-১৮-
অতঃপর মানদাসুন্দরী দাসীর নাম খাতায় কলমে নথিভুক্ত হইল। শ্রীশ্রী জগদ্ধাত্রী আশ্রমের সর্বেসর্বা হইল মানদা। তাহার এই নূতন সংসারে সে দিবারাত্রি পরিশ্রম করিতে থাকিল। নূতনতর কর্মে মনোযোগ দিতে তাহার নব উদ্যম আসিয়াছে। সারাদিন সে ঘুরিয়া ঘুরিয়া সকলের কাজ তদারকি করে। পাঁপড়, আচার, আমসত্ত্ব তৈয়ারে নিজ উদ্ভাবনী পদ্ধতির প্রয়োগ করে। ফলে স্বাদে, গন্ধে উৎকৃষ্ট সেইসব বস্তুর বিক্রী বৃদ্ধি হইতে থাকে। যাহারা ভিন্ন কাজে যুক্ত, তাহাদের কর্মে সে যোগ দিতে না পারিলেও তাহাদের উৎসাহ দেয়। এমনকি ফাঁকিবাজদিগের প্রতি কড়া নজর রাখে। দিনশেষে মানদার নিকট সকলে একে একে হিসাব চোকাতে আসে। কাহার কতখানি কাজ হইল, তাহার খতিয়ান লওয়া হয়। পরের দিন কাহাকে কী কর্মের ভার দেওয়া হইবে, সেও স্থির হয়। সন্ধের দিকে জপ, আহ্নিকের পরে খানিক বিশ্রাম লয় মানদা। এই আশ্রমের প্রাচীর ঘেঁষিয়া গঙ্গা বহিয়া চলিয়াছে। গঙ্গা সংলগ্ন প্রাচীরের ভিতর খোলা জমি, চাষাবাদ হয় কিছু এই স্থানে। একখানি ফুলের উদ্যানও রহিয়াছে। উদ্যানটি বড়ই মনোরম। আশ্রমের পূজার ফুল এইখান হইতেই মেলে। এই উদ্যানের ভিতরেই বিরাজ করিতেছেন মা জগদ্ধাত্রী। একচালার নিচে তাঁহার বাস। রাত্রে সে এই উদ্যানের ভিতর বসিবার বেঞ্চে বসিয়া থাকে। গঙ্গার শীতল বাতাসে তাহার মন আরও শান্ত হইয়া আসে। আর ঠিক এই সময়েই তাহার হাম্পটি, ডাম্পটি, কুট্টুস ও বেবোর কথা মনে পড়ে। এ প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। একটি দিনও এমন নাই যে উহাদের মুখ স্মরণে আসে নাই মানদার। আজিকে প্রায় দুই বৎসর কাটিয়া যাইল, কিন্তু এক্ষণও বুকের ভিতর মোচড় দিয়া ওঠে। তাহার পর নিজেকেই সে প্রবোধ দেয়, অবলা জীবগুলিকে ঈশ্বরই আহার দিতেছেন নিশ্চিত। বেবোও বড় হইয়াছে, কলু-পলুর মুখেও শুনিয়াছে, পিতা ও সৎ মাতা এবং ভ্রাতা, ভগিনীদের সহিত সে সুখেই আছে। তথাপি অতীব সুখের সংবাদ সে পাইল আজই। তাহার কুট্টুস, বেবোর কিট্টি, বেবোর সহিতই তাহাদের নূতন গৃহে ঠাঁই পাইয়াছিল। তবে আর কী? বাকি জীবন এইস্থানেই কর্মমুখর ভাবে কাটিয়া যাইবে মানদার। এই স্থানে সে যোগ্য সম্মান পায়, পায় নিজ রোজগারের স্বল্প কিছু অর্থ। আর ওই অনাথা, আতুরদের ভালোবাসাও সে কম পায় নাই। প্রথম প্রথম বেশ্যা, কুলোটা বা থ্যাটারের মাগীদের সে ভয়ের চক্ষে দেখিত। না জানি উহারা তাহাকে অকথা-কুকথা বলিয়া বসে! কিন্তু ধীরে ধীরে তাহার ভয় কাটিয়া গিয়াছে। দেখিয়াছে উহারা আর পাঁচটা নারীদের মতোই অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনার স্বীকার। ফলে একসুরে বাজিয়া উঠিতে তাহাদের খুব বেশি সময় লাগে নাই।
এই স্থলে দেখিতে দেখিতে সাত বৎসরকাল অতিক্রান্ত হইল মানদার। এইখানেও কয়েকখানি বিলাই জুটিয়াছে। আর ছোট বালক, বালিকার তো অভাব নাই। এইরূপ এক বালক, যাহার নাম যদু, মানদার খুব ন্যাওটা হইয়া উঠিয়াছে। যদুর সহিত জুটিয়া গিয়াছে দুইখানি বিলাই। যদু তাহাদের নাম দিয়াছে অলি আর কলি। এই যদুর পিতার ঠিকানা নাই। তাহার মাতার হস্তশিল্পে নিপুণতা দেখিলে আশ্চর্য হইতে হয়। শাড়ি, চাদর, টেবিলক্লথে তাহার ডিজাইন অনুযায়ী অনেক মেয়েরা সুইসূতায় যাদু দেখায়। তাহার নৈপুণ্যে এবং মানদার তদারকিতে দেখিতে দেখিতে এই আশ্রম অনেক শক্তপোক্ত হইয়াছে। আক্ষরিক অর্থেই আশ্রমের বাসিন্দাদের থাকার ব্যবস্থা ও জগদ্ধাত্রীর চালা পাকা দালান হইয়াছে। এক সদাশয় ব্যক্তির অনুগ্রহে ইহা সম্ভব হইয়াছে। ব্যবসায় যা মুনাফা হয়, এই আশ্রমের কাজেই তাহা পুনরায় বিনিয়োগ করে মানদা। পলু, কলু মধ্যে মধ্যে মানদাকে এই লইয়া রসিকতা করে। তাহার এহেন ব্যবসা বুদ্ধি দেখিয়া উহারা বলে, ‘এখন তো আর একে আশ্রম বলা যাবে না, এ হল গিয়ে আমাদের স্বর্গ। আর তুমি হলে স্বয়ং মা লক্ষ্মী।’ মানদা লজ্জা পায়, বিব্রত হয়।
পলু, কলুর ইচ্ছায় হউক বা ষড়যন্ত্রে, এই স্থলে বর্তমানে একখানি আখড়া গড়িয়া উঠিয়াছে। মস্ত মস্ত পালোয়ানেরা এইস্থলে কুস্তির তালিম দেয় আশ্রমিক কিশোর, যুবাদের। ইহাদের সহিত বহিরাগত কিছু যুবাবয়স্করাও হাজির হয় মধ্যে মধ্যে। সেই সকল দিনগুলিতে পলু, কলুও উপস্থিত থাকে। সেদিন তাহারা অতিরিক্ত সতর্কতা হেতু চারিদিক প্রদক্ষিণ করিতে থাকে। বহিরাগত যুবকদের লইয়া গোপন বৈঠক বসে তাহাদের। সেই স্থলে কাহারও প্রবেশাধিকার থাকে না। তাহাদের দেখিলেই সকলে তটস্থ হইয়া ওঠে। স্বাভাবিক ভাবেই এই সকল ঘটনা মানদারও নজর এড়ায় নাই। প্রথম দিকে সে ভাবিয়াছিল, ছেলেছোকরার দল আড্ডা দিতেছে। ওই দিকে নজর করিলে বয়স্ক মানুষের মান থাকে না। কিন্তু ইহাদের আচরণে এমন কিছু গোপনীয়তা থাকিত, যাহা তাহার চক্ষে অন্যরকম ঠেকিয়াছিল। আশ্রমের অন্য কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিলে, কেহই কিছু কহে না। সকলেই না জানিবার ভান করিয়া এড়াইয়া যায়। যদু মুখ ফসকাইয়া বলিয়া ফেলিয়াছিল, ‘ওরা স্বদেশী করে গো! তুমি জান না?’ স্বদেশী করিবার অর্থ কী, যদু বুঝে না। মানদাকে জিজ্ঞাসা করিতে গিয়া সে এই গোপন তথ্য ফাঁস করিয়া ফেলিল।
ভয়ে মানদার অন্তরাত্মা শুকাইয়া আসিল। শেষে কি এই বয়সে পুলিশে ধরিবে তাহাকে? শেষ জীবনেও কি তাহার নিস্তার নাই? ভাবিয়াছিল, এইখানেই সে দেহ রাখিবে। বোধ করি ইহাদের জ্বালায় সেও আর হইবার নহে। পলু, কলুকে চাপিয়া ধরিল মানদা। ‘তোরা কি শেষে আমায় জেলে ভরবি? কী সব শুনছি আমি? স্বদেশী করা লোকেদের এইখানে নিয়ে আসছিস! পুলিশ ঠিক টের পেয়ে যাবে একদিন আর সকলকে ধরে নিয়ে যাবে।’ মানদার উদ্বেগ দেখিয়া উহারা চিন্তিত হইয়া পড়িল। ভাবিয়াছিল মানদা টেরও পাইবে না। তাহাকে আশ্বস্ত করিয়া সেইদিন তাহারা বিদায় লইল। অবশেষে দুই দিন বাদে দুই ভাই যুক্তি করিয়া মানদার সম্মুখে উপস্থিত হইল। আখড়ায় বহিরাগত কেহ প্রবেশ করিবে না, এই সিদ্ধান্ত লইয়াছে ইহারা। মানদাও স্বস্তি পাইল। কয়েকদিন সত্য সত্যই বাহিরের কেহ আসিল না বটে, কিন্তু দুইদিন যাইতে না যাইতেই পুনরায় বহিরাগত কয়েকজন যুবা আশ্রমের সন্ধ্যারতির সময় প্রবেশ করিতে লাগিল। মা জগদ্ধাত্রীর সম্মুখে খোল কর্ত্তাল লইয়া কীর্তনের আসর বসাইয়া দিল উহারা। ইহাতে মানদা প্রীত হইল। অন্যান্যরাও সন্ধ্যারতির সময় কীর্তন শুনিবার টানে জমায়েত হইতে লাগিল। ভিড়ের ভিতর কয়েকখানি ছায়া কোথায় চলিয়াছে কাহারও নজর যাইল না। মানদাও সকল বুঝিয়া না বুঝিবার ভান করিয়া রইল এইবার। এই ক’দিনে মনে মনে সে অনেক ভাবিয়াছে। ইহারা ক্ষতি করিতেছে না কাহারও। দেশ কী, স্বাধীনতা কী সে এতকাল বুঝে নাই। এই স্থলে আসিয়া স্বাধীনতার অর্থ খানিক হইলেও বুঝিয়াছে। তাহার নিকট দেশ বলিতে এই আশ্রম। এই আশ্রমের ক্ষতি হউক সে যেমন চাহে না, তেমনি এই আশ্রমের বাড়বৃদ্ধি হইলে তাহার আনন্দ সবথেকে বেশি হইবে, ইহাতেও কোনো সন্দেহ নাই। কীর্তনের আসরের আড়ালে যদি উহারা নিজেদের পরিকল্পনা স্থির করিতে এই স্থলে বৈঠক করিয়া থাকে, তাহাতে দোষের কিছু নাই।
ইদানীং তাহার কাজের চাপ বাড়িয়াছে। স্বাভাবিক ভাবেই পুরানো স্মৃতি তাহাকে আর জ্বালায় না। উহাতে প্রলেপ পড়িয়াছে। পলুদের মুখে খবরাখবর পায়। কিছুদিন পূর্বেই সুবিমলবাবু স্বর্গে গিয়াছেন। তাঁহার স্ত্রীও অসুস্থ। তাজ্জবের ব্যাপার এই যে, বড় গিন্নীমা সুস্থ হইয়াছেন পূর্বের তুলনায়। মায়ের স্নেহমমতার ছোঁয়া পাইতেছে পলু, কলু এক্ষণও। পরম করুণাময় রহিয়াছেন ইহাদের জন্য। দুজনের একজনও বিবাহপাশে আবদ্ধ হইল না। উহারা থিয়েটারে নাম করিয়াছে, খ্যাতি, প্রতিপত্তি উহাদের মাথা ঘুরাইয়া দেয় নাই, ইহা আরও সুখকর সংবাদ। আর বেবো বর্তমানে নাকি মস্ত চাকুরে। তাহাকে হিল্লি, দিল্লি ছুটিয়া বেড়াইতে হয়। তাহার অন্যান্য ভ্রাতারাও মোটের উপর করিয়া খাইতেছে।
দিন যায় না, মাস যায়, মাস যায় না, বছর—এইভাবেই কাটিয়া যাইল আরও কয়েক বৎসর। সেইদিন সন্ধ্যারতি সবে শুরু হইয়াছে। আশ্রমের দোরে একখানি গাড়ি আসিয়া থামিল। দ্বারবান খবর দিল, একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি মানদার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহে। মানদার মুখ বেজার হইল। একটু যে ধর্ম কর্ম করিবে, তাহারও উপায় নাই! আপিস ঘরে আসিল সে। এক সৌম্য দর্শন, সদ্য যুবা যাহার পোশাক ও চেহারা দেখিয়া তাহার আভিজাত্য বোঝা যাইতেছে, আসিয়া দাঁড়াইল। মানদা তাহাকে বসিতে বলিয়া জিজ্ঞাসু নেত্রে তাহার মুখে দিকে তাকাইয়া রহিল। সেই যুবক তবু কিছু বলে না। মৃদু হাসি লইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। মানদার অসোয়াস্তি বাড়িতেছিল। কিঞ্চিত রুক্ষ স্বরে সে জানিতে চাহিল, ‘হ্যাঁ বলুন!’ এইবার সেই যুবা ছুটিয়া তাহার নিকট আসিয়া কহিল, ‘পিসী, তুমি আমাকে চিনতে পারলে না? আমি বেবো!’ বিস্ময়ে হতবাক মানদা কী করিবে বুঝিতে পারিল না। আড়াল হইতে বেবো তাহার নবপরিণীতা পত্নীকে লইয়া আসিল। উহাদের আদর, আহ্লাদ করিতে রাত বাড়িয়া যাইল। সে রাত্রে উহাদের নিজ হস্তে লুচি ভাজিয়া দিল মানদা। আশ্রমিকদের সকলের জন্যই সে রাত্রে ভোজের ব্যবস্থা হইয়া গেল। যাওয়ার আগে বেবো বলিল, ‘শোন পিসী, আর তোমাকে কাজ করতে হবে না। আমি আলাদা বাসা নিয়েছি। তুমি সেখানে থাকবে আমাদের মাথার ওপর।’ সেই ছোট্ট বেবো আজ মস্ত বড় হইয়াছে, তাহাকে লইয়া যাইতে চাহিতেছে, ইহার চাইতে বড় প্রাপ্তি বুঝি মানদার কিছু ছিল না ইহ জীবনে। আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়া মানদা বেবোকে কহিল, ‘শোন্, আজ আমার বড় আনন্দের দিন। তুই আমাকে নিয়ে যেতে এসেছিস! কিন্তু ভাই, আমি চলে গেলে এখানকার অনাথা মেয়েগুলোকে কে দেখবে বল? ওরা আবার ছন্নছাড়া হয়ে যাবে। বরং আমি এখানেই থাকি। তুই অবরে সবরে এসে দেখা করে যাবি।’ বেবো জানিত, মানদা পুনরায় অন্যের মুখাপেক্ষী হইবে না। সে মানদার এই সিদ্ধান্ত মাথা পাতিয়া মানিয়া লইল। এক বৎসরের মাথায় সে স্ত্রী ও সদ্যোজাত কন্যাকে লইয়া পুনরায় মানদার নিকট আসিল। ‘পিসী, তুমি আমাদের মেয়ের নাম রাখ, আর ওকে আশীর্বাদ কর।’ নিজের দেরাজ হইতে একটি ক্ষুদ্র বাক্স খুলিয়া মানদা একখানি সোনার বিছেহার বাহির করিল। এ তাহার তিলে তিলে জমানো উপার্জনে তৈয়ারী হইয়াছে। বেবোর সন্তানের জন্যই সে হারখানি বানাইয়াছিল। মেয়ের কণ্ঠে হারখানি রাখিয়া তাহার মস্তক চুম্বন করিয়া মানদা অশ্রুসজল চক্ষে, আবেগ রুদ্ধ কণ্ঠে কহিয়া উঠিল, ‘তুই আমার দেবী। দেবিকারানি। ওরে ও বেবো! এ তুই কী দেখালি আমায়! স্বয়ং মা জগদ্ধাত্রীর মুখ বসানো তোর মেয়ের মুখে। ওকে রক্ষা করিস মা!’
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী
~অতঃপর মানদাসুন্দরী দাসীর কাহিনী এইস্থানেই সমাপ্ত হইল~