মানদাসুন্দরী দাসী ও হাম্পটিডাম্পটি (পঞ্চম পর্ব) – তুষ্টি ভট্টাচার্য

পর্ব ৪
পর্ব ৬
পর্ব ৪
পর্ব ৬

-৫-

  আজিকে সংসারের নানাবিধ কর্মের ভিতরে দিনের দ্বিতীয় প্রহর কাটিয়া যাইল। নিত্যনৈমিত্তিক এই দিনযাপন মানদার। শুধু আজিকের দিনটা কিঞ্চিৎ অন্যরূপ হইল সুবিমলবাবুর অছিলায়। তাঁহাদের আহার সমাপন হইয়াছে, দিবানিদ্রার তোড়জোড় শুরু হইয়াছে ঘরে ঘরে। তথাপি সুবিমলবাবুর কক্ষ হইতে কলহপূর্ণ চিৎকার কানে আসিল। চাকরবাকরেরা উৎসুক হইয়া কান পাতিল যথারীতি। মানদার কর্ণেও আসিয়াছিল উচ্চ চিৎকার। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। ক্ষুধার উদ্রেক হওয়ায় সে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া আপনার আলো চালের ভাত লইয়া বসিল। এক পলা দুধ তাহার বরাদ্দ। খানিক নিরামিষ ব্যঞ্জন এক চিমটি লবণ ভাতের সহিত মাখিতে মাখিতে মানদা ভাবিতেছিল সুবিমলবাবুর কথাই। এমন কী হইল যে এই অসময়ে উহারা তারস্বরে ঝগড়া করিতেছে! সাধারণত মধ্যরাত্রে মদ্যপ অবস্থায় কক্ষে ঢুকিলে এইসবের পালা শুরু হয়। খাওয়ার শেষভাগে দুধটুকু সে একমুঠো চিনির সহিত ভাতে মাখিয়া লয়। মিষ্টি পছন্দ তাহার। ক্বচিৎ মিষ্টান্ন, পরমান্ন বা মিঠাই তাহারও জুটিয়া যায় এই গৃহে। সেইদিন তাহার বড় পুলক জাগে। ছুটিয়া বেড়াইতে মন চায় বালিকার ন্যয়। যদিও তাহা সম্ভব হয় না বলিয়া সে হাঁসাহাঁসিগুলিকে অকারণ তাড়া দেয়, আর তাহাদের পিছে পিছে ছুটিতে থাকে। বেশিরভাগ দিনে এই চিনিই তাহার মিষ্টিমুখ করায়। এঁটো পাড়িয়া সে নিজ কক্ষে আসিয়া হাম্পটি ডাম্পটির সহিত সময় কাটাইতে লাগিল। এই সময়ে হঠাৎই তাহার সংসারের কথা মনে আসিল।

বৈদূর্যবাবুর সহিত বিবাহ হইবার সময়ে সে সদ্য রজস্বলা হইয়াছিল। মাসিকের দিনগুলায় পেটে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাইত। স্বামী হইয়াছে যেহেতু, স্ত্রীর শরীরের উপর তাহার অধিকার তো রহিয়াছেই। ফলে এই রকম দিনেও তাহাকে রেহাই দিত না স্বামী নামক অসুরটি। যদিও তাহার লীলাখেলার সাধ্য ছিল না, সাধ ছিল বেশী। দু পাঁচ মিনিটে বাদেই সে উপুড় হইয়া নিদ্রা যাইত। ক্রমে মানদারও শরীরে জোয়ার আসিল। শরীরের উত্তাপ পাইতে তাহারও সাধ হইত। একেক সময়ে স্বামীকেই সে ডাকিত স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া। স্বামী সাড়া দিলেও সে ছিল ক্ষণিকের। ধরিয়া রাখিবার ক্ষমতা তাহার ছিল না। অভুক্ত শরীরের জ্বালা জুড়াইতে মানদা বালতি বালতি জল ঢালিত গায়ে। সে বুঝিয়াছিল, এই লোকের সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা নাই আর। সে কোনোদিনই মা হইতে পারিবে না। মা হওয়া তো দূর, তাহার যৌবন জ্বালা দূর করিতেও ওই লোক অক্ষম। তথাপি সে স্বামী। তাহার নামে সে মাথায় সিন্দুর দেয়। পিসশাশুড়ি উহাকে নানাবিধ প্রশ্ন করিতে থাকে মধ্যে মধ্যেই। এড়াইয়া যায় মানদা। সে বোঝে, সংসার অভিজ্ঞ এই মহিলা তাহার ভিতরকার কথা পড়িয়া ফেলিয়াছে। একদিন তাহাকে মাথায় হাত বুলাইয়া তাহার খোঁপা বাঁধিয়া দিতে দিতে পিসি বলিয়াছিলেন, “শোন্‌ মুখপুড়ি! স্বামীসুখ তুই পাবি না, এ আমি জানতুম। এই কচি বয়সের মেয়েকে কি আদদামড়া লোক মানাতে পারে? বাচ্চাকাচ্চাও হবে কিনা কে জানে! ঘাটের মড়া বেঁচে থাক তবুও। নইলে বিধবা হওয়ার যন্ত্রণা তুই সইতে পারবি না”।    

  তাহার পিসশাশুড়ির বাক্যে যে ঈশ্বর কর্ণপাত করেন নাই, তাহার প্রমাণ দিবার জন্যই বোধকরি তড়িঘড়ি বৈদূর্যবাবুকে পরপারে চলিয়া যাইতে হইল। তিনদিনের নোটিশে সান্নিপাতিকে তাহার প্রাণবায়ু শুষিয়া লইলেন উপরওয়ালা। তাঁহাকে তো আর শাপমন্দ করার উপায় নাই, করিতে পারিলে না জানি কত অযুত সহস্র মানবের সেই সব আকথা, কুকথার ভার তিনি কী রূপে বহন করিতেন! ফলে খানিক ক্রন্দন আর খানিক ভীতি লইয়া মানদা বিধবা হইল। পিসশাশুড়ির সহিত তাহার শয়নের ব্যবস্থা হইল অতঃপর। তাহার ঘর, তাহার পালঙ্ক, বিছানায় ভাগ বসাইল অন্য কেহ। এ বাড়ির রীতি এই, কেহ বিধবা হইলে তাহার নাকি নিজস্ব ঘরে, নিজস্ব বিছানায় ঠাঁই হয় না। বিধবা অতশত লইয়া কী করিবে? তাহার এক্ষণে ধর্মকর্মে মন দিবার সময়। নির্জলা উপবাস, অম্বুবাচি, কয়েকখানি শুকনা ফল, নাম মাত্র দুগ্ধ আর আলো চাউলের জাউ—এই তাহার বরাদ্দ। সত্যি বলিতে কী, মানদা কেশ কর্তনের বেদনায় যতখানি ম্লান হইয়াছিল, নিরামিষ ভোজনে ততখানি হয় নাই। মাতুলকুলে বিধবা মায়ের সহিত সেও নিরামিষ আহারে অভ্যস্ত হইয়াছিল। মাছের গন্ধ তাহার পছন্দের ছিল না। প্রথমদিনে পুকুর ঘাটে নিজের মুণ্ডিত মস্তক শোভিত পানসে মুখখানি দেখিয়া তাহার নিজেরই ডাক ছাড়িয়া কাঁদিতে সাধ হইয়াছিল। অশ্রু সম্বরণের চেষ্টাও সে করে নাই। যুবতী সদ্য বিধবার কান্না দেখিয়া ঘাটের অপর মহিলারা তাহাকে সান্ত্বনা দিতে আসিল। তাহার ভাবিতেছিল এ শোক বুঝি স্বামীর কারণে। যাহা হউক, পিসশাশুড়ির সহিত তাহার সখ্য বৃদ্ধি হইল। মোটের উপর সে ভালোই ছিল কয়েক বৎসর। কিন্তু সময় সকলকেই ডাকিয়া লয়। পিসিকেও লইয়া যাইল যমদূত। এই প্রথম শোকে উপুড় হইয়া মানদা কাঁদিল। মায়ের মৃত্যুর পর এই বেদনা তাহার আবার বাজিল। মনের দুইটা কথা বলারও আর সঙ্গী রহিল না তাহার। ভিতর ভিতর গুমরাইতে গুমরাইতে সে ক্রমশ নিশ্চুপ পাষাণ প্রতিমার ন্যয় হইয়া যাইল। ওই ঘরের বাসও যে তাহার উঠিবে, সে অবশ্য তাহার কল্পনাতেও ছিল না। প্রকৃত পক্ষে কল্পনা তো দূর, কোনো চিন্তাভাবনা করিবার মতো মস্তিষ্ক সক্ষম ছিল না তক্ষণ তাহার। অকস্মাৎ এক দিন সে দেখিল, পোঁটলা বাঁধিয়া দুইখানি থান সহ তাহাকে এই গৃহ হইতে বহিষ্কৃত হইতে হইয়াছে। এক গলা ঘোমটা টানিয়া সে পথের ধারে বসিয়া রহিল কিছুক্ষণ।

  আজিকাল ডাম্পটি অতীব সুভদ্র হইয়া যাইতেছে। আয়তনে বা আকারেই শুধু না, তাহার ব্যবহারেও এক পূর্ণাঙ্গ পুরুষের ছাপ পড়িয়াছে। হাম্পটি সন্তান লইয়া ব্যতিব্যস্ত থাকে। ডাম্পটি মধ্যে মধ্যেই উঁকি দিয়া পলায়ন করে। মানদার ভয়, পাছে সে হাম্পটির বাচ্চাটিকে আঘাত করে! নিকটে ঘেঁষিতে দেয় না। সদা সর্বদা পাহারার ব্যবস্থাও করা সম্ভব নহে। ফলে একসময় মানদা দেখিতে পায়, হাম্পটির শিশুর সহিত ডাম্পটি ক্রীড়া করিতেছে। শিশুটির সদ্য চক্ষু ফুটিয়াছে। সে সাক্ষাৎ বাঘের মাসী। গায়ে ডোরাকাটা দাগ লইয়াই জন্মিয়াছে। বেবো আসিয়া তাহাকে হাতের পাতায় তুলিয়া লইয়া মুখ দিয়া বিচিত্র আওয়াজ করে। না জানি শিশুটি কী বোঝে! সেও বেবোর দিকে জুলজুল করিয়া চাহিয়া থাকে। ভালোবাসার স্বাদ বুঝিতে কোনো প্রাণেরই অসুবিধা হয় না। একদিকে ডাম্পটি, অপরদিকে বেবো, শিশুর দুইখানি খেলার সাথী জুটিয়া গিয়াছে জন্মের তরে। উপরন্তু তাহার মাতৃদেবী, হাম্পটি সুন্দরী তো রহিয়াছিলেনই। বর্তমানে তিনি খাইয়া মাখিয়া পুনরায় হৃত জৌলুস ফিরিয়া পাইয়াছেন। তাহার চপলা মতিও ফিরিয়া আসিয়াছে। বেবো শিশুটির ফিরিঙ্গী নাম দিয়াছিল, কিট্টি। মানদা সেই নাম বাতিল করিয়া তাহাকে কুট্টু বলিয়া ডাকিয়া থাকে মধ্যে মধ্যে। এক মাসের অধিক হইয়াছে তাহার বয়স। ফলে টলোমলো পায়ে চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইত প্রাথমিক ভাবে। দুইদিন যাইতে না যাইতে সে ছুটিয়া বেড়ায়। মানদা তাহাকে কাছে লইয়া আদর আহ্লাদ না করিলেও সে মানদার ভক্ত হইয়াছে। তাহার পায়ে পায়ে ঘোরে সর্বদা। দুইচারিদিন তো সে হেঁশেলের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল। কোনোক্রমে তাহাকে তাড়াইয়াছে মানদা। হাম্পটিকে তিরস্কার করিয়াছে, ডাম্পটির দিকে বেলন ছুড়িয়াছে, তবেই উহারা হেঁশেলের দাওয়া হইতে পলায়ন করিয়াছে ছানা সমেত।

  মানদা কর্ম করিতে করিতে ভাবিতে থাকে। কুট্টুর পিতা উধাও হইয়াছে সেই কবেই। তাহাকে পিতৃস্নেহ দিয়া লালন করিতে ডাম্পটিকে কে শিখাইয়া দিল? সর্বদা কুট্টুকে পাহারা দেয় হাম্পটি। আর ডাম্পটি উহাদের দুইজনকে চোখে চোখে রাখে। যেন সে এক বিরাট পুরুষ, দুইখানি চপলা, চঞ্চলা সন্তান প্রতিপালনের ভার তাহার। যদিও ক্রীড়ার সময়ে তাহার ভিতরকার বালক স্বভাব ফিরিয়া আসে। সেই রূপ দেখিয়া মানদার শান্তি লাগে। এই ডাম্পটিকেই সে অধিক পছন্দ করিত। এখনকার ছদ্ম গাম্ভীর্য মাখা মুখখানি দেখিলে তাহার বেদনা জাগে। প্রকৃতির নিয়মানুসারে সে এখনও কিশোর। তাহার খেলিবার বয়স ফুরায় নাই। দায়িত্ব স্কন্ধে লইবার বয়সও আসে নাই। নেহাতই হাম্পটির অকালপক্বতার কারণে তাহারা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাইতেছে।

   পরমুহূর্তে মানদার সম্বিত ফেরে। নিয়ম কাহারা তৈয়ারী করিয়াছে? প্রকৃতিরও নিয়ম আছে বৈকি! সে নিয়ম করিয়া ঋতু অনুযায়ী ফুল ফুটাইয়া থাকে, বৃষ্টি নামাইয়া আনে, মেঘের আনয়ন হয়, শীত, বসন্ত, তাহারই সৃষ্টি। এ নিয়মে কোনো ফাঁকি নাই, তাহার ছুটিও নাই। জীবন সৃষ্টিও তাহার হস্তে, অন্তও তাহার হস্তে। কিন্তু যাপন? সেইখানে তাহার কোনো ভূমিকা নাই। মনুষ্য সংসার জীবনের যত নিয়মকানুন মনুষ্য কৃত। তাহাদের নিজস্ব সুবিধার্থে সৃষ্ট। ভাইবোনের সংজ্ঞা কে তৈয়ার করিয়াছে? পিতামাতা, মাতুল, দেবর…এই সব সম্পর্কের খতিয়ান প্রকৃতিতে নাই। নর ও নারী, এই দুইখানি সহজ সত্য জানে প্রকৃতি। তাহাদের ভিতর সেতু গড়ে তাহাদের সন্তান। এইভাবেই জগত সৃষ্টি করিয়াছেন তিনি। তবে আর হাম্পটিকে দোষ দিয়া লাভ কী? উহারা প্রকৃতির সহিত একাত্ম। উহাদের নিজস্ব নিয়মকানুন নাই। উহাদের ভাইবোন, মাতাপিতা নাই। হ্যাঁ, মাতৃত্ব আছে। মাতৃত্বের তাগিদ, সন্তানের সুরক্ষায় মাতার অধিক মনোযোগ প্রকৃতিই নির্ণয় করিয়া দিয়াছে। আক্ষরিক অর্থে, সন্তান নিজের পায়ে দাঁড়ালে প্রাণীকুলের মাতারা মনুষ্যজগতের মাতাদের ন্যয় সর্বক্ষণ উহাদের পিছে পড়িয়া থাকে না। সন্তানের জন্য প্রাণী-মাতাদের জীবন ও যাপন ক্ষয়িষ্ণু হইয়া আসে না। (ক্রমশ)

পর্ব ৪
পর্ব ৬
পর্ব ৪
পর্ব ৬

প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী