মানদাসুন্দরী দাসী ও হাম্পটিডাম্পটি (দ্বিতীয় পর্ব) – তুষ্টি ভট্টাচার্য

পর্ব ১
পর্ব ৩
পর্ব ১
পর্ব ৩

-২-

না জানি মানদার বেবোর সহিত কত জন্মের সম্পর্ক! যার রেশ লাগিয়া রহিয়াছে এই জন্মেও। মাতৃস্নেহের বিড়ম্বিত ঝুলি হইতে কিঞ্চিৎ বেবোকে প্রদান করিয়া তৃপ্তি লাভ করে সে। আর বেবো সম্ভবত আপন মাতৃস্নেহ বঞ্চিত ছিল বলিয়াই বাল্য হইতে বোবা সাজিয়া থাকিত। তাহার মাতৃদেবী প্রসূতি কক্ষেই বেবোকে জন্মদান করিয়া ইহলোক ত্যাগ করিয়াছিলেন। তাহার দেখভালের লাগিয়া ধাত্রী, কাজের লোক ছিল বটে, কিন্তু মাতৃস্নেহের বিকল্প যেহেতু হয় না, তাই বেবো ও রসে বঞ্চিত রহিয়াছে। পরবর্তী কালে তাহার সৎ মায়ের আবির্ভাব হইয়াছে, সৎ ভ্রাতাভগিনীর অধিকার প্রকট হইয়াছে। এই কারণেই হয়ত মানদার নিকট সে বাল্যকাল হইতেই প্রশ্রয় পায়। মানদাই পাখির বুলি শিখাইয়া তাহাকে বক্তিয়ার খিলজি করিয়া তুলিয়াছে। ফলে হাম্পটি আর ডাম্পটির নামকরণ লইয়া মানদার কোনোরূপ আপত্তিতে বেবো কর্ণপাত করে নাই।     

   এই গৃহের অভ্যন্তরে জটিলা কুটিলা বেশ কিছু নারীর বাস, যাহারা গৃহের বাহিরের জগত সম্বন্ধে কোনোরূপ ধারণা রাখে না। স্বামী, পুত্রের অঙ্গুলিহিলনে যাহাদের জীবন টলমল করিতে থাকে, পদ্মপাতায় বিন্দু জলের ন্যায় উহাদের অস্তিত্ব, এই রহিয়াছে, তো এই বিলীন হইয়া যাইতে পারে। পুরুষ অভিভাবকদের নিকট উহারা দাসীর ন্যায় আজ্ঞাবহ হইয়া থাকে। কিছু অতিরিক্ত প্রসাদ লাভের হেতু পরিবারের নিকট ও অন্য সদস্যদের প্রতি মিথ্যা রটনা ও অতিরঞ্জিত বার্তা রটাইতে পিছপা হয় না। হয়ত দুই জায়া, দুই ভগিনী বা ননদিনী ও বৌমা হইয়া তাহারা নিজেদের ভিতর অত্যন্ত সখীসুলভ মনোভাব দেখাইয়া থাকে। পিঠ পিছে, নিজের স্বার্থসিদ্ধি করিতে উহারাই নিমেষে চরিত্র বদল করিয়া হিংস্র হইয়া ওঠে। উদার হইতে, মহীয়সী হইতে উহাদের বাসনা জাগে না কখনই। গৃহের পুরুষ চরিত্ররা দিব্যকান্তি, তেজে, বীর্যে বলীয়ান বলা যায়। বংশানুক্রমে ইহারা পুরোহিত। ফলে এই রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ বংশে পূজা, অর্চনা, বারব্রত, ইত্যাদি বৎসরের বেশিরভাগ সময়েই লাগিয়া থাকে। গৃহে যজমান প্রাপ্ত দুধ, ক্ষীর, ফলমূলাদি, মিষ্টান্নের অভাব নাই। ফলে এই গৃহে মানদার ন্যায় আশ্রিত ও আশ্রিতার সংখ্যা লইয়া কাহারও মাথাব্যথা নাই। ভিক্ষু বা অনাথ কেহই অভুক্ত ফেরে না এই গৃহ হইতে। মানদার এইরূপ অতিরিক্তের আহার সরবরাহের দায়িত্ব। অবশ্য সেই দায়িত্ব সে নিজেই চাহিয়া লহিয়াছিল কোনো এক সময়ে। উহাদের জন্য অবশ্য পরিবারের পুরুষ সদস্যদের তুলনায় কিঞ্চিৎ কম ওজনদার খাদ্য বরাদ্দ থাকে। পাকা, ওজনদার মৎস্য বা কচি পাঁঠার ঝোল ওই হতভাগ্য, বঞ্চিতদিগের জন্য নহে। মানদা কলা পাতায় উহাদের মোটা চালের ভাত, ডাল, শাকাদি ব্যঞ্জন বাড়িয়া দেয় যত্ন করিয়া। ক্ষুধার্ত মানুষগুলার তাহাই তৃপ্তি সহকারে চাটিয়া পুটিয়া খাইবার দৃশ্য দেখিতে দেখিতে মানদার বড় সুখ হয়। এতখানি তৃপ্তি বুঝি এই বংশের পুরুষদের গুরুভোজে থাকে না। বাবুদিগের ভোজন অর্থ তৈলাক্ত কেশে অতিরিক্ত তৈল প্রদান। আর ইহাদের ভোজন যেন চাতকের জল সেবন। ইহাদের এঁটো পাড়িয়া লইবার নির্দেশ দিয়া মানদা অন্দরে প্রবেশ করে। হাতমুখ ধুইয়া নিজের নিরামিষ খাদ্যে মন দেয়। তখন বেলা পড়িয়া আসে প্রায় দিনই। এক ঝি আছে, সে মানদার হাম্পটি ডাম্পটির জন্য মাছের কাঁটা জড় করিয়া ভাত মাখিয়া দেয়। অবশ্য ঝি এই কাজ বিনা পারিশ্রমিকে করে না। মানদাকে রোজই কলাটা, মূলোটা, উদ্বৃত্ত মিষ্টান্ন ঝিয়ের কোঁচরে আলগোছে ফেলিয়া দিতে হয়। বিলাইদ্বয় খানিক আগেই আহার সারিয়াছে। কিছু দূরে বসিয়া উহারা মানদার মতিগতি বুঝিবার চেষ্টা করিতেছে। মানদা গম্ভীর মুখে দাওয়ায় বসিল উহাদের দিকে পিছন ফিরিয়া। পাছে বিড়ালগুলিকে দেখিলে মায়ায় মন আছন্ন হয়, পাছে সে উহাদের কৃতকর্মের পাপ লঘু করিয়া দেখে! এইরূপ বসিয়া থাকিতে থাকিতে কখন যেন দুচোখের পাতা মুদিয়া আসিয়াছিল। শঙ্খধ্বনির শব্দে চটকা ভাঙিয়া মানদা দেখিল তাহার কোলের কাছে গুটিসুটি হইয়া উহারা অকাতরে নিদ্রা দিতেছে। বাঁধ ভাঙিয়া গেল মানদার। উহাদের মাথায় হাত বুলাইয়া দিয়া চটের বস্তা চাপাইয়া দিল উহাদের গায়ে। বড়ই মশার উৎপাত সন্ধ্যা হইলে। বাছারা ঘুমাইতে পারিবে না।

    সন্ধ্যাবাতি দেখাইতে গিয়া আজ আচম্বিতে প্রদীপের উষ্ণ তৈল চলকাইয়া মেঝেতে পড়িল। আর অতর্কিতে সেই তৈলে পা পড়িয়া পিছলাইয়া পড়িল মানদা। দাওয়ার খুঁটি ধরিয়া সে গায়ে হাতের চোট এড়াইতে পারিলেও পায়ে মোচ আসিল। মাগো বলিয়া অস্ফুটে চিৎকার করিয়া উঠিয়াছিল সে। বিড়ালদুটি তাহাকে ঘিরিয়া উথালপাতাল করিতেছে ততক্ষণে। ক্ষমতা থাকিলে উহারাই মানদাকে পাঁজাকোলা করিয়া তুলিয়া শুশ্রূষা করিত যেন! উহাদের ডাকেই হউক, অথবা কোনো কাজে এক ঝি মানদাকে পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া তুলিল। গিন্নীমার কাছে খবর চলিয়া গেছে ইহারই ভিতর। তিনি স্বয়ং দাঁড়াইয়া থাকিয়া চুন হলুদের প্রলেপ লাগাইতে আদেশ দিলেন আরেকজন ঝিকে। এইরূপ সেবা ও হল্লার মাঝে পড়িয়া মানদা বেজায় অপ্রস্তুত হইয়া পড়িল। তাহাকে ঘিরিয়া ধরিয়া মানুষজনের এত এত মনোযোগ, এত সংবেদনে সে নিজেকে অপরাধী বোধ করিতেছিল। যেন সে এক বেদম অন্যায় ঘটাইয়াছে এই সংসারে। এই অপরাধের দোষ কাটাইতে সে তক্ষুণি উঠিয়া পড়িতে উদ্যত হইল। কিন্তু পায়ের চোট বাদ সাধিল। উফ বলিয়া বসিয়া পড়িল আবারও। হাঁ হাঁ করিয়া উঠিল দুইজন। গিন্নীমার মুখে শুনিয়া আরও দুই সদস্যা তাহাকে দেখিতে আসিল। এইটুকু আদর পাইয়া আজ যেন মানদা নিজেকে নতুন করিয়া খুঁজিয়া পাইল। সে যে নিতান্তই অনাহুত নয়, সে যে একান্তই অবহেলায় পড়িয়া থাকা কোনো মানুষ নয়, সেই বোধ আজ তাহাকে তৃপ্তি দিতেছিল। গরম দুধ আর খই তাহার মুখের সম্মুখে ধরিয়া দিল একজন, আর তাহার আহার হইলে বাটি তুলিয়া লইয়া, তাহাকে শুয়াইয়া তবে সে যাইল।

  রাতে শুইয়া শুইয়া সে আকাশপাতাল ভাবিতেছিল যথারীতি। কে সে? নিজেকে কি চিনিতে পারিয়াছে কখনও মানদা? সে যে এক পৃথক অস্তিত্ব, এক মানবী আত্মা, এই বোধ তাহার হইলেও, সেই প্রমাণ আজ পর্যন্ত পায় নাই। আজ পায়ের চোটের ব্যথা, যন্ত্রণা সেই প্রমাণ ছাড়িয়া যাইল যেন। তাহাও এই বয়সে আসিয়া। মার্জার দুটিও যেন আজ তাহাকে আদর দেখাইতে বদ্ধপরিকর। বিছানায় উঠিয়া উহারা পা চাটিয়া দিতে থাকিল। আরামে চোখ বুজিয়া আসিতেছিল মানদার। তন্দ্রার ভিতরে কে যেন তাহার নাম ধরিয়া ডাকিতেছিল ক্ষীণ স্বরে। চোখ মেলিয়া তাকাইল সে। প্রদীপের পলতে স্তিমিত করিয়া রাখিয়াছে ঝি। সেই মৃদু আলোয় অন্ধকারে দ্বারের দিকে চোখ মেলিল মানদা। ভেজানো দরোজার আড়ালে কারুর ছায়া! যথাসম্ভব নিজেকে গুছাইয়া উঠিয়া বসিল সে। ঘুম আর দ্বিধা মিশ্রিত কণ্ঠে কোনোক্রমে বলিল—কে? দরোজার ওপার হইতে সাড়া আসিল—আমি! এই সেই জলদগম্ভীর স্বর, যাহা এককালে তাহার নীরব হৃদয়কে উথালপাতাল করিয়া তুলিত। আজিও বুঝি সেই উথাল ঢেউয়ের ভ্রম লাগিয়া আছে বুকের ভিতর। অনুরণনে তারই লেশ টের পাইল এক্ষণ বুঝি বা! ঘোমটা কপাল পর্যন্ত টানিয়া দরোজার আড়াল হইতে মানদা প্রত্যুত্তরে বলিল—রাত হয়েছে। আপনি এখন আসুন কর্তা মশাই। আমার তেমন কিছুই হয়নি। পায়ে সামান্য চোট। এই সব মামুলি কারণে এই ঘরের দরজায়, এতরাতে আপনাকে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে অনর্থ হবে। এ বাড়িতে আমার বাস উঠে যাবে। এই বয়সে না জানি কোথায় ঠাঁই পাব আবার…তাহার কথা শেষ হইবার পূর্বেই পায়ের শব্দ তড়িৎ গতিতে দূরে সরিয়া যাইল। মানদাও হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। জানালার নিকট আসিয়া দূরে চোখ মেলিয়া ধরিল। কয়েকগাছি জোনাকির ইতিউতি ওড়া আর ঝিঁঝিঁর বিভ্রম ব্যতীত আর কিছুই নাই। যেন অতীত ঘুমাইয়া পড়িয়াছে দূরের ওই ঝোপঝাড়ের ভিতর। প্রত্যূষে শিশিরে স্নাত হইয়া জাগিয়া উঠিবে! ওই শিয়ালকাঁটা আর ওই শেফালী, যেন আলিঙ্গনরত অবস্থায় ক্রন্দন করিতেছে এইক্ষণে। উহাদের অস্ফুট বক্তব্যে কাহারও দৃকপাত নাই। উহাদের আচরণ কেবলই মানদার পর্যবেক্ষণ হেতু পড়িয়া রহিয়াছে। (ক্রমশ)

পর্ব ১
পর্ব ৩
পর্ব ১
পর্ব ৩

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী