকারে এ গৃহ হইতে দূরে কোথাও উহাদের ছাড়িয়া আসিবে। ভাগ্যদেবী সহায় হইলে কী না সম্ভব! তাঁহার কৃপা পাইলে আদর লাভ হইবে, আশ্রয় মিলিবে, উপরন্তু আরও অধিকতর কিছু মিলিয়া যাইতে পারে। মানদার বারংবার আশ্রয়হীন হওয়া ছিল বিধাতার লিখন। অকাল বৈধব্য, নিজ গৃহ হইতে বিতাড়িত হওয়া, সম্পূর্ণ অজানা মানুষের গৃহে পরিচারিকার ন্যয় জীবন পরিক্রমণ—এসবই কি ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস ছিল না? তাহারও সুখে সংসার করিবার অধিকার ছিল, ছিল নিজ গৃহের আশ্বাসে বাস করিবার দাবী। হাম্পটি ডাম্পটি জন্ম হইতে মাতাপিতাকে পায় নাই। মানদার স্নেহচ্ছায়ায় উহারা নির্দ্বিধায় বাড়িয়া উঠিয়াছে। এই গৃহে উহাদের পূর্ণ মাত্রায় অধিকার রহিয়াছে । শুধু মানদা কেন, এ গৃহের প্রায় সকল বাসিন্দাই উহাদেরকে পছন্দ করে। এমনকি শিশু কিট্টিও আদরে, আহ্লাদে, অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে সুখে দিনযাপন করিতেছে। আর উহার সহোদর ভাইবোনেরা অবাঞ্ছিতের মতো পড়িয়া রহিয়াছে এক কোণে। এও কি ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস নয়?
সুবিমলবাবু সম্ভবত কোনোরূপ ভাবে তাঁহার সমস্যার সমাধান করিয়াছেন অথবা সমস্যার ক্ষতে মলমের প্রলেপ লাগাইয়াছেন। নহিলে হঠাৎ করিয়া উহাদের কলহ বন্ধ হইয়া যাইল কিরূপে? কয়েক দিবস পূর্বেই যাহাদের নিত্য কলহ এই গৃহের শান্তি ভঙ্গ করিত, আজ তাহারা যেন কিছুই হয় নাই, এমন মুখ করিয়া সুখে দিনাতিপাত করিতেছে। যেন বা অতীতের ওই কলহপূর্ণ দিনগুলি ছিল ভ্রমমাত্র। মানদার এরূপ কোনো অধিকার নাই, যাহাতে যাচিয়া পড়িয়া এই কলহের কারণ বা কলহনিবৃত্তির কারণগুলি জানিতে পারে। এক রহস্যের খাসতালুকে তাহার বাস। যে রহস্যের সমাধান হইবে না কোনোদিন, সে কাহিনি মানদা অগ্রিম জানিয়া বসিয়া আছে। তথাপি কানাঘুষায় শোনা যাইতেছে, সুবিমলবাবু কোনো এক সাহেব কোম্পানির সহিত গাঁটছড়া বাঁধিয়াছেন। সেই কোম্পানিকে তাঁহার পাটের ব্যবসার স্বত্ব দান করিয়াছেন, তাহাতে তিনি এককালীন অর্থ পাইয়াই এই যাত্রায় ঋণের দায় হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছেন। ফলে আপাতত শান্তি নামিয়াছে এই গৃহে। আর শান্তি আসিলে অবধারিত ভাবে উহার সঙ্গ লয় আলস্য। কর্মের চাপ নাই, নাই অর্থচিন্তা, এইরূপ সুখে দিনযাপন করিতে করিতে মস্তিষ্কে পুনরায় শয়তান জাগিয়া উঠে কাহারও কাহারও। সুবিমলবাবুও তদ্রূপ ব্যক্তি। এক্ষণে তাঁহার যৌবন নাই, উদগ্র বাসনা ও লালসায় ভাটা পড়িয়াছে, ফলে শয়তানী বুদ্ধি অন্য ক্ষেত্রে চাগিয়া উঠিয়াছে। এই গৃহ সে কোনো এক সাহেবকে বেচিয়া দিতে মনস্থ করিয়াছে। এই সাহেবের সঙ্গে তাঁহার পাটের ব্যবসা সূত্রে পরিচয় হইয়াছিল; এই গৃহে সাহেবকে আমন্ত্রণও করিয়াছিলেন সুবিমলবাবু একসময়ে। হঠাৎ সেই সাহেব তাঁহার সহিত যোগাযোগ করিয়া এই গৃহ ক্রয় করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এইখানে তিনি তাঁহার বাগান বাড়ি বানাইবেন। পরিবর্তে সুবিমলবাবুকে মোটা অর্থ দিতে প্রস্তুত তিনি। কিন্তু সুবিমলবাবু জানেন, এই কর্ম এত সহজ নহে। এক্ষণে পরিমল বাবুর পুত্ররা রহিয়াছেন, বৌদিদিও আছেন। তায় বাস্তুভিটে! দুইশত বৎসর ধরিয়া মাথার উপরে রহিয়াছেন স্বয়ং শ্রীধর। তিনি তো কেবল শিলামাত্র নহেন, তিনি অতি জাগ্রত। সুবিমলবাবু করজোড়ে তাঁহার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাইলেন মনে মনে। পাপ হইবে না তো তাঁহাকে বাস্তুচ্যুত করিলে? (ক্রমশ)
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী