-৭-
শ্বশুরবাড়ি হইতে বিতাড়িত হইয়া মানদা সারাটা দিন পথেই কাটাইয়াছিল। পথ চলিতে চলিতে ক্লান্ত হইয়া বারংবার সে পথেই বসিয়া পড়ে। রাস্তার কল হইতে জল পান করিয়া ক্ষুধাতৃষ্ণার নিবৃত্তি ঘটায়। কোথায় যাইবে সে? দেখিতে দেখিতে বৈকাল হইয়া আসিল। সারাদিনের ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তায় সে রীতিমতো কাহিল হইয়া পড়িয়াছিল। এই শহরে তাহার কেহ কোথাও নাই। মাথা গুঁজিবার একটুকু আশ্রয় কেহ দিবে না তাহাকে। দুই চক্ষু দিয়া অবিরাম জল পড়িতে লাগিল তাহার। ‘ভগবান! এর চেয়ে মৃত্যু দিলে না কেন আমায়?’ অতঃপর ঈশ্বরের নাম লইতে না লইতেই তাহার মাথায় বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। এই তো! মন্দিরের দরোজা বন্ধ হয় নাই। সে আশেপাশের দোকানীকে জিজ্ঞাসা করিয়া কালীবাড়ির ঠিকানা জানিয়া লইল। ঠিকানা শুনিয়া সে কিছুই বুঝিল না যদিও। দোকানি সম্মুখের দিকে হাত বাড়াইয়া কহিল, ‘আর এক ক্রোশ সিধে গেলেই কালীবাড়ি পাবে’। আশ্বস্ত হইয়া সে তড়িঘড়ি পা চালাইল সর্বশক্তি দিয়া। দূর হইতে ঘণ্টার আওয়াজ কানে আসিলে সে নিশ্চিন্ত হইল। যেন ঐখানেই রহিয়াছে তাহার প্রকৃত ঘর! ঈশ্বর কি মুখ ফিরাইবেন? মা কালীর নাম জপিতে জপিতে সে মায়ের দোরে মাথা ঠুকিল। সন্ধ্যারতির সময় হইয়া আসিয়াছিল ততক্ষণে। চাতালে বসিয়া সে পরম ভক্তিভরে আরতি দেখিল। আরতি শেষে মায়ের ভোগ পাইল। সারাদিনের পরে দানাপানি পাইয়া শরীরে যুত আসিল তাহার। পুঁটুলি খুলিয়া ভাবিতেছিল একবার মা গঙ্গার কোলে ডুব দিয়া আসিবে কিনা! ঘাটে গিয়া বসিল খানিক। সারাদিনের শেষে গঙ্গার বাতাস পাইয়া ক্লান্ত, শ্রান্ত মানদার কক্ষণ যে চক্ষু মুদিয়া আসিয়াছে, সে নিজেও টের পায় নাই। আচম্বিতে ঝপাং শব্দ আর কোলাহলে চোখ খুলিয়া যাইল তাহার। ঠাওর করিয়া যা বুঝিল, একটি বালক বুঝি জলে পড়িয়া গেছে, আর তাহা লইয়াই শোরগোল ও হাহাকার উঠিয়াছে। কোনোরূপ অগ্রপশ্চাৎ না ভাবিয়া সে জলে ঝাঁপ দিল। ঘাটের আলোয় দেখিল একখানি কেশাবৃত মস্তক জলে ডুবিতেছে, উঠিতেছে। খপাৎ করিয়া চুলের মুঠি ধরিয়া লইল তাহার। তীব্র স্রোত পায়ের তলে, শরীর যেন ভাসাইয়া লইয়া যাইবে। এ তাহার পুষ্করিণীর স্থির জল নহে, সে অগ্রে ভাবিয়া দেখে নাই। শরীরের শেষ শক্তি দিয়া সে পাড়ের দিকে ফিরিতে লাগিল। নিজ শরীরের ভার, উপরন্তু আরেকটি সন্তরণ-অপটু শরীরের ভার বহিয়া ফিরিতে তাহার ছাতি ফাটিয়া যাইতেছিল। গবগব করিয়া সেই ঘোলা জল অজান্তেই কণ্ঠে প্রবেশ করিতেছিল, এই বুঝি তাহার শরীর শিথিল হইয়া তলাইয়া যায়… এই বুঝি চিরনিদ্রার দেশে চলিতেছে সে…সত্য সত্যই তাহার দুই চক্ষুর পাতা ভারী হইয়া নামিয়া আসিয়াছিল। এ পৃথিবীতে বাতাস নাই কেন? তাহার বক্ষ হইতে বাতাস কাড়িয়া লইবার জন্য বিধাতা এত তৎপর হইলেন কেন? ডুবিয়া যাইতে যাইতে সে জ্ঞান হারাইয়াছিল। জ্ঞান ফিরিতে দেখিল, পাড়ে শুইয়া আছে সে। আর তাহাকে ঘিরিয়া কয়েকটি উৎকণ্ঠিত মুখ। সে চোখ মেলিয়া দেখিল বলিয়া তাহার হাত ধরিয়া উঠাইয়া বসাইল সেই বালক, যে বালকের চুলের মুঠি ধরিয়া সে প্রাণ বাঁচাইয়াছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। তাহার পরিজনেরা মানদার পরিচয় জানিতে চাহিল। একজন গিন্নীসুলভ মহিলা তাহাকে নিরুত্তর দেখিয়া বলিল, ‘তুই এই শুকনো থানটা জড়িয়ে আয় আগে।’ তাঁহার আদেশ পালন করিবার পর সে গিন্নীমার সহিত চলিল।
যাইতে যাইতে মানদা ভাবিতেছিল, এ কোথায় চলিলাম আমি! এঁরা আমার কেহ না। ইহাদের গৃহে থাকিতে হইবে? সম্পূর্ণ অপরিচিত, অনাত্মীয় মানুষ এরা। কোথায় থাকে, জাতই বা কী ইহাদের কে জানে! এক বুক আশঙ্কা, উদ্বেগ আর দ্বিধার সহিত মানদা এই গৃহে প্রবেশ করিল। গিন্নীমার ঝিকে কিছু নির্দেশ প্রদান শুনিয়া সে বুঝিল, এই গৃহে তাহার মতো অনাত্মীয় আশ্রিতার সংখ্যা কম নহে। ঘরদোর এবং ঠাঁটবাঁট দেখিয়া মানদা আন্দাজ করিল ইহারা বনেদী পরিবার। খানিক নিশ্চিন্ত বোধ করিল সে। ঝিয়ের সহিত কক্ষে আসিয়া উপস্থিত হইল। যাওয়ার সময় ঝি বলিল, ‘এইখানেই থাকবে আজ থেকে। না পোষালে চলে যেতে পার অবশ্য। তবে তোমাকে দেখে তো ভালো ঘরের বেধবাই মনে হচ্চে। যাবে আর কোথায়? যাওয়ার জায়গা নেই বলেই তো এয়েচ!’ তক্তপোশে বসিয়া মানদা ঘাড় ঘুরাইয়া দেখিতেছিল ঘরখানি। নেহাতই চার দেওয়ালের একখানি বাহুল্যহীন ঘর। তথাপি ছাদ তো রহিয়াছে! ‘তবে তাই হোক ঈশ্বর! তোমারই কৃপায় আজ আমি এই ছাদের তলে আশ্রয় পেয়েছি। তোমার চরণে শত কোটি প্রণাম।’ ইতোমধ্যে ঝিয়ের মুখেই শুনিয়াছে ইহারা সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবার। অজাত-কুজাতের গৃহেও তাহাকে থাকিতে হইল না, ইহাও তাহার নিকট ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ।
মানদা এই পরিবারের সদস্যের প্রাণ বাঁচাইয়াছে বলিয়া তাহাকে ইহারা কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ঝিয়ের স্থান দেয় নাই। তদুপরি মানদা ব্রাহ্মণ কন্যা ও ব্রাহ্মণের বিধবা বলিয়া কিঞ্চিৎ প্রশ্রয় পাইয়া থাকে বাড়ির তরফ হইতে। যে গিন্নীমাকে মানদা ঘাটে দেখিয়াছিল, সেই হইলেন এ গৃহের বড়মা। তাঁহার কথা অমান্য করিবার সাহস কাহারও নাই। পুরুষ সদস্যরাও বড়মাকে সমীহ করিয়া চলেন। ধবধবে চালের ন্যায় গাত্রবর্ণ তাঁহার, চওড়া লালপেড়ে শাড়ি, এক গা গহনায় তিনি যেন সাক্ষাৎ প্রতিমা। তাঁহার স্বামী দীর্ঘদিন শয্যাগত। পারিবারিক সূত্রে ইহাদের পেশা যজমানি। অদ্যপি ইহাই তাহাদের রুজিরুটি। যদিও সুবিমলবাবু পাটের ব্যবসা করিতেন এককালে। যথেষ্ট অর্থ, প্রতিপত্তি হইয়াছিল তাঁহার সেই সূত্রে। ইদানীং তাঁহার ব্যবসার হাল নিম্নমুখী। ইহাদের বহির্বাটির সহিত অন্দরমহলের দূরত্ব রহিয়াছে। সদর দরোজা দিয়া প্রবেশ করিলে বার-বাড়ি। দু-তিনটি কামরা রহিয়াছে সেইখানে। বাহিরের মানুষজনের আনাগোনা সেই স্থলে। এমনকি হোমিওপ্যাথির শখ ছিল বড় কর্তার। গরীব-গুর্বোদের নাক্সভোমিকা আর টিনচার আয়োডিন বিলাইতেন তিনি সেই ঘরে বসিয়া। বহির্বাটির লাগোয়া উদ্যান শোভা পাইতেছে। আর সেই উদ্যানের শেষ প্রান্তে তাহাদের মতো আশ্রয়হীন ও ঝি-চাকরের বাসস্থান। উদ্যান শেষ হইলেই বসত। সেই স্থানে বাহিরের মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ধীরে ধীরে মানদা এই বাড়ির সদস্য হইয়া পড়িল। তাহাকে কেহ তিরস্কার করে না বটে, তবে আদরও যে তাহার খুব বেশি জোটে, এও বলা চলে না। আদর আহ্লাদ পাইবার অভ্যাস অবশ্য তাহার নাই, পাইলেই বরং তাহার অসোয়াস্তি হইত। বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া যায়। এই গৃহেরও বয়স বাড়িয়াছে। আগেকার জেল্লা নাই আর। বয়স বৃদ্ধি হইলে মানুষ যেরূপ জেল্লা হারায়, ইহারও সেইরূপ অবস্থা। বড়মা, বড় কর্তা দেহ রাখিয়াছেন বহুকাল হইয়াছে। সেই বালক এক্ষণে মধ্যবয়স্ক প্রায়। তাহারও সন্তানসন্ততি বড় হইয়াছে। সুবিমল বাবু মধ্যম সন্তান। বড়বাবু পরিমল। তাঁহার স্ত্রীই এক্ষণে গিন্নীমা হইয়া হেঁসেল ও সংসারের হাল ধরিয়াছেন। বড়মার যোগ্য উত্তরসূরি তিনি।
দেখিতে দেখিতে মানদারও বয়স বাড়িয়াছে। আশ্রয়হীন হইবার ভীতি আর তাহার নাই। যদিও সুবিমল বাবুর কল্যাণে সেই বিপদ তাহার সম্মুখে আসিয়াছিল যৌবনে। বড়মার সহায়তায় সে রক্ষা পাইয়াছে। ইষ্ট দেবতার নাম জপ করে মানদা দিনে দুইবার। জপের পূর্বে বড়মাকে পেন্নাম করিয়া লয় নিত্য। মধ্যে মধ্যে বড়মার কথা ভাবে সে। কী মানুষই না ছিলেন! এমন উদার মনস্ক মহিলা এমন এক রক্ষণশীল পরিবারের গিন্নী হইতে পারেন, তাহা মানদার ধারণার বাহিরে ছিল। একদা মানদা যে জাতের ভয় পাইয়াছিল, সেই জাত-কুলকে নস্যাৎ করিয়া দিতে দেখিয়াছিল বড়মাকে। আর বিস্ময়ে, ভয়ে বিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিল একদিন।
সেই ঘটনা স্মরণ করিলে স্থানু হইয়া যায় মানদা। তক্ষণ প্রায় তিন/চারি বৎসর এই গৃহে মানদার কাটিয়া গিয়াছে। প্রখর গ্রীষ্মকাল। প্রখর রৌদ্রে টুটিফাটা মাটিতে খালি পায়ে হাঁটিয়া দ্বিপ্রহরে এক শীর্ণকায় মানুষ উপস্থিত হইয়াছিল এই গৃহের সম্মুখে। তাহাকে দেখিয়া অসুস্থ বোধ হইতেছিল। ঝি চাকরেরা তাহাকে জলপানি প্রদান করিলেও সে জবুথবু হইয়া বসিয়াছিল। সকলেই ভাবিয়াছিল রৌদ্র পড়িলে সে প্রস্থান করিবে। অকস্মাৎ সে পথেই শুইয়া পড়িল কাঁপিতে কাঁপিতে। একজন তাহার নিকট গিয়া দেখিল, শরীরে বসন্তের গুটি উঠিয়াছে তাহার। ভিতর বাড়িতে সংবাদ পৌঁছিলে সভয়ে ছুটিয়া আসিল অন্যান্যরা। তাহাকে কীরূপে এই স্থান হইতে বিতাড়িত করা যায় সেই লইয়া আলাপ আলোচনা চলিতে থাকিল জোর কদমে। কেহ তাহার নিকট যাইয়া শুশ্রূষার চিন্তা করিল না। এইরূপে পড়িয়া থাকিলে হয়ত তাহার সেই রাত্রি অতিক্রম হইত কিনা সন্দেহ।
সহসা সেথায় বড়মা আসিয়া পড়িলেন। এক গলা ঘোমটা টানিয়া তিনি তাঁহার খাস চাকরকে ঐ লোকটিকে পাঁজাকোলা করিয়া ঘরে লইয়া আসিতে নির্দেশ দিলেন। সেই চাকর ইতস্তত করিলে তাহাকে ভর্ৎসনা করিলেন। রাগ দেখাইয়া উহাকে বলিলেন, ‘তুই মরলে তোর দেশে প্রচুর টাকা পাঠিয়ে দেব আমি, এমনিতেই বা কদিন বাঁচবি তুই? মরার আগে কিছু ভালো কাজ করে যা অন্তত!’ টাকার লোভেই হোক আর ভয়েই হোক, সেই চাকর লোকটিকে পাঁজাকোলা করিয়া গৃহে লইয়া আসিল। সারা রাত্রি তাহাকে জলপটি আর পাখার বাতাস করিলেন স্বয়ং বড়মা। লোকটির কী জাত তাহা চিন্তা করিলেন না একবারও। তাহাকে ছুঁইলে বসন্তের প্রাদুর্ভাব আসিতে পারে এ গৃহে, সেই ভয়ও পাইলেন না। সেই কক্ষের বাহিরে মানদাও রাত্রি জাগিয়া বসিয়াছিল। জল গরম করিয়া আনিতেছিল মধ্যে মধ্যে। কখনও বা বরফ জলও। ভয়ে, বিস্ময়ে আর শ্রদ্ধায় সেই রাত্রে মানদা বড়মাকে তাহার জীবদ্দশায় দেখা শ্রেষ্ঠ মানবীর স্থানে বসাইয়াছিল। যে স্থানে তিনি আজিও রহিয়াছেন। মানুষটি সুস্থ, সবল হইলে তবে এই গৃহ হইতে ছাড়া পাইয়াছিল। তাহার রাহাখরচ বাবদ তাহাকে কয়েক আনি দিতেও ভোলেন নাই বড়মা। সেই লোকই পরবর্তীকালে এই গৃহের সকলের বাউলদাদা হইয়া উঠিয়াছিল। এই পথে যাইলেই এই গৃহে এক দুইদিন কাটাইয়া যাইত। তাহার পিড়িং পিড়িং একতারা সারাক্ষণ চঞ্চল করিয়া তুলিত সকলকে। বড় মধুর গান বাঁধিত সে। কিন্তু হায়, সেই বাউলদাদাও নাই, সেই দিনও আর নাই। তবে মানদার জাত লইয়া সংস্কার, ভীতি উবিয়া গিয়াছে সেই রাতের পর হইতে। সেই ঘটনার অভিঘাতেই বাহির বাড়িতে পাত পাড়িয়া অনাথ-আতুড়দের ভোজন করাইবার দায়িত্ব সে নিজ স্কন্ধে লইয়াছিল।
আমার মন ময়ূরী ছিলি কুথা/ তরে চক্ষের তলে পাইলাম না/ তরে উজান বাইয়া পাইলাম না/ তরে গাঙের ধারে পাইলাম না রে…/ আমার মন ময়ূরী ছিলি কুথা/ ছিলি ছিলি এই হৃদয়ে/ ওই দিগরে বিরথাই খুঁজলাম তরে/ ওরে তুই আছিলি এই মনের ভিতর জানতাম না…/ তুই আছিলি প্রাণের ভিতর বুঝতাম না/ আকুল পরাণ ব্যাকুল হইল/ বুকে তরে ধরলাম না…/ আমার মন ময়ূরী ছিলি কুথা…
আকুল করা এই গানের সুরে দিগ্বিদিক আচ্ছন্ন হইয়া যাইতেছিল। আকাশের জলদরাশি সেই গান শুনিয়া আপন ভার আর সহিতে সক্ষম হইল না। ক্রন্দন ধ্বনির ন্যায় আছড়াইয়া পড়িল পৃথ্বীর বুকে। আর সেই যুবতী কী করিল? তাহার ঢলঢল মুখশ্রী জুড়ে তক্ষণ রৌদ্রবৃষ্টি খেলা করিতেছে। অকাল সাঁঝের মাঝে যেন সেই মুখখানিই কেবল আলো ছড়াইতেছে এই ধরায়। ধারা নামিয়াছে তাহারও চক্ষে, বুক ছাপাইয়া সেই অশ্রু মিশিতে চাহিতেছে আরেক বক্ষে। দুই বক্ষের মিলন হইলে আকাশ ভাঙিয়া বৃষ্টি আসিল। চারিদিক আচ্ছন্ন হইয়া যাইল বৃষ্টির তোড়ে। ঝাপসা হইয়া আসিল দুইটি শরীর… আর নিদ্রা ভঙ্গ হইল মানদার। তাহার বুকের ভিতর এক দুঃখের মোড়ক খুলিয়া সুখ আসিয়া গলিয়া পড়িতে লাগিল। অকারণ অশ্রু গড়াইয়া পড়িল চক্ষু হইতে। জানালা হইতে একফালি মেঘলা আকাশ মানদাকে ডাকিল হাতছানি দিয়া। কাপড় গুছাইয়া মানদা বাহিরে চলিল। তাহার আজ কী জানি হইয়াছে! হাঁসাহাঁসি গুলা আকুল হইয়া ডাকিতেছে দেখিয়া উহাদের সহিত ঘাটে চলিল রোজকার মতোই। অন্যদিনে সে উহাদের জলে নামিতে দেখিলেই সরিয়া পড়ে। আজ ঘাটেই বসিয়া রহিল নিশ্চুপ। যেন তাহার আজি কোনো কাজ নাই। অনন্ত কাল বসিয়া থাকিলেই তাহার চলিবে। সম্মুখে সন্তরণরত হাঁসগুলি তাহাকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া অবাক হইল যেন। তাহাদের বিস্ময়ের আরও কিছু বাকি ছিল তক্ষণও। মানদা পুকুরে নামিয়া পড়িল আচম্বিতে। আর তাহার পরে শুরু হইল তাহাদের যৌথ ক্রীড়া। এ এমনই এক দিন, সারাজীবনে এমন দিন কদাচিৎ আসিয়া থাকে।
কুট্টুর দৌরাত্ম্যে মানদা হিমশিম খাইয়া যায়। মাতৃদুগ্ধ পানের অতিরিক্তে সে মায়ের পাত হইতেও ভক্ষণ করিতে শিখিয়াছে। হাম্পটিও নেহাতই বালিকা, ফলে তাহাদের নিরন্তর ক্রীড়া চলিতে থাকে। যদিও ডাম্পটির সহিতই অধিক ভাবসাব কুট্টুর। সেই পেটুক কিশোর ডাম্পটি শিশুটির জন্য খাবার ফেলিয়া রাখে পাতে। তাহাকে সর্বদা আগলায় পিতার মতোই। মাতুলের সংজ্ঞা সে জানে নাই, প্রকৃতিগত অভিভাবক রূপে, পিতা সাজিয়া বসিয়াছে কুট্টুর। যে কুট্টুর জন্মের কারণে সে বীতরাগ হইয়াছিল! হায় রে মনের ধরনধারণ! মনুষ্যকুলই বা কী আর প্রাণীকুলই বা কী, মানসিক দোলাচলের ভিতরে পড়িয়া সমস্ত জীবকেই পড়িয়া দুলিতে হয় বুঝি এইভাবে! অনিত্যকে সর্বক্ষণের সঙ্গী করিয়াই জীবনের চলাচল সমাপ্ত হয়। ফোঁস করিয়া এক অহেতুক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মানদা নিজকর্মে মন দিল। হস্তের সহিত তাহার মনও কর্মে প্রবৃত্ত থাকে। তফাৎ এই—হস্তের কর্ম স্থির করে চারিপাশ কিন্তু মনের কর্ম স্থির করিবার বিধাতা মন-ই। সে স্বভাব স্বাধীন। তাহার কোনোরূপ কৈফিয়ত লাগে না। সুবিধাবাদীও বটে এই মন! কেহ তাহার চলনের নাড়িনক্ষত্র টের পায় না। এই কারণেই মানদা মুখ ফুটিয়া প্রকাশ করিবার চাইতে মনে মনে কথা বলায় অধিক আস্থা রাখিয়া থাকে। (ক্রমশ)
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী