পর্ব ১৬
পর্ব ১৮
পর্ব ১৬
পর্ব ১৮
-১৭-
দিবসের আলোয় মানদা কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত হইল। এই আলোর উপরই তাহার যত ভরসা। আঁধার দেখিতে তাহার আর ভালো লাগে না। নিত্য কর্মে ব্যপৃত হইলে সে শুনিল, চাকরবাকরেরা ভবিষ্যৎ আলোচনায় মগ্ন। কে কোথায় নতুন কর্মের সন্ধান করিতেছে, কে কোথায় নতুন কর্ম পাইয়া গিয়াছে, এই লইয়াই গুলতানি চলিতেছে। কাহারও কর্মে মন নাই। যে কর্মে আর সংস্থান হইবে না, সেই কর্মে মনোযোগ আসে না। মধ্যাহ্নে ভবঘুরেদের খাবার পরিবেশন করিতে যাইলে মানদাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হইতে হইল। ‘হ্যাঁগো মা! এই বাড়িতে নাকি তোমরা আর থাকবে না? এরপর আমাদের আর অন্ন জুটবে না। দে মা, অন্নপূর্ণা, আর দুটি ভাত দিয়ে যা!’ মানদা উহাদের আশ্বস্ত করিতেও পারিল না। তাহার নিজেরই যে কী গতি হইবে, কে জানে! দুর্ভাবনা ভুলিয়া সে ভুখা মানুষগুলোর পরম তৃপ্তি সহকারে খাইবার দৃশ্য দেখিতে লাগিল। আর এই দৃশ্য দেখিবার সুযোগ পরম করুণাময় তাহাকে দিবে না। এই মানুষগুলার খাদ্য জুটাইয়া দিও তুমি, হে প্রভু! মনে মনে শ্রীধরের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাইল সে। জীব দিয়েছেন যখন তিনি, আহারও নিশ্চয় তিনিই জোগাইবেন। মা অন্নপূর্ণার ভাণ্ডারে অন্নের অভাব নাই। শুধু ইহারা কেন, জগত সংসারের কেহই না খাইয়া মরিবে না—এই দৃঢ় বিশ্বাস মানদার রহিয়াছে। জগত সংসারের চিত্রটি তাহার কাছে এক ক্ষুদ্র গণ্ডীর ভিতর রাখিয়া দিয়াছিলেন উপরওয়ালা। এইবার তাহার ব্যত্যয় ঘটিতে চলিতেছে….
সারাদিন পলু আর কলু বাড়ির বাহিরে কাটাইল। রাত্রে আসিয়াই মানদাকে ডাক দিল। মানদা হন্তদন্ত হইয়া আসিল। বিনা ভূমিকায় পলু বলিল, “আর তিনদিন!’ “আর তিনদিন কী বাবা?” “আর তিনদিন এই বাড়িতে থাকবে তুমি।’ ‘মানে? তারপরে কোথায় যাব?’ “আমরা যেখানে তোমাকে নিয়ে যাব, সেখানেই যাবে।’ মানদা বিস্ময়ে কিছুক্ষণ উহার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল। তাহার পর ‘আচ্ছা’ বলিয়া ধীরে নির্গত হইয়া যাইল। কলু ব্লিল, ‘দেখলি দাদা! ছোটমা একটা কথাও আর জিজ্ঞেস করল না?’ পলু উত্তরে কহিল, ‘তুই এখনও ছোটমাকে চিনিসনি? ছোটমা মুখ ফুটে কোনদিন কিছু বলেছে? সারাটা জীবন তো এভাবেই কাটিয়ে দিল। অবশ্য এছাড়া ওঁর তো আর কোনো উপায় নেই রে! আমরা যদি জলেও ফেলে দিই, তাই ওঁকে মেনে নিতে হবে।’ ‘হ্যাঁ, তা ঠিকই। কিন্তু জলে ডোবা থেকে যে আমাদের বাঁচাইয়, তাঁকে কি আমরা জলে ফেলে দিতে পারি? এতদিন ওঁর উপর হাজার অন্যায়, অবিচার হয়েছে আর আমরা কুলাঙ্গার বলেই সেই সবকিছু দেখেও হয়তো এড়িয়ে গিয়েছি।
অবশেষে ছিন্ন পত্রের ন্যায় এ গৃহের বাসিন্দারা নিজেদের তল্পি গুটাইয়া চলিল নতুন বাসস্থানে। চলিল বলিলেই কি চলা যায় এত সহজে? ছাড়িয়া যাইবার পূর্বে এই গৃহ হইতে শিকড় উচ্ছেদ পর্ব রহিয়া যায়। কবেকার এক ভাঙা কৌটার শোকে গৃহিণী আকুল হইয়া কাঁদিতে থাকে। কংস, পিত্তলের তৈজস একে একে বস্তাবন্দী হইতেছে, আবার কবে যে এগুলির প্রয়োজন পড়িবে, জানে না কেহ, তথাপি এই ফাঁকতালে গুন্তিতে যেন কম না হয়, সেদিকে কড়া নজর। কাহারো আবার সারাজীবন ধরিয়া অতি যত্নে রাখা দোয়াত-কলম, অদ্য এই শেষসময়ে আসিয়া উল্টাইয়া যাইল। তিলতিল করে সাজিয়ে তোলা মেহগিনি কাষ্ঠের এই আলমারী-দেরাজগুলি ফাঁকা করিতে যে এই ক’দিনমাত্র সময় পাইবে তাহাই বা কে জানিত! পাটে পাটে ছিঁড়িয়া যাওয়া শাড়ির শোকে গৃহ আজ মূহ্যমান। কেহ আবার শাড়ির খাঁজে লুকাইয়া রাখা অর্থ পাইয়া উল্লসিত। মায় কোন কোনা হইতে লুক্কায়িত অহিফেন শুদ্ধু মিলিল। পিঞ্জরবন্দী টিয়াপাখিটাও যেন টের পাইয়াছে- তাহার চিরপরিচিত আকাশ আজ থেকে বদলাইয়া যাইবে।
শিশুদিগের বড়ই সমস্যা হইয়াছে বর্তমানে। তাহাদের খেলার সামগ্রী সকলই বাঁধিয়া ছাঁদিয়া প্রস্তুত। ফলে উহাদের সময় কাটিতেছে না। একখানি দোদুল্যমান কাঠের ঘোড়া, যাহার ঠ্যাঙের অংশ ভাঙিয়া গিয়াছিল সমবেত অত্যাচারে, তাহাকে এই স্থানেই ফেলিয়া যাওয়া হইবে, স্থির হইয়াছে। ঘোড়ার শোক ভুলিতে এবং হাতের নিকট খেলার কোনো বস্তু না পাইয়া একদল শিশু ওই খঞ্জ কাঠের ঘোড়াটির ওপর চড়াও হইয়াছে। তাহাতে কেহ বা হুমড়ি খাইয়া পড়িতেছে, কেহ কেহ নিজেদের ভিতর মারামারি করিতেছে। বড়রা নিজেদের সামগ্রী গুছাইতে নাজেহাল হইতেছে, তাই উহাদের সামলাইবার বা শাসন করিবার কেহ নাই। চিৎকারে, বাসনকোসনের শব্দে, জিনিসপত্র টানাটানির ঘর্ষণে এই গৃহ যেন অতিকায় এক যক্ষের রূপ ধরিয়া তাণ্ডব করিতেছে। চারিদিক ধূলায় ধূসরিত।
মানদা নিশ্চুপে সকলই লক্ষ্য করিতেছে। তাহার উদ্বেগ কমিয়া গিয়াছে। সে শুধু ডাক পাইবার অপেক্ষায় আছে। তাহার দুইখানি থান, আর দু-চারটি অপ্রয়োজনের বস্তু, ডাক পড়িলেই মুহূর্তের মধ্যে গুছাইয়া ফেলিতে পারিবে। এই তক্তাও তাহার নহে। মায়, সেও আর এই গৃহের কেহ নহে। এতদিনকার চেনা মানুষের সহিত বিচ্ছেদ বেদনাই তাহাকে ভারাক্রান্ত করিতেছে। সে বড় গিন্নীমার সহিত দেখা করিয়া আসিয়াছে। তিনি তাহার শারীরিক যন্ত্রণা ভুলিয়া কপাল চাপড়াইয়া এই ভিটের জন্য কাঁদিতেছেন। কিন্তু তাঁহার কান্না কাহারও কর্ণে প্রবেশ করিতেছে না। এমনকি সুবিমলবাবুর সহিতও দেখা করিয়া আসিয়াছে সে। মনের জোর লইয়া তাঁহার সম্মুখীন হইয়াছে। বরাবরের মতো মাথা নিচু করে নাই। বরং তাঁহার মুখের পানে স্পষ্ট চাহিয়া বলিয়া আসিয়াছে, ‘কথায় বলে ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। এতদিন এই বাড়ির আশ্রয়ে ছিলাম, এ আপনাদের মহানুভবতা। কিন্তু এবার বোধহয় নিজের ঘর পাব, আর দাসীর জীবন কাটাতে হবে না আমাকে।’ সুবিমলবাবু মানদার এই রূপ পূর্বে কক্ষনো দেখেন নাই। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ভাবিয়াছিলেন, মানদা বুঝি আসিয়া কাঁদিয়া কাটিয়া তাঁহার পায়ে পড়িবে। তাহার পরিবর্তে এইরূপ আলাপে তিনি বিস্মিত হইবেন না রুষ্ট, বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। কোনোক্রমে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কোথায় যাবে?’ মানদা কোনো উত্তর করিল না। মৃদু হাসিয়া বিদায় লইল।
পলু আর কলু শুধু যে থিয়েটার লইয়াই মাতিয়া থাকিত, এমন নহে। তাহাদের দেশোদ্ধার প্রীতি ছিল কিঞ্চিৎ। সরাসরি স্বদেশী না হইলেও তাহারা অনাথ, আতুরদের সাহায্যে একখানি সংস্থা খুলিয়াছিল। এই সংস্থা বয়স্কা থিয়েটার কর্মী, বেশ্যালয় ও নাট্যশালা হইতে পরিত্যক্ত অনাথা, অসহায় বিধবাদের লইয়া হস্তশিল্পের ব্যবসা খুলিয়া বসিয়াছে। ইহাদের প্রস্তুত কৃত আচার, বড়ি, সাবান, ধূপ, আসন, চাটাই, মাদুর, চটের ব্যাগ মায় শাড়ি, গামছা বিক্রয় করিয়া যা অর্থ প্রাপ্ত হয়, ইহাদের দেখভালে তাহা কাজে আসে। বিভিন্ন ধনী ব্যবসায়ী অথবা আশ্রম হইতেও কিছু সাহায্য পাইয়া থাকে ইহাদের সংস্থা। হিসাব নিকাশ ইহারা নিজেরাই করিয়া থাকে, কাজেকর্মেও ফাঁকি নাই। নিজেদের ফসলটুকু এইখানেই ফলাইয়া লয়। শুধু অভাব রহিয়াছে একজন যোগ্য দলপতির। যিনি সুষ্ঠু ভাবে সকল কর্ম সম্পন্ন করিবার বুদ্ধি জোগাইবেন, কাহাকে কী করিতে হইবে নির্দেশ দিবেন…এইরূপ এক নেতা বা নেত্রীর বড়ই প্রয়োজন উহাদের। সমন্বয়ের অভাবে মধ্যে মধ্যেই কলহ, অশান্তি ঘটে এই স্থানে। পলু, কলুর ডাক পড়ে তক্ষণ। তাহারা নিজেদের কর্মে এতই মগ্ন হইয়া থাকে যে ইহাদের ঝঞ্ঝাট সামলানো তাহাদের নিকট ভীষণ এক সমস্যা বৈ কিছু নহে। এক্ষেত্রে একজন দক্ষ ও পরিণত মানুষের নেতৃত্ব থাকিলে পলু, কলুর আর কোনো সমস্যা থাকে না। তাহারা একযোগে মানদাকে এই স্থানে বসাইতে ইচ্ছুক। মানদার থাকিবার জন্য একখানি ঘর খালি করিয়া পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছে পূর্ব হইতেই। একটি টেবিল, চেয়ার আর তক্তপোশের ব্যবস্থাও করিয়াছে।
অতঃপর মানদার ডাক আসিল। পলু, কলুর সহিত সে কৌচে উঠিয়া বসিল। তাহার পূর্বে হাম্পটি, ডাম্পটির সহিত এক আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা হইয়াছে। বেবো ও তাহার কিট্টির সহিতও কম কিছু হয় নাই অবশ্য। বেবোকে সারা বাড়ি খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। মানদাই তাহাকে পুকুরপাড়ের গাছের আড়াল হইতে ধরিয়া আনিয়াছে। তাহার পর ঘাটে বসিয়া বেবোকে জড়াইয়া বহুক্ষণ বসিয়া ছিল সে। এই তাহার সেই প্রিয় ঘাট। হাঁসাহাঁসিগুলা এক্ষণও জলে চড়িতেছে। একমাত্র উহাদের কোনো তাপ উত্তাপ নাই। এই পুষ্করিণী আর ওই কাঠের খাঁচা—এই দুই ছাড়া উহাদের জীবন বলিয়া কিছু নাই। উহাদের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া দুইজনে বসিয়া ছিল। যেন অনন্তকাল এই স্থানেই উহারা নিঃশব্দে বসিয়া থাকিবে। চক্ষের জল নির্গত হইতে হইতে শুকাইয়া আসিলে মানদা উঠিল। বেবোকে সঙ্গে লইয়া উহার ঘর পর্যন্ত আগাইয়া দিল। হাম্পটি, ডাম্পটি নিঃস্পৃহ দৃষ্টি লইয়া মানদার গমন পথে তাকাইয়া রহিল। আহার আর আশ্রয় ব্যতীত বর্তমানে তাহাদের আর কোনো চিন্তা নাই। (ক্রমশ)
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী