-৩-
সুবিমলবাবু দ্রুত পায়ে ফিরিয়া আসিতে আসিতে ভাবিতেছিলেন, কেহ কি দেখিয়া ফেলিয়াছে? অত্যন্ত নির্বুদ্ধিতার কর্ম করিয়া ফেলিয়াছেন ঝোঁকের বশে। এই বয়সে এ হেন অভিসার কি মানায়? অভিসারের কথা মনে আসিতেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলিয়া গেল তাঁহার। সে এক সময় ছিল বটে! যৌবনে মানুষ না জানি এহেন কত কত অভিসার আর ব্যাভিচারে নিবৃত্ত হয়। সেও তাহার ব্যতিক্রম নহে। এ জীবনে নারী শরীর লইয়া ছিনিমিনি খেলিতে খেলিতে একসময় তাহার বিরক্তি উদ্রেক হইয়াছিল। একে বংশগত ভাবে তিনি সুপুরুষ, তায় অঢেল বিত্তের অধিকারী, ফলে ভাত ছড়াইলে কাকের অভাব হয় নাই। অবশ্যই সেই নারীরা যে সবাই কুলশীলা, তাহা নহে। বারবধূ অথবা অনাথা, আশ্রিতা, বাল্যবিধবা—যাহাদের মিষ্ট বাক্যে ভুলাইয়া, কিঞ্চিৎ মুদ্রার ঝনৎকার শুনাইয়া ও আশ্বাস দিয়া তিনি কার্যহাসিল করিয়াছিলেন। এবং প্রায় সকলকেই কার্যকারণ মিটিলে ত্যাগ করিয়াছিলেন অবলীলায়। তিনি এই বংশের পুরুষ সিংহ। স্বর্ণ অঙ্গুরির গাত্রে টোল পড়িলেও তাহার মূল্য কিছুমাত্র কমে না! কিন্তু এই মানদাকে সম্পূর্ণরূপে বশে আনিতে সক্ষম হন নাই। ক্রোধে তাহাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত লইয়াছিলেন একদা। পরিবারের অন্য সদস্যদের দয়ায় এবং বেবোর কান্নায় মানদা রহিয়া গিয়াছে। এই বেবো তাহার চক্ষুশূল। প্রথম পুত্রের প্রতি গোপন স্নেহ অনুভব করিলেও বর্তমান পত্নীর তাড়নায় তাহা প্রকাশ করিতে সক্ষম হন নাই। এই মানদাই উহাকে প্রতিপালন করিতেছে একরূপ। স্বাভাবিক ভাবেই দীর্ঘনিঃশ্বাস হেতু ক্রোধের মাত্রা কমিলে, তিনি মানদাকে লুকাইয়া দেখিতেন মাঝেমাঝে। সদা কুণ্ঠিত এক নারী, তায় বিধবা, আশ্রিতা, পরিচারিকাই বলা শ্রেয়, যাহার মধ্যে এই সংসারের জাঁতাকলে পিষিয়া, নিংড়াইয়া, ডলিয়া, মথিয়া আর কোনোরূপ রসের সন্ধান পাওয়ার আশা করাই বাতুলতা হইতে পারিত, অথচ সেইরূপ বিবেচনা বিধাতার মনে স্থান পায় নাই। কণামাত্র আহার, বিশ্রামেও মানদার লাবণ্য অটুট রহিয়াছে। সর্বোপরি উহার ভিতর কী যেন রহিয়াছে, যাহাতে এক অচেনা বিস্ময় জাগে, কিঞ্চিৎ সম্ভ্রমবোধ আসে। উহার সহিত দূরত্ব বজায় রাখিবার এও এক হেতু বটে। তাহার চুলের ভার কয়দিন অন্তর অন্তরই কর্তিত করিতে হয়। কখনও দেখা যায়, লকলকে সাপের উদ্যত ফণার ন্যয় চুলের ভার গিট্টু দিয়া বাঁধিয়া রাখিয়াছে সে।
এই কেশরাজি দেখিয়াই নাকি সুবিমলবাবুর নেশা হয়! মানদা এই কথা জানিয়াছিল একদা! জানিয়াছিল বলা ভুল হইল, স্বয়ং সুবিমলবাবুর মুখনিঃসৃত মধুর কোমল বাক্য নিজ কর্ণে শুনিয়াছিল একদা। মানদা তখন হাঁসেদের পুকুর হইতে লইয়া আসিতেছিল। তড়িঘড়ি পুকুর ঘাট হইতে এক দৌড়ে নিজের ঘরে খিল লাগাইয়া দিয়াছিল সে। হাঁসগুলি সেই ভরসন্ধ্যাবেলায় নিজেদের বাসস্থান খুঁজিয়া না পাইয়া, ভারী আশ্চর্য হইয়া প্যাঁকপ্যাঁক করিয়া বাড়ি মাথায় তুলিয়াছিল। মদনদাদা ব্যস্ত হইয়া যাইতেছিল, সেও অতীব পুরাতনকাল হইতে, অর্থাৎ উহার বাল্যকাল হইতে এই গৃহে ফাইফরমাশ খাটে। মানদাকে স্নেহ করে কিছু। ভাবিল, হয়ত মানদা অন্য কর্মে বিধ্বস্ত হইতেছে, তাই হাঁসগুলি অনাথের মতো ঘুরিতেছে। উহাদের জালের ঘরে দোর আঁটিয়া মদনদা চলিয়া গেলে মানদা ঘর হইতে বাহির হইল। দোরের আড়াল হইতে উহাদের নড়াচড়ার ক্ষীণ শব্দ আসিতেছে। কিছুক্ষণ বাদে তাহাও আসিবে না। নিশ্চিত ঘুমের আশ্রয়ে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বন্দি থাকিতে হয়ত উহাদের আরাম বোধ হয়। হয়ত ইহাই অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে উহাদের। স্বাধীনতার খেসারত থাকে। আহার, নিদ্রার সুবন্দোবস্ত থাকিতে হয়। তবেই না স্বাধীন জীবন উপভোগ করিতে পারিবে! আজ তাহার নিজ সংসার রহিল না, মাতাপিতা সংস্থান বা পুঁজি তাহার নামে রাখিয়া যান নাই। জীবন তো আর খোলামকুচি নহে, যে ইচ্ছা করিলেই বিসর্জন দেওয়া যায়! পেট থাকিলেই ক্ষুধা লাগে, তৃষ্ণা জাগে। মাথার উপর একফালি ছাদের তলে নিজস্ব একখানি শয়নের বাসস্থান লাগে। এই সব সে পাইত কোথায়? অগত্যা এই পরাধীন, আশ্রিতার জীবন সে বাধ্য হইয়া বহন করিতেছে। সুবিমলবাবুর মতো ক্ষীরলোভী পিঁপড়াদেরও তাড়াইতে হইবে আবার এমন রূপে তাড়াইতে হইবে যেন নিজেকে আশ্রয় হইতে উৎখাত হইতে না হয়। দুমুখী সঙ্কটের মোকাবিলা করিতে করিতে মানদাও বর্তমানে প্রস্তরের ন্যয় কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। ওই মেনিগুলি আছে বলিয়াই সে নিজেকে ফিরে ফিরে পায়।
মেনিগুলির কথা মনে আসিতেই মানদার ঝাঁট জ্বলিয়া গেল। পোড়ারমুখী হাম্পটি পেট বাঁধাইয়াছে। এবার বুঝিবে কত ধানে কত চাল! হুলোর আর কিবা দিন কিবা রাত্রি! সে নির্ভার! কাজ সারিয়া বেপাড়ার হুলো সরিয়া পড়িয়াছে। পাঁচিলের উপর বসিয়া এই দিকে তাকাইয়া রহিয়াছে এক চোখ খুলিয়া। ছদ্ম ধার্মিকের ন্যয় হাবভাব উহার। কৌপিন আর কমন্ডুল ধরাইয়া দিলেই সাধু সাজিবে যেন! যত সমস্যার সম্মুখীন মেয়েদেরই হইতে হয় কেন প্রভু? কেন উহাদের পেট দিয়াছ? পুরুষের পেট হইলে তখন বুঝিত ভোগলালসার ফল কিরূপ মধুর! মানদা আচম্বিতে নিজ উদরে করতল স্থাপন করে। এক ফুঁয়ে দীপের আলো নিভিয়া গিয়াছে যেন—উহার মুখ দেখিয়া এইরূপই মনে হইতে পারিত বটে। তবে ওই মুহূর্তটুকুর স্থায়ীত্ব এতই স্বল্প যে, কাহারও সেদিকে দৃকপাত হইবে না। বস্তুত মানদা পেটে হাত রাখে নাই, বরং খামচাইয়া ধরিয়াছে মাংসপেশি। তাহার দীর্ঘদিনের সঙ্গী পুনরায় যাতনা দিতেছে। অম্লশূলের ব্যথা তাহাকে প্রায়শই পীড়া দেয়। দীর্ঘ বৎসরের অনিয়ম ও উপবাসের ফল ইহা। পেট বলিতে মানদা বর্তমানে সন্তানহীনতার দুঃখে কাতর হয় না, বরং আতঙ্কে থাকে, কখন উহার ব্যথা চাগিয়া ওঠে! একদিকে মানদা পেটের ব্যথায় গলদঘর্ম হইতে লাগিল, অন্যদিকে হাম্পটি ভারি পেট লইয়া হাঁসফাঁশ করিতে থাকিল।
খর দুপুর ক্রমশ নিস্তেজ হইয়া আসিতেছিল। এক মুঠি ভাতে জল ঢালিয়া, চটকাইয়া কোনোক্রমে গিলিয়াছিল মানদা। উহাই তাহার উপশম, সে জানে। ব্যথার তীব্রতা কমিয়া আসিয়াছে, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও এই দুপুরের সহিত স্থিমিত হইয়া আসিয়াছে মানদার। চক্ষু বুজিয়া আসিয়াছিল আপনা হইতেই। আঁখিপল্লব খুলিয়া সে প্রথমে ঠাওর করিতে পারিল না, এক্ষণ বিকাল না রাত কাটিয়া ভোর হইয়াছে। তাহার ঘরের জানালা বন্ধ, দরোজাও ভেজানো রহিয়াছে। আলো আসিতেছে জানালার দুই পাল্লার ফাঁক দিয়া। বাহির হইতে মানুষের কণ্ঠস্বর কানে আসিল। সে ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল বিছানায়। আধো অন্ধকারে চক্ষু মেলিয়া দেখিল, হাম্পটি এক্ষণও নিদ্রা দিতেছে। উহাকে ডাক দিল মানদা। জানালার পাল্লা খুলিয়া দেখিল, পুকুর হইতে বাসনের পাঁজা লইয়া ঘরে ফিরিতেছে ঝি। হাঁসেদের তীব্র প্যাঁকপ্যাঁক কানে আসিল। কাপড়ের খুঁট মাথায় তুলিয়া মানদা চলিল ঘাটের দিকে। হাঁসাহাঁসি গুলা অস্থির হইয়া পড়িয়াছে উহার অদর্শনে। হাম্পটি উহার পিছু লইল। ডাম্পটিও ঘাপটি মারিয়া ছিল কাছাকাছি বোধকরি। পিছু পিছু চলিল সেও। সে অবোধ বালক এখনোপর্যন্ত পুরুষ হয় নাই। তাহার যত ক্রীড়া হাম্পটির সহিত, যত প্রেম-অপ্রেম সকলই হাম্পটির সহিত। তাহারা হরিহর আত্মার ন্যয় থাকিত। এখনও থাকিতে চায়। হাম্পটি অত সাড়া দেয় না আজিকাল। সে নিজ শরীরের আইঢাই লইয়া ব্যতিব্যস্ত। ফলে ডাম্পটি বেচারা একাকিত্বের ভারে ম্রিয়মাণ। তাহাকে হাম্পটি দূরে সরাইয়া দিয়াছে। এই অপ্রেম পূর্বের ন্যয় নহে, এই দুঃখ সহ্য করিবার সহনশীলতা কিশোর ডাম্পটির আসে নাই। দিনদিন সে বড়ই উদাসীন হইয়া যাইতেছে। যেন সন্ন্যাস লইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে কোনো বিরহী। উহাকে দেখিয়া মানদার বড় বেদনা বোধ হয়। উহাকে মাছের মুড়ো, অতিরিক্ত দুগ্ধ প্রদান করিয়া খুশি রাখিতে চেষ্টা করে সে। (ক্রমশ)
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী