পর্ব ১২
পর্ব ১৪
পর্ব ১২
পর্ব ১৪
-১৩-
ভয়ের এক হিমশীতল স্রোত হঠাৎই যেন গ্রাস করিল সুবিমলবাবুকে, নিজেকে ভুলাইতে লাগিলেন। কীসের পাপ? পাপ, পুণ্য বলিয়া কিছুই নাই এই পৃথিবীতে। এই সকলই মনুষ্য সৃষ্ট কাল্পনিক বিধান। শ্রীধর মাথার উপরেই থাকিবেন, গৃহ বদল হইলে তাঁহাকে যোগ্য সমাদরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হইবে-ইহাতে কোনো পাপ নাই। তাঁহার নিত্য পূজা বজায় থাকিবে, পালা, পার্বণও থাকিবে। শুধু বাসস্থান বদল হইবে। ইহাই সঠিক ব্যবস্থা হইবে। এই গৃহ জরাজীর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। সংস্কার করিতে বহুল অর্থের প্রয়োজন, এমনকি সংস্কারের পরেও এই গৃহের হাল নতুনের মতো হইত না। সুবিমলবাবু ইতিমধ্যে একটি গৃহ পছন্দ করিয়া রাখিয়াছেন। ত্রিতল গৃহের সম্মুখে বাগিচা রহিয়াছে, পিছনে রহিয়াছে একখানি পুষ্করিণী। একতলে বৈঠকখানা এবং ভৃত্যদের বাসস্থান ব্যতীত থাকিবে একখানি সুবিশাল রসুইঘর। দ্বিতল ও ত্রিতলে থাকিবে শয়নকক্ষ, পড়িবার ঘর আর স্বয়ং শ্রীধর থাকিবেন সকলের মাথার উপরে। এই গৃহে অতিরিক্ত লোকের ঠাঁই মিলিবে না, ইহা একপ্রকার মনস্থ করিয়া লইয়াছেন সুবিমলবাবু। ভৃত্য ব্যতীত আশ্রিত অথবা খাদ্যলোভীদের সেই গৃহে স্থান হইবে না। অহেতুক খরচ কমাইতে হইবে। এই বাজারে পূর্বের ন্যায় দানছত্র খুলিয়া বসিবার উপায় নাই। অতিরিক্ত ব্যয়ভার লাঘব করিতে হইলে আশ্রিতদের উচ্ছেদ করিতে হইবে। বিশেষ করিয়া ওই মানদার বাস উঠাইতে হইবে। বড় গুমোর তাহার! যৌবনকালে তাহার সেই প্রত্যাখ্যান অদ্যাবধি ভুলিতে পারেন নাই সুবিমল।
একদিকে সুবিমলবাবু এইরূপ পরিকল্পনা করিতেছিলেন, অন্যদিকে মানদা হাম্পটিকে লইয়া ব্যতিব্যস্ত হইতেছিল। হাম্পটির তিনখানি ছানা টলোমলো পায়ে হাঁটিতে শিখিয়াছে, সারাদিন চিঁ চিঁ রবে উহাদের অস্তিত্ব জানান দিতেছে প্রাণপণে। বেবো উহাদের তদারকি করিয়া যায় মধ্যে মধ্যে। মানদাও বারকয়েক চোখ বুলাইয়া লয়। যদিও উহারা পেটিকা হইতে নির্গত হইতে পারে নাই। কিন্তু অস্তিত্ব জানান দিবার চোটে অবোধ শিশুগুলি নিজেদের বিপদ ডাকিয়া আনিয়াছে অজান্তে। দিবাভাগে সকলেই কাজ লইয়া ব্যস্ত। এই গৃহের বাগিচায় বেশ কয়েকখানি নেউলের বাসা রহিয়াছে। উহাদের কেহই তাড়ায় না। সাপের প্রাদুর্ভাব নাই উহাদের কারণে। এই ঘোর বর্ষায় গৃহবাসীরা শুধুমাত্র এই নেউলদিগের কারণেই নিশ্চিন্তে থাকে। মা মনসার কৃপা ব্যতীত সর্পকুলের এহেন দাক্ষিণ্য মেলা অসম্ভব হইত—ইহা এ বাড়ির বাসিন্দাদের বদ্ধমূল ধারণা। ধূমধাম করিয়া মনসা পূজাও করে ইহারা এই কারণেই। নেউলগুলিও কোনোদিন বিরক্তির বা ভীতির কারণ হইয়া উঠে নাই এই স্থানে। ইহারা এঁটোকাটা খায়, এমনকি কেহ কেহ তো নেউলগুলিকে ডাকিয়া খাইতে পর্যন্ত দেয়। ইহারা বহাল তবিয়তে এই স্থানে বিরাজ করে। অপরদিগে ইহারাই এই বাড়ির সকলের ভরসা স্থল। কালকেউটে, গোখরো, শাখামুটি, সর্ব প্রকার সাপের উপদ্রব এই গৃহের চারিধারে। বিশেষ করিয়া প্রাচীর গাত্রের বাহিরেই যে ঝোপজঙ্গল সর্পকুল ওই স্থানেই বিরাজ করে। কত দিন এমন হইয়াছে, প্রতূষ্যে বাগানে বিষধর সর্পের ছিন্নভিন্ন দেহ পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াছে ইহারা। ফলে নেউলগুলিকে কেহই তাড়ায় না, বরং উহারাই এই গৃহবাসীকে রক্ষা করে। কিন্তু আজ বিধি বাম।
এই নেউলদিগেরই কেহ ফাঁকা পাইয়া হাম্পটির একখানি ছানা লইয়া চলিয়া গিয়াছে। আর হাম্পটি কাঁদিয়া কাটিয়া অস্থির হইতেছে সারাক্ষণ। একবার মানদার নিকটে গিয়া অব্যক্ত স্বরে অভিযোগ জানাইতেছে, আরেকবার বেবোর নিকটে গিয়া ক্রন্দন করিতেছে। উহার আছাড়িপিছাড়ি দেখিয়া চক্ষে জল আসিতেছে সকলের। মানদা সকল কর্ম মুলতুবি রাখিয়া হাম্পটিকে ভুলাইতেছে। বেবোও উহাদের সঙ্গ দিতেছে। যতই অবলা জীব হউক না কেন, মায়ের প্রাণ তো বটে। প্রবোধ মানিবে কেন! সন্তানহারা মায়ের বেদনা সমব্যথী ব্যতীত কে আর বুঝিবে! এইরূপে কয়েক ঘণ্টা অতিক্রান্ত হইল। হাম্পটির শোক প্রশমিত হইয়াছে কিনা বুঝা যাইতেছে না, সে স্থির হইয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া আকাশের দিকে তাকাইয়া রহিয়াছে। সেও কি তবে কোনো অবিচারের জন্য বিধাতার কাছে দরবার করে? মানদার বুক ফাটিয়া যাইতেছে উহাকে দেখিয়া। অকস্মাৎ হাম্পটি একখানি ছানা মুখে লইয়া বাহিরের দিকে দৌড় দিল। বেবো উহার পিছে পিছে দৌড়াইল। কিন্তু সে হাম্পটির সহিত পারিবে কেন। সে প্রাচীরে লাফাইয়া উঠিল, এক মুহূর্ত বেবোর পানে চাহিল, পরক্ষণেই প্রাচীরের অন্যদিকে লাফ দিল। মানদার নিকটে যাইয়া বেবো হাহুতাশ করিতে লাগিল। মানদাও বিমূঢ়—সে জানে না, এই ঘটনার গতিপ্রবাহ কোনখাতে বহিবে। ঘন্টাখানেকের ভিতর হাম্পটি ফিরিয়া আসিল। উহাকে দুইটি মানুষ বারংবার নানা প্রশ্ন করিতে লাগিল। কিন্তু উত্তর দিতে হাম্পটি প্রস্তুত ছিল না। মিঁয়াও ব্যতীত উহাদের শব্দ নাই বটে, তবে ওই একটি শব্দ ও তাহার বিভিন্ন উচ্চারণে এবং হাবেভাবে উহারা সকলই বুঝাইয়া দিতে সক্ষম। অন্তত যাহারা বুঝিতে ইচ্ছুক, তাহাদের কাছে। বেবো এবং মানদা হাম্পটি ডাম্পটির নাড়িনক্ষত্র সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। কিন্তু উহাদের পর্যবেক্ষণ এই ক্ষেত্রে কাজে লাগিল না। এক পেট খাইয়া হাম্পটি কিছুক্ষণ বিশ্রাম লইল বারান্দায়। তাহার পরে বাকি শাবকটিকেও মুখে করিয়া চলিয়া যাইল। বেবোকে মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে দিতে মানদা কহিল, ‘যা হল, জানবি ভালোর জন্যই হল। তোর কিট্টি রইল। এরপর যদি আরও তিনটে বেড়াল পায়ে পায়ে ঘুরত, কী হত ভাবতে পারছিস! ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। কিট্টিও এই বাচ্চাগুলোকে দেখলে সহ্য করতে পারত না, ওদের মারধোর করত। কাঁদিস না, তুই বড় হয়েছিস, এবার বুঝতে শেখ’। ‘কিন্তু হাম্পটি যে চলে গেল…ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না’ এই বলিয়া বেবো হাপুস নয়নে পুনরায় কাঁদিতে লাগিল। ‘ওরে বোকা, হাম্পটি ঠিক আসবে দেখিস! পেটের টান পড়লেই আসবে, এই বাড়ি ছাড়া ওকে কে খেতে দেবে? ও তো ঠিক করে শিকার করতেও শেখেনি। আর ওরা হল প্রকৃতির সন্তান, ঘরে থাকা ওদের সয় না। আসবে যাবে, এইটাই প্রকৃতির নিয়ম, এটা মেনে নে বাবা’। মানদার কথায় বেবো কী বুঝিল কে জানে, চুপ করিল। সেও এক্ষণে বুঝিতে শিখিয়াছে, পরিস্থিতি তাহাকে অভিজ্ঞ করিয়া তুলিয়াছে। দুঃখ চাপিয়া রাখিয়া সেও বর্তমান এই পরিস্থিতি মানিয়া লইল। বাধ্য হইয়া মানিয়াছে মানদাও। উপায়ই বা কী! উহাদের মঙ্গল কামনায় শ্রীধরের উদ্দেশ্যে করজোড়ে প্রার্থনা করিল মানদা।
সেই দিন হইতে পাকাপাকি বন্দোবস্ত হইয়া গেল। হাম্পটি আসে, যায়, খায়, ক্ষণিক বিশ্রাম লইয়া চলিয়া যায়। শাবক লইয়া সে নিশ্চিন্তে রহিয়াছে। কিন্তু উহার এতদিনের সুখে অতিবাহিত জীবনের যে অভ্যাস হইয়াছিল, যথা বিছানায় শয়ন, মশার উৎপাত হইতে নিবৃত্তি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাসস্থান এবং নিয়মিত স্নানাদি, সেইসব হইতে সে বঞ্চিত হইয়া, কিঞ্চিৎ কষ্টে দিন কাটাইতেছে। উহার গাত্রের লোম উসকোখুসকো থাকে সারাদিন। মুখখানিও বিবর্ণ দেখায়। মানদা এই করুণ মূর্তির দিকে তাকাইতে পারে না! মাতৃত্বের যে কৃচ্ছসাধন সে স্বেচ্ছায় বরণ করিয়া লইয়াছে, তাহা প্রাণীকুলে কতখানি প্রচলিত সে সম্বন্ধে মানদার ধারণা নাই। মনুষ্যসমাজে মাতৃত্ব কে মহিমান্বিত করিবার উদ্দেশ্যে অনেক কাহিনী প্রচলিত রহিয়াছে, তথাপি কুমাতার নিদর্শনও আকছার মিলিয়া থাকে। মনুষ্যসমাজে যদাপি পিতৃত্বের মহিমা লইয়া বিশেষ আলোচনা নাই। আর এই বিলাই কুলের পালক পিতা ডাম্পটি যে দায়িত্ব স্বেচ্ছায় তুলিয়া লইয়াছে, তাহার তুলনা সম্ভবত কোনো কুলেই নাই। হাম্পটি চলিয়া যাওয়ার পরে সে সারাক্ষণ কিট্টিকে সঙ্গ দেয়। কিট্টির মায়ের জন্য মনখারাপ করিলে ডাম্পটি উহার সহিত ক্রীড়া করিয়া তাহাকে ভুলাইয়া দেয়। রাত্রে উহার সহিত শয়ন করে। প্রাতঃকালে উহাকে সঙ্গে লইয়া ঘুরিতে বাহির হয়। উহাকে বাগানে লইয়া যাইয়া হাগুমুতু করাইয়া লইয়া আসে। মানদা বিস্মিত নয়নে চাহিয়া থাকে। আর মনে মনে প্রণাম জানায় এই অবলাদের। ইহারাই যেন স্বয়ং ঈশ্বর রূপে তাহার নিকট আসিয়াছে। দিনে দিনে কিট্টির বাড়বৃদ্ধি হইতেছে। হাম্পটির দুগ্ধ পানের নেশাও সে ত্যাগ করিয়াছে। হাম্পটি খাইতে আসিলে সে নিকটে যায় বটে, তবে খুব বেশি আদিখ্যেতা দেখায় না। সে সম্পূর্ণ রূপে ডাম্পটির উপর ভর করিয়াছে। এক রাত্রে ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া মানদা দেখে কিট্টি ডাম্পটির বুকে স্তন্য খুঁজিতেছে নিদ্রার ঘোরে। বক্ষ ফাটিয়া যায় মানদার। উহাদের আদর করিয়া সে ঘুমাইতে যায়। বিছানায় শুইয়া ভাবিতে থাকে, দুগ্ধের ধারা কীরূপে স্তন্য হইতে নিঃসৃত হয়, তাহা জানা হইল না। জানা হইল না স্তন্যদানের সুখ। সন্তানকে বক্ষে চাপিয়া ধরিলে বুকের ভিতরে ঢেউ উথলায় কিনা তাহাও জানিতে পারিল না সে। হায় রে! তাহার জীবন অসম্পূর্ণই রহিল। এই সন্তাপ সে নিজের ভিতরেই অবরুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, কখনো কাহাকেও ঘুণাক্ষরেও টের পাইতে দেয় নাই। (ক্রমশ)
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী