মানদাসুন্দরী দাসী ও হাম্পটিডাম্পটি (চতুর্দশ পর্ব) – তুষ্টি ভট্টাচার্য

পর্ব ১৩
পর্ব ১৫
পর্ব ১৩
পর্ব ১৫

-১৪-

        পচা ভাদ্রের গরমে সকলে হাঁসফাঁস করিতেছে। গরম পড়িয়াছে বলিয়া যে রান্নাঘরের কর্মকাণ্ড হ্রাস পাইবে, এমন তো নহে। দুটিখানি ভাতের পর যে ভাতঘুমের চেষ্টা করিবে ইহারা, তাহারও উপায় নাই। উলটানো চুবড়িতে খান পঁচিশেক তাল ঘষা হইতেছে। বিরাটাকার গামলায় সেই তালের ক্বাথ সংগ্রহ করিয়া কাপড় চাপা দিয়া রাখিতেছে ঠাকুর। মানদা সহ আরও পাঁচ-ছয় জনা ঝি, চাকর সেই তাল ঘষিতে  ব্যস্ত। ইহাদের ঘিরিয়া ডুমো ডুমো নীলকান্ত মাছি গুঞ্জন করিতেছেই শুধু নহে, নৃত্যরত হইয়া উহারা তাল এবং তাল ঘর্ষণকারীদের ভয়ানক ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছে। মাছি তাড়াইতে গিয়া মানদার গালে, কপালে অকস্মাৎ তাল মাখা হাতের চাপড় পড়িল। তাহাকে দেখিয়া সকলে একযোগে হাসিয়া উঠিলে মানদা হস্ত-মুখ প্রক্ষালণ হেতু তড়িঘড়ি উঠিয়া পড়িল। এই অসময়ে পুকুরঘাটে গিয়া সে দেখিল, চারিদিক শুনশান। কেবল ঘুঘুর শব্দে দ্বিপ্রহরের স্তব্ধতা ছিন্ন হইতেছে। ঘাটের পার্শ্বে একটি পুরানো তেঁতুল গাছ থাকায়, ঘাটের সিঁড়িগুলি ছায়াচ্ছন্ন থাকে সারাদিন। শীতল সানের পরশে মানদার শরীর জুড়াইল কিঞ্চিৎ। নেউলের বদান্যতায় সর্পের উপদ্রব কম হইলেও দু একখানি সাপের খোলস পড়িয়া রহিয়াছে। হাতমুখ ধুইতে সে ভুলিয়া গেল হঠাতই। শুকাইয়া মামড়ি পড়িল তালক্বাথের। তবু হুঁশ ফিরিল না মানদার। সে কেন জানি স্থির হইয়া বসিয়া রহিল পুকুরঘাটে। ইহার কারণ সম্ভবত মানদাও জানে না। সে নির্দিষ্ট করিয়া কিছু ভাবিতেছিল না, শুধু গাছের আড়ালে বসিয়া থাকা, ডাক পাড়া ঘুঘুটিকে নিবিষ্ট চিত্তে খেয়াল করিতেছিল। যেন তাহার কোনো কাজ নাই, কোনো তাড়া নাই। এই স্থানে বসিয়া থাকিলেই চলিবে। হাঁসগুলি পুকুরের ধারে আসিয়া জলকাদায় গেঁড়িগুগলির তল্লাশ করিতেছিল। মানদাকে দেখিয়া সমস্বরে ডাকিতে ডাকিতে পাড়ে আসিল আহ্লাদ জানাইতে। অন্যসময় হইলে সে হাঁসগুলির সহিত বাক্যালাপ করিত, এক্ষণে তাহার সে ইচ্ছাও নাই। তাহাকে নিশ্চুপ দেখিয়া উহারা জলে নামিয়া পড়িল পুনরায়।  

এইরূপে মানদা যে কতক্ষণ ঘাটে বসিয়া ছিল, তাহার হুঁশ ছিল না। বৈকাল মরিয়া আসিলে, তাহার টনক নড়িল। কর্মে ফাঁকি দিবার প্রবণতা তাহার কোনো কালেই ছিল না, ফলে আজিকের কর্ম অসমাপ্ত রাখিয়া চলিয়া আসিয়াছে বলিয়া তাহার অনুতাপ হইল। তড়িৎ গতিতে সে পাকশালার দিকে চলিল। আর তাড়াহুড়ায় সে ধাক্কা খাইল আচম্বিতে। তাকাইয়া দেখে তিনি আর কেহ নন, সুবিমলবাবু। করজোড়ে তাহাকে নমস্কার করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিল সে। সুবিমলবাবুর জ্বলন্ত চক্ষু দেখিয়া বুঝিল, তাঁহার রোষানল নিভিতে সময় লাগিবে। রান্নাঘরে গিয়া দেখিল, তালের প্রস্তুত্তি শেষ। এক্ষণে নারিকেল কোরার পর্ব চলিতেছে। সেও তড়িঘড়ি নারিকেল লইয়া বসিয়া পড়িল। বৃহদাকার কাঁসার বগী থালা নারিকেল কুরিয়া ভর্তি করা হইতেছে। এক ঝলক দেখিলে মনে হইবে যেন একরাশ জুঁই ফুল যত্নে রাখা আছে। নারিকেলের প্রসঙ্গে মানদার কত কথাই না স্মরণে আসিল। এককালে মাতুলালয়ে এই নারিকেল কাণ্ডের উপর হইয়ে পুকুরের জলে তাহার ভাইবোনেরা কত না লম্ফঝম্প করিয়াছে! নারিকেল পাতার গাড়িতে একে অপরকে ঘষিয়া টানিয়া লইয়া গিয়াছে। আর নারিকেল ছাড়াইবার জন্য তাহাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়িয়া যাইত। যে আগে ছাড়াইবে সে নারিকেলের ভাগ বেশি পাইবে। শৈশবকালের মতো সুখ আর সে কি কক্ষণও পাইয়াছে? কেহই কি পায়? অনাদরের মাতুলালয়েও সে কি সুখে ছিল না? এই বয়সকালে আসিয়া মধ্যে মধ্যে মানদার স্মৃতিকাতরতা জন্মে। বয়সের দোষ ইহাকেই বলে বোধহয়। অতীতচারী হইয়া বর্তমানের রঙহীন দিনগুলি কোনোক্রমে অতিবাহিত করা—এই কারণটিই বোধকরি সুপ্রযোজ্য বলিয়া মনে হয় মানদার। বর্তমানে ফিরিয়া হঠাতই হাসি পাইয়া গেল মানদার। কিশোরীর ন্যায় ফিক করিয়া হাসিয়া উঠিল সে। সুবিমলবাবুর সহিত ধাক্কার কথা স্মরণে আসিল।

মানুষের অজানিতে এমন কত ঘটনাই না ঘটিয়া থাকে জীবনে। যাহাকে রূপক বলিতে মন চায়। নহিলে মানদা বর্তমানে যাহা লইয়া লঘু হাস্যপরিহাস করিতেছে, ভবিষ্যতে এই সংঘর্ষের প্রকারটি অন্যরূপে তাহার সম্মুখে আসিয়া পড়িতে পারে, আজিকে ইহা তাহার নিকট কল্পনারও অতীত। হাম্পটি কি কভু ভাবিয়াছিল, এই গৃহ হইতে তাহাকে চলিয়া যাইতে হইবে? ডাম্পটি কি ভাবিয়াছিল হাম্পটির সহিত তাহার দূরত্ব বাড়িবে? কিট্টি বড় হইতেছে। না জানি তাহারও কত কী দেখিবার আছে! না জানি মানদাকেও আরও কত কত কিছু দেখিতে হইবে! 

বেবো সেদিন কহিল, ‘আচ্ছা তুমি কি হাম্পটির ছানাদুটোকে দেখেছ আর? কত বড় হল কে জানে!’ উহার মুখে এহেন পরিপক্ক বাক্য শুনিয়া মানদা তাহার গাল টিপিয়া আদর করিল, ‘সত্যিই রে! কত দিন হয়ে গেল…ছানাগুলো এখন নিশ্চয়ই দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। একবার যে দেখতে যাব, সেও আর সময় হয় না। কোন বনেবাদাড়ে যে রেখে এসেছে, কে জানে!’ ‘বনে বাদাড়ে নয় গো। আমাদের পাঁচিলের ওপাশেই ফাঁকা জায়গা আছে না…ওখানে একটা ছোট্ট মতো একচালা, ভাঙা ঘর আছে। ওই ঘরের মধ্যেই রেখেছে বাচ্চাদুটোকে। আমি দেখে এসেছি একদিন পাঁচিল ডিঙিয়ে’, এই বলে বেবো হিহি করিয়া হাসিয়া উঠিল। ‘হ্যাঁরে, তুই অত উঁচু পাঁচিল ডিঙোলি কী করে? যদি পড়ে যেতিস? যদি হাত পা ভাঙত? তাহলে তোর নতুন মা মেরে তোর হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিত’। ইহার পর দুই অসমবয়সী বন্ধু গলা জড়াইয়া হাসাহাসি করিতে লাগিল একপ্রস্থ। হাম্পটি এই সময়েই উপস্থিত হইল। বেবো উহার সহিত বকিতে শুরু করিল, ‘হ্যাঁরে, তোর ছানাদুটোকে নিয়ে আয় একবার। পিসি দেখতে চাইছে। নিয়ে আয় ওদের…’ হাম্পটি কী বুঝিল জানি না, আকাশ পানে উদাস নয়ন মেলিয়া বসিয়া রহিল। মানদার বুকটা ছ্যাঁত করিয়া উঠিল। বাঁচিয়া আছে তো উহারা! হাম্পটিকে পর্যবেক্ষণ করিল মানদা। দেখিল উহার স্তন্য দুধের ভারে আনত এক্ষণও। এমনকি মাই চুষিবার ছাপ স্পষ্ট। দেখিয়া নিশ্চিন্ত হইল সে। আহা দুধের বাছারা, মা ষষ্ঠীর বাহনেরা, ভালো থাক, বেঁচে থাক!

  বেবোর মুখে মানদা শুনিল, অর্থচিন্তা খানিক দূর হওয়ায় তাহাকে নতুন মা ইদানীং গঞ্জনা দেয় না পূর্বের মতো। আদর, আহ্লাদ না করিলেও গাল পাড়ে না কথায় কথায়। ভাইবোনেরাও তাহাকে ক্রীড়ায় অংশ লইতে দেয়। শুনিয়া মানদা নিশ্চিন্ত হইল। তবু এইভাবে চলিলে ছেলেটার কষ্ট কিছু লাঘব হইবে। বাছা আমার ভালো থাক। এই পৃথিবীর সকল প্রাণী ভাল থাক—নিত্য এই কামনা করে সে শ্রীধরের কাছে। তাহার জীবন ফুরাইয়া আসিল প্রায়। সে মরিলেও কী আর বাঁচিলেও কী! একটা বোঝা কমিয়া যাইবে এই সংসার হইতে। বাঁচিয়া থাকিয়া অন্যের গৃহের অন্ন ধ্বংস ব্যতীত তাহার কোনো ভূমিকা নাই এই ধরায়। ‘প্রভু, এইবার তুলে নাও আমায়…আর যে পারি না!’ অস্ফুটে বলা এই বাক্য শ্রবণ করিবার কেহ ছিল না সম্মুখে। তথাপি কোথা হইতে ডাম্পটি আসিয়া তাহার ক্রোড়ে চাপিয়া বসিল অসময়ে। ‘আরে করিস কী, করিস কী…নাম্‌, নাম্‌, ছুঁয়ে দিলি তো! আবার আমাকে কাপড় কাচতে হবে। হতভাগা…যা, যা!’ তাড়াইলেও ডাম্পটি পলাইল না। তাহার পাশে পাশে ঘুরিতে লাগিল। যেন সে বলিতে চায়, ‘আমাদের ছেড়ে কোথায় যেতে চাও তুমি? তোমায় আমরা ছাড়ব না’। এই মায়ার পৃথিবী তাহাকে যাইতে দিতে চাহে না, আর সে যাইবার জন্য উদগ্রীব। এইরূপ দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে মানদা কী করে আর! মায়ার বন্ধন ছিন্ন করা কি এতো সহজ? কাপড় কাচিবার কথা ভুলিয়া গিয়া সে ডাম্পটির সহিত বকিতে লাগিল। ডাম্পটিও বিজ্ঞ মুখ করিয়া তাহার কথা শুনিতে শুনিতে নিদ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল। কিছুক্ষণ বাদেই কিট্টি আসিয়া লম্ফঝম্ফ শুরু করিলে ডাম্পটির নিদ্রা ছুটিয়া যাইল। উহাদের ক্রীড়া দেখিতে দেখিতে মানদা বিবশ হইয়া বসিয়া পড়িল। (ক্রমশ)

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী

পর্ব ১৩
পর্ব ১৫
পর্ব ১৩
পর্ব ১৫