-৮-
আজিকে দ্বিপ্রহরে পুনরায় সুবিমলবাবুর ঘর হইতে কলহের শব্দ আসিতে লাগিল। কানাঘুষায় শোনা যাইল, বিগত কয়েক বৎসর ধরিয়া সুবিমলবাবুর পাটের ব্যবসায় যে ক্ষতি হইয়াছিল, তাহারই জন্য তিনি শ্বশুরগৃহ হইতে ধারকর্জ করিয়াছিলেন। আর সেই ঋণের পরিমাণও নাকি কম নহে। আশা করিয়াছিলেন টাকায় টাকা বাড়িবে। তাহা তো হয় নাই, বরং ভরাডুবি হইয়াছে নাকি তাঁহার। ফিরিঙ্গীরা বাঙ্গালীর পাটের ব্যবসা কব্জা করিয়া লইয়াছে। তাহারা বেনিয়ার জাত, আর সুবিমলবাবু হইলেন পুরোহিত বংশের মানুষ। তাহাদের ফন্দির সহিত আঁটিয়া উঠিতে পারেন নাই। তাঁহার দজ্জাল স্ত্রী দুইবেলা টাকার লাগিয়া ঝগড়াঝাঁটি শুরু করিয়াছেন। যেনতেনপ্রকারেণ তাঁহার পিতার টাকা ফিরাইয়া না দিলে তিনি নাকি আত্মঘাতী হইবেন! এই হুমকির মুখে সুবিমলবাবু নেহাতই বিপর্যস্ত হওয়া ব্যতীত আর কিছুই করিয়া উঠিতে পারেন নাই।
মানদার সহিত সুবিমলবাবুর সাক্ষাৎ হয় না বলিলেই চলে। তবু আজই সুবিমলবাবুর সম্মুখে পড়িয়া যাইল মানদা। বাগানে তাহার প্রিয় গাছগুলির গোড়ায় জল সিঞ্চন করিতেছিল । আর ঠিক সেই সময়ে সুবিমলবাবু হন্তদন্ত হইয়া বাটি হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতেছিলেন। দিবানিদ্রা ঘুচিয়া গিয়াছে তাহার। চেহারায় ধ্বস নামিয়াছে যেন। মাথার পক্ক কেশ দেখিয়া তাঁহাকে বৃদ্ধ বলিয়া ভ্রম হইতে পারে। মানদার ভারি মায়া হইল। মানুষটিকে সে চেনে না। সেই সুবিমলবাবু আর নাই। তাঁহার মুখোমুখি হইয়া ঘোমটা টানিয়া মানদা কোনোক্রমে জিজ্ঞাসা করিল, ‘ভালো আছেন তো? শরীর ঠিক আছে?’ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে মানদার ঘোমটার দিকে তাকাইয়া সুবিমলবাবু কহিলেন, ‘আর শরীর! সে শরীরও নেই, মনও গেছে!’ এই বলিয়াই হনহন করিয়া হাঁটা দিলেন বাহিরের দিকে।
মানদার স্মরণে আসিল সেই প্রথম সাক্ষাতের কথা। এই গৃহে তক্ষণ তাহার মাসাধিক কাল অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। বড়মার অনুগ্রহে ও নিজ স্বভাবগুণে সে এই গৃহের প্রায় সদস্য হইয়া উঠিয়াছে। ব্রাহ্মণ বলিয়া তাহার পাকশালায়ও অবাধ প্রবেশ। মৈথিলী পাচকের রান্নার আয়োজন সে করিয়া দেয়। তাহার নিকটই সে প্রথম চায়ের আস্বাদ জানিয়াছিল। চা তৈয়ারির বিদ্যাও শিখিয়াছিল আগ্রহ লইয়া। মশলা বাটা, কুটনো কোটার নির্দেশও সে দেয় মধ্যে মধ্যেই। আর যে কর্মটি সে নিজেই বাছিয়া লইয়াছে, তাহা হইল, পরিবেশন। এ বাড়ির কর্তাদের দুপুর বা রাত্রের আহার পরিবেশনের দায়িত্ব সাধারণত বৌদের উপরই ন্যস্ত থাকে। কাজেই বাকি রহিল প্রাতরাশ ও চা। এই দুইয়ের দায়িত্ব মানদার। বাবুরা সাধারণত বারান্দায় আরামকেদারায় বসিয়া চা, জলখাবার সেবন করেন। একগলা ঘোমটা টানিয়া মানদা উহাদের তাহা পৌঁছাইয়া দিয়া আসে। সঙ্গে থাকে একজন ঝি। বড়কর্তা চা, জল খান নিজের কুঠুরি সংলগ্ন ঝুলবারান্দায় বসিয়া। সেই ঘরেও তাহার প্রবেশাধিকার দিয়াছেন বড়মা। বড়বাবুও তাহাকে স্নেহের চক্ষেই দেখেন। এযাবৎ মেজকর্তা ও সুবিমলবাবুর সহিত তাহার বাক্যালাপ হয় নাই। এইরকম এক দিনে তাহার সহিত ঝি ছিল না। বোধ করি সে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় মানদা একাই চা ও আহার লইয়া বারান্দায় গিয়াছিল। চায়ের পেয়ালা, পিরিচ টেবিলে রাখিবার সময় মানদা নারীসুলভ সচেতনতায় ঘোমটার আড়াল হইতেই বুঝিতেছিল, সুবিমলবাবু তাহাকে চক্ষু দিয়া একপ্রকার গিলিতেছেন। অসোয়াস্তি হইতেছিল তাহার, পলায়নে উদ্যত হইলেই সুবিমলবাবু তাহার সহিত বাক্যালাপ শুরু করিলেন। নিজের পায়ের আঙুলের দিকে তাকাইয়া জড়োসড়ো হইয়া মানদা নেহাতই সংক্ষিপ্ত ভাবে বাবুটির প্রশ্নের উত্তরে নিজের নাম পরিচয়, ইত্যাদি দিতেছিল। হাজার হউক, সে তো এ গৃহের আশ্রিতা বৈ কিছু নহে। মালিকপক্ষের সম্মুখে সে তো বেয়াদপি করিতে পারে না!
এইরূপে কিছুক্ষণ কাটিলে সুবিমল বাবু চারিদিকে চোখ বুলাইয়া তাহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মানদাকে হুকুম দিলেন ঘোমটা তুলিয়া মুখ দেখাইতে। ভীত, সন্ত্রস্ত মানদা থরথর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে কোনোক্রমে ঘোমটা উঠাইল। সম্মুখে দেখিল অত্যন্ত সুপুরুষ এক যুবা, নীল নয়ন মেলিয়া তাহাকে উৎসুক হইয়া দেখিতেছেন। বিস্ফারিত নেত্রে মানদা তাঁহার চক্ষের দিকে নিষ্পলক তাকাইয়া রহিল। কত না মুহূর্ত কাটিয়া যাইল ওই অবস্থায়…সম্বিত ফিরিলে মানদা অস্ফুটে কহিল, ‘বড়মা ডাকছেন আমায়’। তাহার পরে এক ছুটে সে চলিয়া আসিয়াছিল নিজ কামরায়। জল গড়াইয়া লইয়া আকণ্ঠ পান করিলে খানিকটা ধাতস্থ হইল সে। তাহার মন কহিতেছিল, কী সুন্দর ওই পুরুষ। বড়ই মোহময় তিনি। আর ওই একজোড়া নীল চক্ষু…আহা! বুকের ভিতর তখনও ধকধক শব্দ শুনিতে পাইতেছিল সে। আর অন্যদিকে সুবিমলবাবু ভাবিতেছিলেন, কে এই মেয়ে? নেহাতই ঝি-চাকর গোত্রের মেয়ে তো নহে। চেহারায় সম্ভ্রান্ত বংশীয় লক্ষণ সুস্পষ্ট, মুখের গড়ন লাবণ্যমণ্ডিত, শরীরে রহিয়াছে বিদ্যুৎ। বক্ষে হিল্লোল তুলিতে সক্ষম ওই শরীর। কামনায় আচ্ছন্ন হইয়া সুবিমল স্থির করিলেন, এই মেয়েকে ধরাশায়ী না করিলে তিনি স্থির হইতে পারিবেন না।
বুকের ধুকপুকুনি কমিলে মানদা তাহার প্রকৃত অবস্থানের কথা মাথায় আনিল। ‘হে ঈশ্বর! আমায় সুমতি দাও। কুপথে, বিপদে যেন না পড়ি। আশ্রয়হারা যেন না হতে হয়। আমায় শক্তি দাও প্রভু!’ সেই রাত্রে মানদা এক হাজার বার জপ করিল। দুধ খই ত্যাগ করিয়া উপবাসী হইল। কী যেন এক বিষম ভীতি তাহাকে গ্রাস করিয়াছে। নিজের তক্তপোষে অভুক্ত উদরে, অনিদ্রাকে জড়াইয়া শুইয়া রহিল চুপ করিয়া। মনে মনে স্থির করিল, ওই বাবুর নিকট সে আর যাইবে না। কাল প্রভাতেই সে জলখাবার পরিবেশনের ভার অন্য কাহারও হস্তে সমর্পন করিবে। ভোরের দিকে খানিক তন্দ্রা আসিল তাহার। স্বপ্নে দেখিল, এক তুষারাবৃত পর্বতের খাদ থেকে সে পা পিছলাইয়া পড়িয়া যাইতেছে। অত উচ্চ স্থান হইতে পড়িতে পড়িতে তাহার শরীর শূন্যে ভাসিয়া নামিতে থাকিল। যেন এক ছিন্ন পাতা হাওয়ার ঘূর্ণীতে ভর করিয়া পড়িয়া যাইতেছে। ভারহীন শরীর লইয়া তাহার কি নিজেকে পাখি বলিয়া ভ্রম হইল? নীচে খাদ নিকটবর্তী হইতেছে, এইবার…এইবার তাহার শরীর ছিন্নভিন্ন হইয়া যাইবে…আতঙ্কে চক্ষু মুদিয়া ফেলিল সে। ‘মাগো!’ দুই ঠোঁটের মধ্য দিয়া বাহির হইল তাহার সেই অস্ফুট স্বর। পতনোন্মুখ সে দেখিল, তাহার সেই ক্ষীণকায়া, চিরদুঃখী মাতা ক্রোড় পাতিয়া দিয়াছে। আর সে সেই মাতৃক্রোড়ে শিশুর আকার ধারণ করিয়া শূন্য হইতে খসিয়া পড়িল। আহ! কী শান্তি এই পৃথিবীতে! মানদার নিদ্রা ভঙ্গ হইল। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় তাহার মন শান্ত হইয়া আসিল। আর কোনো ভয় নাই! কোনো বিপদ তাহাকে স্পর্শ করিতে পারিবে না।
বাস্তব চিত্রটি যদ্যপি তত সহজ ছিল না। সুবিমল বাবু ছলে বলে কৌশলে মানদাকে ডাকিয়া লইতেন। বড়মাকে নালিশ করিলে যদি তাহার এ গৃহ হইতে বাস উঠিয়া যায়, সেই ভয়ে মানদা নিশ্চুপ থাকিত। তবে বুড়ি মোক্ষদা সুবিমলবাবুর চরিত্র সম্বন্ধে তাহাকে সাবধান করিয়াছিল। উহার প্রতি তাই তাহার কৃতজ্ঞতার সীমা নাই। প্রথম প্রথম সুবিমলবাবুর রূপ দেখিয়া, তাহার মনোরম, মধুর কথা শুনিয়া মানদারও যে শরীরে, মনে দোলা লাগে নাই—এ কথা বলিলে মিথ্যা বলা হইবে। সেদিন মোক্ষদা তাহাকে একলা পাইয়া ডাকিয়া বলিল, ‘ও মেয়ে! বেশ তো খেয়েমেখে রয়েছিস এ বাড়িতে। এই সোমত্থ বয়সে আবার কি রাস্তায় যেতে চাস? দেখে তো ভালো ঘরের মেয়ে বলেই মনে হয়। তাই বলছিলুম কিনা মেয়েমানুষের গায়ে একবার কালি লাগলে সে কালি জেবনেও মোছে না। বেধবা হলে তো আবার কথাই নেই। সুবিমলবাবুর অমন কত কত মেয়েমানুষের সনে আশনাই! তার গায়ে এক ছিঁটেও কালি লাগবে না। মরবি কিন্তু তুই। তাই সাবধান!’ সেই দিন মানদার টনক নড়িয়াছিল। শরীরের ক্ষুধা হইতে যে উদরের ক্ষুধা শত গুণে বেশি সেই বোধ তাহার জাগিয়াছিল। সে আর কিছুতেই ওই লোকের ফাঁদে পড়িয়া নিজের সর্বনাশ ডাকিয়া আনিবে না। (ক্রমশ)
প্রচ্ছদঃ সুমন মুখার্জী