মানদাসুন্দরী দাসী ও হাম্পটিডাম্পটি (চতুর্থ পর্ব) – তুষ্টি ভট্টাচার্য

পর্ব ৩
পর্ব ৫
পর্ব ৩
পর্ব ৫

-৪-

রাতে পুনরায় এক সঙ্কটে পড়িল মানদা। মেনির সময় হইয়া আসিয়াছে বুঝিয়া, সে মানদাকে ক্রমাগত পায়ে পায়ে জড়াইয়া উহাকে কিছু বলিতে চাহিতেছে। সন্তান জন্মানো এ পরিবারে নতুন কিছু নয়, কিন্তু ঐ সময়ে, অর্থাৎ প্রসবকালীন সময়ে মানদাকে কেহ ডাকিত না। নিতান্ত অনভিজ্ঞ বলিয়াই হয়ত। ফলে এই বিষয়ে সে কিঞ্চিৎ কাঁচাই বটে। বিড়ালের ছানা দেওয়াও কি আর নতুন কিছু ঘটনা এ সংসারে? মা ষষ্ঠীর বাহন তাহারা কত কত বাচ্চা পাড়িয়া থাকে। তাহা লইয়া কেহ উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছে বলিয়া জানা নাই। মেনিকে এইরূপ ছটফট করিতে দেখিয়া মানদা আতান্তরে পড়িয়া যায়। ঝিকে ডাকিয়া লইয়া আসে মেনির নিকট। ঝিয়ের মুখঝামটা সহ্য করিয়াও সে কী করণীয় জানিয়া লয়। একখানি ফলের পরিত্যক্ত পেটিকা সেই ঝি বেটিই জোগাইয়া দেয় তাহাকে। চোখে জল আসে আচম্বিতে উহার এইটুকু বদান্যতায়। ওই পেটিকার ভিতর বিচালি বিছাইয়া ন্যাকড়াকানি পাতিয়া উহার উপর মেনিকে শোয়াইয়া দেয় মানদা। মেনি আশ্বস্ত হইয়াছে এতক্ষণে। কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে মানদার দিকে চাহিয়া থাকে সে। যদিও সারা রাত সে যন্ত্রণায় কষ্ট পাইতে পাইতে ভোররাতে প্রসব করে। সেই রাত মানদাও দু চোখের পাতা এক করে নাই। মেনির চিৎকারে সেও ক্রন্দন করিয়া উঠিয়াছে। তাহার আশঙ্কা—এই বুঝি মেনির প্রাণহানি হইল!
এইরূপ আশঙ্কার ভিতরেও কখন যেন দুচোখ বুজিয়া আসিয়াছিল মানদার। চোখ মেলিয়া দেখিল আলো ফুটিয়া গিয়াছে। আর পেটিকার ভিতরে মেনি নাই। বরং এক ক্ষুদ্র, ক্ষীণকায়া মার্জারের আদল পড়িয়া রহিয়াছে। মৃত! সাদা লোমের ভিতর হইতে কালো ছোপ উঁকি দিতেছে ওই মৃত অবয়বের গাত্রে। কিন্তু মেনি কই? চারিদিকে দৃষ্টি বুলাইয়া উহার ছায়াও দেখিতে পাওয়া যাইল না। অবশেষে অনেক অনুসন্ধানের পরে মেনিকে বাচ্চা সহ মিলিল এক পরিত্যক্ত লোহার পেটিকার অন্দরে। সদ্য মা হওয়ার অভিঘাতে সে ঝিমাইতেছিল। আর কালো লোমের, তাহারই আদলের বাচ্চাটি মায়ের বক্ষ চুষিয়া খাইতেছিল। এ কি অপার্থিব দৃশ্য কোনো? নাকি নিতান্তই সাধারণ এক দলিল? যাহাকে না লিখিলেও চলিত বিধাতার। এইসব ভাবনার ভিতরে কিছুক্ষণ পা চালাইয়া মানদা স্বমূর্তিতে ফিরিয়া আসিল। কালক্ষেপ না করিয়া মা ও বাচ্চাটিকে লইয়া চলিল নিজ কক্ষে। মেনি নিজ সন্তানের সুরক্ষা হেতু মানদাকেও সম্মুখে ঘেঁষিতে দেয় নাই প্রাথমিক ভাবে। দাঁত মুখ খিঁচিয়া হিংস্রতা প্রকাশ করিতেছিল। অনেক বাবাবাছা, সাধ্যসাধনার পরে সে মানিয়াছে। না মানিয়া উহার উপায়ই বা কী? মেনি জানে উহার অবলম্বন বলিতে এই মানদাই। ইতিমধ্যে মানদা মৃত শাবকটিকে পুকুরের ধারে মাটি চাপা দিয়াছে। ঘরের এক কোণে বিচালি পাতিয়া, প্রক্ষলিত কাপড়ের নতুন বিছানা করিয়া উহাদের শয়ন করাইয়াছে। সবকিছু দেখিয়া শুনিয়া ঝি এক বাটি উষ্ণ দুধ লইয়া হাজির। কৃতজ্ঞতায় মানদার অন্তর সিক্ত হইল। মৃদু হাসিয়া মেনিকে উহা পান করাইল সে। কৃতজ্ঞতায় নাকি ধকলে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মেনিরও চক্ষু হইতে জল ঝরিয়া পড়িতেছিল। বাচ্চা লইয়া সে নিজ বিছানায় শুইয়া তৎক্ষণাৎ নিদ্রার দেশে চলিয়া যাইল।
সারাদিনের কাজের ভিতরেও মানদা বার কয়েক উঁকি দিয়া যাইতেছিল ঘরে। ঘরের কপাটে শিকল তুলিয়া দিয়াছিল সে। হুলোর আক্রমণের ভয়ে। বৈকালে মেনিকে কিঞ্চিৎ সুস্থ মনে হইল। ঘর হইতে বাহির হইল সে কয়েকবার। খাইল গোগ্রাসে। পুনরায় সন্তানের নিকট চলিয়া যাইল দ্রুততার সহিত। মানদার নজর এড়ায় নাই—ইতিমধ্যেই মেনি নিজের রক্তস্রাব চাটিয়া মুছিয়া পরিচ্ছন্ন করিয়া তুলিয়াছে নিজেকে। ল্যাজ তুলিয়া চলিতেছে ধীরে ধীরে। তাহার বিস্ফারিত যোনিদ্বার স্পষ্ট হইয়া আছে স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী। রাত্রে শুইয়া মেনিকে দেখিতে দেখিতে মানদা ভাবিতেছিল, মা হইলে শরীরের ধকল যায় বড়। জঠরের ভিতরের ফাঁকা অংশটি বড় বেশি খাই খাই করিতে থাকে। যদিও এ হেন অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করে নাই সে। তবুও জানিয়াছে। সন্তান স্নেহের রূপ জানে নাই তত। মাতৃরূপে তাহাকে কেমন দেখাইত—ভাবনা মাত্রই মানদা হাসিয়া ফেলিল। তাহার আঁচল টানিয়া বায়না ধরিয়াছে এক শিশু, আর সে তাহাকে ছদ্ম ক্রোধে প্রহারে উদ্যত! ভাবিতে গেলেই হাসির উদ্রেক হয়। এইরূপ চপল, লঘু আচরণ যেন তাহার চরিত্রের সহিত ঠিক খাপ খায় না। মানদাকে ওই রূপে কোনোক্রমেই মানাইত না, ইহা বিধাতাও বোধকরি আন্দাজ করিয়াছিলেন। আর তাই তাহার ক্রোড়ে শিশু খেলা করিল না। তাহার স্তনযুগল দুগ্ধের ভারে আনত হইল না। তাহার স্ফীত জঠর দেখিয়া কেহ আন্দাজ করিল না যে, ওই স্থান হইতে পুত্র নাকি কন্যা জন্মিবে।
তথাপি মানদা কুমারী নহে। শ্রী শ্রী বৈদূর্যকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধবা সে। স্বামীর নাম মনে মনে উচ্চারণ করিলে পাপ হয় কি? অন্তর হইতে মানদা এইরূপ পাপপূণ্যে বিশ্বাসী নহে। নিষ্ঠাভরে একাদশী পালনের সময়ে তাহার ক্ষুধা জাগে না, খাদ্যের প্রতি আসক্তিও জাগে না। এইসকলই দীর্ঘ অভ্যাসের ফল। যদ্যপি মৃত স্বামীর প্রতি অতিরিক্ত ভক্তি তাহার অবিচল নাই আর। জীবিত অবস্থাতেও অন্তর হইতে স্বামীর উপর খুব যে টান ছিল অথবা শ্রদ্ধার স্থান অটুট ছিল, এমনও নহে। মুখ ফুটিয়া প্রকাশ করিত না, এই যা। ইহার পিছনে কারণ অবশ্য বিলক্ষণ ছিল। বারোর মানদাকে বিবাহ করিয়াছিল ষাটোর্ধ্ব বৈদূর্য। মানদার আগে তাহার দুই পত্নী ছিল। তাহার ভগবানের কৃপা লাভ করিয়াছে মৃত সন্তান প্রসবের সময়ে। ফলে বৈদূর্যের বংশ রক্ষার্থে মানদাকে লইয়া আসিয়াছিল তাহার বৃদ্ধ পিসিমা। সে বুড়ি মন্দ ছিল না বটে। মানদাকে স্নেহের চক্ষেই দেখিত। বৈদূর্যের সহিত বিছানায় পাঠাইবার রাতে মানদাকে সে অনেক উপদেশ, নির্দেশ দান করিয়াছিল স্বামী সেবার পাঠ হিসাবে। এই বিরাট অন্ধকূপের ন্যয় পতিগৃহটিকে মানদার প্রথম হইতেই পছন্দ হয় নাই। তাহার দম বন্ধ হইয়া আসিত। সূর্যের আলো প্রবেশ করে না দিনমানে, এমন এক জরাজীর্ণ, বল্মীকের বাসাপূর্ণ গৃহটিকে তাহার কয়েদখানার মতো লাগিত। আর পিতৃস্থানীয় স্বামীকে দেখিলেই তাহার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হইবার উপক্রম হইত। মাতুলগৃহে মানদার বিধবা মা, কন্যাসহ আশ্রিতা হইয়া জীবন কাটাইতেছিল। লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সে স্থানেও ছিল বটে, তথাপি মায়ের স্পর্শ ছিল, ছিল পরিবারের ছায়া।
মানদার শুষ্ক চক্ষে আর জল আসে না। আজ বিছানাও শূন্য ঠেকিতেছে। মেনি নিজস্ব বিছানা পাইয়াছে। ঘরও কি পায় নাই সে? নিজ সন্তান লইয়া সে সুখে নিদ্রারত। মানদাকে এক্ষণে তাহার প্রয়োজন নাই। ক্ষুধার উদ্রেক হইলে মানদাকে উহার মনে আসিবে। হায় রে সংসার! সকল জীবকুল শুধুই নিজেরটুকু গুছাইয়া বাগাইয়া লইতে জানিল। জানিল না কেবল এই পোড়ারমুখী মানদা! দীর্ঘশ্বাস চাপিয়া মানদা স্বগতোক্তি করিল—তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকে, এ তোর কেমন বিলাপ বাপু? নিজেকে ঘনঘন বদলাইলে তো চলে না জীবনের। যাহার জীবন যেরূপ খাতে চলে, চলিতে দাও। (ক্রমশ)

পর্ব ৩
পর্ব ৫
পর্ব ৩
পর্ব ৫

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী